অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-২০

0
468

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু

২০)
শাওন রোজ বাসায় ফিরে। স্ত্রী, সন্তান আর মায়ের কাছে। তারা এক টেবিলে বসে খাবার খায়, এক সাথে বসে গল্প করে। এক বিছানায় ঘুমাতে যায়। শরীরের প্রয়োজনে কাছেও আসে। তাদের উথাল-পাথাল প্রেমও হয়।

তারপরও রীমার অতৃপ্তি। সে যেন তার চিরচেনা স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছে। শাওন একটাবারের জন্যও রীমার চোখের দিকে তাকায় না। কেমন যেন পালিয়ে বাঁচতে চায়, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। রীমাও শাশুড়ি মায়ের কথা মতো নিজেকে চুপ রেখেছে। একবারও শাওনের মুখোমুখি হয়ে কিছু জানতে চায়নি। দেখা যাক কী হয়! শাওন কেমন যেন বাধ্য হয়ে সব কিছু করছে। কোথায় যেন সে আঁটকা পড়েছে!

শাওনের এমন অচেনা আচরণের কারণে রীমার সব জেদ গিয়ে পড়ে সীমার উপর। তার ইচ্ছে করে সীমাকে চরম অপমান করতে। কিন্তু কিভাবে শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারে না। তবুও মনে মনে সে অসংখ্য কথা সাজিয়ে লায়লা খালার বসায় কল দেয়। যেভাবে হোক সীমাকে আজ অপমান করেই ছাড়বে রীমা।

“ছোট বোনের বরের দিকে কু নজর দেবার আগে মরিসনি কেন? নির্লজ্জ, বেহায়। তুই না-কি আমার বোন! আমাকে মেয়ের মতো ভালোও বাসিস! কি করে পারলি তুই আমার সাথে এমন প্রতারনা করতে!”

কিন্তু না লায়লা খালার বাসায় কেউ ফোন পিক করেনি। কেউ ফোন পিক করলেও রীমা কিছু বলতে পারত না। কাউকে বকা দেয়ার আগে রীমা কাঁপতে থাকে, তোতলাতে থাকে। তার গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। এটা তার ছোটবেলার অভ্যাস। সামনে থাকলে যাও দুই, একটা বাক্য বলে। ফোনে একদমই বলতে পারে না। উল্টো নিজেই অসুস্থ হয়ে যায়।

কেউ ফোন পিক না করায় রীমা খুশিই হলো। কারণ যত কথাই সাজিয়ে রাখুক, রীমা আসলে কিছু বলতে পারত না। উল্টো সীমাই তাকে অপমান করে ছাড়ত।

মোবাইলে রীমার নাম্বার উঠে থাকতে দেখে, অনেকটা জেদ করে সীমা কল দিল রীমার কাছে। সীমা প্রায় একমাস ঢাকা। রীমার সাথে তার সর্বশেষ দেখা হওয়ার দিন এমন কোনো তিক্ততা হয়নি যে, এত কাছাকাছি থেকেও সীমা ছোট বোনকে একটা ফোন পর্যন্ত করেনি। উল্টো আফসার উদ্দিনকে জানিয়ে গেছে, সীমা যে ঢাকা আছে রীমা যেন এটা জানতে না পারে।

রীমা ভেবেছে হয়তো পাপবোধ থেকেই সীমার এত লুকোচুরি। আজ সীমার জেদ দেখে মনে হচ্ছে না কোনো পাপবোধ থেকে নয়। উল্টো শাওনকে আত্মসাৎ করার ফন্দি নিয়েই সে ঢাকা এসেছে। কিন্তু তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় সে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠেছে।

রীমা ওয়াশরুমে থাকায় সুরাইয়া ফোন নিয়ে এলো শর্মিলি আহমেদের কাছে।গুরুত্বপূর্ণ কল ভেবে শর্মিলি আহমেদ রিসিভ করলেন।

” হ্যালো কে বলছ?”

” আমি সীমা।”

” কিছু বলবা?”

” রীমারে বলতে চাইছি।”

” আমারে বলতে পার।”

” আপনের গুনধর ছেলে সম্পর্কে রীমার কিছু জানার প্রয়োজন। চোখে টিনের চশমা পরে থাকলে তো আজীবনই সব অন্ধকার দেখব।”

” রীমার স্বামী অওনের আগে শাওন আমার ছেলে, আমার ছেলে সম্পর্কে রীমা সব জেনেই সংসার করতাছে। দেখি ছোট বোইনের জামাই সম্পর্কে তুমি বাড়তি কী জানো বলে দাবী করছ যেটা তার মা এবং স্ত্রী জানে না।”

” আপনাদের মতো যেসব মায়েরা জেগে জেগে ঘুমায় তারা তো ছেলেদের দোষ দেখতে পায় না।”

” কী দোষ আমার ছেলের? সেটা কি তোমার চাইতেও বেশি?”

” আমার দোষ!”

” তুমি কার আবেদনে ঢাকা এসেছ? তোমার কী যোগ্যতা আছে শাওনকে কাছে ডাকার। না শিক্ষা আছে, না সৌন্দর্য আছে, না আছে আত্মসম্মানবোধ। যদি বলো শরীর আছে। পুরুষকে কাছে ডাকার সবচেয়ে দামী হাতিয়ার। তিনমাসের মধ্যে সংসার ভাঙার পরও কি বুঝতে পারনি। তোমার শরীরে বিশেষ কিছু নেই। যেটা দিয়ে পুরুষকে আকৃষ্ট করে রাখা যায়।”

” আপনার ছেলে কি আমাকে আসার সাহস দেখায়নি?”

” দেখিয়েছে। তাই বলে কি তুমি চলে আসবা? পুরুষদের তে চার পাঁচটা রক্ষিতা থাকেতেই পারে। আগেকার দিনে অনেক রাজাদেরও রক্ষিতা ছিল। তবে এরা কেউই রানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেনি। যারা দেখেছিল তারা তোমার মতো আস্তাকুড়েই পড়ে থাকে।”

” রীমার জানার প্রয়োজন আছে তার গোবেচারা স্বামীর স্ত্রী ছাড়াও রক্ষিতা আছে।”

” শাওন তোমাকে রিজেক্ট করার পরও কি তোমার মনে হয়নি, তুমি সাময়িক মোহ ছিলে। অনেকটা রক্ষিতার মতোই। সেই তুমি কোন সাহসে শাওনের স্ত্রীর কাছে ফোন দিয়েছ? তোমার সাহসের বলিহারি। এককাজ কারো তো যার বাসায় আছ তাকে ফোনটা দাও, তোমার চরিত্র সম্পর্কে তারও একটু ধারনা থাকা প্রয়োজন।”

সীমার কাথার মাঝে লায়লা খালা এসে পাশে দাঁড়ালেন।

” কী হইলরে সীমা। কার সাথে কথা বলছিস। দেখি।”

বলেই লায়লা খালা মোবাইল কেড়ে নিলো সীমার হাত থেকে।

” আস্সালাম আলাইকুম। কে বলছেন আপনি?”

” ওয়ালাইকুম আস্সালাম। আমি রীমার শাশুড়ি। মিসেস আলতাফ আহমেদ।”

” ও আচ্ছা বেয়ান। আমি সম্পর্কে রীমার খালা হই।”

” জি, আপনার কথা রীমার থেকে অনেক শুনেছি।”

” কোনো সমস্যা কি হয়েছে? আমি কি জানতে পারব? না-কি অযথাই নাক গলালাম।”

” না, না কী যে বলেন। অবশ্যই জানতে পারবেন। সীমার বিয়ের কথা বলছি। মেয়েটা আজ এতগুলো বছর একা। স্বামী নেই, সংসার নেই, সন্তান নেই। বাবা-মা নেই। তাই বলে কি আত্মীয়-স্বজনও নেই? কয়দিন থাকবে সীমা আপনার বাসায়? আমি আপনি আমাদের সবার কি প্রয়োজন না অতিস্বত্তর সীমার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করা।”

” সত্যি বলতে কি। এই বিষয়টা আমার মাথায়ও এসেছে তবে আপনার মতো এতো জোরালোভাবে ভাবিনি।”

” আজই ভাবুন। আমি আফসার উদ্দিনকে ফোন করেছি। প্রয়োজনে আপনিও করুন। বোন কিন্তু তার।সীমার লিগ্যাল অভিবাবক কিন্তু সে।”

” ঠিক বলছেন। আমার হাতে অনেক ছেলেও আছে, প্রয়োজনে আমি ঘটকের সাথে কথা বলব। আগে শুনি সীমা কী বলে!”

” সীমা থেকে কিছু শোনার প্রয়োজন নেই। স্বামী পরিত্যাক্তা পঁয়ত্রিশ বছরের একটা মেয়ে সংসার চায়, স্বামী চায়, স্বামীর সোহাগ চায়। আর কি চাইবে! আপনার তাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। আপনি শুধু আফসার উদ্দিনকে ফোন দিয়ে অনুমতি নিন।”

” আশ্চর্য এক মুহূর্তে আপনার সাথে কথা বলে আপনার ব্যক্তিত্বের মোহে পড়ে গেলাম। একদিন বাসায় আসুন সবাই মিলে। বসে গল্প করব।”

” নিশ্চয়ই আসব। কারণ আমি আপনার আত্মীয়।” এবার রাখছি।”

শর্মিলি আহমেদ চাননি এতগুলো তিক্তকথা একসাথে সীমাকে বলতে। কিন্তু তিনি বাধ্য হয়েছেন। সীমাকে তার অবস্থান বুঝানোর জন্য এর চেয়ে ভদ্র ভাষা শর্মিলি আহমেদের জানা নেই।

তবে তিনি কোনোভাবেই চান না সীমা অন্য কারো কাছে অপমানিত হোক। কারণ তিনি চান ভালোই ভালোয় সীমা তার ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে সুধরে নিক। শাওন নামক মরিচিকার পিছনে ছুটলে সীমাকে পস্তাতে হবে আমৃত্যু। তিনি তার পুত্রবধুর পাশে কারো ছায়াও দেখতে চান না। সীমার মগজে বুদ্ধি থাকলে সে লায়লা খালার কথা শুনে বুঝতে পারবে তাকে অসম্মান করার সমস্ত সুযোগ থাকার পরও শর্মিলি আহমেদ তাকে অসম্মান করেননি। তার মানে আর যাই হোক এই মহিলার শুভবুদ্ধির কাছে সীমার দুষ্ট বুদ্ধি খুব একটা কাজ করবে না।

চলবে..