#ভালোবাসি_প্রেয়সী [১১]
#জান্নাতুল_বিথী
হঠাৎ করে ইমাদ ভাইয়ের এমন প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে দাড়িয়ে পড়ি! ক্লাসের অনেকেই আমাদের দিকে তখনো তাকিয়ে ছিলো। যেনো এখানে ফ্রি তে ড্রামা হচ্ছে। ইমাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! আমাকে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে দেখে সে এগিয়ে এসে আমার হাত মুঠো করে ধরে বললো,
‘চলো আমার সাথে!’
তার গম্ভীর স্বর শুনে কিছু বলার সাহস হয় না আমার! চুপচাপ তার সাথে পা মিলিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসি! মাঠের এক কোণায় এসে নিচে বসে পড়ে উনি, নিজে বসে আমাকে টেনে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো,
‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!’
‘আমি তখন খুব ছোট ছিলাম, বাবা কি করতো জানিনা!’
‘আচ্ছা তোমার এটুকু তো নিশ্চয় মনে থাকবে কেমন পরিবারের মেয়ে তুমি? আই মিন তোমার আত্মীয় স্বজন, আর্থিক অবস্থা কেমন ছিলো সেসব মনে আছে?’
‘আমাদের কোনো আত্মীয় স্বজন ছিলোনা। আমি যখন মমের কাছে নানু বাড়ি দাদু বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার আবদার করতাম তখন মম বলতো মনে করো এটাই তোমার নানু বাড়ি আর এটাই তোমার দাদু বাড়ি! আমরা দুজন কি তোমাকে কম ভালোবাসি যে তোমার অন্য কারো কথা মনে পড়বে?’
একটু থেমে ফোস করে একটা নিশ্বাস ফেলে আবারো বললাম,
‘আর আমার যতো দূর মনে পড়ে আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই স্বচ্ছল ছিলো! দোতলা একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি ছিলো যার নাম ছিলো “স্বপ্ননিবাস”! বাবার পার্সোনাল গাড়ি ছিলো, প্রতি ফ্রাইডেতেই আমরা ঘুরতে যেতাম। স্বপ্নের মতোই ছিলো দিন গুলো!’
বলতে বলতে মলিন হাসি আমি। সত্যিই স্বপ্নের মতো দিন ছিলো। বাবা মায়ের চোখের মনি ছিলাম। বাবা যখন অফিস থেকে ফিরতো তখন সবার আগে জিজ্ঞেস করতো “আমার পিচ্চু সোনা কই?” সে যদি ঘুমে থাকতো যতো রাতই হোক তাকে জাগিয়ে তুলতো তার বাবা। আমাদের বাবা মেয়ের সম্পর্ক দেখে মম বলতো কারো ন’জ’র না লেগে যায়। এটা নিয়েও বাবা আর আমি অনেক মজা নিতাম!
অন্যদিকে “স্বপ্ননিবাস” নাম শুনে মনে মনে চমকে উঠে ইমাদ! পূর্ন দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আজ থেকে বারো বছর পূর্বের কোনো ঘটনা তোমার মনে পড়ে? তোমাদের বাড়িতে তোমার বাবার কোনো বন্ধু বা কেউই আসতো না বুঝি?’
‘না, ব্যাপারটাতে অবাক হওয়ার কথা থাকলেও কিছু করার নাই। আমি খুব ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে কখনো বাহিরের কেউ আসতো না। বাড়িতে কয়েকজন সার্ভেন্ট ছিলো তাও তারা সব সময় আমাদের বাড়িতেই থাকতো। বাহিরের মানুষ বলতে জীবনে কাউকেই আসতে দেখিনি আমি। বাহির থেকে যদি কেউ আসতো তাহলে সেটা হতো বাবা!’
উপমার কথায় আবারো অবাক হয় ইমাদ, সব কথাতে এতোটুকু বুঝতে পারছে রাদিফ চৌধুরি স্ত্রী এবং সন্তান কে খুবই ভালোবাসতেন। একারনে নিজে কি কাজ করতেন এবং সেসব থেকে সব সময় এই দুজন কে দূরে সরিয়ে রাখতো। তার বাবা কি কোনো অ’প’রা’ধ জগতের সাথে জড়িত নাকি এমন কোনো চাকরি করে যেটা তার এবং তার পরিবারের জন্য হার্মফুল। তাছাড়া ইমরোজ সাহেব যেমন নিজের বোনকে পালিয়ে বিয়ে করার জন্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করছে একই কারনে হয়তো রাদিফ সাহেবের পরিবারও মেনে নেয়নি। সবটাই তার ভাবনা। অন্য কিছুও হতে পারে। সব কিছুর সমাধান হতো যদি জানা যেতো রাদিফ সাহেব আসলে কি জব করতেন বা কি কাজের সাথে সে জড়িত!
‘আচ্ছা শেষ কখন তোমার তাদের সাথে দেখা হইছে?’
‘অনেক বছর আগে, বলছিলেন না আপনি বারো বছর পূর্বের ঘটনা? তাদের সাথেও আমার তখনই শেষ দেখা হইছে!’
‘তারপর কোথায় গেছে তারা?’
‘আমি জানিনা সেসব, সেদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে বাবা আমাকে স্কুলে পৌছে দিয়ে প্রতিদিনের মতো বলেছিলো “মা স্কুল ছুটি হলে কোথাও যাবেনা! পাপা এসে তোমাকে নিয়ে যাবো!” প্রতিবারের ন্যায় আমি মাথা নাড়িয়ে স্কুলের ভেতরে চলে গেছিলাম! স্কুল ছুটির পর গেটের কাছে এসে দেখি বাবা এখনো আসেনি। মাঝে মাঝেই তার আসতে দেরী হতো কারনে আমি দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। কিছু সময় পর কয়েটা ছেলে এসে আমাকে বললো বাবা নাকি তাদের পাঠিয়েছে আমাকে বাসায় পৌছে দেওয়ার জন্য! বাবার কথা মনে করে আমি যেতে রাজি না হলে তারা আমাকে জোর করে নিয়ে যায়! মাঝ পথে নিয়ে আমাকে ওরা অনেক মারধোর করে। জানেন আমি অনেক ব্যাথা পাচ্ছিলাম, বারবার চিৎকার করে বাবাকে ডেকেছি। কিন্তু বাবা আসেনি, অনেক মারধোরের পরে এক সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি! তারপর যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমি আয়েশার বাবার কাছে ছিলাম আঙ্কেল বললো উনি নাকি বাবার কোনো এক বন্ধু। আর বাবাই নাকি আমাকে তার কাছে দিয়ে গেছে। কাজ শেষ হলে নাকি আমাকে ফিরিয়ে নিবে। আপনি জানেন আমি এখনো প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে বাবার জন্য বারান্দায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করি। কখন সে আসবে আর এসে মমকে জিজ্ঞেস করবে “আমার পিচ্চু সোনা কই?”
কথা শেষ করেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠি আমি। বাবা সব সময় সকালে বের হলে সন্ধ্যার পর নিয়ম করে আসতো। কখনো দেরী হলে মাঝ রাতে এসে আমার ঘুম ভেঙ্গে দিতো। এতে মম অনেক চোটপাট দেখালেও বাবা সেসবে পাত্তা দিতো না! মমের বকা শুনেও সে দিব্যি হেসে খেলে দুষ্টুমি করতো। হুট করে সেই মানুষটা কোথায় হারিয়ে গেলো? ভাবলেই বুক ভারী হয়ে উঠে আমার।
ইমাদ কিছু সময় চুপ থেকে উপমাকে সামলে নিতে সময় দিলো কিছুটা। তার বাবা মা আর নেই কথাটা কি করে বলবে সে মেয়েটাকে? বাবা মায়ের ছায়া যতক্ষণ মাথার উপরে থাকে ততক্ষণ তাদের মর্ম বুঝা যায় না। যেটা এখন ইমাদ হারে হারে টের পাচ্ছে। এখন তো সে তার পিচ্চু কে ফিরে পেয়েছে তাহলে তাদের উপর অভিমান জমা রেখে কি লাভ হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো,
‘তোমার বাবার চেহারা মনে আছে তোমার?’
‘আছে! বাবা নামক মানুষটাকে কখনো ভুলবো না আমি!’
‘উনার স্কেচ আঁকতে পারবে তুমি?’
‘হঠাৎ আমার বাবাকে নিয়ে গবেষনা কেনো করছেন বুঝতে পারছি না!’
‘হুট করে একটা মানুষ বারো বছর আগে হারিয়ে গেলো, আর খুজে পাওয়া যাচ্ছে না! তো এমন বিষয়ে ইন্টারেস্ট থাকবেনা?’
‘আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। কিভাবে জানলেন?’
‘তুমি যতোটুকু ভাবছো আমি তোমার ব্যাপারে জানি, তার চাইতেও বেশি জানি তোমার সম্পর্কে! বুঝলে? মাথায় এতো চাপ নিয়ো না অজ্ঞান হয়ে যাবে।’
‘আমাকে নিয়ে আপনার এতো ভাবতে হবে না।’
‘তোমাকে নিয়ে আমি না ভাবলে কে ভাববে পিচ্চু?’
‘আচ্ছা সেসব বাদ দাও, এখন জলদি স্কেচ এঁকে দাও আমাকে। লাগবে আমার!’
.
‘ইতির বাবা সম্পর্কে খোজ লাগা তো!’
‘কেনো? উনি আবার কি করছে?’
‘কিছু করেনি, তবে করতে কতক্ষণ? তার সম্পর্কে কিছু জানতে ইচ্ছে করছে!’
‘রায়ান আঙ্কেল কিন্তু অনেক ডেঞ্জারাস মানুষ। ভাই তুই…’
‘আমি যেটা বলছি সেটা কর! উনার বাড়িটা সম্পর্কে খোজ লাগা, কে বানালো কি ভাবে বানালো সবটাই। আর বাড়ির নামটা কেনো স্বপ্ননিবাস রাখছে সেটাও জিজ্ঞেস করিস!’
‘তার বাড়ির নামের পেছনে রহস্য আছে!’
‘জানিনা, তবে গন্ধ পাচ্ছি। এক শহরে এক নামে অনেক বাড়িই থাকতে পারে স্বাভাবিক!’
চলবে,,,,,,