ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )
৩৯.
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
জাফর ভাই,
কোথা থেকে শুরু করব, বুঝে উঠতে পারছিনা। আপনাকে আমার অন্ধকার জীবনের উজ্জ্বল আলো বললে ভুল হবেনা। গায়ের চামড়া কে*টে যদি আপনার পায়ের জুতা বানিয়ে দেই তবুও এই ঋণ শোধ করতে পারব না। আমার নিজের কোন ভাই নেই! থাকলে হয়তো আপনার মতই হতো। আমেনা আমি পিঠাপিঠি ছিলাম। ও যতটা আব্বার বাধ্য সন্তান ছিল, আমি ঠিক ততটাই অবাধ্য ছিলাম। বিয়ের ব্যাপারে আমেনাকে আপোষে রাজি করতে পারলেও, আমাকে বাধ্য করতে পারেনি। আমার চোখে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন ছিল। তাই আব্বা বাধ্য হয়ে প্রথমে আমেনাকেই বিয়ের পিড়িতে বসালো। বিয়ের পরপর-ই বড় ভাইয়ের মত আমার পাশে দাঁড়ালেন। আমার লেখাপড়ার স্বপ্ন, ঢাকায় থাকার ব্যাপারে আব্বাকে বুঝিয়ে বললেন। আপনার কারণেই আমার ঢাকায় যেয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় এসে চারদিকের চাকচিক্যময় দুনিয়া দেখে, মোহের ঘোরে পড়লাম। শোয়েবের সাথে গভীর প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম। বাবা মা, বোন সব রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধু তাকেই চাইলাম। দুজনে ঘর বাঁধলাম। সংসার সাজালাম। তখনো জানতাম না আমার এই একটা ভুল, কাল হয়ে দাঁড়াবে আমার। মন প্রাণ সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসলো না। ঠকালো! গ্রামের যেয়ে ছবিকে বিয়ে করে নিলো। তখন আমি অন্ত: সত্ত্বা। গ্রামে গেলাম। ওর আর ওর মায়ের কাছে কত আহাজারি করলাম। মানলো না! সেদিন প্রচন্ড আঘা*ত পেয়েছিলাম। নিজের প্রতি, গর্ভের সন্তানের প্রতি প্রচন্ড ঘৃ*ণা জন্মায় আমার। আয়নায় নিজেকে দেখতাম আর ভাবতাম এই সন্তান ওই অমানুষ, বেই*মানটার চিহ্ন। ওর বেঁচে থাকার অধিকার নাই কোন। তাই গর্ভপা*ত করবো বলে ঠিক করলাম। ডাক্তার বারবার নিষেধ করল। বলল, এতে আমার প্রাণ যাওয়ার ঝুঁকি আছে। মানলাম না, হাসপাতালে গেলাম। যেই অপারেশন রুমে ঢুকব অমনি অভিলাষা, শাহরিয়ার সাহেব এলো। তিনি চেয়ারম্যান হয়নি তখনো।অভিলাষা হাজার বুঝাল। আমার গর্ভের বাচ্চার পুরো দায়িত্ব নিতে চাইল। যেই অধিকার আমি পাইনি। সেই অধিকার আমার সন্তানকে দিবে বলে প্রস্তাব রাখল।আমি মানলাম না। গর্ভপা*ত করাতে উঠেপড়ে লাগলাম। বড় ডাক্তার এলো। পুনরায় পরিক্ষা নীরিক্ষা হলো। সব রিপোর্ট দেখে বলল, এইসময় এসে গর্ভপা*ত করা সম্ভব না। তারা কোন প্রকার রিস্ক নিতে পারবেনা। বাধ্য হয়ে বাচ্চাকে আমার রাখতে হলো। অভিলাষা অনেক জোরাজোরি করে নিজের সাথে ঢাকার বাড়িতে নিয়ে গেল। ভাইয়ের পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আমার আর গর্ভের সন্তানের খেয়াল রাখলো। সেই নয় মাস প্রতিটি মুহূর্ত আমি ঘৃণার আগুনে পু*ড়েছি। ওই বিশ্বাস ঘা*তকের চিহ্ন বয়ে ক্ষণে ক্ষণে ম*রেছি। এই সন্তান আমার জীবনের কালোরাতের অভি*শাপ!
বাচ্চা জন্ম হলো। কন্যসন্তানের মা হলাম। জন্মের পর তার মুখটা পর্যন্ত দেখলাম না। এতিমখানায় দিতে চাইলে, আপনি আমেনা এসে বাঁধ সাজলেন। তৃতীয় সন্তানের চেষ্টায় তখন সবে মিসক্যারেজ হয়েছিল আমেনার। ভেঙ্গে পড়েছিল আমার বোনটা। গর্ভের সন্তান হারিয়ে এক প্রকার পাগলের মত হয়ে গেছিল। হাসপাতালে দেখতে এসে নবজাতক কন্যাটাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। করুন কন্ঠে আবদার করে বলল, এই বাচ্চাটাকে আমায় দিবে আপা? প্রথমে রাজি না হলেও। বোনের করুন কান্না দেখে রাজি হলাম। শর্ত জুড়ে দিলাম, এই মেয়ে যেন কোনদিন সামনে না আসে আমার। মেয়ের মুখ না দেখেই চলে গেলাম। পড়াশোনা শেষ করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ইমান্দিপুরে ফিরে গেলাম। মাঝে পাঁচ বছর কে*টে গেল।এরই মাঝে একদিন জানতে পারলাম, আপনারা সেই মেয়েটির নাম রেখেছেন ‘প্রিয়’। দেখার প্রচন্ড ইচ্ছা জাগলো। মনের ভেতর মাতৃত্বের টান জন্মালো। নিজেকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। একপ্রকার ছুটে এলাম ঢাকায়। পাঁচ বছরে, সেই প্রথমবার আমার প্রিয়’কে দেখলাম। ছোট ছোট হাত, পা মায়াভরা মুখ। হুবহু আমার প্রতিরূপ। আমারি ছায়া । বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে চাইলাম। অদ্ভুত ভাবে পারলাম না। চোখ ভিজলো না। কোন এক স্বত্বা ভেতর থেকে আটকালো। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘ ওর কাছে যেও না। ও তোমার না, ওই বিশ্বাসঘা*তক, অমানুষটার চিহ্ন ‘ আমি দূরদূর করে সামনে থেকে তাড়িয়ে দিলাম। নিজেকে নিয়ে ভয় হচ্ছিলো, মেয়েটাকে কাছে পেয়ে রাগের বসে, কোন ক্ষ*তি করে ফেলবো না তো? কোনরকম ছুটে আসি সেদিন। এরপর অনেক দিন আবারো মুখোমুখি হই। ওইবার আর প্রথমবারের মত রাগ হয়না তবে রুখা স্বভাব দেখিয়ে এড়িয়ে যাই। এমন ভাবে চলতে থাকে দিন। প্রিয়’র প্রতি মায়া জন্মালেও লুকিয়ে রাখতাম। যার জন্মের পর চেহারা পর্যন্ত দেখতে চাইনি, এতো বছর পর মায়া বাড়ানোর কি দরকার। থাকনা আপনাদের মেয়ে হয়ে মায়া দেখিয়ে কি লাভ! সবকিছু ঠিক চলছিল। অমনি প্রিতী আত্মহ*ত্যা করল। সেখান থেকে প্রিয় মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে, ভেঙ্গে পড়ল। নিজের মেয়ের এমন দুর্দশা দেখতে পারছিলাম না। প্রথমবার মাতৃত্বের অধিকার খাটালাম। নিজের সাথে ইমান্দিপুর নিয়ে আসলাম। ধীরেধীরে সন্তানের প্রতি মায়া ভালোবাসা অনুভব করলাম। ভেবেছিলাম সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে পারবো প্রিয়’কে। আমি ভুল ছিলাম! ইমান্দিপুর এসে প্রিয় আমার পথেই হাঁটল। ভালোবেসে ফেলল শতাব্দকে। শতাব্দ আমার অপছন্দ না, বেশ পছন্দের। কিন্তু আমি চাইনি প্রিয় সেই জ*ঘন্য অতীত, শোয়েবের মুখোমুখি হোক। অনেক বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, পারিনি। শতাব্দ-ই বোধহয় ছিল তার নিয়তি। অমনি একদিন আষাঢ়ের কালো মেঘ হয়ে শোয়েব ইমান্দিপুর এলো। অনেক বছর পর মুখোমুখি হয়ে ভ*য়ংঙ্ক কান্ড বাঁধালো। আমি কোনদিন চাইনি প্রিয়, শোয়েব দুজন দুজনের পরিচয় জানুক। অভিলাষা চেয়ারম্যান সাহেব কেউ এব্যাপারে কারো সামনে মুখ খুলেনি কোনদিন। কিন্তু শোয়েবের আগমনে সব এলোমেলো ঘটলো। সমাজের সামনে নিজের মেয়ের কলঙ্গ রটালো। আমি সবসময় চেয়েছি প্রিয়’র সুন্দর ভবিষ্যৎ হোক। আত্মনির্ভরশীল, আত্মসম্মানবাদী প্রিয় হোক। কিন্তু আমি পারিনি। পারিনি জাফর ভাই! ওই লোকটা এসে তোলপাড় করে দিয়েছে সব। আজ নিজের আত্মসম্মান, মানমর্যাদা হারিয়ে আমি নিঃস্ব। না পারলাম নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে। না পারলাম ভালো মা হতে। মেয়ের মুখে মা ডাক না শোনার আফসোস থাকবে। সেই সাথে শান্তি মিলবে, আমার মেয়েটা তোমাদের কাছে আছে। ভালো বাবা মা আর গোছানো একটা পরিবার পেয়েছে। আমি আপনার চিরকৃতজ্ঞ।চারদিকে এত মিথ্যা অ*পবাদ নিয়ে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। এই মিছে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে, আমি একটু শান্তি চাই। আমার প্রিয়’র খেয়াল রাখবেন। প্রিয় যেন কখনো না জানতে পারে, সে এই অভাগী মায়ের মেয়ে।
ইতি,
আপনার ছোটবোন আয়শা
চিঠি পড়ে হতভম্ব প্রিয়। চোখজোড়া থেকে অশ্রু ঝরছে টপটপ। এতবছর জেনে আসা এই পরিচয়, অস্তিত্ব মিথ্যা সব! সে তার বাবা মায়ের না, শোয়েব হক আর খালার সন্তান! মাথা চক্কর দিলো। থম করে মাটিতে বসে পড়লো। পৃথিবীতে যেই মানুষটাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃ*ণা করে, সেই মানুষটা তার বাবা! তার জন্মদাত্রী মা তাকে দুনিয়াতে আনতে চায়নি। জন্মের পর মুখটা পর্যন্ত দেখেনি। এতটা ঘৃ*ণা করত! এতটা। সে তার মায়ের জন্য অভিশাপ ছিল চিরকাল। মাথা কাজ করছেনা প্রিয়’র পাথর বনে মাটিতে বসে রইল।
রহিমা খালার ফোন পেয়ে, হাসপাতাল থেকে একপ্রকার ছুটে আসলো শতাব্দ। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে প্রিয়। অনেক ডাকাডাকির পরও খুলছেনা। দুয়ারে কয়েকবার করাঘাত করল। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো না কোন। এবার ভয় করতে শুরু করল শতাব্দের।
হন্যহন্য হয়ে ঘরের চাবি খুঁজতে শুরু করল। পেল না। সব চাবি একত্রে বন্ধ ঘরের ভেতরে রাখা। দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকতে, হতভম্ব শতাব্দ। বিছানার পাশে পড়ে আছে রক্*তাক্ত প্রিয়। পাশেই ধারালো ছু*রিটা পড়ে। হাতের কব্জি থেকে গলগল করে র*ক্ত ঝরছে। সেই র*ক্তে ফ্লোর ভিজে। র*ক্তিম মেঝেতে চিঠিটা ভিজে লেপ্টে আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে। কি ঘটেছে বুঝতে বাকি রইল না। দ্রুত পায়ে ছুটে গেল প্রিয়’র কাছে। কাঁপাকাঁপি হাতে ধরতে চাইল। পারছেনা। ভয় হচ্ছে, সে কাঁপছে থরথর। এতএত মানুষকে রক্*তাক্ত দেখেছে। এমন ভ*য়ংকর অনুভূতি হয়নি কখনো। আজ কেন হচ্ছে! তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা র*ক্তাক্ত বলে?
সাহস করে খাবলে ধরল, বুকে জড়িয়ে নিলো প্রিয়’কে। তখনো মৃদু শ্বাস চলছে প্রিয়’র। ঘুটঘুটে অন্ধকারে যেন নিভুনিভু দ্বীপ জ্বলে উঠল। গলা হাঁকিয়ে ড্রাইভারকে ডাকল। দ্রুত গাড়ি বের করতে বলে। প্রিয়’কে পাজকোলে তুলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
ইমার্জেন্সি রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। সারা শরীর র*ক্তে মেখে। চোখেমুখে ভয় আ*তঙ্ক। অধৈর্য হাতপা। ছেলেকে দেখে আঁতকে উঠলেন অভিলাষা। খবর পেয়ে, মেজো ছেলে, ছেলের বউয়ের সাথে ছুটে এসেছে কোনরকম।
শক্তপোক্ত মুখ করে পাথর বনে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। ভেজা চোখ। ধীর পায়ে ছেলের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো অভিলাষা। উষ্কখুষ্ক, অগোছালো চুল। মলিন মুখ। চোখ ভিজে অশ্রু ঝরছে টপটপ। শতাব্দ কাঁদছে!
ছোট থেকেই শতাব্দ খুব বুঝদার। ভীষণ আলাদা রকম ব্যক্তিত্ব! জীবনের অনেক রকম বাজে পরিস্থীতির সম্মুখীন হতে দেখেছে শতাব্দকে। এর আগে অভিলাষা ছেলেকে এমন ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি কখনো। এ কি হাল হয়েছে তার মজবুত, অত্যুগ্র ছেলেটার!
ছেলের কাঁধে হাত রাখল। মায়ের স্পর্শে নড়েচড়ে উঠল শতাব্দ। অস্থির হয়ে পড়ল। চোখমুখ অন্যরকম, দিশাহীন পাগলের মত। বিলাপ সুরে বিড়বিড় করে বলল,
‘ মা, আমার প্রিয়, আমার প্রিয়!’
অঝোরে অশ্রু ঝরছে। অভিলাষা ছেলের চোখ মুছে দিলো। শান্ত করার চেষ্টা করল। বুঝানোর স্বরে বলতে লাগল,
‘ সামান্য চোট, ঠিক..
কথা কাটল শতাব্দ। গলা উঁচিয়ে, গর্জন করে বলল,
‘ সামান্য? কত খানি কেটেছে। কত র*ক্ত ঝরেছে। প্রিয় সামান্য কেউ না। ও আমার কাছে অসামান্য। ওকে ছাড়া আমার চলবেনা। ম*রে যাবো মা।’
বুঝদার ছেলেটার এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল অভিলাষা। হতভম্ব, বিমূঢ় চেয়ে রইল। প্রিয় শতাব্দের দুর্বলতা মানতো।তবে, প্রাণভোমরা যে তা জানতো না! প্রিয়’র কিছু হলে বাঁচবেনা শতাব্দ। ম*রে যাবে তার ছেলেটা।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘আপা’ ডেকে হাউমাউ করে কাঁদছে প্রভা। বুকে জড়িয়ে সামলাতে চেষ্টা করল সমুদ্র।
আমেনা বেগম এক কোনায় বসে। স্রষ্টার কাছে হাত তুলে অঝোরে বিলাপ করছে। ভিক্ষা চাইছে মেয়ের জীবন। জাফর সাহেব শক্ত দাঁড়িয়ে ঠাঁই। মনে মনে নিজেকে নিজে বারেবারে প্রশ্ন করছে,
‘ বেঁচে যাবে তো আমার মেয়েটা!’
গভীর রাত। বাহিরে সবাই। প্রিয়’কে আইসিইউতে শিফট করেছে। শরীর থেকে অনেক র*ক্ত ক্ষয় হওয়ায় অবস্থা জটিল। জ্ঞান ফেরার আগ অবধি ডাক্তাররা ঠিকঠাক বলতে পারছেনা কিছু। অঘটন ঘটার আশংকা আছে এখনো। রুমের সামনে থম মেরে বসে আছে শতাব্দ। শুকনো চোখ মুখ। মোবাইল বেজে চলছে অনবরত। ধ্যান ভাঙলো শতাব্দের। ফোন রিসিভ করে কানে ধরল। অপর পাশ থেকে কিছু বলল। শতাব্দ চুপ। উত্তর দিলো না। অপর পাশ হতে অস্থির, উৎকণ্ঠা আওয়াজ। খানিক নীরব থেকে। শতাব্দ নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,
‘ আমি পরাজিত। রক্ষা করতে পারিনি তাকে। আমার খামখেয়ালিতে, আমার প্রিয় মৃ*ত্যুর সাথে লড়াই করছে।’
প্রচন্ড আওয়াজ হয়ে ফোনটা সংযোগ বিছিন্ন হলো। ফোনের অপর প্রান্তে টুট, টুট আওয়াজ ভাসছে।
চলবে………..
ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )
৪০.
( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
নিকষ কালো রাত কাটিয়ে এক উজ্জ্বল ভোরের উদয় হলো। চারদিকে ঝলমলে আলো। ব্যস্ত শহর, যানবাহনের ঘটঘট আওয়াজ। ভোর রাতের দিকে জ্ঞান ফিরেছে প্রিয়’র। চোখ মেলে চাইছে না কারো দিকে। হাউমাউ করে কান্না করছে। হাতের ক্যানোলা টেনে খুলে বারিয়ে যেতে চাইছে। ডাক্তার এসে ই*ঞ্জেকশন দিয়ে কোন রকম শান্ত করেছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে এখন। গত রাত থেকে শতাব্দ একটু নড়েনি। হাত ধরে ঠাঁই বসে আছে প্রিয়’র পাশে। অনড় চেয়ে আছে প্রিয়’র নিষ্প্রাণ মুখখানায়। পৃথিবীতে দুই ধরনের সত্যি আছে। এক, যা দুর্বলকে শক্ত বানায়।দুই, যা শক্ত মানুষকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।
দুপুরের দিক পুরোপুরি জ্ঞান ফিরল প্রিয়’র। চোখ খুলে বাবাকে পাশে দেখলো। সাথেসাথে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। মেয়ের মাথায় জাফর সাহেব হাত বুলিয়ে দিলেন। পাহাড় সমান ভারী হয়ে আছে বুক। মেয়ের অসুস্থ মলিন মুখখানা দেখে বুকটা কেঁপে উঠল। ছোট থেকে ভীষণ আদর আহ্লাদে বড় করেছে মেয়েকে। প্রিয় অন্যকারো মেয়ে কখনো কিঞ্চিত টের পেতে দেয়নি তাকে। জাফর সাহেব আলতো স্বরে ডাকলো। বলল,
‘ বাবার দিক তাকাবিনা মা?’
প্রিয়’র বন্ধ চোখের কোণ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। গম্ভীর জাফর সাহেব। খানিক চুপ থেকে আবারো বললেন,
‘শুধু জন্ম দিয়েই কি বাবা হওয়া যায়। র*ক্তের সম্পর্ক সব! আত্মার সম্পর্ক কিছুনা? তুই আমার মেয়ে। আমাদের প্রিয়। এটাই একমাত্র সত্য বাকি সব মিথ্যা!’
বাবার কথায় হুহু করে কেঁদে উঠল প্রিয়। পাশ ফিরে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। কান্নার বেগ আরো বাড়ল। আমেনা প্রভা কাছে এসে প্রিয়’কে শান্ত করার চেষ্টা করল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলো আমেনা। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
‘ এই দুহাতে আদর আহ্লাদ ভীষণ যত্নে করে তিলেতিলে মানুষ করেছি তোকে।তুই আমার মেয়ে। আমার প্রিয়। পৃথিবীর যেইকোন সত্যই হোক না কেন! এই সত্যের সামনে সব পরাজিত।’
প্রভা বলল,
‘ তুমি কার মেয়ে, কার কি তাতে আমার কিছু আসেযায় না। তুমি আমার প্রিয় আপা।’
মা বাবা বোনের এমন কথায় প্রিয়’র কান্নার বেগ আরো বাড়ল। অঝোরে কান্না করছে প্রিয়। চোখের জলের সাথে মনের চাপা কষ্টটা টেনেহিঁচড়ে বের করে দিচ্ছে।
ক্যাবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে শতাব্দ। শরীরে গতরাতে সেই র*ক্তমাখা শার্টটা। উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল। চোখেমুখে বিস্তর ক্লান্তি ছড়িয়ে। তবুও ঠাঁই দাঁড়িয়ে। অভিলাষা ছেলের কাঁধে হাত রাখলো। মৃদু আওয়াজে বলল,
‘ জ্ঞান ফিরেছে, ভিতরে যাবিনা।’
শতাব্দের অনড় চাহনি তখনো মুখপানে প্রিয়’র। অনুভূতিহীন নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,
‘ ওর মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস নেই আমার।’
ঝটপট পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। অভিলাষা ছেলের যাওয়ার পথে চেয়ে রইল। তাদের মধ্যেকার এই বিশাল দুরত্ব মিটবে কি আদৌ!
দুইদিন হলো প্রিয়’কে হাসপাতাল থেকে ছেড়েছে। ইমান্দিপুর ফিরে যায়নি অভিলাষা। প্রিয়’র কাছে আর কিছুদিন থাকবে বলে ঠিক করেছে। সমুদ্র প্রভাও এখানেই আছে। শতাব্দ ডাক্তারিতে ব্যস্ত, শাদ এখনো পড়াশোনা করছে। তাই বাবার ঢাকার ব্যবসার হাল সমুদ্রকেই ধরতে হচ্ছে। মাস খানেক পর এই বিল্ডিং’এর পাঁচতলার খালি এপার্টমেন্টে উঠছে। এপার্টমেন্ট কেনা হয়েছে অনেক আগেই। এখন আপাতত গোছগাছের কাজ চলছে।
বাড়ি ফেরার পর থেকে প্রিয় আগের মতই আলাদা ঘরে উঠেছে। অভিলাষা, প্রভা কেউনাকেউ সবসময় সাথে থাকছে। সেই দিনের ঘটনার পর প্রিয় শতাব্দের কথা হয়নি আর। দুজন দুজনকে খুব সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে চলছে। যদিও নিজের দায়িত্ব কর্তব্য জ্ঞান থেকে বিন্দুমাত্র নড়েনি শতাব্দ। প্রিয়’র প্রতিটা প্রয়োজন অপ্রয়োজনের ঠিক খেয়াল রাখছে। প্রিয়’র ভালো লাগা, খারাপ লাগা সবদিকে লক্ষ করছে। কিন্তু কাছে যেয়ে অধিকার খাটানোর জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছে।
তাদের দূরত্বের ব্যপারটা চোখ এড়ায়নি অভিলাষার। এনিয়ে প্রিয়’র সাথে খোলামেলা কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। খানিক স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় আছে তার।
দুপুরের কাঠফাটা গরম মাড়িয়ে, বিকালের অনুজ্জ্বল আলোয় চারিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রোদের তাপ অনেকটাই কমে এসেছে। ঢুলে পড়া সূর্যের র*ক্তিম আলো এসে চোখেমুখে লাগছে। বই উঁচিয়ে মুখের সামনে ধরল প্রিয়। রোদের তীব্র ঝলকানি থেকে চোখ বাঁচাতে চাইল। অমনি কারো পায়ের আওয়াজে পেয়ে পিছনে ফিরল। অভিলাষা এসেছে। চায়ের ট্রে হাতে।
প্রিয় মৃদু স্বরে বলল,
‘ আপনি কষ্ট করে চা করতে গেলেন কেন! আমাকে বলতেন আমি করে দিতাম।’
ঠোঁট মেলে হাসলো অভিলাষা। কাপে চা ঢেলে প্রিয়’র দিক এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ চা বানানো কষ্টের কি কাজ। এখানে বসে খেয়ে হাতপা জং ধরে যাচ্ছে আমার।’
মৃদু হাসলো প্রিয়। বইয়ের দিক মন দিলো। অভিলাষা জিজ্ঞেস করল,
‘ পরিক্ষা চলছে নাকি?’
‘ না, সামনে ফাইনাল তাই আগের থেকে একটু একটু করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। এমনিতেও অনেক বেশি গ্যাপ পড়ে গেছে।’
প্রিয়’র সাবলীল উত্তর। খানিক চুপ করে রইল অভিলাষা।কিছু একটা ভেবে বলল,
‘ তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। ফ্রি আছো?’
মুখের সামনের থেকে বই সরিয়ে নড়েচড়ে বসলো প্রিয়।অভিলাষার গম্ভীর চোখমুখ দেখে, ধীর আওয়াজে বলল,
‘ জি আন্টি জরুরী কিছু!’
অভিলাষা মাথা নাড়াল। খানিক চুপ থেকে নীরবতা ভেঙ্গে বলতে লাগলো,
‘ছোট থেকেই আমার ছেলেটা স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড। ভীষণ জেদি। কোন কিছু মাথায় ঢুকলে তা সম্পন্ন না করা অবধি ক্ষান্ত হবেনা সে। ওর সমবয়সী ছেলেরা যেই বয়সে ড্রাইভিং সিটে বসার সাহস পায়না! সেই বয়সে তুখোড় গাড়ি চালায় সে। এগারো বছর বয়স থেকে গাড়ি চালাচ্ছে। জানি বিশ্বাস হচ্ছে না! কিন্তু সত্যি। আমার শত নিষেধ অমান্য করে গাড়ি চালানো শিখেছে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তার বড্ড ঝোঁক। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলো! আমার কাছে এসে’ তোমাকে চাইল’।সেদিন ছেলের এমন আবদারে হতভম্ব ছিলাম। কথা দিয়েছিলাম, ঠিক সময়ে তাকে তার প্রিয় জিনিসটা এনে দিবো। কারণ আমি জানতাম কারো নিষেধ অমান্য গুনবেনা সে। আবদার অমান্য করলে আরও ক্ষেপে যাবে! আপোষে হোক বা জোর করে ঠিক আদায় করে নিবে তোমাকে।’
প্রিয় চুপ।অভিলাষা আবার বলতে শুরু করল,
‘ আমার অবশ্য এতে অমত ছিলোনা কখনো। অনেক আগে থেকেই তোমাকে পছন্দ ছিল আমার। আয়শাকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে পারিনি। তা নিয়ে সবসময় একটা অপ*রাধবোধ অনুশোচনা কাজ করতো আমার। নিজের কাছে রেখে তার আংশিক ক্ষয় পূরণ করতে চাইছিলাম। যেদিন তোমার জন্ম হলো, হাসপাতালে কোলে তুলে নিজের কাছে নিজে কথা দিয়েছিলাম। একদিন তোমাকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলব আমার। যা আয়শার জন্য করতে পারিনি, সেই সব অপূর্ণ ইচ্ছা গুলোকে তোমার জন্য পূর্ণ করব। আয়েশার কাছে বহুবার হাত চেয়েছি তোমার। শতাব্দকে এমনি পছন্দ করলেও বিয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতে নারাজ। আয়েশা কখনোই চায়নি অতীতের মুখোমুখি হও তুমি। যেইদিন রাতে শোয়েব ভাই ওই বিশ্*রী কান্ড ঘটালো। তার পরেরদিন সকালে ঢাকায় ফিরে যায় শতাব্দ। তোমার বাবার সাথে সরাসরি দেখা করে তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখে। শালি আর এক মেয়ের করুণ পরিনতি দেখে হয়তো ঘাবড়ে ছিলেন জাফর ভাই। ঠুকরে দেয় শতাব্দের প্রস্তাবকে। বলে দেয় কালো অতীতের সেই রহস্যগুলোকে। সেই সাথে হাত জোর করে ওয়াদা নেয় শতাব্দ যেন এসব কোনদিন জানতে না দেয় তোমাকে। এটাও বলে যে, ঠিক সময় তোমাকে তার হাতে তুলে দিবে। নিজের সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি যখন শতাব্দের কাছে এসেছিলে, বুকে পাথর রেখে তোমার বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল তোমাকে। ওর ভয় ছিল কখনো সত্যি জেনে ঘৃ*ণা করবেনা তো তাকে? ভাগ্যের পরিহাসে তার সবচেয়ে বড় ভয়টাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। আয়শার মৃ*ত্যুর কারণ জড়িয়ে তুমি ঘৃ*ণা করতে শুরু করলে। আমার ছেলেটা ভেঙ্গে পড়েছিল। ক্ষণে ক্ষণে তপ্ত আগুনে পু*ড়তো। তার বাহিরের শক্ত ব্যক্তিত্ব দেখে অন্যকেউ টের না পেলেও, ওর ভেতরের তপ্ত আগুনের তান্ডব আমি ঠিক বুঝতাম। মা যে তাই হয়তো চোখে পড়তো। এতটা বছর আমার ছেলে ভালো ছিলনা। তোমাকে না পাওয়ার আক্ষেপে ভেতরে ভেতরে নিজেকে জ্বা*লিয়ে পু*ড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছিল।শুধু তোমাকে পাওয়ার জন্য শেষমেশ তার অপছন্দের নোং*রা রাজনীতিতেও হাত ডোবাল।’
প্রিয় তখনো চুপ। চোখজোড়া ছলছল। অভিলাষা আবার বলল,
‘ আমি তোমাকে অনেক বেশি স্ট্রং ভাবতাম। আফসোস আমার ছেলের এতবছরের অপেক্ষা দুরত্ব বিফল হলো। ও ভয়ে আড়ালে রইল তুমি সেই অঘটন ঘটালে প্রিয়। তোমার এই শক্তপোক্ত আচরণ নিতান্তই ঠুনকো। ভেতর থেকে তুমি এখনো সেই আগেকার দুর্বল প্রিয়’ই রয়ে গেছ। তবে তোমাকে একটা কথা অবশ্যই বলবো। নারীকে কেউ কখনো ভালোবাসে না। হয়তো তার রুপের মোহে জড়ায়, নয়তো গুনের অতলে গড়ায়। যদি কখনো কোন পুরুষ কোন নারীর আত্মাকে ভালোবাসে তাকে আগলে রাখতে হয় প্রিয়। নয়তো একদিন গুড়িয়ে যায় সব! তখন কপাল হাতিয়ে কেঁদে লাভ হয়না কোন। বাকিটা তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, ভালো বুঝবে।’
অভিলাষা চলে গেল। থম মেরে বসে রইল প্রিয়। অশ্রু ঝরছে টপটপ। মনে প্রশ্ন হাজারো। চারিদিকে সবকিছু এতো এলোমেলো অগোছালো কেন! তার ভেতরের ব্যপারটা কাউকে কি করে বুঝাবে। কি রকম ভয়*ঙ্কর অন্ধকার অতলের গোলকধাঁধায় ফেঁসে আছে সে।
শতাব্দের বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা বাজল। বাড়ি এসে প্রথমে প্রিয়’র ঘরে উঁকি দিলো। অন্ধকারে ডুবে আছে ঘর। ঘুমিয়ে গেছে? হয়তো। সামনের দিক পা বাড়াল না আর। নিজের ঘরের আলো জ্বালাতে চমকে গেল। বিছানার পাশে গা এলিয়ে চোখ বুজে আছে প্রিয়। তীব্র আলো চোখে পড়তে নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। আধোঘুমে চোখ খুলে শতাব্দকে দেখলো। হাত ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখছে। প্রিয়’কে দেখেও, দেখল না যেন শতাব্দ। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল,
‘ শরীর কেমন লাগছে? রাতের খাবার খেয়েছ?’
শতাব্দের দিক বিমূঢ় তাকিয়ে রইল প্রিয়। একবারের জন্যও তার দিক তাকাচ্ছে না শতাব্দ। হাসপাতাল থেকে লক্ষ করছে শতাব্দ তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। প্রিয় উত্তর দিলো না কোন। শার্ট পাল্টে ফ্রেশ হয়ে এলো শতাব্দ। প্রিয়’র মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসল। চোখেচোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে? এত রাতে এখানে কেন।’
শতাব্দের চোখ চোখ রেখেই উত্তর দিলো প্রিয়,
‘ আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।’
‘ বলো, শুনছি!’
প্রিয় খানিক চুপ রইল। নিশ্বাসের গতি বাড়ছে তার। অদ্ভুত এক ভয় কাবু করছে মন। আশেপাশে চেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। বড় বড় শ্বাস টেনে বলল,
‘ খালা মা*রা যাওয়ার রাতে আপনি ইমান্দিপুর এসেছিলেন কেন?’
হতভম্ব শতাব্দ। এতবছর পর সেই রাতের কথা তুলছে কেন প্রিয়? আর সেই রাতের কথা ও’ইবা কি করে জানলো। শতাব্দ গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ তোমার কি মনে হয়? কেন গিয়েছিলাম?’
এমন উত্তরের আশা করেনি প্রিয়। অধৈর্য হয়ে পড়ল। চোখজোড়া টলমল করছে। অস্থির, অধৈর্য কন্ঠে বলল,
‘ আমার কি মনে হয় তাতে কিছু আসেযায় না! এই লুকোচুরির খেলা আমি আর নিতে পারছিনা। সত্যিটা শুনতে চাই। গত দুই বছর ধরে প্রতি মুহূর্ত ছটফট করছি এই উত্তরের আশায়। সেই রাতে কেন ছাদের দরজা দিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছিলেন? ভেতরে দুই- দেড় ঘন্টা কি করছিলেন? কেন ছিলেন? তার পরেরদিন কাজের খালাকে ভয় দেখিয়ে টাকা দিয়ে কেন গ্রাম ছাড়া করেছিলেন?’
শতাব্দ গম্ভীর। ঠান্ডা আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুমি এসব কি করে জানো?’
রাগে ফেটে পড়ল প্রিয়। নিজের রাগ দমানোর যথাযথ চেষ্টা চালাল। খানিক সময় নিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল,
‘ দুবছর আগে ঢাকার বাহিরে ফটোশুট ছিল আমার। সেখানে অপ্রত্যাশিত ভাবে কাজের খালার সাথে দেখা হয়। প্রথমে আমাকে দেখে পালাতে চেষ্টা করছিল। আমি আশ্বস্ত করি, তাকে বুঝাই। পরবর্তীতে তিনি সবকিছু খুলে বললেন আমায়। সেই থেকে আপনার খোঁজখবর নেই। জানতে পারি অনেক দিন ধরে আমার উপর নজর আপনার। বাবার সেই জুনিয়র বন্ধুও আপনি। আপনার কি ধারণা আপনি আমার উপর নজর রাখছিলেন? বাবাকে দিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করেছেন। এখনকার দিনে কোন মেয়ে না জেনে, না শুনে কেউ কাউকে বিয়ে করবে এটা কি আদৌ সম্ভব!
উহু, আমি নিজের ইচ্ছায় আপনাকে বিয়ে করেছি। আমি জাল ফেলেছি আপনি ধরা দিয়েছেন। সত্যটা খোঁজার চেষ্টা করেছি। পারছিনা আর। এখন আমার উত্তর চাই! কেন করেছেন এসব?’
শতব্দের বিস্মিত চাহনি। চাপা রাগের শক্ত আওয়াজ,
‘ তোমাকে বলতে আমি বাধ্য নই।’
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল প্রিয়’র। চিৎকার করে বলল,
‘ আপনি অবশ্যই বাধ্য। সেই রাতে যেই মহিলা মা*রা গেছে অনাঙ্ক্ষিত ভাবে তিনি আমার মা! উনার সাথে কি ঘটেছে। কি হয়েছে তা শুনতে চাই আমি। আর আপনি বলতে বাধ্য!’
শতাব্দ চুপ আগের মতই গম্ভীর, রাশভারী। উত্তরের অপেক্ষা করল প্রিয়। শতাব্দের কোন জবাব না পেয়ে। ঠান্ডা, শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমি ধরে নিবো আমাকে পাওয়ার জন্য, পথের কাটা সরাতে আপনি উনাকে খু*ন করেছেন!’
আ*হত দৃষ্টিতে তাকাল শতাব্দ। গভীর কন্ঠে আওড়াল,
‘ এই তোমার বিশ্বাস?’
‘ আপনি ভাবতে বাধ্য করছেন আমায়।’
‘ তুমি যেহেতু মেনে নিয়েছ। কোনকিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই আর।’
‘ সত্যিটা শুনতে চাই!’
শতাব্দ রাগে চেঁচিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলল,
‘ তোমাকে বলতে বাধ্য নই।’
শতাব্দের দিক অনড় চেয়ে রইল প্রিয়। চোখজোড়া থেকে অঝোরে পানি ঝরছে। বুক যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল প্রিয়। কান্নাভেজা শক্ত কন্ঠে বলার চেষ্টা করল,
‘ সত্যিটা জানতে আমি আপনার কাছে এসেছি। কোথাও কিঞ্চিৎ আশা ছিল, ভুল প্রমাণিত হবো। যদি আমার সন্দেহ-ই সঠিক হয়। তবে বিচ্ছেদ চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স দিয়ে মুক্ত করে দিন আমাকে!’
শতাব্দ তেতে উঠল। লা*থি দিয়ে চেয়ারটা দূরে ছুড়ে ফেলল। প্রিয়’র বাহু ধরে বিছানায় ফেলে। উপরে উঠে গেল। প্রিয়’র দিক ঝুঁকে মুখ চেপে শক্ত কন্ঠে বলল,
‘এতবছর আড়ালে থেকেছি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে এনে, শান্ত স্বাভাবিক ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছি। তোমাকে সময় দিয়েছি ভেবেছিলাম বুঝদার হবে তুমি। ভুল ছিলাম। তুমি আপোষে মানার পাত্রী নও। আমি এখনো সেই পুরানো শতাব্দই আছি। আমাকে রাগিয়ে দিলে তোপ সামলাতে পারবেনা তুমি। ডিভোর্সের কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলো। একটু ভাবো, যেই মানুষটা তোমাকে পেতে এতটা হিং*স্র হয়েছিল। তোমাকে কাছে রাখতে সেই মানুষ কতটা হিং*স্র হতে পারবে!’
চলবে……