এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব-১৬+১৭

0
204

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৬

“বংশের চুলকানি একবার ব্যবহারেই খ/ত/ম। মাত্র দশ টাকায়। মাত্র দশ টাকা। চুলকানি মলম, ইঁদুর মা/রা/র মলম।”

মনে মনে উচ্চারণ করে পিয়াস ভাইয়ের কান্ড দেখছি। কিছুদিন আগে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন প্রতিযোগিতায় বেলেন্ডার না দিয়ে মাইক দিলে। দুদিনের জন্য ভাড়া নিতাম।
অপূর্ব ভাইয়ের পোশাক পরিধান করার পর নাজেহাল অবস্থা হলো পিয়াস ভাইয়ের। চুলকানির জন্য শান্তিতে দু দন্ড বসতে পারছেন না। ছুটে গেলেন ওয়াশরুমে। দরজা খোলা রেখেই পানি ঢাললেন। মুখ টিপে হাসছি আমি। তিস্তার আপুর দৃষ্টি এড়ালো না। হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। সন্দিহান গলায় বলেন, “পিয়াসের সাথে কী করেছিস তুই? সত্যি বলবি কিন্তু।”

গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বললাম, “আমি পিয়াসের সাথে কিছু করি নি। আমি শরবতের সাথে করেছি, ওয়াশরুমের মেঝের সাথে করেছি, অপূর্ব ভাইয়ের পোশাকের সাথে করেছি। এখন যদি পিয়াস মাঝখানে ঢুকে পরে, তাতে আমার করণীয় কী?”

তিস্তা আপু মাথায় হাত দিয়ে উল্টো ঘুরে রইলেন। ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। তিস্তা আপুর সময় ঠিক একই গতিতে ছুটছে। বিচলিত হয়ে বলেন, “বুঝার চেষ্টা কর আরু। এখানে প্রয়াস আর না পিয়াস। কারো দোষ নেই। দোষ সব আমার ভাগ্যের। আমি সুজনকে ভালোবেসে ভুল করেছি।”

ভ্রু নাচিয়ে কপাল কুঁচকে বললাম, “তোমার জন্য পিয়াসকে এমন নাকানিচোবানি খাইয়েছি, কে বলেছে? সে আমার ময়না পাখির গলা চে/পে ধরেছিল। তার শাস্তি পেয়েছে।”

“কে শাস্তিটা দিয়েছে শুনি?” দুহাত বুকে গুঁজে বললেন অপূর্ব ভাই। সৌজন্য হাসি দিয়ে তিস্তা আপুর হাত টেনে ধরলাম। পেছনে লুকিয়ে গেলাম। বিরাগী হয়ে বললাম, “তিস্তা আপু, তোমার ভাইয়ের থেকে আমাকে বাঁচাও।”

“তিস্তা ঘরে যা। প্রয়াসের কী লাগবে দেখ।” তিস্তা আপু মাথা নেড়ে ঘরে গেলেন। আমিও বড়ো বড়ো কদম ফেললাম। বিলম্বে হাতটা অপূর্ব ভাইয়ের হাতে দখল হলো। বারান্দার দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিলেন। রেলিং-এ হাত রেখে বলেন, “চৌদ্দ তলা থেকে একটা বল পড়লে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে, মানুষ পড়লে কী হবে নিশ্চয়ই বোঝাতে হবে না। অতিথি বাড়িতে এলে তার সাথে এমন আচরণ করা কোথায় শিখেছিস?”

‘অপূর্ব ভাই আমার ও তিস্তা আপুর কথা শুনেছে’ – বুঝতে বাকি রইল না। হাতটা ছাড়িয়ে কোমরে হাতে দিলাম। অন্যহাতে নাক ঢলে বললাম, “অন্যের বাড়িতে গিয়ে এমন ব্যবহার সে কোথায় শিখেছে।”

“পিয়াস তো বড়ো হয়।”

“কিন্তু আমার বেয়াই হয়। বেয়াই বেয়ানের দুষ্টু সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির ঢুকতে নেই।” বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। অপূর্ব ভাই আমার গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে এতে সন্দেহ নেই। আমিও একটু কোমর দুলিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
___
একটা ঘরে পিয়াস আর প্রয়াস ভাই ঘুমিয়েছেন। অন্যঘরে নানা ভাই, অপূর্ব ভাই ও তিয়াস ভাই। মেয়েরা ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বিছানা করে শুয়েছে।

চোখে আলো পড়তেই ঘুম বিদায় নিল আমার। পরপর তিনবার হাঁচি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে উঠে বসলাম। মেঝেতে শোবার দরুন ঠান্ডা লেগেছে। গলা চুলকাচ্ছে। গলা চুলকে সামনে হাত আনতেই নজর বন্দি হলো কিছু চুল। পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওড়না ঝাড়া দিতেই একগাদা চুল নিচে পড়ল। অবুঝ দৃষ্টিতে চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম। কাঁপা কাঁপা হাতটা কাঁধে রাখতেই হতভম্ব হলাম। আচম্কা বাম চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু কাঁধে ঝরল। বিলম্ব হলো গলায় স্বর আসতে। কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে দিলাম এক চিৎকার, “মামি..

গ্ৰাম থেকে দুই মামি ঢাকায় এসেছেন। উভয়েই রান্না রেখে ছুটে এলেন। তুর শেফালী ঘুমিয়ে ছিল পাশে। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় উঠে বসল তারা। বড়ো মামি বলেন,

“কী হয়েছে আরু? চিৎকার দিলি কেন? দুঃস্বপ্ন দেখেছি?”

দু’হাতে চুলগুলো মুঠো করে কেঁদে দিলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম, “আমার চুল কোথায় মামি? কোমরের নিচে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো মাটিতে কেন গড়াগড়ি করছে?”

আমার কথা অনুসরণ করে তাজ্জব বনে গেল সবাই। ছোটো মামি বলেন, “রান্না ঘরে যাওয়ার আগেও সব ঠিক দেখেছিলাম। হঠাৎ এমন কীভাবে হলো?”

বড়ো মামি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “লক্ষি মা আমার। শান্ত হ।”

অপূর্ব ভাই চেম্বারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। চুলে হাত চালাতে চালাতে বললেন, “কী হয়েছে এখানে? সাতসকালে চিৎকার করছিস কেন আরু?”

অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠে গেল। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। কথা বলতে পারলাম না। বড়ো মামি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন, “দেখ না, একটু আগেও দেখলাম মেয়েটার চুলগুলো ঠিক আছে। এখন দেখছি কে/টে পড়ে আছে। (ছোট মামিকে উদ্দেশ্যে করে বলেন) সবজি ভাজি পুড়ে যাবে, তুই রান্নাঘরে যা।”

“ওকে তৈরি করে দাও। দেখি কান্না থামাতে পারি কি-না।” বলেই অপূর্ব ভাই ঘরে চলে গেলেন। ‘এতগুলো ব্রাশ দেখে বুঝতে পারল না আমার ব্রাশ কোনটা?’ – যার দরুন শেফালী ব্রাশদানীটা খুলে নিয়ে এলো। মামি টুথপেস্ট নিয়ে বললেন, “তোর ব্রাশ কোনটা?”

“একটাতে দিলেই হবে। কালকে সবুজটা দিয়ে ব্রাশ করেছি, আজকে লালটা দাও। আমার চুল না লাগিয়ে দিলে কিন্তু আমার কান্না থামবে না।” মামি কথা বাড়ালেন না। সংক্ষেপে বললেন, ‘ ঠিক আছে।’
পরিপাটি হয়ে অপূর্ব ভাইয়ের সাথে বের হলাম চেম্বারের উদ্দেশ্যে। নিত্যদিনের ন্যায় আজকেও রিকশায় চড়ে গেলাম। আগের দিনগুলোর মতো অট্টালিকা ভেঙে পড়ার মতো ভয় নেই। শরীরে একটু তেজ বিরাজ করছে। পুরোপুরি শাপলা চত্বরে গেলাম না। একটা বড়ো রেস্তোরাঁ দেখে রিকশা থামালেন। ভাড়া মিটিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে গেলাম। অতিপরিচিত এক রেস্তোরাঁ।বিটিভির ধারাবাহিককে অনেকবার দেখেছি।

মুখোমুখি বসে মেনু কার্ড সামনে রেখে বললেন, “দেখ, কী খাবি?”

“চুল লাগবে আমার।”

“চুল খেলে পেটে প্যাঁচ লেগে ম/রবি। চুল ছাড়া কী খাবি সেটা বল।”

অপূর্ব ভাই ওয়েটার ডেকে পরটা ও সবজি ভাজি অর্ডার করলেন। পাশের চেয়ার টেনে বসলেন। মাথার ঘোমটা খুলে বললেন, “তোকে তো সেই লাগছে আরু। পিয়াসকে দুটো ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।”

ভ্রু কুঁচকে বললাম, “তারমানে আপনি জানেন, এটা পিঁয়াজু করেছে?”

“শেফালীকে মিষ্টি কুমড়ার ফালি, তুরকে তুর পাহাড়, তিস্তাকে বিচ্ছু নদী, তিয়াসকে তিন হাস। এখন পিয়াসকে পিঁয়াজু। আমার নাম ঠিক করিস নি।”

“মামি আপনার এমন নাম রেখেছে, ভেঙাবো কীভাবে?”

ওয়েটার খাবার নিয়ে হাজির হলো। অপূর্ব ভাই সবজি মিশিয়ে পরটার টুকরো মুখে তুলে দিলেন। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আলতো করে গাল চেপে মুখে দিলেন। অতঃপর নিজে পরটার টুকরো মুখে দিয়ে বললেন, “এজন্য আমি বলেছি বড়দের সাথে না লাগতে। গতরাতেও বুঝাতে চাইলাম। তুই কি বললি বেয়াই বেয়ান।”

তার বারণে তখন মন সায় না দিলেও এখন আফসোস লাগছে। দ্বিতীয়বারের মতো পূর্বের ভুলটি করলাম না। মৃদু স্বরে বললাম, “স্যরি।”

অপূর্ব ভাই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন। টোল পড়া গালের হাসিটা মারাত্মক লাগল বুকে। নাকে ফুলের সুবাস পৌঁছে গেল। আজ পঞ্জিকায় পহেলা ফাল্গুনের উপস্থিতি।

বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা!
কারা যে কোকিল পিছে/ বসন্ত এসে গেছে!

টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে দিলেন। হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, “চল। একটু বসন্তের ছোঁয়ায় দুজনে বিলীন হয়ে যায়। দু’হাতে বই কুড়াবো।”

পিচের রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছি অজানায়। একটি হাত অপূর্ব ভাইয়ের হাতে বন্দি।‌ অপর হাতটা দিয়ে দৃঢ় ধরলাম। মাথাটা কাঁধে হেলান দিয়ে বললাম, “শাড়ি পরলে ভালো লাগতো না? হাতে দু মুঠো কাঁচের চুড়ি। আমাদের সাথে সাথে রিনিঝিনি শব্দে বাজতে থাকতো।”

নীরব থেকে মোলায়েম কণ্ঠে বলে, “মন্দ হতো না।”

অট্টালিকার বারান্দায় গাঁদা ফুলের সমারোহ। পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় কয়েকটা পাপড়ি মাথার পড়ল। অপূর্ব ভাই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে ছন্দ তুলে বললেন, “রঙ্গবতী।”

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৭

অপূর্ব ভাই ও আমি শপিং মলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। সময় দেখতে দেখতে অপেক্ষা করছি পরিবারের সবার জন্য। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কয়েকটা সিএনজি এসে থামল। একে একে বেরিয়ে এলো সবাই। বাদ যায়নি পিয়াসও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘দুলহান ফ্যাশন’ লেখা একটি দোকানের ভেতরে প্রবেশ করলাম। একের পর এক শাড়ি দেখিয়ে চলেছে কর্মীরা। তিস্তা আপুর মুখ ভার বিধায় পাত্তা দিচ্ছে না সেই সব। মনের কোণে সুজন ভাই বিরাজমান। মামিরা তিস্তা আপুর শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিজেরাই পছন্দ করে চলেছে। তুর অপূর্ব ভাইয়ের হাত ধরে বলে,

“ভাইয়া। আমার একটা শাড়ি নেই। একটা নিবো।”

“জীবনেও তো শাড়ি পড়তে দেখলাম না। নিয়ে সেই আলমারিতে তুলে রাখবি।”

শেফালী অপূর্ব ভাইয়ের ফোনে গেমস খেলছিল। দূর থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ছুটে আসে। উত্তেজিত হয়ে বলে,

“অপূর্ব ভাই আমিও একটা শাড়ি নেই। তুর আপনার বোন বলে কি শুধু ওকেই দিবেন?”‌ বলেই শেফালী অপূর্ব ভাইয়ের অন্য হাতটি জড়িয়ে ধরে। অপূর্ব ভাই সম্মতি দিয়ে জানায়, “তিস্তা থেকে শুরু করে বাড়ির সবার জন্য শপিং-এর টাকা আমি দিচ্ছি। ইচ্ছে মতো করে নে।’
ওরা সবাই ছুটে গেল।
আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। পর মুহুর্তে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বলেন, “তোর শাড়ি লাগবে না? কিনে নে।”

সাজিয়ে রাখা একটা সাদা শাড়ি তার নজরবন্দি হলো। মাঝে মাঝে মতির কাজ। শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলেন, “বিয়ের দিন এটা পরিস, সুন্দর লাগবে।”

বিরক্ত হলাম আমি। সবাই রঙ বেরঙের পোশাক পড়বে আর আমি বিধবার মতো সাদা পরে ঘুরঘুর করব কেন? আশ্চর্য! তেজ নিয়ে বললাম, “পারব না। বিয়ের দিন আমার কত কাজ জানেন? গেট ধরতে হবে, জুতা লুকাতে হবে, প্রয়াস ভাইয়ের খাবারে ভাগ বসাতে হবে। আমি বিধবা ভাতা পেতে চাইনা।”

“সাদা মানে শান্তি। মনে শান্তি এনে দেয়। ইচ্ছে শক্তি বাড়ায়। সাদা শাড়ির সাথে নীল ব্লাউজ পরবি। দূর থেকে দেখে মনে হবে, এক টুকরো শুভ্র নীলাভ মেঘ।
যা, পরে দেখ। ভালো লাগে কি-না?” নতজানু হয়ে মিরে রইলাম। অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। শাড়িটা নিয়ে ট্রায়াল রুম খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। দুইটা ট্রায়াল রুম খুঁজে পেলাম। দুটোই আমাদের দখলে। তিস্তা আপু, শেফালী, তুর ও মামিদের দখলে একটা‌। অন্যটা প্রয়াস ভাইয়ের দখলে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর আরেকটা ট্রায়াল রুম খুঁজে পেলাম। ব্লাউজের হুকের সাথে কাঁধের ছোটো চুলগুলো প্যাঁচিয়ে গেল। দু’হাতে ধরে ছাড়ানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলাম না। টানাটানির এক পর্যায়ে পিঠে আঁচড় লাগল। উপায়হীন হয়ে দরজা খুলে উঁকি দিলাম। ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলাম। তুরকে দেখতে পেলাম। তুরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “একটু ভেতরে আয়। চুলগুলো ছাড়িয়ে দিয়ে যা।”

“পারব না। শেফালীকে বল।” পরক্ষণেই কড়া গলায় ধমক দিয়ে বললাম, “শেফালীকে দেখতে পেলে তোকে বলতাম। তাড়াতাড়ি আয়।”

ভেংচি দিয়ে তুর চলে গেল। বিয়ের মরসুম হওয়ার দরুন ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফাঁকা দেখলে যখন তখন ছুটে আসবে ট্রায়াল নিতে। দরজাটা আস্তে ভিরিয়ে আয়নাতে তাকালাম। অপূর্ব ভাই পার্লার থেকে হেয়ার স্টাইল করেছেন। দেখতে স্টাইলিশ আরু লাগছে। তৎক্ষণাৎ গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পেলাম,
“আরু, কী হয়েছে? তুর বলল তুই ডাকছিস।”

“শেফুকে পাঠান একটু।”

“খুঁজে পেলাম না কোথাও, হয়তো অন্য কোনো ট্রায়াল রুমে। আমাকে বল, কী সমস্যা?”

“হুকটায় চুল প্যাঁচিয়ে গেছে। খুলতে পারছি না।”

“দরজা খোল। আমি দেখছি।”

“আপনি?”

“হম। আশেপাশে কাউকে দেখছি না। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি। ট্রাস্ট মি। চোখ বন্ধ করে সাহায্য করব।”

গভীর ভাবনায় লিপ্ত হয়ে দরজা খুলে দিলাম। ভেতরে ঢুকে দরজাটা ভিরিয়ে দিলেন অপূর্ব ভাই। চোখ বন্ধ করে নিলাম। কাঁধে স্পর্শ লাগতেই কেঁপে উঠলাম আমি। সরে দাঁড়ালাম। আচম্কা চোখ খুলে ফেললাম। আঙুল উঁচিয়ে চুল ছাড়াতে লাগলেন। আয়না থেকে দেখে চলেছি অপূর্ব ভাইয়ের সুক্ষ্ম হাতের কাজগুলো। শুভ্র রঙের শাড়িতে মন্দ লাগছে না।

সবাই শপিংয়ে জমে উঠল। আমি তাদের ভারি ব্যাগ বহন করলাম। প্রয়াস ভাই সবাইকে উপহার দিলেন। আমাকে দিলেন না। মন খারাপ নিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবাকে খুব মনে পড়ছে। কোথায় তিনি? আমার ভাই থাকলে আমাকেও উপহার দিতো। চোখ দুটো মুছে বললাম, “মামি আর কতক্ষণ লাগবে তোমাদের?”

বড়ো মামি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, “মেয়ের বিয়ে বলে কথা, মনমতো কিনব না? তুই বাড়িতে থেকে যেতি।”

বাক্যটি না করে একপাশে চুপটি করে দাঁড়ালাম। চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। এখনো অনেক কিছু রয়েছে। অপূর্ব ভাই বিরক্ত হয়ে বলেন, “হয়েছে এবার তো বাড়িতে চলো। ক্ষুধায় পেটে নাচছে।”

“একটা রেস্তোরাঁ আছে না এখানে? আসার সময় দেখলাম। সেখানে চল, খেয়ে আবার কিনব।”

অপূর্ব ভাই সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে আমার। প্রয়াস ভাইকে দায়িত্ব রেখে আমাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।

বাড়ির অদূরে সিএনজি থামতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল আমার। ধোঁয়ায় আকাশ কালো হয়ে গেছে। বাড়ির চারপাশে ভিড়। কত মানুষের হাহাকার। শেফালী ও তুরকে রেখে ছুটে গেলাম আমি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজে ব্যস্ত হয়েছে। পানি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। শেফালী উত্তেজিত হয়ে বলে, “কত তলায় আগুন লেগেছে আরু, ফ্লাটে আমাদের জামা কাপড় আছে। পু/ড়ে যাবে।”

তুর বলে, “তোর ময়না পাখিটা কোথায় আরু? বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমি ওকে খাঁচায় দেখেছিলাম।”

হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে গেল আমার। ময়নাকে একবার হারিয়েছি আর হারাতে পারব না। ‘ময়না’ বলে চিৎকার করে ছুটে গেলাম। আমাকে এসে ধরল ফায়ার সার্ভিসের নারী কর্মীরা। বলেন, “কত তলায় থাকেন আপনি ম্যাম?”

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “চৌদ্দ তলায়।”

“উপরে যাবেন না ম্যাম। আঠার তলায় আগুন লেগেছে। ষোলো তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আপনি যাবেন না।”

হাতটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, “আমার ময়না আঁটকে পড়েছে। আমাকে যেতেই হবে। প্লীজ ছাড়ুন।”

“ম্যাম, বোঝার চেষ্টা করুন। আগুন অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা আপনার ময়নাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করব। কিন্তু আপনাকে ছাড়তে পারব না।”

অবজ্ঞা করে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিলাম। আশেপাশে পাশে দৃষ্টি গভীর করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে গেলাম। উপরের উঠার সাথে সাথে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ কমে আসছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। দৌড়ে বারো তলা পর্যন্ত উঠে মাটিতে বসে পড়লাম। লিফট শব্দটির সাথে অপরিচিত আমি। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় আরও আগে অসম্ভব এর ব্যবহার। রেলিং-এ হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে দিলাম। শরীরে শক্তি নেই। পেছনে পেছনে দু’জন কর্মী এসেছে। পুনরায় দৌড় শুরু করলাম। ফ্লাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম। বড়ো একটা তালা ঝুলছে। চাবি অপূর্ব ভাইয়ের কাছে। হাত দিয়ে জোরে আঘাত করলাম। হিতে বিপরীত হলো। হাতে ব্যথা পেলাম। দরজায় আঘাত করতে করতে দরজার সাথে মাথা ঠেকালাম। কর্মীদের দেখতে পেলাম না। দু’জন কর্মীকে না দেখে কেঁদে অস্ফুট স্বরে বললাম, “আপনাদের পায়ে পড়ি বোন। আমার ময়না পাখিকে মুক্ত করে দিন। তার মৃ/ত্যুর জন্য আমাকে দায়ি করবেন না।”

মেঝে তখন গরম হয়ে গেছে। সব কিছু ঘোলাটে। চোখে ঝাপসা দেখছি। টকটকে লাল হয়ে গেছে। অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পেয়ে জ্ঞান হারালাম আমি। পরবর্তী দৃশ্য মনে নেই।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]