হোম পলিটিক্স পর্ব-১২

0
304

#হোম_পলিটিক্স

#আফসানানীতু

#পর্ব_১২

খোদেজা বিবির বাগান করার খুব শখ। সমস্যা হচ্ছে ঢাকা শহরে নিজের মনের মত করে বাগান সাজাতে এক মুঠো জমি পাওয়াও আজকাল অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তাতে তিনি পিছপা হননি। বাড়ির সীমানা প্রাচীর আর দালানের মাঝে যে দুই আড়াই ফুট লম্বা ফাঁকা জায়গাটুকু পেয়েছেন তাতেই তিনি মনের সুখে কখনো সিম গাছ তো কখনো লাউ গাছ লাগান। সেই সঙ্গে কাঁচা মরিচ ধনিয়া পাতা তো আছেই! সকালে ফজর নামাজের পরে নিজের এই ছোট্ট বাগান তদারকি করতে তার ভালই লাগে। মজার ব্যাপার হচ্ছে তার ছেলের বউয়েরও বাগান করার খুব শখ। কিন্তু দুজনের গাছ লাগাবার পছন্দ আবার ভিন্ন। সালেহার ফুল গাছ প্রিয়, কিন্তু তার শাশুড়ির কাছে ফুল গাছ মানে শুধুই পয়সার শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। তাই তারা দুজন বাগান করার জায়গাটুকু আপসে ভাগ করে নিয়েছে। খোদেজা বিবির টবে গাছ লাগানো একেবারে অপছন্দ, তাই সালেহাকে তিনি ছাদটা দিয়ে দিয়েছেন বাগান করার জন্য।
তো প্রতিদিনের মতো খোদেজা নিচের গাছগুলোর যত্ন নিচ্ছিলেন, ভোরের নরম আলো এখনো তার সোনালী আঁভা কাটিয়ে ওঠেনি। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন খুব সুন্দর একটা মেয়ে তাদের বাড়ির প্রধান ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে তার পরিচিত লাগে তবে কোথায় দেখেছেন মনে করতে পারেন না।ভালোভাবে দেখার জন্য আরেকটু এগিয়ে আসেন আর তখন সালেহা তার জন্য চা নিয়ে আসে।
– জানতাম আপনাকে এখানেই পাবো। এই যে আম্মা, আপনার চা করে এনেছি। চলেন বারান্দায় বসে খান। খোদেজা তার ছেলের বউকে আঙ্গুল দিয়ে মেয়েটাকে দেখিয়ে বলে,
– যাইতাছি। তার আগে কইতে পারো ওই মেয়েটা কে? পরিচিত লাগতাছে, কিন্তু মনে করতে পারতেছি না কই দেখছি।
সালেহা তাকিয়ে দেখে ফুটপাতে রুচিতা দাঁড়িয়ে। এত সকালে রুচিতাকে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হন তিনি। শাশুড়িকে বলেন,
– পাশের বাড়ির মনির সাহেবের বড় ছেলের বউ ও।
– আইচ্ছা! ছাদে দেখছি কয়েকবার তয় কথা হয়নাই। সেজন্যই ঠিক চিনতে পারতেছিলাম না। তা এই মেয়ে এত সকালে এইখানে কি করে একা একা?
– সেটা তো আমারও প্রশ্ন। আম্মা, আপনি চায়ের কাপটা একটু ধরেন দেখি, আমি দেখে আসি ঘটনা কি।
সালেহা মেইন গেট খুলে বেরিয়ে আসেন।
– রুচিতা, তুমি এত সকালে এখানে কি কর?
রুচিতা বোধহয় কিছু ভাবছিল, সালেহার ডাক শুনে সে রীতিমতো চমকে ওঠে। পিছন ফিরে সালেহাকে দেখে একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে।
– কিছু না আন্টি, বাড়ি যাব ভাবছি।
– বাড়ি যাবে? এভাবে এতো সকালে?
সালেহা ভালো করে তাকান রুচিতার দিকে। তার পরনে ঘরে পরিহিত শত ভাঁজ পড়া শাড়ি। মাথার এলোমেলো চুলে কোন রকমে একটা হাত খোপা করা। চোখ লাল আর ফোলা দেখে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটার রাতে ঘুম হয়নি কিংবা খুব করে কেঁদেছে একটু আগেও। সালহা বুঝতে পারেন মেয়েটা কোন ঝামেলায় পড়েছে। তিনি সামনে এগিয়ে এসে বলেন,
– এত সকালে তুমি একা একা কোথায় যাও বলতো? রুচিতা অপ্রস্তুত কন্ঠে জবাব দেয়,
– বললাম তো আন্টি বাড়ি যাচ্ছি।
– আচ্ছা যেও। তার আগে তুমি আমার বাসায় এসে একটু বস, এক কাপ চা খাও তারপর না হয় যেও।
– না না আন্টি আমি এখন বসবো না, আমার যাওয়াটা খুব জরুরী!
শেষের কথাটা বলতে গিয়ে রুচিতার গলাটা একটু কেঁপে ওঠে। সালহা বুঝতে পারেন মেয়েটা কান্না থামাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তিনি আরেকটু এগিয়ে এসে রুচিতার একটা হাত আলতো করে ধরে নরম কন্ঠে বলেন,
– তা বেশ তো যেও, মানা করছি না। কিন্তু এত সকালে গাড়ি-ঘোড়া তো কিছুই পাবে না। তাছাড়া একা এত সকালে বের হওয়াটাও সেফ না। তুমি আমার মেয়ের মতো, আমি আমার মেয়েকে যেমন এত সকালে একা বের হতে দিতাম না তোমাকেও দিতে পারি না। তুমি আমার বাসায় চলো, ফ্রেশ হয়ে একটু খাওয়া দাওয়া কর তারপর না হয় আমি নিজে তোমাকে তোমাদের বাসায় দিয়ে আসব।
রুচিতা সালেহার কথার জবাব না দিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। সালেহা তাকে রীতিমতো হাত ধরে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসে। সদর দরজা আটকে শাশুড়িকে বলেন,
– মা চলেন আমরা মেহমান নিয়ে বাড়ির ভিতরে যাই, সবাই বসে একসঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে। এসো রুচিতা!
বলে রুচিতার হাতটা আবার ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে রুচিতা সবাইকে অবাক করে দিয়ে সালেহাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। সালেহা প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেন। রুচিতাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
– কেঁদো না রুচিতা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
খোদেজা ছেলের বউকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
– ওরে কাঁদতে দাও বৌমা। মাইয়াটার বুকের মধ্যে মনে হয় অনেক আন্ধার জমছে, কানলে আন্ধার কমবো। সালেহা শাশুড়ির কথা ফেলেন না, রুচিতাকে জড়িয়ে ধরে প্রাণ ভরে কাঁদতে দেন। অবাক করার বিষয় হচ্ছে খোদেজা এবং সালেহা দুজনের কেউই জানেন না রুচিতা কাঁদছে কেন তবু তার কান্না দেখে তাদের চোখ থেকেও উষ্ণ জলধারা নীরবে বইতে থাকে।

***

অকারণে ছুটি সহজে পাওয়া যায় না, তার ওপর নাফিসা রাত জেগে পড়ছে বলে বন্ধের দিনগুলোতে একটু দেরি করেই উঠে। তাই সকাল সাতটায় যখন তার আয়েশের ঘুমের মধ্যে বাগড়া দিতে রুমন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে বলে,
– নাফুদি আমার রং পেন্সিল কি করছো?
তখন তার ইচ্ছে করে ছেলেটাকে থাপরে তার সবগুলো দাঁত ফেলে দিতে।সে বালিশটাকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ রেখেই বলে,
– সব ডাস্টবিনে ফেলে দিছি, ওইখান থেকে টুকিয়ে নিয়ে নেগে যাহ।
– কি? তুমি আমার রং পেন্সিল বিনে ফেলে দিছো?
– ফেলবো না তো কি করবো? তোরে এই রুমে ঘুমাতে দিছি, আমার খাটে রং পেন্সিলের হাট বসাতে দেইনাই। বিছানায় ঘুমাতে এসে দেখছি সব রং পেন্সিলে বিছানা ভর্তি, তাই সব ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিছি। পারলে ওইখান থেকে টোকায় নিয়ে স্কুলে যা। এইখানে ঘ্যান ঘ্যান করবি না।
রুমন এবার রাগে চিৎকার করে ওঠে,
– নাফুদির বাচ্চা!
লাফিয়ে পড়ে নাফিসার চুল খা*মচে ধরে। নাফিসার ঘুম এক লাফে চোখ থেকে বিদায় হয়, সেও দ্বিগুন তেজে লাফিয়ে উঠে রুমনের পিঠে দুমাদুম দুই-একটা কি*ল বসিয়ে দেয়। রুমন এবার পিঠ বাঁকা করে চিৎকার জুড়ে দেয়,
– আম্মা, আম্মা! নাফুদি আমারে মা*রে!
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সালেহা দৌড়ে ঘরে ঢুকেন। তাকে দেখে নাফিসা রেগে মেগে বলে,
– তুমি এই ছাগলের বাচ্চাটাকে এখান থেকে নিবা না ওরে আমি পদ্মা নদীতে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসব। সাতসকালে এমন কান্ড দেখে সালেহা এবার রেগে যান।
– আমি আমার জীবনে এমন পোলাপান দেখি নাই! সারাদিন শকুনের মতন ঠোকড়াঠুকড়ি করে! এই সাত সকালে পুরা দুই বয়সের দুইটা একসঙ্গে ঝগড়া মারামারি করতে পারে?
– মারামারি আমি শুরু করছি না তোমার ছেলে শুরু করছে?
– আম্মা, নাফুদি আমার রং পেন্সিল সব ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিছে। কেমনটা লাগে!
– ইচ্ছা করে ফেলি নাই, ঝাড়ু দিছি তখন ময়লার সঙ্গে বিনে চলে গেছে।
নাফিসা বিরস বদনে জবাব দেয়। সালেহা অগ্নিদৃষ্টি মেলে খানিকক্ষণ নাফিসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,
– নাফিসা শোন, সব সময় ফাজলামো করবি না। রং পেন্সিলগুলো টাকা দিয়ে কেনা হয় নাই? এভাবে কেউ ফেলে দেয় জিনিসপত্র ইচ্ছা হলেই?
নাফিসা এবার রুমনকে তার শরীর থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে, তারপর রং পেন্সিল গুলো পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে বের করে এনে খাটে রাখে।
– তোমার কি ধারনা, আমি এতই বেকুব? টাকা দিয়ে কিনা জিনিস বিনে ফেলে দেবো? ওর সঙ্গে মজা নিতে ছিলাম! তুমিও সেটা বিশ্বাস করলা?
সালেহা এবার লজ্জিত বোধ করেন। তাই তো, তার বোঝা উচিত ছিল তার ছেলে মেয়ে যতই দুষ্টুমি করুক জিনিসপত্র নষ্ট করে না। তাই চট করে মেয়ে সম্পর্কে এমন নেগেটিভ ধারনা পোষন করাটা তার উচিত হয়নি। এতে ছেলে মেয়ের মা বাবার উপর থেকে ভরসা কমে যায়। তিনি এবার শান্ত কণ্ঠে বলেন,
– বুঝলাম, তাহলে ওকে মিথ্যে বলেছিলি কেন?
– বললাম না মজা নিতে ছিলাম!
– এই সাত সকালে তোদের মজা নিতে হয়? আমার কত কাজ থাকে সকালে এই সময়। এখন যদি এই সময়েও আমার রেফারিগিরি করা লাগে তাহলে কাজ করব কখন?
নাফিসা আবারো ঝাঁপিয়ে বিছানায় পড়ে বলে,
– আচ্ছা সরি, এখন থেকে মারামারি করলেও ঘড়ি দেখে করবো।
শুনে সালেহা হেসে ফেলেন।
– তবু বলবি না যে আর মারামারি করবো না।
– ওইটা সম্ভব না! রিফাত আর রুর সঙ্গে মারামারি না করলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না।
– খুব হয়েছে! তোরা তিন ভাই বোন পারিসও! এবার ওঠ, আর শুতে হবে না।
– কেন, সমস্যা কি? আমি একটু ঘুমাই না, রাতে অনেক দেরি করে শুয়েছি তো।
– আহ্, ঘটনা আছে। পাশের বাসার মেয়েটা, ওইযে রুচিতা! ওকে সকালে দেখি একা একা কোথায় যেন যাবার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর আম্মা মিলে ওকে বাসায় নিয়ে এসেছি ধরে বেঁধে, এখন ড্রয়িং রুমে বসে আছে। এতবার জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারিনি কি হয়েছে। তুই একটু হাত মুখ ধুয়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে বস দেখি, দেখ কিছু বলে কিনা। আমি রুমন আর তোর বাবাকে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর আসছি।
চেঁচামেচিতে ততক্ষণে পিয়ারও ঘুম ভেঙে গেছে। সে বিছানায় উঠে বসে বলে,
– ওমা, পাশের বাসার ভাবী এসেছেন? কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?
– বললাম তো বলতে পারছি না। তোমরা গিয়ে দেখো কিছু বলে কিনা। পারলে মেয়েটাকে তোমাদের ঘরে এনে বসাও। মেয়েটা বোধহয় রাতে ঘুমায়নি। বেচারীকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
সালেহার কথা শুনে নাফিসা আর পিয়া ঝটপট মুখ হাত ধুয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। রুচিতা তখন একটা সোফায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তার হাতে মগ ভর্তি চা, কিন্তু সে সেই মগে চুমুক দিয়েছে বলে মনে হয়না। নাফিসা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সামনের মুখোমুখি একটা সোফায় বসে পড়ে।
– কেমন আছেন আপু?
নাফিসাকে দেখে অল্প হাসার চেষ্টা করে রুচিতা, তবে সেই হাসিটাও কেমন ফিকে লাগে তার ঠোঁটে।
– ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?
– আমি তো ভালোই আছি আপু, কিন্তু আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না আপনি ভালো আছেন। কি হয়েছে বলুন তো? এতো সকালে কোথায় যাচ্ছিলেন?
রুচিতা কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
– আচ্ছা আপু বলতে হবে না। আপনি চা খান। চাটা ঠান্ডা হয়ে গেছে নাকি? আবার গরম করে এনে দেবো? পিয়া রুচিতাকে বলে,
– ভাবী চায়ের কাপটা আমাকে দেন দেখি। আমি আমাদের দুজনের জন্য চা আনতে যাচ্ছি। দিন আপনার জন্যও নিয়ে আসছি।
রুচিতা নিরবে চায়ের মগটা এগিয়ে দেয়। পিয়া চা আনতে চলে গেলে নাফিসা বলে,
– আপু চলুন, আমার ঘরে চলুন। ওখানে একটু বিশ্রাম নেবেন, আপনাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে। পারলে একটু ঘুমিয়ে নেন।
রুচিতা হঠাৎ নাফিসার হাত আঁকড়ে ধরে বলে,
– নাফিসা, আমার তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল। বিশ্বাস করো এই মুহূর্তে এই কথাগুলো বলার মত কাউকে আমি পাচ্ছি না। কেন যেন মনে হচ্ছে এই কথাগুলো তোমাকে বা আন্টিকে বলা যায়। কিন্তু কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। আমার বাবা মা এই মুহূর্তে ঢাকায় নেই, তারা ওমরাহ পালন করতে গেছেন। তাদেরকে এখন এই ব্যাপারে কিছু জানিয়ে আমি তাদের ইবাদতের সময়টুকু নষ্ট করতে চাচ্ছি না। এদিকে আমার আর ভাই বোনও নেই যাকে আমি আমার বিপদের কথা খুলে বলতে পারি অকপটে। কিন্তু আমি সত্যি সত্যি ভীষণ বিপদে পড়েছি! কি করব বুঝতে পারছি না। সবচেয়ে বড় কথা আমার পাশে কেউ নেই, আমার ভীষণ একা লাগছে। ভীষণ একা!
রুচিতা ডুকরে কেঁদে ওঠে। নাফিসার ভীষণ মায়া হয়। সে রুচিতার হাতটাকে তার বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে,
– আপু আপনি আমার বড় বোনের মত। আপনার যা বলতে ইচ্ছে হয় আপনি আমাকে বলতে পারেন। এতোটুকু আশ্বাস দিতে পারি, আমি আর আম্মা আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। আর আপনি নিজেকে কখনো একা ভাববেন না। আমি অবশ্যই আপনার সঙ্গে আছি। সঙ্গে আমার পরিবারও থাকবে আশা করি। বলুন আপনার কি হয়েছে?
– আমি বলতেই চাচ্ছি কিন্তু পারছিনা। বিশ্বাস কর, কিভাবে বলবো আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
রুচিতা ফুঁপিয়ে ওঠে। নাফিসা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
– এক কাজ করলে কেমন হয় আপু? আপনি আমার ঘরে চলেন, বিছানায় বসে হাত পা ছড়িয়ে আগে এক কাপ চা খান। তারপর না হয় আপনার সমস্যাটা শোনা যাবে।
রুচিতা লক্ষ্মী মেয়ের মত নাফিসার কথায় সায় দেয়। নাফিসা তাকে হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। নাফিসার খাটে বসে রুচিতার কেমন শান্তি শান্তি লাগে। তার মনে হয় সে তার নিজের বাড়িতে চলে এসেছে। সে আর একা নয়… এমন একটা স্বস্তিদায়ক বিশ্বাস তার এলোমেলো অনুভূতিগুলোকে স্তিমিত করে। কাল সারা রাতে যেখানে মনে হয়েছে তার কেউ নেই, সে কিছুতেই জিততে পারবে না এই অপশক্তির সাথে লড়াই করে। সেখানে এখন মনে হচ্ছে তার সব আছে, সে চাইলেই পারবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। রুচিতা একটা বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
পিয়া তিনজনের জন্য চা নিয়ে ঘরে এসে একটু অবাক হয়। রুচিতা হাত পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মত ঘুমাচ্ছে, আর নাফিসা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম মমতায়।

***

শফি সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। ভিডিওটা দেখার পর রুচিতার উপর ভীষণ রাগ হয়েছিল তার। রুচিতার বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে পারছিলো না কিছুতেই। কিন্তু কাল যখন মা এভাবে সবার সামনে তাকে অপমান করছিল সেই সময় সে রুচিতার মুখের দিকে ভালোভাবে খেয়াল করেছে, সেই থেকে তার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে তার। এখানে রুচিতার দোষ নেই বোধহয়। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভিডিওটাও তো সে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারে না। ওটা যে রুচিতা সেটা তো ঠিক, কেননা ভিডিওতে রুচিতার কাঁধের তিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শফি কি করবে বুঝতে পারে না। এমন সময় তার ঘরের দরজায় টোকার শব্দ হয়। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে আনোয়ারা বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
– কিছু বলবে মা?
– হ্যা, ইয়ে … রুচিতা কি এই ঘরে?
– রুচিতা এই ঘরে থাকবে কেন? ও তো কাল রাতে গেস্ট রুমে শুয়েছিল। তুমি নিজেই তো দেখেছিলে।
– না মানে ঘুম থেকে উঠে ওকে দেখতে পেলাম না তো, ভাবলাম তোর ঘরে আছে কিনা…
– ঘরে নেই? দেখো হয়তো ছাদে গেছে।
– না, ওখানেও তো দেখলাম না!
– কি বলো! ঠিকঠাক মত খুঁজে দেখেছো ?
কাউকে কিছু না বলে বাইরে বের হবার মতন মেয়ে তো রুচিতা না। চিন্তায় শফির কপালে ভাঁজ পড়ে। আনোয়ারা মিন মিন করে কিছু একটা বলতে যায় ঠিক তখন অভি তার রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
– মা আমার অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে,আমি গেলাম।
– কোথায় যাচ্ছিস? নাস্তা করবি না?
– না আজ নাস্তা করতে ইচ্ছে করছে না।
আসলে অভি এই মুহূর্তে বাসার পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচে। নাস্তা খেতে বসে তার মা আবার নতুন কোন নাটক করে কে জানে! বারবার একটা মানুষকে অপমানিত হতে দেখতে ভালো লাগেনা। আর সেজন্যই সে রীতিমতো পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে। কিন্তু অভি বাইরে বের হওয়ার জন্য দু’পা গিয়েও আবার ফিরে আসে। গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে,
– মা শোনো, আমি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সবাইকে নিয়ে বসবো। ভাবীর কি সমস্যা সেটা আগে তার মুখ থেকে শুনবো। এর আগে তুমি বা ভাইয়া দয়া করে ভাবীর সঙ্গে কোন মিসবিহেভ করবে না, এইটুক আমার তোমাদের কাছে অনুরোধ। মেয়েটাকে আগে বলতে দাও তার সমস্যাটা কোথায় তারপর না হয় বিচার আচার যা করার করবে। তার আগে ভাবীর সঙ্গে তুমি বা ভাইয়া কোন মিসবিহেভ করবে না, প্লিজ! আর তাকে বাড়ি থেকে বের হবার কথা তো একেবারেই বলবে না। সে যত বড় অপরাধই করুক, সে এখন এই বাড়ির একজন সদস্য। তোমার আমার এই বাড়িতে থাকার যেমন অধিকার রয়েছে তারও সমান অধিকার রয়েছে। তাই বারবার গলা চড়িয়ে আমার বাড়ি আমার বাড়ি বলে তাকে ছোট করবে না। সে নিজে কিন্তু এই বাড়িতে আসেনি, আমরাই বরং ঢাক ঢোল পিটিয়ে রীতিমতো কলেমা পড়িয়ে তাকে এই বাড়িতে এনেছি ভাইয়ার বউ করে। সুতরাং তাকে সেই মর্যাদাটুকু তোমার দিতেই হবে।
অভি আর দাঁড়ায় না, লম্বা লম্বা পা ফেলে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। এদিকে অভির কথায় আনোয়ারার চোখ মুখ আরো ফ্যাকাস হয়ে ওঠে। তাই দেখে শফি বলে,
– মা তুমি কি আমাদের কাছে কিছু লুকাচ্ছ? আনোয়ারা এবার ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠ বলেন,
– সকালে রুচিতাকে খুঁজতে গিয়ে গেস্ট রুমে এই চিঠিটা পেলাম।
শফি কাঁপা হাতে আনোয়ারার হাত থেকে চিঠিটা নেয়। খুলে চিঠিটা পড়ে তার ভেতরটুকু অব্দি কেঁপে ওঠে। সে যা ভেবেছিল তাই, তার রুচিতা নির্দোষ! অন্তত এই চিঠিটার বক্তব্য সেটাই বলে।
– রুচিতা বাসা থেকে নোট লিখে রেখে বেরিয়ে গেছে, সেটা তুমি এতক্ষণে আমাকে বলছো?
শফির কন্ঠে উষ্মা প্রকাশ পায়।
অভি বেরিয়ে যেতেই আনোয়ারার গলার স্বর এক ধাপ উঁচু হয়ে যায়। সে এবার গলা চড়িয়ে বলে,
– তো কি করব? সবাইকে চিঠি দেখিয়ে বেড়াবো? নাকি গলায় মেডেল বানিয়ে ঝুলিয়ে হাঁটবো আর সবাইকে বলবো, আমার বউ বেলাল্লাপনা করে ধরা খেয়ে বাসা থেকে পালিয়েছে!
– মা! তোমার ভাষা সংযত কর প্লিজ!
– বাহ্, সে যা খুশি তাই করবে আর আমি সংযত ভাষায় সেগুলো প্রকাশ করব?
জবাবে শফি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে ঠিক তখনই পেছনে তার বাবা মনির সাহেবের গর্জন শোনা যায়।
– সকাল হতে না হতেই তুমি আবার চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছো? বললাম শান্তভাবে সবাই বসে আলাপ করব, তার আগেই আবার তুমি মেয়েটাকে আজেবাজে কথা বলছো!
– তোমার আদরের বৌমাকে পেলে তো তাকে শোনাবো! সে তো বাড়ি থেকে ফুরুত করে উড়াল দিয়েছে।
– উড়াল দিয়েছে মানে?
– মানে সে তার প্রেমিকের হাত ধরে ভেগেছে।
– কি আজেবাজে কথা বলছো!
– বিশ্বাস না হলে দেখো! এই যে চিঠি লিখে রেখে গেছে।
মনির সাহেব দ্রুত এগিয়ে এসে চিঠিটা নেন। পড়ে রীতিমতো তার মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠে।
– আনোয়ারা এটা তুমি কি করেছো তুমি জানো? তুমি একটা মেয়েকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটা পর্যন্ত দাওনি। এত সকালে মেয়েটা কোথায় গিয়েছে কে জানে! ওর বাবা-মা দেশে নেই সেটাও তুমি জানো, ওর একটা ভাই বোন নেই! মেয়েটা এখন কই গেছে কে বলতে পারবে! এখনই… ওর আত্মীয়-স্বজন যাদের নাম্বার তোমার জানা আছে ফোন দাও। ফোন দিয়ে খোঁজ নেও রুচিতা কোথায় গেছে।
– তুমি কি ভেবেছ রুচিতা তাদের কারো বাড়ি গেছে? জীবনেও না! এই মেয়ে অবশ্যই তার প্রেমিকের হাত ধরে ভেগেছে। খুব চালাক মেয়ে! মুখে শব্দ করে না কিন্তু কাজে কামে ওস্তাদ!
শফি এই অন্যায় অপবাদগুলো আর সহ্য করতে পারে না। সে রীতিমতো ধমকে ওঠে,
– চুপ কর মা, চুপ কর! আমি তোমার মুখ থেকে রুচিতার নামে আর একটা নোংরা কথা শুনতে চাই না। তুমি মিথ্যে বলছো, আগেও বলেছিলে এখনো বলছো। তোমার রুচিতা সম্পর্কে বলা প্রত্যেকটা কথা বানোয়াট। এর একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না।শফি খুব শান্ত মানুষ, সে কখনো উঁচু গলায় কারো সঙ্গে কথা বলে না। এই প্রথম তাকে এতোটা রাগ হতে দেখা যায়। প্রচন্ড রাগে তার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। আনোয়ারা হতভম্ব হয়ে যায় ছেলের ব্যবহারে। যেই ছেলে কখনো মার মুখের উপর একটা কথা বলেনি আজ সে তার মাকে রীতিমতো ধমক দিচ্ছে! রাগে সে এবার সমান তালে চেঁচিয়ে ওঠে,
– ওই বাজারের দুই পয়সার মেয়ের জন্য তুই আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারলি? তোর মনে হল আমি মিথ্যে বলছি?
এবার মনির সাহেব চিৎকার করে ওঠেন,
– হ্যাঁ বলছো! মিথ্যে না বললেও বানিয়ে তো অবশ্যই বলছো। রুচিতার বিরুদ্ধে আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি। ও কি করেছে না করেছে সেটার বিচার আমি করব। ওকে আমি এই বাড়িতে এনেছি, সুতরাং আমি ঠিক করব ও এই বাড়িতে থাকবে কি না থাকবে। সেটার ফয়সালা করার এখতিয়ার আমি তোমাকে দিইনি এখনো। তাই চুপ করে থাকতে পারলে থাকো নইলে তুমি নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। আমি যদি রুচিতাকে খুঁজে না পাই তাহলে জেনে রেখো তোমার কপালে আজকে এমনিতেও দুঃখ আছে! কিছু বলি না বলে বড্ড বাড় বেড়েছে তোমার। কথায় কথায় নিম্ন শ্রেণীর মানুষের মত কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করাটা তোমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
– কি বললে তুমি! ওই মেয়ের জন্য তুমি আমাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতে পারলে?
আনোয়ারা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।
– হ্যাঁ বলেছি। বলেছি যদি চুপ থাকতে না পারো তাহলে বিদায় হও। এখন তুমি কোনটা করবে সেটা তোমার ব্যাপার। তবে আমি রুচিতার বিরুদ্ধে আর একটা কথাও শুনতে রাজি না।
শফি বাবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে,
– আমিও না।
আনোয়ারা এবার মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে শুরু করেন। তবে তার সেই মেকি কান্নায় মনির সাহেব বা শফির কারোরই মন গলে না। আনোয়ারা নিজের রুমে গিয়ে ঝটপট একটা ব্যাগে কিছু কাপড় গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। চোখ মুছতে মুছতে বলেন,
– আমার পক্ষে চোখের সামনে এরকম অন্যায় দেখা সম্ভব না, তাই চুপ থাকতে আমি পারবো না বলে চলে যাচ্ছি। কিছুদিন বোনের বাসায় থাকবো। এবার শান্তিতে থাকো তোমরা।
আনোয়ারা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যান বাসা থেকে,শফি বা মনির সাহেব কেউই তাকে আটকায় না।
শফি নিজের ঘরে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। তার নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে। তার বোধহয় তার মায়ের সঙ্গেও এমন ব্যবহার করাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু রুচিতা কোথায় গেছে? ভাবতেই কেমন অস্থির লাগে তার। মোবাইলটা হাতে নিয়ে রুচিতার পরিচিত বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবার বাড়িতে ফোন করে খোঁজ নেয় সে রুচিতা ওখানে গেছে কিনা জানতে। কিন্তু রুচিতা কোথাও যায়নি। এবার সত্যি সত্যি ভয় পায় শফি। রুচিতাকে কাল যেভাবে ভেঙে পড়তে দেখেছে সে, তাতে যতসব আজেবাজে চিন্তা মাথায় উঁকি দিতে থাকে তার। অপমান সইতে না পেরে খারাপ কিছু করে বসেনি তো মেয়েটা? কেমন স্বামী সে? স্ত্রীর দুঃসময় তার পাশে পর্যন্ত ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারেনি বরং তাকে নীরবে ভর্ৎসনা করেছে সে। কিন্তু এখন তার কি করা উচিত? পুলিশকে খবর দেবে না নিজেই খুঁজতে বের হবে?
শফি পুরো ঘরে চোখ বোলায়। তার পুরো ঘর জুড়ে রুচিতার উপস্থিতির ছোট ছোট নমুনা অথচ রুচিতা তাকে রেখে চলে গেছে। কোথায় গেছে জানেনা শফি, কি করবে কিভাবে খুঁজে পাবে তাকে সেটাও সে জানে না। শুধু জানে তার রুচিতা নির্দোষ এবং সে একজন কাপুরুষ স্বামী যে পারেনি তার স্ত্রীকে বিশ্বাস করতে। শফি সোফার উপর পড়ে থাকা রুচিতার ব্যবহৃত একটা শাড়ি জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কান্না ভেজা কন্ঠে ফিসফিস করে বলে,
– কেউ না করুক আমি তোমাকে বিশ্বাস করব রুচিতা।আমি তোমার পাশে থাকবো কথা দিচ্ছি। তুমি প্লিজ, একবার… শুধু একবার ফিরে আসো।

চলবে।