#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০
“অপূর্ব ভাই, আপনি আমার উপর অভিমান করে থাকতে পারবেন না। আপনার অভিমান ভাঙানোর ওষুধ আমার হাতে।” নিভৃতে যতনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে অগ্ৰসর হলাম অপূর্ব ভাইয়ের কক্ষের দিকে। শান্ত শিষ্ট সবকিছু। তারা ছায়াটিও অনুপস্থিত। গতরাতে গোছানো ট্রাভেলিং ব্যাগ তার জায়গায় অনুপস্থিত। চলে যায় নি তো?
বইখাতা বিছানায় রেখে ছুটে গেলাম বাইরে। উঠানে বসে কথার ঝুলি খুলেছে চার মামি ও নানি মা। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “অপূর্ব ভাই কোথায় বড়ো মামি?”
“ও তো চলে গেছে। ঘণ্টা খানেক আগে। পাঁচটায় ট্রেন।” বলেই সবাই খোশগল্পে মেতে উঠল। স্কুল ছুটি হয় চারটা নাগাদ।দ্রুতি গতিতে বাড়িতে ফিরতে সময় লেগেছে মিনিট বিশেক। পাঁচটা বাজতে ঢের বাকি। সবাইকে ফেলে স্টেশনের দিকে ছুটে গেলাম সর্বশক্তিতে। মামি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “আরু, কোথায় যাচ্ছিস? আস্তে মা, পরে যাবি।”
পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “স্টেশনে মামি।”
ছুটে গেলাম স্টেশনের দিকে। মিনিট ত্রিশ লাগল পৌঁছাতে। ভিড় চারিদিকে। ট্রেন এসেছে। গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পূর্বে দেওয়া সংক্ষেত বাজছে। যাত্রীরা ব্যস্ত ট্রেনে উঠতে। ছুটে গেলাম দরজার কাছাকাছি। ভিড় ঠেলে উঠে গেলাম ট্রেনে। আশেপাশে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। অপূর্ব ভাই নেই। আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কু সংক্ষেত মনে হানা দিল। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার কথা? জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই হতবুদ্ধ হলাম তৎক্ষণাৎ। ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যে। আশেপাশে গাছপালা পিছনের দিকে দৌড়ে চলেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম মাটিতে। কী করে ফেলেছি আমি। ভেতর থেকে অশ্রুধারা ঝরে পরল। একজন মধ্যবয়সী পুরুষ আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। আগ বাড়িয়ে বললেন, “কী হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন?”
নুয়ে গেলাম। ভীত হয়ে বললাম, “চাচা ট্রেন থামিয়ে দিন না, আমি ভুলে ট্রেনে উঠে গেছি।”
“ভুলে কেউ ট্রেনে উঠে?”
“অপূর্ব ভাইকে খুঁজতে ট্রেনে উঠেছি। কখন যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।” বলেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। লোকটার আমার প্রতি মায়া বাড়ল বৈ-কি। মাথায় হাত দিয়ে শান্তনার ভঙ্গিতে বললেন, “এখন ট্রেন থামানো সম্ভব। কিন্তু বিপদ বাড়ানো ঠিক হবেনা। ট্রেন থেকে নেমে কোথায় যাবে? ইতোমধ্যে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাত হয়ে যাবে।”
ট্রেনে এক লেখার দিকে নজরবন্দি হলো, ‘অপরিচিত কারো খাবার খাবেন না। কথা বলা, সখ্যতা থেকে বিরত থাকুন। শুভ যাত্রা।’ কিছুটা দূরত্বে লেখা, ‘বিনা টিকেটে ভ্রমণ দণ্ডনীয় অপরাধ।’ নত গলায় বললাম, “তাহলে এখন কী করব?”
তিনি উত্তম সমাধান দিলেন, “ঢাকায় পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। কাল ছাড়া আর ট্রেন ছাড়বে না। তুমি আমার সাথে আমার বোনের বাড়িতে চলো। আমি সকালে তোমাকে ট্রেনে তুলে দিবো। চাইলে কয়েক দিন বেড়াতেও পারবে।”
“না। আমি কালকেই ফিরব।”
তার বুকিং করা কেবিনে গেলাম। দুটো বেড ও অগোছালো জিনিস পত্র দিয়ে ভর্তি। বোনের বাড়ি যাচ্ছে বলে কথা। হাঁস মুরগি, শাক সবজি, ডাল, চালতা, কাঠালি কলা ইত্যাদি। আমি বসলাম। হেলান দিয়ে বসলাম। পা’য়ে প্রচুর ব্যথা করছে। চোখের পলক বন্ধ হলো। ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলাম ঘুমে। ঘুম ভাঙল সকালে। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম লোকটিকে। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ডাকছেন। ঠান্ডায় নাক আঁটকে রয়েছে। তিনি তাড়া দিয়ে বললেন, “চলো মেয়ে। রাতে ট্রেন স্টেশনে এসেছে। এখন সকাল সবাই নেমে ট্রেন ফাঁকা হয়েছে। কিছুক্ষণের ভেতরে ফিরতি ট্রেন ছেড়ে যাবে। চলো তোমাকে কিছু খাইয়ে দেই। অতঃপর ট্রেনে চড়ে সোজা বাড়িতে যাবে।”
আমিও রাজি হলাম। গতকাল সকালে খেয়েছি। ক্ষুধায় কাতর। বাড়ির সবার কথা মনে পরছে। নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। ল্যান্ড ফোন কিংবা অপূর্ব ভাইয়ের ফোন নাম্বার জানা নেই। মেঘমুক্ত আকাশের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই ঘিরে ধরে। ফিরতি ট্রেনও মিস্ করলাম। উপায়হীন হয়ে চললাম লোকটির সাথে।
সবুজ রঙের তিন চাকা গাড়িতে জীবনে প্রথমবার চড়লাম। পেছনে বড়ো বড়ো করে লেখা সিএনজি। প্রথমবার দেখলাম ভ্যান ছাড়াও গাড়ি আছে। অনেক ধরনের গাড়ি। বড়ো বড়ো রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগানো। বড়ো বড়ো ইট পাথরের বিল্ডিং। আচ্ছা এগুলো আমার মাথায় ভেঙে পড়বে না-তো? আমার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে লোকটি বললেন, “মেয়ে তোমার নাম কী?”
“অপরিচিতদের মামি নাম বলতে বারণ করেছে।” কথাটা বলে নিজেই খা/রা/প লাগল। আদৌ তিনি আমার অপরিচিত আছে? এক গাল হেসে বলে, “পাগলী মেয়ের কথা শুনো। তুই করে বলছি। তোর নাহয় নিজের নাম বলতে বারণ আছে। কিন্তু আমার নেই। আমার নাম শুনতে বারণ আছে কি?”
“না।”
“আমার নাম ইমদাদুল হোসেন মৃধা।”
বুকের ভেতরে ধুক করে উঠল। অতি চেনা নাম যে। আমার বাবার নাম। গাড়ি থামল। ভাড়া মিটিয়ে নামলেন তিনি। আমিও নামলাম। এক পা ফেলছি তো অন্য পা পিছিয়ে যাচ্ছে। বড়ো একটা বিল্ডিং। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “আমি যাবো না। বিল্ডিং ভেঙে আমার মাথায় পরলে ম/রেই যাবো। বাড়ির কেউ জানবে না, আরু বিল্ডিং-এ চাপা পরে ম/রেছে।”
তিনি আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। চারপাশে ভিড় জমে গেল। ঘিরে ধরল তাকে। লোকটা কুপোকাত হলো। বলে, “মেয়েটাকে জোর করে কোথায় নিতাছেন ভাই?”
“ভাই দেখুন কী জ্বালা। আমার মেয়ে। প্রথমবার ঢাকায় এসেছে। বিল্ডিং দেখে ভয় পাচ্ছে। যদি ওর মাথায় পরে।” ইমদাদুল সাহেব থামতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। রাগ লাগল শরীরে। ইমদাদুল সাহেবের ব্যাগ নিয়ে বললাম, “আপনি আগে আগে যাবেন, পরে আমি। বিল্ডিং ভেঙে আগে আপনার গায়ে পরুক।”
তিনি হাসলেন। আমি পিছুপিছু অগ্ৰসর হলাম। পেছন থেকে খামচে ধরলাম তার শার্ট। বিল্ডিং ভেঙে তার মাথায় পরুক।
__
গোসল সেরে জানালার পাশে বসলাম। ঠান্ডা লাগছে প্রচুর। গরম পানিতে গোসল সেরেছি। এই বাড়ির সবাই খুব ভালো। ইমদাদুল সাহেবের বোন, স্বামী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার। সবার সাথে পরিচয় হলেও ছেলেটির সাথে হলো না। মেয়েটির নাম মিহি। তার ঘরেই বসে আছি। মুখে ক্রিম মাখতে মাখতে বলে, “আরু, চিন্তা করছ কেন?”
শ্বাস নিয়ে বললাম, “বাড়ির সবাই চিন্তা করছে।”
“তবে তুমি চিন্তা কোরো না, কেমন? আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। একটু পর ডাক্তার আসবেন।”
“ফুফুকে সুস্থ দেখেছি। কখন অসুস্থ হয়েছেন?”
“আরে মনের অসুখ। মায়ের মন খা/রা/প থাকে সবসময়। তাই একজন ডাক্তার ঠিক করা আছে। তিনি সপ্তাহে একবার আসেন। গত সপ্তাহে হুট করে গ্ৰামে গেছেন। বলেছেন আজ গ্রাম থেকে ফিরে আসবেন। দেখি আসে কি-না?”
তার কথায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। অপূর্ব ভাইও মনের ডাক্তার। তারমানে মনেরও অসুখ হয়। কিন্তু আমাদের গ্ৰামে কারো হয়না। কারণ তারা যৌথ পরিবার ও প্রকৃতির মাঝে বেড়ে উঠে।
টাওয়াল দেখিয়ে বললাম, “কোথায় রোদে দিবো? আমাদের পোশাক ক্ষেতে খড়কুটোতে মেলে দেই। তাছাড়া রসিতে।”
“এসো।” বলে মেয়েকে আমায় নিয়ে গেল ছোটো বারান্দায়। কী সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া! এতক্ষণ ‘এসি’ নামক যন্ত্রের ভেতরে অবস্থান করছিলাম। গ্ৰিল বিহীন বারান্দা দিয়ে উঁকি দিতেই নজরবন্দি হলো ‘মাটি থেকে উপরের দূরত্ব’ – এত উঁচু। লাফ দিয়ে কাঁধে চড়ে গেলাম মিহির। চুলগুলো চেপে ধরে বললাম, “বাঁচাও, পরে গেলাম। ম/রে গেলাম। মামা-মামি..
মিহি ছাড়াতে চেষ্টা করে বলে, “আরে চুল ছাড়ো। ছিঁ/ড়ে যাচ্ছে, ব্যথা পাচ্ছি। আজব তো! নামো। এই মেয়ে।”
ছাড়াতে ছাড়াতে ছিঁ/ড়ল কিছু চুল। দু’জনেই মুখ থুবড়ে নিচে। মেয়েটিকে রেখে ঘরে গেলাম। জানালার গ্ৰিলে উঠে ঝুলে রইলাম টিকটিকির মতো। মনে মনে আওড়ালাম, “মামি, তোমার ছেলেকে কোথায় পাঠিয়েছ? যখন তখন উঁচু উঁচু বিল্ডিং-এ চাপা পরে প্রাণ চলে যাবে। দশের উপকার করতে গিয়ে নিজের ক্ষ/তি করে ফেলল গো।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১
ডাক্তার সাহেব এসেছেন। দরজায় করাঘাত দিচ্ছে। মিহি পোশাক ঝেড়ে গেল দরজা খুলতে। পেরিয়ে গেল কিছু মুহুর্ত। পাশের ঘর থেকে অতিপরিচিত কণ্ঠস্বর শ্রবণ হলো কর্ণপথে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নেমে গেলাম গ্রিল হতে। ছোটো ছোটো পা ফেলে অগ্রসর হলাম পাশের ঘরে। দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই একটি ছেলেকে দেখতে পেলাম। হালকা গোলাপি রঙের শার্ট, বলিষ্ঠ পুরুষালি শরীর। মাথায় ওড়না টেনে সরে গেলাম। ছেলেটি বেরিয়ে গেল চঞ্চল পায়ে। চিন্তিত লাগল বেশ। ছুটে গেলাম জানালার নিকট। ভয় এক সেকেন্ডে উধাও হয়েছে। সিএনজি ডেকে উঠে যাওয়ার পূর্বে দেখা গেল তার মুখশ্রীর অংশ বিশেষ। ওষ্ঠদ্বয় মৃদু নাড়িয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই।” পরক্ষণেই উচ্চ স্বরে ডাক দিলাম। ততক্ষণে গতিশীল হয়েছে সিএনজি। আমার নম্র ভদ্র গলার আওয়াজ ছয় তলা হতে নিচ তলায় পৌঁছায়নি। দ্রুত গতিতে ছুটে গেলাম নিচে। সিঁড়ি পেরিয়ে নেমে গেলাম রাস্তায়। সিএনজি অদৃশ্য, বহুদূরে। পুনরায় ছুটে এলাম। সিঁড়ি পেরিয়ে উঠলাম ঘরে। হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “অপূর্ব ভাই এখানে কেন এসেছিলেন?”
মিহি সন্দিহান গলায় বলে, “কোন অপূর্ব ভাই?”
“একটু আগে ফুফুকে দেখল না? ডাক্তার। সে।”
“মাকে দেখতে এসেছে। বলেছিলাম না, ডাক্তার আসবে?”
“আমি তার কাছে যাবো। প্লীজ ঠিকানাটা দিন আমায়।”
মিহি আমার কথায় উত্তেজিত হয়ে উঠল। হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে বলে, “শান্ত হও। আমাদের ব্যাপারটা খুলে বলো। তুমি যাকে খুঁজতে ট্রেনে উঠেছিল, সেই ডাক্তার অপূর্ব আহসান?”
“হম। আমার অপূর্ব ভাই। ঠিকানাটা দিন প্লীজ।” মিহি আমায় অপূর্ব ভাইয়ের ঠিকানা লিখে দিল। পৌঁছাতে পারব কি-না জিজ্ঞাসা করল। আমি সায় দিলাম। গোসল সেরে মিহি-র পোশাক পরিধান করেছিলাম। পাল্টে নিজের পোশাক পরিধান করলাম। অতঃপর বেরিয়ে গেলাম চেম্বারের উদ্দেশ্য। মিহি কিছু টাকা দিল আমায়।
সিএনজিতে চড়ে কাগজের লেখাটা পড়ে বললাম, “শাপলা চত্বরে হুমাইরা ক্লিনিকে যাবো।”
ড্রাইভার ক্লিনিকের উদ্দেশ্য যাত্রা আরম্ভ করল। উত্তেজিত হয়ে হিম হাত জোড়া ঘসতে ঘসতে উষ্ণ করে ফেললাম। সিটের উপর ‘আর্দশলিপি’ একটি বই পেলাম। আমার শৈশবের প্রথম পড়া শুরু। বইটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বসলাম। গাড়ি থামল দোতলা একটি ক্লিনিকের সামনে। পঞ্চাশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। মধ্য বয়স্ক একজন লোকজন লোক আমার দেখে পথ আটকে দাঁড়ালেন। মাটি রঙের পুলিশি পোশাক পরণে। আমাকে ধরে নিয়ে যাবে না-তো? থমথমে গলায় বলেন, “কাকে চাই? কোন ডাক্তার?”
হাতের দুপিঠ দেখিয়ে বললাম, “ডাক্তার দেখাতে আসিনি। মনো চিকিৎসক অপূর্ব আহসান আমার ভাই হয়। তার সাথে দেখা করতে এসেছি। একটু বলুন না আমি এসেছি?”
“অপূর্ব স্যার এখানে একা থাকেন। তার পরিবার গ্ৰামে থাকে। আপনি তার সাথে একটা শর্তে দেখা করতে পারবেন। রোগী দেখার সিরিয়াল চলছে। চার্জ দিয়ে সিরিয়াল কে/টে দেখা করতে পারবেন।”
চার্জ? কৌতুহল নিয়ে বললাম, “চার্জ কী?”
“তার ফি। পাঁচশত লাগবে। আছে?” মুঠো করা হাত খুলে দেখলাম। দুটো একশত টাকার কচকচে নোটস। উপরে ব্রীজ। ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন। একবার অপূর্ব ভাইয়ের কাছে পৌঁছাতে পারলেই হয়। সম্মতি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সিটে বসে অতিবাহিত করলাম কিছু মুহুর্ত। অপূর্ব ভাইয়ের চেম্বারের দিকে এক পা এগুলে মহিলারা চ্যাঁচিয়ে বলে, “এই মেয়ে তোমার সিরিয়াল কত? সিরিয়ালে দাঁড়াও। আগে আমার সিরিয়াল?”
কিছুক্ষণ একা একা হাঁটাহাঁটি করে দিলাম এক দৌড়। দরজা খুলে প্রবেশ করলাম ভেতরে। সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিতা একজন ডাক্তার বসা। আমাকে দেখামাত্র বললেন, “বসুন। বলুন আপনার সমস্যা?”
অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটি মাথানত করে বলে, “স্যার মেয়েটি সিরিয়াল কা/টে নি। সোজা ঢুকে এসেছে।”
“সিরিয়াল কা/টেননি কেন?”
“ডাক্তার সাহেব-কে আমার অতি প্রয়োজন। কোথায় তিনি?”
ডাক্তার হেসে বললেন, “আমিই ডাক্তার বলুন আপনার সমস্যা। বসুন। আপনার মতো একটা বাচ্চার কাছ থেকে চার্জ নাইবা নিলাম। সমস্যার কথা বলুন।”
হাতে আদর্শলিপি বইটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “আমি আরু অপূর্ব ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি। প্লীজ তাকে ডেকে দিন।”
বেজায় বিরক্ত সে। রাগান্বিত হয়ে আদেশ করেন, “আউট। গেট আইট। বের হয়ে যান। দাড়োয়ান-কে বলুন যাকে তাকে ঢুকতে না দেয়”
এসিস্ট্যান্ট আমাকে ধমক দিল, “যান। স্যার রেগে যাচ্ছেন। আপনাকে কিন্তু পুলিশে দিবেন।”
ফিচেল হেসে বেরিয়ে গেলাম। সারিবদ্ধ গাছের নিচে বসে পড়লাম। এশার আযানে মুখরিত চারপাশ। বুকের ভেতরে অনুভব করছি অদৃশ্য ভয়। অন্তরে হাহাকার। তারা কি আমায় ভুল ঠিকানা দিল? না-কি সিএনজি ড্রাইভার দিলেন। মিহিদের বাড়ির ঠিকানাটাও নেই, কোথায় যাবো এতরাতে?
ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি দ্রুত গতিতে অতিক্রম করছে। লোকজন ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছে। আমার খবর নেই কারো। হাঁটা ধরলাম আপন মনে। চোখজোড়া ছলছলিয়ে উঠেছে। নিজেকে অসহায় লাগছে। স্টেশনে যাবো। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধান পেলাম নদীর। লঞ্চ চলাচল করছে। নদীর পাশ ঘেঁষে সরু ব্রীজ। রেলিং-এ উঠে বসলাম। পানির তৃষ্ণা অনুভব করলাম। হাতের করতলে নিয়ে এক ঢোক পান করে তৃষ্ণা মেটালাম। বিকট শব্দ শোনা গেল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ঠকঠক করে কেঁপে উঠলাম। কানে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম, “আহ্!”
নদীর জলে ধপাস করে ফেলল কাউকে। একটি জীবন্ত প্রাণ। ডুবে গেল অবিলম্বে। বেশ কয়েকজন যুবক। আমাকে দেখে হতভম্ব তাঁরা। চ্যাঁচিয়ে বলে, “ধর মেয়েটিকে। তন্ময়-কে মা/রার সাক্ষী মেয়েটি।”
ছুটে এগিয়ে এলো একদল যুবক। আমি দৌড় আরম্ভ করলাম। পায়ে সত্তর টাকা দামের স্যান্ডেল। কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই ছিঁ/ড়ে গেল। জুতো জোড়া রাস্তায় ফেলে সালোয়ার উঁচু করে দ্রুত গতিতে ছুটলাম। রাত তখন এগারোটা ছাড়িয়েছে। নির্জন পথঘাট। পেছন থেকে মুঠো করে ধরল চুলের মুঠি। টান দিল। মুখ থুবড়ে গাছের সাথে আঘাত পেলাম। মাথা ঘুরে উঠল। টেনে তুলে দাঁড় করালো। মা/তালদের ন্যায় ভারসাম্য হারিয়ে টলছি। পরপর বসিয়ে দিল দুই চ/ড়। গাছের সাথে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। গাল জোড়া অগ্নিরুদ্ধ। মাটিতে ফেলে এবড়ো থেবড়ো লা/থি দেওয়া শুরু করল। হাতে ছিল মোটা লা/ঠি। বাদ যায়নি দেহ। আ/ঘা/তগুলোতে জর্জরিত দেহ। ব্যথায় গোঙানি শুনতে লাগলাম। শহরের মানুষের মনে দয়া মায়া হয়না? ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল গলা। গলায় হাত দিয়ে কাঁ/টা মুরগির মতো ঝটপট করতে লাগলাম। শ্বাস কষ্ট শুধু হলো। কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো নেত্রযুগল। জীবনের শেষ বুঝি এখানেই।
তীর্যক আলোর রেখা পতিত হলো মুখশ্রীতে। কুঁচকে গেল চোখ মুখ। যুবকেরা ছুটে গেল অদূরে। ঝাঁপসা চোখে অবলোকন করলাম সবকিছু। কাশি উঠল। গাড়িটা চা/পা দিয়ে যাবে বুঝি এক্ষুনি। তেমন কিছু ঘটল না। সামনে থামল, নিকটে এসে। সুদর্শন সুপুরুষ নেমে এলো গাড়ি হতে। মাথাটা আলতো কোলে নিল। উৎকণ্ঠার সাথে প্রকাশ করল, “আরু, তুই? তুই এখানে কী করছিস? বাড়ির সবাই তোর জন্য কত চিন্তা করছে, আর তুই এখানে?”
হাতটা বন্ধনহীন শক্তির চেপে ধরে বললাম, “অ..পূ..র্ব ভা..ই।”
অতঃপর চেতনাশক্তি হ্রাস পেল। পুরোপুরি হারালো না। ক্ষণে ক্ষণে কাশি ছাড়া অপূর্ব ভাই ডেকেও সাড়া পেলেন না আমার। পাঁজাকোলা করে চলল গাড়ির ভেতর। মুখে পানির ঝাপটা দিল। ওষ্ঠদ্বয়ের মধ্যিখান দিয়ে পানি গলিয়ে দিলেন ভেতরে। গালে হাত রেখে উদাসীন হয়ে বললেন, “আরু শুনতে পারছিস? তাকিয়ে দেখ পাখি। এইতো আমি।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]