#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ছোয়া ভার্সিটি থেকে হোস্টেলে ফিরে আসে। বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। তাই জানালার পাশে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। এমন সময় তার ফোনের সাইরেন বেজে ওঠে। ছোয়া টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে সেটা রিসিভ করে। ছোয়ার বাবা শাহাদ হোসেন কল দিয়েছেন। ছোয়া ফোনটা রিসিভ করে প্রথমে সালাম দেয়। শাহাদ হোসেন সালামের জবাব দিয়ে বলেন,
‘কি করছিস মা? ভালো আছিস তো?’
‘জ্বি,আব্বু। আমি ভালো আছি। তুমি ভালো আছ তো? ঠিকঠাক বাড়ি পৌছেছ?’
‘আমি ঠিকই আছি। তুই মনযোগ দিয়ে পড়ছিস তো? শুনে রাখ মা, তোকে কিন্তু ভালো করে পড়তে হবে। আমার স্বপ্ন আমি তোকে নিজের পায়ে দাড়াতে দেখব। আমার এই স্বপ্নটা কিন্তু তোকে পূরণ করতেই হবে।’
ছোয়া নরম স্বরে বলে,
‘জ্বি, আমি নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার স্বপ্ন পূরণ করার।’
শাহাদ হোসেন বললেন,
‘মনে রাখবি ছোয়া জীবনে যতো বিপদ আপদই আসুক নিজের পড়াশোনা কখনো বন্ধ করবি না। আমি থাকি বা না থাকি তুই কিন্তু নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাবি। মনে রাখবি, আমি যেখানেই থাকি না কেন তোকে নিজের পায়ে দাড়াতে দেখলেই আমি সব থেকে বেশি খুশি হবো।’
ছোয়া এবার একটু অভিমান করে বলে ,
‘এভাবে কেন বলছ আব্বু? তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবে। আমার কত ইচ্ছা বলো তো, আমি নিজে চাকরি করে নিজের বেতনের টাকায় প্রথমে তোমাকে একটা পাঞ্জাবী কিনে দেব, ছোটবেলা থেকে তুমি যেমন আমার সব আবদার পূরণ করেছ, তেমনি আমিও তোমার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো পূরণ করব।’
শাহাদ হোসেন নিজের মেয়ের এমন কথা শুনে বললেন,
‘এক জীবনে মানুষের সব ইচ্ছা যে পূরণ হয় না মা। তবে আমার তোর উপর বিশ্বাস আছে, আমি জানি তুই কখনো এমন কোন কাজ করবি না যাতে আমার মাথা নিচু হয়। আর হ্যা, আমার কিছু হয়ে গেলে নিজের মায়ের খেয়ালও কিন্তু তোকেই রাখতে হবে।’
ছোয়ার অভিমানের পাল্লা এবার বৃদ্ধি পায়। সে কাদোকাদো কন্ঠে বলে,
‘এমন কথা বলো না আব্বু। এভাবে কথা বললে কিন্তু আমি আর তোমার সাথে কখনো কথা বলব না।’
শাহাদ হোসেন বলেন,
‘আচ্ছা ঠিক আছে মা, আমি আর এমন কথা বলব না। তুই শুধু আমার কথাগুলো মনে রাখিস। আল্লাহ হাফেজ।’
শাহাদ হোসেন কলটা কে’টে দেন। ছোয়া নিজের ফোনটা পুনরায় টেবিলে রেখে দিয়ে জানালার সামনে এসে দাড়ায়। তার বাবার বলা কথাগুলোর জন্য তার কেমন যেন লাগছিল। যার কারণে তার মনটা কেমন অশান্ত হয়ে ওঠে।
৭.
রাত সাড়ে ১২ টার দিকে ছোয়ার ফোন পুনরায় বেজে ওঠে। ছোয়া সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করে একটু ঘুমোতে গিয়েছিল। কাচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ছোয়া ধড়পড় করে বিছানা থেকে ওঠে। অতঃপর ফোনটা রিসিভ করে।
ফোন রিসিভ করা মাত্রই বিপরীত দিক থেকে কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। ছোয়ার মনটা আনছান করে ওঠে। বিপরীত দিক থেকে কেউ আহাজারি করে কাদছিল। ছোয়া গলার স্বর শুনে বুঝতে পারে এটা তার মায়ের গলা। ছোয়া উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
‘কি হয়েছে আম্মু? তুমি এভাবে কাদছ কেন?’
ছোয়ার মা মতিয়া বেগম বলে ওঠেন,
‘তোর আব্বা খুব অসুস্থ রে। আমি কি করমু, কিছু বুঝতে পারতাছি না। আশেপাশের কয়েকজন প্রতিবেশীরে ডাইকা এহন তারে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তুই কাল সকাল সকাল চলে আসিস ছোয়া।’
নিজের বাবার অসুস্থতার কথা শুনে ছোয়ার বুক কেপে ওঠে। বিকেলে তার বাবার বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। যা ছোয়ার অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়। ছোয়া তখনই হাউমাউ করে কাদতে শুরু করে দেয়। হোস্টেলে ছোয়ার রুমমেট মেঘলা নামের একটি মেয়ে। ছোয়ার কান্নার শব্দ শুনে মেয়েটির ঘুম ভেঙে যায়।
ছোয়া ততক্ষণে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিয়েছে। মেঘলা নামের মেয়েটি ছোয়াকে এভাবে ব্যাগ গোছাতে দেখে বলে,
‘এত রাতে এভাবে ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন তুমি? কোথাও যাবে নাকি?’
ছোয়া কান্নাভেজা গলায় বলে,
‘আমার আব্বু খুব অসুস্থ। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে তার কাছে।’
মেঘলা নামের মেয়েটি নিজের ফোনে সময় দেখে বলে,
‘এখন রাত ১২ টা পেরিয়ে গেছে। এত রাতে একটা মেয়ে হয়ে তুমি একা কিভাবে যাবে? তাছাড়া বাইরে তো বৃষ্টিও হচ্ছে।’
ছোয়া অসহায় গলায় বলে,
‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। আব্বুর কাছে না গেলে আমি শান্তি পাবো না।’
‘তাই বলে এত রাতে একা যাবে? এই শহরে তোমার কোন রিলেটিভ নেই? থাকলে তাদের কল করো।’
ছোয়ার মাথায় তার চাচার চিন্তা আসে। কিন্তু তাকে কল করবে কিনা এই নিয়ে দ্বিধায় ছিল। তবে এই বিপদের সময়ে আর বেশি কিছু ভাবল না। কল করল নিজের চাচা আব্দুল হোসেন কে। আব্দুল হোসেন ফোনটা রিসিভ করতেই বললেন,
‘ছোয়া তুই ঠিক আছিস তো? তোর আব্বুর অসুস্থতার ব্যাপারে শুনলাম। আমি আর তোর বড় মা ইতিমধ্যে হাসপাতালের দিকে রওনা দিয়েছি।’
ছোয়া বলে,
‘আমিও যেতে চাই আব্বুর কাছে। প্লিজ তোমরা আমাকেও নিয়ে যাও।’
আব্দুল হোসেন বলেন,
‘আমরা তো অনেক দূর চলে এসেছি। আচ্ছা দাড়া আমি আমানকে বলছি। আমান বাড়িতেই আছে। ও এখন গিয়ে তোকে নিয়ে আসবে।’
আমানের আসার কথা শুনে খুব একটা খুশি হয়না ছোয়া। কিন্তু এই বিপদের সময়ে আর বেশি কিছু ভাবার মতো অবস্থায় নেই সে।
৮.
আমান গাড়ি নিয়ে ছোয়ার হোস্টেলের বাইরে দাড়িয়ে আছে। একটু পরেই ছোয়া নিচে নেমে আসে। ছোয়ার দিকে এক পলক তাকিয়েই আমান বুঝতে পারে মেয়েটা এখন কতটা ভেঙে পড়েছে। ছোয়া পিছনের সিটে বসতে চাইলে আমান বলে,
‘তুই সামনে এসে বস।’
দুরুক্তি করল না ছোয়া। আমানের পাশেই বসে পড়ল। আমান গাড়ি চালানো শুরু করল। ছোয়া নিজের কান্না অব্যাহত রেখেছিল। কোন মেয়েই বা বাবার অসুস্থতার কথা শুনে স্বাভাবিক থাকতে পারে।
আমান ছোয়াকে শান্তনা দিয়ে বলে,
‘কাদিস না ছোয়া। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু হবে না তোর বাবার।’
ছোয়ার উপর এসব কথার কোন প্রভাব পড়ছিল না। সে শুধু তার বাবার কথাই ভাবছিল।
কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে হাসপাতালে পৌছে যায় ছোয়া ও আমান। ছোয়া গাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে দৌড়ে হাসপাতালের ভেতরে চলে যায়। আমানও তার পেছনে দৌড় দেয়।
ছোয়া হাসপাতালে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ পর নিজের মাকে দেখতে পায়। মতিয়া বেগম তখন শব্দ করে কাদছিলেন। ছোয়া তার সামনে যেতেই মতিয়া বেগম ছোয়াকে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করে বলে,
‘তোর আব্বা আর নেই রে। তুই আসতে দেরি কইরা দিলি। তোর আব্বা আমাদের ফাকি দিয়ে চলে গেছে রে।’
কথাগুলো যেন তীরের মতো বিধছিল ছোয়ার কানে। তার বাবা আর বেচে নেই এই কথাটা তার কাছে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না।
আমান আব্দুল হোসেনের সামনে এএ দাড়ায়। আব্দুল হোসেন বলে,
‘এক ঘন্টা আগেই ছোয়ার বাবা মারা গেছে। তোমরা রাস্তায় ছিলে জানি তোমাদের জানানো হয়নি।’
আমান ছোয়ার দিকে তাকায়। সারা রাস্তা পাগলের মতো কান্না করা মেয়েটা এখন কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে।
ছোয়া তখনো ঘোরের মধ্যে ছিল। তার বাবার বলা শেষ কথাগুলো তার কানে বাজছিল। সামনে তাকাতেই সাদা কাপড়ে মোড়ানো নিজের বাবার মৃতদেহ দেখে ছুটে যায় ছোয়াকে। শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে নিজের বাবাকে। অতঃপর বলে,
‘তুমি আমাকে এভাবে ছেড়ে গেলে আব্বু। কিন্তু তোমার বলা শেষ কথাগুলো আমি ভুলব না। তোমার ইচ্ছা আমি অবশ্যই পূরণ করবো,,,,,ব্যাস তুমি শুধু একবার ফিরে এসো আমার কাছে,, আব্বু’
ছোয়া আবার ডুকরে কেদে ওঠে। আমানের মা জান্নাতুল খাতুন তাকে এসে সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ছোয়াকে সামলানো এখন সহজ নয়। কারণ তার মাথা থেকে বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়া সরে গেছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
>>আসসালামু আলাইকুম। গত পর্বে একটা ভুল হয়ে গেছিল। আমানের মায়ের নাম জান্নাতুল খাতুন ছিল আর ছোয়ার মায়ের নাম মতিয়া বেগম কিন্তু গত পর্বে ভুল করে আমানের মায়ের নাম মতিয়া বেগম দিয়েছিলাম। আর এই পর্বের ব্যাপারে সত্যিই কিছু বলার নেই। আমি নিজেও প্রচুর ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল বাবা ✨