#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৯
স্বাক্ষরের মতিগতি তন্দ্রা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বাক্ষর তাকে নিয়ে আলাদা কিছু অনুভব করে। খুব পসেসিভ তন্দ্রার বিষয়ে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় তার সব ধারণাই ভুল। স্বাক্ষরের মনে আসলে কি চলছে তা-ই বুঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তন্দ্রা। অনুভূতির এই লুকোচুরি খেলা তন্দ্রার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। ইদানীং সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে তার শুধু স্বাক্ষরের কথাই ভাবতে ইচ্ছে হয়। সে কাছাকাছি থাকলে তন্দ্রার মনের মাঝে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। স্বাক্ষরের দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট উপহার গুলো সে খুব যত্নে নিজের কাছে আগলে রেখেছে। তার দেওয়া পায়েলটা তন্দ্রা সবসময়ই পায়ে পড়ে থাকে৷ এর থেকে হালকা ঝুনঝুন শব্দ শোনা যায়।
তন্দ্রা যখন রান্না ঘরের সামনে দিয়ে ঘরের দিকে যেতে থাকে তখন তার মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পায়। তাহেরা মাহমুদ ঘরের দরজা খুলে দেখেন তন্দ্রা রান্নাঘর থেকে যাচ্ছে তাই তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন….
–কিরে ঘুমোস নি? রান্না ঘরে কি করছিলি?
–পানি খেতে এসেছিলাম মা।
–ওহ। খেয়েছিস?
–হুম।
–তাহলে যা। শুয়ে পড়।
–আচ্ছা।
তন্দ্রা দ্রুত পায়ে তার ঘরে চলে আসে। ভাগ্যিস তাহেরা মাহমুদ তাকে রান্না ঘরের সামনে দেখেছে। সিঁড়ির সামনে দেখলে তো নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত তাকে। অন্যদিকে স্বাক্ষর এখনো আগের ন্যায় ছাদের বসে আছে। এক দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে সে। বার বার তন্দ্রার বলা “তোমাকে প্রেমিক প্রেমিক লাগছে” এই কথাটাই মনে পড়ছে। স্বাক্ষর খোলা আকাশের নিচে ছাদের ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে…
–এই মুহুর্তে আমার ঠিক ঈদ ঈদ আনন্দ হচ্ছে। ওই চোখে কিছু একটা ছিল। হয়তো কিছুটা হলেও আমার তন্দ্রাবতী’র মন পড়তে পেরেছি। তোমার কাছে আমার ভালোবাসা একটু একটু করে প্রকাশ পাবে তন্দ্রাবতী। অনুভূতি গুলো যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে তখনই প্রণয়ের পরিনতি ঘটবে। তার আগে একটু আধটু লুকোচুরি খেলা চলতেই পারে।
তন্দ্রা ঘুম থেকে উঠেছে বেশ অনেক সময় হলো। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করার পরপরই তার ঘুম ভেঙে যায়। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে ওঠে সে। তুলি ঘুমোচ্ছে কোলবালিশ আঁকড়ে। তন্দ্রা সন্তপর্ণে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। এখনো হয়তো কেউ উঠেনি। নামাজ আদায় করেই সে ছাদে চলে আসে। এতোক্ষণ খুব করে ইচ্ছে করছিল ছাদে আসার। ছাদের দক্ষিণ দিকের একটা ছোটখাটো বাগান আছে। তন্দ্রা বাগান করা খুবই পছন্দ করে। অনেক রকমের ফুল গাছ লাগানো। এখানে তন্দ্রার সব থেকে পছন্দের ফুলগাছটা হচ্ছে কাঠগোলাপ এবং বেলী। গত বছর নার্সারি থেকে কিনে এনেছিল গাছ দুটো। স্বাক্ষর তাকে কিনে দিয়েছিল। সেই জন্যই আরও বেশি প্রিয় এই গাছ দুটো। গাছ দুটোতেই আজ অনেক ফুল ফুটেছে। এক বছরেই যেন গাছ দুটো খুব দ্রুত শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে বড় হয়ে গেছে। তন্দ্রা কাঠগোলাপ গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ে নিজের কানে গুজে নেয়। হাতে করে কয়েকটা বেলীফুলও নিয়ে নেয়। দু’হাতের মাঝে ফুলগুলোর ঘ্রাণ নিচ্ছে। তীব্র সুবাস ছড়াচ্ছে ফুল থেকে।
বেশ অনেকটা সময় তন্দ্রা ছাদে কাটায়। সকাল হয়ে এসেছে প্রায় অনেকক্ষণ। এতোটা সময় তন্দ্রা ছাদে থাকা দোলনাটায় বসে কাটিয়েছে৷ আজকের সকালটা খুব ভালো লাগছে তার। সকালটাকে ভীষণ আদুরে আদুরে লাগছে তার কাছে। দোলনায় রেখে দেওয়া বেলীফুল গুলোকে নিয়ে নিজের দুহাতের মাঝে নিয়ে নেয়। প্রাণ ভরে এর সুভাস নিয়ে, নিচে যাওয়ার জন্য ছুট লাগায়। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অসাবধানতা-বসত পা পিছলে পড়ে যায় তন্দ্রা। পায়ে হয়তো খুব বেশি ব্যথা লেগেছে তাই চেচিয়ে “মা” বলে ওঠে। তদ্রার চিৎকার শুনে রান্না ঘর থেকে সাহেরা মাহমুদ এবং তাহেরা মাহমুদ ছুটে আসে। উনারা এসে দেখেন তন্দ্রা পায়ে হাত দিয়ে বসে আছে। চোখে পানি টইটম্বুর। যেন যেকোনো মুহুর্তে স্রোতধারা বয়ে যাবে। ঘুমের মাঝেই স্বাক্ষর চমকে উঠলো। তার তন্দ্রাবতী’র কিছু হয়নি তো! নিমিষেই যেন চোখ থেকে ঘুম দূর হয়ে যায়। আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। ঘুম ঘুম চোখে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়। তন্দ্রার চিৎকার শুনে এতোক্ষণে সবাই সিঁড়ির কাছে চলে এসেছে। স্বাক্ষর ব্যস্ত ভঙ্গিতে তন্দ্রা দিকে এগিয়ে যায়।
–তন্দ্রাবতী আর ইউ ওকে?
–পায়ে লেগেছে!
তন্দ্রা কান্না করতে করতে কথাটা বলে। পায়ে চো’ট বেশ ভালোই পেয়েছে। উঠে দাঁড়াতে পারছে না। সাঁত পাঁচ না ভেবেই স্বাক্ষর তন্দ্রাকে কোলে তুলে নেয়। তারপর তাকে ঘরে নিয়ে যায়। আধশোয়া হয়ে বসায়। ওদের পেছন পেছন এ ঘরে সবাই চলে আসে আসে। তুলি তখন সবে মাত্র স্কুল ড্রেস পড়ে তন্দ্রার জন্য অপেক্ষা করছিল। সবসময় তো তন্দ্রা’ই তাকে স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি করে দেয়৷ স্বাক্ষর ঠিক বুঝতে পারছে না তন্দ্রা পা মচকে গেছে নাকি কোনো ফ্র্যাকচার হয়েছে। একবার এক্সরে করিয়ে আনা প্রয়োজন। ইউসুফ মাহমুদ মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন….
–মা কোথায় ব্যথা পেয়েছ?
–পায়ের গোড়ালির হাড়ে ব্যথা করছে খুব।
তন্দ্রার কষ্ট স্বাক্ষরের কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে…
–একটা এক্সরে করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তোমরা টেনশন করো না।
স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার জন্য বের হয়। তন্দ্রাকে পাশের সিটে বসিয়ে স্বাক্ষর ড্রাইভ করতে থাকে। স্বাক্ষরকে দেখে কিছুটা আপসেট মনে হচ্ছে। এদিকে তন্দ্রার এভাবে চুপ করে বসে থাকতেও বোর ফিল করছে। পায়ে এখন আগের মতো সেই তীব্র ব্যথাটা নেই। তবে একটু একটু ব্যথা করছে।
–ভালোবাসো আমাকে?
নিজের উদ্ভট প্রশ্নে তন্দ্রা নিজেই বিরক্ত। তার প্রশ্নে কিঞ্চিৎ চমকে গেলেও তা প্রকাশ্য করে না স্বাক্ষর। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই নিজের মতো করে ড্রাইভ করছে। তন্দ্রা এখনো উত্তরের আশায় তার দিকে তাকিয়ে। প্রশ্ন যখন করেই ফেলেছে তখন জেনে নেওয়াই ভালো।
–তুমি আমার কথা গুলোকে ইগনোর করছো কেন?
–কে বলল আমি ইগনোর করছি!
–তা নয়তো কি? আমার কোনো প্রশ্নেরই তো উত্তর দাও না তুমি।
–আমি কি না বলেছি একবারও।
–হ্যাঁ’ও তো বলছো না!
–সব কথা মুখে বলতে হয় না। না বলা কথা যেদিন বুঝতে পারবি, সেদিন প্রণয়ে পরিণয় হয়েই যাবে।
এরপর আর দুজনের মাঝে একটা কথাও হয় না। স্বাক্ষরের বলা শেষ কথাটা তন্দ্রার কানে বার বার বাজছে। সে এখন নিশ্চিত স্বাক্ষর তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসলে মুখে কেন বলছে না, তা নিয়ে তন্দ্রার কিছুটা রাগ হয়। সে চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। হসপিটালের সামনে এসে গাড়ি থামে৷ স্বাক্ষর এসে তাকে ধরে নামাতে চাইলে তন্দ্রা এতে কপট রাগ দেখায়। স্বাক্ষর বুঝতে পারে তন্দ্রার অভিমান হয়েছে৷
–কিছু অভিমান তোলা থাকুক। আমি সুযোগ বুঝে ভাঙিয়ে দিব।
হসপিটালে এসে স্বাক্ষর নিজ দায়িত্বে তন্দ্রার পায়ের এক্সরে করায়৷ পায়ের গোড়ালির হাড়ে কিছুটা ফ্র্যাকচার হয়েছে। স্বাক্ষরের আজ হসপিটালে থাকা হয় না। সে তন্দ্রাকে নিয়ে বাসার চলে যায়। বাসায় আসতেই সাহেরা মাহমুদ এবং তাহেরা মাহমুদ তন্দ্রাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
–পায়ের গোড়ালিতে একটা ফ্র্যাকচার হয়েছে। কয়েকদিন বেড রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
স্বাক্ষর তার ঘরে চলে আসে। গায়ের শার্টটা ঘেমে শরীরের সাথে লেগে আছে। এই মুহুর্তে তার একটা লম্বা শাওয়ার নেওয়া প্রয়োজন। হাতে করে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। তন্দ্রাকে তাহেরা মাহমুদ ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। তন্দ্রার ঘরে শুভ, সাইফ, হেনা, শিরিন আর হাসনা একজোট হয়ে বসে আছে। তখনই তুলি ঘরে আসে। কাধ থেকে স্কুল ব্যাগটা স্টাডি টেবিলের উপর রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে…
–আপু তোমার পায়ে এখনো ব্যথা হচ্ছে?
–না রে পাখি।
নিজের প্রতি তুলির চিন্তা দেখে তন্দ্রা কিঞ্চিৎ হাসে। বালিশের পাশে দুটো চকলেট লুকিয়ে রেখেছে সে তুলির জন্য।
–স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করে আমার কাছে আয়।
তন্দ্রার কথা মতো তুলি নিজের জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে এসে তন্দ্রার কাছে বসে।
–এগুলো তোর জন্য।
তুলি চকলেট দুটো নিয়ে নেয়৷ চকলেট তার খুব পছন্দের। খুশি হয়ে তন্দ্রার গালে চুমু দেয় সে। তুলির এমন কান্ডে তন্দ্রা হেসে দেয়। শুভ তুলির গাল টেনে বলে…
–আমাদেরকে চকলেটের ভাগ দিবি না তুলি রানী?
–তোমরা তো বড় হয়ে গেছো ভাইয়া।
–বড় হলে কি চকলেট খাওয়া যায় না?
–না তো।
তুলি ড্রইং রুমে চলে যায়। এই সময় তার ফেবারিট কার্টুন হয়। সেটাই সে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। শুভ, সাইফ, হেনা, শিরিন আর হাসনা এখনো তন্দ্রার কাছেই বসে আসে। ওরা একেক ধরনের কথা বলছে আর হাসছে। দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। সাহেরা মাহমুদ ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়ছেন। তাহেরা মাহমুদ তন্দ্রার জন্য প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসেন।
–তোরা গিয়ে খেয়ে নে। আপা তোদের জন্য টেবিলে খাবার বেড়ে রেখেছে। যাওয়ার সময় স্বাক্ষরকে বলে যাস।
ওরা এ ঘর থেকে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই স্বাক্ষর আসে। একটা টেবলেট এগিয়ে দেয় আর বলে “এটা খাবার খাওয়ার পর খেতে হবে”। স্বাক্ষর বরাবরই সবার প্রতি খুবই যত্নবান। তার এই দিকটা তন্দ্রাকে বারংবার মুগ্ধ করে। তন্দ্রা চেয়ে আছে স্বাক্ষরের দিকে কিন্তু স্বাক্ষর একবারও তার দিকে তাকায় না। টেবলেটটা তাহেরা মাহমুদকে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। তন্দ্রা মনে মনে একটা কথাই আওড়ায়।
–তার আবার কি হলো?
চলবে?…….