#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৮
টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পরছে। লেপ্টে পরিণত হচ্ছে বিশাল জলধারায়। বাতাসের ‘শোঁ শোঁ’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বই নিয়ে পড়তে বসেছি। সামনে অপূর্ব ভাই বসে গোছগাছ করছেন। আগামীকাল চলে যাবেন। হাঁচি দিলাম অতঃপর জানালার বাইরে দৃষ্টিতে নিবদ্ধ করলাম। অপূর্ব ভাই পরক্ষণেই ধমকে উঠলেন, “তুই কি ভালো হবি না? পড়ছিস, কিন্তু ঠোঁট নড়ছে না। মুখে কি কাঁঠালের আঠা লাগিয়েছিস? কী চাস, বল। আমাদের পরিবারের মানসম্মান ডুবাতে চাস?”
“হা.. হা.. হাচ্চু।” অতঃপর সর্দিতে মুখমণ্ডল মেখে একাকার অবস্থা হলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাক মুছতে গেলে বিপরীত হলো। আরও মেখে ফেললাম। পৃষ্ঠা ছিঁ/ড়ে নাক মুছলাম। অপূর্ব ভাই কড়া হুংকার দিলেন, “সিলেবাসটা কি তোকে নাক মুছতে দেওয়া হয়েছে? ইচ্ছে করছে ঠাস করে দু গালে চারটা লাগিয়ে দিতে।”
কাঁপা কাঁপা হাতে পৃষ্ঠা দেখলাম। সিলেবাসের ‘৬’ পৃষ্ঠা ছিঁ/ড়েছি। নখ দিয়ে দাঁত কাটতে কাটতে বললাম, “ধুয়ে নিয়ে আসি?”
“হ্যাঁ! এটা তো পোশাক। ধুলেই উঠে যাবে।
আগামীকালের কাজ সিলেবাসের এই পৃষ্ঠা হাতে লিখে নিয়ে আসবি।” বলেই অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। আচ্ছা পুরো সিলেবাস লিখব? নাকি এই এক পৃষ্ঠা? ভাবতে ভাবতে আরও একটা পাতা ছিঁড়ে ফেললাম। ভাঁজে ভাঁজে আনমনে কাগজের নৌকা তৈরি করলাম। পরপর তিনটা নৌকা তৈরি করলাম। যখন চেতনা ফিরল তখন নৌকা খুলতে ইচ্ছে করল না। তুর ও শেফালী আছে, সমস্যা নেই। বাইরে বিরতিহীন ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। নৌকাগুলো ভাসাতে হবে। ভাসানোর পূর্বে আমার পড়ায় মন বসবে না। নৌকা তিনটা হাতে নিয়ে উঁকি দিলাম বাইরে। কেউ নেই। চঞ্চল পায়ে নেমে গেলাম নিচে। আমাদের বাড়ির পুরনো ল্যান্ডফোনটা বেজে চলেছে। বৃষ্টি ও হাওয়ার শব্দে ল্যান্ডফোনের ‘কিলিং কিলিং’ শব্দ শোনা বড্ড মুসকিল। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলাম। সালাম বিনিময় করে বললাম, “এতরাতে ফোন করেছেন, কে বলছেন?”
ভেজা গলায় ওপাশ থেকে বলে, “আমি প্রয়াস।”
“কোন প্রয়াস?”
ছেলেটি বাক্য হারিয়ে ফেলল। সময় নিয়ে ইতস্তত করে বলে, “তিস্তার হবু স্বামী। আমি একটু আপনাদের গ্ৰামে এসেছি। হঠাৎ বৃষ্টির কবলে পড়ে গ্ৰামে আটকে গেছি। আপনাদের বাড়িতে আজকে রাতটা থাকতে পারি।”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। চলে আসুন।”
“বাইরে প্রচুর শিলাবৃষ্টি। ঝড়োহাওয়ার বইছে। কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা যাবে?”
“বড়োদের বলে, ব্যবস্থা করছি। আপনি ঠিকানাটা বলুন।” প্রয়াস ভাই ঠিকানা বলতেই ফোন রেখে দিলাম। অগ্রসর হলাম মামার ঘরে। তাকে জানিয়ে গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। মাঝপথেই দেখা পেলাম অপূর্ব ভাইয়ের। মামার ঘর থেকে ফিরছেন তিনি। আমাকে দেখামাত্র চোখ রাঙালেন। রাগান্বিত গলায় বলেন, “তোর শরীর কি গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি আরু। গন্ডারের চামড়ায় আঘা/ত করলে সাতদিন পর সে বুঝতে পারে তাকে আঘা/ত করা হয়েছে। কিন্তু তোকে এক যুগ বুঝালেও সাধারণ কথাটা বুঝিস না।”
“তারমানে এক যুগ বুঝব না, এক যুগ পর বুঝব।” বলেই ছুটে গেলাম ঘরে। হাত থেকে সেখানে পরল তিনটা নৌকা। ভাসানো হলো না জলে।
__
“আরু, তুমি তো বলেছিলে গাড়ি পাঠাবে। কিন্তু পাঠালে না। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে। জ্বরে ম/রে গেলে তিস্তার বিয়ে কার সাথে হবে?”
ঠান্ডায় আরামসে ঘুমাচ্ছি। প্রয়াস ভাইয়ের কথা মনে হানা দিল। বাজ পড়ল মাঝরাতে। ভয়ে উঠে বসলাম। অপূর্ব ভাইয়ের কারণে তখন বিস্মৃতি হয়েছে সেই সময়ে প্রয়াস ভাইয়ের কথা। নিশ্চয়ই আমার অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। পুরো বাড়ি আঁধারে আবৃত। এগিয়ে গেলাম ল্যান্ড ফোনের নিকট। বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন তার হিসাব নেই। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন করলাম। অবিলম্বে রিসিভ হলো। আমতা আমতা করে বললাম, “আপনি এখনো সেখানে আছেন ভাইয়া?”
তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, “হ্যাঁ আপু। গাড়ি পাচ্ছি না। অর্ধেক ভিজে গেছি। গাড়ি পাঠিয়েছেন?”
প্রত্যুত্তর না করে কল বিচ্ছিন্ন করলাম। নতজানু হয়ে আলতো করে শ্বাস নিলাম। আমার জন্য তার এই অবস্থা। বারান্দা জুড়ে পায়চারি করলাম। ‘কোথায় যাবো? কী করব?’ বুঝতে পারছি না। তিয়াস ভাইয়ের ঘরে গেলাম। দরজায় করাঘাত করে বললাম, “তিয়াস ভাই। তিন হাঁস ভাই। তালে আঁশ ভাই। শুনছেন? একটু দরজাটা খুলুন।”
ভাইয়ের কোনো ভাবাবেগ শোনা গেল না। ঠান্ডার ভেতরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তিনি। অপূর্ব ভাইয়ের কাছে যাওয়ার সাহস নেই। ঘর থেকে ডাট ওয়ালা ছাতা নিয়ে বের হলাম। আমাদের বাড়িতে একটা তালাবদ্ধ সাইকেল আছে। সেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। আশেপাশে কাক পাখির ছায়াও নেই, জনমানব তো দূরের কথা। হিম হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে লোমকূপ। ভীত হলাম তবে জমে গেলাম না। পৌঁছে গেলাম সেখানে। আমাদের টিনের তৈরি প্রাইমারি স্কুল। ছিল ভাঙাচোরা। বর্তমানে সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলায় পড়াশোনা চলছে। সাইকেল গাছের সাথে ঠেস দিয়ে রেখে ছুটে গেলাম ভেতরে। ভেজা বেঞ্চিতে দু’পা তুলে কুঁজো হয়ে বসে আছে। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বললাম, “প্রয়াস ভাই, আপনি ঠিক আছেন।”
উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, “তারমানে তুমি। তুমি রিসিভ করেছিলে। এতক্ষণ লাগল তোমার আসতে। ভিজে কাক ভেজা হয়েছি। জ্বরে কতদিন ভুগতে হয়, কে জানে?”
স্মিত হেসে বললাম, “স্যরি। একদম ভুলে গেছি। আমি সাইকেল এনেছি। ছাতা ধরুন।”
পাশ দিয়ে একটা ট্রলি গাড়ি অতিক্রম করছে। ইট নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেখে শিষ দিল। কয়েক জন ছেলে বলে, “তোমাদের কাজ চালিয়ে যাও। বৃষ্টির রাত বলে কথা।”
রাগান্বিত হলাম তৎক্ষণাৎ। তড়িৎ কণ্ঠে বললাম, “অ/সভ্য-র দল। রাস্তায় কাউকে না চিনেই উদ্ভর কথা বলছেন।”
গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেল। একদল ছেলে বেরিয়ে এলো। সেই ছেলেদের মাঝে আমি খুঁজে পেলাম ‘মিহির’ নামক মৃধা বাড়ির ছেলেটিকে। ছাউনির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। পানি ঝাড়া দিতে দিতে বলে, “তোরা এতরাতে এখানে কী করছিস?”
নতজানু হয়ে বললাম, “প্রয়াস ভাইকে নিতে এসেছি। তিনি আমাদের তিস্তা আপুর হবু বর। বাড়িতে সবাই ঘুমাচ্ছে, কাউকে ডাকার সাহস হয়নি। তাই আমিই এসেছি।”
“সাহায্য না চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে বাড়িতে পৌঁছে যাবি?” বলে ছেলেটি ইশারা করল ট্রলির দিকে। আহ্বান করল যাবার। ভয় ভয় ঠেকছে। বিশ্বাস করতে বড্ড ইচ্ছে করছে। প্রয়াস ভাই বললেন, “আরু, তুমি কি তাদের চিনো?”
কাশি দিয়ে বললাম, “জি-না। তবে তিনি মৃধা বাড়ির ছেলে। আমাদের শ/ত্রু।”
“আমি কারো শত্রু নই। তোর তো প্রশ্নই উঠে না। চল বাড়িতে পৌঁছে দেই।” মিহির আমার হাত ধরলেন। টানতে টানতে উঠলেন গাড়িতে। প্রয়াস ভাই নিজেও উঠলেন গাড়িতে।
পৌঁছে গেলাম বাড়িতে। বাড়ির ভেতরে গেলাম। অপূর্ব ভাইয়ের বারান্দায় ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। ড্রয়িং রুমে অপূর্ব ভাই চেয়ারে বসে আছেন। ধৈর্যহীন হয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই আপনি উঠে গেছেন?”
প্রয়াস ভাইকে দেখে কিছু বললেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি আমার ঘরের যাও। ওখানে ওয়াশরুম আছে। আমি আসছি। জামা কাপড় বদলে নাও।”
আঙুল দিয়ে দোতলায় তার কক্ষটি ইশারা করলেন। প্রয়াস ভাই মাথা নেড়ে চলে গেলেন। পরক্ষণেই অপূর্ব ভাইয়ের ভয়ংকর মুখটি দর্শন করলাম। রক্তিম চোখজোড়ায় বড্ড তেজ। তার শক্তপোক্ত হাতটি তড়িৎ গতিতে আমার গালে আঘা/ত হানল অগ্নিরুপে। চোখজোড়া ছলছলিয়ে উঠল যেন। উচ্চ কণ্ঠে বললেন, “এতরাতে বাড়ির বাইরে এক পা ফেলার সাহস কে দিয়েছে তোকে?”
নতজানু হয়ে ওড়না খামচে নিলাম। চোখজোড়া সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। অপূর্ব ভাই দ্বিগুন তেজ নিয়ে বললেন, “কিছু জিজ্ঞাসা করছি। কথা বল। বল বলছি। নাহলে একদম মুখ ভে/ঙে ফেলব।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]