প্রেয়সী পর্ব-২৪+২৫

0
266

#প্রেয়সী ♥️🥀(২৪)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৪৬.

শাড়ির কুঁচি আগলে দাঁড়িয়ে আছি সিঁড়ির পাশে। গুনে গুনে ঠিক পাঁচখানা সিঁড়ি আসিফ ভাইয়ের বাসার সামনেটাতে। আর এদের দূরত্বও বেশি হলে আট দশ ইঞ্চি! কিন্তু আমার কাছে কেবল এটাই মনে হচ্ছে এদের দূরত্ব কম করে হলেও শ-ফুট। মানে আসমান থেকে জমিন অব্দি এদের দূরত্ব। বিপত্তিটা ঠিক সেখানেই! শাড়িতে
ভ/য়ং/ক/র ভাবে পা জড়িয়ে আছে। ধাপ ফেলে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে পারছি না। আর এদিকে এক এক করে সবাই ভেতরে চলেও গেলো। কেউ একবারও আমার কথা ভাবলো না। কেন এতো নি/ষ্ঠু/র সবাই?

—-” এক্সকিউজ মি মিস? ক্যান আই হেল্প ইউ?”

বকের মতো লম্বা গলাটা উঁচিয়ে কেউ বলে উঠলো কথাটা। আমার চোখ জোড়া ততক্ষণে সতর্ক হয়ে উঠলো। অপরিচিত গলা। চাতক পাখির মতো উল্টেপাল্টে চোখ জোড়া ঘুরাতেই দরজার পাশ থেকে তার অস্তিত্ব পাওয়া গেলো। লম্বাচওড়া শরীরের অধিকারি এক যুবক দাঁড়িয়ে। মাথার চুল গুলো আসিফ ভাইয়ের ন্যায় কোঁকড়ানো। চেহারাটা বেশ চোখা। টানা টানা চোখ। স্বভাবে মেয়েলি ভাব মনে হলেও একদমই তা নয়। সুপুরুষের ন্যায় চলতে চলতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

—-” আসুন?”

আমি বেকুবের ন্যায় তাকিয়ে আছি। কিছু সেকেন্ড আগেই হেল্প করার জন্য বলে এখন ডিরেক্ট হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ আগানো ব্যাক্তিত্ব দেখা যাচ্ছে।

আমি মেকি হাসলাম। তার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললাম,

—-” নো থ্যাংক্স।”

—-” আই থিংক, এটাই আপনার ফার্স্ট টাইম?”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। বিরক্ত গলায় বললাম,

—-” মানে?”

ছেলেটি আমার শাড়ির দিকে ইশারা করে বলল,

—-” শাড়ি।”

আমি আবারও মেকি হাসি জুড়ে বললাম,

—-” জ্বি না। এটাই লাস্ট টাইম।”

—-” মানে?”

—-” শাড়ি।”

ছেলেটা হা করলো আরও কিছু বাক্য আওড়াবে বলে। কিন্তু সে সুযোগটা বেশ শক্তপোক্ত ভাবে আর মিলল না! তার আগেই সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসলো রাহিয়ান ভাইয়ার ডাক।

—-” হেই কেশব?”

পেছন থেকে উনার কাঁধের সাথে আমার কাঁধ মিলতেই কেঁপে উঠলাম আমি। ঘাড় ফিরিয়ে উনার দিকে তাকাতেই উনার শরীরের গন্ধে বিদ্ধ হলো মন।

—-” হেই রাহিয়ান। হাউ আর ইউ ড্যুড?”

বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে হ্যান্ডশেক করতে হাত এগিয়ে দিলো কেশব নামের ছেলেটি। মাতাল হেসে রাহিয়ান ভাইয়াও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে কোলাকুলি করলেন তার সাথে। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন রাহিয়ান ভাইয়া,

—-” তুমি এখনো এখানে কি করছো? ভেতরে যাওনি?”

উনার শান্ত ভঙ্গিতে করা প্রশ্নে আমার ভেতরটা কাঁপতে লাগলো। আবারও কোন ঝড় অপেক্ষা করছে আমার জন্য কে জানে?

কথার মাঝে নাক গলিয়ে বলে উঠলেন কেশব,

—-” উনার মেইবি শাড়িতে প্রবলেম হচ্ছিলো তাইনা মিস?”

আমি শক্ত চোখে তাকালাম লোকটির দিকে। কিছু বলবো তার আগেই বলে উঠলেন রাহিয়ান ভাইয়া,

—-” কাউকে ডাকলে না কেন?”

আমি ঢোক গিললাম। শাড়ির কুঁচি ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। চোখে মুখে ভারি ইনোসেন্ট ভাব এনে ঠোঁট উল্টে বললাম,

—-” সবাই তো চলে গেলো আমাকে রেখে। তাই ডাকতে পারিনি।”

আমার কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন কেশব। কিন্তু রাহিয়ান ভাইয়া নির্বিকার। আমি আঁড়চোখে রাহিয়ান ভাইয়ার ভাব ভঙ্গিমা পর্যবেক্ষণ করছি। কিছু বলবেন নাকি দেখাবেন?

আমাকে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েই হাত বাড়িয়ে দিলেন রাহিয়ান ভাইয়া। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বলার বোধশক্তি আপাতত শূন্য। আমার রিয়াকশনে তার কিছু গেলো আসলো না। তিনি নিজ থেকেই টেনে নিলেন আমার হাত। তার হাতের ছোঁয়ায় ঘোর কাটলো আমার। চমকে উঠে পরিস্থিতি বোঝার আগেই হাঁটা ধরলেন তিনি। আমিও তাড়াহুড়োর উপর উনার পায়ের সাথে পা ফেলতে নিলাম। কিন্তু বিপদ যে কখনো নিধির পিছু ছাড়বেনা তা যে ভুলেই যাই। এক সিঁড়ি, দুই সিঁড়ি হিমশিম খেয়ে পেরিয়ে উঠতে পারলেও তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখতেই কুঁচি পড়লো পায়ের নীচে। আমার ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো কুঁচি খুলে পড়ার ভ/য়ে। আর সে কেঁপে উঠলো আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাথা ফাটার ভ/য়ে।

শাড়ির কুঁচি খুলে পড়বে ভাবতে ঝুঁকে গেলাম আমি। কিন্তু নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারলাম না। তবে নীচেও পড়লাম না। রাহিয়ানের শীতল হাতটা উদাম পেটে এসে ঠেকলো আমার। আমার শরীরের সমস্ত ভার আপাতত তার হাতের উপরই আছে। তৎক্ষনাৎ টনক নড়লো আমার। উনার ছোঁয়ায় অসহ্য ভাবে পু/ড়/ছে মন। তাড়াহুড়ো করে আবারও উঠতে নিলেই উনার হাতটা আমার পেট ছুঁয়ে আরও গভীর ভাবে আঁকড়ে এলো। বুকের ভেতরটায় ক্রমশই ধুরুম ধরুম করে ঢাক ঢোল পেটাচ্ছে।

আচমকা কেশবের বিচলিত কন্ঠ পাওয়া গেলো।

—-” ও গড! তোমরা ঠিকাছো?”

রাহিয়ান ভাইয়া আর সহ্য করলেন না আমার শরীরের ভার। দু’হাতে আমার কোমর চেপে সোজা করে দাঁড় করালেন আমায়। আবারও তার ছোঁয়া। আবারও কেঁপে উঠলাম আমি। শাড়ির কুঁচিটা শক্ত করে ধরে উনার থেকে পিছিয়ে আসতে নিলেই উনি হাত ধরে ফেললেন আমার। খানিক ধমকের সুরে বলে উঠলেন,

—-” একটু ঠিক করে হাঁটতেও পারোনা তুমি?”

আমার কি দোষ? আমি তো ঠিকই হাঁটছিলাম! যত তাড়া তো উনারই ছিলো! তবুও সব দোষ নিধির!

—-” ঠিক করে হাঁটো।”

কেশব রাহিয়ানের কথার রেশ টেনে বলে উঠলেন,

—-” হ্যাঁ, প্লিজ আপনি সাবধানে হাঁটুন। এক্ষনি কিন্তু একটা এ/ক্সি/ডে/ন্ট ঘটে যেতে পারতো।”

কেশবের কথায় বিশেষ পাত্তা দিলাম না আমি। রাহিয়ান ভাইয়ার হাত ধরে বাকি সিঁড়ি দুটো পার করতেই উনার হাত ছেড়ে নিজে নিজেই চলে এলাম ভেতরে। সবাই গোল করে বসে আছেন। আমরা ভেতরে আসতেই উঠে এলেন আসিফ ভাইয়া আর ফাহিম ভাইয়া। আসিফ ভাইয়া আমাকে বসতে ইশারা করে রাহিয়ান ভাইয়া কে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। ফাহিম ভাইয়া পেছন থেকে আমার হাত টেনে ধরল। আমি তাকাতে তাকাতে ভাইয়া এসে আমার পাশে দাঁড়াল। গলার স্বরটা খানিক নীচু করে বলল,

—-” মাঝপথে হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? আর আমাদের হুতুমপেঁচার সাথে কি করে এলি?”

আমি দাঁতে দাঁত চেপে কনুই দিয়ে গুঁতো মা/র/লা/ম ভাইয়ার পেট বরাবর। ভাইয়া ব্যাথায় গুঁজো হয়ে গেলো কিঞ্চিৎ। নিঃশ্বাস চেপে মনে মনে আ;র্ত;না;দ করছে ঠিকই। আমি রা/গি গলায় বললাম,

—-” আমায় সবাই এভাবে ফেলে এসে আবার জিজ্ঞেস করছো?”

ফাহিম ভাই মৃদুস্বরে নিঃশ্বাস ফেললো। হাসফাস করতে করতে বলল,

—-” সরি রে বনু! আসলে হয়েছে কি নতুন একটা গফ পটিয়েছি বুঝলি! তার সাথেই ম্যাসেজ টাইপিং হচ্ছিল আর কি! তাই পেছন থেকে তোকে ঠিক খেয়াল করে নিয়ে আসতে পারিনি!”

আমি ছলছল চোখে তাকালাম। কান্নার করবো এমন সুরে বললাম,

—-” আজ গফ পেলে বলে বনুকে ভুলে গেলে ভাইয়া? দেখো আজই তোমার ব্রেকআপ ঘটিত ঘটনা ঘটে যাবে!”

আমার কথায় ভাইয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কতক্ষণ আমার দিকে তাকাচ্ছে তো কতক্ষণ তার ফোনের দিকে। তার শঙ্কিত মন বারবার ডুকরে উঠছে আর বলছে,

—-” ব্রেকআপ টা কি সত্যিই হয়ে যাবে?”

৪৭.

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে চলে এলাম আসিফ ভাইয়াদের ছাদে। ছাদটা খোলা পরে থাকলেও অসম্ভব সুন্দর তার আকৃতি। তবে তারউপরও করা হয়েছে অসাধারণ ডেকোরেশন। ছাদের মাঝ বরাবর দোলনাটা মরিচ বাতিতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। তার দু-পাশে বড় আকারের নানাজাতের ফুলের টব। গাছের প্রতিটি ডালে ডালে ফুলের কলি সাথে অসংখ্য ফুলও বিদ্যমান।

শুধু তাই নয়, ছাদের চারকোনে চারটি নারকেলের চারাগাছের সাথেও মরিচ বাতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। আর থেকে থেকে থেকে জ্বলে চলেছে তা। আমার মন জুড়িয়ে গেলো নিমিষেই।

—-” ওয়াও জিজু। দিস প্লেস আর… ওয়াও ওয়াও।”

হাত তালি দিয়ে আমোদিত গলায় কথাটা বলে উঠলো ফাহিম ভাইয়া। আসিফ ভাইয়া মৃদু হেসে রিম্মি আপুর দিকে তাকালো। মাথা চুলকে বলল,

—-” তোমার বোনের খুশিতে সামান্য চেষ্টা আর কি!”

রিম্মি আপু লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

—-” থ্যাংক্যু।”

বউমনি বলল,

—-” তোমরা দুজন যাও না ওখানে। দোলনায় গিয়ে গল্প করো। আমরা না হয় এপাশটাতে আড্ডা দিচ্ছি।”

বউমনির কথায় মাথা দুলালো আসিফ ভাই। পাশ থেকে কেশব উৎসাহিত গলায় বলল,

—-” হ্যাঁ হ্যাঁ পার্ফেক্ট। ভাইয়া, ভাবিজি তোমরা যাও তোমাদের মতো করে টাইম স্পেন্ড করো। আমরা ঐদিকটা-তে বসি।”

আসিফ ভাই আর রিম্মি আপু দোলনার দিকে এগিয়ে যেতেই আমরাও অন্যপাশে চলে এলাম। আমি সবাইকে রেখে আগে গিয়ে ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। আমার পাশ ঘেঁষেই ফাহিম ভাইয়া দাঁড়ালো। ভাইটা আমার ভীষণ বিচলিত আমার অ/ভি/শা/পে। কপাল খানা কুঁচকে রয়েছে অনেক্ষন যাবৎ। বারবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে আমার পানে। কিন্তু সে দৃষ্টি কেবল অস্থির। মানে এটা বুঝাতে চাচ্ছে,” বনু তোর এই ছোট খাটো অ/ভি/শা/প টা তুলে নে-না? আমার যে ভীষণ চাপ চাপ ফিল হচ্ছে!”
আমার এমন ভাবনাতে আমি নিজে নিজেই হেসে ফেলি।

—-” সম্পর্কে কিন্তু আপনি আমার একমাত্র বেয়ান হবেন নিধি। জানেন তো,বাঙালিরা বেয়াই-বেয়ানের আত্মীয়তা কিভাবে পূর্ণতা দেয়?”

ঠেস মে/রে বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে কেশব কথাটা ছুঁড়ে মা/র/লো আমার দিকে। আমি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালাম তার দিকে। জোরপূর্বক হাসলাম ঠিক তবে আশেপাশে রাহিয়ান ভাইয়ার অ/গ্নি দৃষ্টির তাপ থেকে বাঁচার ছলেই জবাব দিলাম না। জবাব দিলেই আরেক কথা উঠবে আর তারপর তার পিঠে আরেক কথা। কথাই কথা। থামাথামির আর কোন পথ থাকবেনা।

—-” আপনাকে কিন্তু রেড কালারে বেশ মানিয়েছে বেয়ান।”

—-” ধন্যবাদ।”

কমপ্লিমেন্ট দিলো। তাই খুশিতে একটু শুকরিয়া আদায় করলাম। পাশ থেকে ফাহিম ভাইয়া আমাকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,

—-” তুই আজ রেড কালার পড়েছিস নাকি?”

আমি হা করে তাকালাম। বলে কি ভাইয়া? এতক্ষণেও ওর চোখে পড়লো আমি কি কালার পড়েছি?

—-” না রেড কালার পড়েছি!”

—-” অ্যাঁ!”

—-” হ্যাঁ।”

ফাহিম ভাইয়ার থতমত খাওয়া মুখ টা দেখে হেসে উঠলাম আমি। বউমনি হাসতে হাসতে বলল,

—-” তোমরা পারও বটে। তা কেশব কতদিনের জন্য আছো এদেশে?”

কেশব চকচকে দাঁতের হাসি দিয়ে বলল,

—-” অনলি সিক্স মান্থ বউমনি।”

—-” কেন? এতো কম থাকলে মনে ভরবে বলো? এতো সুন্দর একটা দেশ ছেড়ে যে কি করে থাকো ভাই?”

কেশব মাথা চুলকালো। আঁড়চোখে হয়তো দেখলো আমাকে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,

—-” এবার গিয়ে একদম পারমানেন্টলি চলে আসবো সিওর। এদেশে থাকার একদম শক্তপোক্ত একখানা কারন অবশেষে জোগাড় করে ফেলেছি বউমনি।”

—-” তাই নাকি? তা কি সেই কারন? হু? বলো বলো?”

ফাহিম ভাই আমার দিকে সরু চোখে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড কেশবের দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে পূণরায় আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

—-” বেটা কি কোনো কারনে তোর কথা বলতে চাচ্ছে নাকি রে?”

আমার মস্তিষ্ক সতর্ক হয়ে উঠলো। আমি ভাইয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ভাইয়া আবারও ফিসফিস করে বলল,

—-” আরে বেদ্দপ মাইন্ড খাইছ না! বেটা কিন্তু বেশি সুবিধার পাত্র নয় বনু। সো সাবধান।”

আমি মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। কেশব হঠাৎ আমার কথা কেন বলতে যাবে? উনার সাথে আমার দেখাই তো হলো ঘন্টা দুয়েক। আমি মন দিলাম না ভাইয়ার কথায়। আর কারোর কথা কানে তুলতে ইচ্ছে হলো না। আজ পরিবেশ টা সত্যিই ভীষণ মনোরম। কতক্ষণ পরপর বাতাসের মৃদু ঝাঁপটা সেই সাথে ফুলের সুভাষ। মন ভরে ওঠে। সবাইকে রেখে আমি চলে গেলাম ঐপাশটাতে। এপাশে আলো আসতে বেশ বাঁধা পায়। পুরো জায়গাটা অন্ধকারই বলা যায়। একা এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দু’হাত দু’দিকে মেলে দিয়ে বাতাসের গন্ধ নিতে লাগলাম। ক্ষনিকের উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে মৃদুস্বরে বলেই উঠলাম,

—-” জিবন এতো সুন্দর কেন?”

ম্যাসেজের টুংটাং শব্দে আমার ভাবনার সুতো ছিঁড়ল। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ভাজেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অপরিচিতর ছোট্ট একটা ম্যাসেজ। ফোনটা কাছে এনে অন করতেই ভেসে উঠলো লেখাগুলি,

—-” আমার বড় সাধ হয়
তোমার নিঃশ্বাস আটকায়ে দেখি,
তুমি ম-রো, না আমি!
ইঁচালি-বিঁচালি শরীরের,
ভাঁজে ভাঁজে ~~
আ-গু*ন জ্বা-লা-য়ে দেখি,
তুমি পো-ড়, না আমি!

লেখাটা পড়তেই নিঃশ্বাস আঁটকে এলো আমার। ফোনের সাইড বাটনে চাপ দিয়ে ফোনটাই অফ করে দিলাম। এক্ষনি হয়তো তার কলও আসতে পারে! কিন্তু আমি চাইনা তার সাথে কথা বলতে। উনার পাঠানো কবিতায় আমার সমস্ত অনুভূতি মাঝপথেই শূন্য হয়ে গেলো। কথা গুলো ধারালো সূচের মতো বিধে গেলো অন্তরে। শিরশির করে উঠলো ভেরতটা। সেই সাথে বারবার প্রতিধ্বনি করতে লাগলো উনার বাক্য গুলো।

——–” আমার বড় সাধ হয়
আমার বড় সাধ হয়!

তোমার নিঃশ্বাস আটকায়ে দেখি,
তুমি ম-রো, না আমি!
আমার বড় সাধ হয়!
সাধ হয়! তুমি ম-রো, না আমি?

ইঁচালি-বিঁচালি শরীরের,
ভাঁজে ভাঁজে ~~
আ-গু-ন জ্বা-লা-য়ে দেখি,
তুমি পো-ড় না আমি!

পো-ড় তুমি! পো-ড়!
তুমি পো-ড়, না আমি?

বাক্য গুলোতে অ-তি-ষ্ঠ হয়েই কান চেপে ধরলাম আমি! বিচলিত মনে আশেপাশে তাকাতে লাগলাম!! অস্থিরতায় ঘেমে নেয়ে উঠলাম এমন সুন্দর পরিবেশেও। বাতাসের মৃদু গন্ধে অ-তি-ষ্ঠ হয়ে উঠলো মন। ছাদের কার্নিশে পিঠ ঠেকিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেললাম। দু’হাতে মুখ মালিশ করে শাড়ির আঁচল তুলতে নিয়েই অনুমান হলো আমার অবাধ্য আঁচল খানা তো অনেক আগেই তুলে রেখেছিলাম। আর আমার পেটের বেশিরভাগ অংশই খালি পড়ে আছে। বুকের ভেতর টা আচমকাই ধক করে উঠলো। তবে কি তার এই কবিতার মূল লক্ষই হলো আমার জ্ঞান ভাণ্ডারকে শিক্ষা দেওয়া?

—-” ইঁচালি-বিঁচালি শরীরের,
ভাঁজে ভাঁজে ~~
আ-গু-ন জ্বা-লা-য়ে দেখি,
তুমি পো-ড় না আমি?”

কথাটা আরও একবার বাজতে বাজতে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিল। আচমকাই ভেতর টা ধুকপুক করে উঠল।জানিনা, কি ভেবে রাহিয়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। কিন্তু রাহিয়ান ভাইয়ার দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটা আপাতত শূন্য পড়ে আছে। কোথায় গেলেন উনি? এই তো এক্ষুনি এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

#চলবে_______________l

#প্রেয়সী 🤎🥀(২৫)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৪৮.

সবার চোখ এড়িয়ে ছাদ থেকে নেমে এলাম আমি। ড্রয়িং রুমের পাশ থেকে হেঁটে যেতেই চোখ পড়ল রিম্মি আপুর হবু শশুর – শাশুড়ীর দিকে। দুজনে একসাথে পাশাপাশি বসে সুখ দুঃখের আলাপ পাড়ছেন। মানুষ দুটো খুব অমায়িক। একজন আরেকজন প্রতি খুব সফ্ট। তাদের দুজনের নাকি বরাবরই সা/পে নে/উ/লে সম্পর্ক ছিলো। কেউ কাউকে চোখের নী/লেও সহ্য করতে পারতেননা। কিন্তু এই বাহ্যিক সম্পর্কের চেয়ে আত্মিক সম্পর্কটা ছিলো বেশ গভীর। দুজন দুজনকে হঠাৎই ভীষণ ভালোবেসে ফেলেন। একজন আরেকজনের মায়ায় জড়িয়ে গেলেন। একজন আরেকজনকে হারানোর ভ/য়ে সর্বদাই তটস্থ হয়ে থাকতেন। তবুও মুখ ফুটে কেউ কখনো কারোর মনের কথা বলতে পারেননি। হঠাৎ এলো সেই দিন, দু’জনের মনের কথা একে অপরকে বলে ফেলার সেরা সুযোগ টা হাতে পেলো দু’জনেই। কিন্তু পরিস্থিতিটা ছিলো তাদের বিপক্ষে। আন্টির বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। আঙ্কেল
পা/গ/লে/র মতো রাতদিন ছটফটিয়ে ম/র/তে লাগলো। হঠাৎ আরেক কান্ড হলো। আন্টির বিয়ের রাতে কিছু লোক আন্টিকে তুলে নিয়ে গেলো। আর আঙ্কেলের কাছে সে খবর পৌঁছতেই পাত্রের থেকেও আগে পৌঁছে গেলো আঙ্কেল। লোকগুলোর হাত থেকে আন্টিকে উদ্ধার করে যখন বাড়ির পথ ধরে তাকে নিয়ে আসা হচ্ছিলো তখন আন্টি কান্নায় ভে/ঙে পড়ে আঙ্কেলকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে, এই লোক গুলো আমারই ঠিক করা। আমি চাই না এই বিয়েটা করতে! আমি তোকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি! তুই প্লিজ আমায় নিয়ে আর বাড়ি ফিরিস না। নিয়ে চল তোর সাথে। আমি তোর সাথে যেতে চাই।”

আঙ্কেল হতবাক হয়ে আন্টির কথা গুলো শুনে হঠাৎই আন্টির গাল বরাবর চড় বসায়। আন্টি ভ/য় পেয়ে সিঁটিয়ে গেলো। আঙ্কেলের চোখে চোখ রাখতে না পেরে মাথা নীচু করেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। কিন্তু আঙ্কেল নরম হলো না। আন্টিকে জোর করেই বাড়ি নিয়ে গেলো। অতঃপর তার ঠিক করা পাত্রের সাথেই আন্টির বিয়ে পড়াতে বলল।

—-” নিধি? ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছো মামনি? এদিকে এসো না?”

দূর থেকেই ভেসে আসলো আন্টির গলা। আমি চোখ ঝাপটে আন্টির দিকে তাকালাম। তাদের বাকি কাহিনি টুকু ভাবার আগেই ঘোর কেটে গেলো আমার। আন্টির সাথে ঠিক করা পাত্রের বিয়ে হলে তবে তারা দুজনে আজ একসাথে কি করে? বাকি গল্প টুকু বলার পূর্বেই কিভাবে যেন থেমে গেলেন তারা। শেষ টুকু শোনা হলো না! আচ্ছা এখন গিয়ে কি শুনে নিবো শেষটুকু?

—-” এসো এসো?”

আবারও ডাকলেন আন্টি। আমি নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। গলা খাঁকারি দিয়ে ছোট্ট করে হাসলাম। আসল কথা হলো আমি তাদের ব্যক্তিগত সময়ের মাঝে এই মুহুর্তে ঢুকতে চাচ্ছি না। আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করতে লাগলাম। হঠাৎই আমার ফোনের দিকে চোখ পড়লো। মনেমনে এসেও পড়লো একখানা তরতাজা বুদ্ধি। আমি ফোনটা তুলে মিনমিনে গলায় বললাম,

—-” ফোন! আমার একটা কল এসেছে আন্টি। আমি কথা বলে এক্ষুনি আসছি।”

আন্টি অমায়িক হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে বাইরে চলে এলাম। বাড়ির মেইন গেট থেকে বাইরের গেট অব্দি আলো জ্বলছে। এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রাহিয়ান ভাইয়াকে কোথায় দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। গেলেন কোথায় মানুষটা? আমি শাড়ির কুঁচি ধরে সাবধানে হাঁটা ধরলাম। এই মুহুর্তে উনাকে চোখের সামনে রাখাও যেন আমার স্বস্তির কারন হবে। কিন্তু কেন? জানা নেই।

ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বাইরের গেটে পা রাখতেই চোখ এড়ালো না উনার কালো গাড়িটা। গাড়ির উপর অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছেন তিনি। উনার গোছালো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। বাতাসের তান্ডবে মৃদু ভাবে উড়ছে তারা। ভাঁজহীন শার্টের হাতা দুটোতে ভাঁজ পড়ে গিয়েছে। ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, উনার কি মন খারাপ?

আমার বুক চিঁড়ে তপ্ত শ্বাস বের হলো আমারই মনের অগোচরে। আমি উল্টো পথ ধরলাম। উনার একাকী সময়টাতে আর হস্তক্ষেপ করে উনাকে বিরক্ত না-ই বা করলাম।

—-” শাড়ি পড়াটা কি খুব বেশি দরকার ছিলো?”

উনার শান্ত কন্ঠ বিচলিত করল আমার মন। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে পুড়লো যেন। আমি থমকে দাঁড়ালাম। শুঁকনো গলাতেই ঢোক গিললাম। পেছন মুড়ে উনার দিকে তাকাতে তাকাতে আবারও বলে উঠলেন তিনি,

—-” যে জিনিসে অশান্তি হয় তা না পড়াই শ্রেয়।”

—-” রিম্মি আপু জেদ করলো বলেই তো পড়লাম।”

আমিও শান্ত কন্ঠে জবাব দিলাম। উনি মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। কিছুক্ষন একই ভাবে চেয়ে থেকে চোখ ফেরালেন। কঠিন গলায় বললেন,

—-” কেশব তো দেখি তোমাকে চোখে হারাচ্ছে।”

—-” তাতে আমার কি দোষ? (অভিমানী কন্ঠে)

দু’হাতে ভর করেই নেমে এলেন উনি। অন্ধকারে আন্দাজে পা ফেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভরাট কন্ঠে বললেন,

—-” তোমার এই শাড়ি। তুমি কি জানো রেড ওর ফেভারিট কালার। রেড ওর দুর্বলতা। আর আজ তো আরও বেশি প্রিয় হয়ে গেলো এই কালার। এই শাড়ি, আর এই শাড়ি পরিহিত নারী।”

আমি ধাক্কা খেলাম। শুঁকনো মুখে বললাম,

—-” সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত সমস্যা! আমি নিশ্চয়ই এই রঙ পড়ায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দোষী হয়ে যায় নি!”

—-” ওর থেকে দূরে থাকবে!”

আবারও হু/ম/কি! আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

—-” আমি কেন দূরে থাকবো। সে কি করছে বা করবে তার দায়ও নিশ্চয়ই আমার নয়! আপনি সবসময় আমাকেই কেন….”

—-” আমি বলেছি তো ব্যস। তুমি ওর থেকে দূরে থাকবে মানে দূরে থাকবে।”(দাঁতে দাঁত চেপে)

—-” অসম্ভব!”

কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেই বি/প/দ বাড়ালাম বুঝি! মনেমনে ঠিকই এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে উনার ঝাঁ/ঝ সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। কথা বলার আগে তো জীবনে একবার ভেবে বললাম না। যা মাথায় আসতো তাই গড়গড় করে বলে এসেছি।

উনি চোখের মাঝে সূর্য এঁটে তাকালেন আমার দিকে।
রা/গে বিদিশা হয়েই আমায় ঠেসে ধরলেন উনার গাড়ির সাথে। আমার আত্মা হুড়মুড় করছে বেরিয়ে আসার জন্য! ভ/য়ে আমার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে উঠল।
উনি আমার হাত দুখানা শক্ত করে চে/পে ধরে বললেন,

—-” তুমি আমার কথার অমান্য করছো? কেশবের সাথে কথা বলার জন্য আমাকে অসম্ভব বলছো? হাউ ডেয়ার ইউ ইডিয়ট? আমি তোমাকে যেহেতু বারন করেছি তুমি ওর সাথে কথা বলবেনা তো বলবে না! ওর থেকে দূরত্ব রাখবে তো রাখবে, ব্যস! আমি আর কিছু শুনতে চাই না! আর নেক্সট টাইম থেকে যদি দেখি আবারও শাড়ি পড়ে কোথাও বের হয়েছো তবে তুমিও দেখবে রাহিয়ান কি কি করতে পারে? জি/ন্দা মাটিতে পুঁ/তে ফেলবো তোমাকে!”

আমার দম আঁটকে গেলো। লোকটা স্বাভাবিক সেন্সে নেই তা ঠিক বুঝতে পারছি! আমার হাত দু’খানা মড়মড় করে ভে/ঙে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি ব্যাথায় আরও বেশি সিঁটিয়ে রইলাম। তারউপর উনার এই ধাঁচের কথা! কোন খুশিতে যে নাচতে নাচতে এলাম উনার এখানে খোদা মালুম!

আচমকাই কিছু না বলে একটানে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমায়। উনার কাঁপা কাঁপা হাত টা আমার শাড়ি ভেদ করে পেটর উপর রাখতেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো। অনুভূতির মাত্রাতিরিক্ত তেজ সহ্য করতে না পেরেই দু’হাতে খামচে ধরলাম উনার শার্ট। উনি উনার অন্য হাতটাও চেপে ধরলেন আমার পেটে। আমার সহনশক্তি লোপ পেলো। অনুভূতি শক্তি ভারি হয়ে উঠলো। আমি নিঃশ্বাস আঁটকেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। উনার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগলেও পরমুহূর্তেই সামলে নিলাম নিজেকে! হাতে গোনা কিছু মুহুর্ত উনাকে জড়িয়ে ধরে জোর করেই ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। আর এক মুহুর্তও নিজেকে উনার সামনে রাখার দুঃসাহস করতে পারলাম না৷ উনার থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে এক দৌড়ে চলে এলাম বাসার ভেতর। সিঁড়ির পাশ থেকে সোজা গিয়ে আমাদের জন্য সাজিয়ে রাখা গেস্ট রুমে ঢুকেই দরজা আঁটকে দিলাম। বুকের ভেতরটা থেকে থেকে লাফ মা/র/ছে। হাত-পা তো সেই থেকেই কেবল কেঁপেই চলেছে। নিঃশ্বাস গুলো ভ/য়ং/ক/র ভাবে জড়িয়ে আসছে। জমে যাচ্ছি আমি! বিছানায় বসে জোরে জোরে দম ফেলতেই অপরিচিতর ম্যাসেজের কথা গুলো আরও একবার মাথার মধ্যে বেজে উঠলো,

—-” আমার বড় সাধ হয়
তোমার নিঃশ্বাস আটকায়ে দেখি,
তুমি ম-রো, না আমি!
ইঁচালি-বিঁচালি শরীরের,
ভাঁজে ভাঁজে ~~
আ-গু-ন জ্বা-লা-য়ে দেখি,
তুমি পো-ড়,না আমি!”

৪৯.

জমিয়ে কাজ চলছে নবীন বরন প্রোগ্রামের। কানাঘুঁষায় শোনা গেলো সিনিয়রদের লিডার রাহিয়ান রাফিদ এই প্রথমবার সব কিছু নিয়েই ভীষণ হেলাফেলা করছেন যা এর আগে কখনো কোনো কাজেই করেননি। কারন? কারোর জানা নেই। এমনকি স্বয়ং রাহিয়ান রাফিদেরও জানা নেই। অনেকেই কৌতুহল বশত আলোচনায় বসে যাচ্ছে এরকমটা হওয়ার কি কারন? সেকি প্রেমে পড়েছে নাকি ছ্যাঁ-কা খেয়েছে ব্যাকা হয়েছে। এমন কথায় বেশিরভাগ জনগন সেইরাম ভাবে চটে যাচ্ছে। রাহিয়ান রাফিদকে ছ্যাঁ-কা দেওয়ার মতো কোনো মেয়ে আজও অব্দি এই ভুবনে জন্মায়নি! এর মানে বুঝছেন তো? তাকে ছ্যাঁ-কা দেওয়া অসম্ভব। কেননা, লাখো মেয়ে নিজেই তো প্রতিনিয়ত ছ্যাঁ-কা খেয়ে ম-রে যাচ্ছে একা একা!

আমি আর রাই ভার্সিটির আর্টকলা ভবনের নিচতলায় বসে আছি। আর রাহিয়ান ভাইয়াকে নিয়ে এতো এতো আলোচনা সব আমাদের পাশে বসেই হচ্ছে। রাই আমাকে খোঁচা মে-রে নাকি সুরে বলল,

—-” তোর ইচ্ছে করছেনা মেয়েগুলোর চুলগুলো টেনে উগলে নিয়ে আসতে?”

আমি হতবাক হয়ে বললাম,

—-” কেন?”

রাই অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” তুই আমাকে এখনো জিজ্ঞেস করছিস ‘কেন’? তুই কি সত্যি বুঝতে পারছিস না?”

আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। মেয়েগুলোর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে পূণরায় রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

—-” না! কি হয়েছে বুঝলাম না তো কিছু?”

রাই রা-গে ফুঁসছে। গাল ফুলিয়ে বলল,

—-” তোর জায়গায় আমি থাকলে না ঠিকই ওদের চুল ছিঁড়ে নিয়ে চলে আসতাম। রাহিয়ান ভাইয়ার ছ্যাঁ-কা খাওয়া বা প্রেমে পড়া অব্দি তো ওদের কথা ভালোই লেগেছে কিন্তু এখন? এখন উনাকে স্বপ্নের পুরুষ ভেবে কেমন হা-হুতাশ করে ম-র-ছে দেখ!”

আমি ফিক করে হেসে দিলাম। রাইয়ের চটে যাওয়ার কারন হয়ত ধরতে পেরেছি আমি। তাই খোঁচা মা-রা-র সুরে বললাম,

—-” তোর উনাকে কেমন লাগে?”

রাই নেভানো চোখে তাকালো। আ-হ-ত গলায় বলল,

—-” রূপকে দেখার আগে উনাকে দেখলে হয়ে যেতো কাজটা। কিন্তু কি করার?”

—-” তোর তো তাও একজন আছে। কিন্তু ওদের দেখ, তোর মতো ওদের তো কেউ নেই! যে আছে সে হলো রাহিয়ান ভাইয়া! কাছে টেনে সোহাগ তো আর করতে পারবেনা তাই দূর থেকেই এমন করছে। কি আর করার? যার যা খুশি করতে দে না?”

রাই নড়েচড়ে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় প্রশ্ন করল,

—-” তোর কি আসলেই খারাপ লাগছেনা?”

আমি পূর্নদৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম রাইয়ের পানে। না সূচক মাথা নেড়ে বললাম,

—-” না, হঠাৎ খারাপ কেন লাগবে? আমার তো শুনে বেশ মজাই লাগছে!”

রাই মুখ বাঁকাল। চোখ দুটো সরু করে বলল,

—-” এই একই প্রশ্ন আগামী সপ্তাহে আমি তোকে আবারও জিজ্ঞেস করবো এন্ড আমি ড্যাম শিওর তুই ভিন্ন উত্তর দিবি।”

—-” মানে?”

—-” কিছু না। চল ক্লাসে যাই, তিনতলা অডিটোরিয়ামে তোর নাচের প্রাকটিস হবে।”

নাচের কথা শুনলেই তাল উঠে যায় আমার। আই লাভ নৃত্য। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমোদে মেতে উঠে রাইকে নিয়ে চলে গেলাম তিনতলায় অডিটোরিয়ামে।

অডিটোরিয়াম রুমটা যথেষ্ট বড়। কিন্তু আজ নাচের প্রাকটিসের জন্য আসা স্টুডেন্টদের ভীরে ভরপুর হয়ে উঠেছে জায়গাটা। আমি রাইকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিলল অনন্যা আপুর। সাথে বাঁকা মুখওয়ালি অরিন আপুও রয়েছেন। বুক ধড়ফড় করছে যেন রাহিয়ান ভাইয়া না থাকেন। সায়তানকা নাম লিয়া তো সায়তান হাজির। তাদের পুরো গ্যাং-ই সাউন্ডবক্সের পাশে রাউন্ড হয়ে বসে আছেন চেয়ারে। আমাকে দেখতেই স্রেফ একবার তাকালেন উনি। আর ফিরে তাকালেন না আমার দিকে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নাচের টিচার মারুফা ম্যামের দিকে এগিয়ে যেতেই ডেকে উঠলেন আরফান ভাইয়া। ঝা-মে-লা-র শুরুটা সব সময় এই ব্যাক্তির থেকেই হয়। রাহিয়ান ভাইয়ার ও-য়া-র্নিং-য়ে-র কথা মনে পড়তেই তার ডাক সম্পূর্ণ রূপে উপেক্ষা করে নিজের গন্তব্যেই হেঁটে চললাম। কিন্তু না নিধি থাকবে যেখানে বিপদ যাবে সেখানে! মেনে নিতে শিখ প্রিয়! নিজের মনকে বুঝ দিতে দিতেই সামনে এসে খাম্বা হয়ে দাঁড়ালেন আরফান ভাইয়া। আমি ভ-য়ে ভ-য়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা চালালাম। আঁড়চোখে রাহিয়ান ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি রেখেছি! তিনি তার সম্পূর্ণ ধ্যান জ্ঞান ফোনের মাঝে ডুবিয়ে বসে আছেন। এদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাতে যেন তার কোনো মাথা ব্যাথাই নেই।

—-” তুমি নৃত্যকলাতে নাম দিয়েছো?”

আরফান ভাইয়ের সহজসরল প্রশ্ন। আমি ঢোক গিলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। আরফান ভাই খুশিতে আটখানা হয়ে অনন্যা আপুকে ডাক দিলেন। অনন্যা আপু বসে থেকেই ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলেন কি হয়েছে। আরফান ভাইয়া তার সঠিক জবাব না দিয়েই আবারও ডেকে উঠলেন। অনন্যা আপু তার ডাকে অতিষ্ট হয়েই উঠে এলেন।

—-” কি রে কি হলো তোর হঠাৎ?”

—-” তুই নাচে তোর লাস্ট একটা পার্টনার খুঁজছিলিস না? নিধিও তো নাচবে। তুই ওকেই নিয়ে নে তোর টিমে?”

অনন্যা আপু মিষ্টি হেসে আমার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,

—-” তাই নাকি? নিধি নৃত্যকলাতে নাম লিখিয়েছো?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম,

—-” হ্যাঁ আপু। তাই ম্যামের কাছেই যাচ্ছিলাম কোন দলে কি গানে নাচ হবে সেটা কনফার্ম করতে।”

—-” যাক তাহলে তো হয়েই গেলো। তোমাকে আর ম্যামের কাছে যেতে হবেনা তুমি বরং আমার সাথে চলো। আমার টিমে পুরো ছয়জন কমপ্লিট। আর একজন হলেই ডান। আচ্ছা তুমি নাচ কেমন পারো? একটু ভালো নাকি বেশি ভালো?”

আমি মুখ খোলার আগেই পাশ থেকে উৎসাহিত কন্ঠে বলে উঠলো রাই,

—-” এক কথায় চমৎকার আপু। আমি হলফ করে বলতে পারি নিধির মতো এতো ভালো ডান্সার হোল এরিয়াতে তুমি পাবেনা!”

রাইয়ের কথায় গর্বে বুক ফুলে যাওয়ার কথা আমার। কিন্তু আমি যে তা পারছিনা। ভ-য় হচ্ছে হুতুমপেঁচাকে নিয়ে! আমার সাধের নাচেও আবার বাগড়া দিয়ে বসবে না তো?

আমার মনকে স্বস্তি দিয়েই বাঁধা দিলেন না তিনি। রাইয়ের মুখে আমার ছোট থেকে বড় হওয়ার সাথে সাথে নাচের সম্পর্কটাকে এমন ভাবে উপস্থাপন করলো যে সেও খুশি হয়ে অভিনন্দন করলেন। সবার দৃষ্টির অগোচরেই মাতাল হেসে ছোট্ট করে বলে গেলেন,

—-” অল দ্যা বেস্ট।”

#চলবে____________________