অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-১৭

0
395

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু

১৭)

জীবদ্দশায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবারও ঘটবে, শর্মিলি আহমেদ কল্পনাও করতে পারেননি। রীমার সামনে তিনি যতই শক্তভাবে কথা বলেন না কেন, ভিতরে ভিতরে কিন্তু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছেন।

স্বামী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার যে ভয়াবহ কষ্ট একজন মেয়েকে আমৃত্যু পেতে হয়, সে কষ্ট তিনি এখনও পাচ্ছেন।
একজন স্বামী, বাবা -মায়ের পর যে জীবন, মরনের সাথী হয়। মৃত্যুর পরও যার স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। কী দুর্ভাগ্য শর্মিলি আহমেদ পঞ্চাশ বছর সংসার করেছেন। চার সন্তানের জননী হয়েছেন। অথচ স্বামীর সাথে তাঁর কোনো সুখ স্মৃতি নেই।

সমাজে তাঁর সন্তান পিতৃ পরিচয় নিয়ে বড় হয়েছে। তিনি স্বামীর আশ্রয়ে ছিলেন। তাঁর একটা ঠিকানা ছিল। স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে যেতে হয়নি

কোনো অসৎ ব্যক্তি নোরাং ইঙ্গিত করতে পারেনি। সম্ভল ছিল এটুকই। আর বাকিটা ছিল শূণ্যতা। বাকিটা ছিল ব্যর্থতা, বাকিটা ছিল আশ্রিতা। যার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক নেই, তার আশ্রয়ে থাকা মানেই তো আশ্রিতা।

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে বয়সে অপরিপক্কতার কারণে তিনি কিছু ভুল করেছেন। তার পাশে কেউ ছিল না। পরামর্শ দেয়ার জন্য, সাহস দেয়ার জন্য, ভরসা দেয়ার জন্য। সে কারণে হয়তো অল্প বুদ্ধিতে কিছু নির্বুদ্ধিতা করেছেন। সে ভুলের মাশুল এখনো তাঁকে দিতে হচ্ছে।

সুরাইয়া এসে এবয়সে ঘাড়ে চেপে বসেছে। যে সুরাইয়ার মায়ের জন্য তিনি আজীবন স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। না পারছেন তিনি সুরাইয়াকে গ্রহন করতে, না পারছেন উপড়ে ফেলতে।

সে সুরাইয়াকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখতে হচ্ছে। জীবনে ভালো মানুষ হওয়ার মতো কষ্ট আর কিছুতে নেই। ভালো মানুষ হচ্ছে অনেকটা মোমবাতির মতো নিজে জ্বলে অন্যকে আলোকিত করতে হয়।

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে শর্মিলি আহমেদ বাসন্তিকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে দেননি। আজ রীমার পাশে তিনি আছেন সীমাকে অবশ্যই তার অবস্থান পরিষ্কার করে দেবেন।

শাওন রীমার। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত তাদের সম্পর্ক। এখানে কোনো কালনাগিনীর ছায়া পড়তে পারবে না। শর্মিলি আহমেদ পড়তে দেবেন না।

শর্মিলি আহমেদ প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে কল দিলেন আফসার উদ্দিনকে।
আফসার উদ্দিন কোনো এক অদৃশ্য কারণে শর্মিলি আহমেদকে ভয় পান। অসৎ চরিত্রের মিনমিনে স্বভাবের মানুষরাই সৎ ও চরিত্রবান মানুষকে ভয় পান।

আফসার উদ্দিন অসৎ চরিত্রের নয়। তবে মিনমিনে স্বভাবের। হয়তো একারণেই তিনি শর্মিলি আহমেদকে ভয় পান।

” হ্যালো! আপনার বইন সীমা কোথায়?”

” খালার বাসায় বেড়াইতে গেছে খালাম্মা।”

“‘আপনে কেমন ভাই! একজন সমত্ত বইনকে একবার বইনের বাসায়, একবার খালার বাসায় পাঠাই আপনি কি দায়িত্ব এড়িয়ে যাইতে চাইতেছেন?”

” এটাই কেমন কতা খালাম্মা! তার ভালা মন্দ তো আমিই দেখি।”

” তার ভালা মন্দ দেখলে তো আপনার আরও আগে তারে বিয়া দেওন দরকার আছিল। বইনের সাথে যে অবিচার করছেন, মেয়ের সাথে পারবেন সে অবিচার করতে?”

” খালাম্মা!”

” খালাম্মা বলে অবাক অইবার দরবার নাই। আপনে ছেলে ঠিক করি সীমার বিয়ার ব্যবস্থা করেন। সব খরচপাতি আমি দেব।”

” খালাম্মা ও তো বিয়েতে রাজি অইতাছে না।”

” আপনার কি মনে একবারও প্রশ্ন জাগে নাই, একজন সমত্ত মেয়ে কেন বিয়াতে রাজি অইতাছে না?”

” খালাম্মা আমি বুঝতাঝি না। ”

” আপনার আর বুঝনের দরকার নাই। আমিও আর আপনারে বুঝানোর দায়িত্ব নিতে চাই না। অতিস্বত্তর বইনের বিয়ার ব্যাবস্থা করেন। না হয় অনেক দেরি অই যাইব।”

আফসার উদ্দিন বোনের শাশুড়ির এমন রুক্ষ ভাষায় কথা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেলেন। তবে এটা ঠিক ঢাকা থেকে আসার পর সীমা কেমন যেন বদলে গেছে। আগের মতো সরলতা আর তার মধ্য ছিল না। কেমন উগ্র মেজাজের হয়ে গেছে।
বাড়িতে তার কোনোভাবে মন টিকছিল না। ঢাকা যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। রীমার বাসায় শ্বশুর বাড়ির লোকজন থাকায় সে নিতে চায়নি। তাই চলে গেছে লায়লা খালার বাসায়।

আফসার উদ্দিন বুঝতে পারলেন না। ঐ দিন রাতে হঠাৎ রীমা বলল সীমার বিয়ের কথা। আজ আবার রীমার শাশুড়ি ফোন করে সরাসরি সীমার বিয়ের কথাই বলল।
তার মানে কি সীমা নিজের বিয়ের ব্যাপারে বোন আর বোনের শাশুড়ির সাথে আলোচনা করেছে। হয়তো ভাইকে বলতে লজ্জা পেয়েছে। ভাবির সাথে তো তার সম্পর্ক কোনোকালেই স্বাভাবিক ছিল না।

আফসার উদ্দিনের সীমার জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। অকালে সংসারটা না ভাঙলে তারও তো রীমার মতোই একটা সংসার থাকত, সন্তান থাকতো। কালেভদ্রেও তো ভাইয়ের বাড়ি আসতে পারত না।

শর্মিলি আহমেদ প্রায় নিশ্চিত যেভাবে হোক আফসার উদ্দিন এবার বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করবে। বিয়ের উপযুক্ত নারী হচ্ছে অনেকটা ছাড়া গরুর মতো। যখন যার খেতে সুযোগ পায় মুখ দিয়ে বসে। বিয়ে দিয়ে এদেরকে খোয়াড়ে বন্দী করতে হয়, তাহলে আর সুযোগই পাবে না কারো খেতে মুখ দেয়ার।

বাকি আছে সীমা। তাকে তো বুঝাতেই হবে সে সোনা ভেবে আগুনে হাত দিয়েছে, এখনই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করলে হাতের সাথে সাথে শরীরও পুড়ে ছাই হবে।
যত নিচে নামতে হয় প্রয়োজনে শর্মিলি আহমেদ আরও নিচে নামবেন। তারপরও তিনি বেঁচে থাকতে রীমাকে কষ্ট পেতে দেবেন না।

চলবে….