#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৪৪
জাওয়াদ জামী
জাবেদ পরিবারসহ ঢাকায় এসেছে। শিখার শরীর এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো আছে। তাই শীজার বিয়েতে দাওয়াত পেয়ে ঢাকায় আসতে অমত করেনি।
ও অনেক কিছু নিয়ে এসেছে। সবার জন্য পোশাক, ওদের জমির ধানের চাল, শাক-সবজি, পুকুরের মাছ, বাড়ির পোষা হাঁস-মুরগির মাংস ফ্রীজিং করে এনেছে। সেই সাথে এনেছে কয়েকরকম পিঠা।
কান্তার মেয়ের জন্য একজোড়া সোনার দুল, কান্তার জন্য একজোড়া সোনার বালাও এনেছে।
শিখা হাসিমুখে কান্তার হাতে বালা জোড়া পরিয়ে দিতে দিতে বলে,
” তোর বিয়েতে তো কিছুই দিইনি। এরপর একে একে সব গহনাই গড়িয়ে দিব। আরমানেরও কিছু পাওনা আছে। বিয়েতে নতুন জামাইকে বরণ করিনি, এরপর তার পালা। তোর কোন বারন আমি শুনবনা।
” ভাবি, এসবের কোন দরকার নেই। উনি এসব পছন্দ করেননা। আমাদের যথেষ্ট দিয়েছ। আর কিছুই দিতে হবেনা । শুধু আমাদের জন্য দোয়া কর। ”
” কিছু না দিতেই এই কথা বলছিস? বাবার বাড়ি থেকে তোর যা যা প্রাপ্য, তার সবটাই আমি দিব। হয়তো একবারে দিতে পারবনা। তবে ধীরে ধীরে সবকিছুই দিব। তুই নিষেধ করলেও শুনবনা।
ওদের দুজনের কথোপকথনের মাঝেই রুমে আসে আরমান। মেয়েকে নিয়ে ও বাইরে গিয়েছিল।
আরমানের কোলে কায়াকে দেখে শিখা ওকে নিতে হাত বাড়ায়। আরমানও মেয়েকে শিখার দিকে এগিয়ে দেয়। শিখা কায়াকে কোলে নিলে, আরমান একটা চেয়ার টেনে ওদের পাশে বসে।
শিখা কানের দুল জোড়া বের করে কায়ার কানে ছোঁয়ায়।
” দেখেছিস কান্তা, আম্মুটাকে কত সুন্দর লাগছে! ঠিক যেন ছোট্ট পরী। এবার কিন্তু ওকে নিয়ে তোদের গ্রামে যেতেই হবে। কি আরমান যাবেতো? ”
” আপাতত কিছুদিন ছুটি নেয়ার উপায় নেই, ভাবি। নেহাৎই বিয়েটা শ্রীজার তাই আম এসেছি। অন্য কারও বিয়ে হলে আমি আসতামই না। ”
” আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ দাও, আরমান। তোমাকে বাড়ির জামাইয়ের মর্যাদা দিইনি, বিয়ের পর থেকে কান্তাকে নায়র নিয়ে যাইনি, তোমাদের খোঁজ খবর রাখিনি, এসব অপরাধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তুমি রাগ করে থেকে আমার অপরাধ আর বাড়িয়ে দিওনা, ভাই। একটাবার গ্রাম থেকে ঘুরে এস। আমার দোষে মেয়েটাও কতদিন বাবার বাড়িতে যায়নি। ” শিখার চোখে অনুশোচনার অশ্রু।
আরমান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শিখার দিকে। ও ভাবছে, মেয়েরা আসলেই অন্যরকম। নিজের স্বার্থে তারা যেমন আত্নকেন্দ্রীক হতে পারে, তেমনি সেই মেয়েরাই একটু ভালোবাসা পেলে নিজেদের সব সম্পদ উজার করে দিতে দুইবার ভাবেনা। পরম শত্রুকেও আপন করে নেয়ার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা এদের দিয়েছেন।
” আগে বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক। এরপর সময় বের করে শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যাব। তবে সেটা দুইমাসের আগে সম্ভব নয়। ”
” লাগুক দুইমাস। তারপরও তোমাকে যেতেই হবে। তোমার আর কান্তার পছন্দের সব খাবার রান্না করে খাওয়াব। ততদিনে আমার এই ছোট্ট আম্মুটাও খেতে শিখে যাবে। ”
শিখার প্রতিটি কথা আজ কান্তার চোখে পানি নিয়ে আসছে। ও ভাবতেই পারেনি, ওর সেই হিংসুটে ভাবির এত পরিবর্তন হবে।
শহিদ আহমেদ বাড়ি লোকে লোকারণ্য। গতকাল থেকে বাড়তি কেউই কাজে ফুরসত পাচ্ছেনা। আকলিমা যাবতীয় দ্বায়িত্ব কান্তার কাছে দিয়ে, নিজে শুধু রান্নাঘরের দ্বায়িত্ব নিয়েছে। বাসায় আগত মেহমানরা কে, কি খাবে সেসব তদারকি সে হুইল চেয়ারে বসেই করছে।
শিখা কান্তাকে হাতে হাত মিলিয়ে সাহায্য করতে চাইলেও, কান্তা ওকে ভারি কোন কাজ করতে দিচ্ছেনা। ও শিখাকে শ্রীজার আশেপাশে থাকার কাজ দিয়েছে। সেই সাথে ওর মেয়ের দ্বায়িত্ব দিয়েছে। শিখাও খোলা মনে ওর দ্বায়িত্ব পালন করছে।
আজ শ্রীজার বিয়ে। বধূবেশে ওকে মোহনীয় লাগছে। আকলিমা খানম দূর থেকে মেয়েকে দেখে চোখের পানি মোছে। মেয়েটা আজ থেকে অন্যের ঘর আলোকিত করবে। তার নিজের ঘর আজ অন্ধকারে পতিত হবে। স্রষ্টার এ কেমন বিধান! যাকে ভালোবেসে, বুকে করে মানুষ করল, তাকেই আজ অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে! তার শহরে আজ থেকে অন্য কেউ রাজত্ব করবে।
বিদায় বেলায় শ্রীজা নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ওর কান্না দেখে সবার চোখে পানি আসে। ও কিছুতেই যেতে চাইছেনা। কিন্তু আজ সবাই নিরুপায়। কারও মনে না চাইলেও ওকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাতেই হবে। আরমান বোনকে অনেক বুঝিয়ে গাড়িতে বসায়।
আকলিমা খানম ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শহিদ আহমেদেরও চোখে পানি। তিনি যেখানে নিজেকেই সামলাতে পারছেননা, সেখানে স্ত্রীকে কিভাবে সামলাবেন!
” আকলিমা, এভাবে কেঁদনা। তুমি ওর জন্য দোয়া কর। মেয়েটা বাসায় পৌঁছালে ওর সাথে কথা বলে নিও। আজ দুপুরে বোধহয় কারও খাওয়া হয়নি! তোমার ঔষধও খাওয়া হয়নি। না খেয়ে থেকে এভাবে কাঁদলে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। ”
” আমি কিছুতেই নিজেকে বুঝ দিতে পারছিনা। মেয়েটা যতক্ষণ বাসায় থাকত, ততক্ষণ আমার সামনে ঘুরে বেড়াত, এটাসেটা করত। আমার সেই মেয়েটা কাল থেকে আর আমার সামনে ঘুরবেনা। আমি ওকে না দেখে কিভাবে থাকব! ”
” অভ্যেস করতে হবে। মানুষ অভ্যাসের দাস। মেয়ের ভালোর জন্য এতটুকু আমাদের করতেই হবে। তুমি নিজেকে সামলাও। ”
” শ্রীজা পৌঁছে গেছে ঐ বাসায়। খালা আমাকে এখনই ফোন করে জানাল। ও ভালো আছে। ঐখানে কি কি সব ফর্মালিটিজ আছে, সেগুলো করছে। ফ্রি হয়ে ফোন করবে। এবার আপনারা খেতে চলুন। সেই সকালে একটু খেয়েছি। পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। সব মেহমানরা খেয়েছে। এবার আমাদের পালা। ” আরমান দরজায় দাঁড়িয়ে বলল।
” আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে যাও। বউমার ভাই-ভাবীসহ খেয়ে নাও। ”
আরমান রুমের ভেতরে আসে। বিছানায় আকলিমা খানমের পাশে বসে। আকলিমা খানমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।
” কেন মা, আপনি খাবেননা কেন? আপনি, বাবা আমরা সবাই মিলে একসাথে খাব। আর আপনি না খেলে কান্তাও খাবেনা। ”
আরমানের মুখে মা ডাক শুনে আকলিমা খানম স্তম্ভিত হয়ে যায়। সে আরমানকে জাপ্টে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। তার বিশ্বাসই হচ্ছেনা, আরমান তাকে মা বলে ডেকেছে!
” তুমি আমাকে মা বলে ডাকলে! এত সুখও আমার কপালে ছিল! আজ শুভকে হারানোর দুঃখ আমার ঘুচল। তুমি আমার দুঃখ ঘোচালে। তোমার মত সন্তান যেন প্রতিটা নারী তাদের গর্ভে ধরে। আজ থেকে শুভর জন্য আফসোস আমার বন্ধ হল। আমি আজ পূর্ণ, তোমার মত সন্তানকে পেয়ে। ” আকলিমা খানম আরমানের চোখেমুখ, মাথা, পিঠে হাত বোলাচ্ছ। তার কান্না কিছুতেই থামছেনা।
শহিদ আহমেদও কম অবাক হননি! তার ছেলে কত বছর পর তাকে বাবা বলে ডাকল! অবশেষে ছেলেকে নিজের করে ফিরে পেলেন তিনি।
” আমাকে চেয়ারে বাসাও। আমার ছেলে আমাকে মা বলে ডেকেছে। আজ তাকে আমি কিভাবে ফিরিয়ে দিই! চল আমরা একসাথে খাব। ”
আরমান আকলিমা খানমকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
” কই তুমি যাবেনা৷? ছেলে ডাকতে এসেছে অথচ তুমি এভাবে বসে আছ! ” আকলিমা খানমের ধমকে নড়েচড়ে বসেন শহিদ আহমেদ।
” বাবা, চলুন। ”
এবার শহিদ আহমেদ উঠে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। এরপর তিনজন রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
সাতদিন পর জাবেদ স্ত্রী, সন্তান নিয়ে গ্রামে ফিরছে। ওরা আগেই যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আকলিমা খানম যেতে দেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে ওদের থাকতে হয়।
যাবার আগে জাবেদ আরমানকে রাজি করিয়েছে দুইমাস পর গ্রামে যাওয়ার জন্য। আরমান রাজি হলে জাবেদের বুকের ওপর থেকে বোঝা হালকা হয়।
আরমান চিটাগং একা ফিরে যায়। তবে ওর বাবা-মা’কে বলে যায়, পনের-বিশদিন পর কান্তার সাথে চিটাগং যেতে। আকলিমা খানমও রাজি হয়। সে আরমানের সব কথা একবাক্যে মেনে নেয়। এখন আর শুভর জন্য কষ্ট হয়না তার। সে মনে মনে এটাই ভাবে, এক কুলাঙ্গার সন্তান চলে গেছে তো কি হয়েছে! আরেকটা আদর্শ সন্তান সে পেয়েছে।
চলবে…