#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু
১৫)
” জানো শাওন আমার জীবনে না কখনো প্রেম হয়নি। আমি কারো জন্য চোখের নীচে গাঢ় কাজল পরিনি। কারো জন্য ভাতের থালা সাজিয়ে বসে থাকিনি। কারো জন্য খোঁপায় লাল গোলাপ গুঁজে দেইনি।”
শাওনের কাঁধে মাথা রেখে সীমা কথাগুলো বলল।
শাওন আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,
” তাহলে এখন আমি কী করতে পারি।”
” তোমাকে কিছু করতে হবে না। শুধু চুপচাপ আমার পাশে বসে থাক। এই যেমন ধরো আমি তোমার কাঁধে মাথা রেখেছি, আমি আমার তেত্রিশ বছরের জীবনে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য কাঁধ পাইনি যেখানে মাথা রাখা যায়।”
শাওন সীমার বাঁধন থেকে নিজেকে আগলা করে বলল,
” এসব অনেক শুনেছি সীমা। আমার অনেকগুলো নির্ঘুম রাত এসব গল্প শুনেই কেটে গেছে। দয়া করে এসব বলে আমাকে ইমোশনাল করে দিও না। সত্যি বলতে আমি আজ তোমার থেকে বিদায় নিতে এসেছি। এমন অর্ন্তদহন নিয়ে বাঁচা যায় না।”
“অর্ন্তদহন হয় তোমার! আমারও হয়। রীমা তোমার স্ত্রী হলে আমারও বোন হয়। কই আমার তো বোনের জন্য এত মায়া লাগছে না, স্ত্রীর জন্য এত মায়া কোথায় পাও?”
” তুমি না বললে তোমার অর্ন্তদহন হয়।!”
” হয়! নিজের জন্য হয়। কেন রীমার আগে তোমাকে পেলাম না।”
” পাগলামী করছ সীমা তুমি! তুমি কি এখনো বুঝতে পারনি, আমাদের ব্যাপারটা রীমা অাঁচ করতে পেরেছে।”
” ভয় পাও বউকে?”
” না!”
” তাহলে?”
” ভালোবাসি।”
সীমা চট করে শাওনের শার্টের কলার ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলল,
” তাহলে আমি কে?”
“সীমা শার্টের কলার ছাড়ো! আশেপাশের লোকজন দেখছে। এটা রমনা পার্ক। এখানে অসংখ্য লোকজন রোজ আসে। আমাদের এখন সে বয়স নেই, যে অপ্রীতিকর কিছু দেখলে মানুষ হেসে উড়িয়ে দেবে। অহেতুক মানুষের কৌতুহল বাড়াবে না।”
” আচ্ছা ছাড়ছি, বলো আমি কে?”
” তুমি শান্ত হয়ে বসো সীমা।”
” আমি শান্ত আছি। তোমাকে বলতে হবে তোমার জীবনে আমার অবস্থান কোথায়?”
” কোথাও নেই। তুমি ছিলে প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন তোমারও মিটেছে, আমারও। বাড়তি কিছু তুমি কেন আশা করছ?”
সীমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” শাওন তুমি এটা বলতে পারলে! রাত জেগে আমাদের গল্প করা, আমার কাঁধে তোমার মাথা রাখা। আমার মাঝে হারিয়ে যাওয়া। একই শাওয়ারের নিচে গোসল করা। সবই কি মিথ্যা ছিল।”
” কোনোটাই কি আমি অস্বীকার করছি।”
” করছ। দুইদিন স্ত্রীর আঁচলের নিচে থেকে তুমি সব অস্বীকার করছ। যখন রাতের পর রাত তুমি নিসঙ্গতায় ছটপট করতে, তখন কোথায় ছিল তোমার বউ? যখন নারী সঙ্গ পাওয়ার জন্য তুমি মরিয়া হতে, তখন কোথায় ছিল তোমার বউ? এই আমি তখন তোমার সব প্রয়োজন মিটিয়েছি।”
” তুমি এত চিৎকার দিচ্ছ কেন?”
” দেব, আরও জোরে চিৎকার দেব। তোমার বউ তোমার মায়ের সাথে পলিসি করে আমাকে বাসা থেকে বের করেছে। আমি তোমার মায়ের কাছে যাব, জানতে চাইব আমার অপরাধ কি?”
” সীমা গলা নামিয়ে কথা বলো। তোমার প্রতি আমার আন্তরিকতা ছিল, মায়া ছিল, আগ্রহ ছিল। বলতে পার ভালোবাসাও ছিল। আজ কেন জানি তোমাকে হিংস্র লাগছে। তুমি যা খুশি কর। আমি বাসায় গেলাম। বাসায় আমার স্ত্রী, সন্তান আছে।”
সীমা দৌড়ে গিয়ে শাওনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে, কাঁদতে বলল,
” শাওন আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। যেটাকে তুমি প্রয়োজন বলে নরমাল করতে চাচ্ছ, সেটা আমার ভালোবাসা ছিল। আমার ভালোবাসাকে তুমি উপেক্ষা করতে পার না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না শাওন।”
” আচ্ছা, তুমি এখন আমার কাছে কী চাও বলো।”
” কিছু চাই না তোমার কাছে। তুমি ভীতু, কাপুরুষ। আমাকে দেয়ার মতো কিছু নেই তোমার কাছে।”
” তুমি সব জেনে শুনে কি চাও আমার কাছে?”
” আমি তোমার কাছে থাকতে চাই। পারবে আমাকে রাখতে? তোমার পাশাপাশি থাকতে চাই। রোজ তোমাকে দেখতে চাই।”
” সীমা আমি তোমাকে বুঝতে পারছি। তুমি একটু শান্ত হয়ে পাঁচ মিনিট চিন্তা করে বলে, তোমার চাওয়া কি যৌক্তিক।”
শাওনের কথা শেষ হওয়ার হওয়ার সাথে সাথে সীমার দুচোখ বেয়ে কান্নার স্রোত নেমে এলো।
” এভাবে কাঁদবে না। তুমি বাসায় যাও। তোমার লায়লা খালা চিন্তা করবে। তুমি ঢাকা নতুন। পারলে গ্রামে ফিরে যেও। ফোনে কথা বলব।”
” আর কথা বলার দরকার নেই শাওন। ভালো থেকো তুমি। আমি আমার পথ খুঁজে নেব। তবে বিশ্বাস রেখে এক হতভাগী তোমাকে তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছে।”
গতকাল রীমা সরাসরি প্রশ্ন করার পর শাওন ভেবেছে আর নয়। আজই সব সম্পর্কের সমাপ্তি করতে হবে। তাই সে পরের দিন দুপুরের পর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সীমার সাথে দেখা করতে এলো।
এভাবে দু’নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। সীমা অহেতুক মিথ্যা স্বপ্ন যেন না দেখে। কোনোদিনও এস্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
কিন্তু এত বাজেভাবে যে সমাপ্তি হবে, শাওন ভাবতেও পারেনি।
কোনো স্মৃতি চাইলেই মুছে ফেলা যায় না। শাওনও সীমাকে মুছে ফেলবে না। তবে সীমা যেন নিজেকে গুছিয়ে নেয়। প্রয়োজনে শাওন সহায়তা করবে। কিন্তু না সীমার প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, সীমার উদ্ধত্ব আচরণ অসহনীয়।
তবে শাওনের ভালোও লাগছে বেশ। স্ত্রী ছাড়াও কেউ একজন পাগলের মতো ভালোবাসে।
সীমার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় শাওন আসল। আজ আর সে অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক হতে পারছে না।
ইচ্ছে করে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে।
রীমা একবারও ডাকেনি, তবে কাজে মন বসাতে পারছিল না। বারবার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিল শাওন কি করছে।
শাওন মহা সংকটে পড়ছে, না পারছে সীমাকে গ্রহন করতে না পারছে রীমাকে উপেক্ষা করতে। সীমা যে পাগলামি করছে, সেটা ভয়াবহ। কে বুঝাবে তাকে তার অবস্থান। কেন সে বুঝতে চাইছে না, শাওনের সাথে তার যা হয়েছে সেখানে কোথাও ভালোবাসা ছিল না, কোনো কমিটমেন্ট ছিল না। প্রাকৃতির প্রয়োজনে তারা কাছে এসেছে। সীমা আকাশ কুসুম কল্পনা করলে তো আর হবে না।
সমাজের কথাও চিন্তা করতে হবে। আমাদের মন তো অনেক কিছুই চায়, সব চাওয়া কি সবসময় পাওয়া সম্ভব। সীমা স্বপ্ন ভেবে সব ভুলে যাক।
শাওন বুঝতে পারছে, রীমা অনেক কিছু সন্দেহ করেছে। সন্দেহ করা আর নিশ্চিত হওয়া এককথা নয়। সীমা যে ভাবে পাগল হয়ে গেছে, সে যেকোনো মুহূর্তে রীমার মুখোমুখি হবে। রীমা সব জানতে পারলে কি শাওনকে ক্ষমা করবে?
জীবনেও না। রীমা ক্ষমা করতে চাইলেও শর্মিলি আহমেদ রীমাকে ক্ষমা করতে দেবেন না। শাওনের জীবনটাও কি তার বাবার মতো হবে? অবজ্ঞা, উপেক্ষা আর অবহেলা।
চলবে……