মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-৬৪+৬৫+৬৬

0
562

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬৪

মীরা কলেজ জীবন পার করে ভার্সিটিতে এডমিশনের প্রিপ্রারেশন নিচ্ছে। মাঝে কিছুটা সময় কেটে গেছে। মীরা কলেজ থেকে ভার্সিটিতে যাবে এটাই যা পার্থক্য। কিন্তু তার চরিত্রে এতটুকুও পরিবর্তন আসেনি। পরিবারের কাছে মীরা আগে মতোই বাচ্চা মেয়ে। জায়িনের কাছে সে আগের মতোই অভিমানী। ওদিকে জায়িনও ইন্টার্নি শেষ করে ডক্টর হয়ে গেছে। মুবিন এখন জানা মানা সেলিব্রিটি। হাজারো মেয়েদের ক্রাশ। মুবিনের মেয়ে ভক্তদের নিয়ে মাহিমার হিংসার শেষ নেই। তার এখন আফসোস হয়, কেন মুবিন সেলিব্রিটি হলো। সেলিব্রিটি না হলে এত মেয়েরা তার বয়ফ্রেন্ডের উপর নজর দিত না। মাহিমার হিংসা ও জেলাসি দেখে মুবিনের মজাই লাগে। সে মাহিমাকে রাগানোর এতটুকু সুযোগও ছাড়ে না। মাহিমা বেচারি ঝগড়া করতে করতে একপর্যায়ে কেঁদে ফেলে। মুবিন তখন ভালোবেসে প্রিয়তমাকে বুকে টেনে নেয়।
জায়িনের আজ ঘুম ভাঙতে প্রতিদিনের থেকেও একটু বেশি দেরি হয়ে গেল। আজ ছুটির দিন থাকায় কাল পুরোটা রাতই মীরার সাথে কথা বলতে হয়েছে। ফজরের আজান কানে আসতে মীরা মাথায় হাত দিয়ে বলেছে,

“হায় আল্লাহ! সকাল হয়ে গেছে! আমি আজ সারাদিন কাটাব কীভাবে? একটুও তো ঘুমাইনি।”

“এখন তো কলেজ নেই। পড়াশোনার প্যারাও নেই। দিনে ঘুমোবে।”

“কীভাবে? বলেছিলাম না আজ বড় ফুপুরা আসবে। আমাকে সারাদিন ঘুমাতে দেখলে লাথি দিয়ে জাগাবে।”

হাই তুলতে তুলতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো জায়িন। কয়টা বাজে এখন? দেয়াল ঘড়ির দিয়ে তাকিয়ে আঁতকে উঠতে হলো। বারোটা বাজে? এতবেলা পর্যন্ত সে জীবনেও ঘুমায়নি।
আজ মা-ও ডাকেনি। জায়িন মা’র খোঁজ করতে লাগল।

“মা। মা।”

জায়িন ডেকে যাচ্ছে কিন্তু মা কোন সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। বাড়িতে কি কেউ নেই? জায়িন মা’র ঘরে এসে কাউকে পেল না। মুবিনের ঘরও খালি। মা হয়তো খালামনির ওখানে গেছে। জায়িন দরজা খুলতে গিয়ে বুঝল তাকে বাইরে থেকে আটকিয়ে মা চলে গেছে।

“যা! মা আমাকে ডাকলো না। উল্টো বাইরে থেকে আটকিয়ে চলে গেল!

….

চাচী কী পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। এভাবে এত বড় মেয়েকে কেউ বাড়ি থেকে বের করে দেয়! রাগের মাথায় যা খুশি করে বসলেই হলো! শেষে মানুষের অপবাদ, কটুকথা কাকে শুনতে হবে? সমস্যা যা-ই হোক। ঠান্ডা মাথায় বসে সমাধান বের করতে হবে। রিমু তো এখন আর ছোট নেই। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার বয়স হয়েছে ওর।
সকালে মা রিমুদের বাড়িতেই গিয়েছিল। রিমুর সম্পর্কের কথা বাড়িতে জানলে চাচী রাগারাগি করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মা রিমুকে সাথে করে নিয়ে আসে। এখন জায়িন রিমুদের বাড়ি যাচ্ছে। জায়িন বুঝিয়ে বললে হয়তো চাচী বুঝবে। ছেলে নেই বলে জায়িনকেই ছোট থেকে ছেলের মতো আদর স্নেহ করেছে। আর যা-ই হোক জায়িনের কথা তিনি ফেলতে পারবেন না। জায়িন শার্ট চেঞ্জ করে নিয়ে রিমুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল। হলরুমে বেরিয়ে শুনতে পেলো মা’র ঘরে মীরার গলা শোনা যাচ্ছে। সে যেতে যেতেই শুনলো। মীরা বলছে,

“এলাকার ছেলেছোকরা যাদের ভাই ডাকি তাদেরই প্রেমিক হিসেবে কল্পনা করতে গেলে গা গুলায়। আর তুই আপন মামাতো ভাইয়ের সাথে চক্কর চালিয়েছিস! কেন রে? দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব পড়েছিল? জীবনে অনেক পাপ করেছি। কিন্তু চাচাতো মামাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করার কথা ভাববার মতো পাপও করিনি। এতে ভাই ডাকটার পবিত্রতা ক্ষুন্ন হয়।”

জায়িনের পা থেমে গেল। কপালের মাঝ বরাবর সূক্ষ্ম তিনটা ভাঁজ পড়েছে। না চাইতেও মীরার কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। এভাবে লুকিয়ে কারো শোনা অন্যায়। তবে মীরা কী ভাবে তা জানতে হলে এই অন্যায়টা করতেই হবে। মীরার পরে মাহিমার গলা শোনা যাচ্ছে।

“আমার তো কোন চাচা, ফুপুও নেই। বাপের চাচাতো ভাই চার চাচার সব মেয়ে। মামাতো ভাই একটা আছে। ইভান ভাই। ওকে তো আমি আমার মায়ের পেটের আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসি। সম্মান করি।”

“তোর মামাতো ভাই হারামিটাই বা কেমন বজ্জাত রে! বোনকে আবার প্রপোজ করে কীভাবে? সব দোষ ওই খবিশটার। আমাদের ভাই গুলা দুনিয়া উল্টে গেলেও এমন করতো না। করতো রে মাহি?

“নাহ। মরে গেলেও না। সবাই কি আর ইভান, আবির ভাইয়ার মতো। আজকাল মুভি, ড্রামাতে কাজিন লাভ স্টোরি গুলো দেখে দেখেই এদের মাথা খারাপ হয়েছে। মনে পাপ ঢুকে ছ্যাড়াব্যাড়া কারবার।”

জায়িনের ঠোঁটের কোণে কৌতুকের মিহি হাসির রেখা দেখা দিল। ডান ভ্রু উঁচিয়ে ভাবল, তাই নাকি? নিজের ভাইকে নিয়ে এত বড়াই! রিমুকে এখন তো বড়ো বড়ো ভাষণ দিচ্ছে। অথচ ভাই চোখের সামনে তনির সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। জায়িন আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল।
ওরা রিমুকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিল। এখন রিমু ওদের কথা শুনে গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল। নাক টানতে টানতে বলল,

“তোরা কি আমাকে অপমান করছিস? তোরা না আমার বান্ধবী! আমি কি ইচ্ছে করে ভালোবেসেছি। কীভাবে কীভাবে যেন ভালোবাসা হয়ে গেছে। বিশ্বাস কর আমি জানি না কীভাবে হয়েছে। কিন্তু হয়ে গেছে।”

মীরা রিমুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আফসোসের স্বরে বলল,

“না বুঝে হয়েছে? তাহলে তো আর কিছু করার নাই। থাক তুই কাঁদিস না।”

মাহিমা টেবিলের উপর থেকে টিস্যু বক্স টেনে নিয়ে রিমুকে টিস্যু দিতে দিতে বলল,

“আচ্ছা তুই কাঁদিস না। আমরা তোকে কাঁদানোর জন্য এসব বলিনি। আমরা তোর সাথেই আছি। আন্টিকে আমরা বুঝাবো।”

“মা মানবে না রে। মা’কে কেউ বোঝাতে পারবে না।”

“কেন? ভাইয়ের সাথে আন্টির সম্পর্ক ভালো না?”

“সম্পর্ক ভালো বলেই তো নষ্ট হওয়ার ভয় পাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে নতুন সম্পর্ক গড়লে পুরোনো সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”

মীরা বিরক্ত হয়ে বলল,

“দূর! এসব কোন যুক্তির কথা না।”

সিঁড়ির নিচের অন্ধকার জায়গাটায় জায়িন মীরার কনুই ধরে টেনে আড়ালে নিয়ে এলো। আকস্মিক এই কাণ্ডে মীরা ভয় পেয়ে গেছে। মানুষটা কে তা না দেখেই সে চিৎকার দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ওই মানুষটা তার মুখ চেপে ধরলো। চিৎকার গলার ভেতরেই আটকা পড়লো। শক্ত-সামর্থ্য হাত। ধস্তাধস্তি করেও ছুটানো যাচ্ছে না। জায়িন মীরাকে ঠেলে আলোতে নিয়ে এলে মীরা ওকে দেখে যেন একটু স্বস্তি পেল। ছটফটানি কমিয়ে দিল। জায়িন তীক্ষ্ণ চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,

“এলাকার যাদের ভাই ডাকো তাদের প্রেমিক হিসেবে ভাবতে গা গুলায়? তার মানে কথাটা ইনডিরেক্টলি কাকে বললে? আমাকে প্রেমিক ভাবতে তোমার গা গুলায়! গা গুলানোর মতো তেমন কোন কাজ তো আজ পর্যন্ত করলামই না। তার আগেই গা গুলাগে বাকি দিনগুলো কীভাবে যাবে?”

এই লোক এসব কথা কখন শুনেছে? এত বড় চাপাটা তো মীরা রিমুর সামনে মেরেছিল। হায় কপাল! কেন যে যমের বাড়িতে বসে এসব কথা বলতে গিয়েছিল!

“আমার বোনটাকে অসহায় পেয়ে তখন দুই বোন মিলে যা যা বলেছ সব শুনেছি আমি। আমার সামনেও বলো। আর কী কী বলার বাকি আছে?”

মীরা কথা কীভাবে বলবে? মুখ চেপে ধরে রেখে বলছে, কথা বলো। সীমার একটা ফাজলামি থাকে। দূর গা গরম না তবুও জ্বরের মুখে উল্টাপাল্টা বলছে। কথাটা ফাজলামির একটা সীমা থাকে।

“কী হলো বলো। আমি তো তোমার প্রেমিক। তবুও তো আমাকে দিনেদুপুরে ভাই ডেকে যাচ্ছ। আমাকে ভাই ডেকেও আমার সাথে প্রেম করতে তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ভাই ডাকছো আবার চুমুও খাচ্ছো। যখন তখন জড়িয়েও ধরছো। এই এক বছরে ঠিক কতটা চুমু খেয়েছ হিসেব দিতে পারবে?”

এসব বলে মীরাকে অপমান করছে! কত বড় সাহস। মীরা মুখ খুলতে গিয়েও বাধা পেলো। শেষে জায়িনের হাত কামড়ে দিয়ে নিজেকে ছাড়ালো।

“আপনি কি চুমু খাওয়া নিয়ে আমাকে খোঁটা দিচ্ছেন? আপনি নিজেও কি আমাকে জড়িয়ে ধরেননি? চুমু খাননি? আমি কি কোনোদিনও খোঁটা দিয়েছি?”

“তুমি খোঁটা দিতে পারবে না। কারণ আমি তোমাকে মোটেও বোনের চোখে দেখি না। তোমাকে প্রেমিকা ভাবতে আমার গা গুলায় না।”

একটা কথা নিয়ে লোকটা কীভাবে তাকে টিটকারি দিচ্ছে। মুখ ফসকে নাহয় বলেই ফেলেছে। তাই বলে এই কথাকে এত বড় করে দেখার কী আছে?

“চাপা মারতে গিয়ে ওই কথাটা নাহয় বলেই ফেলেছি। তাই বলে আপনি এই কথাটা নিয়ে আমার সাথে এমন করবেন?”

মীরার অভিমানী বাচ্চা বাচ্চা মুখটা দেখে জায়িন রাগ করে থাকার ভাণটাও করতে পারলো না। মীরার মুখের কাছে এগিয়ে এসে আদুরে গলায় বলল,

“তুমি তোমার কোন বান্ধবীকেই এখন পর্যন্ত আমাদের কথা জানাও নি। আমার সব বন্ধুরা কিন্তু তোমার কথা জানে।”

মীরা আঁতকে উঠলো। বলে কী এই লোক! তার মানে আবির ভাইও জানে! আল্লাহ আল্লাহ। আবির ভাইয়া বাড়িতে বলে দিলে তার কপালে শনি আছে। জায়িন মীরার মুখ দেখেই বুঝে গেল। মীরা মুখ খোলার আগেই বলল,

“ভয় নেই। আবির জানে আমি প্রেম করছি। কিন্তু আমার গার্লফ্রেন্ডটা যে তার আদরের বোন সেটা জানে না। তুমি চাও না বলেই বলিনি।”

“ভালো করেছেন। আবির ভাইয়ের পেটে কথা থাকে না। আর তার থেকে বড় কথা আবির ভাই জেনে গেলে আমি লজ্জা পাবো। ওর বন্ধুর সাথে প্রেম করছি জেনে গেলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবো না।”

“কিন্তু একসময় না একসময় এমন একটা দিন তো অবশ্যই আসবে যখন সবাইকে জানাতে হবে। তখনও কি তুমি লজ্জা পেয়ে না জানিয়েই থাকবে?”

“সেই দিনটা আসুক তখন দেখা যাবে। এখন কয়েক বছর চুরিচুপিই প্রেম চালিয়ে যেতে চাই।”

“আমার অবশ্য চুরিচুপি প্রেম করতেও কোন আপত্তি নেই। এবং এভাবে দেখা করা, কথা বলার মাঝেও একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করে।”

“আপনি তো রিমুর আম্মুর সাথে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কী হলো? আন্টিকে মানাতে পেরেছেন?”

“আন্টি না চাচী শ্বাশুড়ি বলো।”

“দূর মজা না। রিমু কিন্তু ওর মা’কে নিয়েই সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে।”

জায়িন মীরার কপালে চলে আসা চুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলল,

“প্রেম করার সময় মায়ের ভয় ছিল না? মেয়ে গুলো এত ভীতু হয় কেন বলো তো?”

মীরা চোখ পাকিয়ে তাকালো। মেয়েগুলো ভীতু হয় বলতে সে-ও তো ভীতু।

“মেয়েরা মোটেও ভীতু না। মেয়েরা পরিবারের সম্মানের কথা ভাবে। যা ছেলেরা ভাবে না।”

“তাই নাকি?”

“জি তাই।”

“তাহলে বলতে চাচ্ছ তুমি ভীতু না?”

“জি না মশাই।”

“ওকে প্রমাণ দাও। চট করে এক্ষুনি আমাকে চুমু খেতে পারলে মেনে নিব তুমি অনেক সাহসী। আর হ্যাঁ, চুমুটা কিন্তু কপালে গালে খাওয়া যাবে না।”

অসভ্য লোক। সারাক্ষণ চুমু খাওয়ার ধান্দা। মীরা জায়িনের পা মাড়িয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। বজ্জাত বেটা তোমার কপালে এটাই লিখা আছে। এই এক বছরে মীরা এক নতুন জায়িনকে আবিষ্কার করেছে। প্রথম দিকে আন রোমান্টিক বললেও এই ব্যাটার রোমান্টিকতা দেখে শেষে মীরার জ্ঞান হারানোর দশা। মানুষের সামনে কম কথা বলা ছেলেটা যে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কত কথা বলে তা যদি মানুষ জানতো।

চলবে

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬৫

রিমু বাড়ি ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। জায়িন তাকে আস্বস্ত করেছে চাচী কিছু বলবে না। তবুও রিমু বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে না।

“না জায়িন ভাই। আমি বাড়ি যাব না। বাড়ি গেলেই মা আবার মারবে।”

“আরে পাগল, মারবে কেন? আমি চাচীর সাথে কথা বলেছি। কিছু বলবে না তোকে।”

“তোমার সামনে বলেছে কিছু বলবে না। কিন্তু আমি তো আমার মা’কে চিনি। বাড়ি গেলেই মা মারবে।”

জায়িন এই পাগলকে বোঝাতে ব্যর্থ। এত বড় মেয়ে মায়ের মারকে ভয় পাচ্ছে। আর চাচীও কম না। এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলতে হবে কেন? সুমনা রিমুর জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। মেয়েটা এখানে আসার পর থেকে কিছু খায়নি। সুমনা রিমুর পাশে বসতে বসতে বলল,

“থাক, তোকে বাড়ি ফিরতে হবে না। একটা মেয়েকে আমি পালতে পারব। তোর বাপ মায়েরও একটু শিক্ষা হোক। এখন খেয়ে নে তো মা।”

“খাবো না জেঠিমা। খিদে নেই।”

“উঁহু, খিদে নেই বললে তো হবে না৷ খিদে না থাকলেও খেতে হবে। আমি খাইয়ে দেই?”

মুবিন তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মা’কে রিমুর এত খাতির যত্ন করতে দেখে বলল,

“আমাদের বাড়িতে খুঁটি গেড়েছিস কেন ভীতুর ডিম? মাকে এত ভয় তাহলে ভালোবেসেছিলি কেন? তখন কি মা’র ভয় ছিল না?”

সুমনা চোখ পাকিয়ে ছেলের দিকে তাকাল। এমন কথা কেউ সরাসরি বলে? মুবিন মা’র চোখ রাঙানোকে পাত্তাই দিল না। সে বলতে থাকল,

“তোদের মতো মেয়ে গুলার সাথে যে কোন ছেলে প্রেম করতে আসে!”

সুমনা রাগী গলায় বলল,

“মুবিন, কী হচ্ছে কী? ছোট বোনের সামনে কেউ এসব কথা বলে!”

“আহ মা! তুমি এখনও সেকেলের রয়ে গেলে। এখন যুগ পাল্টেছে। সিক্স সেভেনের পোলাপানও প্রেম ভালোবাসা বুঝে। এই গাধাটা তো কয়দিন পর ভার্সিটি যাবে। এর সামনে আর লজ্জা কী?”

জায়িন রুমে গিয়েছিল। ফিরে এসে সবার সাথে বসে টিভি অন করে দিল। মুবিনও ভাইয়ের পাশে বসতে বসতে বলল,

“রিমু প্রেম করছে শুনে চাচী যে রিয়াকশন দিয়েছে, তোমার ছেলেরা প্রেম করছে জানলে তুমিও কি এমন করবে?”

মুবিনের কথা শুনে জায়িনের কাশি উঠে গেল। এই ছেলের লাজলজ্জা সব চলে গেছে নাকি? সুমনা তীক্ষ্ণ চোখে মুবিনের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে বলল,

“আমি কেন এমন করব? আমি তো আরও খুশি হবো। আমার ছেলেরাও প্রেম করতে পারে এটা আমার কল্পনাতীত বিষয়। আমি খুশি খুশি তোদের পছন্দ করা মেয়েকে বউ করে নিয়ে আসব। তোদের পছন্দের কেউ আছে নাকি বলে দেখ আমি মেনে নিই কি নিই না।”

মুবিন হাসতে হাসতে জায়িনের দিকে তাকাল। ভাইয়ের দিকে তাকিয়েই বলল,

“পছন্দের কথা বললেই কী? বড় ভাইয়ের আগে তো তুমি আমাকে বিয়ে করাবে না। ভাইয়ার পছন্দ আছে নাকি আগে সেটা জানো। ভাইয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমি দু’দিনও দেরি করব না।”

মুবিন সুমনার মনোযোগ এক সেকেন্ডে জায়িনের দিকে ঘুরিয়ে দিল। জায়িন পড়ে গেল অস্বস্তিতে। মুবিনটা মাঝে মাঝে যা করে! কিছু বলার ভাষা রাখে না। রিমু নিজের সমস্যার কথা ভুলে গিয়ে জায়িনের কথা জানতে উৎসুক হয়ে উঠল। মুবিন মনে মনে হাসছে। তার ভাইটা নিজেকে অনেক চালাক মনে করে। কিন্তু ভাই কি জানে, সে ডালে ডালে চললে তার ছোট ভাই পাতায় পাতায় চলে। মীরার সাথে ভাইয়ার কী চলছে তা মুবিন ভালো করেই জানে। তলে তলে দিব্যি প্রেম করে যাচ্ছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। মুবিন মুচকি হেসে জানতে চাইল,

“বলো ভাইয়া। তোমার পছন্দের কেউ থাকলে তো কাজ সহজ হয়ে গেল। নইলে আমাদের কষ্ট বাড়বে। মেয়ে খুঁজতে হবে। আজকালকার যুগে ভালো মেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিনই না, অসম্ভব কাজ।”

রিমুও কৌতূহল গলায় জিজ্ঞেস করল,

“তোমার পছন্দের কেউ আছে ভাইয়া? থাকলে আমি জেঠি মা’কে নিয়ে মেয়েটাকে দেখতে যাব। তোমার পছন্দ নিশ্চয় অসুন্দর হবে না।”

সুমনাও ছেলেকে ঠেলছে।

“কিরে বল। ভালো মেয়ে তো তোদের জন্য বসে থাকবে না। বিয়ের বয়স কি হয়নি? আর কবে বিয়ে করবি? আমারও তো দাদী ডাক শোনার ইচ্ছে আছে নাকি?”

মুবিন ভাইকে বেকায়দায় ফেলে মজা নিচ্ছে। জায়িন ভালো করেই বুঝতে পারছে মুবিন ইচ্ছে করে মা’কে তার পেছনে লাগিয়েছে। এবং এটাও বুঝতে পারছে মা এত সহজে তার পিছু ছাড়বে না। জায়িন নড়েচড়ে বসে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,

“এখন আমি বিয়ে করছি না মা। এসব কথা কেন উঠছে?”

সুমনা তেতে উঠে বলল,

“এখন বিয়ে করবি না তো কবে করবি? বুড়ো হলে করবি? পড়াশোনা শেষ করেছিস। ডাক্তারি করছিস। এটাই বিয়ের উপযুক্ত সময়।”

মা’র সাথে মুবিনও তাল মেলালো।

“মা তো ঠিকই বলছে ভাইয়া। অপেক্ষাটা কিসের জন্য করছো তুমি?”

রিমু মুবিনের থেকেও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল,

“আমার অনেকগুলো বান্ধবী আছে। সবগুলাই পরীর মতো সুন্দর। আমার একটা বান্ধবীকে বিয়ে করে নাও না ভাইয়া। অনেক মজা হবে। ননদ ভাবী মিলেমিশে থাকব। আমার তো ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে।”

মুবিন হাসতে হাসতে বলল,

“তুই তোর বান্ধবীদের থেকেই কাউকে ঠিক কর রিমু। এটাই ভালো হবে। মেয়েও জানাশোনা থাকল। আর বিয়ের পর তোর সাথে ঝগড়াও করবে না। তোর সবগুলো বান্ধবীর নাম বল তো শুনি।”

জায়িনের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। এরা কিছু না জেনেই এতদূর এগিয়ে গেছে। মীরার কথা জানলে না জানি কী করত! রিমু একদমে বান্ধবীদের নাম বলে যাচ্ছে।

“সীমা, রিমা, মিলি, সানজি, স্নেহা, জান্নাত।”

মুবিন মনে মনে গাধাটাকে গালি দিল। দুনিয়ার সব মেয়েদের নাম বলে ফেলেছে। কিন্তু আসল মানুষের নামটাই বলছে না।

“একয়টায়! আর নেই?”

“ওহ, মীরা মাহিমাও তো আছে। কিন্তু ওরা বাদ।”

জায়িন এপর্যায়ে আর এদের মাঝে বসে থাকতে পারল না। সে ঝট করে দাঁড়িয়ে দ্রুত রুমে চলে গেল। মুবিন চোখ পাকিয়ে রিমুর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলছে,

“ওরা বাদ যাবে কেন? যাদেরকে আমরা দুই ভাই এবাড়ির বউ করার কথা ভাবছি, তুই তাদেরকেই লিষ্ট থেকে বাদ দিচ্ছিস। এজন্য তোর জীবনে বিয়ে হবে না। তোর গাধা মামাতো ভাইটার সাথে যদিও বিয়ে ঠিক হয় আমি নিজে ভেঙে দেব। গাধা তুই চাচীর হাতের লাঠি খেয়ে মানুষ হ। ভাইদের পছন্দ বুঝিস না তুই কেমন বোনরে!”

সুমনাও ভাবছে মীরাকে তার ভীষণ পছন্দ। জায়িনের জন্য মীরাকে যে মনে মনে ভাবেনি এমন না। অনেকবারই ভেবেছেন। কিন্তু তিনি এটাও জানেন জায়িনের বাবা কোনদিন মীরাকে মেনে নিবে না। তার আদরের বড়ো ছেলের জন্য তো না-ই।

….

বড় ফুপুর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে মীরা মাত্র রুমে এসে জায়িনকে কল করেছে। তার রুমে আসার একটু পরেই ছোট চাচী এলো। মীরা তাড়াহুড়ো করে ফোন বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখল। ছোট চাচীর মুখের দিকে তাকিয়ে ও হাতে ফোন দেখে মীরা বুঝে গেল। সে কঠিন গলায় বলল,

“তুমি আবার ওই মহিলার সাথে কথা বলছো ছোট চাচী? তোমাকে কতবার বলেছি ওই মহিলার সাথে তুমি কথা বলবে না। উনার সাথে আমাদের পরিবারের কারো কোন সম্পর্ক নেই। তবুও কেন উনি বারবার আমাদের বিরক্ত করেন? তুমিই বা কেন ভদ্রতা করে বাইরের একটা মানুষের সাথে কথা বলো।”

ছোট চাচী ফোনের স্পিকার চেপে নিচু গলায় বলল,

“মীরা উনি তোর মা। এভাবে…

মীরা চেঁচিয়ে উঠল,

” উনি আমার মা না। আমার কোন মা নেই। আমি আমার বাবার মেয়ে। এটাই আমার পরিচয়। আর এই পরিচয় নিয়ে আমি অনেক খুশি।”

“মানুষটা এতগুলো বছর ধরে একটা বার শুধু তোর সাথে কথা বলতে চায়।”

“কেন? যে আমার কেউ হয় না, তার সাথে আমি কেন কথা বলবো? কিসের টানে উনি আমার সাথে কথা বলতে চান? উনার ছেলেমেয়ে নিয়ে কি উনি খুশি নেই? আমার কথা কেন উনার মনে পড়ে।”

মীরার চেঁচামেচি শুনে নিচে থেকে সবাই চলে এলো। মীরাকে কাঁদতে দেখে বড় ফুপু অস্থির হয়ে পড়লেন।

“একি, তুই কাঁদছিস কেন মীরা? কী হয়েছে আমার মা’র?”

মীরা কাঁদতে কাঁদতে বড়ো ফুপিকে জড়িয়ে ধরল। উনার বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে লাগল। বড় ফুপু মীরার মাথায় হাতে বোলাতে বোলাতে জানতে চাইল,

“কী হয়েছে মা? আমাকে বল। মীরার কী হয়েছে ভাবী? কাঁদছে কেন ও? একটু আগে তো ভালোই ছিল।”

পরিস্থিতি অনেকটাই হাতের বাইরে চলে গেছে। ছোট চাচীকে না চাইতেও বলতে হলো। ফোনে মীরার মা আছে শুনেই বড়ো ফুপু অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। ছোট চাচীর থেকে ফোন ছিনিয়ে এনে বলতে লাগল,

“লজ্জা নেই তোমার? কোন মুখে মেয়ের সাথে কথা বলতে চাও? এত বছর দূরে থেকে মেয়ের প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠেছে বুঝি? তাই তো নির্লজ্জের মতো এখানে ফোন করেছ। তোমার মতো মহিলাদের তো মরে যাওয়া উচিত। দুই বছরের দুধের শিশুকে ফেলে যে চলে যেতে পেরেছে তাকে অন্তত মা বলা যায় না। তোমার তো আরও দুইটা সন্তান আছে। ফেলে যাওয়া মেয়ের জন্য হঠাৎ এত ভালোবাসা কেন জেগেছে? খবরদার বলে দিচ্ছি। আর কোনদিন তুমি মীরার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আমার ভাইঝি তোমাকে ছাড়াই অনেক ভালো আছে। তার জীবনে তোমার প্রয়োজন নেই।”

বড়ো ফুপু নিজের কথা বলে ওপাশের মানুষটাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দিল। ছোট চাচী কেন এখনও ওই মহিলার সাথে যোগাযোগ রেখেছে এজন্যও অনেক রাগারাগি করলো। মীরা ফুপির বুকে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,

“আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই না। আমি এটাও শুনতে চাই না উনি আমার মা। আমার ভীষণ কষ্ট হয় ফুপি। ভীষণ কষ্ট হয়। ছোটবেলা আমারও তো মা ডাকতে ইচ্ছে করত। আমারও তো মায়ের ভালোবাসা পেতে মন চাইত। প্রিয়া আপু, তনি আপু, ইভান ভাই, রুমশি, আবির ভাই, মাহিমা, মাহা সবার মা আছে। আমার কেন মা নেই? আমার কপালটা এত খারাপ কেন?”

“কে বলেছে তোর কপাল খারাপ? তোর কপাল মোটেও খারাপ না মা। তোর তো দুইটা মা আছে। তোকে ভালোবাসার জন্য তোর দুইটা ফুপু আছে। তুই আমাদের সবার কলিজার টুকরা রে মা। তোকে আমরা কতটা ভালোবাসি তুই হয়তো জানিস না। তুই কেন ওই মহিলাটার জন্য কেঁদে আমাদের কষ্ট দিবি। তোকে কাঁদতে দেখলে যে আমাদের সবার ভীষণ কষ্ট হয়। কাঁদিস না রে মা।”

মীরার কান্না থামছে না। তার জীবনে কোনকিছুর অভাব নেই। শুধু একটা জিনিসেরই অভাব। সবাই তাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। কিন্তু মীরা যার ভালোবাসা চেয়েছিল সেই মানুষটাই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সবসময় সে হাসিখুশি থাকে। কিন্তু এই একটা কথা মনে পড়ে গেলেই নিজেকে সামলাতে পারে না। মানুষটা কেন তার সাথে কথা বলতে চায়? কেন তাকে নিজের মতো ছেড়ে দিচ্ছে না?
জায়িন এতক্ষণ লাইনেই ছিল। তাড়াহুড়ায় মীরা তখন কল কাটেনি। চুপ করে সবটা শুনে চোখ বন্ধ করে বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিল। মীরার কান্না তার বুকের ভেতরটা চুরমার করে দিচ্ছে। এই একটা জিনিস নিয়েই মীরার সব কষ্ট। বাবাও এই জিনিসটার নিয়েই মীরাকে পছন্দ করে না। মীরা যেদিন জানবে তার মা’র জন্য জায়িনের বাবা তাকে মেনে নিবে না। সেদিন হয়তো জীবনের সবথেকে বড় কষ্টটা পাবে। না, জায়িন কখনও মীরাকে কষ্ট পেতে দিবে না।

আজ জায়িনের মনটাও বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। কোন কাজেই মন বসছে না। বারবার মীরার কথাই মনে পড়ছে। মীরাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। রোগী দেখায় এই প্রথম সে উদাসীনতা প্রকাশ করল। বেরুবার আগে জায়িনের ক্যাবিনে একটি মেয়ে ঢুকে। সে প্রথমে রোগী ভেবেছিল। কিন্তু মেয়েটি যখন বলল,

“আমি আপনার পেশেন্ট না।”

জায়িন তখন ভাবল হয়তো কোন রোগীর আত্মীয়। কিন্তু মেয়েটা তার এই ধারণাও ভুল প্রমাণ করল।

“আমার আপনার সাথে ব্যক্তিগত একটা প্রয়োজন আছে। কোথাও বসে কথা বলা যাবে?”

চলবে

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬৬

মেয়েটা চলে যাবার পরও জায়িন উঠতে পারল না। গভীর ভাবনায় বুঁদ হয়ে বসে রইল। সময় বয়ে যাচ্ছে। মীরার সাথে দেখা করার কথা ছিল। অনেকটা সময় ধরে একা বসে থাকায় ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করল,

“স্যার কিছু লাগবে?”

জায়িনের হুঁশ ফিরল। সে ঘড়ি দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠতে উঠতে বলল,

“না। আমাকে যেতে হবে।”

বলেই জায়িন দ্রুত পায়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল। মীরাকে বলা জায়গাটায় এসে দেখল মীরা আগে থেকেই তার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ জায়িনের দেরি করে আসাতেও মীরা কিছু বলল না। শুকনো মুখে একটু হেসে জিজ্ঞেস করল,

“ডাক্তার সাহেবের সময় নেই তারপরও কেন দেখা করতে চায়?”

মীরার যে মন ভালো নেই এটা তার আচরণেই প্রকাশ পাচ্ছে। অন্য সময় হলে পাঁচ মিনিট দেরি করে আসা নিয়ে বড়সড় ঝগড়া বাঁধিয়ে দিত। আজ ওর একেবারেই ঝগড়া করার মুড নেই। জায়িন মীরাকে বুঝতে দিল না কাল রাতের কথা সে শুনেছে। অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক থাকতে চেয়ে জায়িন অপরাধী মুখে বলল,

“সরি ঝগড়ুটে পাখি। এই নিয়ে অগণিত বার প্রমিজ ভেঙেছি। তবুও আবার প্রমিজ করছি আর কোনদিন দেরি হবে না। আজকেই শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দাও।”

মীরা জায়িনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

“ডাক্তারির সাথে সাথে প্রেমিকার মান ভাঙানোর ডিগ্রীও অর্জন করে রেখেছেন। আজ আমি ঝগড়া করব না। এমনকি রাগও করিনি।”

“বাবাহ! বাঁচালে।”

জায়িন মীরার মুড ঠিক করার জন্য সবরকমের চেষ্টা করে গেলেও মীরা রোজকার মতো মন খোলা ভাবে কোনকিছুই করছে না। ওর হাসিটাও আজ চোখ পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। ঠোঁটেই লেগে আছে। জায়িন মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চাপল।
জায়িন শার্টের হাতা গুটিয়ে গলার উপরের একটা বোতাম খুলে বলল,

“ভীষণ গরম। আইসক্রিম খাবে?”

“আপনি খাবেন। আমি দেখব।”

জায়িন ইচ্ছেকৃত ভাবে অবাক হয়ে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

“তুমি খাবে না? এটা কি আমি ঠিক শুনলাম?”

“না মশাই, আপনার কানে সমস্যা হয়েছে।”

“এমনই তো মনে হচ্ছে। যে মেয়ে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতেও আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরে সে আজ আইসক্রিম খাওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিচ্ছে?”

“আমার গলা খারাপ। এখন আইসক্রিম খেলে গলা পুরোপুরি বসে যাবে। তখন এক/দুই সপ্তাহ চিউচিউ করে কথা বলতে হবে।”

মীরা নিজে জায়িনকে আইসক্রিম কিনে দিল। কিন্তু সে নিজে নিলো না দেখে জায়িনও নিতে চাইল না। তখন বাধ্য হয়ে মীরাকেও নিতে হলো। আইসক্রিম হাতে নিয়েই জায়িন রিকশা ডাকল। মীরা অবাক হয়ে বলল,

“রিকশা করে কোথায় যাব?”

“গার্লফ্রেন্ডকে পাশে নিয়ে শহরটা ঘুরব। যদিও আমার নজর একজনের উপরই আবদ্ধ থাকবে।”

“আজকে আন্টি আপনাকে কী খাইয়ে পাঠিয়েছে শুনি? নাকি দুপুরে উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছেন? কাঠফাটা রোদে এত রোমান্স কোত্থেকে পাচ্ছে? বিকেল বেলাও সূর্যের তাপ কমছে না। আর আপনি তখন থেকে রোমান্টিক কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন।”

“সারাজীবন নিজেই আন রোমান্টিক বেডা মানুষ উপাধি দিয়ে গেলে। এখন রোমান্টিক হলেও তোমার সমস্যা!”

“সারাজীবন! আমি আপনার সাথে প্রেমই তো করছি একবছরে কিছু সময় হবে।”

“ওটা তো কথার কথা বললাম।”

ওরা রিকশায় উঠে বসার পর রিকশা চলতে শুরু করলে মন জুড়ানো মৃদু বাতাস লাগতে লাগল। এতক্ষণে মীরার মন কিছুটা ভালো হয়েছে। জায়িন মীরার হাঁটুর উপর দিয়ে হাত নিয়ে ওপাশে রিকশায় ধরে রেখেছে। যেন ঝাঁকি লাগলেও মীরা পড়ে না যায়। মীরা গভীর ভালোবাসা নিয়ে মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। মুগ্ধ হয়ে দেখতেই থাকল। তার মন খারাপ এটা না জেনেও মানুষটা কীভাবে তার মন ভালো করে দিল। মীরা জানিয়েন একটা হাত জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলল,

“আপনাকে ভালোবাসার জন্য আমার গোটা জীবনটা কম পড়বে।”

….

রাতের খাওয়াদাওয়ার পর স্ত্রী ঘরে এলে জামান হোসেন একটা ছবি বের করে স্ত্রীর সামনে রাখলেন। সুমনা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখে আগ্রহ নিয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করল,

“মেয়েটা কে গো? দেখতে তো বেশ সুন্দর।”

“তোমার পছন্দ হয়েছে?”

“পছন্দ হবে না কেন? কিন্তু মেয়েটা কে?”

“এই মেয়েটাকে তোমার বড়ো ছেলের জন্য পছন্দ করেছি। এখন তো তোমারও পছন্দ হয়ে গেল। ছবিটা জায়িনকে দেখিয়ো।”

মেয়েটাকে জায়িনের জন্য পছন্দ করেছে শুনেই সুমনা সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। তিনি মনে মনে অনেকদিন ধরেই জায়িনের জন্য মীরাকে পছন্দ করে রেখেছেন। কিন্তু সাহস করে এই কথাটা স্বামী বা ছেলে কাউকেই বলতে পারেননি। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে জামান হোসেন জিজ্ঞেস করলেন,

“কী হলো? মনে হচ্ছে আমার কথাটা তোমার পছন্দ হয়নি।”

“তেমন কিছু না। কিন্তু..

” কিন্তু কী? একটু আগেই না বললে মেয়েটাকে তোমার পছন্দ হয়েছে। এখন তাহলে কিন্তু কিসের?”

“আমার পছন্দ দিয়েই তো হবে না। তোমার ছেলেও তো পছন্দ হতে হবে।”

“আমার ছেলের পছন্দ আমি জানি। তাছাড়া আমার পছন্দ আর ওর পছন্দ আলাদা না।”

সুমনার মন সায় দিচ্ছে না। তিনি ইতস্তত করে স্বামীকে বললেন,

“হ্যাঁ গো, শোনো না। আমি বলছিলাম কি, তুমি তো মীরাকে চেনো। অনেক দিন ধরেই মেয়েটাকে আমার…

সুমনার কথা শেষ হওয়ার আগেই জামান হোসেন কঠিন চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। স্বামীর দৃষ্টির সামনে সুমনা পুরো কথা শেষ করতে পারল না। জামান হোসেন কঠিন কন্ঠে বললেন,

” আজ যে কথাটা মুখে এনেছ তা যেন আর কোনদিন তোমার মুখে না শুনি। তুমি খুব ভালো করেই জানো ওই পরিবার আমি কেন পছন্দ করি না। তোমার বোনের মেয়েকে ওবাড়িতে বিয়ে দিয়েছে, তখন আমার কিছু করার ছিল না। কিন্তু আমার ছেলেকে আমি জীবনেও ওই বাড়িতে বিয়ে করাবো না। বিশেষ করে ওই মেয়েটাকে তো না-ই।”

সুমনা স্বামীর সামনে দমে গিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

“মীরার মা ওকে ফেলে চলে গেছে এতে মেয়েটার তো কোন দোষ নেই। ওই মহিলার যদি সন্তানের প্রতি টান না থাকে..

“দোষ ওর বাবার। ওর পরিবারের। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে বিবাহিতা একজন মহিলাকে বিয়ে করেছে। যে মহিলা প্রথম সংসার ছেড়ে আসতে পেরেছে সে দ্বিতীয় সংসারও ছেড়ে যেতে পারবে। ওই পরিবারও ভালোমানুষি দেখিয়ে স্বামী সন্তান ছেড়ে আসা মহিলাকে বাড়ির বউ স্বীকৃতি দিয়েছে কোন বুঝে? ছেলেকে বোঝানো উচিত ছিল। দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছিল! তাই তো শিক্ষা হয়েছে। সমাজের চোখে হাসির পাত্র বানিয়ে ছেলের বউ পালিয়ে গেছে।”

সুমনা স্বামীর সাথে তর্ক করতে চাইল না। এই তর্ক ঝগড়ায় মোড় নিবে। তখন ছেলেরা জানবে। তার থেকে সুমনা রাগে, ক্ষোভে চুপ করে থাকল। জামান হোসেন বললেন,

“মেয়ের বাবা নিজে তোমার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত পরিবার। সবাই দেশের বাইরে সেটেল্ড। এর থেকে ভালো সম্বন্ধ আর হবে না। ছেলের খুশিতে তুমিও খুশি হও। তোমার জন্য এটাই ভালো হবে।”

সুমনা স্বামীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য পাশে শুয়ে পড়ল। মনে মনে বলল,

“ছেলের খুশি কিসে তা যদি তুমি বুঝতে! আমার ছেলেটা তোমাকে খুশি করার জন্য নিজের খুশি বিসর্জন দিয়েছে। এটা তুমি কোনদিনও বুঝবে না।”

…..

রাতুল কিসের জন্য কল করে করে পাগল করে দিচ্ছে? মীরা যথেষ্ট বিরক্ত হলো। ব্রেকআপ হলেই রাতুইল্লাটা তাকে জ্বালাবে। মীরা ইচ্ছে করেই কল তুলল না। ফোন ঘরে রেখে বাইরে চলে গেল। প্রিয়া নিজের সাথে ইভা, তনিকেও মুখে ফেইস প্যাক লাগিয়ে বসিয়ে রেখেছে। মীরা সেখানে উপস্থিত হয়েই বলল,

“তোমরা একা একাই রূপচর্চা করছো? আমাকে একটু ডাকলে না? আমার কি সুন্দর হতে ইচ্ছে করে না?”

দু’চোখে শসা লাগিয়ে তনি উপরের দিকে তাকিয়ে সোফায় শুয়ে আছে। মীরার কথা শুনে মুখ বাঁকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,

“শোকরহীন বান্দা! আর কত সুন্দর হতে চাস? যেটুকু আছিস এরচেয়ে বেশি সুন্দর হলে মানুষ ধলা রোগী মনে করবে।”

“করুক। তবুও আমি ফেস প্যাক লাগাব। প্রিয়া আপু তুমি আমাকে লাগিয়ে দিবে না?”

“কেন দিব না? বোস তুই।”

তনি মীরাকে ক্ষেপাতে বলল,

“একটা কথা জানিস তো? সুন্দরী মেয়েদের জামাই কালা হয়।”

মীরা তনির কথার উত্তরে জোরে মুখ মোচড়াল। মনে মনে বলল,

“তোমাকে আমার জামাই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমার জামাই আমার থেকেও সুন্দর। হুহ্।”

মীরা অধৈর্য বান্দা ফেস প্যাক শুকানো পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারল না। একটু সময় পরেই মুখ ধুয়ে ফেলার জন্য পাগল হয়ে গেল। কিন্তু তনি ধমকে বলল,

“এখন মুখ ধুয়ে ফেললে হাত ভেঙে ফেলব তোর। আগেই না করেছিলাম।”

এখানে বসে সময় কাটছে না। ফোনটা হাতে থাকলে সময় কেটে যেত। মীরা রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে রাতুলের এগারোটা মিসড কল দেখে কল ব্যাক করল।

“কেউ মরেছে? এভাবে কল করছিস কেন? ব্রেকআপের কান্দন কান্দার জন্য যদি ফোন করিস রে হারামজাদা, তাহলে…

“কাঁদবি তো তুই বুচি। আমি যেটা দেখাতে যাচ্ছি তা দেখার পর চোখের জল দিয়ে সাগর বানিয়ে ফেলবি।”

“ফাউ পেঁচাল না পেরে কাজের কথা বলল।”

“অনলাইনে ঢোক। ইনবক্সে একটা পিক দিয়েছি। পিকটা দেখার পর যদি ফোন দিয়ে আমাকে বিরক্ত করিস তাহলে লাথি খাবি। তুই যেমন এতক্ষণ আমার কল ধরিসনি। তেমন আমিও এখন ধরব না।”

“হু যা মর গিয়ে।”

“তুই মর।”

“হুশ ফোন রাখ।”

রাতুলের পাঠানো ছবিটা দেখে সত্যিই মীরার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। ছবিতে জায়িন একটা মেয়ের সাথে বসে আছে। মেয়েটা কে? এই মেয়েকে মীরা জীবনেও দেখেনি। মীরা সাথে সাথে রাতুলকে কল করল। কিন্তু রাতুল কল তুলছে না। মীরা রাগে, টেনশনে নখ কামড়ে খেয়ে ফেলছে।

“রাতুইল্লার বাচ্চা। আমার মনে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তুই এখন কল তুলছিস না। কল তোল। কল তুলরে হারামজাদা। পিকটা তুই কোথায় নিয়েছিস? এই মেয়েটা কে? আমার ডাক্তারের সাথে এই মেয়ের কাজ কী? কাজ থাকলে হাসপাতালে দেখা করত। এটা তো কোন ক্যাফে মনে হচ্ছে। কবের ছবি এটা?”

মীরার ধৈর্য শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলে রাতুল কল তুলল। মীরা প্রথমেই কয়েকটা গালি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“এই পিক তুই কোত্থেকে পেয়েছিস?”

“রাস্তায় পড়ে ছিল কুড়িয়ে এনেছি। কোথায় পাব হ্যাঁ? নিজের চব্বিশ হাজার টাকা দামের ফোনের ক্যামেরা দিয়ে তুলেছি।”

“মেয়েটা কে?”

“তোর সতীন। গাধা, আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? আমি কীভাবে জানব। তোর পেয়ারের ডাক্তাররে জিগা। খুব তো জায়িন ভাই, জায়িন ভাই করিস। তোমার বেডা নাকি তোমারে ছাড়া হুরপরী সামনে এসে দাঁড়ালেও তাকায় না। তাইলে এই মাইয়া কে? একঘন্টার উপরে মেয়েটার সাথে ক্যাফেতে ছিল। আমি পাশের টেবিলেই ছিলাম। কিন্তু ওদের মাঝে কী কথা হয়েছে চেষ্টা করেও শুনতে পারিনি।”

রাতুল জায়িনের সাথে মীরার সম্পর্কের কথা জানে। মীরা বলেনি। রাতুল একদিন জায়িনের সাথে মীরাকে দেখে ফেলেছিল। তার পর থেকেই মীরাকে ক্ষেপানো শুরু। মীরা তবুও স্বীকার করেনি। শেষে রাতুল সবাইকে বলে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে স্বীকার করিয়েছে। এখন জায়িনকে কোথাও দেখলেই রাতুল সেই খবর মীরার কাছে পৌঁছে দেয়।
মীরা কল কেটে চিন্তায় পড়ে গেল। মেয়েটা কে হতে পারে? সামান্য একটা ছবি দেখে সন্দেহ করা ঠিক হবে?

“না না। জায়িন ভাই এমন না। হুদাই উনাকে সন্দেহ করে নিজেই পস্তাবো। মেয়েটা যেকেউ হবে পারে। বন্ধু, কলিগ, রিলেটিভ। আমি শুধু শুধু উল্টাপাল্টা ভাববো না। রাতুলের কাজই তো আগুন লাগানো। নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্ক ঠিক নেই। তাই অন্যের সুখ দেখতে পারে না। হুহ্! জায়িন ভাই শুধু আমাকে ভালোবাসে।”

চলবে