#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১৬]
নন্দিনীর মাথার কাছের লম্বা জানালায় দুপুর গড়িয়ে বিকেলগামী আলসে রোদের অম্লান পরশ খেলে যাচ্ছে। সেখানে চুল মেলে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে। পায়ের কাছে রাখা ফোনটা নিঃশব্দে কেঁপে কেঁপে থেমে যাচ্ছে। স্ক্রিনের উজ্জ্বল আলোটা দপ করে জ্বলে কাঙ্ক্ষিত মালিকের অবহেলায় আবার নিভে যাচ্ছে। পালক রুমে এসে খেয়াল করে বলল,
“তোমার ফোন বাজছে।”
নন্দিনী অবহেলায় একপলক তাকাল স্ক্রিনে। আবারও নজর ফিরিয়ে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল। সাড়া পাবে না জেনেও ঘন ঘন ফোন আসার কারণটা নন্দিনী আন্দাজ করতে পারছে। তার বড়ো বোনের ঘরে তৃতীয় সন্তান এসেছে। খবরটা পায়েল সকালেই তাকে অবগত করেছে। সংবাদটা কেন জানি তাকে সামান্যতম পুলকিত করতে পারেনি। আর না ভাবান্তর ঘটাতে পারছে ক্রমাগত ফোনের অস্থিরতা। কেন জানি মনে হচ্ছে খুলনা থেকেই কলটা আসছে। অনুভবকে বারন করা উচিত ছিল তার নাম্বারটা পায়েলকে যেন না দেয়।
বিগত বছরগুলোর দূরত্বে নন্দিনী এখন পরিবারের সদস্যদের মুখটাও স্পষ্ট মনে করতে পারে না। মায়া, আবেগ, অনুভূতির ওপর তার বরাবরই উদাসীনতা। যার ফলে এক্সদের নিকট হৃদয়হীনা, নিষ্ঠুর নামবিশেষ্য পেয়েছে বহুবার। পাষাণ বলে ভর্ৎসনা পেয়েছে কাছের মানুষদের থেকেও। গায়ে লাগে না। এই যে ক্রমাগত ফোনকল বেজে চলেছে। উপেক্ষা করলে কী হবে? কঠিন বিশেষ উপমাগুলো নামের সঙ্গে আরেকটু পাকাপোক্ত হবে। তাতেই বা কী আসে যায়? আব্বা আম্মার কাছে সে বরাবর বখে যাওয়া একটি মেয়ে ছিল।
নন্দিনী গা ঝারা দিয়ে উঠল। ফোন আসা বন্ধ হয়েছে। নামতে গিয়ে খেয়াল করল পালক সারা বিছানায় সাজগোজ ঢেলে বসেছে। জিজ্ঞেস করল,
“আবারো আড়ালে-আবডালে যাওয়ার পরিকল্পনা চলতাছে নাকি?”
পালক লাজুক হেসে বলল,
“ওর ভাই-ভাবী আমাকে দাওয়াত করেছে। দেখা করতে নিয়ে যাবে। উনারা যদি পটে যায় তবে বিয়েটা নিশ্চিত, বুঝেছ। তাই স্পেশাল করে সাজতে হবে আজ।”
“হলেই ভালো।”
নন্দিনী চলে যাচ্ছিল, পালক পিছু ডেকে বলল,
“তোমাকে ফারদিন ভাই ডেকেছিল।”
নন্দিনী ভ্রু কুচকাল। তার সদ্য গালে খা’মচি খাওয়া এক্সের বন্ধু ফারদিনের আবার কীসের দরকার পড়ল? নন্দিনী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে সাজাতে সে ভীষণ ভালোবাসে। ত্বকের যত্নে তাকে অনুকরণ করে জুনিয়র রুমমেটরা। ঠোটে, নাকে এবং গালে হালকা টিন্ট লাগিয়ে, খোলা চুলে অনেকটা ঘরোয়াভাবেই সে হল থেকে বের হলো। তখনই আবারো ফোনটা বেজে উঠল। এবার অবশ্য দিগন্তের ফোন। রিসিভ করতেই দিগন্ত বলে উঠল,
“ওই ছেলেধরা, সিসিমপুরের কলঙ্ক, তুই কই?”
“মঙ্গলে যাইতাছি।”
“কেন? পৃথিবীতে এক্স ছড়াইয়া শান্তি হয় নাই? এখন কি এলিয়েনদেরও ছাড় দিবি না?”
“দিতে পারি, যদি তোর নাদুসনুদুস ভাইটারে আমার লগে সেটিং দিতে পারস।”
দিগন্ত রেগে গিয়ে বলল,
“চাপার দাঁত খুইল্যা হাতে ধরায় দিমু কিন্তু। আমার ভাই মানে তোরও ভাই। গিভ সাম ভাইসুলভ রেস্পেক্ট।”
“আমার আব্বা আম্মায় কোনো ভাই পয়দা করে নাই, কাজেই মাইনষের ভাইরে এডোপ্ট করার কোনো শখ নাই। প্রেমসুলভ রেস্পেক্ট দিতে পারি বড়োজোর। চলবে?”
দিগন্তের আক্ষেপসূচক শ্বাস যেন আছড়ে পড়ল স্পিকারে। বলল,
“একদা বাচ্চারা কথা না শুনলে মায়েরা ভয় দেখিয়ে বলত ঘুমিয়ে পড়ো নয়তো ভুত আসবে, খেয়ে নাও নয়তো ভুত আসবে। ভবিষ্যতে মায়েরা ছেলেদের ভয় দেখাবে, জলদি পড়তে বসো নয়তো নন্দিনী আসবে।”
নন্দিনী বাহবা দিয়ে বলল,
“নাইস জোক! তয় চিনি ছাড়া পুরুষের মন নন্দিনী ধরে না। যার মনে আছে চিনি, তাকে নিয়েই খেলব ছিনিমিনি। মু হা হা হা!”
“বাজে কথা ছাড় ইকরি, দেখা কর। একলা ভাল্লাগতাছে না।”
“খিদা লাগছে। দেখা করলে খাওয়ার বিল তোর।”
“রাক্ষসী রানী নন্দিনী, ইহজীবনে বিলটা নিজে দিছোস?”
“দোস্ত… আমি দুপুরে খাই নাই। পেট এক্কেবারে পিঠের লগে মিশ্যা গেছে। অভুক্ত মাইয়াটারে খাওন নিয়া খোঁটা দিতে তোর কলিজায় বাধে না?”
নন্দিনীর কণ্ঠ করুণ শোনায়। দিগন্ত একটু দমে গেল। বন্ধুদের মধ্যে নন্দিনীর আর্থিক অবস্থা একটু শোচনীয়ই বটে। মেয়েটা বাড়ি থেকে কোনোপ্রকার অর্থসাহায্য নেয় না। দুইটা টিউশনি এবং বিভিন্ন অকেশনে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে পার্ট টাইম ডাক পায়। তাই দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। দিগন্ত বিরক্তি ঝারার ভঙ্গিতে বলল,
“অনেকদিন দান-খয়রাত করি না। আয় তোরে দিয়ে একটু সওয়াব কামাই।”
“দানশীল ফইন্নি!”
“আবার…”
দিগন্তের মুখ থেকে পুরো কথাটা বের হলো না। ফোনের অপরপাশ হতে প্রথমে নন্দিনীর আর্তচিৎকার ও পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার শব্দ তাকে বিমূঢ় করে দিল।
____________
বাড়ি জুড়ে পোলাও, মাংস, ফিরনির গন্ধ মৌ-মৌ করছে। মেহমানদের আপ্যায়নে যেন সামান্যতম ত্রুটি না থাকে সেদিকে তৎপর বাড়ির গিন্নি শারমিন বেগম। বাড়ির বড়ো কন্যাকে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে দেখতে আসছে বলে কথা। সেই উপলক্ষে দশম শ্রেণি পড়ুয়া ঝুমঝুমি আজ মাস দুই পর হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরেছে। রান্নার সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল,
“খিদে পেয়ে গেল আমার। খেতে পাব এখন?”
শারমিন বেগম ছোটো মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,
“একদম না, মেহমান গেলে খাবি।”
ঝুমঝুমি ঢোক গিলে চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“মেহমান যদি সব খেয়ে ফেলে।”
“খেয়ে ফেললে আবার রেঁধে দেব।”
“তখন যদি আমার খাওয়ার ইচ্ছে না থাকে?”
“বাঁদরামো হচ্ছে? তখন ছোটোবেলার মতো মে রে মে রে খাওয়াব। এখন গিয়ে দেখ টুকটুকি রেডি হলো কিনা।”
ঝুমঝুমি গোমড়া মুখে ওপরে চলে গেল। টুকটুকি তখন আয়নার সামনে বিরসমুখে বসে আছে। ঝুমঝুমি বলল,
“এই আপু তুমি লজ্জা পাচ্ছ না কেন?”
“লজ্জা পাওয়ার কী হলো?”
ঝুমঝুমি উঠতি বয়সী কিশোরী। প্রেম, বিয়ে, প্রেমময় সম্পর্ক এইসব বিষয়ে তার অগাধ কৌতুহল। হোস্টেলে রাত বাড়লেই বন্ধুদের ফিসফিস করে প্রেম করতে শোনে। পড়ার ফাঁকে, অবসরে উপন্যাসের বইয়ে পড়ে প্রেমের হাজারো উপাখ্যান। মনের ভেতর গড়ে তোলে ফ্যান্টাসি। সেইসব ভাবনা থেকেই বলল,
“পাত্রপক্ষ দেখতে এলে মেয়েরা লজ্জায় একদম নুইয়ে পড়ে। গাল আপেলের মতো লাল হয়ে যায়। তোমার তো সেসব লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।”
টুকটুকি আয়নাতে দেখছে একমাত্র বোন নাদিরা হক ঝুমঝুমিকে। মেয়েটার লজ্জা শরম এমনিতেই কম, হোস্টেলে যাওয়ার পর একেবারে পেকে গেছে। রুষ্ট গলায় বলল,
“তোর মাঝে বেশ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মাকে বলে তোর বিয়েটা আগে দেই?”
ঝুমঝুমি বোনের রুষ্ট স্বরটা ধরতে পারল না। সাগ্রহে বলল,
“ধুর, আমি এভাবে বিয়ে করব নাকি? চিনি না জানি না এমন একজনকে মেনে নিয়ে মুরুব্বি টাইপ সংসার আমার দ্বারা হবে না। আমি তো প্রেম করে বিয়ে করব।”
“আর তোর প্রেম মেনে নেওয়ার জন্য বাবা-মা বসে আছে!”
“না নিলে পালিয়ে যাব, সিম্পল!”
টুকটুকির চোয়াল ঝুলে পড়ার দশা। সেদিনের মেয়ে তার থেকে গুনে গুনে আট বছরের বড়ো বোনের সামনে বসে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে! টুকটুকি দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“মা’র খাবি ব’দ’মাইশ।”
ঝুমঝুমি বিজ্ঞের মতো বলল,
“আপু, ভেবে দেখ, অচেনা এক লোক তোমাকে জাস্ট কবুল বলার অধিকারে তার সিগারেট খাওয়া কালো, মোটা ঠোঁট দিয়ে চুমু খাচ্ছে। ইয়াক! ভাবতেই গা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। এরচেয়ে একজনকে চিনি, জানি, অনুভব করি এমন কারো থেকে চুমু খাওয়া ব্যাটার। তুমি ভার্সিটিতে পড়েও একটা প্রেম করতে পারলে না। নিজের কোনো পছন্দের মানুষও নেই। বোকা মেয়েদের এই হলো যন্ত্র’ণা। পরিবারের মতের বাইরে কিছুই পারে না।”
টুকটুকি হতভম্ব বোনের কথা শুনে। এইটুকুন বয়সে এহেন অধঃপতন দেখে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পায়ের জুতোটা খুলে ছুঁড়ে মা’রল ওর দিকে। বলল,
“বের হ বে’য়া’দব। তোর হোস্টেলে থাকা ছুটাচ্ছি আমি।”
ঝুমঝুমি ঝুকে গিয়ে নিজেকে বাঁচাল। তার কথা সঠিক মূল্যায়ন পেল না এমন একটা ভাব ধরে চলে যেতে যেতে বলল,
“আই নো তোমার এই সম্বন্ধে মত নেই। মেয়েরা যখন উদাসী থাকে, কাজে-কর্মে মন থাকে না তখন বুঝে নিতে হবে তাদের মনে অসুখ করেছে। তোমারও অসুখ করেছে তাই না? এজন্যই লজ্জা-টজ্জা না পেয়ে, সেজেগুজে পাত্রের অপেক্ষা না করে উল্টে বিরক্ত হচ্ছো।”
টুকটুকি নিঃস্পন্দ চোখে বোনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। সে এখন অনিচ্ছায় পাত্রপক্ষের সামনে বসা নিয়ে কাঁদবে নাকি বোনের পেকে যাওয়া নিয়ে শোকাভিভূত হবে বুঝে উঠতে পারল না। আয়নায় অবহেলার চোখে নিজেকে একবার দেখে নেয়। সাদা-বেগুনি শাড়িটা তার গমরঙা ত্বকে একরাশ স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছে। সেই সঙ্গে হালকা প্রসাধনীর সুক্ষ্ম স্পর্শ সংযোগ করেছে মোহনীয়তা। রিতা আন্টি তার চুলে জড়ানোর জন্য গাজরা ফুলের মালা পাঠিয়েছেন। সেটা হাতে নিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতেই ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করতেই অনুভব উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠল,
“টুকটুকিরে, ইকরি এক্সিডেন্ট করেছে। দিগন্ত ওকে নিয়ে হসপিটাল যাচ্ছে। আমিও রওনা হয়েছি…”
আকস্মিক কথাটা হজম করতে টুকটুকির একটু বেগ পেতে হলো। প্রিয় বন্ধুর দু’র্ঘ’টনায় সে দিকবিদিক ভুলে, শাড়ির কুচি আগলে ছুটে বেরিয়ে গেল। পাত্রপক্ষ তখনও এসে পৌঁছায়নি। শারমিন বেগম কাজে ব্যস্ত। ঝুমঝুমি ছাড়া টুকটুকির এই প্রস্থান কেউ দেখতে পেল না। বোধহয় সেই ছুটে যাওয়ায় পাত্রীদেখা থেকে রেহাই পাওয়ারও একটা প্রয়াস ছিল।
টুকটুকি বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই দৈবাৎ নিশীথের সামনে পড়ল। মেয়েটাকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে এগিয়ে এলো। বলল,
“মিস হুমায়রা, ইজ এভ্রিথিং অলরাইট?”
টুকটুকি জোরে জোরে মাথা নেড়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
“ইকরি… ইকরি এক্সিডেন্ট করেছে, নিশীথ। আমাকে একটা সিএনজি ডেকে দিন, প্লিজ!”
“আপনি শান্ত হোন। দেখছি।”
টুকটুকিকে সিএনজিতে তুলে দিয়েও নিশীথ তাকে একা ছাড়ল না। নিজেও উঠে বসল সঙ্গে। গাড়িটা দৃষ্টিসীমা পেরোতেই ঝুমঝুমি মিটমিট করে হাসতে হাসতে ছাদ থেকে নেমে এলো। মাকে গিয়ে বলল,
“আপু রিতা আন্টির ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে, মা।”
চলবে.
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১৭]
টুকটুকি যখন হসপিটালে পৌঁছেছে পশ্চিমাকাশ তখন ক্ষয়িষ্ণু আলোয় লালিত। সূর্যটা ডুবুডুবু প্রায়। এদিকে পূর্বকোণ থেকে ধেয়ে আসছে কালো মেঘেদের দল। তপ্ত গোধূলির ঠান্ডা বাতাস উড়িয়ে আনছে বৃষ্টির আগমনী ঘ্রাণ। শরতের মেঘেরা বোহেমিয়ান। তারা কখন আকাশের সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবে আসে আর কখন ভূপৃষ্ঠে পতিত বর্ষণ হিসেবে তা আগে থেকে বোঝা মুশকিল। টুকটুকি নিশীথকে ফেলেই ছুটে চলে গেছে ভেতরে। নিশীথ সেদিকে তাকিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। রিসেপশনে পা দিতেই দেখল মেয়েটা অনুভবের বাহু আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। অপরদিকে অনুভব তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে। নিশীথের এগোতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু এসেই যখন পড়েছে খোঁজ না নিয়ে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। নিশীথকে দেখে ভরসা পেয়ে অনুভব বলল,
“নিশীথ ভাই, দেখছেন অবস্থা! আপনি একটু থাকুন ওর পাশে। দিগন্তরা এক্স-রে রুমে গেছে টেস্ট করতে। এই সুযোগে আমি ঔষধগুলো কিনে আনি।”
নিশীথ সম্মতি দিল। জানা গেল নন্দিনীর পায়ের ওপর দিয়ে দূরন্ত গতির বাইক চলে গিয়েছে। এখন তাকে এক্স-রে রুমে নেওয়া হয়েছে। দিগন্ত সঙ্গে আছে। টুকটুকি রিসেপশনে বসে বারবার নাক টানছে। নিশীথ থেকে থেকে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ঘেটে যাওয়া সাজপোশাক তাকে অপরিপাটি করলেও সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সুন্দরতায় ভাটা ফেলতে খুব একটা সক্ষম হতে পারেনি। সৌন্দর্য মানেই শুধু পরিপাটি হবে কেন? বরং তার সম্মুখের মেয়েটিকে এই মুহূর্তে বলা যেতে পারে অগোছালো সুন্দরী। নিশীথের চট করে গতকালের কথা মনে পড়ল। টুকটুকিকে আজ দেখতে আসার কথা। সাজের রহস্য যেন এই মুহূর্তে উদঘাটন করতে পারল সে। গলা খাকারি দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টায় সক্ষম হলো। টুকটুকি নাক টানায় বিরতি দিয়ে হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
“আপনাকে কষ্ট দিলাম। না এলেও পারতেন।”
না এলেও পারত নিশীথ। কিন্তু কেন এলো? যুক্তিযুক্ত উত্তর নেই। কিছু ঘটনা বা পরিস্থিতি অত হিসেবনিকেশ করে জীবনে আসে না। অফিস থেকে ফেরার পথে সে কী জানত হুমায়রা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে তার সামনেই পড়বে! নাকি সেই বুঝেছিল এক মুহূর্তের জন্য ওই অসহায় মুখটা তাকে চিন্তাগ্রস্ত হতে বাধ্য করবে! সেই মুহূর্তে শুধু মনে হয়েছিল পড়ন্ত বিকেলের কমলাটে ছঁটায় একজোড়া উদ্বেগ আক্রান্ত চোখের বিমর্ষ মেয়েটাকে সঙ্গ দেওয়া দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে যুতসই উত্তর নিশীথ ভেবে পেল না। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল,
“আপনাকে তো আজ দেখতে আসার কথা। এসেছিল?”
“আসার কথা, কিন্তু আমি হসপিটালে।” টুকটুকির কণ্ঠে হেয়ালির আঁচ পেয়ে নিশীথ চমকে উঠল। তবে এ নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না।
নন্দিনীর যাবতীয় টেস্ট শেষ হতে হতে ক্লান্ত ধরনীর বুকে আঁধার নেমে এসেছে। ডান পায়ে বেশ ভালোই ফ্রেকচার হয়েছে। মাস দুয়েক পায়ের ওপর প্রেশার দেওয়া নিষেধ। অনুভবের ভাইয়া এই হসপিটালেই দায়িত্বরত। সেই সুবাদে খরচায় একটু ছাড় পাওয়া গেছে। টুকটুকি নন্দিনীকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। নন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলল,
“ম’রাকান্না জুড়ছোস ক্যান? আমি তো এহনো ম’রি নাই। চুপ যা।”
টুকটুকি ভেজা কণ্ঠে বিরোধ করল,
“কাঁদব না তো কি নাচব? পা ভেঙে বসেছিস। হাঁটতে পারবি কিনা কে জানে।”
অনুভব নিচুস্বরে বলল,
“দোস্ত, আমাগো কী কান্দা উচিৎ?”
দিগন্ত তেতো মুখে বলল,
“চুপ কর। এর হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে সুবিধা আছে। বাঁ’দ’রামি ছেড়ে একটু জাতে আসতেও পারে এই সুযোগে।”
টুকটুকি কটমট করে তাকায়। দিগন্ত পুনরায় তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“আমারে গরম না দেখাইয়া এই মেয়েরে দেখা। জিজ্ঞেস কর চোখ দুইটা শোকেসে সাজাইয়া রাস্তায় বের হইছে কেন?”
ব্যথার মাঝেও নন্দিনীর কণ্ঠের ঝাঝ গেল না। একই স্বরে বলল,
“সব তোর দোষ।”
“আমার!” দিগন্ত সদ্য মাটি ফুড়ে বের হলো যেন।
“হ। তুই আমারে ফোন দিছিলি ক্যান? তোর লগে কথা কইতে গিয়াই তো কান্ডটা ঘটল।”
“তুই যে রাস্তায় গড়াগড়ি করতাছিলি আমি তো জেনে বসে ছিলাম। নিজে সতর্ক হতে পারলি না, বাঁ’দর?”
নন্দিনী উত্তর দিল না। তার ভুরু দ্বয়ের মাঝে য’ন্ত্রণার ছাপের বাইরেও সুক্ষ্ম একটা চিন্তার ভাজ ফুটে উঠেছে।
বন্ধুদের থেকে দূরেই নিশীথ দাঁড়িয়ে ছিল। নন্দিনী তাকে একপলক দেখে টুকটুকির দিকে দৃষ্টি ফেরায়। সাজের ধরন দেখে বলে উঠল,
“কিরে, আজকে মা বরিশাইল্ল্যার আহনের কথা। আইছিল?”
টুকটুকি কাচুমাচু হয়ে না বোধক মাথা নাড়ে। তার নতনেত্র দেখেই নন্দিনী যা বোঝার বুঝে যায়। দাঁতে দাঁত ঘষে আস্তে করে একটা অশ্রাব্য গা’লি দিল। এরপর নিশীথকে ডাকল।
“এসে ভালোই করেছেন, নিশীথ ভাই। আমি ফাইন আছি। আপনি এই পাগলকে নিয়ে বাসায় যান। ওদিকে বোধহয় কে’লে’ঙ্কারি ঘটে যাচ্ছে।”
“যাব না।” টুকটুকি জেদ ধরল। সাথে ফোনটাও নেই। কাজেই ওদিকের খবর তার অজানা। কিন্তু জেদের মাঝেও ভয়টাকে দমানো যাচ্ছিল না। না বলে চলে তো এসেছে। ওদিকে পাত্রপক্ষ ফিরে যাওয়ায় বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়া কি হবে তা ভেবে মনে মনে শঙ্কিতও হচ্ছিল। কিছু বলার আগেই নিশীথের ফোন বেজে উঠল। কথা বলতে সে বন্ধুমহলের থেকে দূরে সরে গেল।
হসপিটাল থেকে বেরুতেই গায়ে লাগল বৃষ্টির ছাঁট। এক পশলা বৃষ্টি ঝরে গেছে ইতিমধ্যে। নিশীথ ফোন রিসিভ করতেই মায়ের উচ্চস্বর কানের পর্দা নাড়িয়ে দিল।
“টুকটুকি তোর সঙ্গে নিশীথ?”
“হ্যাঁ। আমার সাথেই আছে।” নিশীথের সরল স্বীকারোক্তি। সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ওপাশে বুক ফাঁটা কান্নার স্বর বেজে উঠল। নিশীথ আঁতকে উঠল,
“কী হয়েছে মা?”
“মানসম্মানের বারোটা বাজিয়ে আবার জিজ্ঞেস করছিস কী হয়েছে? তোর থেকে এমন অবিবেচকের মতো কাজ আমি মোটেও আশা করিনি।”
“আমি কী করলাম?”
“আমি ঠিক সন্দেহ করেছিলাম। টুকটুকির চোখে তোর প্রতি কমনীয়তা তাহলে আমার মনের ভুল ছিল না। শুধু আফসোস তোর চোখের ভাষা চিনতে পারিনি। কিন্তু আমি তো তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখনই স্বীকার করে নিতি টুকটুকিকে পছন্দ। আমি কী একমাত্র ছেলের পছন্দকে পাত্তা দিতাম না?”
“কী যা তা বলছ এসব!” নিশীথ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কথাগুলো যেন কুয়াশাচ্ছন্ন। কোনোটার স্পষ্ট মানেই ধরতে পারছে না।
রিতা দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন,
“নাটক করিস আমার সাথে? টুকটুকিকে নিয়ে ভেগে গিয়ে এখন নাটকও করা হচ্ছে! তোরা কি সবদিক থেকে মানসম্মান ডোবানোর চেষ্টা করছিলি যে পাত্রপক্ষ আসার দিনই পালাতে হলো। ওহহ! তারমানে গতকাল এই নিয়ে দুজনের চায়ের আলাপ হচ্ছিল। আমারই চোখের সামনে তোরা সর্বনাশের প্ল্যানিং করলি। এই শিক্ষা দিয়েছিলাম তোকে?”
“তোমাকে কে বলেছে এসব?”
“কে বলবে আবার? তোদের দুজনকে সিএনজি করে পালাতে দেখা গেছে। পুরো এলাকা বুঝি জেনেও গেল। শুধু মাইকিং করা বাকি।”
রিতা আবারো গলা ছেড়ে কাঁদতে বসলেন। নিশীথ স্তব্ধ। সর্ব চিন্তা তালগোল পাকিয়ে গেল তার। কী থেকে কী হলো মস্তিষ্ক হজম করতে পারল না।
নন্দিনীর শহরে কোনো আত্মীয়পরিজন নেই। এই মুহূর্তে তার দরকারি ও ভারী কাজ এবং চলাচলের জন্য কারো সাহায্য একান্তই প্রয়োজন। অনুভব কিংবা দিগন্ত বাড়িতে মেয়ে বান্ধবী তুলতে পারবে না। এদিকে টুকটুকি বাড়িতে বিশাল ঝামেলা পাকিয়ে চলে এসেছে। সবাই ঠিক করেছিল নন্দিনীকে হসপিটালে কয়েকটা দিন রাখতে, অন্তত ঝুকিমুক্ত হওয়া অবদি। এরপর টুকটুকি তাকে নিজের বাড়িতে নেবে নাহয় ওর সঙ্গে হলে গিয়ে থাকবে। কিন্তু নন্দিনী থাকতে নারাজ। বেড নেওয়ার বাড়তি খরচের বোঝা তার টানাটানির জীবনের ওপর প্রেশার ফেলবে। বন্ধুদের অবস্থাও আহামরি উচ্চবিত্ত পর্যায়ে নয়। সকলেই পরিবারের দারস্থ। দিগন্ত সেদিক থেকে আলাদা। সে বড়োলোক পরিবারের সন্তান। বাবা শিল্পপতি, মা সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত। কিন্তু চা-সিঙারার বিল আর হসপিটালের বিলে তফাৎ আছে। নন্দিনী এই মুহূর্তে তা একদমই চাইছে না। ব্যাপারটা সকলেই ধরতে পারল। দিগন্ত এবার বেজায় চটে গেল। সেই দুপুর হতে সামান্যতম ফুরসত সে পায়নি। ভার্সিটির প্রথম বন্ধু কিংবা চির শত্রুকে আহ’ত অবস্থা পেয়ে উদ্বিগ্নতা, ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে বারবার। এত দৌড়াদৌড়ির পর এখন তিনি টাকার চিন্তায় ভাঙা পা নিয়ে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে চাইছে! আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
“তুই থাকবি, তোর ঘাড়, হাত, ঠ্যাং সব থাকব। দরকার পড়লে বুয়ার কাম কইরা হসপিটালের বিল শোধ করবি। তাও বেড ছাড়া যাবে না। তাছাড়া গতকাল আরো একটা টেস্ট আছে। সবকিছু ওকে না হওয়া অবদি নট নড়নচড়ন। মাথা গরম করবি না ইকরি মিকরি চাম চিকরি।”
অতঃপর তর্ক-বিবাদ শেষে স্থির হলো নন্দিনী হসপিটালে থাকছে। বন্ধুদের কারো খাওয়া হয়নি। অনুভব গেল খাবার আনতে। দিগন্তকে নন্দিনীর পাশে রেখে টুকটুকি নিশীথের খোঁজে বের হলো। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে এসে তাকে আবিষ্কার করল রিসেপশনে সর্বহারার মতো বসে থাকতে। ছুটে এসে জানতে চাইল,
“কী হলো আপনার?”
নিশীথ স্থবির জিভটাকে নাড়িয়ে কোনোমতে উচ্চারণ করল,
“কে’লে’ঙ্কারি ঘটে গেছে।”
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১৮]
ওদের বাড়ি ফিরতে রাত দশটা গড়াল। প্রকৃতি এখন সিক্ততায় শীতল। শিরশিরে বাতাসের স্নিগ্ধতায় দুটি চিত্ত অনাগ্রহী। নিশীথ ও টুকটুকি যতটা না ক্লান্ত তার চেয়েও বেশি শঙ্কিত, মূর্ছিত। যে পরিস্থিতি তাদের অগোচরে, অজানায় তৈরি হয়েছে সেটার ধাক্কা এখন সশরীরে সামলাতে হবে। নিশীথের দেহে থেকে থেকে একটা রাগের চিকন ধারা বইছে। কোনোকিছু না জেনে, আগুপিছু না ভেবে এ ধরনের রটনা কি করে ছড়াল, কারা ছড়াল সে ভেবে পাচ্ছে না। তবে যেটা ভাবতে পারছে তা হলো তার সহজ-সরল মা সে ঘটনা অনায়াসেই বিশ্বাস করে নিয়েছে। নিশীথের সমস্ত ক্ষো’ভ গিয়ে পড়ছে এই মূর্তিমান মুসিবত টুকটুকির ওপর। নিপার বিয়ের দিন হতে আজ অবদি এই মেয়ের সাক্ষাতে ভালো কিছু পায়নি সে। জীবনে যা করেনি, যা ঘটেনি তাই ঘটেছে। প্রথমে পেল অসামাজিক, অহং-কারী ট্যাগ এরপর তো তার পেশাটাকেই মিস্তিরি বলে তামাশা করা হলো। আর এখন, সরাসরি ভেগে যাওয়া! নিশীথ সিএনজি থেকে নেমেই প্রথমে ধমকে বলল,
“সব দোষ আপনার।”
“আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? আপনি যেখানে আমিও সেখানে।”
নিশীথ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
“আপনি কি পারতেন না বাড়িতে সত্যিটা জানিয়ে বের হতে?”
টুকটুকি চুপসে গেল,
“জানলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বেরোতে দিতো নাকি!”
“আপনি যে পাত্রপক্ষকে এভোয়েড করে পালাচ্ছেন আমি কী জেনে বসেছিলাম? অথচ হেল্প করতে গিয়ে দুর্নামটা আমারই হলো। এখন তো দেখছি আপনি মানুষটা মোটেও ছেলেমানুষ না। মহা ধড়িবাজ!”
টুকটুকির কান্না পেয়ে গেল। হ্যাঁ মানছে পাত্রপক্ষকে এড়াতেই না বলে ছুটেছিল। কিন্তু বন্ধুর জন্য চিন্তা, উৎকন্ঠা তো সত্যি। তেমনই সত্যি নিশীথের সঙ্গটা তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল। কিন্তু এদিকে যে মহা গিট্টু পেকে যাবে কে জানত? বাবা-মায়ের সামনে মুখ দেখাবে কেমন করে? নন্দিনীর এক্সিডেন্টের সত্যতা বলে নিস্তার পেতে চাইলে তারা যদি জিজ্ঞেস করে না জানিয়ে কেন গেল? কিংবা পাত্রপক্ষের জন্য আরেকটু অপেক্ষাই বা কেন করল না? সে তো আর ডাক্তার না যে ঠিক সময় না পৌঁছালে রোগীর ক্ষতি হবে। সঙ্গে আবার নিশীথ ছিল। মনে হরেক রকম যুক্তিতর্ক করেও যেন নিজের ক্ষণিকের চালাকিটা ঢাকতে পারছে না। তবে নিশীথ এবারও তাকে ভুল চিনেছে। ঠিক চিনেছে নন্দিনী। টুকটুকি আসলে ধড়িবাজ নয়, হাইব্রিড জাতের ব’লদ। সে এবার হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুর করল। তার সহজ সরল জীবনটা ক্রমশ জটিল হচ্ছে কেন?
ক্রমশ নির্জন, বিজন হতে থাকা ধুলোমাখা শহরের নিয়ন আলো ছড়ানো রাস্তায় সেই কান্নার শব্দ নিশীথের মনে সামান্যতম মমতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলো। সে শক্ত গলায় আদেশ করল,
“কান্না কোনো সমাধান নয়। যুতসই সমাধান না দিতে পারলে দয়া করে চুপ থাকুন।”
নিশীথ নিজের বাড়ির দিকে এগোয়। পেছনে ফোঁপাতে ফোপাঁতে এগোয় টুকটুকি। নিশীথ ভ্রু দ্বয়ের মাঝে বিরক্তির ভাজ ফেলে বলল,
“আমার সঙ্গে আসছেন কেন? বাড়িতে যান।”
টুকটুকি অসহায় চোখে না বোধক মাথা নাড়ে। তার সাহস হচ্ছে না। নিশীথ আর কিছু না বলে কলিংবেল চাপল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিল কাজের মেয়েটি। যেন সে দরজা খোলার অপেক্ষাতেই ছিল। রিতা আন্টি মাথা চেপে বসেছিলেন। ছেলের পাশে শাড়ি পরিহিতা টুকটুকিকে দেখে তিনি প্রথমেই আঁতকে উঠে বললেন,
“বিয়ে করে ফেলেছিস?”
নিশীথ অবিশ্বাস্য চোখে কয়েকপল তাকিয়ে রইল। এরপর চাপা রাগে বলল,
“হ্যাঁ, হানিমুনে যাওয়ার আগে দোয়া নিতে এলাম।”
রিতা আন্টির চোখের কোলে শ্রাবণ মেঘের ঘনঘটা। মন ভাঙার দুঃখে জর্জরিত স্বরে বললেন,
“তোদের দুটিকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। পারলি এভাবে আঘা’ত করতে? আজকের পর আমি নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করব না। যা হানিমুন, সুগারমুন সব কর। এরপর ডায়াবেটিসমুন বাধা। কিন্তু এ বাড়িতে জীবনেও আসবি না। আমার সব গর্ব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস তোরা।”
কাঁদতে কাঁদতে রিতা আন্টির শ্বাসটান উঠল। টুকটুকি এবার শব্দ করে কান্না জুড়ে দিল। নিশীথ ছুটে গিয়ে ইনহেলার আনে। হুলুস্থুল পরিস্থিতিটা নিরবে উপভোগ করছে রান্নাঘর থেকে কান পেতে থাকা কাজের মেয়েটা। আড্ডা দেওয়ার মতো মোক্ষম একটা গল্প পাওয়া গেছে। একসময় রিতা আন্টি ঠান্ডা হয়ে এলো। নিশীথ রাগ ধরে রাখতে না পেরে বলল,
“লোকের কথা বিশ্বাস করার আগে তোমার একবার নিজের সন্তানের মুখ থেকে সত্যিটা জানতে ইচ্ছে হলো না? আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না, মা। এই তোমার বিশ্বাস! আমি কি চু রি করেছি নাকি আমার সামর্থ্য বা যোগ্যতা কোনোটাই নেই যে পালিয়ে বিয়ে করব?”
“তাহলে সত্যি কোনটা? এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো?”
“হুমায়রার বান্ধবী নন্দিনীকে তো খুব পছন্দ করো। জানো কি এক্সিডেন্ট করেছে? আমরা তাকে দেখতে গিয়েছিলাম একসাথে। সামান্য ঘটনাকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই তিল থেকে তাল করে দিলে? একেই বলে বাঙালি। সঠিকটা জানার আগেই হুজুগে গা ভাসাবে।”
নন্দিনীর সংবাদে রিতা আন্টি চমকে উঠলেন। উনার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হলো যখন নন্দিনী নিজেই ফোন করে কথা বলল। অপ’রা’ধবোধে ছেয়ে গেল উনার ভেতরটা। ছুটে এসে কান্নারত টুকটুকিকে বুকে আগলে নিলেন। চোখ মুছিয়ে বললেন,
“ওই বাড়ি থেকেই তো জানাল। তোদের নাকি একসাথে পালিয়ে যেতে দেখেছে। এরমাঝে পাত্রপক্ষ উপস্তিত হয়ে পরিস্থিতি এমন হলো যে মাথাই কাজ করছিল না। তোকে ফোনে পাচ্ছিলাম না, টুকটুকিও ফোন ফেলে গেছে। সব মিলিয়ে নিজেকে সামলাতে পারিনি সোনা। কেঁদেকেটে কি হাল করেছিস চেহারার।”
টুকটুকি অভিমানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“এতক্ষণ তো সহ্যই করতে পারছিলে না। যেই সত্যিটা জানলে অমনি বদলে গেলে। তুমি আসলে আমায় পছন্দই করোনা। বুঝে গেছি আমি।”
রিতা আন্টি অসহায় বোধ করলেন। হুট করে সংবাদটা পেয়ে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন বৈকি। একটা মেয়ে চোখের সামনে চড়ুই পাখির মতো ঘুরে বেড়ায়, আদর খায়, সেই যদি ছেলের সঙ্গে মিলে অবিবেচকের মতো কাজ করে বসে ধাক্কা তো লাগবেই। সন্ধ্যার পর টুকটুকির মায়ের সঙ্গে কথা কা’টাকা’টিও হয়ে গেছে এক দফা। কিন্তু এটাও সত্যি টুকটুকিকে তিনিই আগে পুত্রবধূ করার ক্ষীণ ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন যেটা ছেলের শীতলতায় চাপা পড়ে গেছে। সম্মানহানির শঙ্কায় রুঢ় আচরণ করে ফেলেছেন বোধহয়। এখন নিজেকে চরম বোকা মনে হচ্ছে। কান নিয়ে গেল চিলে প্রবাদের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে কানে হাত দেওয়ার কথাই মনে ছিল না। রিতা আন্টি একহাতে নিশীথের হাত জড়িয়ে অপর হাতে টুকটুকিকে কাছে টেনে আবার কেঁদে ফেললেন। তবে এই কান্না স্বস্তির। ভীষণ ভীষণ রাগ, অভিমানের ধারালো কান্নার পর একটু ক্লান্তিময়, স্বভাবসুলভ আহ্লাদী, কোমল কান্না যাকে বলে। আদরের দুটি ছেলেমেয়ে উনার মনে শেষমেষ আঘা’ত দেয়নি। তারা কোনো দোষ করেনি। হ্যাঁ, না জানিয়ে চলে গিয়ে ভুল একটু করে ফেলেছে। এ ভুল ক্ষমা করাই যায়। কিন্তু এখনো টুকটুকির পরিবারের মোকাবিলা করা বাকি। আজকের ঘটনার মূল ভুক্তভোগী তারাই। বিষয়টা আরো ঘোলা হওয়ার আগে ধীরস্থির হয়ে মিটমাট করে নিতে হবে।
টুকটুকি অভিমানসিক্ত লোচনে নিশীথের দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টি নজর কাড়তেই নিশীথের হঠাৎ ফোনে মায়ের বলা কথাটা মনে পড়ে যায়। এই ভেজা দুটি চোখ কি সত্যিই তার প্রতি কমনীয়!
________________
নন্দিনীর মনে হয় হসপিটালের আবহাওয়াটাই এমন যে নিজেকে অসুস্থ লাগে। একটা রাত বেডে কাটিয়েই তার কেমন নিজেকে রোগী রোগী লাগছে। কিন্তু গতকাল সদ্য ভাঙা পা নিয়েও সে মনেপ্রাণে সতেজ ছিল। পায়ের সাদা ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে ক্ষণে ক্ষণে তার চোখে আ’গুন জ্ব’লে উঠছে। চোখের সামনে ঘটনাটা স্পষ্ট। ফাঁকা সড়কে ইচ্ছাকৃত তার গায়ের ওপর বাইক তুলে দেওয়া হয়েছে।
দিগন্ত খাবার নিয়ে প্রবেশ করল। এই রুমে আরো দুটি বেডে রোগী আছে। কাজেই তারা গলা ছেড়ে কথা বলতে পারছে না। নন্দিনী দিগন্তের ওপর কিছুটা বিরক্ত। এর যুক্তির কাছে হেরেই পয়সা খরচ করে বেড ভাড়া দিতে হচ্ছে। দিগন্ত মুখ দেখেই মনের কথা বুঝে গেল। এলোচুল গাল থেকে সরিয়ে কানের পিঠে গুজে দিয়ে বলল,
“আরেকটা রাত থাক, মামা। টুকটুকি ঝামেলা কা’টাইয়া গ্রিন সিগন্যাল দিলেই মুক্তি। এরপর টুকটুকি তোর পারসোনাল নার্স। অলসের হাড্ডিরে জন্মের খাটান খাটাবি।”
নন্দিনী মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল,
“ওয় কী গ্রিন সিগন্যাল দিব। নিজের জীবনেই তো ট্রাফিক জ্যাম লাগাইয়া রাখছে।”
দিগন্ত কথা না বাড়িয়ে খেতে ইশারা করল। সবজি দেখে অভক্তি এসে গেল রোগীর। ঠোঁট উলটে নিষ্পাপ চাহনি দিয়ে বলল,
“দোস্ত, কাচ্চি খাইতে মনে চায়।”
দিগন্ত অদ্ভুত দৃষ্টি হেনে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল,
“তুমি বিয়া বাড়িতে আসো নাই ইকরি-মিকরি।”
খাওয়া দাওয়া শেষে নন্দিনীর মুখোমুখি বসল দিগন্ত। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“এবার বল এক্সিডেন্টটা হইল কেমনে?”
নন্দিনী আধশোয়া হয়ে বসে আছে। দৃষ্টিতে আবারো রাগের ছোঁয়া লেগেছে। বলল,
“ওই মুখ আমি নিজের হাতে খামচি দিয়া ভচকাইছি। শা’লা মুখ ঢাকলেও চোখ চিনতে ভুল হয় নাই।”
দিগন্ত চমকে উঠল। ফোঁসফোঁস করে বলল,
“ওই হারামি এই কাম করছে? কী যেন নাম…”
“শাহীন। ওর বন্ধু ফারদিন আমারে ডাকছিল কাল। তখনই খটকা লাগছে। বাইকারের মুখ ঢাকা থাকলেও চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় নাই।”
“তোরে আমি হাজার বার সাবধান করছি। শুনিস নাই কথা। যার তার লগে ডেটিং করতে চলে যাস। হইল না বিপদ?”
রাগে দিগন্তের গা জ্ব’লে যাচ্ছে। এতক্ষণ মেয়েটাকে সে সেবা করেছে। এখন মনে হচ্ছে অন্য পা-টাও ভেঙে দেয়। যেচে বিপদ ঘাড়ে এনে সবাইকে জ্বা’লিয়ে মা রছে। নন্দিনী অবশ্য ঠান্ডা আছে। তার চোখে অন্যরকম এক দ্যুতি। দিগন্ত সন্দিহান হয়ে বলল,
“শাহীনের খোঁজ নিতাছি। তার আগে বল আর কোনো ঝামেলা বাধাস নাই।”
নন্দিনী দুষ্টু হাসে। চোরা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
“দোস্ত, ন্যুড দেখবি?”
“কী বললি?” দিগন্ত বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়।
“আরে ব্যাটা আগেই ফাল মা রোস ক্যান? মাইয়াগো ন্যুড না। পোলাগো, দেখবি?”
দিগন্ত ভর্ৎসনার কণ্ঠে বলে,
“তুই…তুই এসব দেখা শুরু করছস আজকাল? হা’রা’মী, নষ্ট, অ’সভ্য। আমি তোর সাথে আর চলমু না।”
“দেখ না আগে। তোর শইল্যে যা তার শইল্যেও তাই। এত শরমের কি আছে?”
“এইটা শরম না শালীনতা। তোর অ’শ্লীল মস্তিষ্ক বুঝবে না।”
দিগন্ত দুইহাতে চোখ ঢেকেছে। নন্দিনী হাসতে হাসতে বলল,
“পোলাপাইন আমারে অ’শ্লীল কয় আর এদিকে নিজের মাথায় নষ্ট চিন্তাভাবনা। সিক্স প্যাক ছাড়া পোলাগো বদনে দেখার মতো ইন্টারেস্টিং কিছুই নাই। এই বদনওয়ালার তো ভুড়ি। বেশি শরম করলে খালি মুখটা দেখ।”
দিগন্ত আঙুলের ফাঁক গলে তাকায়। ছবির ছেলেটা শাহীন। নন্দিনী ছেলেটাকে আগেও দেখিয়েছিল একবার। ছবিতে খালি গায়ে তার কোমড় অবদি দৃশ্যমান। দিগন্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
“এইটা ন্যুড!”
“জামাকাপড় নাই৷ ন্যুড-ই তো হইল। তুই কি মামা আরো কিছু আশা করছিলি? আমার সন্দেহ তাইলে মিছা না। তোমার পোলাগো উপ্রে ইন্টারেস্ট আছে!”
নন্দিনী ভ্রু নাচাতেই দিগন্ত ফুঁসে উঠল,
“থা’প’ড়াইয়া ইন্টারেস্ট বুঝামু তোরে। বে’দ্দপ মাইয়া। এতকিছুর পরেও এই হা’রা’মজাদার ছবি তোর ফোনে কী করে?”
“হা-ডু-ডু খেলে। তুই তো শরমের ঠেলায় ট্রেইলার পিক দেখলি। মেইন পিকচার আভি বাকি হ্যায়।” নন্দিনী চোখ টিপল। দিগন্ত অবাক হয়ে বলল,
“তার মানে?”
“মানে যেইটা না দেখতে পাইয়া আফসোস করলি ওইটাও আছে। বহু কষ্টে ন** পোলার এক্সের থাইকা এইসব জোগাড় করছি। লিটনের ফ্ল্যাটে র’ঙ্গ’তামাশা ভালোই চলে ওর। এইবার শুধু প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের গ্রুপে গ্রুপে ওর খোলস ছাড়া রূপ প্রচার করা বাকি।”
“এখনই কিছু করিস না। শাহীন দুঃসাহসিক কাজ করছে। পরবর্তীতে আবারো করব না নিশ্চয়তা নাই। আগে ভালোমতো খোঁজ খবর নেই। শিকু আসুক, আলাপ করে বাকিটা এগোবো। মাছ শুধু জল থেকে তুললেই চলবে না, ছাই দিয়ে ধরতে হবে।”
চলবে…