#প্রেয়সী ♥️🥀
#লেখনীতেঃমুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ২০
৩৯.
” নিধি আপু, ছোট সাহেব আপনাকে ছাদে ডেকে পাঠিয়েছে।”
লিয়ার মুখে এটুকু শুনতেই এক দৌড়ে ছাদে এসে হাজির হলাম! কিন্তু রাহিয়ান ভাইয়ার দেখা নেই! আমাকে আসতে বলে এখনও নিজেই এসে পৌঁছাতে পারলেননা। আমি ছাদের এ-মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত চোখ বুলাচ্ছি। সকালের সতেজ হাওয়া এখনও বয়ে চলেছে মৃদুভাবে। সূর্য মামার প্রখর তাপ একটু কম বলেই অনুভব হচ্ছে। বসন্তের সময় এ যেন এক শান্তি। সূর্যের তাপ প্রখর থাকলেও অনুভবে তা সামান্যই বিরাজমান। সবটাই মিলেমিশে। হাল্কা ঠান্ডা সাথে হাল্কা গরম! আমার মনে হয় ছয়টা ঋতুর মধ্যে এই ঋতুটাই বেশি উপভোগ্য।
—-” উহুম উহুম!”
পেছন থেকে রাহিয়ান ভাইয়ার গলার স্বর পেতেই ঘুরে দাঁড়ালাম। মৃদু বাতাসে আমার খোলা চুল গুলো এলোমেলো ভাবে উড়তে লাগলে দু’হাতে চেপে কানের পাশে গুঁজে দিলাম। চোখে মুখে একটা সিরিয়াসনেসের ভাব আনলাম! শক্ত গলায় প্রশ্ন করলাম,
—-” আপনি সবটাই জানেন! অথচ আমাকে কিছুই বলেননি? সেদিন বাজারের মধ্যে বাবার সাথে ঠিক কি হয়েছিলো?”
রাহিয়ান ভাইয়া ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। শুঁকনো মুখে বলে উঠলেন,
—-” বলছি। তবে তার আগে তুমি আমাকে এটা বলো, আঙ্কেল কি অর্নব আই মিন হৃদ কে আগে থেকেই চিনতো? তুমি কি আঙ্কেলকে হৃদের কথা বলেছিলে?”
আমি শান্ত কন্ঠে বললাম,
—-” বাবা আমার বিষয় সবকিছুই জানে। ছোট থেকে বাবাই ছিলো আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড যাকে আমি কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই সবটা শেয়ার করতে পারতাম! ঠিক সেভাবেই হৃদের কথাও বাবাকে বলেছিলাম! বাবা সেদিন ভালো মন্দ কিছুই বলেনি। শুধু বলেছিলো, যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে যেন ভালো করে ভেবে নেই!”
—-” হৃদকে আঙ্কেল কখনো দেখেনি?”
—-” প্রথমে তো কখনোই দেখতে চায়নি তবে বাবা অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগেই হঠাৎ করে একদিন এসে হৃদকে দেখতে চাইলো। আমি ঐ তখনই বাবাকে প্রথম হৃদের ছবি দেখাই!”
—-” আঙ্কেল হঠাৎ যখন হৃদের ছবি দেখতে চাইলেন তুমি কারন জানতে চাও নি?”
—-” উঁহু! আমি ভেবেছিলাম হয়তো এমনিই…”
—-” সেদিন বাজারের মধ্যে আঙ্কেলের সাথে কিছুই হয়নি! হয়েছিলো বাজারের শেষ দিকের একটা হোটেলের ভেতর।”
আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাজারের শেষ দিকে হোটেলের ভেতর! মানে?
—-” কিন্তু বাবা সেদিকে হঠাৎ ঐ হোটেলে কখন গেলো আর কেনই বা গিয়েছিলো? আমাকে তো সেরকম কিছুই বলে যায়নি! উল্টে আমাকে তো রোডের মোড়ে সিএনজি ঠিক করতে পাঠালো।”
—-” হু গিয়েছিলো কারন আঙ্কেল সেই হোটেলের পাশের ছোট একটা মুদি দোকান থেকে সবসময় ছোট ছোট দরকারি কিছু জিনিস কিনে নিয়ে যেতো। যখনই কিছুর দরকার হতো তখনই ওখানে যেতো। আর আমার মনে হয় যেদিন আঙ্কেল তোমার থেকে হৃদের ছবি দেখতে চেয়েছিলো সেদিন ঐ হোটেলে হৃদকে কোনো মেয়ে নিয়ে যেতে দেখেছিলো!”
—-” কিন্তু বাবা তার আগে তো কখনো হৃদের ছবি দেখেনি তবে হঠাৎ করে হৃদকে দেখতেই কি করে বুঝলো ওটাই হৃদ?”
—-” ‘নির্মলা করদি’ হোটেলটার নাম! হোটেলের সামনেই ‘Afoot’ নামের একটা রেস্টুরেন্ট আছে। বেশ নামকরা। আঙ্কেল সেদিনের ঠিক দু’দিন আগে সেই রেস্টুরেন্টে তার এক অফিস কলিগের সাথে গিয়েছিলেন লাঞ্চ করতে। তখন খেতে বসে তার কানে বারবার তোমার নাম নিয়ে কিছু অপ্রত্যাশিত কথা আসে। আঙ্কেল কান উঁচিয়ে কথা গুলো শুনতেই….”
—-” কি ছিলো কথা গুলো?”
আমার প্রশ্নে থেমে গেলেন রাহিয়ান ভাই। আমার দিকে তাকিয়ে ভাবুক কন্ঠে বললেন,
—-” কিছু বাজে কথা! আই থিংক সেটা তোমার না জানলেও চলবে!”
—-” আমি জানতে চাই প্লিজ…”
—-” হৃদ তোমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিলো ওর প্লানে! আজ যেখানে ও…. ও অন্য মেয়েদের নিয়ে যায় সেখানে তোমাকে…. আই হোপ তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাচ্ছি?”
কি বুঝবো ঠিক বুঝতে পারছিনা! আমার অগোচরে এতো কিছু ঘটে গেলো? অথচ আমি এর এক চুলও টের পাইনি!
—-” ত..তারপর?”
কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম। উনি আমার দিকে এক ধাপ এগোতে নিয়েও এগোলেন না! নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
—-” আর ইউ ওকে?”
আমি ঢোক গিললাম। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললাম,
—-” হু, তা..তারপর কি হলো?”
—-” তারপর… তারপর আঙ্কেল হৃদকে ফলো করে! ফলো করতে গিয়ে দেখে সে হোটেলের মেয়েদের সাথে.. যাই হোক! সেদিনও আঙ্কেল হৃদকে একটা মেয়েকে নিয়ে সেখানে যেতে দেখে। তাই আঙ্কেল ওর পিছু নেয়। আর আঙ্কেল যখন ওর পিছু নেয় তখন আমিও ঐ হোটেলের সামনের রোড থেকে কাঁচা বাজারেই ঢুকছিলাম! মায়ের জন্য কাঁচা আম নিতে! মা বাড়ির কোনো কাজের লোককে বাজারে পাঠাবে না কারন তারা নাকি তার জন্য ভালো আম নিতেই পারবেনা! তাই জেদ করে সবসময় আমাকেই পাঠায়। আর আমিও মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে চলে আসি! সেদিনও এলাম৷ গাড়ি রেখে এলাম আবিরের বাসার সামনে কারন এদিকের সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি আসবেনা! আমি বাজারের ভেতর ঢুকতেই হঠাৎ আঙ্কেলকে চোখে পড়লো। হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছেন কোথাও একটা।। আঙ্কেলকে দেখতেই যেন এক ধাক্কায় আমার ছোটবেলাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মায়ের থেকে আঙ্কেলের ঐ সময়কার ছবি দেখেছিলাম অনেকবার। চেহারায় অনেকটাই মিল খাচ্ছিলো! আর তাকে দেখতেই আমার শুধু আঙ্কেলের মুখটাই ভাসতে লাগলো। মনে হলো উনার সাথে দু’মিনিট কথা বলতে পারলে হয়তো ব্যাপার টা ক্লিয়ার করতে পারবো। তাই আমিও উনার পিছু নেই। একপর্যায়ে আমরা দুজনেই ঐ হোটেলের মধ্যে প্রবেশ করি। হৃদ তখন রুম ঠিক করছিলো। আঙ্কেল ওকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ায়। আচমকা কেউ সামনে এসে দাঁড়াতে হৃদ ভড়কে যায়। রেগে গিয়ে আঙ্কেলের কমন সেন্স নিয়ে পাঁচ কথা শুনিয়েও দেয়। আঙ্কেল কিছু বলেনি কেবল মনে মনে রা/গ পুষছিল! কিন্তু হঠাৎ আঙ্কেল কিছু না বলেই হৃদের কলার চেপে ধরে মা/র/তে শুরু করে। আমি এতক্ষণ সবটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলেও তখন দৌড়ে গেলাম তাকে ছাড়াতে। তবে আমি দৌড়ে যেতে যেতে হৃদ আঙ্কেলকে ঘুরিয়ে নীচে ফেলে দেয়। তারপর শুরু হয় ধস্তাধস্তি। হৃদ আঙ্কেলের পাঁজরের হাড়ে কয়েকটা লাথিও মা//রে। আঙ্কেল ব্যাথা সইতে না পেরে গোঙ্গাতে থাকে কেবল। আমি আঙ্কেলকে গিয়ে ধরতেই আশেপাশের লোকজন এসে হৃদকে ধরে ফেলে। আঙ্কেল নীচে পড়েই তোমার ব্যাপারে হৃদকে সাবধান করতে থাকে! কিন্তু হৃদ আর ওখানে না থেকে চলে যায়। আমি আঙ্কেলকে হসপিটালে নিতে চাইলে আঙ্কেল তোমার কথা বলে কেঁদে ফেলে! আমি আঙ্কেলের কাছে একজন অপরিচিত হলেও আঙ্কেল আমায় সব কিছু ডিটেইলস বলতে থাকে। তুমি রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছো বলে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে আসতে বলে। আমিও উনার কথা মেনে নিয়ে তোমার কাছেই আঙ্কেলকে নিয়ে আসছিলাম। আমি তখনও জানতাম না তুমি আঙ্কেলের মেয়ে। হঠাৎ আঙ্কেলের শরীর অবস হতে লাগে। বুঝলাম আঙ্কেলের স্ট্রোক এসেছে। তোমার কাছে আসতে আসতে আঙ্কেল প্রায় সেন্স হারাচ্ছিলেন। তবুও সে তোমাকে দেখতেই ডেকে উঠেছিলো। আর তুমি তো আঙ্কেলকে ঐ অবস্থায় দেখে পুরো ভে/ঙে/ পরেছিলে! আর আমি যদি তখন আঙ্কেলের কন্ডিশন তোমাকে বলতাম তাহলে তুমি আরও বেশি ভে/ঙে পরতে। তাই তোমায় মিথ্যে বুঝ দিয়ে বলেছিলাম আঙ্কেলের বিপি লো হয়ে গিয়েছে। হৃদকে আমি সেদিনই ওর যথাযোগ্য শা/স্তি দিতে পারতাম কিন্তু দেইনি। কারন আমি চেয়েছিলাম তুমি আগে সবটা জানো আর তারপর ওর ব্যাবস্থা করা যাবে। তোমাকে প্ল্যান করেই সবটা জানানো হয়েছে। আর কাল তুমি সবটা জেনেও গিয়েছো কিন্তু আসল সময় এসে তুমি সেন্স হারালে। তোমার জন্যই কাল হৃদ প্রানে বেঁচে গেলো। নয়তো ওর মৃ/ত্যু….”
—-” হৃদ!!(কান্নাজড়িত কন্ঠে) ও আমার বাবার সাথে…”
আমার পা জোড়া ভে/ঙে আসতেই ফ্লোরের উপর ধপ করে বসে পড়লাম! ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠলো।পারলাম না আর নিজেকে সামলাতে! দু’হাতে মুখ চেপে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম!
—-” বাবা… বাবা আ’ইম সরি বাবা! আ’ইম সরি! আজ আমার জন্যই তোমার এই অবস্থা হয়েছে। তোমার এই অবস্থার জন্য শুধু আমি দায়ী! যেখানে তোমাকে সবসময় আগলে রেখে এসেছি সেখানে আজ তোমার সবচেয়ে বড় ক্ষ/তি টা আমার জন্যই হয়ে গেলো বাবা… আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা! আমাকে ক্ষমা করে দাও… বাবা!”(কাঁদতে কাঁদতে)
এই পৃথিবীতে যদি সবচেয়ে বড় অভাগী কেউ হয়ে থাকে সেটা শুধুই আমি। লোকে হয়তো ঠিকই বলে! আমি হলাম অপয়া,অলক্ষী! জন্মের সময় মাকে খেয়েই কেবল শান্ত হইনি আমি! আবার বাবাকেও খেতে বসেছি! ছিহ্.. ঘৃ/না হচ্ছে নিজের প্রতি। চরম ঘৃ/না হচ্ছে।
কাঁধের উপর কারোর ছোঁয়া পেতেই ফোপাঁতে ফোঁপাতে মুখ তুললাম। রাহিয়ান ভাইয়া কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কিছু একটা ভাবছেন তিনি! কিন্তু সেটা জানার আমার বিন্দু মাত্র আক্ষেপ হলো না। আমি কেবল মুক্তর ন্যায় চোখের জল ঝরিয়েই চলেছি।
উনি আচমকাই আমার দু’বাহু চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি উঠতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে উনার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। উনার দৃষ্টি কঠিন। আমি ভীত হয়ে উনার শার্ট ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যেতে নিলেই আরও শক্ত করে আমাকে চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এক তো কাঁদছি মনের ক/ষ্টে তার উপর উনার এই বিহেভিয়ার সত্যি বড় আশ্চর্যজনক।
আমি কান্না ভুলে স্রেফ ফোপাঁতে লাগলাম। বোধকরি উনি এখন মুখ খুলবেন। হ্যাঁ আমার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়েই মুখ খুললেন তিনি। কঠিন স্বরে প্রথমেই এক রাম ধমক মা/র/লে/ন আমায়। আমি সটান হয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললাম। উনি আমার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন,
—-” অনেক হয়েছে তোমার কান্নাকাটি। তুমি কি পেয়েছো বলোতো? সময় নেই ক্ষন নেই চান্স পেলেই হলো শুধু কেঁদেই যাচ্ছো আর কেঁদেই যাচ্ছো! অনেক সহ্য করেছি তোমার কান্না, আর না। তোমায় যেন আর কখনো কাঁদতে না দেখি নিধি! একদম কাঁদবে না তুমি! তুমি জানো? তুমি যখন কাঁদো তখন আমার….”
একটুকু বলেই ঢোক গিললেন তিনি। আমার টনক নড়লো। আমি যখন কাঁদি তখন উনার… কি? আমার দুঃখ ভুলেই ভালো মনে প্রশ্ন টা করতে নিচ্ছিলাম তাকে কিন্তু তার আর সুযোগ হলো না। পূনরায় সে তার কঠিন রূপটা ব্যক্ত করে বলে উঠলেন,
—-” তোমার কারনে আঙ্কেলের কিচ্ছু হয়নি এটা সবসময় মাথায় রাখবে। তুমি আঙ্কেলের ছোট্ট একটা প্রাণভোমরা নিধি। যে কিনা আঙ্কেলকে নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। তোমায় দেখে আঙ্কেল নতুন করে বাঁচার শক্তি পায় নিধি। ভালো থাকতে চায়। আর আফসোস করে কি বলে জানো? যদি তার মেয়েটাকে সে আরও একশ বছর আগলে রাখতে পারতো! আঙ্কেল তোমার জন্য বেঁচে আছে। শুধু এবং শুধুই তোমার জন্য। আর সেই তুমি অকারনেই এভাবে কাঁদতে পারো না। তুমি কাঁদবে না! শুনেছো তুমি? আমি বলেছি তুমি কাঁদবে না। আর কখনোই কাঁদবে না। তুমি কাঁদলে যে তোমার বাবা ভালো থাকবেনা।”
আমি ঠোঁট উল্টে আবারও কেঁদে উঠলাম। যে যাই বলুক না কেন? আমার জন্যই তো বাবার আজ এই দশা!
৪০.
বাবার অপারেশন সাকসেসফুল। নীচ থেকে খবরটা শুনেই টলমল চোখে চলে এলাম নিজের রুমে। রাহিয়ান ভাইয়া আঁড়চোখে তাকিয়ে ছিলেন অনেক্ষন। সকালে উনার এতো বুঝানোর পরেও আমি কাঁদছি সেই ভেবে সে ভীষণ অবাক। বাবার অপারেশন সাকসেসফুল তাতেও আবার কিসের কান্না? এটা তো সুখের খবর। তবে সুখে কেন মানুষকে কাঁদতে হবে? হবেনাই বা কেন? হওয়া তো উচিৎ। কান্না এমন এক জিনিস যেটা সব জায়গাতেই খাটে। মানুষ যখন দুঃখে কাঁদে তখন সে ঠোঁট উল্টে, থুতনীতে অসংখ্য ভাজ ফেলে তবে কাঁদে। আর যখন মানুষ সুখে কাঁদে তখন কিন্তু ঠোঁট উল্টে নয় বরং হাসতে হাসতে কাঁদে। ঠিক এখন যেমন আমি কাঁদছি। সুখের কান্না কাঁদছি।
—-” নিধি আপু আসবো?”
লিয়ার গলা পেয়ে দু’হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে পেছনে তাকালাম! দরজার সামনে ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে লিয়া। আমি হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম। “ভেতরে এসো” বলাতেই লিয়াও হাসি মুখে ভেতরে ঢুকে এলো। ট্রে তে খাবারের বদলে কয়েক টুকরো কাগজ পড়ে আছে। আমি কৌতুহল নিয়ে লিয়ার দিকে তাকাতেই লিয়া মৃদু হেসে বলল,
—-” ডিনারের মেনু লিস্ট। বাসা আজ পুরো ফাঁকা। কাকাকে বাজারে পাঠিয়ে এগুলো আনাতে হবে। আর তারপর রান্না হবে।”
আমি অবাক চোখে তাকালাম। ব্যাপার তো বেশ হাইফাই।
—-” আচ্ছা এই ব্যাপার। তা এগুলো নিয়ে আমার কাছে হঠাৎ? কিছু বলবে?”
—-” হ্যাঁ বলবো। বউমনি আপনার কাছে পাঠালো আপনার কোনো পছন্দের খাবারের নাম থাকলে বলুন সেই অনুযায়ী সব কিছু আনানো হবে আর তারপরে রান্না হবে।”
লিয়ার কথা শুনে আমার ভ্যাবলাকান্ত হাসি দিলাম! ওর প্রস্তাব নাকচ করে বললাম,
—-” নিধি এজ অলওয়েজ সিম্পল। খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমার বরাবরই আগ্রহ বেশ কম। তুমি বউমনিকে বলো বউমনি যেন তার পছন্দ মতোই কিছু একটা বলে দেয়। আমি সেটাই খাবো।”
—-” কেন? বলুন না আপনি? দেখুন এখানে কিন্তু সবারটাই লেখা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু আপনিই…”
—-” আমার এখন কোনো খাবারের আইটেম মাথায় আসছেনা গো। তুমি বউমনিকেই বলো না প্লিজ?”
লিয়া আর কথা বাড়ালো না। হতাশ চোখে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে চলে গেলো। আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে সিনিয়রদের এসাইনমেন্ট গুলো নিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। অনেক দিন হয়ে গিয়েছে তারা আমার বাবার উছিলায় এগুলো এখনো চাননি! আর আমি যদি আজও এগুলো কমপ্লিট না করি তবে কবে জানি অরিন আপু দৌড়ে এসে আমাকে চ্যাং-দোলা করে নিয়ে যায়!!
৬-টা এসাইনমেন্টের এতো মোটা ফাইল দেখে বেশি কিছুনা নদীর পানিতে ভেসে যেতে ইচ্ছে করলো। এতগুলো এসাইনমেন্ট আমি একা.. কি করে.. কি করবো? এগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়াতেই তো মনে হচ্ছে হেলতে দুলতে নীচে পড়ে যাচ্ছি। রব! হেল্প মি! বিসমিল্লাহ বলে প্রথম এসাইনমেন্ট টা সামনে রাখলাম।কেন জানিনা মনে হচ্ছে বিশাল বিশাল গোলমাল পাকাবো এই এসাইনমেন্টে। গোলমাল পাকানোটা কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু না ভায়া বরং গোলমাল না পাকানোটাই অস্বাভাবিক! ফাইলটার কোনায় কোনায় চোখ বুলালাম। উপরে নামটা দেখতেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। “রাহিয়ান রাফিদ”। খেয়েছে.. গোলমাল পাকতে প্রথমে নিজেই উঠে এলো?
নামটায় আরেকবার চোখ বুলালাম। মুখ বাকিয়ে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে আপনাআপনি বলে উঠলাম,—-” নাইস নেইম!” নিজের এহেম কান্ডে এবার নিজেই বেশ বিরক্ত হচ্ছি! এটা কি করছি আমি? অযথা সময় ন/ষ্ট। দ্রুত ফাইলটা খুলে প্রশ্নপ্রত্রটা হাতে নিয়ে যেন হ্যাং হয়ে গেলাম। বাপের কালে এমন প্রশ্ন দেখিনি! আর এখন নাকি এগুলো আমাকে সল্ভ করতে হবে! মানে ভাবা যায়? ভাবতেই মাথা ঘুরিয়ে অন্ধকার দেখছি চোখে! চোখের মধ্যে আচমকাই রাজ্যের ঘুম যেন খসে খসে পড়তে লাগলো। চোখ দুটো সরু করে সামনের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম নিজেকে। ঘুমটা কি ঢব না ভ/য়? ভ/য় থেকেই এতো ঘুমাসছে?হে রব!
উফফ নিধি তুই একটু বেশিই চিন্তা করে ফেলছিস! ঘুমা তো। রাতে উঠে না হয় এগুলা কমপ্লিট করে দিবি! হিহি আমার এতো মাল্টিবুদ্ধি আগে জানতাম না তো! কথা গুলো ভাবতেই ভাবতেই হাই তুললাম। উনার ফাইলটা দু’হাতে চেপে ধরেই শুয়ে পড়লাম। আর শুতেই ঘুম। এই বুঝি জীবনের প্রথম পা/প। জানিনা এর পরিনতি কতটা
ভ/য়ং/ক/র হতে যাচ্ছে।
#চলবে____________________
#প্রেয়সী ♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ২১
৪১.
—-” নিধি মা? কিরে.. এ বেলায় হঠাৎ ঘুমচ্ছিস? শরীর খারাপ মা? উঠ তো একটু? আমায় কফি দে! না কফি না! আজ বরং আমায় পাস্তা করে খাওয়া। বাপ বেটিতে বেশ আয়েস করে খাবো আজ। কিরে উঠলি?”
বাবার অগোছালো কথা গুলো ধীরেধীরে মিলিয়ে যেতেই ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে উঠে পড়লাম। মাথার মধ্যে টনটন করে ব্যা/থা করে উঠলো। দু’হাতে শক্ত করে মাথাটা চেপে ধরতেই আবারও বাবার কন্ঠ পেলাম যেন। ঝটপট চোখ খুলে তাকাতেই সব কিছু ফাঁকা বলে অনুভব হলো। সেই সাথে নি/স্ত/ব্ধ পরিবেশ। রাত হয়ে গিয়েছে অনেক্ষন। প্রহর ক’টা কাটলো ঠিক বুঝতে পারছিনা। এ-ঘরে কি কেউ এসেছিলো? বিছানা ছেড়ে নামতেই কিছুতে খোঁচা খেয়ে কাতর কন্ঠে গোঙ্গিয়ে উঠলাম। রাফিদ ভাইয়ার এসাইনমেন্টের বড় ফাইলটা। তার সুউচ্চ মাথাতে হাতের চাপ পড়তেই সেও পাল্টা আ/ঘাত করলো আমার হাতের কব্জিতে। কপাল কুঁচকে সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত ডলতে ডলতেই হঠাৎ আমার ভেতরটা ধক করে উঠলো।
‘এসাইনমেন্ট গুলো যে সব বাকি’ মনে হতেই মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। আমি যে সব গুলো ইনকমপ্লিট রেখেই… আচ্ছা ক’টা বাজে? কাল ভেবেছিলাম ভার্সিটি যাবো! এই ম/র/ন দশার জন্য তো মনে হচ্ছে আগামী এক মাসেও ভার্সিটিতে পা রাখা সম্ভব হবেনা! দৌড়ে উঠে গেলাম ওয়াসরুমে। কোনো রকমের চোখে মুখে পানি ছিটিয়েই বের হয়ে আসলাম। মানবতার খাতিরে হলেও এগুলো আমায় কমপ্লিট করতে হবে! এতোদিন তাদের এসাইনমেন্ট গুলো আঁটকে রেখেও যদি কমপ্লিট না করে দেই তবে উনারা আমায় কথা শোনাতে বা আদারস্ পানিশমেন্ট দিতে দু-বারও ভাববেনা! রাহিয়ান ভাইয়া হয়তো তার কাজিন হওয়ার সুবাদে ছেড়েও দিতে পারে কিন্তু বাকিরা? মনে মনে নিজেকে বকা দিয়েই রাহিয়ান ভাইয়ার এসাইনমেন্ট টা নিয়ে বসলাম। দরকার হলে না হয় রিম্মি আপুর থেকে হেল্প চেয়ে নিবো। প্রশ্নপত্র টা কই জানি ছি….! অ্যা…. এগুলো কি?
পুরো এসাইনমেন্ট কমপ্লিট!! হাউ ইজ দিস পসিবল! মাম্মিইইইই….. ফাইলটা ফেলে দিয়ে সিঁটিয়ে গেলাম দেয়ালের সাথে। এ-কি ভূ/তু/ড়ে কান্ড! এগুলো তো সব ইনকমপ্লিট ছিলো পাপ্পাজি! তবে কমপ্লিট হলো কি করে? আআআআআ……. (গলা ফাটিয়ে দিলাম এক চিৎকার) আমার মাথা ঘুরছে। এখনি আমি জ্ঞান হারাবো। হেইয়ো… আমি জ্ঞান হারাবো ম/রে যাবো বাঁচাতে পারবে না কেউ!
আমার চিৎকারের উৎস খুঁজেই সবাই এক এক করে হাজির হলো আমার রুমে। বউমনি আর রিম্মি আপু আমাকে ভ;য়ের দরুন কাঁপা-কাঁপি করতে দেখে দৌড়ে এসে ধরলো। ‘কি হয়েছে, কি হয়েছে’ জিজ্ঞেস করতে করতে নিজেরাও হ/য়রান হচ্ছে আমাকেও হ/য়রান করছে। নীচে এসাইনমেন্টের ফাইলগুলো পড়ে থাকতে দেখে ফাহিম ভাইয়া এসে সব গুলো তুলে বেডের উপর রেখে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল,
—-” পিচ্চি? কি রে কি হয়েছে? চেঁচালি কেন? ভ/য় পেয়েছিস? আর এগুলো কি? কার এসাইনমেন্ট?”
লিয়া জল ভর্তি গ্লাস এনে আমার সামনে ধরে ভী/ত কন্ঠে বলল,
—-” আপু পানিটা খেয়ে নিন। খেয়ে নিন।”
বউমনি লিয়ার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরতেই আমি চোখ বুঁজে ঢকঢক করে সব পানি গিলে খেলাম। আহ্ শান্তি। বড় করে বার কয়েক দম ফেলে সবার দিকে চোখ বুলালাম। সবার মুখই কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু কথা হলো আমি কি জবাব দিবো?
রিম্মি আপু আমার হাত ধরে বেডের উপর বসিয়ে দিলো। বউমনি লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল ফ্যানের পাওয়ারটা আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিতে। লিয়া মাথা নেড়ে ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে আবারও এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। ফাহিম ভাইয়া এসাইনমেন্টের ফাইল গুলো গোছাতে গোছাতে বলল,
—-” এগুলো তো ভাইয়াদের এসাইনমেন্ট মনে হচ্ছে। পিচ্চি? এগুলো তোর রুমে… মানে তোর কাছে কি করে?”
আমি জবাব দিলাম না। এদের কারোর আগ্রহই আমার গায়ে লাগছে না। আমি তো ভাবছি অন্য কথা। এই ইনকমপ্লিট ফাইল গুলো কমপ্লিট কি করে হলো আর এই টুকু সময়ের ব্যবধানেই বা কি করে সম্ভব?
—-” বউমনি? কি হয়েছে! কে চিৎকার করলো? কার কি হয়েছে?”
হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন রাহিয়ান। আমি চোখ তুলে তাকাতে তাকাতে উনি আমার সামনে এসে হাজির হলেন। বউমনি সবার মুখ চেয়ে উনার দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
—-” নিধি!… ও বোধহয় কিছু দেখে ভ/য় পেয়েছে! দেখছো না এখনো কেমন ঘাবড়ে আছে মেয়েটা?”
—-” নিধি? আর ইউ ওকে?”
আমি ঢোক গিললাম। ওকে আর কি? কিছুই ওকে নয়!
—-” ভ/য় পেয়েছো? কি দেখেছো?”
আমি ফুস করে নিঃশ্বাস ফেললাম। ডানে বামে মাথা নেড়ে বললাম,
—-” কিছু না। আমি ঠিকাছি ভাইয়া।”
আমার কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো ফাহিম ভাইয়া। আমাকে খোঁচা মা/রা/র উদ্দেশ্য বলল,
—-” হ্যাঁ রে পিচ্চি? তোর কি আমাদের কাউকে নজরেই পড়ছে না? না মানে এতক্ষণ ধরে যে আমরা বারবার জিজ্ঞেস করেই চলেছি তোর কি হয়েছে, কি হয়েছে? তুই কোনো জবাবই দিলিনা! অথচ ভাইয়া এসে জিজ্ঞেস করতেই তুই সুন্দর করে বলে দিলি? মানে, হলো কিছু এটা? আমাদের কোনো পাত্তাই দিলিনা তুই!”
বউমনি হেসে ফেললো ফাহিম ভাইয়ার কথায়। রিম্মি আপু হাসতে নিয়েও হাসলো না রাহিয়ান ভাইয়ার উপস্থিতির ভ/য়ে। আমি লজ্জায় পড়লাম। ভারী অদ্ভুত কান্ড করে বসলাম। সত্যিই তো এতোক্ষণ ধরে এতগুলো মানুষের প্রশ্নের কোনো জবাবই দিলাম না!
রাহিয়ান ভাইয়া গম্ভীর মুখে বললেন,
—-” চুপ কর তুই। নিধি?”
রাহিয়ান ভাইয়ার গম্ভীর স্বরে ঢোক গিললেন ফাহিম ভাইয়া। রাহিয়ান ভাইয়া আবারও বলে উঠলেন,
—-” কি হয়েছে ঠিকঠাক বলো? এনি প্রবলেম?”
আমি করুন চাহনি দিয়ে না সূচক মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ না! নো প্রবলেম। আর হলেও তাকে জানানো পসিবল না। আর কথা বাড়ালেন না রাহিয়ান ভাইয়া। চুপচাপ বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। উনার ভয়ে টটস্থ সবাই হঠাৎই হু হা করে হেসে উঠলো। ফাহিম ভাইয়া আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
—-” তুই হঠাৎ গঞ্জিকা সেবন করছিস কবে থেকে রে?”
আমি তো নির্বাক! মানে? গঞ্জিকা? আর আমি? কি করে কি? আমি মাথায় হাত ডলতে ডলতেই বোকা গলায় প্রশ্ন করলাম,
—-” মানে কি ভাইয়া? এসব তুমি কি বলছো?”
রিম্মি আপু মুখ বাঁকিয়ে বলল,
—-” ঐ কু/ত্তা কি বলছিস এসব? ও কেন গাঁজা খেতে যাবে?তুই খাস, আর সেটা ওকে বলছিস?”
ফাহিম ভাইয়া রিম্মি আপুকে পাল্টা বকে বলে উঠলো,
—-” গাঞ্জা না খেলে এমন কবুতরের মতো নাক ডেকে ঘুমায় কি করে?”
ফিক করে হেসে উঠলো লিয়া। ফাহিম ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” কবুতর কি নাক ডেকে ঘুমায় ফাহিক ভাইয়া?”
ফাহিম ভাইয়া ভ্রু কুঁচকালো। তার কথায় কোনো যুক্ত নেই বুঝতেই জোরপূর্বক হাসলো। কথা ঘুরানোর তালে বলল,
—-” ঐ তো একই হলো! আসল কথা হলো গাঞ্জা খেলে মানুষ দিন দুনিয়া ভুলে হারিয়ে যায়। বিশেষ করে একবার ঘুমোতে পারলে তাকে তুলে নিয়ে পুকুরে ফেললেও তার ঘুম ভা/ঙে না। ওর বেলায়ও এমন হয়েছে!”
আমি ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,
—-” আমি তো টেনশনে ঘুমিয়ে গেছি ভাইয়া।”
আমার কথায় চারজনেই বেশ মনোযোগী হলো আমার প্রতি। ভাবুক গলায় লিয়া বাদে বাকি তিনজনই বলে উঠলো,
—-” কিসের টেনশন?”
আমি এসাইনমেন্ট গুলোর দিকে ইশারা করে বললাম,
—-” এগুলো রাহিয়ান ভাইয়া আমাকে দিয়েছিলেন। কমপ্লিট করতে।”
ফাহিম ভাইয়া বুকে হাত চেপে গোল গোল চোখ করে বলল,
—-” ওদের এসাইনমেন্ট নোট হঠাৎ তোকে কেন দিলো? হুয়াই?”
—-” পা/নি/শ/মে/ন্ট!”
‘পা/নি/শ/মে/ন্ট’ আবারও একই সাথে বলে উঠলো তিনজনে। আমি তিনজনেরই মুখ চেয়ে বললাম,
—-” হু পা/নি/শ/মে/ন্ট!”
ফাহিম ভাইয়া ধপ করে উঠে বসল আমার পাশে। বেশ আগ্রহ করেই গোলাকার চোখ নিয়ে বলল,
—-” ইন্টারেস্টিং ইয়ার। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভাইয়া এজ আ সিনিয়র তোকেই কেন এতবড় পা/নি/শ/মে/ন্ট দিতে গেল? কাহিনি কি?”
আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে আবারও বললাম,
—-” সেটা আমারও প্রশ্ন। ভার্সিটি উঠেই কেন এই সিনিয়রদের র্যাগিংএর খাতায় সেরা ইডিয়ট হিসেবে আমার নামটাই উঠলো আর আমার সাথেই বা এতোকিছু কেন হলো?”
রিম্মি আপু আমার পাশ ঘেঁসে বসলো। ফাহিম ভাইয়ার ন্যায় সেও একই ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
—-” এই নিধু বলনা? বলনা কি হয়েছিলো?”
আমি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। সবার মুখ চেয়ে রাহিয়ান ভাইয়া আর তার ফ্রেন্ডদের সাথে আমার হাড্ডাহাড্ডির কাহিনী শোনাতে লাগলাম। ফাহিম ভাইয়া ভিসি আর চিতা বাঘ স্যারের কাহিনী শুনতেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। রিম্মি আপুও হাসতে হাসতে আমার উপরই ঢলে পড়লো। বউমনি আর লিয়ারও একই দশা। তাদের এতো হাসি দেখে আমিও হেসে উঠলাম। সত্যিই সে এক ইতিহাস হয়েছিলো মাত্র কয়টা দিনে।
—-” আচ্ছা এখন বল হঠাৎ চেঁচালি কেন এখন??
ভূ/ত-প্রে/ত দেখলি নাকি?”
ফাহিম ভাইয়া পেট চেপে ধরে বলে উঠলো কথাটা। আমি মাথা নেড়ে বললাম,
—-” না গো ভাইয়া। এই এসাইনমেন্ট গুলো ইনকমপ্লিট রেখে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু উঠে দেখি এগুলো সব কমপ্লিট হয়ে আছে! ভাবতেই তো আমার গায়ে কাটা দেয়। এগুলো কমপ্লিট কে করলো? তাও মাত্র বিকেল থেকে রাতের মধ্যে?”
ফাহিম ভাইয়া চিন্তিত ভঙ্গিমা টেনে বলল,
—-” ভাইয়া করেনি তো?”
রিম্মি আপু অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-” ভাইয়া কি করে করবে? ও তো সন্ধ্যার পরপরই বেরিয়ে গেলো ফ্রেন্ড’দের আড্ডায়। আর এলো কখন? রাত এগারোটায়। তবে ওর দ্বারা কি করে সম্ভব?”
বউমনি বলল,
—-” হ্যাঁ গো নিধি। রিম্মি কিন্তু ঠিকই বলেছে।”
ফাহিম ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ভ/য় দেখানোর চেষ্টা করে বলল,
—-” তবে কি জ্বী/ন বাবাজিই খেল দেখালো নিধু?”
আমি আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে উঠলাম। রিম্মি আপু আমায় ধরে ফাহিম ভাইয়ার বিরূদ্ধে বলল,
—-” সর বেয়াদব ফাজলামো করিস না। ও কিন্তু এমনেই ভ/য় পেয়ে আছে।”
ফাহিম ভাইয়া চোখ দুটো সরু করে নিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
—-” আমি তো তোকে ভ/য়/ই দেখাতে চাই বাচ্চে। ভ/য় পা… তুই ভ/য় পা!”
আমি ভ/য়ে গুটিয়ে গিয়ে চেপে ধরলাম রিম্মি আপুকে। বউমনি আমাদের কান্ড দেখে বকা দিলো ফাহিম ভাইয়াকে। ফাহিম ভাইয়া ফিক করে হেসে উঠতেই লিয়া বলল,
—-” বউমনি, রাত তো দেড়টা বাজে। নিধি আপু তো এখনো খায়নি। আমি কি আপুর খাবার দিবো টেবিলে?”
খাবারের কথা শুনতেই যেন ক্ষিধেয় মোচড় দিলো পেট। আমি বউমনির দিকে অসহায় মুখে তাকালাম। বউমনি লিয়াকে যেতে বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” সেই বিকেলে রুমে এসে ঘুমিয়েছো। আর একাবারও উঠলেনা। আর কিছু খেলেও না। রাত এখন দেড়টা। অনেক হয়েছে গল্প আর এসাইনমেন্ট। এসো চলো? খেতে চলো।”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই হোহো করে হেসে উঠলো ফাহিম ভাইয়া। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” আমি কি আর সাধে বলেছি তুই গ?ঞ্জি/কা সেবন শুরু করেছিস? মানুষ গা/ঞ্জা খেলেই এমন ম/রা/র মতো ঘুমায় বনু!”
আমি ঠোঁট উল্টে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,
—-” আমার নামে মিথ্যে অপবাদ জাতি মেনে নিবেনা ভাইয়া।”
ভাইয়া হেসে ফেললো। সাথে বউমনি আর রিম্মি আপুও হাসতে লাগলো।
৪২.
টানা ৬দিন বাদে আজ আবারও ভার্সিটির প্রাঙ্গণে নিধির পায়ের ধুলো পড়লো। উফফ! এতোদিন পার হওয়ার পর ফিলিং লাইক “ভার্সিটি টা আমার জন্যই হয়তো অকেজো পড়েছিলো।” আমিও আসলাম আর ভার্সিটিও তার সতেজতা ফিরে পেলো।
ভার্সিটির সামনে বড় বটগাছটাকে কেন্দ্র করেই তার ছায়াতলে বসে আছে অসংখ্য স্টুডেন্ট। তাদের মাঝেই সিনিয়রদের গ্রুপ টা দেখা যাচ্ছে। রাতে হুলস্থুল কান্ডটা হলেও এক দিক থেকে বলা যায় আখেরে লাভ আমারই হয়েছে। এসাইনমেন্ট গুলো কমপ্লিট তো হলো। কথাটা ভেবেই ফাহিম ভাইয়ার মতে লাইক গা/ঞ্জাখোরদের মতো করে একখানা হাসি দিতে ইচ্ছে করলো। হাঁটতে হাঁটতে তাদের দিকেই এগোচ্ছি। মনে মনে একগাদা ঠাঁসা সুখ থাকলেও সমস্যা হলো ওয়েদার। আজ ওয়েদারটা খুব বেশি ঝলসানো। রোদের প্রখরতায় চারপাশের সবুজ ঘাস গুলোও যেন হলুদ হয়ে উঠেছে। বেশিদূর তাকাতে নিলেই চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো দশা হয়ে যায়। তাই কপালে হাত ঠেকিয়েই এমন অমানবিক রোদের থেকে নিজেকে সেফ করছি।
—-” হেই নিধি! হোয়াটসআপ?”
একটু দূর থেকেই আরফান ভাইয়ের উচ্ছ্বাসিত কন্ঠটা পাওয়া গেলো। চোখ তুলে তাকিয়ে জোরপূর্বক একখানা হাসি টেনে মাথা নাড়তে নাড়তে অবশেষে হাজির হলাম তাদের সামনে। আমাকে দেখতেই চোখের মাঝে সূর্য এঁটে তাকালেন অরিন আপু। বুঝি ছোটখাটো একখানা মুখ ভেংচিও কেটেছেন। আমার দশআনা দামের পাত্তা তাকে আর ছোঁড়া হলো না। আমি নিজের মতো করে ব্যাগ থেকে এসাইনমেন্ট গুলো বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিলাম। আরফান ভাই হাসি মুখে সেগুলো হাতে তুলে নিয়ে যার যার হাতে দিয়ে দিলেন। রাহিয়ান ভাইয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে ফোন চেপে চলেছেন! মুডের উনিশ বিশ চলছে নাকি? বাসা থেকে তো ভালো মানুষই বের হয়েছিলেন!
—-” ভাই এটা কি আমার এসাইনমেন্ট? নিধি তুমি আমারটাও নিজ হাতে নিয়ে এলে?”
রূপ ভাইয়ার অসহায় কন্ঠে খানিক ভাবুক হয়ে তাকালাম আমি। যেহেতু এসাইনমেন্ট গুলো করার দায়িত্ব আমারই ছিলো তবে তো তা সহীহ্ সালামিতে নিয়ে আসার দায়িত্বও আমার। পাশ থেকে খোঁচা মে/রে উঠলেন দিপু ভাই।
—-” কেন রে তোর এসাইনমেন্ট কি অন্যকারোর নিয়ে আসার কথা ছিলো নাকি?”
জিয়ান ভাই নাকি সুরে বললেন,
—-” আরে বুঝোছ না বেটা? মনে সুখ চলছে।”
হেসে ফেললেন অনন্যা আপু আর আরফান ভাই। আমি তাদের মশকরার “ম” টাও ঠিক ধরতে পারছিনা। আমার পাশে দাঁড়িয়ে রাই এর দিকে প্রশ্নসূচক মুখ করে তাকাতেই ঠোঁট উল্টালো রাই। অর্থাৎ তাদের ঠাট্টা মশকরা ওর মগজেও ঢুকছেনা ঠিক। আমি জোরপূর্বক হেসে রূপ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,
—-” কেন ভাইয়া? এসাইনমেন্টে কি কোনো প্রবলেম…”
আমাকে থামিয়ে দিয়েই মাঝপথে বলে উঠলেন আরফান ভাই,
—-” আরে না না কোনো প্রবলেম নেই নিধি। ও বেটা এমনেই ফাজলামো করছে।”
আমি সবার মুখ চেয়ে তাকালাম। আসলেই কি এমনি ফাজলামো করলো নাকি ডালমে কুছ কালা ধলা হ্যায়?
—-” নিধি? তোমাদের ক্লাস আই থিংক অনেক্ষন স্টার্ট হয়ে গিয়েছে। জলদি যাও এন্ড ক্লাস জয়েন করো।”
দৃষ্টি সম্পূর্ণ ফোনে রেখেই গম্ভীর স্বরে কথাটা বলে উঠলেন রাহিয়ান ভাইয়া। কেন জানিনা তার গম্ভীর গলা আমার ভেতরটায় ঝড় তুলে দিলো। উনার এই গম্ভীর চেহারার পেছনে এক্স্যাক্ট কারনটা কি সেটা যতক্ষণ জানতে না পারছি ততক্ষণে তো শান্তি পাচ্ছি না!
রাই আমার হাত টেনে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
—-” হাওয়া তো বেশ গরম মনে হচ্ছে নিধু। চল চল ক্লাসে যাই!”
—-” কিন্তু….”
আমার কথার মাঝেই আহত গলায় বলে উঠলেন রূপ ভাইয়া,
—-” রাই? তুমি চলে যাচ্ছো?”
তার প্রশ্নের ধরনে হাসির বেগ যে আমারও চাপল না তা ঠিক নয়। আমি মুখ টিপে হেসে উঠতেই হু হা করে হেসে উঠলেন সবাই। শুধু গুমোট বাঁধা মুখ করে বসে রইলেন মহাশয়! হয়েছে টা কি কে জানে?
দিপু ভাই ধরাম করে এক কিল বসিয়ে দিলো রূপ ভাইয়ার পিঠে। স্বজোরে কিল খেয়ে পিঠ চ্যাপ্টা করে মুখ কুঁচকে ফেললেন রূপ ভাইয়া। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে
মা/রা/ত্ম/ক টাইপ এক গালি আওড়াচ্ছেন দিপু ভাইয়ের জন্য। আমি আর হাসি চেপে রাখতে না পেরেই ভূমি কাঁপিয়ে হেসে ফেললাম। আমার সেই হাসিতে যোগ হলো বাকি সবাই। হাসতে হাসতে হঠাৎ রাহিয়ান ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তেই খাঁড়ার উপর হাসি থেমে গেলো আমার।
ভ/য়ং/ক/র এক হেঁচকি তুলে রাই-এর হাত ধরে উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম। সত্যিইতো হাওয়া বেশ গরম মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে কিছু পথ এগোতেই রূপ ভাইয়ার ভাঙা গলার গান ভেসে আসল কিঞ্চিৎ।
—-” যেও না সাথিইই… ও সাথি রেএএএ….”
বুঝলাম, রূপ ভাইয়া আমার পাশের এই সুন্দরীর প্রেমে পড়েছে।
#চলবে____________________