কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব-১৪+১৫

0
264

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী

” এই অ’স’ভ্য মেয়ে এখানে সংয়ের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই পরিবারের সব বিষয়েই নিজেকে জড়াতে ইচ্ছে করে? আমরা চাইনা তুমি পরিবারের কোন বিষয়ের মধ্যেই থাক, সেটা কি তুমি বুঝতে পারনা? নি’র্ল’জ্জ, বে’হা’য়া মেয়ের এই সামান্য জ্ঞানটুকুও নেই! একে কিছু বলেও আবার শান্তি নেই। আরেকজন জানলে তো বাড়ি সরু মানুষকে অপমান করে ছাড়বে। ” রাজিয়া খানম হঠাৎই কান্তার ওপর খেঁকিয়ে উঠে।

” রিল্যাক্স, দাদি শ্বাশুড়ি। আমার কোন ইচ্ছেই নেই আপনার যতসব জ’ঘ’ন্য কথাবার্তা শোনার। বয়সতো আর কম হয়নি, এই বয়সে কোথায় আল্লাহ রসুলের নাম নিবেন। তা না করে মানুষের পেছনে আঙুল দিয়ে বেড়ানোয় আপনার সুখ। আপনার কথার ধারে ভদ্রলোক চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এত জোড় পান কই! গ্রামে দেখেছি আপনার বয়সী মহিলারা হয় ক’ব’রে গেছে নয়তো প্যা’রা’লা’ই’জ’ড হয়ে বিছানায় শুয়ে কা’ত’রা’য়। কিন্তু আপনি দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন। আপনার উচিত বেশি বেশি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা। এতে আল্লাহও খুশি হবেন আর আপনিও পাপ মুক্ত থাকবেন। ”

” তোমার এত বড় সাহস! তুমি আমার মৃ’ত্যু কামনা করছ? আজ শহিদ বাসায় আসুক। আমি একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। আমার সাথে এই আচরনের শোধ নিয়েই তবে ক্ষান্ত হব। ”

” আপনার ছেলেকে যা খুশি বলবেন। এতে আমার যায় আসেনা। আমিও তাকে বলব আপনি একজন ভদ্রলোকের সাথে কত খারাপ আচরণ করেছেন। ভদ্রলোক কাঁদতে কাঁদতে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আবার আমাকেও বিনা দোষে গালি দিয়েছেন। ”

” তুমি আমাকে থ্রে’ড দিচ্ছ? দুই দিনের মেয়ে। জীবনে কখনো শহরের মুখ দেখেছ? যেই ঢাকার পানি পেটে পরেছে সেই রং বদলাতে শুরু করেছ? ”

” বাহ্ দাদি শ্বাশুড়ি, আপনি দেখছি ইংরেজিও জানেন! আচ্ছা আপনি কোন শহরের মেয়ে ছিলেন বলুনতো? আমেরিকা না ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন? কাউকে কিছু বলার আগে নিজের শেকড়ের দিকে ভালোভাবে তাকাবেন। তারপর বলবেন। আমি চিন্তা করছি দাদা শ্বশুর আপনাকে সহ্য করেছেন কিভাবে! আপনার যা ঝাল। বেচারা বোধহয় দুনিয়ায় বেঁচে থেকেও মৃ’ত্যু’র স্বাদ পেয়েছে। দাদা শ্বশুরের জন্য কয়েক বালতি সমবেদনা জানাচ্ছি। ”

” বেয়াদব মেয়ে, তুমি আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও। কোন কু’ক্ষ’নে যে শহিদ এই মেয়েকে ছেলের বউ করে এনেছে। ”

” যাচ্ছি, যাচ্ছি। আমারও শখ নেই আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আপনার ঝাল ঝাল কথাবার্তা শোনার। মুখ তো নয়, যেন মে’শি’নগা’ন। হা করলেই কথার আ’ঘা’তে মানুষের কলিজা ঝাঁ’ঝ’রা হয়ে যায়। ” কান্তাও কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেয়।

রাজিয়া খানম রা’গে থরথর করে কাঁপছে। আজ পর্যন্ত তাকে কেউ এভাবে বলেনি। দুইদিনের মেয়ের কতবড় সাহস তাকে এতগুলো কথা শোনায়!

” আম্মা, আমি আপনাকে বারবার বলেছি, ঐ অ’স’ভ্য, গাঁইয়া মেয়েকে কিছু বলতে যাবেননা। ভালো আচরণ ওর কাছে আশা করেন কিভাবে? আপনি ভেতরে যান। আপনার ছেলেকে কিছুই বলার দরকার নেই। শেষে দেখবেন হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। ”

ছেলের বউয়ের কথা মেনে নিয়ে রাজিয়া খানম নিজ রুমে চলে যায়।

রাত এগারোটা বাজে অথচ আরমানের বাসায় আসার নাম নেই। কান্তা অনেকক্ষণ ইতিউতি করে আরমানের নম্বরে ফোন দেয়। ওর বুক দুরুদুরু করছে। না জানি ওর নম্বর দেখে লোকটা কোন খোঁ’চা মা’রে। তিনবার রিং হতেই আরমান ফোন কে’টে দেয়। কান্তা ফোন হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে। যেন ও ফোনকে বলছে, কি রে রিং হতে না হতে নিতাই মাষ্টার কে’টে দিল কেন?
কিন্তু বেচারা বাকশক্তিহীন ফোন কোন জবাব না দিয়ে নিরুত্তর থাকে।

এগারোটা দশে আরমান বাসায় আসে।
ঘামে ওর শরীর জুবুথুবু। চিবুক বেয়ে কয়েক ফোঁটা নামতে নামতে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

আরমান ওর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ড্রেসিংটেবিলে রেখে আলমিরা থেকে কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে। কান্তার সাথে কোন কথা বলেনা।
কান্তা এতক্ষণ তার কাজকর্ম কপাল কুঁচকে দেখছিল।

” ব্যাটার ভাব দেখ! আমার সাথে কথা বলতে তার সম্মানে বাঁধে। এমন ভাব করছে, যেন সে হাতি আর আমি পিঁপড়া! ”

নিজে নিজেই বকবক করতে করতে কান্তা রান্নাঘরে আসে। খাবার গরম করে রুমে নিয়ে আসে।
ততক্ষণে আরমান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।

কান্তা বারান্দা থেকে টি টেবিল এনে তাতে খাবার রাখে।

” তারাতারি আসুন। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। ”

” তুমি প্লেটে ভাত দাও, আমি আসছি। ”

কান্তা চুপচাপ আরমানের নির্দেশ মেনে প্লেটে খাবার তুলে দেয়।
এরপর দু’জন নিরবে খাবার খায়।

আজ ফজরের নামাজ আদায়ের পর কান্তা বই নিয়ে বসেনি। ওর শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, তাই ঘাপটি মে’রে শুয়ে আছে। সকাল সাড়ে ছয়টা বাজলেও উঠার কোন নাম নেই কান্তার। ওর বাম পাশে সটান হয়ে শুয়ে আছে আরমান। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। মাথার ওপর ফ্যান শা শা শব্দে ঘুরে চলেছে।

একটু শীত শীত বোধ হওয়ায় কান্তা শরীরে ওড়না পেঁচিয়ে শোয়। কিন্তু এতেও ওর শীত কমেছেনা। অগত্যা পায়ের নিচ থেকে কাঁথা নিয়ে শরীরে জড়ায়।

হঠাৎই বালিশের তলায় থাকা বাটন ফোনটা বেজে ওঠে। এই সকালে আবার কে ফোন করল!
কান্তা বিছানা হাতড়ে খুঁজতে থাকে তার ফোন।

এদিকে ফোনের শব্দে আরমানের ঘুম হালকা হয়ে গেছে। তবুও চুপটি করে শুয়ে থাকে।

ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে কান্তা। বড় ভাইয়া ফোন দিয়েছে!
বিয়ের একমাস পর ওর বাড়ি থেকে কেউ ফোন দিয়েছে!

” আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া। তুমি হঠাৎ ফোন দিলে যে? কারও, কিছু হয়েছে? ”

” কেউ ফোন করলে তাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে হয়, তা কি ভুলে গেছিস? এত বছরেও তুই এসব শিখলিনা? অ’স’ভ্য’ই থেকে গেলি! ”

” যে এত বছরেও কিছু শিখেনি, তার কাছ থেকে এখন ফর্মালিটি আশা করা বৃথা তা কি তুমি জানোনা? আর তাছাড়া বিয়ের একমাসের মধ্যে যে ভাইরা তার বোনের কোন খোঁজ নেয়নি, সেই বোনের কাছ থেকে তুমি সহবৎ আশা করো কোন লজ্জায়? তোমাদের কি একবারও মনে হয়নি, যে বোঝা টাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলেছ, তাকে তোমাদের জন্য কটুকথা শুনতে হতে পারে? চিরকাল তুমি অন্ধই থেকে গেলে ভাইয়া। যাকে বলে চোখ থেকেও অন্ধ। ” কান্তা ইচ্ছে করেই শুয়ে থাকা অবস্থায় কথা বলছে। আরমান যে ওর পাশে আছে তা নিয়ে ও বিন্দুমাত্র লজ্জাও পাচ্ছেনা। কারন দুইদিন আগে আর দুইদিন পরে, আরমান একদিন ঠিকই সবকিছু জানতে পারবে।

” আমি তোর হালচাল জানার জন্য ফোন দিলাম, আর তুই কিনা আমাকেই কথা শোনাচ্ছিস? এখন তো মনে হচ্ছে, তোকে বিয়ে দিয়ে খুব একটা ভুল করিনি। তোর এই ত্যা’ড়া স্বভাবের জন্যই শিখা তোকে নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে ও ঠিক কাজটাই করেছে। একটা উপদেশ দেই শোন, নিজের মুখটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখ। তাছাড়া দেখবি সারাজীবন মানুষের কটুকথা নিয়েই বাঁচতে হবে। ”

” অনেক ধন্যবাদ তোমার উপদেশের জন্য। যে মানুষ তার বউয়ের কথার বাইরে কখনও যায়না। বউয়ের কথাই তার কাছে হাদিসের ন্যায়, আর যাইহোক সেই মানুষের মুখে উপদেশ মানায়না। যে মানুষ তার বউয়ের কথা শুনে বোনের গায়ে হাত তুলতে দুইবার ভাবেনা, সে আজ তার বোনকে উপদেশ দিচ্ছে! এটাও আমাকে মানতে হবে! যে ভাই তার বোনের বিয়ের একমাস পর ফোন দিয়ে বোনের খোঁজ নিচ্ছে, সেই ভাইই আজ বোনকে উপদেশ দেয়! একটুতো লজ্জা কর ভাইয়া। ”

” তোর মত বেয়াদব মেয়েকে ফোন দেয়াই আমার ভুল হয়েছে। আজ থেকে ভুলে গেলাম, আমার কোন বোন আছে। ”

” আমার অনেক উপকার করলে ভাইয়া। তোমাদের মত ভাইদের জন্য আমার লজ্জা হয়। তোমরা যদি আমার সাথে সম্পর্ক না রাখ, তবে সেটা আমার জন্যই ভালো। তোমাদের নিয়ে অন্যকে ইনিয়েবিনিয়ে মিথ্যা বলতে হবেনা। তবে জানো তোমরা আমাকে পর করে দিলেও আমার কষ্ট হবেনা। কষ্ট হবে আরাফের জন্য। তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিতো। তোমাদের দুই ভাইয়ের মত বেইমান আমি নই। ছোটবেলা থেকে বাবা হারা বোনটাকে আপন করতে পারনি। মাথার ওপর মায়ের ছায়া ছিল তাই বড় হয়েছি। কিন্তু মা যখন মা’রা গেল তখন তোমাদের কাজের মেয়ে হয়ে রইলাম। শুধু ভাইদের জন্য দ্বায়িত্বই পালন করে গেছি। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে পেয়েছি অবহেলা, অনাদর, লাঞ্ছনা। তাদের বউদের কথা বাদই দিলাম। তারা অন্য বাড়ির মেয়ে। তাদের দূর্ব্যবহার মানাই যায়। ”

” তুই আসলেই একটা বেইমান। তোর মত বোন যেন আর কারও ঘরে না জন্মায়। আজকের পর থেকে তোর সাথে আমাদের আর কোনও সম্পর্ক থাকবেনা। ভুল করেও আমাদের ফোন দেয়ার চেষ্টা করবিনা। ”

আরমান নিজের বালিশে মাথা রাখা অবস্থায়ই অপরপক্ষের বলা কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে। ওর ভেতরটা রা’গে ফে’টে যাচ্ছে। কোন ভাই তার বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে পারে!

” বাঁচালে ভাইয়া। এই নামমাত্র ভাই-বোনের সম্পর্কের পাঠ আজ নিজের হাতে শেষ করে দিয়ে। তোমার আজকের বলা কথাগুলো আমার আজীবন মনে থাকবে। তোমার সাথে কোন সম্পর্কই আমার থাকবেনা। কিন্তু আমার বাবার রেখে যাওয়া বাড়িটার সাথে আমার নাড়ির সম্পর্ক কখনও ভোলার নয়। আমি বাবার একজন ওয়ারিশ হিসেবে, বাবার বাড়িতে যাব। কারন তার সকল কিছুতে আমার তোমাদের মত সমান অধিকার আছে। এই কথাটাও মাথায় ভালোভাবে ঢুকিয়ে নাও। সব শেষে একটা কথা বলি, তোমার নিজেরও একটা ছেলে আছে। তাকে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলো। দাবার চাল কখন উল্টে যায়, তা বলা যায়না। আর যাইহোক আমার মত কষ্ট সহ্য তোমরা কখনোই করতে পারবেনা। এবার রাখছি। ” কান্তা ফোনের লাইন কে’টে দিয়ে নিরব কান্নায় ভেঙে পড়ে।

চলবে…

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী

আরমান কোন নড়াচড়া না করে শুয়ে থাকে। ও বুঝতে পারছে কান্তা কাঁদছে। তবুও ইচ্ছে করেই ওকে শান্তনা দেয়না। এই মুহূর্তে ওকে কাঁদতে দেয়াই আরমানের কাছে উচিত বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া ওর ঘাপটি মে’রে শুয়ে থাকার আরেকটা কারন হলো, ও চায়না আরমান ওদের ভাইবোনের কথা শুনতে পেয়েছে ভেবে অস্বস্তিতে পরুক।

কান্তা কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে হালকা করে। ততক্ষণে ওর শরীরে জ্বর জাঁকিয়ে বসেছে। এদিকে আরমানের ভার্সিটি যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।
কান্তা অনেক কষ্টে উঠে বসে। ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

আরমানের চোখের ঘুম সেই কখন গায়েব হয়ে গেছে। কান্তা বেরিয়ে যেতেই ও উঠে বসে। তখনও ওর মাথায় আ’গু’ন জ্ব’ল’ছে। ভাই হয়ে ছোট বোনের সাথে এত খারাপ আচরণ কি করে করতে পারে! ঘুরেফিরে এই কথাই ওর মাথায় এই কথাই ঘুরছে। আর যাই করুক না কেন এই লোকটাকে আরমান কখনোই ক্ষমা করবেনা।

” আপনার খাবার এনেছি। খেয়ে নিন। আজকে পরোটা করতে পারিনি। আপনার জন্য লাঞ্চবক্সে শুধু একটা তরকারি আর ভাত দিয়েছি। একটু কষ্ট করে খেয়ে নিয়েন। ” টি টেবিলে রুটি আর ডিম ভাজা রেখে কান্তা বলল।
আরমান গোসল সেরে সবেমাত্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।

” রুমে আনলে কেন? আমি ডাইনিং রুমে যেয়েই খেতাম। এই, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? ” আরমান কথা বলতে গিয়ে কান্তার দিকে তাকালে বুঝে যায়, কান্তার কিছু একটা হয়েছে।

” মনে হয় জ্বর এসেছে। ”

আরমান তড়িঘড়ি করে আসে কান্তার কাছে। ওর কপালে হাত রেখে চমকে উঠে।

” শরীর জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে, আর তুমি বলছ, মনে হয় জ্বর এসেছে! আমার খাওয়ার চিন্তা বাদ। আগে তুমি রুটি খেয়ে মেডিসিন নাও। ” আরমান জোর করে কান্তাকে দুইটা রুটি খাইয়ে দেয়। এরপর একটা প্যারাসিটামল দেয় কান্তার হাতে।
এরপর নিজেও দুইটা রুটি খায়।

” এখানে মেডিসিন রইল। জ্বর না কমলে আরেকটা খাবে। এই অসুস্থ শরীরে কেন রান্না করতে গেলে? আমার না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে। তাই কখনও যদি শরীর খারাপ হয়, রান্নার চিন্তা না করে আগে আমাকে বলবে। ঠিক আছে? আজ আর রান্নাঘরে যেওনা। আমি খালাকে বলে যাব, সে তোমার খাবার রুমে নিয়ে আসবে। ”

কান্তা কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ায়।

আরমান প্রয়োজনীয় সব কিছু ব্যাগে তুলে নিয়ে কান্তার কাছে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা খাটের একপাশে বসে আছে।
হুট করেই আরমান কান্তার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরে। এরপর কান্তার মাথায়, কপালে পরপর কয়েকটা চুমু দেয়।

” চুপচাপ শুয়ে থাকবে কেমন? বেশি খারাপ লাগলে খালাকে ডাকবে। আর আমাকে ফোন দিবে। আমি ফোন দিলে রিসিভ করবে। কারও সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবেনা। আজ আর কোচিং-এ যাওয়ার দরকার নেই। আজকে জ্বর না কমলে কাল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব। ”
কান্তা বাধ্য মেয়ের মত আরমানের সকল কথায় সায় দেয়।

আরমান বেরিয়ে যেতেই কান্তা হু হু করে কেঁদে উঠে। আজ আরমান ওকে জড়িয়ে ধরেছে, চুমু দিয়েছে। এত সুখও কি ওর কপালে ছিল! মানুষটা কত খেয়াল রাখে ওর। এখনও যেন আরমানের ছোঁয়া ওর শরীরে লেগে আছে। কান্তা দুপুর পর্যন্ত থেকে থেকেই কেঁদে উঠে।

আরমান সারাদিনে বেশ কয়েকবার ফোন করে কান্তার খোঁজ নিয়েছে। ওর জ্বর এখনও আছে।
খালা এসে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিয়েছে। আরমান ভার্সিটি যাওয়ার আগে তাকে বলে গেছিল।

সারাদিন একবারের জন্যও আকলিমা খানম কিংবা রাজিয়া খানম দুজনের কেউই কান্তার খোঁজ নেয়নি। শ্রীজা যতক্ষণ বাসায় ছিল ততক্ষণ কান্তার পাশে ছিল। সন্ধ্যায় শহিদ আহমেদ বাসায় এসে খালার কাছে কান্তার কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন কান্তার রুমে। তিনি কিছুক্ষণ কান্তার মাথায় হাত রেখে ওর পাশে বসে থাকেন।

আরমান আজ একটু তারাতারি বাসায় ফিরেছে। সে যখন রুমে এসেছে তখন কান্তা জ্বরে কাতরাচ্ছে। খালা ওর মাথায় পানি ঢালছে।
আরমান ভেতরে আসার কিছুক্ষণ পর খালা কান্তার মাথা মুছিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আরমান ফ্রেশ হয়ে এসে কান্তার পাশে বসে। হাত রাখে ওর মাথায়।

” আপনি আজ এত তারাতারি আসলেন যে? দুপুরে ঠিকমত খেতে পেরেছিলেন তো? ” ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে কান্তা।

” কি আশ্চর্য মেয়ে তুমি! নিজে জ্বরে কাতর অথচ নিজের চিন্তা না করে আমার চিন্তা করছ! তোমার জন্য তারাতারি বাসায় এসেছি। আর দুপুরের খাবারও পেট পুরে খেয়েছি। এখন একটু উঠে বস। আমি কিছু খাবার এনেছি। সেসব খেয়ে ঔষধ খাবে। আজ রাতটুকু দেখব। সকালের মধ্যে জ্বর না কমলে কাল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব। ”

” ডক্টরের কাছে নিতে হবেনা। এমনিতেই সেরে যাব। এরকম জ্বর জীবনে কত হয়েছে। এমন অস্থির কেউ হয়নি। আর না করেছে এত সেবা। আপনি মিছেমিছি ঘাবড়াচ্ছেন। দেখবেন কাল সকালেই জ্বর পালাবে। ”

” অতীতে কেউ তোমার জন্য চিন্তা করেনি জন্য ভবিষ্যতেও কেউ চিন্তা করবেনা, এমনটা ভাবার কোন কারন নেই। অতীতে যতটা অবহেলিত ছিলে, ভবিষ্যতে তারচেয়েও বেশি কারও ভালোবাসার নাম হবে তুমি। অতীতের যে দুঃসহ স্মৃতি তোমার মনে দাগ কে’টে’ছে। শীঘ্রই সেই দাগে কেউ প্রলেপ লাগাবে ভালোবাসার। তোমার চারপাশে থাকবে ভালোবাসায় ঘেরা সুখস্মৃতি। সেই ভালোবাসার দেয়াল ডিঙিয়ে অতীতের কালো স্মৃতি ভবিষ্যতে তোমার আশেপাশে পৌঁছাতে পারবেনা। একটা কথা মনে রেখ, তুমি কারও রাজ্যের রানী। না থাকুক সে রাজ্যে কোন প্রজা, অর্থ কিংবা কোন প্রতিপত্তি। সেই রাজ্য তুমি নামক রানীতেই পূর্ণ। সেই ভালোবাসায় ভরা রাজ্যে প্রজা, বিত্ত-বৈভব কিংবা প্রতিপত্তি সবকিছুরই স্থান তুমি দখল করে আছ। যে রাজ্যের প্রতিটি কোনা তুমিময়। ”

কান্তা মুগ্ধ হয়ে আরমানের কথা শুনছে।

” আপনি এভাবেও কথা বলতে পারেন! যে মানুষের মুখে একমাসেও হাসি দেখিনি, আজ তার মুখে এসব শুনে আমার মাথা ঘুরছে। আমার হাতে একটা চি’ম’টি কা’টু’ন তো। তাহলেই বুঝব আপনি সত্যিই এখন আমার পাশে বসে আছেন। ”

” শরীরটা যে এত খারাপ, তবুও ফাজলামো যাচ্ছেনা? এবার উঠ। খেয়ে ঔষধ খেতে হবে। ” আরমান কান্তাকে উঠে বসতে সাহায্য করে।

রাত দুইটা। তবুও আরমানের চোখে ঘুম নেই। কান্তার জ্বর বেড়েই চলেছে। আরমান একবার ওর কপালে পানিপট্টি দিচ্ছে তো আরেকবার বালতি ভর্তি পানি এনে মাথায় ঢালছে। কান্তাও বুঝতে পারছে মানুষটাকে ওর জন্য খুব ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

” কান্তা, এই কান্তা। একটু কষ্ট করে উঠে বস তো। আমি তোমার শরীর মুছে দেই। তোমার শরীরে অনেক তাপ। ঠান্ডা পানিতে শরীর মুছলে তোমার ভালো লাগবে। ” আরমানের গলায় উদ্বেগ খেলে যায়। ক্রমাগত কান্তার জ্বর বেড়েই চলেছে। আরমান আল্লাহকে ডাকছে। রাতটুকু কোনমতে কাটলেই সকালে ওকে ডক্টরের কাছে নিবে।

” এসব কি বলছেন! আপনি আমার শরীর মুছে দিবেন কেন! আমার বুঝি লজ্জা করবেনা? আপনি দিনদিন কেমন অ’স’ভ্য হয়ে যাচ্ছেন। ” কান্তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। জ্বরের প্রচন্ডতায় চোখ খুলতে পারছেনা।

” তোমার এখন যে অবস্থা, তাতে যে কোন সময় জ্ঞান হারাতে পার। তবুও তোমার কথা বন্ধ হচ্ছেনা। তুমি কি এখন নিজ নিজে শরীর মোছার অবস্থায় আছ? দেখি একা উঠে বস তো, কেমন পার। ”

” খুব পারব। ” বলেই কান্তা বসতে গেলেই মাথা চক্কর দেয়। সাথে সাথে ধপ করে শুয়ে পরে।

” বাহ্ একা একা খুব বসতে পেরেছ। এজন্য তোমাকে পুরস্কৃত করা উচিত। বেশি কথা না বলে চুপচাপ থাক। ”

এরপর আরমান কান্তাকে তুলে বসায়। কিন্তু সে শরীর মুছে দেয়ার কথা বললেই, কান্তা আঁইগুঁই করতে থাকে। ও কিছুতেই আরমানকে দিয়ে শরীর মুছিয়ে নিবেনা। এদিকে আরমানও নাছোড়বান্দা। সে কান্তাকে হু’ম’কি’ধা’ম’কি দিয়ে ওর শরীর মুছিয়ে দেয়। পুরোটা সময় কান্তা ঠোঁট কা’ম’ড়ে, চোখ বন্ধ করে থাকে। লজ্জায় ওর শরীর মিইয়ে যাচ্ছে। ও স্বপ্নেও ভাবেনি কখনও এমন দিন কখনও আসবে। আরমানের সামনে কখনও এই অসুস্থ অবস্থায়, এভাবে নিজেকে মেলে ধরতে হবে

” লজ্জাবতীর লজ্জার পর্ব শেষ হলে চোখ খুলতে পারেন। ঝগড়া করার সময় তো লজ্জার বালাই থাকেনা। ঠাসঠাস করে কথা বলতে পারলেই তখন বাঁচেন। তখন অপ্রয়োজনে হাজার কথা বলেন, তবুও লজ্জার ল – ও দেখিনা। কিন্তু এই মুহূর্তে এত লজ্জার কি আছে! ” আরমান চেষ্টা করছে কান্তার লজ্জা ভাঙানোর।

কান্তা তবুও নিরুত্তর থাকে। ওর আরমানের দিকে তাকানোর সাহসই নেই।
আরমানও কান্তার অবস্থা বুঝতে পেরে মিটমিটিয়ে হাসছে।

পরদিন সকালে আরমান কান্তাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হতে গেলেই রাজিয়া খানমের সামনে পরে।

” এই সাত সকালে ঐ বেয়াদব মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? হয়েছে তো সামান্য জ্বর, তাতেই এমন এলিয়ে পরছে, যেন কি না কি হয়েছে! এমন ভাব করছে যেন আমাদের কখনও জ্বর হয়নি। আর তার সাথ দেয়ার জন্য তুমিও একপায়ে খাড়া হয়ে থাক! স্বামী আমারও ছিল। কই আমার অসুখ করলে সে তো এমন উদগ্রীব হয়নি। যতসব আদিখ্যেতা। যেন বাংলাদেশে আর কেউ বিয়ে করেনি, আর কারও বউ নেই। তা-ও যদি সেই বউ আবার রূপসী হত। ” মুখ ঝামটা দিয়ে বলে রাজিয়া খানম।

সারারাত ঘুম না হওয়ায় মাথা ঝিমঝিম করছিল। তারউপর এমন কথা শোনায় আরমানের মেজাজ হারায়। কড়া চোখে তাকায় রাজিয়া খানমের দিকে।

” শফিকুল ইসলাম যত্ন করেছে কি না, সেটাতো আপনাকে দেখেই বোঝা যায়। বেচারা আপনার সেবাযত্ন করতে গিয়ে অকালেই দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছে। সে যদি আপনার সেবা না-ই করত, তবে আজ আপনি দুনিয়ায় থাকতেননা। কিন্তু দেখেন সব শত্রুদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে আপনি দিব্যি বেঁচে আছেন। আর আমার কলিজায় পেরেক মা’র’ছে’ন। আর ঐদিকে আপনার নির্বোধ স্বামী আপনার সেবা তো পায়নিই উল্টো আপনাকে হুজুর হুজুর করে গেছে। আপনি নাকি তাকে সবসময়ই দৌঁড়ের ওপর রাখতেন? আপনার জ্বালায় সবাই অতিষ্ট থাকত! এসব কিন্তু আমি আপনার শ্বশুর বাড়ির মানুষের মুখেই শুনেছি। আর সেই আপনি আজকে নিজের গুণগান গাইছেন! এত কষ্ট করে নিজেকে চেনানোর কোনও প্রয়োজন নেই। আপনাকে চিনতে কারও বাকি নেই। ” আরমান কথাগুলো বলে পৈ’শা’চি’ক আনন্দ পায়।
এরপর সে কান্তাকে ধরে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।

রাজিয়া খানমের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেছে। তিক্ত সত্যি কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে।
পাশ থেকে শ্রীজা মুখ টিপে হাসছে। ভাইয়া আজ বেশ জব্দ করেছে বুড়িকে।

” বলছি কি দাদিমা, অযথা ভাইয়ার পেছনে লাগতে যাও কেন? এতে তোমার কোন লাভ হল? শুধু শুধু তোমার অতীতের সত্যিকারের কথাগুলো সামনে চলে আসল। এরপর থেকে ভাইয়াকে এমন কিছু বলোনা যাতে তোমার অতীত আবারও সামনে আসে। এসব কিন্তু ভিষণ লজ্জার। ” শ্রীজাও একটু খোঁ’চা দেয়া৷ সুযোগ ছাড়েনা।

” শ্রীজা এসব কি বেয়াদবি? দাদিমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? আরমানের সাথে মিশে ওর মতই বেয়াদব হচ্ছিস তুই। আর একদিন যদি তোকে এভাবে কথা বলতে শুনেছি তবে সেদিন তুই আমার হাতে থা’প্প’ড় খাবি। ” আকলিমা খানম রেগে গেছে।

” কেন মা, আমাকে থা’প্প’ড় মারবে কেন! দাদিমার আচরণ তোমার চোখে পড়লনা! সে অযথাই ভাইয়, ভাবিকে অপমান করে। নিজের সম্মান নিজেকেই রাখতে হয়। কেউ কাউকে এমনি এমনিই সম্মান করেনা। দাদিমা নিজের সম্মান নিজেই হারাচ্ছে। ” শ্রীজা আর সেখানে দাঁড়ায়না। সোজা নিজের রুমে চলে যায়।

চলবে….