শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-২২+২৩+২৪

0
488

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[২২]

প্রিয়ার এডমিশন টেস্ট শেষ হয়েছে কিছুদিন হলো। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে আহামরি ফলাফল করার কথা না, আকাঙ্ক্ষাও করেনি। ঢাবি, জাবি কোথাও সিরিয়াল না আসায় প্রিয়া পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিল। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিকে ভর্তি পরীক্ষার আগেই এডমিশন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে। হিসেবি প্রিয়া জাতীয়তে ভর্তি না হয়ে সেই টাকায় পাবলিকের ফর্মের টাকা ভরেছিল। নিজের ওপর দয়াও কম হচ্ছিল না তখন। ভবিষ্যতের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো এই এডমিশন টাইম। যখন একজন শিক্ষার্থী লম্বা সময় ধরে একটা বিষয় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। কেউ ডাক্তারির পেছনে ছোটে, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাশন ডিজাইনার, আর্টিস্টসহ কতশত স্বপ্ন তাদের দুচোখে রাতদিন খেলা করে। যে স্বপ্নের তাড়নায় উঠতি তরুণরা সুস্থির হতে পারে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছেলেমেয়েরা ছুটে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিমুখে। কেউ নিজের স্বপ্ন পূরণে একাগ্র কেউ বা পরিবারের।

এমন নাজুক সময় প্রিয়া ভাবে চাল-ডাল কিংবা ডিমের দাম বেড়ে গেলে কোনদিকে খরচ কমাবে, মাছ মাংসের দিকে তো হাতই দেওয়া যায় না। দিয়াটা আমিষ খেতে খুবই ভালোবাসে। প্রথম প্রথম বস্তিতে ওঠার পর শুক্রবারের দিন পাশের বাড়ি থেকে গোস্তের ঘ্রাণ পেলে মুখ শুকিয়ে থাকত মেয়েটা। মেয়েরা মানসিক দিকে থেকে পুরুষের তুলনায় আবেগপ্রবণ হলেও তাদের সহনশীলতা পর্বতের ন্যায় বিশাল ও দৃঢ়। ডেলিভারির পেইনের সঙ্গে প্রাণ দিয়ে ল’ড়াই করে হলেও সন্তানকে আলোর মুখ দেখায়। সংসারের জন্য নিরবে ক্ষয়ে যায়। মুনিরা বেগম অনেকটা চাপা স্বভাবের। নিজের খারাপ লাগা কিংবা অসুবিধাটুকু না ঠেকলে স্পষ্টত মুখে আনতে পারেন না। মেয়ে দুটোও হয়েছে মায়েরই মতো। কপটতা, ভ ণ্ডা মি কিংবা স্বার্থপরতা কোনোটাই পায়নি। পাশের বাড়ির মাং সের ঘ্রাণ পেয়ে দিয়া একদিন আক্ষেপ করে বলেছিল,
“অনেকদিন মাং স ভাত খাই না, আম্মু।”

মুনিরা সেদিন অসহায়ের মতো মেয়েকে আগলে নিয়ে কেঁদেছেন। অদৃষ্টকে উপহাস করেছেন। সেই দৃশ্যের পর দিয়া কখনোই মাং স খাওয়ার কথা মুখে আনে না। শুক্রবারে যখন অন্যের ঘর থেকে গরম গরম মাং সের তরকারির সুঘ্রাণ ছোটে সেই ঘ্রাণ শুকে শুকে ডাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে নেয়। প্রিয়া সবই দেখেছে, সবই বুঝেছে। শুধু অভাব তার জবান বন্ধ করে রেখেছে। জাইমের কেয়ারটেকারের কাজটা পাওয়ার পর বোনের মুখ চেয়ে প্রিয়া জীবনে যা কল্পনা করতে পারেনি তাই করেছে। যেদিন অন্তরা ভাবীদের বাড়িতে ভালো রান্না হয় প্রিয়ার জন্যও তার কিছু বরাদ্দ থাকে। প্রিয়া নিজেরটুকু লুকিয়ে আনে বোনের জন্য। ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় তার হাত কাঁপে। সেদিনগুলোতে সারাটা পথ আসার সময় চোখ বারবার ঝাপসা হয়। অভাবের কাছে পরাস্ত হয়ে, বাড়ন্ত বোনের শুকনো, মায়ামাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে বোঝায়, সে তো চু রি করেনি। নিজের ভাগেরটা বোনের জন্য আনে।

মাসের অন্তে এই স্থানসংকুলান সংকটাপন্ন রুমটার ভাড়া গুনতে হয় প্রিয়াকে। দিয়া একটি আধা-সরকারী স্কুলে পড়ছে। মাসে মাসে বেতন দিতে হয়। আগে অবশ্য নামকরা কেজিতে ছিল। তখনকার পরিস্থিতিও ভিন্ন ছিল। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বাবা সাধ্যের মধ্যে মেয়েদের বিলাসিতা দিয়েছেন। আমিষের কোনো সংকট ছিল না। সপ্তাহান্তে সপরিবারে অভিজাত রেস্তোরাঁয় ডিনার করেছে। খেতে ইচ্ছে না করলে প্লেট ভর্তি দামী দামী খাবার এঁটো করেছে। এখন সেসব অতীত। সেই অতীত সোনালি নাকি অমাবস্যার ন্যায় কলুষিত এখন ভাবতে আর ইচ্ছে হয় না। প্রিয়া ভাবছে দিয়াকে এবার সরকারি স্কুলে দেবে। দুর্মূল্যের বাজারে খরচটা যদি আরেকটু আয়ত্ত্বে আসে।

উচ্চতর ডিগ্রি পাওয়ার সমস্ত স্বপ্ন যখন প্রায় নিভু নিভু তখনই অন্ধকারে আলোর বিচ্ছুরণের মতো প্রিয়ার সিরিয়াল পাওয়া গেল আজিমপুরের ইডেন মহিলা কলেজে। সমাজবিজ্ঞান সাবজেক্ট এসেছে তার। অনেকদিন বাদে প্রিয়া বুঝি হাসল সেই সংবাদে। কাঁদলও। নিঃশেষিত স্বপ্নের আ গুন যখন ছাইয়ের স্তুপ হতে ফিনিক্স পাখির মতো ধরা দেয় সেই মুহূর্তে শত শত মন্দভাগ্যের মাঝেও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়।

অনুভব প্রিয়ার এডমিশন টেস্টের বইপত্র, নোটস যোগাড় করে দিয়েছিল। স্বপ্ন হারানো মেয়েটিকে পুনরায় স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়েছিল। অদৃষ্টে যা ছিল, প্রিয়ার পরিশ্রম যেটুকু ছিল তাই পেয়েছে। কিন্তু অনুভবের অবদান সে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে না। ইডেন মহিলা কলেজে সিট পেয়েছে শুনে অনুভবও খুশি হয়েছে। উৎসাহ দিয়ে বলল,
“মন্দ না। পড়াশোনা শেষে পাবলিক, প্রাইভেট কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই সেই সরকারি চাকরির পেছনেই ছুটবে যদি না আলাদা প্যাশন থাকে। তুমিও ছুটবে। পরিবারের ভবিষ্যত ভেবে হলেও তোমাকে পড়াশোনা আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। হাজার হাজার গ্রেজুয়েট বেকার বসে আছে। সেখানে এইচএসসি পাশের যোগ্যতায় তুমি বেশিদূর এগোতে পারবে না।”

কথা সত্যি। প্রিয়া বস্তিতে ওঠার দিন কয়েক বাদের প্রতিবেশী মেয়েদের সঙ্গে মিলে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিল। কিন্তু পুরুষ সহকর্মীর অপ্রীতিকর আচরণে দুদিন গিয়েই হাল ছাড়তে হয়েছে। সেই সঙ্গে অনুধাবন করতে পেরেছে দুনিয়াটা তার জন্য কতটা ল’ড়া’ইয়ের। এখানে টিকে থাকা শারীরিক অ-স্ত্র যু-দ্ধের মতো না হলেও মানসিক যু-দ্ধটা নিরব বিধ্বং-সী।
প্রিয়া অনুভবকে শুরুতে যতটা উদ্ভট ও জেদি ভেবেছিল ধীরে ধীরে মিশে বুঝল সে মনের দিক থেকে খুবই ভালো একজন মানুষ। আশেপাশের মানুষদের প্রতি সাহায্য পরায়ণ ও যত্নশীলও বটে। প্রিয়ার বিকারহীন, সোজাসাপটা কথায় মাঝে মাঝে রেগে গেলেও পরে আবার ভুলে যায়। তবে এই মুহূর্তে প্রিয়ার মাথায় নতুন চিন্তা চেপে বসেছে। ক্লাস সামলে এই চাকরিটা করা বোধহয় তার পক্ষে অসম্ভব হবে। এই সুযোগ সুবিধা, ঘরোয়া পরিবেশ, নিরাপত্তা ছেড়ে ভালো চাকরি সে আদৌ কি জোটাতে পারবে?

অনুভব একদৃষ্টে দেখছিল প্রিয়ার দিশেহারা মুখখানা। এখন গম্ভীর মেয়েটিকে এখন অল্প অল্প বোঝে। বোঝে বলেই সে হাসু তথা প্রিয়ার ওপর রীতিমতো মুগ্ধ। আত্মসম্মানের তেজ নাকের ডগায় নিয়ে ঘোরে যেন কোনো সম্রান্ত পরিবারের মেয়ে। অনুভবের মনে হয় তেমনই হওয়ার কথা। বিব্রত না করতে ব্যক্তিগত প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে হয়। তবে প্রিয়া যতই গম্ভীরতা অবলম্বন করুক শীতোষ্ণ মিঠে রোদের পরশে প্রকটিত কৈশোরের স্নিগ্ধতা লুকানো যায় না। অনুভব প্রিয়ার গালে আলতো হাতে টোকা দিয়ে বলল,
“সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। শুধু ঠান্ডা মাথায় খুঁজে বের করতে হবে। এখন জাইমের কাপড় বদলাও গিয়ে, হাসুউউউ!”

প্রিয়ার গালে অনুভবের ছোট্টো টোকা দেওয়ার দৃশ্যটা খোলা দরজার ওপারে অন্তরা ভাবীর মায়ের ঘোলাটে চোখের পর্দায় স্পষ্ট ফুটে উঠল।
________________

নিশীথের কাছে বাড়িটা ইদানীং সত্যি সত্যিই ভূতের বাড়ি মনে হয়। কোলাহল ঠাসা শহরের বুকে নিশ্ছিদ্র নির্জনতা নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালে দেয়ালে অদ্ভুত হাহাকার। নিশীথ এমন পরিবেশে স্বস্তি বোধ করত সর্বদা। সে স্বভাবত একটু ঘরকুনো ও নির্জনতা পছন্দ করা মানুষ। কাজের বাইরে অবসর কাটে গাছ কিংবা বইয়ের সঙ্গে। নিশীথ ঢাকা ফিরে আসার পর ছাদে সবজির চাষ শুরু করেছে। সেখানে নিয়মিত সময় ব্যয় করে। ছাদবাগানের প্রতি ভালোবাসা বাড়ছে। কিন্তু ইদানীং বাড়ির আকাঙ্ক্ষিত নির্জনতাই নিশীথকে স্বস্তি দিচ্ছে না। এই শান্ত পরিবেশে সজীবতা নেই, নির্জীবতাই প্রকট। কারণ বাড়ির একমাত্র কর্ত্রীর মধ্যাকার কিশোরী কুসুম প্রগলভতা শেষ বিকেলের পানসে রোদের ন্যায় ম্লান হয়ে এসেছে। মা কেমন গুমোট হয়ে থাকে সারাদিন।

তিনটে মাস আগে মায়ের একমাত্র অসম বন্ধু টুকটুকি যখন বিয়েতে অমত পোষণ করে, সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে, সকলের চোখে খারাপ হয়ে বাড়ি ছাড়ল, সকলে টুকটুকির দোষ দেখলেও একজন মাত্র মানুষ তার ছেলের দোষ খুঁজে পেলেন। রিতা নিশ্চিত ছেলেই এমন কিছু বলেছে যাতে করে টুকটুকি আংটিবদলের আগের দিন বিয়েটা ভেঙেছে। সেই সময় মেয়েটার চোখে কি ভীষণ হাহাকার লেপ্টে ছিল। হারিয়ে ফেলার য’ন্ত্রণা ছিল। কিন্তু সব ছাপিয়ে অপমানের দং’শন ছিল। দৃষ্টির ভাষা নিশীথ না বুঝলেও রিতা বুঝেছিলেন। বদনাম হোক কিংবা না হোক, ছেলের জন্য এই মেয়েটিকেই রিতা পুত্রবধূ হিসেবে চাইছিলেন। কলুষমুক্ত, নরম, কোমল স্বভাবের একটা মিষ্টি চড়ুই সারাক্ষণ কিচিরমিচির করে ছুটে বেড়াবে ঘরময়। সুনসান বাড়িটায় প্রাণের সঞ্চার করবে নিজের চঞ্চলতা দিয়ে। আগে যখন রিতা ছেলেকে বিয়ের ব্যাপারে বলতেন নিশীথ মায়ের ওপরই সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় যখন অসময় উত্তম কাজের সুযোগ পেলেন তিনি যোগ্যতা, গুণ সবদিক বিচার করে টুকটুকিকেই বউ করার ঘোষণা দিলেন।

এখানে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ লুকিয়ে ছিল বৈকি। বিয়ের পর থেকেই রিতার সপ্রতিভ সত্ত্বা সঙ্গহীনতায় ভুগেছে। স্বামী ছিলেন গোমড়ামুখো আর্মি অফিসার। দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে ল’ড়াই করলেও সংসারের প্রতি ছিলেন চরম মাত্রায় উদাসীন। জীবদ্দশায়ও স্ত্রীর প্রতি আত্মিক টান উনার তৈরি হয়নি। যেন স্ত্রী সংসারের একটা নিত্য প্রয়োজন বস্তু। তার আবার হৃদয় বলে কিছু হয় নাকি! দুটি সন্তানের জননী হয়ে রিতা ভেবেছিলেন একাকিত্ব ঘুচবে। কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুটোও বাবার মতো অন্তর্মুখী স্বভাবের হলো। বড়ো হতে হতে সকলেই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। একাকি রিতার মনে পুরোনো বাড়ির দেয়ালের মতো শ্যাওলা জমতে লাগল।
এ বাড়িটা কেনার পর তিনি বুড়ো বয়সে এসে হুট করে অসম এক বন্ধু পেয়ে বসলেন। টুকটুকি তার নাম। ঘন্টার পর ঘন্টা কেউ উনার সঙ্গে গল্প করে, গল্প শোনে, আবেগে কাঁদে, হাসিতে হাসি মেলায়। রিতার জীর্ণ মনটা আবারো উজ্জীবিত হয়ে উঠল যেন। তাই বোধহয় অল্প বয়সী মেয়েটার চঞ্চল সঙ্গটাকে শেষ বয়সে নিজের কাছে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। ভুলটা সেখানেই হলো। তিনি ছেলেকে বুঝতে বা বোঝাতেই হয়তো ভুল করেছেন ভেবে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করলেন। এমনকি ছেলের বিয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে স্বভাবসুলভ তীব্র অভিমান আঁকড়ে ধরলেন। নিশীথকে সরাসরি বলে দিলেন,
“তুই যে মেয়ে আনবি আমি তাকেই বউ হিসেবে ঘরে তুলব। মনের মতো কাউকে পেলে বলিস বাবা। আমি কাউকে চাপিয়ে দিতে চাই না। আমার মুখ চেয়ে তোকে রাজিও হতে হবে না। তোর বাবার ওপর আমাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ আমি এক মরুভূমিতে একা বিচরণ করেছি বছরের পর বছর। আর কারো সঙ্গে তেমন হোক চাই না।”

সেই থেকে নিশীথ তার মাকে ধীরে ধীরে ম্লান হতে দেখছে। নিজেকে আজকাল খুব বেশি অ’প’রা’ধী মনে হয় তার। কেন আরেকটু স্বতঃস্ফূর্ত হলো না মায়ের প্রতি। একজনের জন্য নির্জনতা আরামদায়ক হলেও অন্যজনের ওপর য’ন্ত্র’ণাদায়ক কিনা তাও বুঝতে হয়। নিশীথের বাবা বোঝেনি। তিনি নিজেকে সুখী করতে চেয়েছেন। নিশীথ বুঝতে বুঝতে টের পেল মা নেতিয়ে গেছে। আসলে ছাত্রাবস্থায় পিতার পরলোকগমনের পর থেকে পরিবারের হাল ধরার চিন্তাটা মাথায় জেঁকে বসেছিল। মায়ের বংশের সাহচর্যে রাজনীতিতে জড়াতে চায়নি কখনো। নিজ বংশ কম গৌরবান্বিত নয়। সকলেই নিজ প্রচেষ্টা ও মেধায় সমাজের উচ্চস্তরে নাম লিখিয়ে নিয়েছিলেন। অলিখিতভাবেই সেই ধারা রক্ষার দায় পড়েছিল নিশীথেরও। নিজের পরিচয় গড়তে হবে, সংসারের অবলম্বন হতে হবে, বংশের গৌরব ধরে রাখতে হবে ইত্যাদি ভাবনার মাঝে মস্তিষ্ক এতটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল যে নির্জনতাই এক সময় স্বস্তির হয়ে উঠেছিল। যেখানে তার প্রতি কারো কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।

পরিশ্রমীদের পথচলা কখনো থমকে যায় না। হয়তো পথ বদলে যায়। এখন নিশীথের ক্যারিয়ার সম্ভাবনাময়। সম্মানের সিড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। নিশীথ মাহমুদ নামটি নিজের উজ্জ্বলতা ছড়াতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই দেখল সেই উজ্জ্বলতারও ছায়া হয়। যেই ছায়ায় ঢেকে গেছে অন্দরমহল। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড একা মনে হয়। ক্লান্ত দেহটি নিয়ে বাড়ি ফেরার পর একটা ভরসার হাত ধরার জন্য বুকের ভেতর শূন্যতা তৈরি হয়। প্রগলভতাময় স্নেহ পেতে বুকটা খা খা করে। সেই থেকে নিশীথ আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে নিজেকে হাসিখুশি রেখে মায়ের সামনে উপস্থাপন করতে। রোজ বিকেলে মাকে ছাদে নিয়ে যাচ্ছে। একটি অছেলে চেষ্টা করছে সুছেলে হওয়ার।

ড্রাইভিং লাইসেন্সটা হাতে আসতেই নিশীথ বাবার গাড়িটা দাদাবাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। এখন এটাতে চড়েই অফিসে যাতায়াত করে। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে মা এই গাড়িতে উঠতে চান না। আজ অফিস থেকে ফিরে অনেকটা জোর করেই নিশীথ মাকে নিয়ে বের হতে চেয়েছে। রিতা আসতে না চাইলে বলেছে,
“ছেলের ড্রাইভিং-এর ওপর বিশ্বাস নেই বলেই গাড়িতে উঠতে চাও না। আমি কি এতটাই অছেলে?”

কথাটা বলে নিশীথ নিজেই একটু ভড়কে গেছিল। অছেলে শব্দটা যে নারীর দেওয়া তার সঙ্গে এ বাড়ির কোনো যোগাযোগ নেই। বরং টুকটুকির বিয়ে না করার দৃঢ় সিদ্ধান্তে নিশীথ নির্ভার হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎই সেই রমনীর ফেলে যাওয়া শব্দগুলো মস্তিষ্কে উঁকিঝুকি দেয়। ভাবনার দ্বারে ঘোরাঘুরি করে অনেক অবিন্যস্ত কথামালা। চোখ বুঝলে এখনো স্পষ্ট সেই চোখজোড়ার আর্দ্রতা দেখতে পায়। মেয়েটির দৃষ্টিতে কপট রাগের আড়ালে কিছু একটা ঘাপটি মে রে থাকত। অনুসন্ধানের আগেই চোখজোড়া হারিয়ে গেছে। নিশীথ ভ্রু কুচকে ভাবে, সকালে ঝুমঝুমি বোনের কথা স্মরণ করানোর পর থেকেই বোধহয় অবচেতনে টুকটুকির কথা ভাবছিল সে। তাই মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।

নিশীথের আবেগপ্রবণ কথায় কাজ হয়েছে। রিতা ছেলের ড্রাইভিং স্কিল দেখতে অনেকদিন বাদে প্রয়াত স্বামীর গাড়িতে বসলেন। নিশীথ মাকে নিয়ে সুপারশপে গেল। দুজন দেখেশুনে বাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনল। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে ব্রেক করতেই ঠিক সামনের গাড়ি থেকে দুটি মেয়েকে নামতে দেখা গেল।

টুকটুকি উবারের ভাড়া পরিশোধ করে ফিরতেই রিতা আন্টিকে দেখে অপ্রস্তুত হলো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করেছে নন্দিনী। রিতা আন্টিকে দেখে নিজেই গদগদ হয়ে এগিয়ে যায়।
“সুইট আন্টি, কতদিন পর দেখা।”

রিতা আন্টির টুকটুকির ওপর তীব্র অভিমান জমে আছে। বোধহয় নন্দিনীর ছুটে আসার জায়গায় তিনি ওকেই চাইছিলেন। গম্ভীর মুখে বললেন,
“তোমরা তরুণ। বুড়ো মানুষকে মনে থাকবে কেন? তোমার পায়ের কি অবস্থা এখন?”
“মনে আছে বলেই না পা ঠিক হতেই আপনাদের দেখতে চলে এলাম।”

তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে পরিচিতজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ মাঝে মাঝে এমন বিব্রতকর হয়ে ওঠে না পারা যায় এড়াতে আর না জড়াতে। টুকটুকির অবস্থাও এখন তেমনই। অস্বস্তিতে বুদ হয়ে আছে। নন্দিনীটাও হুট করে যা শুরু করেছে… টুকটুকি কোনোমতে উচ্চারণ করল,
“ভালো আছ আন্টি?”

রিতা আন্টি মৃদু মাথা নাড়লেন,
“ভালো।”
এরপর সম্বোধন ছাড়াই স্বগোতক্তি করলেন,
“থাকছ তো দুয়েকদিন? সময় পেলে বাড়িতে বেড়িয়ে যেও।”
রিতা আন্টি চলে গেলেন। সেদিকে তাকিয়ে কুয়াশাঘন সন্ধ্যায় টুকটুকির মুখটাও পাণ্ডুর হয়ে উঠল। নিশীথ ড্রাইভিং সিটে বসেই স্থির দৃষ্টিতে গোলগাল গড়নের মেয়েটিকে দেখছিল এতক্ষণ। আগের তুলনায় একটু শুকিয়েছে বোধহয়। মায়ের প্রস্থানে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো নিশীথ। টুকটুকি আরেকদফা ভড়কে গেল তাকে দেখে। গাড়িতে কেউ আছে ওরা লক্ষ্য করেনি। শীতল সন্ধ্যায় কেমন গরম লাগতে শুরু করেছে টুকটুকির। বলিষ্ঠ দেহের শ্যামোজ্জ্বল পুরুষটির স্থির চোখে চোখ পড়তেই হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়তে লাগল। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। নিশীথ কিছু বলার আগেই টুকটুকি ঝরের গতিতে প্রস্থান করল।
নন্দিনী কৌতুক করে বলল,
“ভর সন্ধ্যায় ভূত দেইখ্যা ভাগল না কি?”

নিশীথ চেহারায় গাম্ভীর্য টেনে চেয়ে রইল। তার মনে পড়ছে মেয়েটির সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা। যেদিন টুকটুকি তার সঙ্গে কথা বলতে এলে এভাবেই পামকিনের পেছনে ছুটে চলে গিয়েছিল।

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[২৩]

“এমন হাঁপানি রোগীর মতো করতাছোস ক্যান?”

নন্দিনী তীক্ষ্ণ বাক্য ছুড়ে দিল বিছানায় ঝুকে বসে থাকা টুকটুকির দিকে। যে কিনা রাস্তা থেকে দৌড়ে দোতলার রুমে এসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। নন্দিনী ওর গায়ে হাত রেখে চমকে উঠল,
“আরেহ! কাঁপতাছোস ক্যান? মৃ’গী হইলনি? এই ঝুমঝুমি আমার জুতাডা আন।”

ঝুমঝুমি অবাক হয়ে বলল,
“জুতা দিয়ে কী হবে, আপু?”

“টুকটুকির নাকে শুকামু। মৃ’গীরোগের মোক্ষম ওষুধ।”

টুকটুকি সেই অবস্থাতেই চোখ পাকিয়ে তাকায়। নন্দিনী ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“তোর রোগের একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে না! তাই বাটা জুতা নাকে ধরমু। চিন্তা করিস না, আমার পায়ে আবার দুর্গন্ধ হয় না।”

ঝুমঝুমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওর কথায় দাঁত বের করে হাসছে। টুকটুকি ক্ষে’পে গিয়ে নন্দিনীর চুল টান দিল। গায়ের শাল খুলে হাত দ্বারা বাতাস করতে করতে অসহায়ের মতো বলল,
“আমার অবস্থা নিয়ে তুই মজা করছিস?”

“তো কী সিরিয়াস হইয়া অ্যাম্বুলেন্স ডাকমু? মেডিকেল বোর্ড বসামু?”

“একটু স্বাভাবিক মানুষদের মতোও তো জানতে চাওয়া যায়।”

নন্দিনী জ্যাকেট খুলে রাখল গা হতে। রুমে এসে সত্যি সত্যিই গরম লাগছে। টুকটুকির পাশে বসে চোখ পাকিয়ে বলল,
“অস্বাভাবিক কী দেখলি তুই? আমি কি বিলাইর ভাষায় কথা কইছি, নাকি চিলের ভাষায়? বাই দ্যা ওয়ে, পশু-পাখিগো ভাষা তুই বুঝোছ?”

“আবার?”

নন্দিনী ওর রাগে লাল মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আইচ্ছা ভালো মতোই কইতাছি, ওই নিশীইথ্যারে দেইখ্যা এমন সেন্টি খাইলি ক্যান? মনে হইল পিছনে দড়ি ছাড়া গরু দৌড়ানি দিছে।”

টুকটুকি ব্যথিত নয়ন মেলে ধরে। এই মেয়ে এত আজব কেন? কিংবা আজব মেয়েটাই তার বেস্ট ফ্রেন্ড হলো কেন? জগতের আজব আজব বিষয়গুলো কেন টুকটুকির সাথেই ঘটছে। এই যে একটু আগে নিশীথকে দেখে তার গলা শুকিয়ে গেল, হাত-পা শিরশির করে উঠল, কণ্ঠ বুজে গেল। নিশীথ যদি কথা বলতে চাইত নির্ঘাত উল্টোপাল্টা কিছু ঘটিয়ে ফেলত টুকটুকি। কিন্তু ওই মানুষটার সামনে টুকটুকি আর নিজেকে অপ্রস্তুত করতে চায় না। ইতিমধ্যেই সে নিজের ব্যক্তিত্বকে যথেষ্ট অপমান করে সেড়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“যাকে এড়াতে বাড়ি থেকে দূরে আছি, বাড়ি আসতে না আসতেই ওই লোকের সাথে দেখা হয়ে গেল! তারচেয়েও বড়ো কথা ওই লোককে দেখলে আমার বুক কাঁপছে। আগে এমনটা হয়নি রে। তাই কোনোমতে পালিয়ে এলাম।”

ঝুমঝুমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“ওয়াও আপু! দুলাভাইকে দেখলে তোমার বুক কাঁপে? এটাই তো প্রেমের লক্ষণ।”

টুকটুকি কড়া চোখে তাকায়। এই অকালপক্ক মেয়েটিই যত নষ্টের গোড়া। কটমট করে বলল,
“বে’য়া’দব মেয়ে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে কথা গিলছিস এখনো…”
বলতে বলতে কথা হারিয়ে ফেলল টুকটুকি। কী সম্বোধন করল এই মেয়ে! দুলাভাই! লাফিয়ে উঠে বি’স্ফো’রিত কণ্ঠে বলল,
“ঝুম, কাকে দুলাভাই বললি তুই? দিন দিন লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছিস। আমি দূরে আছি বলে যে শাসন করতে পারব না সেটা ভাবিস না।”

“জন্মদিনে তুমি বকছো আমায়? নিশীথ ভাইয়া আমার জাতীয় দুলাভাই। আর আমি উনার শ্যালিকা। ডিল হয়েছে আমাদের মাঝে।”

“কীসের ডিল?” টুকটুকি বিস্ময় ধরে রাখতে পারছে না।
ঝুমঝুমি চাপা হাসল। বড়ো বোনের মুখশ্রীর প্রতিটা ভঙ্গি তাকে আনন্দ দিচ্ছে। ও চলে যাওয়ার আগে ফিচলে হেসে বলল,
“বলব না। আমার শরম করে।”

ঝুমঝুমির জন্মদিনে বিশেষ কোনো আয়োজন নেই। দুদিন বাদে এসএসসি পরীক্ষা উপলক্ষে মুরুব্বিদের দোয়া নিতেই একটু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। টুকটুকি অনেকদিন পর বাড়ি এসে বুঝল পরিস্থিতি সুবিধার না। এমনিতেই বিয়ে ভাঙায় বাবা তার ওপর রেগে আছেন। মা শুরুতে যদিও নারাজ হয়েছিলেন কিন্তু মেয়ের দূরে দূরে থাকার বেদনায় সেই রাগ চাপা পড়ে গেছে। টুকটুকি মূলত মায়ের নরম কথাতেই বাড়িমুখো হয়েছে। কিন্তু রাতে খেতে বসে যা শুনল তাতে ওর মনে হলো বাড়ি না এলেই ভালো হতো। শারমিন বেগম মেয়েকে ভালোমন্দ খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন,
“তোর বড়ো খালার ছোটো জায়ের মেজো ছেলের কথা মনে আছে?”

টুকটুকির তালগোল পাকিয়ে গেল। ফোলা ফোলা মুখখানায় বিভ্রান্তি খেলে গেলে তিনি আবার বললেন,
“ওই যে সুন্দর-মুন্দর সাংবাদিক ছেলেটা।”

“রাকিব? নাম বললেই তো পারো। তা না বড়ো খালার ছোটো জায়ের মেজো ছেলে বলে ব্রেইনে ট্রাফিক জ্যাম লাগিয়ে দিচ্ছো।”

“হ্যাঁ, রাকিবের কথাই বলছি। আগামীকাল তোর খালার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। একটু ভালোমতো থাকবি ওদের সামনে।”

টুকটুকি চকিতে তাকায়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে এইসব কথার সুক্ষ্ম অর্থ সে বোঝে। মায়ের এত নরম-সরম স্বভাবের কি তবে এই কারণ? খেয়াল করল ওর অস্থির লাগাটা আবার ফেরত আসছে। ফাকা গলায় বলল,
“গ্রেজুয়েট হতে আর কয়েক মাস মাত্র, মা…”

“সে তুমি গ্রেজুয়েট হয়ে দিল্লি গিয়ে চাকরি করো তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়েতে এবার মানা করতে পারবে না। যথেষ্ট কেচ্ছা করে উঠেছো। তোমার বাপও কিন্তু রেগে আছেন। তাকে এই বয়সে আরো য’ন্ত্র’ণা দিতে না চাইলে চুপচাপ থাকবে। আর যদি পরিবারের চিন্তা না থাকে তো যেথায় খুশি যাও।”

টুকটুকি খাবারের সাথে কান্নাটুকুও গিলে নিল। ওর প্রতিবাদ করার মুখ নেই, সাহসও নেই। কোনো পিছুটান নেই। নেই অপমানিত হওয়ার কোনো কারণ। তবুও হাহাকারে ছেয়ে যায় বুকের ভেতরটা।
_____________

উত্তুরে হাড় হিম করা হাওয়ায় কুঁকড়ে আছে প্রকৃতি। কুয়াশার অস্পর্শী চাদর ঘিরে আছে চারিদিকে। মৃদু জোছনায় আঁধার কিছুটা ম্লান। টুকটুকি মলিন বদনে ছাদে উঠে যারপরনাই চমকে গেল। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনী। আঙুলের ভাজে জ্ব’লছে এক চিলতে আ’গুন। নির্মল কুয়াশার মাঝে একটা ভারী ও গন্ধযুক্ত ধোঁয়া পাক খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। টুকটুকি তড়িঘড়ি করে ছাদের দরজা আটকে দেয়। ছুটে গিয়ে এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে মেয়েটার হাতের আ’গুন। চাপা আ’র্তনাদ করে বলে,
“তুই আবার সিগারেট খাচ্ছিস, ইকরি!”

নন্দিনী নির্লিপ্ত চোখে তাকায়। ছাদের লো ভোল্টের হলুদ বাতির আলোয় ওর মুখখানা দেখায় রাতের মতোই ধোয়াশা। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ফালাইলি ক্যান? মাত্র ধরাইছিলাম। এইবার সিগারেটের দাম দিবি তুই।”

“বাড়ির কেউ টের পেলে কী ভাববে বুঝতে পারছিস? কেন এমন খামখেয়ালিপনা করিস?”

“হলে খাওন যায় না মাইয়াগো প্যানপ্যানানির ঠ্যালায়। এহন নিরিবিলিতেও খাইতে দিবি না? শান্তির মায় কী আমার জীবনে আইসাই ম’র’ছিল!”

নন্দিনী মুখ ফিরিয়ে রেলিংয়ে হেলে দাঁড়িয়ে রইল। টুকটুকি সবকিছু উপেক্ষা করে দুহাতে জাপটে ধরে ওকে। ভার্সিটির প্রথম দিন থেকে নন্দিনীর উদ্ভট আচরণ ওকে সম্মোহিত করেছিল। নিজের চারপাশে কুহেলিকার বলয় তৈরি করে রাখা এই মেয়েটির অদ্ভুত সব আচরণ আবিষ্কারের আশায়ই বোধহয় বন্ধুত্বটা তৈরি হয়ে যায়। দুজনে একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেছে। কেউ শুনলে বিশ্বাসই করতে চাইবে না। তবে সত্যি হলো প্রিয় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এই আপাদমস্তক কেয়ারলেস মেয়েটির মনের তল বন্ধুরা কেউ খুঁজে পায়নি।
নন্দিনী চেইন স্মোকার নয়। মাঝেমধ্যে যখন নিজেকে একদমই দমাতে পারে না তখন একটা খাবেই। এই সময় মেয়েটাকে একটু বেশিই উদাসীন দেখায়। যার দুচোখে কোনোকিছু হারানোর ভয় নেই, পাওয়ার আশা নেই। এমন মানুষ প্রকৃত পক্ষে ভয়ং’কর হয়। নিজেকে শেষ করে দিতেও কোনোরূপ মায়া করে না। টুকটুকির ভয়টা সেখানেই। আবেগি হয়ে বলল,
“এতটা ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুলে আচরণ কেন তোর? একটু ভালো করে বাঁচা যায় না? এইসব প্রেম নামের অপ্রেমের খেলায় মেতে একাকিত্ব ঘোচানো যায়? মুক্ত পাখিকেও দিনশেষে নীড়ে ফিরতে হয়। দলছুট পাখিটাও এক সময় নতুন উদ্যোমে উড়তে শুরু করে। নীড় হারা পাখিটাও ঝড়ের কবলে সর্বস্ব হারিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখে যায়। তুই কেন ধ্বং’সের মোহে আচ্ছন্ন, পাখি? কেন জীবন নিয়ে এই বৈরিতা? এবার অভিমানকে বিদায় দে। মনের দেয়াল ভাঙ। মায়ের সাথে কথা বল। হয়তো কোনো ভুল হয়েছে। কিন্তু বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না।”

নন্দিনী শীতল গলায় বলল,
“মুরুব্বিয়ানা দেখাইস না, টুকটুকি। তোরা আমার শান্তির জায়গা। অশান্তি করিস না।”
“আমরা প্রত্যেকেই তোর ভালো চাই। তোকে ক্ষণিকের শান্তি নয়, চিরসুখী দেখতে চাই।”
নন্দিনী আড়মোড়া ভেঙে বলল,
“হইছে জ্ঞান দেওয়া? নিজের জীবন ভাইস্যা যায়, উনি আরেকজনের বৈঠা বায়। শখ দেখলে বাঁচি না।”

টুকটুকি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বৃথা চেষ্টা। গ্রুপে ভিডিও করল ও। কিছুক্ষণের মাঝেই দিগন্ত জয়েন করল। অনুভব অফলাইন আছে। দিগন্ত তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কী রে ভাই, পড়াশোনা নাই? ডিস্টার্ব করছিস কেন?”
নন্দিনী ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,
“ডিপার্টমেন্ট-এর টপারের চাঁদমুখটা দেখি একটু। পড়ালেখার ঠ্যালায় দেখি চেহারা-সুরত ব্রাইট দেখাইতাছে। সিজি এবার ফোর আউট অফ ফোর হইব মনে হইতাছে।”
দিগন্ত তীক্ষ্ণ চোখে দেখল ফোনের ওপর ঝুকে থাকা মেয়েটিকে। গালের দুপাশ বেয়ে গড়িয়ে আছে খোলা চুল। চারিদিক আবছা ঠাহর করে বলল,
“কই তোরা?”
“ছাদে।”
“নিশ্চয়ই ভূতের সঙ্গে লাইন মা’রার চেষ্টা করতেছিস।”
“আরে মামা, তুই কেমনে বুঝলি?”
“বাজে কথা রাখ, টুকটুকির কি হলো?”
“কাল আবার দেখতে আসবে। এবার সাংবাদিক।”
দিগন্ত গলা উঁচিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টুকটুকিকে বলল,
“ছেলেধরা নিয়ে গেছিস যখন একটু সামলে চলিস বন্ধু।”

টুকটুকি মলিন হেসে রিতা আন্টির বাড়ির দিকে তাকায়। ম্লান জোছনায় খেয়াল করে লম্বা কেউ সটান হয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। বুকটা ধক করে ওঠে ওর।

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[২৪]

হোয়াইট প্রাডো গাড়িটা জ্যামে আটকেছে দশ মিনিট হলো। নন্দিনী ব্যস্ত চোখে ঘড়ি দেখল। ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তার শোভাবর্ধক হলো ট্র‍্যাফিক জ্যাম। নন্দিনী সেই জ্যামকে উদ্দেশ্য করে কিছু অশ্রাব্য গা’লি ছুড়তেও ভুলল না। গা’লির আংশিক ভাগ দিগন্তের কপালেও জুটল। কী দরকার ছিল গাড়ি পাঠানোর? একটা উবার ডেকে নিলেই সমস্যা মিটে যেত। জ্যামের ফাঁকফোকর কেটে অলিগলি ধরে যাওয়া বাইকের জন্য কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু দিগন্ত পন্ডিতের তাতে ভরসা হলো না। বিজ্ঞের মতো ফোন করে বলল,
“দেখ ইকরি, সবেই ভাঙ্গা ঠ্যাং ঠিক হলো। এখন যদি বাইকে উঠে আবার কোনো বিপদ ঘটে! আজকাল চ্যাংরা পোলাপাইন বাইক থাকলেই রাইড শেয়ারিং শুরু করেছে। কে কতটা প্রফেশনাল বলা যায় না। উড়াধুড়া চালিয়ে শেষে ঠ্যাংয়ের সাথে বডিটাও ভেঙে দেবে। কোনো দরকার নেই ওসবে যাওয়ার।”
“আহারে বড়োলোকি চিন্তা! এতসব ভাবলে জীবনেও গাড়িতে চড়া হইব না। তো আমি কী হাঁইট্যা সাভার যামু?”
“কেন? তোর আশিকদের বল কোলে করে পৌঁছে দিতে।”
কথাটা বলে দিগন্ত বুঝল সে ভুল বলেছে। নন্দিনী কারো কোলে ওঠা তো দূর অনুভব এবং সে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেদের হাত ধরাটাও সহ্য করতে পারে না। ছোঁয়াছুঁয়িতে আবার তার ভীষণ এলার্জি। বয়ফ্রেন্ড একটু আদর করে ছুঁয়ে দিলেই এক্স হয়ে যায়। বেচারা বয়ফ্রেন্ড বুঝেই উঠতে পারে না তার দোষটা কোথায় ছিল। এই কথা শুনে যে কেউ নন্দিনীকে ভীষণ ভদ্র একটি মেয়ে ভেবে ফেলতে পারে। তাদের ধারণা আহ’ত হয় নন্দিনীর ভাষার মাধুর্যতা শ্রবণ করে। নন্দিনীর মুখ যে সভ্যতার ধার ধারে না তা পরিষ্কার হলো পরবর্তী উত্তরে।
“তোর ভাইরে পাঠাইয়া দে। সে কোলে নিলে আমার কোনো আপত্তি নাই। সারা পথ ভলিউডওয়ালা রোমান্স করমু।”
দিগন্ত ফোন রাখার আগে দাঁত কিড়মিড় করে বলেছে,
“ইকরি-মিকরি চাম চিকরি! আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি, চুপচাপ চলে আসবি। নয়তো ড্রাইভারকে বলব তোর পায়ের ওপর চাকা তুলে দিতে। বাকি গ্যা’ঞ্জাম আমার ভাই-ই সামলে নেবে।”

টুকটুকি আজ ভার্সিটি আসতে পারেনি। তার মায়ের মনে শঙ্কা জন্মেছে মেয়ে আজ বাড়ির বাইরে গেলে আবার ফাঁকি দেবে। পরে আবার পাত্রপক্ষের সামনে নাক কাটাতে হবে। অগত্যা নন্দিনী একাই এসেছে। গাড়িতে উঠে প্রথমে ভেবেছিল ভালোই হলো, এসির বাতাসে আরাম করে যাবে। কিছুটা পথ যেতেই বুঝতে পারল আরামের ব্যারাম হিসেবে একজোড়া কুটকুটে চোখ তাকে মাপছে। দিগন্তের ভরসাযোগ্য ড্রাইভারের বয়সটা ত্রিশের কোঠায় হবে, পাতলা দেহাবয়ব, গাঁজাখোরের মতোন মুখখানা। একটা অতিব কৌতুহলী ভাব আছে অঙ্গভঙ্গিতে। জ্যামে আটকাতেই সেই কুটকুটে চোখ সড়ক ছেড়ে ব্যাক মিররে উঠে এলো। নন্দিনী হাত ছড়িয়ে বসে ছিল। ড্রাইভারের দৃষ্টি খেয়াল করেই খ্যাকিয়ে উঠে বলল,
“কি মিয়া, মাইয়া মানুষ জীবনে দেহো নাই?”

ড্রাইভার থতমত খেয়ে গেল। বড়োলোকের মেয়েদের সাধারণত ড্রাইভারদের দিকে বিশেষ নজর থাকে না। তারা ড্রাইভারকে দেখে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে। কাজেই কোনো ড্রাইভার তাদের দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে খেয়াল থাকে না। আর খেয়াল হলেই চাকরি নট। সেদিক থেকে দিগন্তদের ফ্যামিলিটা বেশ। মেয়ে বলতে দিগন্তের মা ছাড়া কেউ নেই। কাজেই রাস্তা ছাড়া ড্রাইভারেরও দেখাদেখির বিষয় নেই। আজ ড্রাইভারের চোখে নন্দিনীকে দেখার পাশাপাশি কৌতুহল ছিল দিগন্ত কেন এই মেয়েকে গাড়িতে করে পৌঁছে দিতে বলেছে সেটা বুঝতে চাওয়া। ভাষার যে টোন তাতে কোনো সন্দেহ নেই মেয়েটি মিডলক্লাস। এর সঙ্গে মালিকের ছোটো ছেলের কিরকম মেলামেশা সেটা জানার একটা আগ্রহ মনে তৈরি হয়েছে বৈকি। অবশ্য ড্রাইভার নতুন। কাজেই দিগন্তের বন্ধুদের চেনার কথা না। নন্দিনী উত্তর না পেয়ে আবারো বলল,
“কানে কালা নাকি মুখে বোবা? এমনে কি দেহো? বাড়িত মা-বইন আছে?”
“আছে।” ড্রাইভার ইতস্তত করে উত্তর দিল।
“বউ আছে?”
“নাই।”
নন্দিনী সব বুঝে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। চুকচুক করে আফসোস করে বলল,
“নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ডও জুটে নাই? এইরকম কয়ডা কপাল পোড়া হয়। যাগো না জুটে বউ আর না জুটে প্রেমিকা। আই ফিল ইয়োর পেইন। এই পেইন থেকে ভয়াবহ রোগ হয়।”
রোগ শুনে ড্রাইভার আঁতকে উঠল। যেন সত্যিই সে রোগী এমন সুরে বলল,
“কি বলেন আপা? কীসের রোগ হয়?”
“বলতেছি, তুমি শোনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেও।”
জ্যাম ছুটে গেছে ততক্ষণে। পেছনে একটা পাজেরো সমানে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। অগত্যা মনের মাঝে শঙ্কা চেপে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছাতে নন্দিনী মুখটাকে বিকৃত করে বলল,
“এই রোগের নাম লু’ই’চ্চা সি’ন্ড্রোম। আর শিরোনাম হলো, যেদিকে দেখিবে মাইয়া, দৃষ্টিখানি দিবে মেলিয়া। চোখের সুখই মনের সুখ। আরেকদিন যদি আমার চোক্ষের সামনে তুই পড়ছোস, চোখ লইয়া মারবেল খেলমু, হা’রা’মজাদা।”
সজোরে গাড়ির দরজা আটকে নন্দিনী হনহনিয়স চলে গেল।

দিগন্ত ভার্সিটি এসেছে কিছুক্ষণ হলো। এককাপ চা নিয়ে ও অপেক্ষা করছিল নন্দিনীর পৌঁছানোর। পথের দিকে এলোমেলো দৃষ্টি মেলে চায়ে চুমুক দিতেই অসাবধানতায় জিভ পুড়ে গেল। চায়ের কাপ নামিয়ে ভালোমতো খেয়াল করে দেখল মেডিকেলের সেই ইমন! যে কিনা নন্দিনীর পেছনে ঝুলে আছে তিনমাস ধরে। বান্দা আজ ক্যাম্পাসে সে হাজির! দিগন্ত নিজেই এগিয়ে গেল। হ্যান্ডশেক করে কুশলাদি বিনিময় করে ইমন বলল,
“নন্দিনী কি ক্যাম্পাসে পৌঁছেছে?”
দিগন্ত ভ্রু কুচকাল। তারমানে নন্দিনী যে ক্যাম্পাসে ছিল না সেই খবরও জানা! গলা ঝেরে বলল,
“নন্দিনী তো আরো ঘন্টাখানেক আগেই এসেছে।”
“একটু দেখা করতাম। ফোনে পাচ্ছি না। আপনি কি বলতে পারবেন ওকে কোথায় পাব?”
দিগন্ত মনে মনে একটা মিচকে হাসি দিল। মুখে বেদনার ছায়া ফেলে বলল,
“ভাই ইমন, আপনার কিছু জানার দরকার আছে নন্দিনীর ব্যাপারে। সে ঘন্টাখানেক আগেই এসে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেটে চলে গেছে। আপনি বোধহয় ওর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসের ব্যাপারে জানেন না।”
ইমন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়। সবিস্ময়ে বলে,
“ও রিলেশনশিপে আছে?”
“আলবত। আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। এখন যার সঙ্গে রিলেশনে আছে সেটা ওর কততম বয়ফ্রেন্ড নন্দিনী নিজেও জানে না। ইনফ্যাক্ট আপনি জানলে অবাক হবেন নন্দিনীর নেক্সট টার্গেট হতে চলেছে আমারই বড়ো ভাই। আপনার সিডিউল কবে বলতে পারি না।”
ইমন জোরে জোরে মাথা নাড়ে।
“অসম্ভব, নন্দিনী এমন মেয়েই না।”

দিগন্ত একটা কাষ্ঠহাসি হাসল। ওরা প্রায় চারটি বছর একসঙ্গে থেকেও নন্দিনীকে চিনল না আর এই ছেলে নাকি তিনমাসেই চিনে ফেলেছে। হাউ ফানি! দিগন্ত সম্মতি দিয়ে বলল,
“ঠিক, নন্দিনী এমন মেয়েই না। আসলে কেমন মেয়ে সেটা আপনি ধারণাও করতে পারবেন না। শী ইজ আ সাইকো। বয়ফ্রেন্ড অন্য মেয়ের দিকে যাস্ট একটু তাকালেও মে’রে আলুভর্তা করে দেয়। মা’রা’মা’রিতে খুবই দক্ষ। পা টা কিন্তু এমনি এমনি ভাঙেনি। এক্সিডেন্ট এর কাহিনি যাস্ট ভোগাস।”
ইমন ঠিক কতটা কি বিশ্বাস করল বোঝা গেল না। তবে সে ক্যাম্পাস ত্যাগ করল মিনিট কয়েক পরেই। এবং ঠিক পরমুহূর্তেই নন্দিনীর আগমন ঘটল। তেড়ে এসে দিগন্তের কলার ঝাকিয়ে বলল,
“তোর গাড়ি আর গাড়ির ড্রাইভার জানি জিন্দেগীতে আমার চোখের সামনে না পড়ে।”
আকস্মিক আ’ক্র’মণে দিগন্ত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ধাতস্থ হয়ে বলল,
“জংলী কোথাকার! ছাড় আমারে। কি করছে আমার গাড়ির ড্রাইভার।”
“হা’লা লু’ইচ্চা সি’ন্ড্রোমে আ’স’ক্ত।”
“কি বলিস! এমন তো দেখিনি।”
“তুই কি মাইয়া? নাকি তোর গায়ে মাইয়াগো পার্টস-পাতি আছে যে হা’লায় লোভাতুর হইয়া দেখব?”
দিগন্ত বিরক্ত হলো। ধমকে বলল,
“আহ! একটু ভদ্রভাষায় কথা বলা যায় না?”
“নাহ যায় না, চলতে পারলে থাক, নয়তো ফোট।”
দিগন্ত কথা বাড়াল না। নন্দিনীর মেজাজ গরম হয়েছে মানে বিষয়টা মোটেও মজার নয়। বাড়ি একটা বিহিত করবে বলে আশ্বাস দিল। নন্দিনীকে আশেপাশে নজর বোলাতে দেখে বলল,
“কারে খুঁজিস?”
“ইমন আসার কথা।”
দিগন্ত তড়িঘড়ি করে নন্দিনীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“রাখ তোর ইমন। মান্নান স্যারের ক্লাস আছে এখন। মিস করলে আমাদেরই লস। ইমন-কিমন প্রক্সি দিতে পারবে না।”
___________________

দুপুর গড়াতেই তেজস্বী সূর্য তেজ হারিয়েছে। নরম আলোয় দেহ শেকে নিচ্ছে অলস প্রাণেরা। ঝরিয়ে দিচ্ছে দেহে সঞ্চিত সকল হিম। নন্দিনী টুকটুকির বাড়িতে রাত্রিযাপন করে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও টুকটুকি তাকে ছাড়েনি। ক্লাস শেষ করে আবারো ফিরতে বলেছে। জীবনের ক্রমপরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে টুকটুকির মন বেচারা খাপ খাইয়ে নিতে নিতে পর্যদুস্ত প্রায়। তার মনের সুতো আটকে আছে সেই তিনমাস আগের সময়টায়। যখন তার শুভাকাঙ্ক্ষী আরো কয়েকজন বেশি ছিল। ছিল আরেকজন মমতাময়ী বন্ধু। আর মমতাময়ীর অসামাজিক পুত্র। ঝগড়া, রাগ যাই থাক না কেন মনে তখন অনাবিল শান্তি ছিল। আর এখন তাদের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও কেমন অস্বস্তিকর। একই মানুষ, একই স্থান, শুধু ঘটনা প্রবাহের ধারায় আচরণ বদলে গেছে।

আজ আবারো বাড়িতে সুঘ্রাণ মৌ মৌ করছে। বড়ো খালার ছোটো জায়ের মেজো ছেলের আপ্যায়নে দুপুর থেকেই রান্নাঘরে এলাহি আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মায়ের শীতল দৃষ্টির কবলে পড়ে টুকটুকির পরিপাটি দেহটিকে যত্ন নিয়ে আরেকটু পরিপাটি করতে হয়েছে। বড়ো খালা মায়ের চেয়ে বয়সে বেশ অনেকটাই বড়ো। গালভর্তি পান নিয়ে ঘোরেন সব সময়। টুকটুকির মনে হয় নানির অভাবটা তার বড়ো খালাই পূরণ করে দিচ্ছেন। সেই নানিসুলভ খালার নিজের কন্যাসন্তান নেই বলেই বোধহয় টুকটুকির প্রতি একটু বেশিই নরম। তাকে নিজ বাড়ির বউ করবে কল্পনা করেও তিনি উচ্ছ্বসিত। একমাত্র মেয়েকে বোনের হেফাজতে রাখতে পারলে শারমিন বেগমও নিশ্চিন্ত। তাই এবারের খুশির আমেজটা একটু বেশিই। টুকটুকি চুল বেধে নিতে নিতে হঠাৎ চমকে উঠল। নন্দিনী রুমে প্রবেশ করেছে। তবে সেটা টুকটুকির চমকানোর বিষয় নয়। নন্দিনীর কোলের জিঞ্জার কালার পারসিয়ান বিড়ালটাই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। টুকটুকি বলল,
“ওকে কোথায় পেলি?”
“বাড়ির সামনে। আদর আদর লাগল তাই ধইরা নিয়া আইলাম।”
“এটা রিতা আন্টির বিড়াল। দিয়ে আয়।”
নন্দিনী পামকিনকে টুকটুকির কোলে দিয়ে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত গলায় বলল,
“পারমু না। ভুইলা গেছোস আমার ঠ্যাং মাত্রই ঠিক হইছে। এত হাঁটাহাঁটি সম্ভব না।”

পামকিন টুকটুকির বাহুতে মাথা ঘষছে। এতদিন পরেও যেন চিনে ফেলেছে কোলটা। টুকটুকি কিছুক্ষণ বিরামহীন আদর করল। বাড়ি ফিরিয়ে দিতে ঝুমঝুমিকে খুঁজল। কাজের বেলায় এই মেয়েকে একদমই পাওয়া যায় না। ও বাড়িতে আবার খোঁজ পড়ে কিনা! রিতা আন্টি তো এই সঙ্গীকে চোখের আড়াল করতেই পারে না। নন্দিনী একে বাইরে পেল কী করে? টুকটুকি ভাবল কলিংবেল বাজিয়ে পামকিনকে দরজার সামনে রেখে আসবে। দরজা খুলতে খুলতে সে পগার পার। তবে ভাবনা সফল হলো না। কলিংবেল বাজাতে যাওয়ার সময় রিতা আন্টি নিজেই বেরিয়ে এলেন। বোধহয় পামকিনকেই খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। টুকটুকি যারপরনাই অপ্রস্তুত হলো। মাথা নিচু করে বলল,
“পামকিন রাস্তায় বেরিয়েছিল। তাই দিতে এলাম।”

রিতা আন্টি পামকিনকে কোলে নিয়ে বললেন,
“বাইরে থেকে চলে যাবে? এসো ভেতরে। পুডিং করেছি, চিজ কেকও আছে। তুমি তো পছন্দ করো। একটু খেয়ে যাও নাহয়।”
টুকটুকি নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেও পারল না। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে রিতা আন্টিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“আমি কিচ্ছু খাব না তোমার হাতের। কাল থেকে আমায় তুমি করে বলছো। তুই করে কেন বলছো না?”

রিতা আন্টি আবেগপ্রবণ মানুষ। টুকটুকির কান্নায় সামিল হতে খুব একটা দেরি হলো না। দীর্ঘসময় বাদে উভয়ের অভিমানের বরফ যেন অশ্রু হয়ে বইতে লাগল। রিতা আন্টি বললেন,
“কেন বলব? তুই কি আমাকে আপন ভেবেছিস? ভাবলে পারতিস এতদিন যোগাযোগ না করে দূরে থাকতে? দূরে থেকেই প্রমাণ করে দিয়েছিস পর কখনো আপন হয় না।”
“আই রিয়েলি মিস ইউ আন্টি। রিয়েলি রিয়েলি।”
“ওসব ঢঙের কথা।”
“মনের কথা।”
“ঢঙের মন।”
“জানেমান।”

দুজনে কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেলল। সেই অশ্রুসিক্ত হাসি বলে দেয় দুজনের মনের টানে সামান্যতম খাঁদ নেই। আছে অসম বন্ধুত্বের নিগূঢ় মমতার রেশ। ভেতর থেকে নিশীথ সেই দৃশ্যটা দেখে অদ্ভুত শান্তি অনুভব করল। যেন অনেকদিন বাদে মনের ভারটা হুট করেই নেমে গেল। ও জিজ্ঞেস করল,
“তোমার আহ্লাদী বোন এত সেজেছে কেন?”
ঝুমঝুমি রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলল,
“আমার আহ্লাদী বোনকে আজ দেখতে আসছে যে। এবার সত্যি দুলাভাইটা পেতে চলেছি।”

নিশীথের দৃষ্টি খাটো হয়ে এলো। রিতা আন্টি ততক্ষণে টুকটুকি জড়িয়ে ধরেই ভেতরে নিয়ে এসেছে। টুকটুকি ভেতরে ঢুকে দেখল ঝুমঝুমি এ বাড়িতেই আছে এবং এখন সে নিশীথের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। টুকটুকির গলাটা আবার শুকিয়ে আসতে লাগল। বুকের ভেতর কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। বিপরীতে নিশীথের দৃষ্টি রুক্ষ। গত সন্ধ্যায় মেয়েটি তাকে উপেক্ষা করে দৌড়ে গেছে ভোলেনি সে। টুকটুকির পাশ কেটে চলে যাওয়ার সময় নিশীথ একটা বিদ্রুপের দৃষ্টি ফেলে ক্ষীণ গলায় বলে গেল,
“মোড়ের মাথার ছকিনা পা’গলীর মতো দেখাচ্ছে।”

চলবে…