#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_১৩
#আনিশা_নিঝুম
ট্রলারের শব্দে আমি পিটপিট করে চোখ খুললাম। নিজের অবস্থান বুঝতে আমার মিনিট দুয়েক লাগলো। রাতের অন্ধকারে আশেপাশে মেয়েদের চাপা আর্তনাদ ভেসে উঠছে আমার কানে। বুক কেঁপে উঠলো আমার! ট্রলারে প্রায় পনেরো জনের মতো মেয়ে! কোথায় যাচ্ছে এরা? আমাকেই বা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ভাবতে ভাবতেই গলা শুকিয়ে এলো। আমার পাশে বিধ্বস্ত এক মেয়েকে দেখলাম। মধ্য রাতের আঁধারে মেয়েটা শুকনো মুখে সে বসে আছে। আমি ঢোক গিলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,’এটা কোথায় যাচ্ছে?’
মেয়েটা বিস্মিতপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার কথায়! যেনো সে খুব বেশিই চমকেছে। তার পাশের মেয়েগুলোও চমকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাদের মধ্যে শুধু একটা মেয়ের মাঝেই কোনো হেলদুল দেখলাম না। মেয়েটা নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে নতজানু হয়ে বসে আছে। আমার পাশের মেয়েটা আমাকে বলল,’তুমি জানো না কোথায় যাচ্ছে?’
আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম,’না! জানি না কোথায় যাচ্ছে।’
মেয়েটা এবার শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,’রাতের আঁধারে আমাদের পাচার করা হবে আর দশ মিনিটের মধ্যে এখানে একদল বিদেশি আসবে। তারা তাদের পছন্দ মতো মেয়ে নিয়ে চলে যাবে। আর বাকিদের হয়তো বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
মেয়েটির কথা শুনে গলা শুকিয়ে এলো আমার। আমস্র সাথেও কি এমন হবে? রাফাত আমায় ঠকালো! আমার উচিতই হয় নি ওকে দয়া দেখানো! বুঝা উচিত ছিলো সে দয়ার যোগ্য না!
‘প্রতিদিনই রাতের আঁধারে এইসব করা হয় এখানে?’
‘হু।’
তখনই হৈহৈ এর শব্দে সব মেয়ে ভীতু দৃষ্টিতে তাকালো। তাকালাম না সেই নিশ্চুপ মেয়েটি আর আমি। হয়তো অপরপ্রান্তের সেই মেয়েটি আর আমি বুঝতে পারছি আমার সাথে এখন যা হবে একটুও ভালো হবে না। কয়েক লোক ট্রলারে চড়ে গেলো। সর্বপ্রথম আমার পাশের মেয়েটার কাছে এসে বিদঘুটে হেসে বলল,’তুই তো বিক্রি হয়ে গেছিস। চওড়া দামে বিক্রি করেছি তোকে।’
মেয়েটা ভীতু চোখে তাকালো। চোখ দিয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমার খারাপ লাগলো। জেগে উঠলো আমার মনের প্রতিবাদী সত্ত্বা, কর্কশ কণ্ঠে লোকটি বললাম,’অন্যের মা বোনকে বিক্রি না করে আপনি নিজের মা বোনকে বিক্রি করুন।’
আমার কথায় ওই লোকটি আমার কাছে এসে আমার চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে বলল,’ বে শ্যা তুই নিজে প তি তা হয়ে প্রতিবাদ করিস কেমনে? চিনিস আমাকে তুই? এক ধাক্কা দিলেই এই মূহুর্তে তোকে পাওয়ার জন্য পুরো পার্টি লাফিয়ে পড়বে।’
ভয় পেলাম আমি মনে মনে, কিন্তু তা কিছুতেই প্রকাশ করা যাবে না। চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলাম। লোকটি চুলের মুঠি ছেড়ে বলল,’তোর অনেক তেজ তাই না? তোর তেজ আজ বাইর করমু। সবার আগে তোরেই বিক্রি করমু আমি।’
ততক্ষনাৎ কয়েকটা বিদেশি লোক ট্রলারে উঠে বলে,’এরে আমি কিনিবো। যত টাকা চাস তত টাকাই দিবো খালি এরে আমার চাই।’
লোকগুলোর কথায় বাংলাদেশি সেই লোকটা বিশ্রী হাসলো। আমার কাছে এসে আমার হাতের বাঁধন খুলে আমার বাহু শক্ত করে চেপে দাঁড় করালো। আমি দাঁড় না হতে চাইলে পরপর দুগালে শক্ত হাতের থাপ্পড় পড়লো। অধর কেটে রক্ত বের হলো আমার। কিন্তু কাঁদলাম এই মূহুর্তে কাঁদলেই আমি হেরে যাবো! শক্ত হয়ে যদি লড়ি তাহলে আমি বাঁচার সাথে এই বাকিদেরও বাঁচাতে সক্ষম হবো
১৭.
দূর থেকে সব পর্যবেক্ষণ করছে ত্রিধার। পর পর পাঁচটা ট্রলার থেকে মেয়েদের আজ পাচার করা হবে বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। এই একটি ট্রলারের তার স্নিগ্ধতাকেও রাখা হয়েছে। মুমিন ত্রিধারের কাঁধে হাত রেখে বলল,’আফশান, আমাদের পাঁচজনকে পাঁচটা ট্রলারে যেতে হবে। তুই একা পারবি না তাই তোর সাথে আরো চারজন যাচ্ছি আমরা। আমরা ইশারা দিলেই পুরো পুলিশ ফোর্স এসে ওদের হাতেনাতে ধরবে।’
পলাশী কাঁদতে কাঁদতে ত্রিধার বলল,’আমার বেখেয়ালির জন্য মেয়েটার সাথে আজ এইটা হলো। ত্রিধার দয়া করে আমার বোনটাকে বাঁচাও আজ ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না কখনো।’
পলাশীর ক্রন্দনরত মুখশ্রীর দিকে একবার তাকিয়ে বিদেশিদের মতো ছদ্মবেশ ধারণ করলো ত্রিধার ও তার সহকর্মীরা। ত্রিধার হেঁটে হেঁটে গেলো ট্রলারগুলোর কাছে। প্রত্যেকটা ট্রলারে ভালো করে নজর বুলিয়ে একটা ট্রলারের কাছে গেলো। এক নীল রঙা সালোয়ার কামিজ পরিহিতা মেয়েকে নিয়ে তখন ঝগড়া, মাতামাতি চলছিলো। এক লোক মেয়েটির বাহু চেপে দাঁড় করিয়ে সবাইকে শান্ত করছে। আর বিদেশি হৈহৈ করতে করতে মেয়েটার দাম বলছে। আচমকা বুক ছ্যাৎ করে উঠে ত্রিধারের। মেয়েটার মুখ দেখার বাসনা জাগে তার। ধীর পায়ে ট্রলারের সামনে গেলো। সবার নজর গেলো ত্রিধারের দিকে। মেয়েটাকে ধরে রাখা লোকটা বলে,’আপনেও দাম জিগাইতে আইসেন?’
ত্রিধার জবাব না দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা তখন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ছিলো যেনো এক তাজা ফুল মূর্ছে গেছে।
‘এই মেয়েটাকে আমি নিবো।’
ত্রিধারের কথায় উপস্থিত বিদেশিগুলো রেগে গেলো। হৈহৈ করে বলল,’আপনে নেবেন মানে? আমরা চওড়া দামে কিনিতে আসছি। আপনে অন্যগুলায় যান।’
ত্রিধার কারো কথার জবাব দিলো না। মেয়েটার নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনি যতটাকা চান তা আমি এই মূহুর্তে ক্যাশ রূপে দিবো কিন্তু আমার মেয়েটাকে এই মূহুর্তে চাই।’
ত্রিধারের কথায় এক বিদেশি বলল, ভাগা ভাগি করি চলেন।’
ত্রিধার লোকটির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,’আমার জিনিসে আমি ভাগ পছন্দ করি না। এই কথা আরেকবার বলবেন জিহ্ব টেনে ছিড়ে ফেলবো।’
মেয়েটা ত্রিধারের দিকে তাকালো। ত্রিধার বুক ধক করে উঠলো। ত্রিধার ট্রলারে উঠলো, মেয়েটার বাহু চেপে ধরলো তখনই নজর পরলো সেই চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটার দিকে। ত্রিধার মেয়েটিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো অস্পষ্ট সুরে বলল,’মীরা!’
তখনই গুলির শব্দ কানে এলো ত্রিধারের। গুলির শব্দে কানে আসতেই উপস্থিত সকলে ভয় পেয়ে গেলো বিদেশিরা পালাও পালাও করতে করতে ধরা খেলো। মেয়েটির পাশের লোকটি আচমকা পকেট থেকে ছুড়ি বের করে ত্রিধারের থেকে মেয়েটিকে কেড়ে নিয়ে তার গলায় ছুড়ি চেপে বলল,’আগে বাড়াইসেন তো মাইয়াডা মাইরা লামু আমি।’
ত্রিধার ভয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,’স্নিগ্ধতা!’
আমার নাম শুনে আমি মাথা তুলে তাকালাম। ছদ্মবেশে ত্রিধারকে দেখতে পেয়ে কান্না করে উঠলো৷ত্রিধার ঘাবড়ে গেলো৷ দূরে সরে গিয়ে বলল,’ওকে কিছু করলে আমি তোকে জানে মেরে দিবো রাসকেল।’
লোকটি আমার গলায় ছুড়ি আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। ব্যথায় ব্যাথাতুর শব্দ করে উঠলাম আমি। ছুড়িঘাতে গলার চামড়ে ছিলে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে গলা বেয়ে। আমার অবস্থায় ত্রিধার বেশ ঘাবড়ে গেলো। সে হাত দিয়ে পুলিশদের বলল,’কেউ গুলি ছুড়বা না। যদি আমার স্নিগ্ধতার ক্ষতি হয় আমি সবগুলোকে জানে মে রে দিবো।’
ত্রিধারের এতো হিংস্র আর ভীতু রূপ এর আগে কেউ দেখে নি কখনো। সবাই বন্দুক নামিয়ে ত্রিধারের দিকে তাকালো। লোকটি বলল,’আমি আগে এখান থেইকা পলামু তারপর এই মাইয়াডারে দিমু।’
‘নাহ! তোর কেউ কিচ্ছু করবে না। তারপর ও স্নিগ্ধতাকে ছেড়ে দে।’
‘বিশ্বাস করি না আমি।’
লোকটি আমার গলায় ছুড়ি চেপে ধীরে ধীরে ট্রলার থেকে নামতে শুরু করলেন। এক মেয়ের পায়ের ধাক্কায় লোকটি শব্দ করে পরে গেলেন ট্রলারে। কিন্তু পরার পূর্বে তিনি ছুড়ি শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন যার ফলসরূপ আমার গলা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। পুলিশেরা তাড়াতাড়ি লোকটির দিকে বন্দুক তাক করল। আমি ধপ করে পরে গেলাম সাথে সাথে। ত্রিধার ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন আমার কাছে। আমার মাথা নিজের কোলে রাখলেন।
‘স্নিগ্ধতা! কিছু হবে না তোমার। আমি এখনই হসপিটাল নিচ্ছি।’
চলবে….