কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব-৩৬+৩৭

0
275

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৬
জাওয়াদ জামী

আরমান আকলিমা খানমের কথার উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে রাখে।
আকলিমা খানম অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে আরমানের উত্তরের।
বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে মুখ খোলে আরমান।

” আপনি চিন্তা করবেননা, আমি শ্রীজার বিয়ের বিষয় নিয়ে খালার সাথে কথা বলব। অনেকটুকু পথ জার্নি করে এসেছেন। এবার একটু রেষ্ট করুন। ”

” তুমি আমার কথার উত্তর সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছ, এটা বেশ বুঝতে পারছি। আজ তুমি এভাবে আমার কথা এড়িয়ে যেওনা। আমি মায়ের দাবি নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। আমার জায়গায় তোমার মা থাকলে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দিতেনা। এতবছর নিজের রা’গ নিয়ে থেকেছি। তাই তোমার মূল্য বুঝিনি। আজ যখন তোমাকে চিনলাম, তখন আমি নিঃস্ব। তবে এটাও আমি জানি আমার পূর্ণতার কারনও তুমি। আজ তোমার মা হয়ে, তোমাকে সন্তান হিসেবে গ্রহন করে নিয়ে আমি পূর্ণ হতে চাই আরমান। জানি কখনো তোমার নিজের মা’য়ের মত হতে পারবনা। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কোথায়, বল? ” আকলিমা খানমের কথা শুনে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলের চোখে পানি এসেছে। সব সময় চুপচাপ থাকা অহংকারী মানুষটাও যে এভাবে বলতে পারে তা কারোরই মাথায় ছিলনা।
আরমানও চূড়ান্ত পর্যায়ে অবাক হয়ে গেছে। এমনটাও হবার ছিল! চিরকাল যার কাছ থেকে অবহেলা, অনাদর বৈ কিছুই পায়নি, আজ তার এ কি রূপ দেখছে সে!

” আপনি কি চাইছেন? ” আরমান সরাসরি জিজ্ঞেস করে।

” আমি চাই আমার বড় সন্তানকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। সে তার হিস্যা বুঝে নিক। বাবার বিপদে কাঁধে কাঁধ রেখে তার পাশে দাঁড়াক। আমি চাই আমার পুত্রবধূকে নিজের কাছে পেতে, আমার অনাগত নাতি/নাতনিকে ছুঁয়ে দেখতে। আমি জানি এটা সম্ভব নয়। কিন্তু সেগুলো সম্ভব করার দ্বায়িত্ব তোমার। তুমি তোমার চাকরির ফাঁকে ফাঁকেই এসব করতে পার। ”

” আপনি এখন রুমে যান। ফ্রেশ হয়ে নিন। খালা খেতে দিলে রুমেই খেয়ে নিবেন। কষ্ট করে এখানে আসার দরকার নেই। ” আরমান কথাগুলো বলেই উঠে যেতে লাগলে আকলিমা খানম তার হাত ধরে ওকে থামিয়ে দেয়।

” এখনও আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। উত্তর না পেলে যে আমার ভেতরে যেতে ভয় করছে। ” আকলিমা খানম কাঁদছে। তার চোখে কিছু হারানোর ভয় দেখতে পাচ্ছে আরমান।

ও জোরে শ্বাস নেয়। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে জবাব দেয়।

” ঠিক আছে, আপনার নাতি/ নাতনি ঢাকাতেই ভূমিষ্ট হবে। এরপর সে আপনার কাছে কিছুদিন থাকবে। আপনি ইচ্ছেমত ছুঁয়ে দেখবেন তাকে। তবে বেশিদিন ওদের আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে চাইবেননা। আমি ওদের ছাড়া থাকতে পারবনা। তবে প্রতিমাসে অন্তত দশদিন আপনাকেও আমার কাছে এসে থাকতে হবে। সে আমি বাংলাদেশের যে প্রান্তেই থাকিনা কেন। এবার ভেতরে যান। খালা আপনাকে ফ্রেশ করিয়ে দিবে। ”

” আমি তোমার কাছে চিরদিন ঋনী হয়ে থাকব, আরমান। আজ তুমি আমাকে যে সম্মান দিয়েছ, একজন মা এর থেকে বেশি কিছু চায়না। তবে তোমার মুখে মা ডাক শোনার আক্ষেপ আমার চিরকাল থাকবে। কখনও যদি ইচ্ছে হয়, আমাকে মা বলে একবার ডেক, দেখবে আমি তোমার জন্য জীবন দিয়ে দিব। ”

” মা, অনেক কথা বলেছেন। এবার ভেতরে চলুন। আমি আপনাকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করছি। এরপর সবাই মিলে একসাথে খেতে বসবেন। বাবা, আপনিও আসুন। ” কান্তা বুঝতে পারছে আরমান আকলিমা খানমের কথায় অপ্রস্তুত হচ্ছে। তাই ও আরমানকে একটু স্বস্তি দিতে এগিয়ে আসে। এরপর ও আকলিমা খানমের হুইল চেয়ার ঠেলে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়।

শ্রীজা একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এত বছর ও যা চেয়েছিল, অবশেষে আজ তা পেয়েছে। কিন্তু হারিয়েছেন ছোট ভাইকে। এমন অপূর্ণতার মিলন তো শ্রীজা চায়নি।
ও ছোট ছোট পায়ে আরমানের কাছে এসে দাঁড়ায়। দুই হাতের মধ্যে জড়িয়ে নেয় ভাইয়ের হাত। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

” শ্রীজু, তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর? ” বোনের কান্না দেখে আরমান উদগ্রীব হয়ে গেছে।

” তুমি বাড়িতে সত্যিই যাবে, ভাইয়া? কতদিন ঐ বাড়িতে তোমার পা পরেনি। তুমি ছাড়া সেখানে একটুও ভালো লাগেনা। ”

” হুম যাবোতো। তবে তুইও কিন্তু বেশিদিন সেখানে থাকতে পারবিনা। সেখানে থাকার দিন তোর ফুরিয়েছে। ”

শ্রীজা আরমানের কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়।

” বিয়ের পর তো তোকে শ্বশুর বাড়িতেই থাকতে হবে, তাইনা? না-কি জামাইকে নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকতে চাস? সোজা কথায় ঘরজামাই। ”

আরমানের দুষ্টুমিতে শ্রীজা লজ্জা পায়। আসলেই তো! ওর বাবার বাড়িতে থাকার দিন ফুরিয়েছে! হায়রে জীবন, হায়রে নারী। কোথায় যে তার আসল ঠিকানা, তা তারা নিজেই জানেনা। বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে শ্রীজার। এত বছরের মায়া কাটানোর সময় কাঁধে এসে নিঃশ্বাস ফেলছে। এ মায়া কি আদৌ কাটানো যায়?

তিনদিন চিটাগং থেকে ঢাকায় ফিরেন শহিদ আহমেদ ও তার স্ত্রী,কন্যা। আজকে তার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। অবশেষে সম্পর্কের ভীত মজবুত হয়েছে। তিনি ফিরে পেয়েছেন তার অনাদরে বেরে উঠা সন্তানকে। থেকে থেকেই তার ঠোঁট ভেদ করে হাসি বেরিয়ে আসছে। কিন্তু পরক্ষণেই শুভর কথা মনে হতেই সব হাসি উবে যায়। না জানি ছেলেটা কোথায় আছে।

শুভ ওর বাবার পাঠানো কাগজ হাতে নিয়ে রা’গে ফুঁসছে। ওর বাবা ওকে মাত্র ত্রিশ লক্ষ্য টাকার প্রপার্টি দিয়েছে! অথচ সে কোটি টাকার মালিক।

” আমাকে ত্যাজ্য করে সব প্রপার্টি ঐ আরমান আর শ্রীজাকে দিতে চায় শহিদ আহমেদ? সেটা আমি হতে দিবনা। প্রয়োজনে শহিদ আহমেদকে খুন করে আমি নিজে ফাঁসিতে ঝুলব। তবুও তাকে আমি সুখে থাকতে দেবনা। ” রাগে চিৎকার করতে থাকে শুভ।

শুভর পাশে বসে থেকে সবকিছু দেখছে ওর পার্টনার লিসা। ও ভাবছে, খুব লস হয়ে গেল। আগে শুভর সাথে সময় কাটালে প্রচুর টাকা পাওয়া যেত। শুভর যা হাতখরচ তাতে ত্রিশ লক্ষ টাকা শেষ হতে বেশিদিন সময় লাগবেনা। এখন এই টাকা শুভ নিজে চলবে নাকি ওকে দিবে? এই চিন্তাই বারবার লিসার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
অনেক ভেবে লিসা সিদ্ধান্ত নেয় টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও শুভর সাথে থাকবে।

শহিদ আহমেদে আঘাত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে শুভ। ওর নামে থাকা প্রপার্টি বিক্রি করে একজনকে ঠিক করে, শহিদ আহমেদকে শেষ করতে। সেই আততায়ী একদিন সুযোগ বুঝে শহিদ আহমেদকে ট্রাকচাপা দেয়। শহিদ আহমেদ অফিস থেকে বেরিয়ে কেবলই নিজের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন। ঘটনার আকষ্মিকতায় তিনি ভরকে যান। চেষ্টা করেন সরে আসতে কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে।
সেদিন সেখানেই মা’রা যায় তার ড্রাইভার। মুমূর্ষু অবস্থায় শহিদ আহমেদকে ভর্তি করা হয় হসপিটালে। অবস্থা খুব শোচনীয় হওয়ায় তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।

খবর পেয়ে আরমান কান্তা ও খালাকে নিয়ে ছুটে আসে ঢাকা। ওরা সরাসরি চলে যায় হসপিটালে।
আকলিমা খানম ও শ্রীজা যেন অকূলপাথারে পরেছে। অবশ্য আরমান আসার আগেও ওর বড় খালা ও খালু এসেছে। তারা আকলিমা ও শ্রীজাকে শান্তনা দিচ্ছে।
আরমানের অনুপস্থিতিতে ওর খালু যাবতীয় ঝক্কিঝামেলা সামলেছে।

আরমানকে আসতে দেখে শ্রীজা আর আকলিমা খানম হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আরমান ওদেরকে কি বলে শান্তনা দিবে ভেবে পায়না। কান্তা বড় পেট আর ভারী শরীর নিয়ে আকলিমা খানমের পাশে এসে দাঁড়ায়। নানানভাবে তাকে শান্তনা দিতে থাকে। ওর নিজেরও শহিদ আহমেদের জন্য কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এখন তাকে শক্ত হয়ে অন্যদের সামলাতে হবে। এটা ভেবেই সে নিজেকে শক্ত রেখেছে।

কিছুক্ষণ হসপিটালে থাকার পর আরমান কান্তাকে খালা ও আকলিমার সাথে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। ও আর শ্রীজা দুজনে হসপিটালে থেকে যায়। আর তাদের সাথে থাকে ওর খালা, খালু।

সাতদিন পর লাইফ সাপোর্ট থেকে ফিরে আসেন শহিদ আহমেদ। তবে তার অবস্থা এখনও ক্রিটিক্যাল।

আরমান নিজের লোক লাগিয়েছে কে ওর বাবাকে এই অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে, তার খোঁজ নিতে।

দীর্ঘ একমাস পর সুস্থ হন শহিদ আহমেদ। তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। তবে তিনি এখনও হাঁটতে পারছেননা।
কান্তা এই একমাস ঢাকাতেই আছে। ওর ডেলিভারির আর দেরি নেই। তাই আরমান ওকে চিটাগং নিয়ে যায়নি। সে সপ্তাহে দুইদিন ঢাকা এসেছে। নিয়মিত খোঁজ রেখেছে তার বাবার।

সেই ট্রাক ড্রাইভারকে অবশেষে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞেসাবাদের পর জানা যায় কেউ একজন তাকে ফোনে নির্দেশ দিয়েছিল, শহিদ আহমেদকে শেষ করতে। পুলিশ তার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে দেখল সেই সিমকার্ড বন্ধ রয়েছে। সিমকার্ডের ডিটেইলসে পুলিশ কিছুই পায়না। কারন কারও একজনের আইডিকার্ড ব্যবহার করে সিমকার্ড কেনা হয়েছিল। আইডি কার্ডের সুত্র ধরে সেই ব্যাক্তির কাছে পৌঁছালে জানা যায় তার আইডিকার্ড তিনমাস আগে হারিয়ে গেছে। ফলে মূল পরিকল্পনাকারি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

সকাল থেকেই কান্তার শরীর ভিষণ খারাপ লাগছে। ও বারবার ঘামছে, আর পিপাসা পাচ্ছে। গতরাতে আরমান বাসায় এসেছে। ফজরের নামাজ আদায় করে কান্তা আরমানের পাশে শুয়েছিল। তখন হঠাৎ করেই ওর পিপাসা অনুভূত হয়।
শরীর খারাপ থাকায় কান্তার কোন কাজ করতে হয়না। শ্রীজা, খালা আর অন্য মেইড মিলে সব কাজ করে। শহিদ আহমেদ অসুস্থ থাকার কারনে শ্রীজার বিয়ের কথাবার্তা আপাতত বন্ধ রয়েছে। রিয়াদও ক্যালিফোর্নিয়া চলে গেছে। সে তিনমাস পর দেশে ফিরবে। তখনই ওদের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই পরিবার।

একসময় কান্তার অস্বস্তি বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে সে আরমানকে ডাক দেয়। কান্তার ডাকে আরমান আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। ওর চোখ যায় কান্তার মুখে। আর তাতেই আরমানের কলিজা শুকিয়ে যায়।

” কান্তা, এই, কান্তা। কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন করছ কেন? আমি ডক্টরকে ফোন দিব? ”

” আমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে চলুন, প্লিজ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ” কান্তাকে আর কিছুই বলতে হয়না।
আরমান সবাইকে ডাক দেয়। ড্রাইভারকে বলে গাড়ি বের করতে।

হসপিটালের করিডোরে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে আরমান। আকলিমা খানম একমনে আল্লাহকে ডেকে চলছে। শ্রীজা কান্তার জন্য যতটা না চিন্তা করছে, তারথেকেও বেশি চিন্তা করছে আরমানের জন্য। ও জানে, আল্লাহ না করুন কান্তার কিছু হয়ে গেলে ওর ভাইকে বাঁচানো যাবেনা। তাই ও আরমানের পাশ থেকে সরছেনা।

” শ্রীজারে, ডক্টর এতক্ষন ভেতরে কি করছে বলতো? ওরা কি সত্যিকারের ডক্টর? এত সময় লাগারতো কথা নয়। আমাকে ওরা ভেতরেও থাকতে দিলনা। ”

” ভাইয়া, রিল্যাক্স। একটুতো সময় লাগবেই। তুমি এত হাইপার হচ্ছ কেন! দেখবে ভাবি আর আমাদের পুচকু সোনা ঠিকঠাক থাকবে। ”

” কান্তার কিছু হলে আমি হসপিটালে আ’গু’ন লাগিয়ে দিব বলে দিলাম। ওরা আমার কান্তার সাথে কি করছে! মেয়েটার বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে! ও কিভাবে এত কষ্ট সহ্য করছে? এক কাজ কর। তুই ডক্টরকে ডাক। আমি ভেতরে যাব। আমি আর এখানে এক মুহুর্তও থাকবনা। ”

কান্তা বিপদে পড়ে গেছে। ও আরমানকে থামাতেই পারছেনা। আবার ও চাচ্ছেনা আরমান ভেতরে যাক। কারন ওর ভাই করিডোরে থেকেই যেমন পাগলামো করছে, কান্তার কাছে গেলে তার অবস্থা দেখলে আরও বেশি পাগলামো করবে। ও বুঝিয়েশুনিয়ে আরমানকে একটা চেয়ারে বসায়। ততক্ষণে হসপিটালে আরমানের দুই খালা চলে এসেছে। আরমানের পাগলামি দেখে তারা আরমানকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করছে।

চলবে…

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী

টেনশন নিতে না পেরে জ্ঞান হারায় আরমান। ওকে নেয়া হয় কেবিনে। ডক্টর এসে চেইক করে জানায়, সমস্যার কিছু নেই। অতিরিক্ত টেনশনে তার এই অবস্থা।

শ্রীজা ভাইয়ের বেডের কাছে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ওর এই মুহূর্তে ভিষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু আরমানের যেকোন সময় জ্ঞান আসতে পারে ভেবে সেই ইচ্ছেকে জলাঞ্জলী দেয়।

জ্ঞান ফিরলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আরমান। কতক্ষণ সে এভাবে বিছানায় শুয়ে আছে!
আরমানকে উঠতে দেখে কেবিনে থাকা নার্স নড়েচড়ে বসে।

আরমানকে হাতের ক্যানুলা খুলতে দেখে নার্সটি কথা বলে।

” স্যার, এভাবে খুলছেন কেন? আপনার স্যালাইন এখনও শেষ হয়নি। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, স্যার। ”

” আপনি আমাকে খুলতে সাহায্য করুন। নইলে আমি এসব ছিঁড়ে ফেলব। আমাকে আমার স্ত্রীর কাছে যেতে হবে। ” আরমানের গুরুগম্ভীর গলার কথা শুনে নার্সটি আর কথা বাড়াতে সাহস পায়না। সে চুপচাপ আরমানের হাতের ক্যানুলা খুলে দেয়।

আরমান কেবিন থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে আসে। ওকে বেড়িয়ে আসতে দেখেই ওর ছোট মামা সেখানে এসে দাঁড়ায়।

” তুমি এভাবে উঠে আসলে কেন! স্যালাইন তো এখনও শেষ হয়নি! আমি মাত্রই তোমার কেবিন থেকে বের হয়েছি, আর এই সুযোগে তুমি এমন কান্ড ঘটালে! ”

” মামা, কান্তা কোথায়? ও কেমন আছে? ”

আরমানের মামা বুঝতে পারে তার ভাগ্নেকে এবার আর আটকে রাখা যাবেনা।

” এস আমার সাথে। ” বলেই আতিক সাহেব তার ভাগ্নেকে নিয়ে সামনে হাঁটা ধরলেন।

আরমানকে নিয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন অন্য একটা কেবিনের সামনে। আরমানকে ইশারা করতেই সে কেবিনের দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে।

আরমানকে ঢুকতে দেখে সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই ভাবছে, এই ছেলেটাকে স্যালাইনের সাথে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে। এখনই তার ঘুম ভাঙ্গার কথা নয়। কিন্তু সে এখন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কিভাবে সম্ভব!

সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখেও আরমান পরোয়া না করে এগিয়ে যায় বেডে শোয়া কান্তার দিকে। তার আগেই ওর সমানে এসে দাঁড়ায় শ্রীজা।

” ভাইয়া, এই নাও তোমার প্রিন্সেসকে। একদম তোমার কার্বনকপি। দেখ কেমন ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছে। ”

শ্রীজার বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় আরমান। একটা ছোট্ট পুতুল শ্রীজার কোলে হাত-পা নাড়ছে। ওকে দেখে আরমানের পা কাঁপছে। আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসছে ওর গলা। চোখ কোনে জমা হয় পানি। সৃষ্টিকর্তা ওর চাওয়া পূরণ করেছে! অবশেষ মা এসেছে ওর ঘরে! যাকে সে মেয়ের রূপে পেতে চেয়েছিল।
কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়েকে কোলে নেয় আরমান। ছোট্ট করে চুমু দেয় মেয়ের কপালে। আর তাতেই সেই পুতুল ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠে। আরমান চমকে তাকায় শ্রীজার দিকে। ওর মনে প্রশ্ন জমা হয়, ওর স্পর্শে প্রিন্সেস হঠাৎ কেঁদে উঠল কেন? ভাইয়ের চোখে ভাষা বুঝতে পেরে ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে শ্রীজা।

” চিন্তা করোনা, ভাইয়া। পুতুলে ক্ষুধা পেয়েছে, তাই কাঁদছে। তুমি ওকে নিয়ে ভাবির কাছে যাও। ”

আরমান প্রিন্সেসকে নিয়ে ধীর পায়ে কান্তার কাছে যায়। কান্তা ওকে দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। সেই সাথে কেবিনের সবারই ঠোঁটে হাসির রেখা। সবাই ভাবছে, এই ছেলেটা এত বউ পাগল কি করে হয়েছে!
এবার আরমান কেবিনের বাকি সবার দিকে নজর দেয়। ওর মামী, খালা ও আকলিমা খানম সবাই মুখ টিপে হাসছে।

” মা’কে পেয়ে কেমন বোধ করছ, আরমান? তোমার মেয়ে একদম তোমার মতই হয়েছে। তুমিও ছোটবেলায় এমন গোমড়ামুখো ছিলে। আর এভাবেই ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে। ” আরমানের বড় মামী হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন।।

মামীর কথা শুনে আরমান শুধু হাসে। মেয়ের কপালে আরেকটা চুমু দিয়ে, ওকে কান্তার দিকে এগিয়ে দেয়।

” বউমা, তুমি পাখিটাকে খাওয়াও। আমরা একটু বাহির থেকে আসছি। ডক্টর তোমাকে কবে রিলিজ দেয়, সেটা একটু শুনে আসি। যদি আজকেই রিলিজ দেয়, তবে আমি আর দেরি করবনা। নাতনিতে নিয়ে সোজা বাসায় যাব। তোমার শ্বশুর তোমাদের অপেক্ষায় ছটফট করছে। ” আকলিমা খানম ওদেরকে একা থাকার সুযোগ করে দিয়ে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

আরমান নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে কান্তার দিকে। ওর মনে উথালপাথাল ইচ্ছেরা হাতুড়ি পেটাচ্ছে নিষিদ্ধ কিছু করতে। কিন্তু আপাতত উথাল-পাথাল ইচ্ছেদের দমিয়ে রেখে, কান্তার চোখেমুখে পরপর অনেকগুলো চুমু খায়।

” তুমি ঠিক আছ, বউ? আরেকটু হলে আমি ম’রে’ই যেতাম। এত কষ্ট হয় কেন বলতো? মনে হচ্ছিল আমার কলিজা কেউ টেনে ছিঁ’ড়’ছি’ল। তুমি সহ্য করেছ কেমন করে! তোমার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল। এটাই প্রথম এটাই শেষ। আরেকটা সন্তানের জন্য বায়না কিছুতেই করতে পারবেনা বলে দিলাম। এত টেনশন আমি নিতে পারবনা। ”

” আমাকে দেখুন, আমি একদম সুস্থ আছি। মা হতে গেলে একটু কষ্ট সহ্য করতেই হয়। এতেই তো মা হওয়ার স্বার্থকতা। আজ নিজেকে পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে। সেই সাথে আপনাকে পূর্ণ করতে পেরে নিজেকে গরবিনী মনে হচ্ছে। তবে আপনার শেষ অনুরোধ আমি রাখতে পারবনা। আমার তিনটা সন্তান চাই। একটাকে নিজের বুকে পেয়েছি, এবার আর দু’জনের আসার অপেক্ষা। ”

” হোয়াট! তিনটা! ইম্পসিবল। আমার শুধু তোমাকে চাই। তিনটা সন্তান হলে তুমি আর তুমি থাকবেনা। বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে আমাকে সময় দিতে পারবেনা। আমাদের একটা প্রিন্সেসেই চলবে। আল্লাহ ওকে নেক হায়াত দিন। ওকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করার দ্বায়িত্ব তোমার। আর আমি ওর চলার পথটা মসৃণ করার দ্বায়িত্বে থাকব। এটাই আমার শেষ কথা। ”

” সেটা আর এক বছর পর দেখা যাবে। আগামী পাঁচ বছরে আমার বাড়ি জুড়ে তিনটা ছানাপোনা হেসে-খেলে বেড়াবে। এটাই আমার স্বপ্ন। এবং এটাই ফাইনাল। আপনি যদি আমার স্বপ্নে বাগড়া দেন তবে আমি রুম বদলাতে বাধ্য হব। ”

” এই বউ, এই। এসব কি বলছ? আমি তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারবনা। তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম আসেনা, তুমি এটা খুব ভালো করেই জানো। তাই এমন হিটলারের মত কথা বলবেনা। তোমার সকল স্বায়ত্তশাসন মেনে নিলেও এইটা মেনে নিবনা। প্রয়োজনে পাঁচ বছরে তোমাকে দশটা ছানাপোনা গিফ্ট করব। আমার কাছে শোয়ার দ্বায়িত্ব তোমার, আর তোমাকে ছানাপোনা গিফ্ট করার দ্বায়িত্ব আমার। আমি এই ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। বাসায় চল। আগামী ছয়মাসের মধ্যে আরেকবার সবাইকে সুসংবাদ দিব। ” আরমানের এরূপ নির্লজ্জ কথাবার্তা শুনে কান্তা লজ্জায় চোখ বন্ধ না। ও ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে আছে। আরমান এক দৃষ্টিতে কান্তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে।

আরমানের ঘোর কাটে মেয়ের কান্নার শব্দে। কান্তাও চোখ খুলে মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করে।

” আপনি বাইরে যান। আমি মেয়েকে খাওয়াব। ”

” খাওয়াও। তোমাকে কে মানা করেছে! মেয়েকে খাওয়ানোর সাথে আমার বাইরে যাওয়ার সম্পর্ক কি! আমার মেয়েকে এভাবে অভুক্ত রাখার সাহস কোথায় থেকে পাও! ”

” আপনি বাহিরে না গেলে আমি ওকে খাওয়াতে পারছিনা। ” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে কান্তা।

” এই যে লজ্জাবতী? আমার কাছে এত লজ্জার কিছুই নেই৷ এতদিন ধরে সংসার করছ, আমাকে কামনার আ’গু’নে জ্বা’লি’য়ে-পু’ড়ি’য়ে খাক করে দিয়েছ, তোমার তনু-মনের মালিক বানালে তবুও এত লজ্জা কোথায় থেকে আসে? এমনতো নয় যে তোমার শরীরের খাঁজ আমি চিনিনা। যেখানে তোমার শরীরের প্রতিটি লোমের গোড়ায় আমার বিচরণ, সেখানে তোমার লজ্জা পাওয়াটা নিতান্তই হাস্যকর। ”

কান্তা এবার রে’গে যায়। ও মেয়েকে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে, ওকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
আরমান কান্তার কান্ড দেখে মনে মনে একদফা হাসে। তবে কান্তাকে সুস্থ দেখে ও হাঁফ ছাড়ে। আরমান ভেবেছিল কান্তাকে বোধহয় সি সেকশনে নিতে হবে। কিন্তু না কান্তা স্বাভাবিকভাবেই সন্তানের জন্ম দিয়েছে।

আরমানের ছোট মামা ডক্টরের সাথে কথা বলে ঠিক করলেন, কাল সকালেই কান্তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। ডক্টর জানিয়েছে, মা ও মেয়ে দুজনেই সুস্থ থাকায়, বাসায় নিয়ে যেতে কোন সমস্যা নেই।
আজ যেহেতু রাত হয়েছে। আকলিমা খানমও চাচ্ছেননা তার নাতনিকে রাতে বাসায় নিয়ে যেতে। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় আগামীকাল সকালে কান্তাকে বাসায নেয়া হবে।

কিছুক্ষণ পর আকলিমা খানম সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে যায়। শুধু শ্রীজা আর আরমান হসপিটালে থেকে যায়।আরমানের খালা, মামী কান্তার কাছে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু আরমান জোড় করেই তাদেরকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।

আরমান সারারাত মেয়ের পাশে বসে থাকে। কান্তাকে ঘুমানোর সুযোগ দিয়ে ও মেয়ের খেয়াল রেখেছে। মেয়ে বারবার বিছানা নষ্ট করলে ও অপটু হাতে পরিষ্কার করে দিয়েছে। শ্রীজা ভাইকে অনেকবার বলেছে, ও পরিষ্কার করবে কিন্তু আরমান শোনেনি।

পরদিন সকালে আরমানের খালা ও মামী হসপিটালে আসে ওদেরকে নিতে। হসপিটালের যাবতীয় ফর্মালিটি কমপ্লিট করে ওরা বাসায় রওনা দেয়।

কান্তা ড্রয়িংরুমে পা দিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। পুরো বাড়ি সাজানো। পুরো মেঝেয় ফুলের কার্পেট। দেয়ালে বড় করে লিখা, ওয়েলকাম হোম, আওয়ার লিটল প্রিন্সেস। জ্বলজ্বল করছে লিখাগুলো।
আকলিমা খানম ও শহিদ আহমেদ অধির আগ্রহে নাতনিকে বরণ করতে অপেক্ষা করছে।

আরমান মেয়েকে কান্তার কাছে দেয়৷ কান্তা ফুলের বিছানা পা দিয়ে মাড়িয়ে এসে দাঁড়ায় শহিদ আহমেদের কাছে।
শহিদ আহমেদ কাঁপা কাঁপা হাতে নাতনিকে কোলে নেন। আনন্দে দুই ফোঁটা অশ্রু টুপ করে পরে তার চোখ থেকে। আকলিমা খানমকে ইশারা করতেই সে একটা খাম ধরিয়ে দেয় প্রিন্সের হাতে।

” বউমা, এখানে আমার নাতনির জন্য গিফ্ট আছে। সাবধানে খামটা রেখে দিও। আমার বাড়িতে কত বছর পর অথিতি আসল। আমি এই আনন্দ কাকে দেখাই। আজ নিজের কলিজা কে’টে দিতে ইচ্ছে করছে তোমাকে। তুমি বেঁচে থাক মা। সুখে থাক। ”

শহিদ আহমেদের কাছ থেকে প্রিন্সেসকে কোলে নেয় আকলিমা খানম। তার চোখমুখে উপচে পড়ছে খুশি।

সবকিছু দেখে আরমান গোপনে চোখের পানি মুছে।

বিঃদ্রঃ প্রিয় পাঠক/পাঠিকাগন আরমান-কান্তার প্রিন্সেসের নাম আপনারাই রাখুন। ‘ ক ‘ দিয়ে একটা নাম দিন। যার নাম ভালো লাগবে, সেটাই প্রিন্সেসের নাম হবে।

চলবে…