কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0
451

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#অন্তিম
জাওয়াদ জামী

কেটে গেছে ছয়মাস। এরইমধ্যে আরমান কান্তাকে নিয়ে কান্তার গ্রাম থেকে ঘুরে এসেছে।
কান্তা মাসের পনের দিন চিটাগং থাকলে বাকি পনের দিন, ঢাকায় থাকে।
যে কয়দিন ও চিটাগং থাকে, সে কয়দিন ওর সাথে আকলিমা খানমও থাকে। শহিদ আহমেদ সুযোগ পেলে তার ছেলের কাছে যায়।

কান্তা নিয়মিত ক্লাস করতে পারেনা। তবে যে কয়দিন ঢাকায় থাকে, সেই কয়দিন ক্লাস মিস দেয়না।
এরইমধ্যে কান্তা অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। ও প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে ভালো সিজিপিএ অর্জন করেছে।

শ্রীজা আগামীকাল রাতে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। ও একাই যাবে। কারন রিয়াদ আসতে পারছেনা।
শ্রীজা বাবার বাড়িতে এসেছে দুইদিন আগেই। কান্তাও ঢাকায় আছে। আজ রাতে আরমানও আসবে। ওর বোন ক্যালিফোর্নিয়া যাবে অথচ ভাই হিসেবে ও থাকবেনা, এটা হতেই পারেনা।

শ্রীজার মন ভালো নেই। ও থেকে থেকেই কাঁদছে। বাবা-মা, ভাই-ভাবী আর কায়াকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে, সেকথা ভাবতেই ওর কান্না পাচ্ছে।
কান্তা ওকে অনেক বুঝিয়েও সুবিধা করতে পারছেনা।

কায়া আধোআধো স্বরে সবাইকে ডাকতে শিখেছে। ওর ডাক শুনে সবাই আনন্দে আত্নহারা হয়ে যায়। আরমানতো মেয়েকে ছাড়া থাকতেই পারেনা। কান্তা যে কয়দিন ঢাকায় থাকে ওর ভিষণ কষ্ট হয়। কিন্তু ও নিরুপায়। ওর মা অসুস্থ, বারবার তার ঢাকা-চিটাগং করতে কষ্ট হয়।

আজ রাতে শ্রীজার ফ্লাইট। দুপুরে শ্রীজার শ্বশুর বাড়ির সকলে এই বাসায় এসেছে। শ্রীজার শ্বাশুড়ি ছেলের বউকে কাছ ছাড়া করছেননা। তিনিও কাঁদছেন। এই কয়মাসে শ্রীজা তার সকল গুণ দিয়ে ভদ্রমহিলার মন জয় করে নিয়েছে।

আকলিমা খানম কাঁদছে। তার মেয়ে কিছুক্ষণ আগে দেশ ছেড়েছে। আবার কবে ও দেশে আসবে তা কেউ জানেনা। কান্তা এয়ারপোর্টে যায়নি। ও জানে শ্রীজা রওনা দেয়ার সাথে সাথে, ওর শ্বাশুড়ি কান্নাকাটি করবে। তাই তাকে সামাল দেয়ার জন্য কান্তা বাসায় থেকে গেছে।

গতকাল থেকেই সবার মন খারাপ। কাল থেকে কেউ ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করেনি। তাই কান্তা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরে ঢুকেছে।

একসাথে সবাই খেতে বসেছে। খাদিজা খালাও তাদের সাথে আছে। কান্তা খাবার পরিবেশন করছে।

” আরমান, তুমি কবে চিটাগং ফিরছ? যাবার সময় বউমাকেও নিয়ে যাবে? ” শহিদ আহমেদ ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন।

” আমি আজ রাতেই রওনা দিব। কান্তাকে এখানে রেখেই যাব। ওর আর চিটাগং যাবার প্রয়োজন নেই। ”

” কেন! বউমা কেন আর চিটাগং যাবেনা? ”

” বাবা, আমার প্রমোশন হয়েছে। গাজীপুর পোস্টিং দিয়েছে। আগামী মাসেই জয়েন করতে হবে। আজ সকালেই জানতে পারলমা। তাই এই কয়দিন ওদের আর চিটাগং নিয়ে যাবনা। গাজীপুর আসলে আমি বাসা থেকেই অফিস করব। অযথা আপনাদের নিয়ে আর টানাটানি করবনা। ”

” তোমার প্রমোশন হয়েছে! কনগ্রেচুলেশন বেটা। কিন্তু ধানমন্ডি থেকে গাজীপুর অনেক দূর হয়ে যায়। তোমাকে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হবে। বিষয়টা সহজ হবেনা। এত পরিশ্রম তোমার শরীরে সইবেনা। তুমি বরং গাজীপুর একটা বাসা ঠিক কর। ”

আরমানের প্রমোশন হয়েছে শুনে সবাই ভিষণ খুশি হয়। আকলিমা খানম ছেলেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। চুমু দেয় ছেলের কপালে।
হঠাৎই আরমানের শরীর অবশ হয়ে আসে। মা বেঁচে থাকলে হয়তো এভাবেই চুমু দিত! তবে সে নিঃস্ব নয়। আরেক মা সে পেয়েছে। যে মাকে পেয়ে তার জীবন প্রতিনিয়ত নতুনভাবে আবিষ্কৃত হচ্ছে।

” বাবা, তুমি গাজীপুর বাসা নাও। এখান থেকে অফিস করতে তোমার ভিষণ কষ্ট হবে। আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারবনা। তুমি সেখানে বাসা নিলে দেখা যাবে, প্রতি সপ্তাহে দুই-তিন দিন আমরা সেখানেই থাকতে পারব। ” আকলিমা

” বাসা আমি নিব। কিন্তু সেখানে আপনাদের নিয়ে যাবনা। কান্তা এখানেই থাকবে আর আমিও থাকব। তবে যেদিন বাসায় ফিরতে লেইট হবে, সেদিন আমি সেই বাসায় থাকব। তবে আপনারা চাইলে সেখানে প্রতিমাসে একবার বেড়াতে যেতে পারেন। আপনার আর বাবার দুজনেরই শরীর তেমন একটা ভালো নয়। আপনাদের নিয়ে টানাহেঁচড়া আমি করবনা। ”
এরপর আর কোনও কথা থাকেনা। আরমানের সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেয়।

শুভর টাকা শেষ হয়ে আসছে। একসাথে লিসা আর সেই মেয়েটার পেছনে ওর খরচ করতে হয়। অনেক চেষ্টা করে মেয়েটাকে পটাতে পেরেছে। তাই শুভ কিছুতেই চায়না মেয়েটাকে হাতছাড়া করতে। যদিওবা মেয়েটার চাহিদা একটু বেশি। কিন্তু তাতে কোন অসুবিধা নেই। ওর পেছনে খরচ করার মত যথেষ্ট টাকা ওর কাছে আছে। এসব ভেবেই এতদিন টাকা উড়িয়ে এসেছে শুভ। একটা ফ্ল্যাটে ও সেই মেয়েটাকে নিয়ে থাকছে। সেখানে লিসাও মাঝেমধ্যে আসে।

শুভর কোলে বসে আছে ঐ মেয়েটি। যার নাম অ্যানি। ও একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। ও নিজেকে সিলেটের মেয়ে বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু শুভ এখন পর্যন্ত ওর পরিবারের খবর জানেনা। ওর পড়াশোনার যাবতীয় খরচ শুভ বহন করছে। এমনকি ওর প্রয়োজনীয় সকল কিছুই শুভ দিচ্ছে।

” বেইবি, আমার একটা আইফোন লাগবে। তুমি আজকেই আমাকে আইফোন কিনে দিবা। ” ন্যাকা স্বরে বলে অ্যানি।

” বেইবি, তোমাকে না গতমাসে একটা আইফোন কিনে দিলাম! এটা আর কিছুদিন ব্যাবহার কর। পরে কিনে দিব। ”

” তোমার সাথে এজন্যই কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। কিছু চাইতে ইচ্ছে করেনা। রিকো সত্যি কথাই বলে, তুমি আসলেই একটা কিপ্টে। হাত খুলে খরচ করতে পারনা। অথচ রিকোর কাছে থাকতে সে আমি না চাইতেও সবকিছু দিত। ”

” আমিও তো তোমাকে সবকিছুই দিচ্ছি। প্রতিমাসে তোমার পেছনে লাখ টাকা খরচ করছি। জীবনে জু’য়া খেলতামনা। তোমার প্রয়োজন মেটাতে জু’য়া ধরেছি। আবার টুকটাক বিজনেস করছি। সেসব থেকে যা আয় হচ্ছে, সব তোমার পেছনেই খরচ করছি। কিন্তু তুমি সব সময়ই রিকোর প্রসংশা কর! ফারদার রিকোর নাম আমার সামনে নিবেনা। ওকে আমি জাষ্ট হেইট করি। ” শুভ রে’গে গেছে।

” বেইবি, তুমি আমার ওপর রাগ করলে! তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসোনা। আমি থাকবোনা তোমার সাথে। ” কথাটা বলেই অ্যানি পার্স নিয়ে বেরিয়ে যায়।

আসলে অ্যানি সুযোগ খুঁজছিল ফ্ল্যাট থেকে বাইরে যাওয়ার। রিকো ওকে উত্তরার এক ফ্ল্যাটে দেখা করতে বলেছে। সেখানে রিকোকে সঙ্গ দিলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে।

সেদিনের ঘটনার দুই দিন পর অ্যানি শুভর ফ্ল্যাটে আসে। দুইদিন কোথায় ছিল জানতে চাইলে, অ্যানি বলে, ও সিলেট গিয়েছিল। কিন্তু শুভ জানে অ্যানি মিথ্যা বলছে। ও এই দুইদিন রিকোর সাথে ছিল। অথচ কন্টাক্ট করার সময় শুভ জানিয়েছিল, যে কয়দিন ও শুভর সাথে থাকবে, সেই কয়দিন অন্য কারও কাছে যাওয়া যাবেনা। অ্যানি শর্ত ভেঙেছে। রা’গে শুভ ওর গালে দুইটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। অ্যানি ফোঁসফোঁস করতে করতে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়।

আজকাল শুভর বিজনেস ভালো যাচ্ছেনা। সে ছেলে বাসায় থাকতে কখনোই বাবার বিজনেসের দিকে তাকিয়ে দেখেনি, সে হঠাৎ করে কিভাবে বিজনেস করবে! বিজনেস করতে হলে, আগে শিখতে হয়।
এদিকে অ্যানি ভিষন প্যারা দিচ্ছে। তার আজ এটা চাই তো কাল ওটা চাই। এরমধ্যে আবার লিসার ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে হয়।
ও ড্রাগসের বিজনেস করছে। হঠাৎই এক ড্রাগ ডিলারের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। সেই ডিলারের লোকজন এসে শাসিয়ে যাচ্ছে।
নানান চিন্তায় শুভ আজকাল অস্থির হয়ে থাকছে।

আজ রাতে ফ্ল্যাটে অ্যানি কিংবা লিসা কেউই নেই। শুভর কয়েকজন বন্ধু এসেছে। ওরা শুভকে বিজনেসে সাহায্য করে। কয়েকজন খদ্দের এসেছে। তাদের সামনে বিভিন্ন ধরনের ড্রাগস রাখা হয়েছে। যার যেটা পছন্দ, সে সেটার দাম মিটিয়ে নিজের কাছে নিচ্ছে। এরপর সেখানেই সেগুল সেবন করছে। পুরো রাত চলতে থাকে এসব নোংরা কাজকর্ম।

মাঝরাতে দুইজন এসেছে। তারা পছন্দমত ড্রাগস নেয়। শুভ টাকা চাইলেই নানান টালবাহানা শুরু করে। শুরু হয় তর্কাতর্কি। এক পর্যায়ে শুভ ওদের একজনকে ধরে আচ্ছামত ধোলাই দেয়। ওদের কাছ থেকে ড্রাগস নিয়ে, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়।

দুইদিন পর, মাঝরাত পেরিয়েছে কিছুক্ষণ আগে । সেই ফ্ল্যাটের নিজের রুমে অ্যানিকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে শুভ।
হঠাৎই ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যায়। ভেতরে প্রবেশ করে তিনজন মুখোশধারী।
শুভ জানলনা, ওর পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটা ওর সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে।

তিনজন মুখোশধারী সরাসরি শুভর রুমে চলে আসে। একজন চেপে ধরে ও পা। দ্বিতীয়জন ও অ্যানি মিলে ধরে দুই হাত। তৃতীয়জন মুখে কুশন চাপা দেয়।
ঘুমের ভেতর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায়, ঘুম ভেঙে যায় শুভর। চোখ মেলেই নিজেকে বন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়াতে শুরু করে। কিন্তু তিনজন দশাসই মানুষের সাথে পেরে উঠেনা। এদিকে কুশন নাকমুখে ক্রমাগত চেপেই বসছে। অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করতে থাকে শুভ। তখনও ওর মনে একটাই প্রশ্ন, কেন? এরা কারা?

একজন বোধকরি শুভর মনের কথা শুনতে পায়। আশেপাশে তাকিয়ে একটা জর্জেট ওড়না পায়। সেটা দিয়েই শুভর পা বেঁধে, আয়েশ করে দাঁড়ায়। এরপর মুখ থেকে মুখোশ খুলে ফেলে।
তাকে দেখে শুভ চমকে যায়।
এ তো তার চেনা! সেদিন যাকে ড্রাগস কিনে টাকা না দেয়ার অপরাধে বেধড়ক মারধর করেছিল, সেই ছেলে!

” সেদিন তো খুব হম্বিতম্বি করেছিলি! কিন্তু আজ তোকে কে বাঁচাবে? যে ড্রাগ ডিলারের সাথে তোর শত্রুতা, আমি তার কাজিন। ” আর কিছুই বলেনা সেই ছেলেটা।

শুভ যা বোঝার বুঝে নেয়। কিন্তু অ্যানিকে ওর একটা হাত চেপে ধরে রাখতে দেখে, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়।

” বেইবি, তুমি না আমাকে সেদিন থা’প্প’ড় মে’রে’ছি’লে। তুমি কাজটা ঠিক করনি। আমি আবার কারও ঋণ রাখিনা। ”

শুভ অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। ততক্ষণে কুশন ওর মুখে আরও কঠিনভাবে চেপে বসেছে। ওর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝরছে। মনে হচ্ছে বুকটা ফে’টে কলিজা বেরিয়ে আসবে। চোখদুটোও যেন বি’স্ফো’রি’ত হচ্ছে! ভিষণ পিপাসা পেয়েছে ওর। একটুখানি অক্সিজেনের জন্য ছটফট করতে পারে।
কিন্তু ওর জন্য কারও তিল পরিমাণ দয়া হয়না।

একসময় শুভর চোখের তারায় ভেসে উঠে মায়ের মুখ, বাবার হাসি, ছোটবোনের আদুরে ভাইয়া ডাক, বড় ভাইয়ের গম্ভীর মুখখানা। ধীরে ধীরে সব যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছে। শুভ চেষ্টা করছে চোখ খুলে রাখতে।

আবারও ওর চোখের তারায় ঝিলিক দেয়, ওর ধাক্কায় মায়ের পতন, বাবার অ্যা’ক্সি’ডে’ন্ট, বোনকে দেয়া থা’প্প’ড় বড় ভাইকে করা অপমান।

মুখে কুশন চাপা থাকায়, মনে মনে বলে, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।
একসময় ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায়।

আরমান বিছানা ছেড়েছে কিছুক্ষণ আগে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই ওর ফোন বেজে ওঠে। দ্রুত পায়ে বিছানার কাছে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখল, ওর নিয়োগ দেয়া একজনের নম্বর। যাকে আরমান শুভর ওপর নজর রাখার জন্য রেখেছিল।
এই অসময়ে তার নম্বর আরমানের ভ্রু কুঁচকে আসে।
ও ফোন কেটে ব্যাক করে।

” হুম বল। এত সকালে ফোন দিয়েছ যে? ”

অপরপাশ থেকে কিছু বলতেই, আরমান নিজের জায়গায় জমে যায়।
ওর শরীরের সমস্ত শক্তি যেন নিমেষেই নিঃশ্বেস হয়ে গেছে।ঐ অবস্থায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে তা বলার সাধ্য ওর নেই।

কান্তা রান্নাঘর থেকে রুমে এসে দেখল, আরমান ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে আরমানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর খটকা লাগে। আরমানের কাছে এসে ওর বুকে হাত রাখে।

বনানীর ছয়তলা বিল্ডিংয়ের তিনতলার ফ্লাটে একটা লা’শ পাওয়া গেছে। পুলিশ এসে ঘিরে রেখেছে পুরো বিল্ডিং।

আরমান হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে বের হয়। ওর সাথে শহিদ আহমেদও আছে।

শহিদ আহমেদের বাড়ি আজ আরেকবার শোকে নিরব। আকলিমা খানম যেন বাকশক্তি হারিয়েছে। সে নিজের মত করে কাজ করছে। কারও সাথে কোন কথা বলছেনা।

শহিদ আহমেদ হসপিটালে ভর্তি। তার পাশে শ্রীজার শ্বশুর আছে।

আরমান বনানী থানায় বসে আছে। কথা বলছে ওসির সাথে। ওর কাছে একের পর এক ফোন আসছে।
থানায় শুভর বন্ধুদের আনা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞেসাদের পর অনেক তথ্য জানতে পারে পুলিশ।

তিনদিন পর শহিদ আহমেদের জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফিরতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। আরমান বাবার কাছে যেয়ে তাকে শান্তনা দিতে থাকে।

একটু সুস্থবোধ করলে শহিদ আহমেদকে নিয়ে বাসায় আসে আরমান। আকলিমা খানম তখনও নিশ্চুপ।
আরমান যেয়ে তার মাথায় পরম আদরে হাত রাখে।
তিনদিন পর আজকে আকলিমা খানম চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

” আমি সেদিন কেন ওকে বাসা থেকে বের করে দিলাম? সেদিন সেই ভুল না করলে আজ আমার ছেলে বেঁচে থাকত। আমিতো ওকে ওর ভালো থাকার জন্য বের করে দিয়েছিলাম। ও শান্তিতে থাকুক, আমি এটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু ও শান্তি পেলনা কেন? আমার শুভ, আমার ছেলে। ” আকলিমা খানম বারেবারে এই কথাগুলো বলেই কাঁদছে।

কান্তা ওর শ্বাশুড়িকে একটা বারের জন্যও কাছ ছাড়া করছেনা। ও চেষ্টা করছে যেন দ্রুতই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়।

আরমান সাতদিনের চেষ্টায় খুঁজে বের করে সেই তিনজনকে। তারা দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর অ্যানিকে এ্যারেষ্ট করে দশদিন পর। ওদের বিপক্ষে সকল প্রমান সংগ্রহ করেছে আরমান। ওদের শাস্তি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

দুইমাস পেরিয়ে গেলেও আকলিমা খানম কিংবা শহিদ আহমেদ কেউই স্বাভাবিক হতে পারেননি। শহিদ আহমেদ বিজনেস ছেড়ে বাসাতেই থাকছেন। সময় দিচ্ছেন স্ত্রীকে। আকলিমা খানম সেদিনের পর থেকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়েছে। কান্তা জোড় করে তাকে খাওয়ায়, গোসল করায়। কিংবা মাঝেমধ্যে বিকেলে বাসার পাশে পার্কে নিয়ে যায়। কান্তা চেষ্টা করছে শ্বাশুড়িকে স্বাভাবিক করার।

আরমান আনমনে বিছানায় বসে আছে। ওর পাশে কায়া খেলনা নিয়ে খেলছে। মাঝেমধ্যে বাবাকে এটাসেটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। আরমান ধৈর্য্য সহকারে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

এই দুইমাসে আরমান অনেকটা শুকিয়ে গেছে। ও কিছুতেই শুভ মৃ’ত্যু মানতে পারছেনা। ধীরে পা ওর সব আপনজন হারিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় ও শুভকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। শুভ একসময় আরমানের ন্যাওটা ছিল। ভাইয়া ছাড়া কিছুই বুঝতনা। এটাওটার জন্য ভাইয়ার কাছে বায়না ধরত। কিন্তু সেই শুভ হঠাৎই কেমন পাল্টে গেল! একসময় আরমানকে পর করে দিল। কিন্তু আরমানতো ওকে পর করতে পারেনি। ওর কাছে শুভ সেই ছোট্টটিই ছিল। যেমনটা শ্রীজা এখনও আছে। আরমানের চোখের কোন বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।

” এত ভেঙে পরলে কিভাবে চলবে সবকিছু? আপনি নিজেকে শক্ত করুন। আপনিই একমাত্র পারবেন বাবা-মা’ কে সামলাতে। কষ্টতো আমারও হচ্ছে। ছেলেটার সাথে আমিও অনেক দুর্বব্যহার করেছি। সেদিন কেন তাকে যেতে দিলাম, কেন আটকালামনা? তবুও দেখুন আমি নিজেকে সামলেছি। ওর জন্য কষ্ট না পেয়ে দোয়া করুন। আপনিই আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। আপনার ওপর নির্ভর করছে এই গোটা পরিবার। আপনার সন্তানরাও আপনাকে হাসিমুখে দেখতে চায়। তাদের আপনার কাছে অনেক চাওয়া। ” কান্তা আরমানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল।

আরমান তবুও কিছু বলেনা। কিন্তু কিছু একটা ওর মস্তিষ্কে ধরা দিতেই ঝট করে সোজা হয়।
কান্তাকে নিজের পাশে বসিয়ে নেয়।

” কি বললে তুমি? আমার সন্তানেরা আমার হাসিমুখ দেখতে চায়? তবে কি আমি আরেকবার বাবা হতে চলেছি? ” আরমানের দৃষ্টিতে জিজ্ঞেসা।

” হুম। ”

” আমার মন খারাপের সময়েই তুমি কেন সুখের হাওয়া নিয়ে আস! তবে কি সত্যিই আমার সন্তানেরা আমার কষ্ট সহ্য করতে পারেনা! আমার জীবনটা কেন এত সুখে ভরিয়ে দিলে তুমি! একটা কথা শুনে রাখ, তুমি ছাড়া আমি চিরটাকাল অপূর্ণই থেকে যেতাম। তুমিই আমার পূর্ণতা। আমার পৌরুষের অহংকার তুমি। আমি নিজের পুরুষত্ব নিয়ে গর্ব করিনা, গর্ব করি তোমাকে নিয়ে। তুমি আমার জীবনে এসেই আমাকে সুখের সাগরে ভাসিয়েছ। প্রতিটা পুরুষের জীবনে তোমার মত একজন নারী আসলে সে পরিপূর্ণ হতে বাধ্য। ” আরমান একহাতে কান্তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়। অপরহাতে মেয়েকে নেয়।

” আমি যদি বলি আপনি আমার অহংকার। আমার নারীত্ব আপনাতেই পূর্ণ হয়েছে। আপনি না থাকলে আমি নিঃস্ব। আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে আপনার বাস। আপনি আমার #কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন । যে ধন আমাকে গরবিনী করেছে। যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই অনন্তকাল। ”

সমাপ্ত