#দ্বিধা_চক্র
পর্ব ১৩
সময় নিরবে বয়ে চলে বলে তার গতির শব্দ শোনা যায় না। কতটা সময় অবনি নিলয়ের বুকে মুখ ডুবিয়ে ছিল জানা নেই। নিলয় জেনেও জানতে চায় না। অবনির চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে, মা যেকোনো সময় চলে আসতে পারে।
অবনি ঝট করে সরে আসে।
বোকামি হয়ে গেল। কেন বলতে গেল অবনিকে! আরো কিছু সময় বুকে জড়িয়ে রাখতো।
নিজের চুলগুলো ঠিক করে লাজুক কণ্ঠে অবনি বলে, আমি আসি।
-না, এখুনি নয়। আরো কিছু সময় তোমাকে চাই ।
অবনি লজ্জা রাঙা হয়ে আছে, চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। বলল, কাছে আসা কোনো সমাধান নয়।
নিলয় নিজের কপাল চুলকে বলল, যে জিনিসের অভিজ্ঞতা নেই সেটার সমাধান কী করে দেই বলো। মা কী বলে জানো? কোনো মানুষই পরিপূর্ণ বা পারফেক্ট নয়। দুজন অপরিপূর্ণ মানুষ মিলে একটি পরিপূর্ণ সংসার গড়ে উঠে। তোমার অপূর্ণতায় আমি, আমার অপূর্ণতায় তুমি পাশে দাঁড়াবে তবেই না আমরা পরিপূর্ণ হবো।
– আপনার মা এতো সুন্দর কথা বলেছে?
– হুম, আমার মা শাশুড়ী হিসাবে অনেক ভালো হবে।
– লোভ দেখাচ্ছেন?
– অবশ্যই।
শিউলি নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকলেন। তুমি কি খেতে পছন্দ করো অবনি?
– জ্বি আন্টি, আমার কোনো বাছবিচার নেই। যে যা দেয়, তাই খাই।
– বাহ্ ভালো তো। নিলয় এতো বাচবিচার করে…
চোখের ইশারায় মানা করে চললো নিলয়, সেদিকে শিউলির নজর নেই। তিনি বলে চললেন, ওর মর্জি জিজ্ঞেস করেই আমার রাঁধতে হয়, তাও মাঝে মাঝে ওর পছন্দ হয় না, তখন নিজেই রান্না করে খায়। নদী আবার তোমার মতো, কিছুতেই মানা নেই।
অবনি আড়চোখে নিলয়ের দিকে তাকালো। নিলয় অসহায় মুখে অবনিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো।
– তোমার জামাটা খুব সুন্দর, কোথা থেকে নিয়েছো?
– আন্টি, অনলাইন থেকে। নদীকে আমি লিংক দিয়ে দেবো। খুব ভালো ভালো জামা পাওয়া যায়।
– হ্যাঁ, দিও তো। নদীর চয়েস এতো ভালো নয়, নিলয়ের ভালো। কিন্তু ছেলেটা শপিংয়ের নামই শুনতে চায় না। কিছু চাইলে টাকা দিয়ে দেয়, নয় নিজে পছন্দ করে কিনে আনে। বলি আমাকেও সাথে নে, মা ছেলে মিলে একটু দেখে শুনে পছন্দ করি, তা না।
নিলয় মাকে ইশারা করেই যাচ্ছে শিউলি সেটা লক্ষ্য না করলেও অবনির চোখে পড়ে যায় । নিলয় ধরা খাওয়া মুখ করে বলে, আমার সুনাম করার কিছুই নেই মা?
এতোক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারে শিউলি। বলে, না না, তোর সুনাম করে শেষ করা যাবে! এমন লক্ষী ছেলে…
নিলয় থামিয়ে বলে,থাক মা, দুপুরের রান্না চড়িয়েছো? অবনি কিন্তু খেয়ে যাবে।
-না, না আন্টি আমি দুপুরের আগেই চলে যাবো। আরেকদিন খাবো। আজ না।
-সেটা না হয় পরে দেখা যাবে। তোমাদের চা দেই?
– আন্টি আপনি ব্যস্ত হবেন না। চলুন আমি আপনাকে সাহায্য করি।
নিলয় চেঁচিয়ে ওঠে , না না।
অবনি চমকে উঠে। শিউলি হেসে বলেন, নিলয় একা একা বসে কি করবে, এরচেয়ে তোমরা দুজন গল্প করো।
শিউলি চলে গেলে নিলয় বলে, অল্প সময়ের জন্য এসে রান্নাঘরে ঢুকতে চাইছিলে কেন? এখানে আমার সামনেই বসে থাকো।
অবনি চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর বলে, এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি কিন্তু চলে যাবো।
নিলয় হেসে ফেলে। আচ্ছা, চোখ বন্ধ করলাম।
সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে নিলয়।
-না বলে চলে যেও না প্লিজ।
– না, যাচ্ছি না। মিথিলার কথা না জেনে কি করে যাই।
নিলয় হেসে ফেলে, মেয়ে মানুষ বলে কথা।
– কেন, আপনি আমার এতোটুকু ভাইকে দেখে গাল ফুলান নি?
– আচ্ছা বলছি, মিথিলা স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা একটা মেয়ে। ওকে হিংসার চোখে দেখার কিচ্ছু নেই।
– আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম। আর কিছু নয়। আচ্ছা আপনার পরিবার জানে মিথিলার নাম?
– না ওভাবে বলিনি। শুধু জানে একটা মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। কেন?
– এমনি।
কিছুসময় পরে নিলয় দুষ্ট হেসে বলে, জানি, তুমি আমাকে দেখছো, আর কতক্ষণ দেখবে? দেখতে খারাপ নই আমি, তোমার পাশে ঠিকঠাক মানিয়ে যাবো।
-ইশ! আমি আপনাকে দেখছি না।
– তাহলে সেদিন যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটা পূরণ করার প্ল্যান ?
– কী স্বপ্ন?
– শুনলে রাগ করবে।
– থাক, বলতে হবে না। ছেলেদের স্বপ্ন আবার ভালো হয় না কি।
ঠোঁট চেপে হেসে নিলয় বলে, সাধু সন্ন্যাসিকে নিশ্চয়ই বিয়ে করতে চাইবে না?
-ধ্যাত! আমি চলে যাচ্ছি।
– না, থামো। চোখ খুলেই অবনির হাত টেনে ধরে নিলয়। স্বপ্নে আমি কিছু করিনি, তুমিই এগিয়ে আমাকে চুমু দিয়েছো।
-আমি গেলাম, হাত ছাড়ুন।
– থামো না অবনি, চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি, আজই।
অবনি চোখ উপরে তুলে বলে, আজই? কোন সুখে?
– ছুটি আরো দুদিন বাড়িয়ে নিবো। শুক্র, শনি মিলে পাঁচদিনের ছুটি। হানিমুনে সোজা সমুদ্র নয়তো পাহাড়।
– আচ্ছা ছোটলোক দেখছি। হাত ছাড়িয়ে যেতে যেতে অবনি বলে গেল, ভাঙা ঠ্যাংয়ে বিয়ে করার শখ কত!
অবনি চলে গেলে নিলয় টের পেল পা ব্যাথা বেড়েছে। শরীরও ক্লান্ত লাগছে। দুপুরের খাওয়া শেষে পেইন কিলার খেয়ে সুখ সুখ অনুভূতিতে শুয়ে পড়লো।
ঘুম ভাঙ্গলো নদীর ঝাঁকুনি খেয়ে।
-ভাইয়া, এই ভাইয়া, তুই তোর ব্যান্ডেজ করা পায়ে পাজামা পরতে পারবি?
নিলয় ঘুম ঘুম চোখে বিরক্ত হয়ে বলল, পাজামা কেন পরবো?
– ট্রাউজারের সাথে তো পাঞ্জাবি মানাবে না। লুঙ্গি পরবি?
নিজের মাথার বালিশ নদীর দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল, ভাগ এখান থেকে, ঘুমাতে দে।
কুতকুত খেলার মতো এক পা সামনে তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে নদী বলল, তুই কি এভাবে অবনিদের বাসা যাবি?
নিলয় চমকে উঠল। অবনির বাসা মানে?
– মানে অবনির বাবা আমাদের বাবার সাথে আলাপ করছে।
উত্তেজিত সুরে প্রশ্ন করে নিলয়, কি বিষয়ে?
– বাবা এলেই জানবি।
রাশেদ সাহেব নিলয়ের রুমে ঢুকে বলেন, তুই যে মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিস বলিসনি কেন সেই মেয়ে অবনি?
নিলয় হা হয়ে চেয়ে থাকে।
রাশেদ সাহেব শিউলির দিকে চেয়ে বলেন, অবনির বাবার কাছ থেকে আজ জানলাম। অবনি জানতো না নিলয় ওকে বাঁচিয়ে এতোটাই ব্যাথা পেয়েছে যে বিছানায় পড়ে আছে। আজ জেনে নাকি খুব কান্নাকাটি করেছে। ওদের পক্ষ থেকে ডেকেছে আমাদের। কবে যেতে পারবি নিলয়?
নিলয় হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। কি ঘটছে কোনদিকে গড়াচ্ছে কিছুই বুঝছে না। তোতলার মতো করে বলল, কে..ন, কেন যাবো?
– আরে… আংটি পরাতে?
নিলয় এখনো হা হয়ে আছে।
নদী ফিসফিস করে বলল, মুখ বন্ধ কর ভাই, নইলে সবাই বুঝে যাবে তুই যে আসলেই একটা গাধা!
চলবে।
ঝিনুক চৌধুরী।