#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী
” ভাইয়া, আমাদের প্রিন্সেসের নাম কি রাখবে বলতো? আমি গতকাল থেকে অনেক খুঁজেও মনের মত নাম পাইনি। ” শ্রীজা প্রিন্সেসকে আদর করতে করতে আরমানকে জিজ্ঞেস করে। আরমান তখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল। ও আগামীকাল সকালেই চিটাগংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। আর কান্তা মেয়ের পাশে শুয়ে আছে। ওর শরীর ভিষণ ক্লান্ত।
” আইরিন বিনতে আরমান কায়া। তোদের সুবিধার্থে ছোট নাম হিসেবে ‘ কায়া ‘ রেখেছি। ” আরমান কাজের ফাঁকে জবাব দেয়।
” দাদিমার দেয়া নাম রেখেছ, ভাইয়া! ” শ্রীজা স্তম্ভিত।
” কেন তোর পছন্দ হয়নি? ”
” কেন পছন্দ হবেনা! তুমি কি অপছন্দ হওয়ার মত নাম রেখেছ! ভাবি তোমার পছন্দ হয়েছে? ”
” খুউউব পছন্দ হয়েছে। ”
” আমি যেয়ে সবাইকে প্রিন্সেসের নামটা জানিয়ে আসি। ” বলেই এক দৌড়ে রুম ছাড়ে শ্রীজা।
আরমান ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসে।
” আবার কবে আসবেন? ” মন খারাপ করে আরমানকে জিজ্ঞেস করে কান্তা।
” আগামী পনের দিনের মধ্যে আসতে পারবনা এই গ্যারান্টি দিতে পারি। ”
” তবে কি আপনার প্রিন্সেসের আকিকা আপনাকে ছাড়াই হবে? এতটা পাষাণ আপনি কবে থেকে হয়েছেন! ” কান্তার কথা শুনে হাতের কাজ রেখে কান্তার দিকে এগিয়ে আসে আরমান।
দুই হাতের আঁজলায় কান্তার মুখ নিয়ে একটু উঁচু করে।
” আমি পাষাণ হইনি। আর কোনদিন হবওনা। যার কাছে তোমার মত স্ত্রী আছে, একটা পুতুলের মত প্রিন্সেস আছে, সেই পুরুষ কখনও পাষাণ হতে পারেনা। সে হয় মহাপ্রেমিক, পাগল স্বামী আর শ্রেষ্ঠ পিতা। আমিও তেমনি একাধারে মহাপ্রেমিক ,পাগল স্বামী আর শ্রেষ্ঠ পিতা হওয়ার চেষ্টায় আছি। সেই সার্টিফিকেট একমাত্র তুমিই দিতে পারবে। ”
” আপনি অলরেডি সেই উপাধিগুলো অর্জন করেছেন। একশোয় একশো নম্বর পেয়েছেন আপনি। কিন্তু আমি এই পনের দিন আপনাকে ছাড়া থাকব কেমন করে! আর আপনিও কি আপনার প্রিন্সেসকে না দেখে থাকতে পারবেন? ”
” আমার কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে। তুমি ঢাকা আসার পর থেকে নিয়মিত অফিস করা হয়না। বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে বারবার ঢাকা আসতে হয়েছে। এবার আর তা করতে পারবনা। তুমি কষ্ট করে এই কয়েকটা দিন থাক। আমি পনের দিন পর এসে তোমাদের নিয়ে যাব। ”
” আমি পনের দিন পর চলে গেলে বাবা-মা যে কষ্ট পাবে। তারা কেবলমাত্র নাতনিকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে আছেন। তাদের এই উচ্ছ্বাসে আমি বাঁধা দিই কেমন করে! আমি একমাসের আগে এখান থেকে যেতে পারবনা যে। ” কান্তা মুখ ভার করে বলে।
” তবে এই একটা মাস আমাকে ছাড়াই একটু কষ্ট করে থাক। আমি চেষ্টা করব ছুটি নিতে। তোমাদের ছেড়ে থাকতে আমারও কষ্ট হবে। ” আরমান কান্তার পুরো মুখে আর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
জাবেদ ঘরে বসে স্কুলের কাজ করছে। তার পাশে আরাফ বই নিয়ে বসে আছে। শিখা ঘর গোছাচ্ছে। আলমিরাতে কাপড়চোপড় রাখতে যেয়ে একটা প্যাকেট পায় শিখা। কৌতুহলবশত সেটা খুলে দেখে সে। প্যাকেট খুলতেই দুইটা বাক্স পায় সে। গহনার বাক্স। অবাক হয়ে বাক্স দুটো খুলতেই শিখা দেখল একটাতে সোনার চেইন সাথে কারুকার্যখচিত লকেট আর একজোড়া সোনার দুল। আরেক বাক্সে ছোট একজোড়া সোনার চুরি। শিখা ভাবছে ও নিজেতো এগুলো কিনেনি, তাহলে এগুলো অবশ্যই জাবেদ কিনেছে। কিন্তু কার জন্য এগুলো কিনেছে সে? আর ওকেই বা জানায়নি কেন?
” এগুলো কার জন্য কিনেছ? আমাকে দেখাওনি কেন? ” চুরি জোড়া হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে শিখা।
” দেখানোর প্রয়োজন মনে করিনি তাই দেখাইনি। সবকিছু যে তোমাকে দেখিয়েই করতে হবে, এটা কি কোথাও লেখা আছে? তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে কেন সেগুলোতে হাত দিয়েছ? সেগুলো যেমন ছিল তেমনভাবে রেখে দাও। ” বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয় জাবেদ।
” তুমি সংসারের ক্ষতি করে কার না কার জন্য এসব কিনেছ, আমি জিজ্ঞেস করলেই দোষ? কার জন্য কিনেছ এসব? আমার সংসার ধ্বংস করে লুকিয়ে লুকিয়ে কাকে এসব দিবে? ”
” এই সংসার শুধু তোমার নয়, আমারও। তোমার থেকে সংসারের ওপর মায়া আমার কম নেই। তুমি যখন নিজের বোনকে সোনার দুল, রিং, চেইন গড়িয়ে দিয়েছ, বড় বোনের মেয়েকে চেইন দিয়েছ, মামাত বোনের মেয়েকে চেইন দিয়েছ, মামাতো ভাইয়ের ছেলেকে ব্রেইসলেট দিয়েছ, তোমার ভাইকে চেইন দিয়েছ তখন সংসারের চিন্তা কোথায় ছিল? তখন আমি কি একবারও তোমাকে কোন প্রশ্ন করেছি? আজ আমি যখন এই সামান্য জিনিসগুলো এনেছি, তখন তোমার এত প্রশ্ন কেন? ওগুলো যেখানে ছিল সেখানেই চুপচাপ রেখে দাও। ”
জাবেদের খোঁটা শুনে মিইয়ে যায় শিখা। কিন্তু ও দমবার পাত্রী নয়। পূর্ণদমে আবারও কথা বলে।
” আমি আমার কাছের মানুষদের দিয়েছি। এতে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু তুমি এসব কার জন্য কিনেছ? তোমার কাছের কে এমন আছে? ” সন্দেহের সাথে জিজ্ঞেস করে।
” কেন, আমাকে কি তোমার বেওয়ারিশ মনে হয়? আমার কি কোন আত্মীয়, আপনজন থাকতে পারেনা? তুমি আমার সংসারে আসার আগ পর্যন্ত আমার সবকিছু ছিল। কিন্তু তুমি এসে সবাইকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছ। আমার আত্নীয়-স্বজনদের অকারনে অপমান, অসম্মান করে, নিজের বাপের বাড়ির সবাইকে নিয়ে মেতে থেকেছ। অথচ আমার আত্মীয়স্বজনদের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমার বাপের বাড়ির কারও নেই। ”
” তুমি আমাকে কি মনে করেছ? আমি তোমার কেনা পুতুল? যখন যা ইচ্ছা তাই বলবে? তোমার সব আত্মীয় স্বজনরা লাটসাহেব আর আমার বাপের বাড়ির সবাই ফকির? তুমি কার জন্য এসব কিনেছ? এক কথায় জবাব দাও। ” শিখা এবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে।
আরাফ মায়ের এরূপ উচ্চবাচ্য দেখে মনে মনে বিরক্ত হয়, কিন্তু কিছু বলার সাহস পায়না।
” আমার ভাগ্নীর জন্য এগুলো কিনেছি।” উত্তর দিয়ে নিজের মত কাজ করতে থাকে জাবেদ।
” ভাগ্নী! তোমার ভাগ্নী আবার কে? কোথায় থেকে আবার তোমার ভাগ্নী গজালো? ”
” ভালোভাবে কথা বল। আমার ভাগ্নী কে হতে পারে, কোথায় থেকে আসতে পারে এটা বুঝতে হলে নিশ্চয়ই তোমাকে পিএচডি ডিগ্রীধারী হতে হবেনা। ” জাবেদের চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শিখা একটু ভয় পায়। বেশ কিছুক্ষণ ভাবনার পরও ওর খটকা যায়না।
” তবে কি তোমার বোনের মেয়ে হয়েছে? ”
” হুম। ”
” কবে? তোমাকে খবর দিয়েছে? নাকি বেহায়ার মত তুমি যেচে ফোন করেছ? ”
” বোনের খবর নিতে গেলে যদি বেহায়া হতে হয়, তবে আমি এক হাজার বার বেহায়া হতে রাজি আছি। এতে তোমার সমস্যা হচ্ছে কেন? ”
” তোমার বোনের মেয়ে হয়েছে ভালো কথা। কিন্তু এই অভাবের মধ্যে এতগুলো জিনিস কেন কিনলে? তোমার বোনের স্বামী নাকি এএসপি হয়েছে। সে কি দিয়েছে তোমার ছেলেকে? যে আজ তার মেয়ের জন্য তুমি এত কিছু কিনেছ? ”
” বিয়ের পর আমার বোনকে কয়দিন নায়র এনেছ তুমি? আরমানকে কয়দিন জামাই আদর করেছ যে ছেলের জন্য আশা করছ? কিছু পেতে কিছু দিতে হয়। এই কথাটা বোধহয় তোমার জানা নেই? তুমি তাদেরকে কিছু না দিয়েই, ছেলের জন্য পেতে চাচ্ছ? তা তোমার বাপের বাড়িতে যে এতকিছু দিয়েছ, তারা আমাকে কি দিয়েছে? ঐ বছরের একটা ঈদে পাঞ্জাবি ছাড়া কিছুইতো দেয়না। আর আমার ছেলের হাতে পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে দ্বায়িত্ব সাড়ে। তবুও তুমি তাদের পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচ কর কেন? তখন সংসারের অভাবের কথা চিন্তা হয়না? ”
এবার শিখার মুখ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ও ভেতরে ভেতরে রাগে গজরাতে থাকে। জাবেদ কান্তার মেয়েকে এত কিছু দিবে, সেটা ও মানতেই পারছেনা।
আরমান গতকালই চিটাগং চলে গেছে। কান্তা মেয়েকে নিয়ে অলস সময় পার করছে। মেয়েকে খাওয়ানো ছাড়া কোন কাজই করতে হচ্ছেনা ওকে। আকলিমা খানম দুইজন কাজের মেয়ে রেখেছে কান্তা আর ওর মেয়ের কাজ করার জন্য। বসে থেকে ওর হাত-পায়ে খিল ধরে গেছে। আরমান আধাঘন্টা পরপর ফোন করে ওদের খবর নিচ্ছে। সুযোগ পেলেই ভিডিও কলে মেয়েকে দেখে নিচ্ছে। এ নিয়ে বাসার সবাই হাসাহাসি করছে। শ্রীজা পদে পদে কান্তাকে খোঁচাতে ছাড়ছেনা।
দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আছে। শ্রীজা প্রিন্সেসকে কোলে নিয়ে ওর মায়ের সাথে গল্প করছে। খালা কান্তার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। কান্তার চুল এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। কোমড় ছুঁয়েছে ওর ঘন কালো চুলগুলো। খালা সুন্দর করে ওর চুলে বিলি কাটছে। এতে একটু তন্দ্রাভাব আসে কান্তার।
গল্পগুজব, হাসিঠাট্টার মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। একজন মেইড উঠে যেয়ে দরজা খুলে দেয়। কিন্তু সে আগন্তুককে চিনতে না পারায় আকলিমা খানমের শরণাপন্ন হয়। আকলিমা খানমও যেতে পারছেনা। তাকে কেবলমাত্র হুইচ চেয়ার থেকে সোফায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে শ্রীজাকে উঠতে হয়। ও প্রিন্সেসকে কোলে নিয়েই দরজার কাছে যায়।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও কয়েক মুহুর্ত পর বুঝতে পারে এরা কারা। সে হেসে তাদের ভেতরে আসতে বলে।
আগন্তুককে নিয়ে ভেতরে আসতেই কান্তার চোখ যায় সেদিকে। ও অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। দুই বছর পর ও ভাই আর ভাতিজাকে দেখছে।
জাবেদ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ শ্রীজার কোলে থাকা পুতুলের দিকে৷ একটু পর দারোয়ান চাচা মালিকে সাথে নিয়ে ভেতরে আসে। তাদের হাতে অনেক জিনিসপত্র।
কান্তা এতদিন পর ভাইকে দেখে আবেগে কেঁদে ফেলে। দ্রুত পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে আরাফকে। দুই বছরের ব্যবধানে ছেলেটা কত বড় হয়েছে! কে বলবে, এই ছেলে একদিন ফুপুর ন্যাওটা ছিল! ফুপুর ওড়নার কোনা ধরে এটাসেটা বায়না করত!
আরাফকে বুকে জরিয়ে নিয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলে কান্তা। জাবেদের চোখেও পানি।
এদিকে শ্রীজা জিনিসপত্রের কথা দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, এসব জাবেদ এনেছে।
আকলিমা খানমের সাথে জাবেদকে পরিচয় করায় কান্তা। আকলিমা খানম হেসে তাকে বাড়িতে স্বাগত জানায়।
বিঃদ্রঃ আপনাদের দেয়া নামের মধ্যে থেকে ‘ কায়া ‘ নামটি রাখলাম আরমান-কান্তার প্রিন্সেসের জন্য। অনেকেই ইনবক্সে আমাকে অনুরোধ করেছিল এই নামটি রাখবার জন্য। আপনারা যারা অন্য নাম সাজেস্ট করেছিলেন, সবগুলো নামই সুন্দর ছিল। অনেক অনেক ভালোবাসা রইল আমার পাঠক মহলের জন্য।
চলবে…
#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী
আরমান বেশ কয়েকবার কান্তাকে ফোন দিয়ে পায়না। কান্তাকে না পেয়ে ওর কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয়। দুরুদুরু বুকে ফোন করে শ্রীজাকে। শ্রীজা তখন ড্রয়িংরুমে আরাফের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিল। জাবেদ শহিদ আহমেদের সাথে গল্প করছিল। কান্তা কেবলই কায়াকে ঘুমিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসেছে।
শ্রীজা ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরমানের নম্বর।
ও কথা না বলে ফোন এগিয়ে দেয় কান্তার দিকে।
কান্তা আরমানের নম্বর দেখে করিডোরের দিকে যায়।
” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনি? ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। তুমি কোথায় আর তোমার ফোন কোথায়? কতবার ফোন দিয়েছি, জানো? আমি ভয় পেয়ে গেছি। আমাকে হার্ট অ্যাটাক করানোর ধান্দায় আছো? বেয়াদব মেয়ে, একটাবারও ফোন করলে ঠিক সময়ে পাওয়া যায়না। ” আরমানের বকা শুনেও কান্তার কষ্ট হয়না। বরং ওর ভিষণ হাসি পাচ্ছে। লোকটা কত চিন্তা করে ওর জন্য।
” আপনার মেয়েকে ঘুমিয়ে দিচ্ছিলাম। তাই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছি। পরে আর ভায়োলেন্ট করতে মনে নেই। এরপর ড্রয়িংরুমে এসে বসেছি। সব সময়ই খালি পুলিশি মেজাজ দেখানোর তালে থাকেন! যতসব ভন্ড পাব্লিক। ”
” এই তুমি কি বললে? ভায়োলেন্ট মানে জান? ফোন সাইলেন্ট মোড থেকে নরমাল মোডে আনতে হয়। আর তুমি ভায়োলেন্ট মোডে আনবে, মানে? আর আমি ভন্ড পাব্লিক? অশিক্ষিত মেয়ে ওয়ার্ড মিনিং জানেনা, আবার আমাকে ভন্ড বলে! এই মুহুর্তে আমি তোমার সামনে থাকলে কানের নিচে তবলা বাজাতাম। ”
” পারেনতো ঐটাই। ঘরে বউ কিছু বললে, কানের নিচে তবলা বাজাবেন। বাইরে পাব্লিক কিছু বললে লাঠি দিয়ে পেছনে তবলা বাজাবেন। আপনার জীবনটাই তবলাময়। এক কাজ করেন, চাকরি ছেড়ে তবলার ব্যবসা ধরেন। জীবনে প্রচুর উন্নতি করবেন। ”
আরমান বুঝতে পারছে এখন ও যা-ই কিছু বলুকনা কেন ওর বউ ওকে খোঁ’চা’বে। তাই আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এর শোধ পরেও নেয়া যাবে।
” দুপুরে খেয়েছিলে? আমার প্রিন্সেস কেমন আছে? তোমাকে বিরক্ত করেনাতো? ”
” আমরা সবাই দুপুরে খেয়েছি। আপনার প্রিন্সেসও ভালো আছে। ও তো আর বাপের মত হয়নি, যে আমাকে বিরক্ত করবে। আমার সোনা মেয়েটা একদম আমার মত লক্ষ্মী হয়েছে। বাপের মত ত্যাঁদড় হয়নি। ”
” কান্তা। ” দাঁতে দাঁত পিষে বলে আরমান।
” জ্বি, পতি মহাশয়। আজ্ঞা করুন। ”
” আমাকে শুধু ঢাকা আসতে দাও। ”
” এখনই ওয়েলকাম। চলে আসুন। ”
” আচ্ছা রাখছি। ” হাল ছেড়ে দিয়ে বলে আরমান।
” এই না, রাখবেননা। আমার কথা শেষই হয়নি। আর এই কিপ্টে লোক ফোন রেখে দিচ্ছে! বউয়ের প্রতি একটুও দরদ নেই দেখছি কিপ্টেটার! ”
” দেখ, সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। এখনও খাওয়া হয়নি। বাসায় এসেই আগে তোমাকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু তুমি ভালোভাবে একটা কথাও বলছনা। আমি রেগে গেলে তোমাকে কি করতে পারি জান? ”
” আপনি আপাতত আমাকে কিছুই করতে পারবেননা। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। এখন গোসল করে খেয়ে নিন। এরপর ভিডিও কল দিয়েন। ততক্ষণে আপনার প্রিন্সেসও উঠে যাবে। ”
” আরও দশ মিনিট পর গোসল দিব। আগে বউয়ের সাথে কথা বলে নিইন। বউটাকে কতদিন দেখিনি। বউ বিনা বুকের ভিতর শূন্য শূন্য লাগছে। ”
” ঢাকা থেকে গেছেন চারদিন আগে। তাতেই কতদিন হয়ে গেছে! ”
” তুমি এসব বুঝবেনা। ঝগরুটেরা কখনও ভালোবাসা বুঝে। আমার সীমাহীন ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা তোমার মত ঝগরুটে মেয়ের নেই। আমার কাছে একেকটা দিন তোমাকে ছেড়ে থাকার মানে, যুগ-যুগান্তর তোমাকে কাছে না পাওয়ার সামিল। তোমার ঠোঁটের হাসি একদিন না দেখলে নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে। তোমার তনুর সুবাস না নিলে অপূর্ণতায় আমার তনু-মন ছেয়ে যায়। কিন্তু তুমি বোকা রমনী, আমার চাওয়া আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলেনা। ”
” ওহে চালাক পুরুষ, এবার উঠুন। গোসল সেরে কিছু খেয়ে নিন। এরপর যত খুশি প্রেমালাপ করবেন। ”
” আমার রোমাঞ্চে পানি ঢালতে তুমি সদা তৎপর দেখছি। আজকাল বড্ড বেশি উড়ছ। তোমার পায়ে শিকল পড়ানোর সময় এসে গেছে। আমার নামের প্রেমের শিকল। তখন উঠতে-বসতে আমার প্রেমালাপের সুরে সুর মেলাবে। আজ আমি যেমন ছটফট করছি, সেদিন তুমি এমন ছটফট করবে। প্রেম পিপাসায় তোমার বুকটা খাঁ খাঁ করবে। এই আরমানের ভালবাসা ছাড়া কোন সরোবরের পানিতে এই পিপাসা মিটবেনা। ”
” যেদিন আপনার বউ হয়ে এসেছি, সেদিন থেকেই আমি আপনার ভালোবাসার পিপাসায় পিপাসার্ত। যতই ভালো বাসুননা কেন এই পিপাসা মিটবার নয়। পিপাসা না মিটে বরং বেড়ে যায়। আমার জীবনে আপনাকে পেয়ে আমি গৌরবে গরবিনী। ”
” ভালোবাসি জান পাখি অনেক ভালোবাসি তোমাকে। এবার আমার প্রিন্সেসের কাছে যাও। আমার মেয়েটা অনেকক্ষণ যাবৎ একলা আছে। ”
” আপনিও উঠুন। এভাবে অনিয়ম করবেননা। ”
” হুম। রাখছি। ”
” আরেকটা কথা। ”
” বল। ”
” ভাইয়া এসেছে, আপনার প্রিন্সেসকে দেখতে। ”
” ভাইয়া! ” আরমান একটু অবাক হয়।
” আমার বড় ভাইয়া আর আরাফ। ”
” আচ্ছা! অনেক ভালো হয়েছে তারা এসেছে। তাদের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না হয়। আর তারা যেন কয়েকটা দিন ঢাকায় থাকে। শ্রীজার সাথে আরাফকে ঘুরতে পাঠিয়ে দিও। তোমার কাছে টাকা আছেতো? সেখান থেকে ভাইয়া, আরাফ আর ভাবির জন্য পোশাক কিনে দিও। শোন তোমার কাছে যেই টাকা আছে থাক। আমি এক্ষুনি তোমার এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছি। সেখান থেকে কিনে দিও। ”
” আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! আচ্ছা, এসব নিয়ে পরে কথা হবে। আপনি আগে গোসল সেরে খেয়ে নিন, প্লিজ। আমি রাখছি। ” ফোন কেটে দেয় কান্তা।
” কান্তা, আসব? ” জাবেদ কান্তার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
” এস ভাইয়া। ”
জাবেদ ভেতরে আসলে কান্তা ওকে বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দেয়। জাবেদ বিছানার পাশে চেয়ার টেনে নেয়।
কায়া ঘুমাচ্ছে। আর ওর পাশে আরাফ বসে আছে। শ্রীজা ডিভানে থাকা কাপড়চোপড় গোছাচ্ছে। তবে জাবেদকে ভেতরে আসতে দেখে শ্রীজা বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
” শ্রীজাপু, তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ! ”
” তোমরা কথা বল। আমি পরে আসব। ”
” আমাদের এমন কোন গোপন কথা নেই যে তোমার বাইরে যেতে হবে। তুমি কোথাও যাবেনা। যাও যা করছিলে কর। ”
” শ্রীজা, আমি আসার পর থেকে তোমার সাথে তেমন কথা হয়নি। তুমি এখন এখানে থাকলে, এই সুযোগে গল্প করা যাবে। এস আমার কাছে এসে একটা চেয়ার নিয়ে বস। ” জাবেদ হাসিমুখে বলল।
” ভাইয়া, গল্প করার জন্য আরও অনেক সময় আছে। অনেকদিন পর আপনি বোনকে কাছে পেয়েছেন। দু’জনে মন খুলে গল্প করুন। আমরা বরং কালকে গল্প করব। ” শ্রীজা হাসিমুখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
জাবেদ ভাগ্নীর মুখের দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর ওর মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়।
” এগুলো আমার মা’কে পরিয়ে দে। দেখি কেমন লাগে। ” জাবেদ তার হাতে থাকা প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় কান্তার দিকে।
” এখানে কি আছে? ” কান্তা অবাক হয়ে জানতে চায়।
” খুলেই দেখ। ”
কান্তা প্যাকেট খুলে অবাক হয়ে গেছে। প্যাকেটে থাকা বক্সের মধ্যে সোনার চেইন, দুল আর চুরি।
” ভাইয়া, তুমি এতসব কিছু ওর জন্য এনেছ! কি করেছ এসব? এগুলো লাগবেনা, ভাইয়া। তুমি আমার মেয়ের জন্য দোয়া কর। ”
” কেন আমার বুঝি ওকে কিছু দিতে ইচ্ছে করেনা? আমাকে পর করে দিসনা, কান্তা। তোর সাথে যে অন্যায় করেছি, জানি তার কোন ক্ষমা নেই। তুই এগুলো নিলে, নিজের কাছে আমার অপরাধ একটু হালকা লাগবে। তুই ফিরিয়ে দিসনা এসব। আমার ছোট্ট মা’য়ের হক আছে তার মামার জিনিসের ওপর। তোর কাছে হাতজোড় করছি। ” জাবেদ কান্তার হাত ধরে কেঁদে ফেলে।
” ভাইয়া, এভাবে বলোনা। ঠিক আছে আমি এগুলো নিব। তবুও তুমি চোখের পানি মোছ। আমি এখনই তোমার মা’কে এগুলো পরিয়ে দিচ্ছি। তুমি দেখে বল ওকে কেমন লাগছে। ”
কান্তা কাঁপা কাঁপা হাতে প্রিন্সেসের গলায় চেইন, হাতে চুরি জোড়া পরিয়ে দেয়। এরপর ফোনে কয়েকটা ছবি তুলে আরমানের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
আরমান ফোন হাতে নিয়ে দেখল ম্যাসেঞ্জারে কান্তার অনেকগুলো ম্যাসেজ এসেছে। ও হাসিমুখে ম্যাসেঞ্জার ওপেন করেই হা হয়ে গেছে।
ওর ঘুমন্ত প্রিন্সেসের ছবি। প্রিন্সেসের গলায় চেইন সাথে কারুকার্যখচিত লকেট, হাতে বালা, কানের খাঁজে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সুন্দর ঝুমকো জোড়া। এতেই যেন পরীর মত লাগছে ওর কন্যাটিকে।
কান্তা ম্যাসেজে লিখেছে, পুতুলের মামা এনেছে।
ম্যাসেজের জবাবে আরমান লিখে, মাশা-আল্লাহ।
শহিদ আহমেদের জোড়াজুড়িতে জাবেদ তিনদিন ঢাকায় থাকে। এই তিনদিনে শ্রীজা আরাফকে নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। কেনাকাটা করে।
এই তিনদিনে আতিথিয়তার কোন কমতি রাখেনি আকলিমা খানম। তার আতিথিয়তায় মুগ্ধ হয়ে গেছে জাবেদ। সে মনে মনে ভিষণ খুশি হয় এই ভেবে যে, তার বোন সুখে আছে।
শহিদ আহমেদ শ্রীজাকে টাকা দিয়েছেন জাবেদের পারিবারের সবার জন্য কেনাকাটার করতে। শ্রীজা নিজের পছন্দমত আরাফ, জাবেদ আর শিখার জন্য পোশাক কিনে।
তিনদিন পর জাবেদ বিদায় নেয় বোনের কাছ থেকে। যাবার সময় বোনের মাথায় হাত রেখে কেঁদে ফেলে জাবেদ। শহিদ আহমেদকে তার পরিবারসহ গ্রামে যেতে দাওয়াত দেয়। শহিদ আহমেদ জানান, সুযোগ পেলেই তিনি সবাইকে নিয়ে জাবেদের গ্রামে যাবেন।
জাবেদ যাওয়ার দুইদিন পর কান্তার ফুপু আসে কায়াকে দেখতে। তিনিও অনেক কিছু এনেছেন এই বাড়ির সবার জন্য। তিনি দুইদিন কান্তার সাথে কাটিয়ে মেয়ের বাসায় যান।
কান্তার এই কয়েকটা দিন খুব ভালো কাটে। ভাই , ফুপু আসায় ওর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে।
পনের দিন পর আরমান ঢাকায় এসেছে। এই কয়দিনে মেয়েটা একটু বড় হয়েছে। হাত-পা নেড়ে খেলতে শিখেছে। শব্দ শুনে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। আরমান মেয়েকে এতসব কিছু করতে দেখে বাঁধভাঙা খুশিতে কান্তাকে জড়িয়ে ধরে। কান্তা আরমানের খুশির পথে বাঁধা না হয়ে দেখতে থাকে, একজন বাবার উপচে পড়া উচ্ছ্বাস।
চলবে…..