#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪০
আকাশে বিমান চলছে। বাচ্চাদের মতো মাথা উপরে তুলে দেখছি। সামনে থেকে ক্রমশ পেছনে যাচ্ছে সে। আমিও তার সাথে সাথে একটু একটু করে মাথা পিছিয়ে নিচ্ছি। এক পর্যায়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়লাম। মাথার পেছনের অংশে হাত বুলাতে বুলাতে দেখলাম বিমান। বিমানের সাথে সাথে একজন মহিলা এলো কাছে। উচ্চ স্বরে বলে, “আরু, এই আরু। দিব্যি সুখে আছিস দাদা বাড়িতে। শান্তিতে আছিস। তোর সুখের জন্য আমি আমার ছেলেকে হারাতে বসেছি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছে এক ধারে। তার চোখ আদৌ খুলবে কি-না জানি না। সবকিছু তোর জন্য হয়েছে।”
আমার বাহু ধরে বলে চলেছেন এক নাগাড়ে। কাঁদছেন তিনি। আমার কষ্ট লাগছে। আমি তাকে দেখছি। কোথাঔ তাকে দেখেছি। কিন্তু কোথায়? নয়না চাচি ছুটে এলেন। আমাকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, “আপা ছাড়ুন ওকে।”
“কেন ছাড়ব ওকে। ওর মতো স্বার্থপর একটা মেয়েকে ছাড়ব না আমি। আমার ছেলেটা ওর জন্য এমন হয়েছে। আর সে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।” বলেই গলা চে/পে ধরলেন। নয়না চাচি ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন। উনি কী অপূর্ব ভাইয়ের মা? আসলে তার মুখশ্রী আমার মনে নেই। অপূর্ব ভাই ছাড়া কারো মুখ আমার মনে নেই। নয়না চাচি আমাকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, “আরু পা/গ/ল হয়ে গেছে, আপা। একটা পা/গ/লকে মে/রে কী শান্তি পাবেন আপনি? ছেড়ে দিন ওকে।”
আমাকে ছেড়ে দিলেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরপর কয়েকটা কাশি দিয়ে আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। কারণ আমি পাগল। কষ্ট পেলে মানুষ কাঁদে, আর আমি হাসি।
তিনি আবার বললেন, “কী বলছেন কী? আরু, পা/গ/ল হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ। অপূর্ব কে হয়তো একটু বেশিই ভালোবাসে। কতদিন চিৎকার করে কেঁদেছে। অপূর্ব নাকি ওর চোখের সামনে এসে ভাসে। সহ্য করতে পারে না আরু। ডাক্তার বলেছে, ‘মাথার পেছনে আঘাত লাগাতে এমন হয়েছে। বাকিটা মেন্টাল ডিপ্রেশনে।’ কী করব কিছু বুঝতে পারছি না।” বলতে বলতে কেঁদে দিলেন নয়না চাচি। মাটি দিয়ে খেলছি আমি। অজান্তেই মুখে তুলে দিচ্ছি। আমার থুথু ফেলছি। মামি বললেন, “আপনারা এতো বড়লোক। একটা ডাক্তার দেখাতে পারেন। নাহলে আরুকে আমায় দিয়ে দিন। আমি ওর যত্ন নিবো।”
“ডাক্তারের কাছে নেয় নি। ডাক্তার বাড়িতে এনেছিল। আরুকে দেখে বলেছে, সে প্রেগন্যান্ট। মা হতে চলেছে। ডাক্তারের কাছে নিলে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে, সেই ভয়ে নেয় নি। আগে আরুর অ্যা/ব/র্শ/ন করবে, তারপরে ব্যবস্থা নিবে।”
মামি হতবাক হয়ে গেলেন। আমাকে কাছে ছুটে এলেন। আদরে আদরে বলে দিলেন আমায়। আমি শুধু তাকিয়ে দেখলাম আর ছাড়াতে চেষ্টা করলাম। মামি বললেন, “আমার অপু বাবা হতে চলেছে? আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। কেমন স্বপ্ন লাগছে সবকিছু। কীভাবে আমি ওদের বাঁচবো। আরুকে আমার সাথে নিয়ে যাই।’
“না। আরু প্রেগন্যান্ট। আপনাদের কাছে যদি আরু আর অপূর্বর কাবিননামা থাকে তাহলে নিতে পারবেন। নাহলে না। ওরা মা/ম/লা করবে, আরুকে আপনারা অ/প/হর/ণ করেছেন।” নয়না চাচির কথাতে মামি চুপ করে গেলেন। ভাষা নেই তার কাছে। পুনরায় বললেন, “একটা উপায় আছে। আপনারা আরুর ব্যাপারটা আদালতে জানান। পা/গ/লকে বন্দি করে রাখার অধিকার নেই কারো। আদালত থেকে রায় দিবে। তখন আরুকে পা/গ/লা গা/রদে নিয়ে যাবে।”
“আমার ভাগ্নে, আমার বাড়ির বউ, আমার নাতি। তাঁরা থাকবে পা/গ/লা গা/রদে। কীভাবে থাকবে তাঁরা?” মামি চিন্তিত হয়ে বললেন।
“তাহলে আর কী? ছেলে, ছেলের বউ, নাতিকে হারান। আরুকে অ্যা/ব/র্শন করে বিয়ে দিয়ে দিক। তারপরে ডাক্তার দেখাক। আমাদের কী?”
আমাকে দেখে মামি উঠে গেলেন। ধপাধপ টা ফেলে চলে গেলেন। দাদি জান আসলেন তখন। বললেন, “কার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলে নয়না?”
“কেউ না। আরুর সাথেই বলছিলাম।”
“আরুকে ভেতরে নিয়ে এসো। লোক জানাজানি হলে সমস্যা আছে।”
“আসছি।”
বলেই নয়না চাচি আমাকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
.
আবুল চাচার চিৎকারে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম আমি। তিনি ক্রমাগত চিৎকার করে বলছেন, “বাড়িতে পুলিশ এসেছে। কে কোথায় আছো নেমে এসো। ওরা নাকি আমাদের আরুকে নিয়ে যাবে।”
ভিড় জমেছে বাড়ির বাইরে। সবাই উপস্থিত হয়েছে। কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আমাকে নেওয়া হয়েছে সেখানে।
বাড়িতে কয়েকজন পুলিশ এলো, সাথে এলো উকিল। মামারা মামিরাও ছিলেন সাথে। ছিল কয়েকজন মেয়ে। ছিল চির চেনা প্রিয় জন। আমি কাউকে চিনলাম না। শুধু চিরচেনা। দাদি জান বললেন, “আমরা আমাদের বাড়ির মেয়েকে পা/গ/লা গা/রদে পাঠাতে পারি না। আপনারা চেনেন না, এটা মৃধা বাড়ি।”
উকিল নোটিশ দেখিয়ে বললেন, “এটা মৃধা বাড়ি হোক আর চৌকিদার বাড়ি। আইন সবার জন্য সমান। আদালত থেকে নোটিশ দিয়েছে আপনাদের মানতেই হবে। (পুলিশদের উদ্দেশ্য করে বলে) ওকে গাড়িতে তোলো।
দাদি জান বলেন, “যা টাকা চাইবেন, তাই দিবো। বিনিময়ে আমাদের আরুকে রেখে যান।”
নানা জান বললেন, “বেয়ান সাহেব, এতো সহজ নয়। টাকা দিয়ে সব পাওয়া যায় না। যদি সব পাওয়া যায়, আমি আপনাকে কিছু টাকা দিয়ে দিচ্ছি। আপনি একটা আরু নিয়ে আসেন। আর আমার নাতি আরুকে আমাকে ফিরিয়ে দিন।”
“ফিরিয়েই যদি নিবেন। তাহলে ফোন করে কেন আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, আমার মেয়েকে। আরু এখন ভারসাম্যহীন, ভালো হলে আমাদের কাছে নিয়ে আসবো।”
পুলিশ তাড়া দিল আমাকে নিতে।
একজন এসে আমার হাতটা ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “আরু, আমি তোর বড়ো মামা। আমাকে মাফ করে দিস। সব দোষ আমার। সেদিন যদি তোর বাবার হাতে তোকে তুলে না দিলাম। তাহলে এই দিনটা দেখতে হতো না। আমরা সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকবো। অপেক্ষায় থাকব, আমাদের বাড়ির ছোট্ট তুরের জন্য।”
দুইজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে এসে ছাড়িয়ে নিলেন আমায়। গাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বললাম, “আমি যাবো না। আমার অপূর্ব ভাই আমার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন। প্লীজ ছেড়ে দিন আমায়।”
“তোমার অপূর্ব ভাই আমাদের সাথে আছে। তোমার সাথে দেখা করতে চায়।”
“কোথায় তিনি?”
“তোমাকে যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
“তাড়াতাড়ি চলুন।”
পুলিশ মহিলাটির কথায় যেতে রাজি হলাম আমি। আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষায় আছি অপূর্ব ভাইয়ের। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। গাড়ি থেকে আমাকে নামানো হলো। ভেতরে নেওয়া হলো। সাদা পোশাক পরনে অনেকের, কারো আবার হাত পায়ে শিকড় টানা। গায়ে নোংরা পোশাক, চুলগুলো এলোমেলো, ময়লা গায়ের রঙ যেন কতদিন গোসল করে না। আমি আশেপাশে তাকিয়ে বললাম, “এরা তো আমার অপূর্ব ভাই নয়, তিনি কোথায়? তাকে ডাকুন।”
কেউ অপূর্ব ভাইকে ডাকল না। আমাকে শক্ত করে ধরে সামনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এর ভেতরে নীল এপ্রোন পরিহিতা এক নার্স ছুটে এলো। এসে বলে ডাক্তারকে, “স্যার, চারশো বত্রিশ নং কেবিনের নয় নাম্বার প্যাসেন্ট ছাদ থেকে লা/ফ দিয়ে আ/ত্মহ/ত্যা করেছে।”
ডাক্তার সাহেব তাচ্ছিল্য করে বলে, “সে-তো নতুন নয়, পুরাতন খবর। পা/গ/ল হলেও এরা পা/গ/ল নয়। এরা ভালোবাসার কাঙ্গাল। ভালোবাসার মানুষের জন্য তারা এখানে। এই পা/গ/লা গা/রদে থাকতে থাকতে কবে জানি আমি পা/গ/ল হয়ে যাই।”
মূল দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দরজার সামনে বসে আছি আমি। আমাকে এখন এখানেই থাকতে হবে। সবাই ব্যস্ত মৃ/ত পা/গ/লকে নিয়ে। আমার অপূর্ব ভাই তো পাগল নয়, তিনি এখানে কী করছে? কত লোকের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমার অপূর্ব ভাইকে দেখেছে, কি-না। কেউ বলতে পারছে না।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪১
‘মাটিতে, হাতে, পোশাকে’ সব জায়গাতে লেখা অপূর্ব আহসান। দেয়ালটাও আমার অ/ত্যা/চা/রে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মুক্তি চাই তার। কিন্তু আমি তাকে মুক্তি দেবো না। ইটের কুঁচো দিয়ে বিরতিহীন ভাবে লিখে চলেছি। আমার পাশেই একটা মেয়ে বসে আছে। লেখা থামিয়ে মেয়ের কাছে গিয়ে বললাম, “শোনো, তুমি কি আমার ছোটো বাচ্চাটাকে দেখেছ? আমার বাচ্চা। ডাক্তার আমার পেট কে/টে ওকে বের করেছে। তারপরে নিয়ে গেছে। আমি এক নজর তাকে দেখেছি। আর দেখিনি, কোথায় আছে আমার সেই রাজকুমারী? তুমি জানো?”
মেয়েটা আমাকে ধাক্কা দিল। আমি পরে গেলাম মাটিতে, উঠলাম না। তোমরা জানো, আমার একটা মেয়ে আছে। তার নাম আমি জানি না।
নার্স মেয়েটা এলো আমার কাছে। ধীর গলায় বলে, “আপনার স্বামী আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। আপনাকে ডাকছে। চলুন।”
হঠাৎ করেই অভিমান জমে উঠল। মৃদু স্বরে বললাম, “যাবো না, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি তাকে যেতে বলুন।”
“তার নাম অপূর্ব আহসান।”
চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়ল। অপূর্ব ভাইয়ের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয়। তিনি আসেন আমাকে দেখতে। সাথে একটা মেয়েও আছে। আমাকে মা মা বলে ডাকে। আমার খুব কষ্ট হয়, ইচ্ছে করে বুকে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু আমি পা/গ/ল বলে কেউ সেই মেয়েটিকে আমার কোলে দেয়না। ভয় পায় দিতে। মাটিতে শুয়ে পড়লাম। হাত পা মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি কোথাও যাবো না।”
“তিনি আপনাকে একবারের জন্য নিয়ে যাবেন। কাগজপত্র তৈরি করা হয়ে গেছে। (একটু বিরতি দিয়ে আবার বলে) আগে অপূর্ব নামটি শুনলে তাকে দেখার জন্য আপনি পা/গল হয়ে যেতেন। এখন তেমন করেন না কেন?” বলেই মেয়েটি আমাকে ধরে ধরে উঠালো। হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগল অফিস কক্ষের দিকে। যেখান থেকে পা/গ/লদের শুরু ও শেষ হয়। খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, “আগে অপূর্ব ভাই আমার ছিল। তাই অপূর্ব অপূর্ব করতাম। এখন তিনি আছে। কিন্তু আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য তিনি নেই।”
নার্স আমাকে চেয়ারে বসিয়ে সভাপতি সহ বেশ কয়েকজন ডাক্তারকে বলে, “আরু এখন আর অপূর্ব শুনে আসতে চায় না। জোর করে নিয়ে এসেছি।”
আমার পাশেই আমার স্বামী অপূর্ব বসে আছেন। তার কোলে একটা ফুটফুটে মেয়ে। সৌজন্য হেসে বলে, “হয়তো ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেছে।”
“না, এই ভালোবাসা কখনো ফিকে হয়ে যায় না। আপনি প্রতিবার এসে চলে যান। আরু তখন প্রচণ্ড কেঁদেছে। আপনার উপর অভিমান করে হয়তো যেতে চাইছে না। একবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখুন না, সব জায়গায় আপনার নাম লিখে রেখেছে। পা/গ/ল হলেও আপনার উপর অভিমান করে আছে।” ডাক্তারের কথাতে অপূর্ব ভাই আমার দিকে তাকালেন। আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন। চুলের ভাঁজে স্পর্শ করলেন অধর। বললেন, “আমিও আরুকে আমার কাছে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। বাড়ির কেউ রাজি ছিল না। প্রথমত, তারা আরুর পরিবারকে ভয় পাচ্ছিল দ্বিতীয়ত, আরুকে সামলাতে গেলে আমার মেয়ে পাখিকে কেউ সামলাতে পারতো না। আরু তার ক্ষ/তি করে ফেলতে পারে। তাই। পাখি একটু বড় হয়েছে। এখন সে বুঝবে। এবার আরুকে ভালো করার দায়িত্বটা আমি নিলাম।”
আমার হাত ধরে উঠলেন অপূর্ব ভাই। ছোটো পাখি বাবার গলা জড়িয়ে রেখেছে। অপূর্ব পাখিকে নামিয়ে দিয়ে বলেন, “পাখি সোনা, তুমি একটু হেঁটে চলো। তোমার মা যেতে চাইছে না, তাকে একটু কোলে নেই।”
“আচ্ছা বাবাই।” পাখি কোল থেকে নেমে হাঁটতে লাগল। অপূর্ব আমাকে কোলে নিল। এগিয়ে গেল সামনে। কী সুন্দর গাড়ি? এমন গাড়িতে আমি আগে কখনো চড়ি নি। অপূর্ব ফন্ট সিটে আমাকে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। পাখিকে কোলে নিয়ে বসলেন ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি চলতে শুরু করল। দীর্ঘ পর পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেল ‘সাত ভাই চম্পা’ নিবাসে। ভেতরে তাকাতেই হতভম্ব হলাম। আমাদের সেই টিনের ঘর নেই। বড়ো বাড়ি। দাদা বাড়ির মতো রাজকীয়। গাড়ি দেখে হামলে পড়ল সবাই। বড়ো মামি গাড়ির দরজা খুলে বের করলেন আমায়। বললেন, “আমার সেই ছোটো আরু।”
আড়চোখে ঝোপঝাড়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম মায়ের সেই কবরটি বাঁধনো হয়েছে বড়ো করে। তুরের কোলে ছোট্ট একটি মেয়ে, তিস্তা আপুর কোলেও একটি ছেলে। শেফালী পেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তঃসত্ত্বা সে। তিয়াস ভাইয়ের পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। নিঃসন্দেহে তার বউ। মামাদের চুল পাকতে শুরু করেছে। আমাকে ছাড়াই সবকিছু বদলে গেছে। ভালো আছে সবাই। কারো অনুপস্থিতিতে কিছু আঁটকে থাকে না।
একঝাঁক ময়না পাখি এসে থামলো সামনে। গুনে শেষ করতে পারলাম না তাদের অগনিত সংখ্যা। তার ভেতর থেকে একটি পাখি উড়ে এসে আমার কাঁধে বসল। আমার গালে দুটো ঠোকর দিয়ে বলে, “আরুপাখি আরুপাখি আরুপাখি।”
আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল। ময়না পাখি তার পুরু ঠোঁট দিয়ে চুষে নিল সেই জল। অতঃপর সব পাখিরা একসাথে ডেকে উঠল, “আরুপাখি আরুপাখি আরুপাখি।”
পাখি অপূর্ব হাত টেনে বলে, “বাবাই! তুমি তো বলেছিলে, আমার নাম আরুপাখি। তাহলে ময়নারা আমাকে আরুপাখি না বলে মাকে কেন আরুপাখি ডাকছে? বলো? বলো?”
“কারণ তুমি ছোটো আরুপাখি আর সে বড়ো আরুপাখি। বড়ো আরুপাখিকে দেখে সবাই খুশি হয়েছে।” অপূর্বর কথাতে পাখি চুপ করে আছে। মামি এগিয়ে এসে আমাকে বলে, “এগুলো সব তোর ময়না পাখির বাচ্চা। গত পাঁচ বছরে যত ডিম দিয়েছে কিছু ‘তা’ দিয়েছি। বাকিটা তোর মেয়েকে খাইয়েছি।”
আমি জবাব দিলাম না। আমি বড্ড স্বা/র্থপ/র। শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে পাখিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। চাইলেই তাকে কাছে রাখতে পারতাম।
সাইকেলের টুং টাং শব্দ শুনতে পারলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একজন ডাক টিকেট দাঁড়িয়ে আছে। কত শত চিঠি তার কাছে। একটি চিঠি বের করে ঠিকানা দেখল। তারপরে উচ্চ স্বরে বলে, “আদালত থেকে আপনাদের চিঠি এসেছে। গ্ৰহণ করুন। আমাকে যেতে হবে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। এই আধুনিক যুগেও চিঠি এসেছে। বড়ো মামা গ্ৰহণ করলেন চিঠি। সই করলেন কাগজে। চলে গেল ডাক টিকেট। বড়ো মামা চিঠিটা খুলে পড়লাম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “পাঁচ বছর আমাদের পরিবারটাকে অশান্তি দিয়েও শান্তি হয়নি মৃধা পরিবারের। আরুর ফেরার খবর শুনে আদালতে আগের মা/ম/লা রি ওপেন করেছে।”
অপূর্ব বললেন, “আমি কালকে আরু আর পাখিকে নিয়ে আদালতে যাবো। আরু আমার বিবাহিত স্ত্রী। সব প্রমাণ আছে। দেখি আরুকে কীভাবে নিয়ে যায়।”
“আমিও যাবো। আদালতে যাবো। আমার জীবনের পাঁচটি বছরের হিসাব চাইবো। চাইবো আমার সুখ, শান্তি।” মনে মনে বললাম। এক দমকা হাওয়া এসে লাগল বুকে। মায়ের মতো গন্ধ ভেসে এলো কাছে। মা তুমি বড্ড দেরি করেছ আসতে। তোমার আরু আরও আগে এসেছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম মায়ের কবরের সামনে। পেছন থেকে মামী বলে উঠলেন, “অপু আরুকে এত স্বাভাবিক, এত শান্ত কেন লাগছে? কোনো পা/গ/লামি কেন করছে না? ও কী ঠিক হয়ে গেছে?”
“জানি না, হতেও পারে। আবার নাও হতে পারে। আদালত থেকে বাড়িতে ফেরার সময় আরুকে একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। কথা বলে রেখেছি।”
আমি এগিয়ে গেলাম। বসলাম মাটিতে। কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]