#বাতাসে_তার_সৌরভ–২৩
বেলা বাড়ার সাথে বাড়িটাও সচল হচ্ছে ধীরে ধীরে। ঘরের মধ্যে বসে থেকে থেকে নদী অস্থির আবার স্থবির হয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ যে ব্যাপার তা হলো, নদী তার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছে না। রাতের বেলা চার্জে দিয়ে শুয়েছিল। সকালবেলা ব্যাগ গুছিয়ে দরজা বন্ধ দেখে সেটা নিয়েই অস্থির হয়ে গেল। পরে দেখে মোবাইলটাও নেই। মাঝরাতে তার চোখটা কোন একসময় লেগে এসেছিল, তখনই সম্ভবত ফোনটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। চেনা দেয়াল, খাট, পালঙ্ক টেবিল, তবুও ঘরটা ক্রমে কারাগারে পরিণত।
নদী ক্রমাগত দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে, কেউ যেন আশেপাশে নেই। একবার ঠিকেঝি এলো, দরজায় হ্যাচবোল্টে তালা ঝোলানো দেখে অবাক হয়ে রানুখালাকে ডাকতে গেল। তারও কোন খবর নেই। যেন কোন মৃতবাড়ি।
বাইরের দিকের জানালায় অনেক ডাকাডাকির পর মেজমামি কান্তা, আর বেলা এলো। নদী কিছু বলার আগে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল–
” একটা ব্রাট ঘটনা ঘইটেসে, আপাতত চুপ থাকো!ঝামেলা করলি সর্বনাশ হবে ”
” মামি আমি কিছু বুঝতে পারছি না ”
” বুঝতে পারা লাগবে নানে, তোমার খালা সবাইরে ভাঁওতা দেসে!বইলেছে ছেইলে ভালো হইয়ে গিয়েছে, ঘন্টা ভালো হয়েসে! এই পাগল আরও বাড় বেইরেসে। বলসে বিয়ে করবে না।”
” কিন্তু আমি কি দোষ করেছি? আমার ঘরে তালা কেন? বিয়ে করবে না তাঁর জটিলতা ”
বেলা বলল ” নদীপু, তুমি যতটা জটিল ভেবেছো, ঘটনা তার থেকে একটু জটিল, সে তোমারি বিয়ে করতি চায়! তুমি যেন ভেইগে যেতে না পারে এজন্য দরজায় তালা ঝুলোয়েছে, বন্দুক নিয়ে ঘুরছে বাড়িময়। বে না দিলি আত্মহত্যা করবে হুমকি দেচ্ছে”
নদীর সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠলো। মনে হচ্ছে চোখের সামনে যা দেখছে সব স্বপ্ন, ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন। কোনমতে নিজেকে সামলে বলল ” আমার মোবাইলটা কে সরিয়েছে? ”
কান্তামামি মাথা নেড়ে বলল, ” তা তো জানিনে ওই শয়তানটাই কাউরি দিয়ে সরিয়েছে! আপাতত একটু শান্ত থাকো। তোমার বড়মামা এক বিপদে পইড়েছে, না আসা পর্যন্ত কোনমতে ঠ্যাকায় রাখা লাগবি৷”
বেলা বলল, কিন্তু কাকি,শাহীনভাই আব্বা আসার আগে যদি আবার কোন কাণ্ড কইরে ফেলে। রানুফুপু তো বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছে”
নদীর হঠাৎ মোবাইলের জন্য অস্থিরতা কমে গেল। এখন সে আতিপাতি করে খুঁজবে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে হারপিক জাতীয় কিছু আছে কিনা।সূক্ষ্ম একটা ভয় এটা খেয়ে নিলে মৃত্যু বেশি কষ্টকর হবে কি?
*******
নিশি মহা বিরক্ত হয়ে তার লাগেজ প্যাক করছে। তার বিরক্ত হবার দুটা কারণ, এক হলো আমেরিকার জন্য তার মায়ের যাবতীয় উদ্ভট উদ্ভট সব জিনিস সংগ্রহ। কক্সবাজার থেকে রাজ্যের শামুক ঝিনুক, সিলেটের বাগানের কয়েক কেজি চা তো বটেই, একগাদা শুকনো ধুন্দলের আঁশও যাচ্ছে আমেরিকায়। দুজন মানুষ মিলে এত এত জিনিস কীভাবে বয়ে নিয়ে যাবে নিশির মাথায় ঢুকছে না।
” তোর কি মনে হয় মাষকলাইয়ের ডালের বড়িটা মবিন জোগাড় করতে পারবে? জিনিসটা জরুরি ছিলো… ”
নিশি মায়ের কথার জবাব দিল না,শব্দ করে কাপড় রাখল। তার বিরক্তির আরেকটা কারণ হলো মবিন। শানুর সাথে পরিচয় হবার পর এমন কোন দিন নেই যেদিন তার তলব পড়ছে না। আর এই মবিন লোকটাও প্রায় সোনামুখে ছুটে চলে আসছে। বিষয়টি নিশির মোটেই ভালো লাগছে না। এই দেশে টাকা আর ক্ষমতার প্রতি মানুষের খুব নির্লজ্জ লোভ আছে। আর কেউ যদি আমেরিকান সিটিজেন আর ডলারের গন্ধ পায় তাহলে তো কথাই নেই। জোকের মতো পিছু ছাড়ে না।
” অসাধারণ ছেলে বুঝলি, আমাএ ন্যাশনাল আইডি কার্ডটা কিছুই আপডেট করতে পারতাম না। এই ছেলে নির্বাচন কমিশনে লাইনঘাট করে কীভাবে বের করে দিলো।চমৎকার একটা ছেলে”
” তোমার মনে হয় না “চমৎকার” সার্টিফিকেটটা একটু বেশি তাড়াতাড়ি দিয়ে ফেলেছ ”
“চমৎকার মানুষকে তাড়াতাড়িই চেনা যায়, বদমাশগুলোকে সহজে চেনা যায় না ৷ ইউর ফাদার ইজ ওয়ান অফ দেম”
” দুইদিনের পরিচয়ে তার সাথে যখন ইলোপ করেছিলে তখন চমৎকারই লেগেছিল ”
নিশি মুড অফ করে হোটেল রুম থেকে বের হয়ে গেল। শানুর সাথে দীর্ঘক্ষণ তর্ক করার এক পর্যায়ে তিনি নিশির বাবার প্রসঙ্গ তুলে নিয়ে আসেন। কথাগুলো হয়তো মিথ্যাও নয়, তবে কেন যেন নিশির বাবার বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে ইচ্ছে হয় না, তেমনি মায়ের কোন বদনাম বাবার করার চেষ্টা থাকলে নিশি থামিয়ে দেয়।
হোটেল লবি থেকে থেকে বেরিয়ে নিশি ফুটপাতে আনমনে হাঁটছে। হাতে বেশিদিন সময় নেই, নিশির পাসপোর্ট চলে এসেছে ; ঢাকায় আছে আর একসপ্তাহ! এরপরই ফিরে যাবে ক্যালিফোর্নিয়া।সেখানে গিয়ে হাইস্কুল এডমিশন, এরপর নার্সিং ট্রেনিং ,শানু মোটামুটি মেয়ের লাইফ রি-ডিজাইন করে ফেলেছেন। স্বপ্ন দেখার নিজেস্ব আনন্দ আছে তবে সেটা কতটা বাস্তব মতো হয় সেটাই প্রশ্ন। নিশি রোডসাইড ফুটপাথ দিয়ে মনের অজান্তেই নদীর নতুন সাবলেট বাসায় চলে এলো। মাকে নদীর হাতের কয়েকটি খাবার খাওয়ানো দরকার। বিশেষ করে ওভেন ছাড়া কেক, পুডিং আর মুরগীর কোরমা।নদূর হাতে এই জিনিসগুলো সম্পূর্ণ আউট অফ দি ওয়ার্ল্ড।
ভাবনা নিয়ে নদীর বাড়ির গেটে প্রবেশ করতেই হঠাৎ মাথায় এলো আরে নদী তো ঢাকায় নেই। আজকে সকালেই রওনা হবার কথা কিন্তু রওনা হয়ে আর কল দেয়নি। আশা করা যায় ওই জায়গা থেকে বের হতে পারবে৷ যদি না পারে তাহলে প্ল্যান বি রেডি রাখতে হবে।
নিশি তার মোবাইল বের করে নদীর নাম্বারে কল দিল, বেশ কিছুক্ষণ বেজে কলটা রিসিভ হলো।
– হ্যাঁ নদু… কী অবস্থা?
– হ্যালো…আমি…
ওপাশ থেকে থেকে থেকে শব্দ গুলো ভেঙে যাচ্ছে। নেটওয়ার্ক দুর্বল।তবে শা শা শব্দে মনে হচ্ছে নদী গাড়িতে।
নিশি কিছুক্ষণ পরে কল দেবে ভেবে রেখে দিলো। নদীটার জন্য একটা টেনশন রেখেই যেতে হবে। মায়ার একটা নিজেস্ব জাল থাকে যেটা মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেয় না।
” আরে নিশু, এইখানে কী কর? ”
পথে নেমে মবিনকে দেখে সাবধানে বিরক্তি লুকালো নিশি৷ মবিন হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল,” আমি তোমাদের হোটেলেই আসছিলাম। ফাইনালি প্রবলেম সলভড! মাষকলাইয়ের ডাল ইজ হিয়ার। ”
” ওয়াও প্রাউড অফ ইউ, শি উইল বি ভেরি হ্যাপি ”
” আই হোপ সো।
” এতই যে আপনাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে বসতে পারেন। ”
নিশির কথায় মবিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো। নিশি হেসে বলল,
” রাগ করলেন কেন? আমিতো কমপ্লিমেন্ট দিলাম। আপনি খুব ভালো যাচ্ছেন। খুব সিস্টেমেটিক্যালি তাকে আপনার ওপর নির্ভরশীল করে দিয়েছেন, বন্ধুত্ব তৈরি করছেন। সময়ের পারফেক্ট ইনভেস্টমেন্ট। আমরা কিন্তু ওখানকার ইমিগ্র্যান্ট না, সিটিজেন । আমাদের পাসপোর্টগুলো নীল।আপনারো দ্রুতই হয়ে যাবে। ”
” আমি যে হওয়াতে চাই সেটা এতটা নিশ্চিত হয়ে গেলে নিশু৷ “মবিনের গলা শান্ত।
” নিশু আমাকে শুধু মা ডাকে “নিশির কড়া গলায় মবিন একটা হকচকিয়ে গেল।
” ওকে,, আই এপোলোজাইস। কিন্তু কিছুটা হার্ট তুমি আমাকেও করেছ৷ তোমার ধারণা যে আমি সম্ভবত তোমার মাকে আর তোমাকে পটিয়ে আমেরিকা যাবার তাল করছি। ”
নিশি উত্তর দিলো না।
মবিন স্বগতোক্তি করে বলল ” আমার জন্য বিষয়টি নেওয়া কষ্টকর। তবে অস্বাভাবিক নয়। সময়টাই এতো খারাপ যে বিনা স্বার্থে কেউ কাউকে সাহায্য করে না। সবারই নিজের নিজের মতলব থাকে।সমস্যাটা হলো আমার স্বভাব। বিপদে পড়া একা মানুষ দেখলে আজাইরা জড়িয়ে যাই।আপাতত এইটা দেখ। ”
মবিন নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স এগিয়ে দিলো। ক্যানাডার লাইসেন্স। মবিন তার মোবাইলের এলবামে তার কিছু ছবি বের করে দেখালো,বেশ কয়েকবছর আগের। জায়গাটা টরেন্টোতে।
” আমি একজন ক্যানাডিয়ান ইমিগ্রেন্ট। ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা ওখানেই, পাঁচ বছর আগেও টোরেন্টোতে জব, বাড়ি গাড়ি সবই ছিলো। দেশে এসেছিলাম বিয়ে করতে। বউ নিয়ে ফেরত যাবার প্রসেসে বউটা হুট করে কনসিভ করে ফেলল, ব্যাংকিংয়ে আমার ক্যারিয়ার তখন তুঙ্গে, আমি টরেন্টো ব্যাক করলাম। ওর ডেলিভারির আগে দিয়ে ফিরেছিলাম। কিছু স্বপ্ন থাকে যা আমরা স্পর্শ করেও আগলে রাখতে পারি না। মেয়ে আর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর ফিরে যাইনি কারণ ওখানের একাকিত্ব হয়তো আমায় মেরে ফেলত। বছরে একবার সেখানে যাওয়া হয়। বাকি সময় এখানেই থাকি, ছোট একটা স্কুলে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাই, বাবা-মায়ের খেয়াল রাখি আর কারো বিপদ দেখলে চেষ্টা করি সাহায্য করতে। বাস্তব স্বপ্ন ভাঙার পরে আমার স্বপ্নের দেশে যাবার আগ্রহ হারিয়ে গেছে নিশি।কাজেই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করা ছেড়ে দিতে পারো ”
মবিন খুব হালকা গলায় কথাটা বললেও নিশির মনে হল মানুষটার চেহারা বদলে গেছে। এখন কেন যেন ছেলেটাকে বেশ শক্ত ব্যক্তিত্বের একজন মনে হচ্ছে । দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা মানুষরা একটা চকচকে ভাব লেপ্টে ঘোরাফেরা করে, এই মানুষটা তার ব্যতিক্রম।
মবিন একটা প্যাকেট এগিয়ে বলল
” ধরো, মাসকলাইয়ের বড়ি, আন্টিকে বলো, এটা কেনার প্রয়োজন হয়নি আমার দুঃসম্পর্কের খালা বানিয়ে দিয়েছেন ”
” আপনি নিজে হাতেই দিন। মা আপনাকে দেখে খুশি হবেন এন্ড আই এম সরি ফর মাই বিহেভিয়ার। এইদেশের প্রচুর লোভি আর স্বার্থপর মানুষের সাথে পরিচয় হতে হতে আমার হয়তো থট প্রসেসটাই বিগড়ে গেছে ”
মবিনকে নিয়ে হোটেল পৌঁছাতেই শানুকে পেল বারান্দায়। বেশ থমথমে মুডে ফোনে কারো সাথে কথা বলছেন।
– ভাবী এইটা কোন কথা বললে এতো যুদ্ধ করে মেয়েটা কলেজে ভর্তি হয়েছিলো। কী পোড়াচ্ছিল তোমাগের?বিয়ে দেয়ার জন্যি এতো উঠে পইড়ে লেইগেছ?
নিশি বুঝলো সম্ভবত তার মামিদের মধ্যে কারো সাথে কথা বলছেন শানু৷ ওপাশ থেকে কিছু শুনে শানুর মুখ আরও অন্ধকার হয়ে গেল–বলসো কী! তা এই জিনিস পেইল কোথায়? ইন্ডিয়া থে এইনেসে! সব্বনাশ! আমি কী বলব, পারলি রানুরি ধইরে একটু ঝাড়ু পেটা করো। টাকার লোভে পাগল ছেলেরি বিয়ে করাতি গেসলো। যত্তোসব। মাঝখানে এতিম মেয়েটার কিছু না হলিই হইলো ”
ওপাশ থেকে আবার কিছু বলা হলো,
প্রতুত্তরে শানু বললেন, ‘ না আমারি এসবে টানবে না একেবারে। আমি এসব কিচ্ছু জানি না। বিয়েতে তো আমি এমনিতেই আসতাম না৷ ভাইজানরি ধরো গে যাও, তার মাথায় এইসেছিলো এই বুদ্ধি। আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি। সামনের শুক্রবার আমার ফ্লাইট। মেইয়ে নিয়ে কোন মতে ফিরে গেলেই বাঁচি। ”
শানু বিরক্তমুখে ফোন রেখে দিলেন।
নিশি একটু তটস্থ হয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো।সম্ভবত নদীর পালানোর বিষয়টা জেনে গেছে সবাই। এইজন্যই শানুকে ফোন করেছিলো।
” ইজ দেয়ার এভরিথিং অলরাইট? নদু কি কিছু করেছে নাকি মম ”
” কী আর করবে, করতিসে তো রানুর পাগল ছেলেটা। নদীকে তালা দিয়ে ঘরে আটকে রেখেছে ”
” ঘরে আটকে রেখেছে মানে কি বল! ওর তো সকালের বাস ধরে পালানোর কথা ও নিজে মুখে বলেছে মাছের ঘের ওয়ালা কে ও বিয়ে করবে না ”
নিশি দ্রুত ফোন দিলো নদীর ফোনে, কিন্তু দেখা গেলে এখন ফোন বন্ধ। নিশির মনে হলো তখনও রিসিভ যে করেছিল সে নদী ছিলো না।
শানু নিজের মেয়ের কথায় ধাতস্থ হতে সময় নিলো। নিশি সংক্ষেপে সব বুঝিয়ে বলার পর ঘটনা কিছু আন্দাজ করলেন। নিশি দেখা গেল বেশ ছটপট করছে৷ যেকরে হোক পুলিশ নিয়ে বোনকে উদ্ধার করা দরকার।
” সবচেয়ে আগে আমাদের এখান থেকে দূরে থাকা দরকার। ”
নিশির মায়ের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। শানু শান্তগলায় বললেন , ” শোন মা, আমার কথাগুলো একটু রুড লাগবে, কিন্তু আমাকে আমার বাচ্চার সিকিউরিটি দেখতে হবে। রানুর ছেলেটার মাথায় সমস্যা আছে, ওখানে তাকে যারা ভালো তাকে হ্যান্ডেল করতে পারবে তাদের থাকা দরকার । তুমি আমি গিয়ে কোন লাভ হবে না মাই ডিয়ার। বড় মামা ফিরে এলে সামলে ফেলবেন, সব জায়গায় না বুঝে জড়াতে নেই ”
” ইউ নো ওয়াট মম, আই থ্যাংক টু গড যে নদু এভাবে চিন্তা করে না। ও যদি তোমার মতন ভাবতো তাহলে আজকে হয়তো আমি তোমার সামনে জীবিত দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। ও আমার পাশে তখন ছিল, যখন তুমি নিজের ক্যারিয়ার আর বয়ফ্রেন্ডকে সামলাচ্ছিলে। আর আজ তুমি বলছ আমি যেন ঝামেলার মধ্যে না জড়াই।
” নিশু ডার্লিং লিসেন… ”
” আমি লজ্জিত মম! ” নিশি মাকে থামিয়ে দিলো, ” এইজন্য যে তোমার মতো হিপোক্রেট কেউ আমার মা! আমি খুবই লজ্জিত ”
বারান্দা ছেড়ে ঘরে এসে দেখে মবিন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে।
******
” বারোটা ঘন্টা তীব্র পেইনের মধ্যে থেকে মেয়েটাকে জন্ম দিলাম, এইভাবে মেয়েটা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে! ”
” না মিনু যাবে না! আমি যেতে দিবো না! আমি প্রয়োজনে বাড়ি মডগেজ রাখবো সেরা চিকিৎসা করাবো কিন্তু আমার মেয়েকে মরতে দেব না”
ছেড়াছেড়া দৃশ্যগুলো আজ হঠাৎ যেন স্পষ্ট হয়েছে চোখে৷ একেবারে ভুলে যাওয়া স্মৃতি।মনে পড়ছে পাঁচ বছরের নদীর আধোঘুম আধো জাগরণে শুনেছিল বাবা মায়ের কথা। রক্তের কি এক বিরল অসুখ ধরা পড়েছিল নদীর। মা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন বাবা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বাবা সেই রোগ সারাতে সত্যি বাড়িটা মডগেজ দিলেন। বিদেশ যাত্রা হলো।মনে পড়ে সেই প্রথম প্লেনে চড়া।
এয়ারপোর্টে সব মামা খালারা এসেছিলেন বিদায় দিতে। স্নেহে আর্দ্র সব মুখ৷ সবার মুখেই দোয়া। এই একই মুখগুলো ধীরে ধীরে বদলে গেল বাবার মারা যাবার পর ছয়মাসের মধ্যে মা বাবলু চলে গেল…! তারা কাঁদলেন বিচিত্র চোখে তাকিয়ে রইলেন নদীর দিকে।
কানে ভেসে আসে এক আহাজারি ” কেউ রইলো না! মেয়েটা ছাড়া পরিবারে আর কেউ রইলো না”
ছেড়া ছেড়া স্মৃতি আসছে – আল মদিনা হোটেলের বাথরুম থেকে পালানোর দৃশ্য, শাহবাজের লাম্পট্য থেকে ছুটে পালানোর মুহূর্ত, ঢাকার সড়কে অজস্র নোংরা হাতের স্পর্শ থেকে রক্ষা করে এগিয়ে চলা। চোখের সামনে ভাসছে চন্দ্রমল্লিকার গেট, নতুন রূপ পাওয়া গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের গ্রানাইট পাথরের সিড়ির ধাপগুলো..শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আছে একজন রাজপুত্র। যার হাতে গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের চাবি, নদীর যেটাকে চন্দ্রমল্লিকায় রূপান্তর করতে হবে। আরে ওইবাড়ির পেছন দরজার চাবি তো এখনো তার কাছে! জি এসকে ফেরত দেওয়া হয়নি।
মাথার মাঝের শব্দগুলো স্নায়ুকোষে ধাক্কা দিলো সুক্ষ্মভাবে।ইশারায় কেউ যেন বলছে চোখ খোলো, বাস্তবে এসো।।
নদী চোখ খুলল যখন বিকাল গড়িয়েছে। উঠে বসতে গেলে মনে হলো সমস্ত শরীর ব্যথা। গলা শুকিয়ে কাঠ লাগছে। মাথা উঠাতে গিয়ে হুটকরে ঘুরে উঠলো।
” নদীপু শরীর খারাপ লাগছে?”
বেলা একটা চেয়ারে বসে আছে চুপচাপ। ঘরের দরজা ভেড়ানো। নদী একটু উত্তেজিত হয়ে বলল,” বেলা বড় মামা আসছে? ”
” আসেনি বড়চাচার বিরাট ঝামেলা লেইগেসে। দুটো দুকান পুইড়েসে, ফিরতে নাকি লেট হবে”
” তাহলে দরজা… ”
” তোমার খাবার দিতে এসেছিলাম ,শাহীন ভাই বইলেসে পাহারা দিতি।নতুন বউয়ের কি লাগে না লাগে এইজন্যি৷ ”
“মানে? ”
” মানে হাতে পিস্তল নিয়ে শান্তি হয়নি , বাইরের গেটে পাহারাও বসিয়েছে ”
বেলার চোখের কোণে অসহায়ত্ব দেখে নদী বুঝলো পরিস্থিতি কিছুই বদলায়নি।শুধু তার ঘরের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে।
তবে এভাবে বসে থাকলে কাজের কাজ কিছুই হবেনা।কোন অবস্থায় পালানোর চেষ্টা করতে হবে। কপালে যদি মৃত্যু থাকে তাহলে তাই সই। বেলার হাতে মোবাইল দেখে হঠাৎ চমকে উঠলো নদী।
তার কাছ থেকে ফোন হাতে নিয়ে
বলল” তোর কাছে নিশির নাম্বার আছে না?
“নেই তো, এটা তো মায়ের ফোন। নিশিপু কি কারো সাথে কথা বলে? ওই এক তুমারে একটু পছন্দ করে… তার নাম্বার তো জানিনে ; তবে নদীপু আব্বারে ফোন দিও না। মা কড়া কইরে নিষেধ কইরে দিয়েছে ”
ফোন হাতে নদীর নিজের গালে চড় দিতে ইচ্ছে করলো৷কেন নিশির নাম্বার মুখস্ত করলো না?সব সময় ফোন হাতে থাকে এই গুরুদায়িত্ব ফোনই নিয়ে রেখেছে। নদীর মনে পড়লো তার লাগেজ ব্যাগে গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের প্যাডে নাম্বার আছে। দুটা নাম্বার, রিসিপশনে বসা কাদেরভাইয়ের কাছে, আরেকটা তুষারের কাছে থাকে। কোন ভাবে সেখানে খবর দিলে হয়তো কিছু হতে পারে।অন্তত সোহরাব সামদানী সাহেব জানলে…।
নদী রিসিপশনের নাম্বারে কল দিয়ে ক্রমে এঙ্গেজ পেলো। বেলা ঘরের বাইরের জানালায় চকিত নজর রাখছে, কেউ চলে এলে সর্বনাশ। রিসিপশনের নাম্বারে না পেয়ে নদী তুষারের নাম্বারে কল দিলো।
” গ্যাব্রিয়েলস কিচেন, হাউ মে আই হেল্প ইউ? ”
” হ্যালো তুষার ভাই আমি নদী”
” এক্সকিউজ মি ম্যাম শোনা যাচ্ছে না”
” আমি নদী তুষার ভাই… ”
” জি কে? ”
নদী কয়েকবার নিজের নাম নিচু গলায় উচ্চারণ করার কারণে তুষারের বুঝতে একটু অসুবিধা হলো।
” নদী! ও মাই গড কী ব্যাপার তোমার ফোন কোথায়? ”
” আমার অনেক বড় বিপদ, তুষার ভাই ”
” মানে বুঝলাম না কোথায় তুমি?”
” সাতক্ষীরা আমার খালার বাড়ি, এখানে আমাকে জিম্মি করে রেখেছে। প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করুন। ”
” কি বলছ বুঝতে পারছি না, কী সমস্যা হয়েছে তোমার তো আজই চলে আসার কথা ”
নদী নিচু গলায় যথাসম্ভব স্পষ্টভাবে বলল ” আমি ফিরতে পারছি না তুষার ভাই। আমার অনেক বড়ো বিপদ ,এখানে আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে আপনি কোন অবস্থায় স্যারকে জানান। প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন ”
” বিয়ে মানে কিসের কি, তোমাকে বিয়ে দিচ্ছে…”
” হ্যাঁ জোর করে, প্লিজ তুষার ভাই আমাকে সাহায্য করুন আমি এখান থেকে … ”
নদী আরও কিছু বলতে যাবার আগে বেলা ফোন কেড়ে নিলো। দরজার কাছাকাছি শাহীন হেঁটে আসছে।বেলা দ্রুত ফোনে কিছু টেপাটেপি করছে,
-কী অবস্থা বলো তো নদী? শরীর কিরাম?
নদী উত্তর দিলো না। মুখ রাগে থমথমে। শাহীনের পেছনে আতঙ্কিত মুখে দুই মামি উঁকিঝুঁকি মারছেন।
শাহিন কাউকে গ্রাহ্য করলো না বলল- তোমারি আমি বইলেসিলাম না ওয়াদা রাখবো, দেখ এখন আর তোমাকে কেউ জোর করতি পারবে না। আর অচেনা মানুষের গলায় মালা পরানোর কোন যুক্তিও নেই আজীবনের ব্যাপার তাই নারে বেলা!”
বেলা চমকে তাকালো।ফ্যাকাসে হাসার চেষ্টা করলো।
শাহীন অবাক হয়ে বলল- ওমা তোর মোবাইল আছে দেখসি, দে দেখিনি কীরাম সেট।
শাহীন বেলার হাত থেকে ফোনটা এক অর্থে কেড়েই নিয়ে নিল, ” তা বড়োমামা ফোন কইরেসে? ”
” না করে নাই “বেলার গলা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
” হ্যাঁ একটা বড় সমস্যা হয়েছে তারি আর টেনশন দিয়ে কাজ নেই, বুঝতি পারিসিস? সে যা জানার এখানে এসেই তো জানবে আপাতত ফোনটা আমার কাছ থাকুক ”
” ভাইয়া কিন্তু… ”
শাহীন হেসে বলল ” একরাতের জন্যি বন্ধক নিচ্ছি, ফোন এলে তোরে ডেইকে দেবো কেমন, আমার ভালো লক্ষ্মী আপু না তুই “এরপর নদীর দিকে তাকিয়ে বলল,” আসি নদী কিছু খাওয়াদাওয়া কর, তোমার শুকনো মুখ দেখতি আমার এক্কেবারে ভালো লাগেনা।খেয়াল রেখো নিজের, তোমার জীবনটা কিন্তু এখন আমার আমানত ” শাহীন লাজুক হেসে বেরিয়ে গেল।
এদিকে বেলা তার ফোন হারিয়ে হতভম্ব। নদী থম ধরে থাকা অবয়ব হুট করে নড়ে উঠলো। জীবনের এত চড়াই উৎরাই পার করেছে একটা মানসিক বিকারগস্তর সাথে বিয়ে করতে নিশ্চয়ই নয়। এর থেকে মৃত্যুও ঢের ভালো।
তীব্র রাগে নদী উঠে দাঁড়াতে গেলেও হুট করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল।বেলা ছুটে এলো দ্রুত,
” ও মা নদীপু তোমার গা তো জ্বরে গা পুইড়ে যাচ্ছে, ও মা, মা… বেলা চিৎকার দিয়ে মাকে ডাকছে।
*******
” ভাবি ব্রাট একটা সর্বনাশ হবে কলাম! “শাহবাজ গলা খাদে নামিয়ে বিজবিজ করছে রানুর কাছে ” বিউটির বাপ আগের ইউপি চেয়ারম্যান। বোলবোলা কলাম কম নেই। বিয়ের তিনদিন আগে কোন ঘাপলা হয়েছে শুনলে পুরো ফ্যামিলি শুদ্ধু কেইট্টে রেখে দেবে একেবারে ”
“তা কি আমি জানিনে? ভাইপোরি বুঝাও গে যাও আর না পারলি তাগের জিনিস সব ফেরত দে আসো ওসব আমরা ব্যবহারও করিনি ”
“সে কী বলছ এইসব ফেরত দিলি তো বুঝতে বাকি থাকবে না.. ”
” না থাকলি কী আর করাপাগলের সাথে বিয়ে দেলে আরও বড় সমস্যা হতে থাকপে।একটু বুঝোয় বল্লিই হইলো। ”
শাহবাজের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। ঘটনা শুধু জিনিসপত্রই নয় মেয়ের বাবার কাছ থেকে বেশকিছু টাকা , শাহবাজও ধার নিয়েছিলেন। আত্মিয়োতা হয়ে গেলে বিষয়টি সিথিল হয়ে যেত। কিন্তু এরমধ্যেই শাহীন মাকে কোন পানিপড়া খাইয়েছে কে জানে ।
রানুর বিষয়টি পানিপড়া না হলেও কিছুটা বৈষয়িক যুক্তিবোধ কাজ করছে৷ এই বিষয়টা আগে তার মাথায় কেন এলো না ভাবছেন। গতরাতে ছেলের বাগদত্তার কথাগুলো যখন শুনছিলেন রাগে গা রি রাত করে উঠছিলো বিউটি মেয়েটা অবলীলায় বলে যাচ্ছিলো,
” আমার কলাম ঘর অপরিষ্কার একেবারে ভালো লাগে না বুইঝেন মা। যেইখানে পা দোবো, একেবারে ফকফকা হতি হবে। দুজন তো আমার ঘর পরিস্কার করতিই লাগবে তবে একটা কতা বাথরুম কিন্তু কাজের লোক দে পরিস্কার করাব না”
” সে তুমি নিজি হাতে করলি তো ভালোই “রানু জোর করে হাসিটেনে বললেন। বিশাল শরীরে বাথরুমে এঁটে থাকাই মহৎ ব্যাপার, তিনি নাকি পরিস্কারও করবেন।
” আরে না মা, আমার এসব করার অভ্যাস নেই তবে আপনার ছেলের অভ্যাস আছে তো? কমোড সাফ করতি পারবে তো? আমার বড় শুচিবায়ুর সমস্যা পরিস্কার না হলি বসতি পারিনে”
রানু স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলেন।
” আর হ্যাঁ গেস্টরুম কিরাম আমগের? এসি কি আছে? আমার মা কিন্তু মেইয়ের কাছে এইসে থাকপে কদিন পর পর। ও মায়ের স্বভাব বুইসেন, মেইয়েগের বাড়ি ঘুইরে ঘুইরে থাকেন।আমাগের সুবিধা অসুবিধা দেখেন। মা কি খাতি পারে আর কি পারে না, আমি লিস্ট পাঠায়ে দোবো।”
রানুর মাথা ঘুরছিলো বেশি আর কথা আগাতে পারেননি।ছেলের এই উদ্ভট কর্মে হুট করে মাথা খুলেছে।নদীর রঙ চাপা হলেও নিখুঁত গড়ন, তার ওপর নিজের হাতে মানুষ করা মেয়ে ; পরিশ্রমী, ঘরের কাজ জানা। আর একটা কথা মনে পড়েছে।পুবপাড়ায় রানুর বাবার একটা পৈতৃক সম্পত্তি আছে। তিনবোনকে লিখে দেয়া দশকাঠা জমি। শানু তার ভাগেরটা বোনদের লিখে দিয়েছে, বাকি রইলো রানু আর উত্তরাধিকার সূত্রে মিনুর মেয়ে নদী। নদী ঘরে এলে পুরোটাই হাতে চলে আসে।এই চিন্তাগুলো আগে মাথায় এলে এখন এত ঝামেলা হতো না। বাসার সবাই ভয়ে তটস্থ হলেও রানুকে এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিতে হবে।
” বিরাট বড় গন্ডোগোল হতি যাচ্ছে ভাবি ছেইলেরে এখনই ঠ্যাকাও।” শাহবাজ ষড়যন্ত্রের কন্ঠে বলে চলেছে ” এই মেইয়ে ঢাকায় ছিল এতদিন কোন কোন লাফাঙ্গাগিরি কইরেসে আল্লাহ মালুম এইখানে যখন যে ছিল তখনও তার রিপোর্ট ভালো ছিল না ”
“রিপোর্ট তো আপনারও ভালো ছিল না চাচা ” শাহবাজ ভূত দেখার মতো করে চমকে গেলো। শাহীন গুটিগুটি পায়ে ঘরে ঢুকেছে, হাত খালি তবে চোখের দৃষ্টি অসম্ভব শীতল। ঠোঁটে ক্রুর হাসি।
” আপনার রিপোর্ট আমি বলব? ছোট থাকতিই মেলা দেইখেসি।আমাগের ঠিকেঝি জাহাঙ্গীরের মা ঘর মুছতি লাগলেই আপনার কাজ ছেল ঝুইকে পড়ে তার বুক দেখা একবার তো তার হাতে চড়ও খেয়েছিলেন, ভুল বললাম? ”
শাহবাজের মুখ শুকিয়ে এতটুকু, ” কী বলছ এসব আমি… ”
” যা বলছি ঠিক বলছি। গোটা দুনিয়া জানে, গরু খাসিই খালি নয়, মেইয়ে মানুষির মাংস আপনার বড় প্রিয়। এখন যা বলব মনোযোগ দিয়ে শোনেন ” ভাইপোর শেষ কথায় মনোযোগ দিতে বাধ্য হলেন শাহবাজ, কারণ পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট রুপালি আগ্নেয়াস্ত্রটা এখন বেপর্দা হয়েছে। “আপনি এখন কাজির ব্যবস্থা করেন শুভ কাজে আমি বিশেষ দেরি করতি আগ্রহী না। ”
” নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই শুভকাজে আসলেই দেরি করা ঠিক নয় ”
শাহবাজের চোখ আটকে আছে পিস্তলের রুপালি নলে, এমন মোহনীয় রূপের সামনে যেকেউ মেনে নিতে বাধ্য।
শাহবাজ তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হবার মুখে নদীর বড় মামি নাজিয়া হন্তদন্ত হয়ে এলো।
” নদীর গায়ে আকাশ পাতাল জ্বর বমি কইরে ভাসায় দেচ্ছে ঘর ”
********
জেরিনের মাথা চিনচিন ব্যথা করছে সকাল থেকেই। চিনচিন ব্যাথা নিয়েই সোহরাবের জন্য কফি বানালো।
তিনি দেখা গেল স্টাডিতে আছেন,প্রিয়তমার হাসির প্রত্যুত্তরে হাসি দিলেন না।জেরিন ঘন হয়ে বসলো মাথার কাঁচাপাকা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কোন সমস্যা?
” সমস্যাই সমস্যা!
” আমাকে বলা যায়? ”
” আগে আমার নিজেকে বুঝতে দাও জেরিন। কোন কাছের মানুষ প্রতারণা করলে বিষয়টা জটিল হয়ে যায়। হিসাব বুঝতে সময় লাগে। এনি ওয়েজ উইল ইউ প্লিজ লিভ মি ফর এ হোয়াইল একটু জরুরি মেইল করছি”
জেরিনের মাথাধরা যেন বেড়ে গেল। মুখ অন্ধকার করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। সোহরাব কালরাত থেকে কেমন গম্ভীর মুডে আছে। জেরিনের গাঢ় আহবানেও তেমন কোন সাড়া দেননি পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন৷ জেরিনের চাপা চিন্তা হচ্ছে সোহরাব কোন ভাবে গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের এই মাসের পার্টি বাজেটের ব্যালেন্স সিটটা পেয়ে গেলেন নাকি। অনেক গুলো হিসাবই বাড়তি করে দেখানো।
এই মাসে এই ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব সোহরাবের হাতে। এক অর্থে জেরিনের হাতেই। সোহরাবের আরও কাজ থাকে সব দিকে খেয়ালও থাকে না,জেরিন বেশ রিল্যাক্স হয়েই কাজ করছিলো। জিএসের নির্ধারিত কিছু জিনিসের কোয়ালিটির নাম একই হলেও সোর্স আলাদা। তাই খরচ বেঁচেছে প্রায় দেড়গুণ। তবে সোহরাবকে আগের দামের হিসাবই দেয়া হয়েছে। এই বিষয়ে জিএস ছিল দারুণ টনটনে জ্ঞানের,
ম্যাটেরিয়াল কোয়ালিটি প্রতিটি পাই পয়সার হিসেব রাখতো। এই মাসের দুটা পার্টি চমৎকার এরেঞ্জ হয়েছে সামনের সপ্তাহে আরও বড় পার্টি আছে।
সবই চৌকস হাতে জেরিন সামলাবে, একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট পুরাটাই কন্ট্রোলে। মূলত এখন যদি সুযোগ না নেয় তাহলে বাকি জীবন পস্তাতে হবে। সোহরাব যদিও অন্তরঙ্গতার সময় ভরসা দেয় তবুও এই মুখের কথার দাম কোথায়? সোহরাব যদি বিয়ের জন্য রাজি হতো তাহলে চিন্তা থাকে না গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের দায়ভার সহজেই সামলানো যাবে৷ কিন্তু সোহরাবের যেন বিয়ে নিয়ে কিছু দ্বিধা আছে।
জেরিনের ছেলেটাকে দামী স্কুলে ভর্তি করেছে সামনে আরও অনেক গুছিয়ে আগাতে হবে।
আশা করা যায় গ্যাব্রিয়েল আমেরিকা গেছে অর্থাৎ সেখানেই সেটেল হয়ে যাবে৷ বাঙালি বাবার ছেলে হলেও বিলিতি সাহেব। গরম দেশে কতদিন আর পড়ে থাকবে?
কিন্তু তার আগে জানা দরকার সোহরাব এত গম্ভীর কেন তার কাছে কি সত্যি কোন তথ্য গেছে? এই বিষয়ে cover-up করা দরকার। জেরিনের চিন্তায় বিচ্যুতি ঘটাল তুষারের কল,
” ম্যাম নেক্সাস গ্রুপের পার্টির জন্য ওনারা এসে গেছেন স্যারের কলে পাচ্ছি না তাই ”
” বসাও আমি আসছি স্যার বিজি “জেরিন বেশ দায়িত্ব নিয়েই কথাটা বলল।
” ম্যাম আরেকটা ব্যাপার, নদী কল দিয়েছিলো ”
” রওনা কি দিয়েছে দুইদিনের ছুটি নিয়ে গেছে, আজকের মধ্যে আসার কথা।
” না ম্যাম বলল কী ঝামেলার মধ্যে পড়েছে, বিয়ে না কি হয়ে যাচ্ছে.. স্যারকে খবর দিতে বলল…মানে ”
“রাবিশ” জেরিন বিরক্ত “তার কাজিনের বিয়ে হচ্ছে, এখন আমি তাকে ছুটি দিতে চাইনি কিন্তু এই চালাক মেয়ে বড়ো স্যারকে পটিয়ে ঠিকই বের হয়ে গেল। আচ্ছা আমি বলে দেব সময় করে ”
জেরিন ফোন ছাড়লো। এই নদীটাকে জেরিন পছন্দ করতো, বুদ্ধিমতী, পরিশ্রমী, চৌকস। তবে মেয়েটার একটা বিশেষত্ব আছে, ভালো রাধুনির থেকেও বেশি স্মার্ট। জিএসের মুখে আলো খেলা করে নদীকে দেখলে। সোহরাবও কেমন আহ্লাদী করে কথা বলেন।এমনিতেই ওই রাবেয়ার আত্মিয়ো তার উপর সামদানীদের প্রিয়পাত্রী ; জেরিনের জন্য এমন চরিত্র ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আপাতত এর কিছু দোষ বাড়ানো যাক।সোহরাবকে আপাতত সোহরাবকে কিছু বলার দরকার নাই,নদী আসুক দেরি করে। সার্ভিসে লাল দাগ পড়লে নিজেই সামলে নেবে। অতিচালাকের গলায় দড়ি।
তুষার ফোন রেখে কাজে মন বসাতে পারলো না, নদী খুব কাঁদোকাঁদো গলায় সাহায্য চাইছিল।শুনে মন খারাপ হয়ে গেছে কিন্তু তুষার কীই করতে পারে?মেয়েটাকে ভালো লাগতো কিন্তু তার জন্য চাকরি রিস্কে ফেলে তো যেতে পারে না। সাহস দেখাতে গেলেও পয়সা লাগে।ওইসব সিনেমাতেই ভালো লাগে। যাক মেয়েটা বেহাত হলো। সবার কপালে কি সবকিছু থাকে?
*****
একদিন পর
নিশি হা করে তাকিয়ে আছে। তার সামনে প্রায় উনিশো আশি সালের একটা মাইক্রোবাস জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে। নিশির কড়া নজরে মনে হলো বাসটা নিজেও কিছুটা বিব্রত।
” বেস্ট সার্ভিস বুঝলে নিশি! সেই ত্রিশ বছর ধরে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে “মবিন হাসিমুখে এমন ভাবে কথা বলছে যেন দিগ্বিজয় করে এসেছেন। “এখনও খুব স্মুথ চলে ”
“এই ভাঙাচোরা খাটারা উড়ে চললেও আমি যাবো না।”
” আরে না খুব ভালো জার্নি হবে ”
” আমি সিওর! জীবনের শেষ জার্নি মেমরেবলই হয় , কারণ এই খাটারা সাতক্ষীরা যেতে যেতে এক এক করে সব পার্টস খুলে পড়বে , ফাটাফাটি এক্সপেরিয়েন্স, থ্যাংকস আ লট ” নিশি রাগে গজগজ করছে।
” আরে যন্ত্রণা,সমস্ত যানবাহন শ্রমিকদের স্ট্রাইক ,খুলনায় নেই এয়ারপোর্ট। যশোর পর্যন্ত গেলেও সেখান থেকেও রেন্ট এ কার নিতে ঝামেলা হবে। বাস তো বন্ধই।এক বড় ভাইকে দিয়ে রিক্যুয়েস্ট করে এইটা ম্যানেজ করসি। ড্রাইভার খুব মাইডিয়ার লোক। ”
গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো কালো চিমড়েমারা লোকটাকে বিশিষ্ট গঞ্জিকাসেবী লাগলেও মাইডিয়ার লাগলো না।
নিশি থমথমে গলায় বলল ” এই গাড়িতে আমি, মা কেউইই উঠবো না”
নিশি মাইক্রোতে উঠতে রাজি নয় শানু দেখা গেল সাতক্ষীরায় যেতেই রাজি নয়। বিশাল কেওস হবে, তিনি কোন অবস্থাতেই সেটার অংশ হতে চাচ্ছেন না। নিশির হুট করে কান্না পাচ্ছে৷ নদী গাধীটাকে ইচ্ছে হচ্ছে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেয়। কোন দু:খে ওই দোজখে গেল? গতকাল পর্যন্ত অসম্ভব আতঙ্কে কেটেছে, বিয়ে হয়ে গেছে নাকি জানতো না ।
সন্ধ্যার পর জানা গেল যে এখনো হয়নি। মআ কল দিয়েছিলো বড়মামির কাছে, জানতে পেরেছিল পরিস্থিতি একই রকম আছে, শাহিন পাগলটা পিস্তলের ভয় দেখিয়ে পুরাবাড়ি কব্জা করে বসে আছে, মেয়েপক্ষকে বলেছে বিয়ে হবে না। এদিকে নদীর শরীর খারাপ, ডাক্তার বলেছে ভাইরাল ফিবার। এই কথা শুনে শাহীনের বিয়ের পাগলামি কমেছে । ভয় হলো রানুখালার কথায় মনে হলো তিনি কেমন রাজি রাজি। নিশি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পৃথিবীর উল্টে গেলেও এখন তাকে সাতক্ষীরা যেতেই হবে। যে করে হোক গাধীটাকে ওখান থেকে আনতে হবে । এদিকে বাসের টিকিট নেই, রেন্ট এ কারও নেই, আর মাও যাবে না মেয়েকেও যেতে দিবেন না । পুরো একটা বেলা মাকে বুঝিয়ে লাভ হলো না। ক্লান্ত হয়ে নিশি মায়ের সাথে তর্ক ক্ষান্তি দিলো।মেয়েকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শানু বাথরুমে গেলে একটা ছোট লাগেজ নিয়ে নিশি সাবধানে বিকালের দিকে বেরিয়ে এলো।
হোটেলের নিচে দেখা গেল মবিন আরেকটা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
” এটার অবস্থা ভালো, টু থাউজ্যান্ড প্রাডো। ”
” মা যাবে না, আমি যাব একা নিতে পারবে আপনার মাইডিয়ার ড্রাইভার ? ”
” পারবে যদি ড্রাইভারের ওপর বিশ্বাস থাকে ” মবিন হাসলো।
নিশি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো , ” আপনার গাড়ি?
” উহু আমার আব্বার, চালাবো আমি যদি বিশ্বাস থাকে। তুমি মনে হয় তোমার বোনটাকে খুবই ভালোবাসো।ওর কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছ, বাইরে থেকে নিজেকে শক্ত দেখাও অথচ ভেতরে ইমোশনের ভান্ডার। ”
নিশি আর কথা বাড়ালো না গাড়িতে উঠে বসলো। সামান্য যা দ্বিধা ছিলো মবিন গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে কাটিয়ে দিলো। শানুকে ফোন করলো এবং জানিয়ে দিলো তার সাথে নিশি যাচ্ছে। সাথে নিজের বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নাম্বারও দিয়েদিলো সিকিউরিটি হিসেবে৷ শানু রাগবশত মেয়ের সাথে কথাই বললেন না।
নিশিরও কথা বলতে ইচ্ছে হলো না।নিজের মায়ের এই স্বার্থপর রূপটা তৃতীয় কারো সামনে উন্মোচন করার আগ্রহ হচ্ছে না। মবিন গাড়ি নিয়ে মহাসড়ক দিকে এগোচ্ছে।নিশির এত বিরক্ত লাগছে যে ক্রমাগত আসা ওভারসিজ ফোন কলও ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ফোনকল বারবার কেটে দিয়েও একজন ক্লান্তিহীন ভাবে চেষ্টা করেই যাচ্ছে। একসময় বাধ্য হয়ে রিসিভ করলো, ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠে ইংলিশে বলছে
” হ্যালো এটা কি নিশি?আমি গ্যাব্রিয়েল ”
” ওহ আচ্ছা, বল তুমি কেমন আছ? ” নিশি বিরক্ত চেপে সৌজন্য দেখালো।
” আমি দারুণ কিন্তু একটা প্রবলেম হয়েছে, আশা করি তুমি আমায় সাহায্য করতে পারবে ”
” গো আ হেড বাবুর্চি একটু তাড়াতাড়ি বল ”
” গত দুইদিন ধরে আমি মেহরোজের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না,আসলে আমার খুব কনফিডেনসিয়াল একটা পেপার কালেক্ট করতে সে খুলনা গিয়েছিল।ভুল করে ওর লাগেজে চলে যায়। সেটার জন্য বাবা অপেক্ষা করছে। জরুরি কাগজ। তুমি তার ফ্যামিলি, এ জন্যেই জানতে চাচ্ছি,ও কি ঠিক আছে?
” ওয়েট এ মিনিট, নদু তোমার দেয়া এসাইনমেন্টে সাতক্ষীরা গিয়েছিল? ”
” হ্যাঁ, ও বলল যে দুইদিনের মধ্যে ফিরে আসবে। গিয়ে কল করেছিল কাগজ গুলো তখনও ওর সাথে ছিলো। কিন্তু এখন আর কোন খবর নেই ফোনও বন্ধ আমার ভয় হচ্ছে কাগজগুলো নিয়ে ও কোনো রিস্কে পড়লো কিনা ”
নিশি ততক্ষনে উত্তেজিত ” ইউ বাবুর্চি কা বাচ্চা!সো ইউ আর দ্যা কালপ্রিট হিয়ার, তোমার র জন্য নদু ওই হাবিয়া দোজখের আটকে গেছে! ”
“নিশি এত ফাস্ট বাংলা আমি বুঝি না, এর মানে কী? ”
” মানে তোমার কাগজ উদ্ধার করতে গিয়ে নদু মহাবিপদ ডেকে এনেছে । কিছু বোঝা গেলো? ওর লাইফ বিরাট ঝুঁকিতে। তুমি বললে পাহাড় থেকেও ঝাপ দেবে ”
” বুঝলাম না কি বলছ, আমার পেপারসগুলো কোন রিস্কে কি আছে ”
” আরে জাহান্নামে গেছে তোমার পেপারস। আমার বোন বাঁচে নাকি তার নাই ঠিক! ওকে হস্টেজ করে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে আমার ফ্যামিলি। এই কয়দিনের মধ্যে যদি আমার বোনের কিছু হয়, তো শুনে রাখ বাবুর্চি, আমেরিকা এসে তোমার ঠ্যাং কেটে কাবাব বানিয়ে তোমাকেই খাইয়ে দেবো ”
নিশি ফোন রেখে দিলো। ওপাশে রম্য হতভম্ব হয়ে বসে আছে। এই আধাপাগল মেয়েটা কি বলে? মেহরোজের বিয়ে? মানে কী!
(চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম