শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
494

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৬]

শুভ্র ভোরের শুভ সূচনা। মনুষ্যসৃষ্ট শব্দকে ছাপিয়ে কানের খুব কাছেই শালিক জুটির ঝগড়াঝাটি শোনা যাচ্ছে। কিছুদিন ধরে ঘুম ভেঙে প্রিয়ার শরীরে অদ্ভুত আলস্য ঘিরে ধরে। মনে হয় সে আবার তার পুরোনো বাড়িতে আছে। সেই ধবধবে দেয়াল, ছাদ, টাইলসের মেঝে। মাঝের সময়টা মিথ্যা। কোনো বেদনা ছিল না, কাছের মানুষের মুখোশ খুলে পড়ার যাতনা ছিল না, ছিল না ষড়যন্ত্র। অভাবের টানে জুতোর তলা খোয়াতে হয়নি। টিনের মরচে ধরা ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের মধ্যে বসবাস করে মায়ের হতাশা, বোনের কাতরতা কিছুই দেখতে হয়নি।
জানালা দিয়ে আসা সূর্যকিরণ গা স্পর্শ করতেই প্রিয়া ঘোরের জগৎ থেকে ছিঁটকে বেরিয়ে আসে। এও তার বাড়ি নয়। কিছুই কল্পনা নয়। তাকে আবারো মুখোমুখি হতে হবে বাস্তবতার। নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠেছে আজ সপ্তাহখানিক হলো। খাট না থাকায় ফ্লোরিং করে ঘুমাতে হচ্ছে তাদের। বিছানা ছেড়ে বাইরে যেতেই চমকে উঠল প্রিয়া। অনুভব ডাইনিং রুমে বসে আছে মায়ের পাশে। হেসে হেসে গল্প করছে দুজনে। প্রিয়ার এলোমেলো অবস্থার দিকে অনুভব এক পলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ওড়নাহীন মেয়ে দেখে সে অনভ্যস্ত এমন নয়। তার বন্ধু কিংবা সহপাঠি মেয়েরা অফ-শোল্ডার, স্লিভলেস ড্রেস পরলেও অনুভবের সমস্যা হয় না। কিন্তু প্রিয়া তেমন নয়। সে পরিপাটি করে ওড়না ঝুলিয়ে রাখে গলায়। সেটাই তার কম্ফোর্টজোন। অনুভব অন্যের কম্ফোর্টকে সম্মান করে। সে অস্বস্তিতে না পড়লেও প্রিয়া যে অস্বস্তিতে পড়বে তা নিয়ে সন্দেহ নেই বলেই চোখটা প্রেয়সীর ঘুমভাঙা মুখটাকে উপভোগ করার বাসনা পরিত্যাগ করল।

প্রিয়া অনুভবের দৃষ্টির চাঞ্চল্য দেখেই তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে যায়। মা পিঠ দিয়ে ছিলেন বলে ক্ষণিকের এই অপ্রস্তুত অবস্থা সম্পর্কে অনবগত রইলেন। সে গায়ে ওড়না জড়িয়ে পুনরায় বাইরে আসতেই খেয়াল হলো অনুভব ও মা চা খাচ্ছে। দিয়া চায়ের কাপ ও নোনতা বিস্কুট নিয়ে দক্ষিণের খালি ঘরটায় গিয়ে বসেছে। প্রিয়া ভ্রু কুচকায়। বাড়িতে না আছে চা পাতা, না চিনি, দুধ। মুনিরা বেগম বললেন,
“দেখ, সকাল সকাল চায়ের উপকরণ নিয়ে চলে এসেছে ছেলেটা। ওর নাকি সবার সাথে চা খেতে ইচ্ছে করছে। নিজের হাতে বানিয়েও দিয়েছে।”

“সবই তোমাকে পটানোর ধান্ধা।” বলতে ইচ্ছে করলেও কথাটা প্রিয়া গিলে নিল। নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে একটু দূরে সরে বসল তাদের থেকে। চুমুক দিয়ে দেখল খেতে ভালোই হয়েছে। অনুভব ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জানতে চায় চা কেমন হয়েছে। প্রিয়া সত্যিটা বলল না। লোকটা বড়ো জ্বা’লাতন করছে ইদানীং। মাথায় উঠতে দিলেই বিপদ। ও কাঁধ ঝাকিয়ে বোঝাল চা কোনোরকম হয়েছে।

অনুভব তাতে দমে গেল না মোটেও। সে বলে চলেছে,
“আম্মু, আপনার চলাচলের সুবিধার জন্য একটা হুইল চেয়ার কিনব। একদম নতুন পারব না। অনেক দাম নেবে। সেকেন্ড হ্যান্ড পেয়েছি এক বন্ধুর কাছে। ভালো কোয়ালিটির। বন্ধুর বাইক এক্সিডেন্টের পর দুই মাস ইউজ করেছিল। অল্পদামে দেবে। বিকেল নাগাদ নিয়ে আসব।”

“কত দাম পড়বে?”

“আট হাজার নেবে, আম্মু। পরিচিত বলে কমে দিচ্ছে।”

মুনিরা বেগম আঁতকে উঠলেন,
“কম হলেও অনেক টাকার ব্যাপার। প্রয়োজন নেই বাবা। আমি মানিয়ে নিয়েছি।”

অনুভব ভয়ানক বিমর্ষ হয়ে মাথা নত করে বলল,
“আপনি তো আমায় ছেলে হিসেবে গ্রহণ করছেন না, আম্মু। তাই আমিও আপনাকে মায়ের সেবাটুকু অধিকারবোধে নির্দ্বিধায় করতে পারছি না। চিন্তা নেই। ধার হিসেবেই নেবেন। প্রিয়া ইভেন্টের জবটায় জয়েন করে ধীরে ধীরে শোধ দেবে নাহয়। চাকরিটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। টিউশনি কবে না কবে পাবে, মনমতো পাবে কিনা তার ঠিক নেই। ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার গজাচ্ছে। টিউশন মিডিয়া হচ্ছে। সব টিউশনি তারাই ক্যাচ করে ফেলছে বলে এখন স্বাচ্ছন্দ্যে ভালো টিউশনি পাওয়াও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি গ্রেজুয়েশন দিয়ে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি বলে স্টুডেন্টদের ফ্যামিলির কাছে যতটা প্রায়োরিটি পাব, প্রিয়া তত সহজে পাবে না। তারচেয়ে নন্দিনীর এনে দেওয়া জবটাই প্রেফারেবল। অবশ্য ইভেন্টের জবটায় বেতন দিয়ে কোনোমতে চললেও নানান জায়গায় ইভেন্ট এরেঞ্জ করতে যেতে হয় বলে ফিরতে রাত হবে। পাশে কেউ থাকলে ওরও সুবিধা হতো।”

প্রিয়া বিস্ময়ে হতভম্ব। কত্ত বড়ো নির্লজ্জ! একে তো দমে দমে আম্মু আম্মু করছে আবার ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা বলছে! লজ্জায় প্রিয়া বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। মায়ের দিকে তাকাতেও সংকোচ লাগে। অনুভব দিয়ার সঙ্গে গল্প করার বাহানায় স্থান ত্যাগ করে দক্ষিণের ঘরটায় ঢুকে গেল। যাওয়ার আগে চোখ টিপে মেয়েটার লজ্জা ও অপ্রস্তুতভাব আরেকধাপ বাড়িয়ে দিতে ভুলল না।

দক্ষিণের রুমটায় কেউ থাকে না। ফাঁকা পড়ে আছে। প্রিয়া মা-বোনকে নিয়ে পাশের ঘরটাতেই থাকে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া বাড়িতে কোনো ফার্নিচারও নেই। সবটা ধীরে ধীরে গড়তে হবে। দিয়া জানালার গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে দেখছিল। অনুভবকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“এই বাড়িটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে ভাইয়া। কিন্তু এখানে আমার কোনো বন্ধু নেই। তুমি আমাদের সঙ্গে কবে থেকে থাকবে? অনেক মজা হবে তাহলে।”

অনুভব ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিল। দুজনের ভাব হয়েছে অতি দ্রুত। বলল,
“থাকব। তোমার রাগী আপুটার রাগ কমলেই থাকব। কিন্তু এই রুমে তোমরা কেউ থাকছ না কেন?”

“মা বলেছে এটা তোমার আর আপুর রুম হবে।”

“কী বললে?” অনুভব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

দিয়া একই কথা পুনরাবৃত্তি করল। অনুভব ডগমগিয়ে ওঠে। আম্মু বলেছে! তারমানে উনি মেনে নিয়েছে! খুশিতে দিয়াকে কোলে নিয়ে একপাক দেয় সে। দিয়ার খিলখিল হাসি ফাঁকা ঘরের দেয়ালে বারি খেয়ে উচ্চধ্বনি করে ওঠে। দিয়া মায়ের ডাকে ছুটে বেরিয়ে যেতেই প্রিয়া এলো। তার মুখ থমথমে। একটু আগের নির্লজ্জতার জন্য রাগ দেখানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে। মুখ খুলতে যাওয়ার আগেই অনুভব ওকে প্রায় বাহুর মাঝে লুফে নেয়। প্রিয়া জড়তা কাটিয়ে উঠতেই টের পায় উত্তেজনায় দেহ কাঁপছে লোকটার। যা ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে প্রিয়ার দেহে। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“দিয়া চলে আসবে।”

অনুভব সে কথায় পাত্তা দিল না৷ একটু আগে যাকে এলোমেলো দেখতেও বাধছিল এখন তাকেই বুকের মাঝে নিতে সংকোচ লাগছে না। কয়েকটা চুমু টুমুও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। প্রিয়া আবারো তাড়া দিতেই অনুভব বলল,
“আম্মুর এটুকু কান্ডজ্ঞান আছে হবু স্বামী স্ত্রী আলাদা কথা বললে তাদের স্পেস দিতে হয়। কেউ আসবে না।”

প্রিয়া জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বলল,
“অত লাফালাফির কিছু নেই। আমি এখনো রাজি হইনি।”

অনুভব সে কথায় পাত্তাই দিল না। আবারো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“খুব জ্বা’লাচ্ছ, হাসু। তুমি জানো আমি হলের খাবার খেতে পারি না। খাবার কোনোমতে পানি দিয়ে গিলে খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। আমি না বাঁচলে তো তুমি স্বামী পাবে না। তোমার জন্য হলেও আমায় বাঁচতে হবে। আমার প্রতিটা স্ট্রাগলে তোমার চিন্তা, দেখেছো?”

“আপনার স্ট্রাগলের গল্প শুনে আমার মোটেও কান্না পাচ্ছে না।”

“আই ফিল পিটি ফর মাইসেল্ফ। একটা নিষ্ঠুর বউ জুটতে চলেছে।”

“তাই গুণীজনরা বলেছেন, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। আরেকবার ভাবুন, ইউ হ্যাভ এনাফ টাইম।”

অনুভব হাতের বাধন শক্ত করে। কিছুটা রাগ, কিছুটা বেদনার সঙ্গে উচ্চারণ করে,
“মুরুব্বিদের মতো জ্ঞান দেবে না, খবরদার! একটু নরম হও মেয়ে। এত প্র‍্যাক্টিক্যাল হতে কে বলেছে তোমায়? জীবনটাকে ক্যালকুলেটর বানিয়ে ফেলছো একদম। দুঃখের হিসেব করা ছেড়ে সুখের স্বপ্ন দেখো। তুমি জানো কতদিন পরিবারের সাথে, আপন মানুষের সাথে বসে একসঙ্গে থাকা হয় না আমার। হলের দেয়ালগুলো প্রতিনিয়ত নিঃসঙ্গতা মনে করিয়ে দেয়। আমার আপন বলে অধিকার দেখানোর মতো কেউ নেই। কেউ না। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি মানুষ ডিপ্রেশনে কেন ভোগে।
সেই ডিপ্রেশন থেকে বাঁচতে হলেও একটা শান্তির নিবাস চাই। আমার শান্তি যে হাসু। হাসুকে ছাড়া একটা শান্তির নিবাস কী করে গড়ব আমি? অবশ্য তুমি যদি আমায় ভালো না বাসতে পারো, স্বামী হিসেবে না মানতে পারো তাহলে ভিন্ন কথা। আমি আর জোর করব না।”

প্রিয়া বিহ্বল হয়ে আছে। পুরুষালি বুকের ওমে শরীর শিরশির করছে তার। সমস্ত দুশ্চিন্তা ঝরে গিয়ে দেহটা এক লহমায় নির্ভার হয়ে গেছে। মা ব্যতীত অন্য কারো বন্ধন এতটা নির্মল, আদুরে, প্রশান্তিকর হতে পারে সে জানত না। অনুভব সাড়া না পেয়ে ব্যথিত হয়। প্রিয়া তাকে ভরসা করে না! ভালো বাসে না! সে কী আসলেই মন ছুঁতে ব্যর্থ হলো? অনুভব প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে স্বপ্ন সাজানো দক্ষিণমুখী জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টিসীমায় ভাসে মেঘহীন খরতপ্ত আকাশ। ক্ষণকাল বাদে প্রিয়া এসে তার পাশে দাঁড়ায়। অনুভব ফিরে তাকায় না। প্রিয়া ওর বাহুতে মাথা রেখে চোখ বুজল। ফুরফুরে হাওয়া কানে কানে শুনিয়ে যায় প্রেয়সীর নিরব সমর্পণ। মন উত্তাল হয়। অনুভব এক লহমায় আবারো তাকে টেনে নেয় বুকের মাঝে। কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলে,
“ভালোবাসি, ভালোবাসি।”
___________________

রঙচটা দেয়ালে টানানো ডিম্বাকৃতির আয়নায় নিজেকে দেখে নন্দিনীর কপালে ভাজ পড়ে। চুলের বর্তমান অবস্থার জন্য ঠিক কোন বিশেষণ ব্যবহার করবে ভেবে পাচ্ছে না। মানুষ যে অগোছালো অবস্থাকে কাকের বাসার সঙ্গে তুলনা করে তা আসলে ভুল। কাকের বাসাও অনেক পরিপাটি। অন্তত কাক তার সাধ্যমতো নিজ বাসাকে বাসযোগ্য রাখে। সেখানে তো আর মানুষ থাকবে না যে মানুষের মনের মতোন দৃষ্টিনন্দন করে গড়বে। কাজেই মানুষের অবস্থার সঙ্গে কাকের তুলনা করাটা বোকামি হবে। কাক বেচারা যদি জানত মানুষ তার বাসাকে কতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে! জানলে সেও কি মন খারাপ করত? কিংবা রেগে গিয়ে উড়ে উড়ে মানুষের মাথায় পটি করত! সেসব না করলেও নন্দিনীর তেলহীন, আগা ফাটা, রুক্ষ, জট লেগে যাওয়া চুল দেখে নিশ্চয়ই বিদ্রুপ করে বলত,
“তোর চুলের সঙ্গে তুলনা করা মানে আমার বাসাকে অপমান করা।”

নন্দিনী চুলে চিরুনি চালাতে গিয়ে রীতিমতো যু’দ্ধ করতে শুরু করেছে। তখনই পালক রুমে ঢুকল। তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ হয়ে গেছে রিসেন্টলি। পরিবার নাকি তাকে মানবে না এমন দোহাই দিয়ে বয়ফ্রেন্ড সরে পড়েছে। পালক সারাক্ষণ মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতের বেলা বালিশে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একেবারে ভেঙে পড়েছে। নন্দিনীকে চুলের সঙ্গে কু’স্তি করতে দেখে ও বলল,
“মাথায় তেল দিয়ে জট ছাড়াও। আমি হেল্প করব?”

নন্দিনী মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,
“নিজের মুখটা আগে ঠিক কর। আমি হেল্প করমু?”

পালক উত্তর না দিয়ে মুখ নামিয়ে নেয়। দেখে মনে হচ্ছে আবার কাঁদবে। নন্দিনী রাগে চিরুনি ছুঁড়ে মারে। পড়েছিল এক ল’ম্প’টের খপ্পরে। আড়ালে-আবডালে ডাকাই ছিল যার প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। অথচ এই মেয়ে সেই ছেলের জন্যই কেঁদে ভাসাচ্ছে দুই বেলা। সেমিস্টার ড্রপ দেবে নিশ্চিত। এরা যার প্রতি লয়াল হয় তার লয়ালিটি কতটুকু তা কেন বুঝতে চেষ্টা করে না? একেই বলে প্রকৃত অন্ধপ্রেম।

নন্দিনী জট ছাড়ানোর চিন্তা বাদ দিয়ে চুলে খোপা করে বেরিয়ে গেল হল থেকে। অনুভব লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করছে দিনরাত। দিগন্ত গ্রি (Gree) এক্সামের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত৷ এই পরীক্ষা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাচেলর বা মাস্টার্স করা যায় না। যদিও এখনো দিগন্তের ইচ্ছে নেই এব্রোডে যাওয়ার। এখানেই মাস্টার্স করতে চায়। টুকটুকি হুট করে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। তার সঙ্গে কারোই ঠিকমতো কথা হচ্ছে না।

লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখে মুখোমুখি হলো দিগন্ত, নন্দিনী। বিশেষ বার্তা শোনার জন্য তাদের ডাক পড়েছে অনুভবের নিকট। দিগন্ত নন্দিনীর চুল টেনে বলল,
“ফোন কি সাজিয়ে রাখার জিনিস? গতকাল থেকে কয়বার কল করেছি তোকে?”

“কয়বার?” নন্দিনী পাল্টা চুল টেনে দেয়।

“বাইশবার।”

“সংখ্যাটা কত বললি?” নন্দিনী কান খুঁচিয়ে জানতে চায়। ওর চোখেমুখে কৌতুক।

দিগন্ত দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করে,
“বাইশ।”

“আমাগো বাড়িত যাইস, বকরির লেদা ভাইজ্যা দিমু কড়কড়াইয়া খাইস।”

“লেদা মিনস পটি না? ইয়াক থু থু! এসব নোংরা, বিদঘুটে কথাবার্তা তুই কোত্থেকে পাস?”

নন্দিনী বিতৃষ্ণায় দাঁত দিয়ে ঠোঁট কা’মড়ে বলল,
“পটি হুইন্যা এমন ভাব লইতাছো যেন জীবনে পটি করো না? তোমাগো বাড়িত টয়লেট নাই?”

“ব’দ’মাইশ, তুই কি ভালো হবি না?”

নন্দিনী গা ছাড়া ভাব নিয়ে সুর করে গাইতে লাগল,
“আমি তো ভালা না ভালা লইয়াই থাইকো…”

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৭]

শারমিন বেগম খেয়াল করছেন বড়ো কন্যাটি কয়েকদিন যাবত মুষড়ে পড়েছে। ঠিকমতো খাচ্ছে না, ঘুমের সময়টাও এলোমেলো। বাইরেও বেরোচ্ছে না একদম। নিজেকে একেবারে বন্দি করে রেখেছে। টুকটুকি মোটেও চুপচাপ বসে থাকার মেয়ে নয়। দিনে একবার হলেও হাঁটতে বের হবে। মিশুক স্বভাবের জন্য এ বাড়ি ও বাড়ি সব প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার গলায় গলায় ভাব। সেই মেয়ের এমন পরিবর্তন দৃষ্টিকটু লাগে বৈকি।

শারমিন-তোফায়েল হক দম্পতির প্রথম সন্তান হওয়ায় টুকটুকির প্রতি সকলের ভালোবাসা ছিল অনেকটা উপচে পড়া কলসের টলটলে জলের মতো। আদর-আহ্লাদে আচ্ছন্ন মেয়েটিকে ফুলের টোকা দিতেও মায়া হতো। শারমিন বেগম ছোটো কন্যাকে বড়ো করতে যে পরিমাণ কসরত করেছেন বড়োটার বেলায় তার অর্ধেকও করতে হয়নি। ঝুমঝুমি দুষ্টুমি করে বেশি, চিৎকার করে কথা বলে, মেজাজ দেখায়, সহজে তাকে কাঁদানো যায় না। শারমিন বেগম সব সময় তাকে টুকটুকি সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলেছেন নরম মনের হতে। কিন্তু এখন মনে হয় কথাটায় ভুল ছিল৷ বরং টুকটুকির মনটাকে শক্ত করার উপদেশ দিলে ভালো হতো। মেয়েটাকে অতিরিক্ত আদর করে গায়ে বড়ো করলেও মনে বড়ো হতে দেননি। সব সময় ছোটোবেলার মতো নরম-সরম করেই রাখতে পছন্দ করেছেন। তাই এখন আবেগী মেয়েটা ব্যথা সহ্যই করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা তো আবেগে চলবে না। জীবনে যদি বড়ো কোনো প্রতিকূলতা আসে তখন! সারাজীবন উনারা থাকবেন না মেয়েকে আগলে রাখতে। একটা যোগ্য জীবনসঙ্গীকে কি ওর দায়িত্ব দিয়ে যেতে পারবেন? রাকিব কি হবে সেই যোগ্য মানুষটা? মনের মধ্যে দোনোমনা বাসা বাধে। রাকিব ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছে দুদিন আগে। তার জন্য তো মেয়ের এমন বিরহ নয়। রাকিবের সঙ্গে টুকটুকির সম্পর্ক আত্মীয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মানসিকভাবে সহজ হতে পারেনি। তাছাড়া শারমিন বেগম খেয়াল করেছেন রিতা আন্টির সঙ্গে টুকটুকির পুনরায় আগের মতো মেলামেশা। বিশেষ করে নিশীথ, তার গাড়িতে করে অনেকবারই ফিরতে দেখেছেন মেয়েকে। এরপর একদম হুট করেই সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সে। একটা শঙ্কা মনের মাঝে প্রবল হয়ে উঠছে।

এখন মধ্য দুপুর। সোনালি কিরণ চুইয়ে পড়ছে সামনের লনে। শ্রান্ত প্রকৃতি একফোঁটা বৃষ্টির আশায় কাতর হয়ে আছে। শারমিন বেগম কন্যাদ্বয়কে দুপুরে খাওয়ার সময় ডাকতে গিয়ে দেখলেন ঝুমঝুমি ফ্লোরে গড়াগড়ি করে উপন্যাসের বই পড়ছে। টুকটুকি অসময়ে ঘুমাচ্ছে। শরীর খারাপ করল কিনা ভেবে তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের কপালে হাত রাখেন। ঝুমঝুমি বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“এ অসুখ শরীরের নহে মাতারানী। এ অসুখ মনের।”

“হেয়ালি করবি না আমার সাথে। নয়তো চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব। সোজাসুজি কথা বলবি।”

ঝুমঝুমি একটুও ভয় পেল না ধমকে। প্রবল উৎসাহে বলল,
“আমার মনে হয় জিনটা আবার ফেরত এসেছে। উপন্যাসে পড়েছি মেয়েদের এমন অবস্থায় বেশিদিন রাখলে তারা পা’গল হয়ে যায়। আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। একমাত্র সমাধান অতি দ্রুত আপুকে বিয়ে দেওয়া। হাতের কাছে যে ছেলেকে পাবে তার সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দাও। দরকার পড়লে ঘরজামাই আনো। নয়তো বিপদ।”

“মানে কি? সবাইকে তোর বড়ো খালার মতো বোকা পেয়েছিস নাকি যে আবজাব বুঝাবি? কারো সমস্যা নিয়ে মজা করবি না ঝুম। নয়তো এবার সত্যি সত্যিই চড়িয়ে দাঁত খুলে নেব।”

“দাঁত খুলে নিলে কথা বলব কী করে? আমার তো আবার দাঁত গজাবে না। ফোঁকলা দাঁতের মেয়েকে কেউ বিয়েও নেবে না। তোমার ঘাড়ে বসে খাব সারাজীবন। কিন্তু পড়ে গেলে দাঁত কেন গজায় না বলোতো? দাঁতের বিষয়টা চুলের মতো হওয়া দরকার ছিল। যেন পড়ে গেলে আবার গজায়। তাহলে হাড্ডি চিবিয়ে খেতে অসুবিধা হতো না। তুমি আমার হাড্ডি খাওয়ার অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারবে?”

“তোকে দাঁতের মর্ম বোঝাতে হবে দেখছি।”

শারমিন বেগম তেড়ে যেতে নিলেই ঝুমঝুমি লাফিয়ে ছুট দেয়। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে এসে আবার বলে,
“দাঁত চোখ সবই তো আছে তোমার। এবার ইন্দ্রিয় সজাগ করে দেখ মেয়ের কোন অসুখ করেছে। নির্ণয় করতে পারলে ডাক্তারের থেকে ভালো ট্রিটমেন্ট দিতে পারবে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।”

ঝুমঝুমি চলে গেল। শারমিন বেগম বিরক্তির শ্বাস ফেলেন। মেয়েটা অল্প বয়সে এতটা পেকে গেল কী করে? চতুরতায় সবাইকে হার মানায়। ঝুমঝুমির উচ্চ বাক্যালাপে টুকটুকির ঘুম উড়ে গেছে। শারমিন বেগম পাশে বসে বললেন,
“অবেলায় ঘুমাস কেন? রাতে ঘুম হয়নি?”

“হয়েছে তো। মনে হলো একটু বোনাস ঘুমাই।”

টুকটুকি চোখ পিটপিট করছে ঘুমের আলস্যে। শারমিন বেগম মনোযোগ দিয়ে মেয়েকে দেখেন। ঘুমিয়ে মুখটা ফুলে আছে। গোলগাল মুখে তাকে মিষ্টি লাগছে দেখতে। কণ্ঠের আদরটুকু লুকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
“টুকটুকি, সরাসরি কথা বলবি। ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বললে কিন্তু চ’ড় বসাব গালে। তোর কী হয়েছে? কয়েকদিন ধরেই দেখছি অন্য খেয়ালে আছিস। কারণটা কী?”

টুকটুকি মাথা নত করে রইল। মনে হচ্ছে ছোটোবেলার মতো ভুল করে মায়ের হাতে ধরা পড়ে গেছে। মা কৈফিয়ত চাইছেন ভুলের। তাই হলে বরং ভালো হতো। ছোটোবেলার ভুল, মন খারাপ কিংবা কষ্ট খুব সহজেই ভুলে যাওয়া যেত। বড়োবেলায় তা হয় না। সে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়ল মায়ের বুকে।
“আমার ভালো লাগে না, মা। কিচ্ছু ভালো লাগে না। বুকের ভেতর কিছু একটা কুণ্ডলি পাকাচ্ছে। তাড়াতে পারছি না। থেকে থেকে দমবন্ধ লাগে। তুমি আমাকে জড়িয়ে থাকো মা। ভালো লাগছে এখন।”

শারমিন বেগম মেয়ের অস্থিরতায় উদ্বিগ্ন হোন। টুকটুকি ঠোঁট টিপে থাকে। ভালো শব্দটা জুড়ে যে ভালোবাসা, সে ভালোবাসা কেন শুধু বেদনাই উপহার দেয়?
__________________

পড়ন্ত বিকেলের গায়ে মেদুর আভা। পশ্চিম আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে লালিত গোধূলির আদুরে রেখা। পূর্বাকাশের কোলে কালো মেঘেরা ছোটাছুটি করছে। গ্রীষ্ম এসে চলে যাওয়ার যোগাড় অথচ ঝড়ের দেখা নেই। অনাবৃষ্টির অনাসৃষ্টি কান্ডে প্রকৃতি স্তব্ধ, শ্রান্ত, পিপাসায় কাতর। একই রকম স্তব্ধ, শ্রান্ত ও পিপাসাকাতর দেহটি নিয়ে অফিস থেকে ফিরেছে নিশীথ। গাড়ি পার্ক করার আগে দুবার হর্ণ দিয়ে শব্দদূষণ করে নিল অযথাই। এই কাজটা সে দুদিন হলো করছে। যেন সারাদিনের সমস্ত রাগ হাতের মুঠোয় এনে হর্নের গায়ে ঝেরে দিচ্ছে। বাড়িতে ঢুকতেই রিতা আন্টি তীক্ষ্ণ মেজাজে বললেন,

“সমস্যা কী তোর? অহেতুক হর্ন বাজিয়ে কানের মাথা খাচ্ছিস কেন?”

“দেখছি হর্নটা ঠিকমতো কাজ করে কিনা।”

“সেটা বাড়ির সামনে এসেই করতে হবে?”

“হু।”

“গলা ঠিক আছে কিনা সেটাও চেক করে নিতি চিল্লিয়ে। ছাগল কোথাকার।”

নিশীথ হতবাক। আহ’ত গলায় বলে,
“তুমি আমায় ছাগল বললে?”

“ছাগলামি করলে তো ছাগলই বলব। শুধু ছাগল না। বোবা ছাগল। ম্যা ম্যা-ও তো করতে পারিস না।”

“এসব বাজে কথা তুমি ফেইসবুক ইউজ করে শিখছো, তাই না? আজই বাসার ওয়াইফাই লাইন কাটব আমি।”

নিশীথ ওপরে চলে গেল। সবকিছুই বিস্বাদ লাগছে। কোনোকিছুতেই সুস্থির হতে পারছে না। কিছু একটা ঠিক নেই বুঝেও থম মে রে আছে৷ সে অফিসের পোশাকেই বসে রইল। দেখে মনে হচ্ছে শান্ত, অবিচল একজন মানুষ। অথচ মনের ভেতর ঝরের কবলে বিপর্যস্ত প্রকৃতির মতো লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

টানাপোড়েন শব্দটার সঙ্গে নিশীথের পরিচয়টা খুব বেশিদিনের নয়। তার গৌরবান্বিত নিয়মানুবর্তী জীবনের স্বাভাবিক চক্রটার অধঃপতনও সেখান থেকেই। নিজেই নিজেকে নিগ্রহ করাটা সে শিখেছে টুকটুকি নামের এক অতি সাধারণ মানবীর অসাধারণ অনুভূতিতে জড়িয়ে। আবেগী, ঝগড়ুটে, কথাপ্রিয় ও চঞ্চল মেয়েটির সঙ্গে তার প্রথম দেখা কবে তা বলা মুশকিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করার পর পিতৃছায়ার অভাবপুষ্ট সংসারটিকে নিজের কাঁধে তুলে নেওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল না। চট্টগ্রামে থাকাবস্থায় নিজেকে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত, মর্যাদাময় অবস্থানে দেখার তাড়না তাকে দিন-রাত এক করে কাজের পেছনে ছুটিয়েছে। বাড়িতে আসা হতো ছুটির দিনগুলোতে। তখনই খেয়াল করেছিল মায়ের সঙ্গে একটি মেয়ের ভীষণ ভাব। ফোনে কথা বলার সময় মা মাঝে মাঝেই সেই মেয়েটিকে নিয়ে প্রশংসা করতেন। নিশীথ শুধু শুনত। আগ্রহ জাগানিয়া কোনো বিষয় না পাওয়ায় মেয়েটিকে শুধুই মায়ের অবসরের সঙ্গী হিসেবে মস্তিষ্কে ঠাঁই দিয়েছিল। পরিচয় করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তাও অনুভব হয়নি। তাছাড়া ঘরকুনো স্বভাবের ফলে তার স্বতঃস্ফূর্ততার গন্ডি সীমিত। মায়ের অবসরের সঙ্গী সেই স্বতঃস্ফূর্ততায় পড়ে না। মেয়েটি প্রথম মনোযোগ পেল তার খালাত বোন নিপার বিয়েতে। পরিচয়টা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। ভুল বোঝাবুঝিতে প্রথমেই তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল। সেই প্রথম নিশীথ জেনেছিল সে অসামাজিক, নাক উঁচু একজন মানুষ। ঝগড়াই যে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তেমনও নয়৷ মেয়েরা যেমন বিশেষ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে টের পায় কে তাকে অন্যচোখে দেখে নিশীথও টের পেয়েছিল। কিন্তু টুকটুকি এতটাই চঞ্চল ও দ্বিধান্বিত স্বভাবের ছিল যে ভাবনা অতলে প্রবেশের আগেই পথ পরিবর্তন করে ফেলত প্রতিবার। নিশীথ প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল তাকে ও টুকটুকিকে জড়িয়ে উড়ো খবর ছড়ানোর পর। স্বাভাবিকভাবেই এমন জিনিস হজম হয়নি। জীবনে তার একফোঁটা কালি নেই। বিনাদোষে কেন মাথা নোয়াবে? রাগের বশেই টুকটুকিকে কথা শুনিয়েছে। কীই বা করার ছিল তখন! একটা ভুলকে কেন্দ্র করে নতুন জীবন শুরু করা মানসিক অ’ত্যা’চার ব্যতীত কিছুই মনে হচ্ছিল না তখন। সেই ঘটনার পর মেয়েটি একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল। এরপর একটি সপ্তাহ ধরে তাদের বিয়ের আয়োজন হচ্ছিল। মা প্রফুল্লচিত্তে মহা সমারোহে আংটি বদল অনুষ্ঠানের আয়োজনে মেতেছিলেন। ঝুমঝুমির ইঙ্গিত, টুকটুকির পূর্ববর্তী আচরণের যুক্তিমূলক স্মৃতিচারণে নিশীথ নিশ্চিত হয়েছিল তার প্রতি মেয়েটির অনুরাগ সম্পর্কে। ভেবেছিল নতুন করে। সে এমন কোনো হ্যান্ডসাম নয় যে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে। চোখে কোমলতা নেই, কণ্ঠে মিষ্টতাও নেই। শুধু আছে কঠোর ব্যক্তিত্ব।

দীর্ঘ একটি সপ্তাহ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে ও ঠিক করেছিল মায়ের মুখ চেয়ে নিজের সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের মানুষটাকে বিয়েটা করবে। অনুভূতি ওর দিকে থেকে ছিল না তখনো। আংটি বদলের আগের দিন হুট করেই খবর এলো টুকটুকি বিয়ে নাকচ করেছে। করেই খান্ত হয়নি তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়িও ত্যাগ করেছে। নিশীথের মনে জন্ম নিয়েছিল সুক্ষ্ম ভাবনা। মেয়েটা বোধহয় প্রচন্ড আঘা’ত পেয়েছে। বদনাম তারও কিছু কম হয়নি বরং নিশীথের চেয়ে দ্বিগুণ।

ভাবনা অনেকটা ঘুণপোকার মতো। মনের ভেতর একবার জাঁকিয়ে বসতে পারলে ডালপালা মেলে অন্তরকে অস্থির করে তোলে। শান্ত, ধীরস্থির নিশীথকে ভাবনার জাল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছিল। টুকটুকি কেন বাড়ি ছাড়ল? কেমন তার মনের অবস্থা? দিনগুলো কেমন শূন্য লাগতে শুরু করে। টানাপোড়েনের সূত্রপাত্রও বোধহয় সেখান থেকেই। কয়েকদিন বাদেই নিশীথ টুকটুকির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। বিয়ে না হোক, মায়ের মনের যত্ন নেওয়ার কৃতজ্ঞতায় সৌজন্য সম্পর্ক রাখা উচিত। টুকটুকি তাও নাকচ করে দিল। নিশীথ টের পেল মেয়েটির কোমল মনে ঘাপটি মে’রে থাকা ধা’রালো অভিমানী সত্ত্বার। অন্তরে ক্রমেই তিক্ততা বাড়ছিল। সুক্ষ্ম যাতনা পিছু ছাড়ছিল না।

টুকটুকির পুনরাগমন ছিল চৈত্র দুপুরে ঝুপ করে নামা বৃষ্টি মতো স্বস্তির। অদৃশ্য বৃষ্টির জলেই বোধহয় ধুয়ে গেছিল সকল দ্বিধা। নিশীথ নিজেকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছিল। নারীর অপার্থিব সৌন্দর্য, দেহ নিসৃত সুমিষ্ট ঘ্রাণ, হাসির মূর্ছনা, চাহনির আকর্ষণ তাকে নতুন করে চেনাচ্ছিল অব্যক্ত মনের ভাষা। কঠিন হৃদয়ের বাধ ভাঙছিল ধীরে ধীরে। এরপর…
টুকটুকি হাত না বাড়ালে নিশীথ কী পারত হৃদয়ের শেকল ভাঙতে? হয়তো যতক্ষণে শেকল নিজে থেকে ভাঙত ততক্ষণে বোধহয় অনেকটা দেরি হয়ে যেত। বাকিজীবন জ্ব’লে পুড়ে নিঃশেষ হতে হতো। কিন্তু শেকল ভাঙার কাজটা টুকটুকিই করে দিয়েছিল। হৃদয়ের আকাশের একমাত্র নক্ষত্রটা খসে পড়ার আগেই ধরে ফেলতে সাহায্য করায় নিশীথ আজন্ম টুকটুকির কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাতেও দুজনের সম্পর্ক মসৃণ হয়নি। একটা গাড়ি দীর্ঘদিন অচল থাকার পর হুট করে চালাতে যেমন জটিলতা দেখা দেয়, তেমনই মনের শেকল ভাঙলেও নিশীথ এতদিনের নিস্পৃহ স্বভাবটাকে দূর করতে পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছে না। বুকের ভেতর অজস্র কল্পনা, প্রণয়ের বুদবুদ হয়। মুখে আসে তার সামান্যই। প্রকাশ হয় আরো অল্প। নিশীথ দুহাতে ঘাড় চেপে ধরে মাথা নুইয়ে বসে। যে একলা থাকা তার ভীষণ প্রিয় আজকাল তাও কেমন তিতকুটে মনে হয়।

রিতা আন্টি কিছুক্ষণ বাদে নিশীথের জন্য তার পছন্দের স্পেশাল চা নিয়ে হাজির হলেন। নিশীথ নতমুখেই বসে আছে। এই ছেলেটা কেন যে বাপের মতোই হলো? তিনি হতাশ শ্বাস ফেলে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“দেখ জাফরানটাকে, দুধের ওপর ছেড়ে দিলে ধীরে ধীরে রঙ ছাড়ে। একসময় নিজের রঙে রাঙিয়ে তোলে সম্পূর্ণ তরল, মিষ্টি সুবাস ছড়ায়, স্বাদে বৈচিত্রতা আনে। স্বাদ, রঙ, গন্ধ তিনেই এই মশলার জুড়ি নেই। আমার কাছে মনে হয় ভালোবাসাও ঠিক এমনই হওয়া উচিত। ভালোবাসা রঙ ছাড়বে, সুবাস ছড়াবে, স্বাদে উভয়ের অন্তর পরিতৃপ্ত হবে। আর এই তিনের পারফেক্ট সংমিশ্রণ তখনই হবে যখন দুজনই সম্পর্কটাকে সমান এফোর্ট দেবে৷ অনুভূতি চারা গাছের মতো। বিজ মাটিতে পড়লেই তা গজায়। হয়তো সম্মুখে, নয়তো অলক্ষ্যে। সেই অনুভূতি থেকে সম্পর্ক গড়ে তোলা হলো চারাগাছের পরিচর্যার মতো। চারাগাছকে তুমি যত্ন করে, পানি দিয়ে, সার দিয়ে সজীব রাখবে। পোকামাকড়ের আ’ক্র’মণ থেকে বাঁচাবে। তাহলেই না একসময় গাছে ফুল ফুটবে। পরিচর্যা না করলে তা অযত্নে ঝরে যাবে। সম্পর্কও তেমনই। আমার ছেলে বুদ্ধিমান। ভেঙে বোঝাতে হবে না নিশ্চয়ই?”

নিশীথ মাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে মুখ আড়াল করে। রিতা আন্টি চায়ের কাপ পাশের বেডসাইড টেবিলে নামিয়ে রেখে ছেলের বাহুতে হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমার ছেলে পড়াশোনায় ফার্স্ট। ক্যারিয়ারেও তার গতি অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু বাহ্যিক জীবনের গতিশীলতার সাথে অন্তরেও গতিশীলতা প্রয়োজন। সামঞ্জস্যতা না থাকলে দিনশেষে আত্মতুষ্টির স্থানটা ফাঁকা পড়ে থাকবে। শুধু ক্যারিয়ারে বিজয়ী হলে হবে না, প্রিয় মানুষের বিশ্বাস, ভরসা, স্বস্তি, শান্তির স্থানটার বিজয়ী হতে হবে। প্রিয় মানুষটাকে ভালোবেসে জয় করতে হবে। মনের কথা বিনা জড়তায় বলতে হবে। নির্জনতাকে ভালোবেসে নিস্পৃহ থাকা কিংবা মনের কাছে চুপ থাকাটা ততক্ষণ স্বাস্থ্যকর যতক্ষণ না তাতে আশেপাশের মানুষের অসুবিধা হয়। আমাদের প্রিয় মানুষের প্রতি দায়িত্বশীলতা, যত্নশীলতা ব্যক্ত করতে হবে। ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা প্রকাশ করলে আরো বেড়ে যায়। গুটিয়ে রাখলে তাতে ধুলো জমে। আমি চাই না তুমি তোমার বাবার মতো হও। যেই তোমার স্ত্রী হোক, আমি কখনোই চাইব না তার জীবনটা আমার মতো হোক। কখনো না।”

রিতা আন্টি চলে গেলেন। নিশীথ কতক্ষণ বসে ছিল সে জানে না। বাইরে তখন ঘুটঘুটে আঁধার। নিশীথ ফোন নিয়ে সেই নম্বরটা ডায়াল করল যেটাতে প্রতিদিন ফোন করবে করবে করেও করা হয় না। ফোন রিসিভ হলো অনেকটা সময় বাদে। টুকটুকি নিস্তেজ গলায় বলল,

“বলুন?”

“অ শ্রেণির মানুষটা প্রেমিক হয়ে উঠতে পারছে না। আপনি কী তাকে অপ্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন?”

টুকটুকি মুখের ফোন কেটে দিল। সপ্তাহ বাদে যোগাযোগ করে দুটো আকুতি মাখা কথা বললেই সে গলে যাবে না। কিছুতেই না।

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৮-প্রথম অংশ]

সকাল থেকেই দিনটা গুমোট। সূর্যটা পুরোপুরি আত্মপ্রকাশে অনিহা প্রকাশ করছে আবার বৃষ্টিও ঝরতে নারাজ। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ট নন্দিনী হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছে অফিসে ঢুকতেই ম্যানেজার মন্টুর সামনে পড়ে গেল। ম্যানেজার মন্টু ঠোঁট প্রশস্ত করে ফাঁকা দাঁতের বিশ্রী এক হাসি দিয়ে বলল,
“কী ব্যাপার? আজকাল দেখি ঘনঘন অফিসে আসো৷”

নন্দিনী বিরক্তি লুকিয়ে একইরকম হাসি প্রদর্শন করল। বক্র সুরে বলল,
“পাতলা পাতলা আসলে আপনার খুব সুবিধা, মন্টু ভাই।”

“আমি অধম। আমার সুবিধা অসুবিধা কে দেখে? ঘন ঘন আসলে তো তোমাদের মতো মেয়েদের সুবিধা।”

“আপনার বউ তো শুনেছি আগে চাকরি করত। সেও মনে হয় অফিসে খুব সুবিধা পেত? তাই কি চাকরিটা ছাড়িয়ে দিয়েছেন।”

ম্যানাজার মন্টুর চোখদুটি দেশলাইয়ের কাঠির মতো ফস করে জ্ব’লে উঠল। কঠিন গলায় বলল,
“আমার বউ ছাড়া গরু ছিল না। তার লাগাম আমার হাতে ছিল সব সময়।”

নন্দিনী ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“ওহহ! আপনার চোখে আপনার বউ তাহলে গরু! শুনে মজা লাগল। সবাইকে মানুষ ভাবতে হবে এমন কোনো বিষয় নেই। আমার চোখও আপনাকে মানুষ হিসেবে দেখে না। কেমন দেখে জানেন? ছোটোবেলায় একটা কাইল্লা বিলাই পুষতাম। তার নামও ছিল মন্টু। আপনার মতোন সেও বারবার আমার পথ কাটত। আসলে কিছু মানুষ নিজের যোগ্যতাকে ঘষামাজা করতে পারে না, অন্যের যোগ্যতা দেখে ফড়ফড় করে।”

ম্যানেজার মন্টু অপমানে লাল মুখে বলল,
“নন্দিনী, তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলতেছ।”

“সেম টু ইউ, মন্টু ভাই। মানুষ অন্যের যোগ্যতা বিচার করতে যে পরিমাণ চিন্তাশক্তি ব্যয় করে তার সিকিভাগও যদি নিজের মানসিকতার উন্নয়নে ব্যয় করত তাহলে সমাজের অর্ধেক সমস্যা কমে যেত।”

নন্দিনী ম্যানেজার মন্টুকে প্রায় ডিঙিয়ে এগিয়ে গেল। মন্টু পেছন থেকে গজরাতে গজরাগে বলতে লাগল,
“কার জোরে এত গলাবাজি বুঝি না মনে করছে! বস এত মায়া মহাব্বত কেন দেখায় বুঝি না ভাবছে। চরিত্রের নাই ঠিক…”

কথাটা সম্পূর্ণ হলো না। ম্যানেজার মন্টু ছিটকে পড়ল মেঝেতে। নাকে হাত দিয়ে অবাক চোখে চাইল সম্মুখের অগ্নিরূপী মেয়েটির দিকে। বিস্ময়ে হতভম্ব অফিসের বাকি স্টাফেরা। নন্দিনী কাউকে পাত্তা দিল না। হাত ডলতে ডলতে বিরস গলায় বলল,

“আমার কাইল্লা বিলাই পোষা ছিল। তাই সে পথ কাটলেও কিছু কইনাই। কিন্তু আপনি পোষা না, ছাপোষা। আজকে নাকের ওপর ট্রায়াল দিলাম। পরেরবার অন্যের খেতে মই দিতে আসলে শরীরের পার্টস সব উলোট পালোট কইরা দিমু একদম। খেটে খাওয়া হাত আমার। নরম সরম ভাববেন না।আপনার ভাষাতেই মনে রাখবেন, ছাড়া গরু বিপদজনক। কোনখানে গুতা দিয়ে ফিউজ কইরা দিব টের পাইবেন না।”

নন্দিনী সবাইকে উপেক্ষা করে, সকলের আগ্রহকে দ্বিগুণ করে চলে গেল বসের কেবিনে। আমিন সাহেবের হাতে সকালের পত্রিকা। পত্রিকার সংবাদ বোধহয় খুব একটা মনঃপুত নয়। কপাল কুচকে আছেন তিনি। অন্যহাতে পেপার ওয়েট ঘোরাচ্ছেন বেশ কায়দা করে। অর্থাৎ খবরে খুব একটা মনোযোগ নেই উনার। মস্তিষ্ক যখন একইসঙ্গে একাধিক কাজ করতে চায় তখন কোনোটাতেই পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না। নন্দিনী কাচের দরজায় আঙুল দ্বারা দুবার শব্দ করে এক সেকেন্ড থামল। এরপর সরাসরি ঢুকে গেল ভেতরে। আমিন সাহেব তার উপস্থিতি জেনেও ফিরে তাকালেন না। নন্দিনী চেয়ারে ধপ করে বসে বলল,
“বস, আপনার অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঢুকলাম, বসলাম। আপনার উচিত রাগ করা।”

আমিন সাহেব গালে ভাজ ফেলে হাসলেন। মধ্যবয়সী ধা’রালো মুখশ্রী ক্লিন শেভ করা, চুলগুলো সব কুচকুচে কালো, তবে প্রাকৃতিকভাবে নয়। তিনি চুলে কলপ দেন সর্বদা। তাতে বয়সটাও একটু কম দেখায়। কিছু মানুষের কখনো ভুড়ি হয় না। আমিন সাহেব সেই দলের লোক। রোগা, লম্বাটে দেহটিকে সোজা করে নন্দিনীর দিকে ফিরলেন তিনি। হাসি মুছে বিরস গলায় বললেন,
“অযথা রাগ করতে যাব কেন? রাগ আমার মতো মানুষের শরীরের জন্য খারাপ। রাগ-জেদ করবে তোমরা। যৌবন হলো রাগের বয়স। তরুণদের র’ক্ত টগবগ করবে এটাই স্বাভাবিক।”

নন্দিনী নিজের হাঁটুতে কি’ল দিয়ে বলল,
“কারেক্ট বস। আমার মনের মতো কথা বলেছেন। এটাই তো রাগের বয়স। রেগেমেগে দুই তিনজনের নাক ফাটিয়ে দেওয়াও অতি স্বাভাবিক বিষয়। তাইনা?”

আমিন সাহেব ভ্রু কুচকালেন। বাইরের কোনো ঘটনাই তিনি জানেন না। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন,
“তুমি কী এ ধরনের কোনো কান্ড ঘটিয়েছ, নন্দিনী?”

“যদি ঘটাই, আর তা যদি আপনার আশেপাশে হয় তবে অবশ্যই জানবেন। তার আগে আমার কথার উত্তর দেন। আমি যে আপনার অফিসের রুল ব্রেকার, আপনাকে বসের মতো নূন্যতম সম্মান দেই না, তাতে আপনার রাগ হয় না? অন্যদের বেলায় এতটা ঢিলেমি তো নেই। আমাকে এতটা ছাড় দেওয়া কেন? প্রশ্নটা কিন্তু আপনার গোটা অফিসের পক্ষ থেকে করছি।”

আমিন সাহেব কাচের টেবিলের ওপর দুটি হাত ভাজ করে অত্যন্ত সাবলিল গলায় বললেন,
“গুড কোয়েশ্চেন। একজন কোম্পানির কর্ণধার হিসেবে আমি সব সময় এমপ্লয়ি কতটা পোলাইট তা দেখব না, বরং তার মাঝে কতটুকু প্রতিভা আছে, কতটা গাটস্ এন্ড ইনোভেটিভ পাওয়ার আছে তা খুঁজে বের করব এবং সেসব প্রতিভাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেই চেষ্টা করব। এদিক থেকে আমি সফল। যদিও পার্মানেন্ট জয়েন করছ না তবুও তুমি আমার বিজনেসের একটা এসেট। আর রইল কথা সম্মানের, সম্মান আসবে ভেতর থেকে। মেকি সম্মান দিয়ে মানুষের আস্থা, ভালোবাসা অর্জন করা যায় না। অফিসের সবাই একটা মেকি মুখোশ পরে থাকে। যতটা ভীতু, চেষ্টা করে তারচেয়েও ভীতু হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে। বোঝাতে চায় আমাকে তারা ভীষণ ভয় পায় এবং মানে। এদিক থেকেও তুমি আলাদা। মেকিপনা নেই। আই লাইক ইট।”

“তাহলে আপনার উচিত অফিস থেকে এটিকেট এন্ড ম্যানারস-এর রুলস মুছে দেওয়া। যারা কাজের প্রেশারে আপনার আড়ালে গা’লি দেয়, তারা সামনে দেবে। লাইক ইটের মজা কতটা বুঝে যাবেন।”

আমিন সাহেব আবারো গালের চামড়া কুচকিয়ে হাসলেন।
“তাহলে ব্যবসা লাটে উঠবে। স্রোতের বিপরীতে সবাই চলতে পারে না, ডিয়ার নন্দিনী। স্রোতের ধাক্কা সবাই সইতে পারে না। ভেসে যায়। আর যারা পারে তাদের দমানো উচিত নয়। এতেই সমাজের বৈচিত্রতা রক্ষা পায়। আমি তোমার উল্টো স্রোতে বয়ে চলার পক্ষে আছি সব সময়।”

নন্দিনী চেয়ারে হেলান দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমিন সাহেব সুযোগসন্ধানী বস টাইপের নয়। কখনো কোনো স্ক্যান্ডালে জড়ায়নি। নন্দিনী বসের দৃষ্টিতে কলুষতা দেখেনি। তাহলে পাঁচটা বছর গড়িমসি করেও এখানে তার বারবার ফিরে আসা হতো না। তবুও নন্দিনীর প্রতি বসের অগাধ স্নেহ প্রশ্নবিদ্ধ!

“ওহহ তোমাকে যে কারণে ডাকলাম।”
বলে আমিন সাহেব পেছনের ড্রয়ার থেকে কিছু বের করলেন। টেবিলের ওপর বেনসনের একটা প্যাকেট ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,
“টেক ইট। গত ইভেন্টটা সাকসেসফুলি এরেঞ্জ হওয়ায় ভাবছিলাম কিছু গিফট করব তোমায়। কিন্তু তোমার মতো বাউণ্ডুলে স্বভাবের মানুষকে গিফটের মোহে ফেলা দুষ্কর। তাই ভাবলাম এটাই মোক্ষম উপহার। ঠিক ভেবেছি?”

নন্দিনী প্যাকেটটা লুফে নিয়ে বলল,
“একদম ঠিক।”
_______________

রোদ ম রা বিকেলের অলস বেলা। টিউশনে বেরোনোর আগে প্রিয়া ছোটাছুটি করে হাতের কাজগুলো সেড়ে নিচ্ছিল। মুনিরা বেগম এখন আগের মতো হুইলচেয়ারে চলাচল করেন। অনুভবকে কিছুতেই এটা কেনা থেকে নিবৃত্ত করতে পারেননি তিনি। টাকার মায়ায় নিষেধ করলেও এখন বড্ড সুবিধা হয়েছে। মেয়েরা বাড়ি না থাকলে জড়বস্তু হয়ে থাকতে হয় না। তিনি প্রিয়াকে হড়বড় করতে দেখে বললেন,
“অনেক হয়েছে। বাকিটা আমি পারব। একটু বিশ্রাম নিয়ে তো বেরোবি নাকি?”

“হয়ে গেছে। আর কিছু করতে হবে না। তোমাকে কাজে হাত দিতে দেখলে দিয়াও পাকামো করে এসে হাত লাগাবে। ওকে পড়া থেকে উঠতে দেবে না একদম। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে কপালে দুঃখ আছে বলে দিয়ো।”

প্রিয়া বাসন মেজে রেখে বেসিনে হাত ধুতে নিলে ফোনটা বেজে উঠল। পড়া থেকে ওঠার বাহানায় দিয়া ফোনটা নিয়ে ছুটে বাইরে এলো। বলল,
“বড়ো চাচি কল করেছে।”

প্রিয়া থমথমে চোখে চায়। একের পর এক সর্বনাশ করেও শান্তি হয়নি? আবার ফোন করেছে? মুনিরা বেগম মেয়ের ভাবভঙ্গির উষ্ণতা টের পেয়ে নিজেই ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলেন। প্রিয়া এসে ফোনটা নিয়ে স্পিকার অন করে দিল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো শায়লা চাচির করুণ স্বর,
“হ্যালো, প্রিয়া?”

“আমি ভাবী।”

“কে মুনিরা? তোমার সাথে কথা বলতেই ফোন করলাম। তোমাগো জন্য সুখবর আছে।”

সকলের ভ্রু কুচকে এলো। মুনিরা বেগম শান্ত কণ্ঠে জানতে চান,
“কীসের সুখবর, ভাবী?”

“তোমাগো আর বস্তিতে থাকতে হবে না। আমি তোমার ভাসুরকে বলেছি তোমরা এখন থেকে আবার এই বাড়িতেই থাকবা।”

“হঠাৎ…”
মুনিরা বেগম হতভম্ব। যে মানুষটা তাদের তাড়িয়ে সুখে ছিল এখন আবার ফিরিয়ে নিতে চাইছে কেন? এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন প্রিয়ার বাবার জেল থেকে মুক্তির সময় এগিয়ে আসছে। ফিরে নিশ্চয়ই তিনি সম্পত্তির হিসেব চাইবেন। অংশ চাইবেন। সন্তানদেন বঞ্চিত করার কৈফিয়তও চাইবেন। হয়তো তখন কিছুটা ঝামেলায় পড়বে ভাইয়েরা। সেই ঝামেলা এড়াতেই আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে মিমাংসা করতে চাওয়া। যদিও সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ জে’লখাটা ভাইকে কৌশলে বঞ্চিত করে সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করতে তাদের একটুও ঝামেলা পোহাতে হবে না। উপরন্তু ভাইয়ের পঙ্গু স্ত্রী ও সন্তান তাদের কাছে বোঝা ছাড়া কিছু না। মুনিরা বেগমের ধোয়াশার মাঝেই শায়লা চাচি মৃদু গুঙিয়ে উঠে উত্তর করলেন,
“হঠাৎ না, অনেকদিন ধরেই ভাবতেছি। সময়ের অভাবে বলা হয় নাই। তোমার স্বামী দোষ করছে। শাস্তি পাইতেছে…”

“আমরা কীসের শাস্তি পাচ্ছি?” কথার মাঝেই মুনিরা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লেন।

“স্বামী-স্ত্রী হইল একে অপরের অর্ধেক অঙ্গ। কাজেই স্বামীর দোষের ভার তোমারেও বহন করতে হইতেছে। তোমার ভাগ থেকে তোমার মেয়েদের। মনে করো আল্লাহ তোমাগো শাস্তি দিছে। শাস্তির মেয়াদ শেষ। তোমরা বাড়ি ফিরা আসো। সবাইরে আমি বুঝাইছি এতগুলা দিন। তোমাগো থাকতে অসুবিধা হইব না।”

কথা শেষ করে শায়লা চাচি আবারো গুঙিয়ে উঠলেন। মুনিরা বেগম বললেন,
“আপনি অসুস্থ নাকি ভাবী?”

“আর বইলো নাগো, মুনিরা। সিড়ি থেকে পিছলে পড়ে মাজাটা গেছে। আজ এক সপ্তাহ বিছনায় পড়ছি। উঠবার ক্ষমতা বুঝি গেল। হাগা-মুতা সব ঘরের মাঝেই। বড়ো মেয়েটার বিয়ে দিলাম। মেজোটাও ধারেকাছে আসে না এখন। খালি বলে, আমার ঘরে নাকি গন্ধ। কও, কাকে খাইয়ে পড়িয়ে বড়ো করলাম। ছোটোকালে কার হাগা-মুতা পরিষ্কার করলাম? এখন সে আমারটা সহ্য করতে পারে না।”

প্রিয়া তীক্ষ্ণ চোখে চায় মায়ের দিকে। সুখবরের কারণটা জলের মতো পরিষ্কার এখন। হাতি কাদায় পড়েছে। টেনে তোলার অবস্থা নেই। তাই কাদায় নেমে সেবা-যত্ন করার লোক প্রয়োজন। ফিরে গেলে যে প্রিয়াদের নিজের বাড়িতে কাজের লোক হয়ে থাকতে হবে, ফাইফরয়েমাশ খাটতে হবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। শায়লা চাচি বিছানায় পড়েও নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু ভাবছেন না। প্রিয়ার খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,
“অন্যের শাস্তির খুব সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন, নিজের কেন এই দুরবস্থা তার কোনো ব্যাখ্যা আছে কি চাচি?”

তা আর বলা হয় না। কে কতটুকু সুখ-দুঃখের দাবিদার তা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু প্রিয়ার শঙ্কা মা আবার গলে গিয়ে মেনে না নেন। ওকে অবাক করে মুনিরা বেগম এই প্রথম শক্ত গলায় বললেন,
“মেয়ের বিয়ে দিলেন তা তো জানালেন না, ভাবী? তখন আমাদের শাস্তি শেষ হয়নি বলে দাওয়াতের কাতারেও পড়িনি?”

শায়লা চাচি আমতা আমতা করে বললেন,
“এত তাড়াহুড়ায় বিয়ে হলো যে সবাইরে ডাকতে পারি নাই। তুমি তা ভেবে রাগ ধইরো না মুনিরা। চলে আসো বাড়িতে।”

“রাগ করিনি ভাবী। আগেও করিনি, এখনো করি না। আপনার জন্য দোয়া করব। আল্লাহ আপনাকে শেফা দান করুক। আপনিও আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন। সামনের শুক্রবার প্রিয়ার বিয়ে। আমি গরীব হলেও কাউকে দাওয়াত দিতে কার্পণ্য করব না। মেয়ে বিয়ে দিয়ে একটা ছেলে সন্তানের শখটাও পূরণ করতে চলেছি। তাদের নিয়েই বাকি জীবন আমার চলে যাবে। আমাদের বিলাসবহুল বাড়ি দরকার নেই।”

“তারমানে তুমি আসবা না?” শায়লা চাচির কণ্ঠের কোমলতা মুছে গেছে।

“আপনাকে দেখতে নিশ্চয়ই যাব।”

শায়লা চাচির গোঙানি হঠাৎ ক্ষোভের আকার ধারণ করল। যেন য’ন্ত্র’ণার কারণটা তারাই। কটাক্ষ করে বললেন,
“তো কার ঘাড়ে ঝুলাইতাছ মেয়েরে? সব জানে? মেয়ে বিয়াই যখন দিবা তাইলে আমার সম্বন্ধটা কী দোষ করছিল?”

“মেয়ে আমার ঝুলানোর বস্তু না। তাকে আমি সামাজিক রীতি মেনেই বিয়ে দিচ্ছি। চোখের সামনেই সংসার দেখব। জামাই বিচক্ষণ বলেই সব জানাতে সংকোচ হয়নি। আপনি ভালো থাকবেন ভাবী। প্রিয়া টিউশনি করাতে যাবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মুনিরা বেগম উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ফোন রাখলেন। দিয়া লাফিয়ে উঠে বলল,
“আপুর বিয়ে! আমি পড়ব না এ কয়দিন।”

সে ছুটে গিয়ে বইখাতা গোছাতে লাগল। প্রিয়া লজ্জাবনত হয়ে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মেঝে খুটতে থাকে। মুনিরা বেগম তাকে বললেন,
“বাবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে আয়। বলিস আমাদের নিয়ে আর চিন্তা না করতে।”

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৮-দ্বিতীয় অংশ]

শুক্রবার সকালে উৎসবের আমেজে বিছানা ছেড়েছে টুকটুকি৷ গোসল করে কাঁচা হলুদ রঙের একটা শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে৷ সাজগোজে একটুও কমতি রাখেনি। বন্ধুদের মধ্যে প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে। হোক সেটা বড়ো কি ছোটো, আনন্দ, উল্লাসের কোনো কমতি ওরা রাখবে না। গতকাল রাত দেড়টা পর্যন্ত বন্ধুরা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে এক্টিভ ছিল। বিয়ের সমস্ত প্ল্যানিং, কেনাকাটা সংক্রান্ত আলোচনা সব দুদিন ধরে গ্রুপেই হয়েছে। কাজের কথার চেয়ে অকাজের কথা, তর্ক, একে অন্যকে খোঁচানোটাই হয়েছে বেশি। ঠিক করা হয়েছে টুকটুকি ও নন্দিনী হবে কনেপক্ষ। দিগন্ত হবে পাত্রপক্ষ। কিন্তু দেখা গেল স্বয়ং পাত্রই কনে পক্ষ হতে মড়িয়া। এ নিয়ে হাসি-মজাও কম হয়নি। অনেকদিন বাদে আগের মতো লম্বা একটা আড্ডা হওয়ায় মনটাও বেশ ফুরফুরে টুকটুকির। ভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর ছেড়ে দিয়ে কানে দুল পরার সময় হুট করেই সকালের স্নিগ্ধতা ভেঙে ফোনে টুংটাং শব্দ হয়।

“মিস হুমায়রা, আপনার কি মনে হচ্ছে না আমাদের এবার কথা বলা উচিত, দেখা করা উচিত? ইটস্ বিন ওভার টু উইকস্ নাও।”

টুকটুকি শান্ত দৃষ্টিতে ম্যাসেজটা দেখল। দুই সপ্তাহ আগে হলেও সে এমন মিষ্টি আবদারে উতলা হতো। কিন্তু এখন তেমন কিছু হচ্ছে না। হৃদয়ের চঞ্চল চোরা গলি এখন শান্ত, স্থির। সে সংক্ষিপ্ত প্রত্যুত্তর করল,
“ভীষণ ব্যস্ত, মি. মাহমুদ।”

আর কোনো ম্যাসেজ এলো না। টুকটুকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাজগোজ শেষ করে দরকারী সমস্ত মেকাপ আইটেম ব্যাগে ভরে নেয়। দুই বান্ধবী মিলে আজ প্রিয়াকে সাজাবে। সবাই মিলে নবদম্পতির ছোট্টো সংসারের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করেছে দুদিন ঘুরে ঘুরে। সেসব সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে হবে। টুকটুকির আজ ছোটোবেলায় পুতুল বিয়ে দেওয়ার মতো আনন্দ হচ্ছে। সে ব্যাগপত্র নিয়ে সিএনজি ডাকতেই চমকে উঠল। অপরপাশ থেকে হেঁটে আসছে নিশীথ। পরনে পাঞ্জাবি, কাঁধের কাছটায় ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। একহাতে দুই হাতল যুক্ত চটের ব্যাগ, অর্থাৎ বাজার থেকে ফিরেছে। টুকটুকির সঙ্গে একটা হিমশীতল দৃষ্টি বিনিময় হলো দূর থেকেই। শীতল চোখে কাঁচাসোনার মতো ঝলমল করা রূপবতীর ব্যস্ততা মাপল বোধহয়। টুকটুকি কী ভেবে হঠাৎ আঁচল দিয়ে নাক অবধি ঢেকে নেয়। যেন নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। কথা বলা এড়াতেই তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে গেল। নিশীথ পুরোটা নিরবে অবলোকন করে মনে মনে একটু আহ’ত হলো। অভিব্যক্তি গোপন করে পুনরায় হাঁটতে শুরু করল।

সফেদ মোল্লার সাদামহলের তিন তলার দক্ষিণের ফ্ল্যাটে সকাল থেকে ব্যস্ততার বহর। অনুভব-প্রিয়ার বিয়েতে আত্মীয় বলতে প্রিয়ার মামা-মামীরা এসেছেন। আর অনুভবের বন্ধুবান্ধব। আরেকজন প্রধান অতিথি আছে। জাভেদ হাসান, অনুভবের একমাত্র অভিভাবক। তাকে আসতে রাজি করিয়েছে প্রিয়ার মা। মুনিরা বেগম বিয়ের দিন ঠিক করার আগে অনুভবকে সঙ্গে নিয়ে কথা বলেছিলেন তার বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে। অনুরোধ করেছিলেন,
“বাবা-মায়ের অবর্তমানে এতদিন ধরে ভাইকে তুমি খাইয়েছ, পড়িয়েছ, আদর-যত্নে রেখেছ। সেই ভাই কাকে বিয়ে করবে একবার যাচাই করে নেবে না? তুমিই তো ওর একমাত্র অভিভাবক। অভিভাবকের দায়িত্ব কিন্তু বিশাল। ধৈর্য, সহ্যক্ষমতা বেশি থাকতে হয়। রাগের পাশাপাশি দায়িত্বশীলতাও থাকতে হয়। তোমারও তো একটা সন্তান আছে। সন্তান ভুল করলে বাবা-মাকে ভুল করতে নেই। বরং শাসন করে হলেও সঠিক পথটা আমরা বাতলে দেই। তেমনই তোমার ভাই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে কিনা নিজে যাচাই করে দেখো। তোমার অমত থাকলে, আমাদের যোগ্য মনে না হলে এই বিয়ে হবে না। কিন্তু বাবার ভুলের জন্য আমার নির্দোষ মেয়েকে তুমি অপছন্দ করবে, তা আমারও মানতে কষ্ট হবে।”

এই কথোপকথনের পর জাভেদ হাসান এসেছিল প্রিয়ার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। শিক্ষিত, নম্র, বুদ্ধিমতি একজন মায়ের আন্তরিকতায় সে মুগ্ধ হয়েছে। ক্ষোভের সঙ্গে পুষে রাখা ভুল ধারণাগুলো কথা বলার সময় ক্রমেই বানোয়াট মনে হয়েছে নিজের কাছে, দ্বিধা কেটে গিয়েছে অনেকটাই। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে আসবে বলে আশ্বাসও দিয়েছে। জাভেদের একবার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল বিয়ের পর নতুন বউ নিয়ে অনুভব তার ফ্ল্যাটে উঠুক৷ কিন্তু সম্পর্কের জল ঘোলা হয়ে গেছে। অন্তরা নিজের সংসারে দেবর ও দেবরানিকে মানতে পারবে না। কখনো কখনো দূরত্ব সম্পর্ক ভালো রাখে। কিন্তু এই সম্পর্কগুলোকে আত্মার সান্নিধ্যে আত্মীয়তা বলে নাকি সামাজিক রীতিতে সৌজন্যতা!

বেলা দশটায় পিকআপ ভ্যান নিয়ে হাজির হলো দিগন্ত। বিয়ে উপলক্ষে সমস্ত কেনাকাটা বন্ধুরা মিলে করলেও দিগন্ত আলাদাভাবে একটি সেগুন কাঠের খাট উপহার দিচ্ছে। খাটটাকে ঘরে ঠিকঠাক বসিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে সে খাটেই শুয়ে পড়েছে। দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে যেই না স্বস্তির নিশ্বাসটা ফেলতে যাবে তখনই দেখল হলুদ শাড়িতে নন্দিনী আসছে। এতক্ষণ সে পাশের রুমে কনের রূপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলে দেখা হয়নি। নন্দিনী খেকিয়ে উঠল,
“এইডা কী হুতনের সময়? কাম নাই তোর?”

দিগন্ত কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে নন্দিনীকে আপাদমস্তক দেখে বিরক্ত গলায় বলে,
“কি বিশ্রী লাগছে তোকে! মনে হচ্ছে সরিষা খেতের ভূত চলে আসছে। সর সর, এইসব ডাকিনীমার্কা লুক দেখলে মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়।”

“মেজাজ ধুইয়া পানি খা। বাসর ঘর সাজানোর ফুলের খবর কই? সময়মতো না পাইলেরে হালুম, ডাকিনী তোর ধর থাইকা মাথাডা জাস্ট আলাদা কইরা দিব।”

দিগন্ত মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,
“সকল কাজের কাজি তো এক আমিই। নিজেরা সব পটের বিবি সেজে হুকুম চালাও। তা নিজের হাতে সাজতে গেলি কেন? বলতি আমিই সাজিয়ে দিতাম।”

নন্দিনী ওর যাওয়ার দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে থাকে।

মুনিরা বেগম অনুভবের বন্ধুদের আন্তরিকতায় রীতিমতো মুগ্ধ। দিয়া উৎসাহে ঘুরঘুর করছে আশেপাশে। বহুদিন বাদে একটা উৎসব উৎসব আবহ পেয়ে সে অবুঝ আনন্দে বলে উঠল,
“ভাইয়া আর আপুকে প্রতিদিন বিয়ে দাও, মা। তাহলে প্রতিদিন মজা হবে।”

ওর কথায় মুনিরা বেগম হেসে ফেললেন। কতদিন বাদে সকলে প্রাণখুলে হাসছে! এই হাসিটা অমলিন থাকুক, দোয়া ছাড়া আর কীই বা করতে পারেন মেয়েদের জন্য!
প্রিয়ার আজ অফুরন্ত অবসর। টুকটুকি ও নন্দিনী তাকে যেভাবে বলছে সেভাবেই থাকতে হচ্ছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি পরিচর্যায় লেগেছে দুই বান্ধবী মিলে। নামমাত্র হলুদের রীতি রক্ষায় সকালে হলুদের শাড়ি পরে এসেছে দুই বান্ধবী। পরানো হয়েছে প্রিয়াকেও। বিছানায় হাঁটু গুটিয়ে বসে আছে ও। লাজুক আভায় ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হয়েও গুটিয়ে যাচ্ছে বারবার। পাশেই টুকটুকি ভিডিও কলে তর্ক করছে। অনুভব অনুনয় করে বলে চলেছে,
“একটা বার দেখতে দে না। তুই তো এমন পাষাণ ছিলি না টুকটুকি। আমার ভালো বন্ধু তুই। বাচ্চাকাল থেকে একসাথে আছি আমরা। সেই খাতিরে…”

“উহু উহু, কোনো খাতির চলবে না। বন্ধুত্ব ভুলে যা আজকের জন্য। আমি কনেপক্ষ আর তুই পাত্র। টাকা ছাড়া কোনো কাজ হবে না। ফেলো কড়ি মাখো তেল।”

“আচ্ছা, চকচকে দশ টাকার নোট দেব। এবার দেখতে দে। একটা মাত্র বউ আমার। তার হলুদের সাজ না দেখলে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে।”

“এইসব ফাঁকিবাজি চলবে না। দশটাকা দিয়ে আজকাল ভেলপুরিও জোটে না। তোর বউয়ের একটা ডিমান্ড আছে তো নাকি! সারাজীবনের আফসোসের দাম দশটাকা হতে পারে না। দাম বাড়াও নতুন জামাই।”

দিগন্ত ওপাশ থেকে বলল,
“আচ্ছা আট আনা বাড়িয়ে দেব, চলবে?”

টুকটুকি ক’টাক্ষের দৃষ্টি হেনে বলল,
“এখন বোঝ, হুদাই ইকরি তোরে ফই’ন্নির পোলা বলে না।”

“আর তুই কী করতেছিস? বন্ধুর ইমোশন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করেছিস।”

“তোগো ইমোশন যে ভ্যালুলেস সেটা তো জানতাম না।”

“এত্ত বড়ো অপমান! এই আমার চেকবই, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডগুলা কেউ বাইর কর।”

প্রিয়া কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে। অবাক হয়ে দেখছে যে মানুষগুলো হাজার হাজার টাকা খরচ করে বন্ধুর বিয়ের আয়োজন করেছে তারাই আবার দশ-বিশ টাকা নিয়ে তর্ক করে হয়রান হচ্ছে! অনেক তর্ক-বিবাদের পর একশ টাকায় ডিল হলো তাদের। টুকটুকি টাকার অংকে খুশি না হয়ে মুখ গোমড়া করে ফোনটা প্রিয়ার দিকে ফেরাতেই অনুভব হা করে তাকায়। কাঁচা হলুদ শাড়িতে শ্বেত চন্দনের মতো মখমলি মেয়েটাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। ছোটো মুখশ্রীতে আজ গম্ভীরতা নেই। আছে লজ্জার ফুলঝুরি। প্রিয়া চোখ তুলল না মোটেও। অনুভব গদগদ হয়ে উচ্চারণ করে,
“মাশাআল্লাহ, নজর না লাগুক আমার বউয়ের। কানের পিঠে কাজল দাও।”

টুকটুকি কাশি দিল, “আমরা কিন্তু আছি দোস্ত।”

অনুভব ধমক দিয়ে বলল,
“তোদের এখানে কী ব’দ’মাশ? প্রাইভেসি দে আমাদের। দেখছিস না হাসু লজ্জা পাচ্ছে!”

“কবুল বলার আগে নো প্রাইভেসি। হাসুর লজ্জা তাড়ানোর জন্য সারাজীবন পাবি।”

প্রিয়া হাঁটুতে মুখ লুকায়। পাজি লোকটা নিজে তো হাসু ডাকে এখন তার বন্ধুরাও এখন হাসু বলেই ডাকছে! বোধহয় তার প্রিয়া নামটা শুধু খাতা কলমে লেখার জন্যই বেঁচে থাকবে একসময়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রিয়ার রাগ হচ্ছে না। হাসু নামটাকেই আপন মনে হচ্ছে। তারচেয়েও বেশি আপন সম্বোধনকারী মানুষটা।
_________________

ছাদের প্রান্তে গোধূলির নিবিড় ছায়াতলে নবদম্পতির ফটোশুটের আয়োজন করা হয়েছে। প্রিয়া এবং অনুভবকে একের পর এক পোজ শিখিয়ে ছবি তুলেই যাচ্ছে নন্দিনী। অনুভব বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে লজ্জারাঙা বউকে আঁকড়ে ধরে আছে। তার পরনে কালো শেরওয়ানি। প্রিয়াকে সাজানো হয়েছে টুকটুকে লাল বেনারসিতে। গাজরা ফুলের মালা ঘাড়ের দুদিক দিয়ে শোভিত। দুই হাত ভর্তি চুড়ি ঝলমল করছে। দুই চোখ ভরা কাজলে ভাসছে ছলছল জল। কবুল বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল কিনা! দুই মা-মেয়ের কান্নায় ইস্তফা দিতেই বন্ধুরা ওদের ছাদে এনেছে ছবি তুলতে।
অনুভব কবুল বলার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্য প্রিয়ার হাত ছাড়েনি। সকলের সামনে অস্বস্তিতে প্রিয়া বেশ কয়েকবার ছাড়াতে চেয়েছে। প্রতিবারই অনুভব কড়া চাহনিতে তাকাচ্ছে যেন প্রিয়া মূল্যবান কিছু ছিনিয়ে নিতে চাইছে। হাত ঘেমে একাকার দুজনের। তবুও ছাড়ার নাম নেই৷ বিয়ের দিনেই যা নমুনা দেখাচ্ছে তাতে সারাজীবন যে কী পরিমান জ্বা’লাবে ভাবতেই প্রিয়া হয়রান। অনুভব সকলের অগোচরে ওর কানের পিঠে একটা ছোটো চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল,
“প্রিয়তমা হাসু, অনুভবের অনুভূতিতে ভিজতে আপনি প্রস্তুত তো?”
প্রিয়ার শুকনো ঢোক গিলল। থুতনি ঠেকে রইল বুকের সঙ্গে। এক অচেনা অনুভূতি ওর মনের অলিগলি গ্রাস করে নিচ্ছে৷ জানান দিচ্ছে অন্তরে অন্যকেউ আধিপত্য ছড়াচ্ছে সদর্পে।

বাসর সাজাতে সাজাতে রাত দশটা বেজে গেছে। বন্ধুরা সবাই এখন বাড়ি ফিরবে। দিগন্ত একলা পেয়ে অনুভবকে খোঁচা দিয়ে বলল,
“দোস্ত, সবচেয়ে মজবুত খাটটা কিন্তু দিয়েছি। সেগুন কাঠের। ভাঙার সম্ভাবন নেই। তাও যদি ভাঙে একটুও লজ্জা পাবি না। আমি আরো মজবুত খাট আনিয়ে দেব।”

অনুভব কপট রাগের ভঙ্গিতে ওর পিঠে ঘু’ষি দিল। ছেলেরাও যে লজ্জায় টুকটুকে লাল হয় সেটা সুদর্শন অনুভবকে না দেখলে বুঝতই না দিগন্ত। সেই লালাভ আভায় মিশে আছে প্রিয় মানুষকে পাওয়ার সুখ। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে পূর্ণতার মৃদু হাসি। প্রিয় মানুষকে পেয়ে সে আজ জগতের সবচেয়ে সুখী পুরুষ।
________________

রাতের গায়ে হিমেল হাওয়া বইছে৷ চন্দ্র তারকাখচিত আকাশটা মেঘে আচ্ছাদিত। গুরুম গুরুম শব্দ তরঙ্গ জানান দিচ্ছে বৃষ্টি হবে। দিগন্ত গাড়ি এনেছে। মেয়েদের পৌঁছে দেবে বাড়িতে। কাজেই গাড়ি না পাওয়ার চিন্তাটা টুকটুকিকে বিচলিত করল না৷ রাস্তায় বেরিয়ে চমকে উঠল ও। রোড সাইড হলদেটে আলোয় নিশীথের গাড়িটা চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। নিশীথ বোধহয় ওর পথ চেয়েই ছিল। দেখা মাত্রই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। টুকটুকি ভড়কে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। বলল,
“আপনি এখানে?”

নিশীথ শান্ত গলায় বলল,
“নিতে এসেছি। গাড়িতে উঠুন।”

“ঠিকানা কোথায় পেলেন?”

উত্তরটা নন্দিনী দিল,
“আমি দিছি। হালুম কয়জনরে আনা নেওয়া করব? রাত বাড়তাছে। তারচেয়ে তুই তোর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে চলে যা।”

টুকটুকি কটমট করে চায়। ঘরশত্রু বিভীষণদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে! এখন ফিরিয়ে দেওয়াটাও শোভনীয় দেখাচ্ছে না। নিশীথ নিঃশব্দে গাড়ির দরজা খুলে অপেক্ষা করতে লাগল। উপায়ান্তর খুঁজে না পেয়ে টুকটুকি গোমড়া মুখে চড়ে বসল। মনকে বোঝালো একটুও গলে যাবে না সে।

টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। গাড়ির উইন্ডস্ক্রিণ ঘোলা হয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে। নিশীথ রেইন ওয়াইপার চালু করে দিয়ে বলল,
“শুনলাম খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন? ঘুমের টাইম এলোমেলো হয়ে গেছে? এত শোকের কারণ?”

টুকটুকি মুখ ঘুরিয়ে আছে। মনে তার অভিমানের বরফশীতল পাহাড়। এরমাঝে নিশীথের খোঁচা দেওয়া কথা শুনে রাগ হলো। যেন জানেন না শোকের কারণ কি! অন্যদিকে ফিরেই উত্তর দিল,
“কোনো কারণ নেই। মৌনব্রত পালন করছি। কথা বলা কমানোর চেষ্টা করছি।”

বিড়াল বলে মাছ খাব না! নিশীথ একপলক চাইল ওর মুখপানে। অভিমানের মাত্রাটা এবার অনেক বেশি।
“মৌনব্রতের নিয়মটা কী শুধু একজনের সাথে কথা বলা যাবে না?”
টুকটুকি সে কথার উত্তর না দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বলল,
“গাড়ি থামান।”
“কেন?”
“ভিজব।”
“বর্ষণ রাজা ডাকছে বুঝি?” নিশীথ বক্র সুরে জানতে চাইল।
“হু, সে আমার অপেক্ষায় আছে।”

নিশীথ ব্রেক কষল সশব্দে। উষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“আর আমি যে অপেক্ষায় আছি, সেটা চোখে পড়ে না?”
“আপনি কার অপেক্ষায় আছেন তা আমি কী করে জানব? আমাকে তো কখনো বলেননি।”
“বর্ষণ রাজা যে আপনাকে ডাকছে তা কী করে বুঝলেন? মুখে বলেছে?”
“আমার আর বর্ষণ রাজার আন্ডারস্ট্যান্ডিং অন্যকে ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছুক নই।”
“আমি অন্যকেউ?” নিশীথ আহ’ত চোখে চায়।
টুকটুকি অভিমানসিক্ত গলায় আস্তে করে বলল,
“নিজের কেউ হলেন কবে?”
নিশীথ ওর হাত ধরল শক্ত করে। বলল,
“আমার মনে দা’বানল লেগেছে, মিস. হুমায়রা। মেঘকুমারীর কৃপা ছাড়া এই দা’বানল নিভবে না। আপনি কী পোড়া গন্ধ পাচ্ছেন না?”

চলবে…