#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
থমথমে মুখে ডাইনিং রুমে এলো পৃথুলা। আরশান অলরেডি খেতে বসেছে। এক পলক সে পৃথুলার দিকে তাকিয়ে পূণরায় খাওয়ায় মনোযোগ দিল। শিমুলের মুখ চুপসে আছে। সে আরশানের পাশের চেয়ারে বসল। ঘটনা কী ঘটেছে জানার জন্য আরশান প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে?”
পৃথুলা অভিযোগ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“উনি আমার সাথে বাজে আচরণ করেছেন।”
শিমুল হকচকিয়ে গেল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হড়বড় করে বলল,
“মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথা।”
“মিথ্যে নয় সত্যি কথা। টুনটুনি দেখা যাচ্ছে বলেছিলাম আমি। আর উনি সঙ্গে সঙ্গে…”
পৃথুলাকে থামিয়ে দিয়ে আরশান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
“টুনটুনি দেখা যাচ্ছে মানে কী?”
পৃথুলার ভ্রুঁ কুঁচকে গেল। সে বলল,
“আপনিও এরকম রিয়াকশন করছেন কেন? টুনটুনি পাখির নাম শোনেননি কখনও?”
শিমুল অসহায়ের মতো বলল,
“স্যার, আপনি যা মনে করেছেন আমিও প্রথমে তা-ই ভেবেছিলাম। এজন্য ভয় পেয়ে চেক করছিলাম। আর উনি ভেবে বসে আছে আমি বাজে আচরণ করেছি তার সাথে।”
আরশান কপাল চুলকাচ্ছে। এই প্রসঙ্গ কীভাবে বদলাবে বুঝতে পারছে না। পৃথুলা বলল,
“ভয়ের কী আছে? টুনটুনি পাখি কি আপনার ওখানে গিয়ে বসে ছিল?”
শিমুল উত্তেজনায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
“স্যার! দেখুন, সে কীভাবে কথা বলছে আমার সাথে।”
আরশানের বিষম ওঠার উপক্রম। সে হাতের ইশারায় শিমুলকে বসতে বলে পৃথুলার উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনি এখানে টুনটুনি পাখি পেলেন কোথায়?”
“বারান্দা থেকে দেখেছি।”
“টুনটুনি নয়। হয়তো অন্য কোনো পাখি দেখেছেন। তবে যা-ই হোক, হুট করে আপনি এমনভাবে কথাটি বলেছিলেন যে, শিমুলের জায়গায় যেকোনো ছেলে থাকলেই ঘাবড়ে যেত। ও অনেক ভালো একটা ছেলে। আপনার সাথে কোনো বাজে আচরণ করেনি।”
“চো-রে-র সাফাই গাইছে আরেক চো-র। সে যে কত ভালো! আপনি ভালো? আপনি, সে কেউই ভালো না। যদি ভালো হতেনই তাহলে আমার বোনকে কেন কি’ড’ন্যা’প করতে চেয়েছিলেন? আর আমাকেই বা এখনও কেন আটকে রেখেছেন?”
“আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।” বেশ শান্তকণ্ঠেই বলল আরশান।
“আপনারা আমাকে ছাড়বেন না?”
“অবশ্যই ছেড়ে দেবো। তবে সেটা সময় হলে। এর আগ পর্যন্ত আপনি এখানেই থাকবেন।”
পৃথুলা চুপ করে থেকে মনে মনে বলে,
“আমিও দেখব আমাকে কতদিন আটকে রাখতে পারিস। এমন জ্বা-লা-নো জ্বা-লা-ব যে, বইন বইন ডেকে কুল পাবিনা।”
আরশান চুপচাপ খাচ্ছে। তার পৃথুলার দিকে কোনো রকম মনোযোগ নেই। সে শিমুলকে নিশ্চুপ দেখে বলল,
“না খেয়ে চুপচাপ বসে আছো কেন? খাও।”
পৃথুলার ভীষণ রাগ হলো। একই তো তাকে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত টুনটুনি পাখি নিয়ে একটা অঘটন ঘটল। তার ওপর আবার সে যে না খেয়ে বসে আছে এটা কি এই লোকের চোখে পড়ে না? সে কি এখন আরশানের রেসপন্সিবিলিটি নয়? তাহলে তার প্রতি কেন এত অবহেলা? সে রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আরশান এবং শিমুল দুজনই চোখ তুলে চাইল ওর দিকে। শিমুল অসহায়ভাবে বলল,
“আপনি উঠে যাচ্ছেন কেন? এখনও রেগে আছেন? বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝি ছিল ম্যাম। আপনি প্লিজ রাগ করে না খেয়ে থাকবেন না। এতে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবেন।”
পৃথুলা আড়দৃষ্টিতে একবার আরশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনাকে কে বলল আমি না খেয়ে থাকব? অন্যায় করলে আপনারা দুজন করেছেন। খাবার তো আর করেনি।”
কথা শেষ করে সে নিজের খাবারগুলো রুমে নিয়ে গেল। তার যাওয়ার পথে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে আরশান শিমুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই মেয়েকে এভাবে কতদিন সহ্য করব শিমুল?”
“কিছু করার নেই স্যার। যতদিন না শিলা চৌধুরীর বিষয়টি ধামাচাপা পড়ছে ততদিন সহ্য করতেই হবে। তবে এই ব্যাপারে যেন উনি কিছু না জানে আমাদের সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।”
“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার তো আরও কাজকর্ম আছে। সব ছেড়ে তো আমি বেশিদিন এখানে বসে থাকতে পারব না। আবার মেয়েটাকে একা রেখে যেতেও পারছি না।”
“একটা লোক রাখলে কেমন হয় স্যার?”
আরশান একটু ভেবে বলল,
“রিস্ক হয়ে যায়। বিশ্বস্ত মানুষ পাব কোথায়? যা করার আমাদেরই করতে হবে। যেগুলো ফোনে সলভ্ করা পসিবল হবে সেগুলো ফোনেই সলভ্ করে ফেলব। আর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তখন তুমি এদিকটা সামলাবে।”
“ঠিক আছে স্যার।”
.
পৃথুলা খেতে খেতে এখান থেকে যাওয়ার পায়তারা করছিল। কীভাবে সে এখান থেকে বের হবে? আদৌ কি কোনো পথ তার জন্য খোলা রয়েছে? তার এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তার চেয়েও মন বেশি উশখুশ করছে এটা জানার জন্য যে, শিলাকে কেন ওরা কি-ড-ন্যা-প করতে চেয়েছিল? কীসের স্বীকারোক্তির কথাই বা বলে? শিলা এখন কোথায় আছে? মাথার ভেতর এত প্রশ্ন! অথচ উত্তর দেওয়ার মতো কেউই নেই। ঐ লোককে তো জীবনেও কিছু জিজ্ঞেস করে জানা যাবে না। পৃথুলা রুটিতে কামড় দিতে দিতে ঘরের মাঝে হাঁটছিল। এই ঘন বন-জঙ্গলের মাঝে তাকে আর কতদিন আটকে থাকতে হবে কে জানে! তাকে যেদিন কি-ড-ন্যা-প করা হয়েছিল সেদিন ফোনটা তো তার সঙ্গেই ছিল। এখন তাহলে ফোন কোথায়? নিশ্চয়ই ওদের কাছে রয়েছে। সে ফোন নেওয়ার জন্য আবার ডাইনিং রুমে গেল। কিন্তু সেখানে আরশান কিংবা শিমুল নেই। সেই দু’তলায় উঠায় ডানপাশের করিডোর ধরে আরশানের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
আরশান দরকারে ছাদে যাবে বলে খেয়ে-দেয়ে আগেই উঠে পড়েছে। শিমুল সব গুছিয়ে আরশানের রুমে গিয়েছে। সে ভেবেছিল এতক্ষণে হয়তো আরশান রুমে চলে এসেছে। কিন্তু রুমে গিয়ে দেখল রুম ফাঁকা। সে ছাদে যাবে বলে ঠিক করল। এর আগেই ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করল সে।
শিমুল আরশানের ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। ঐ সময়ে পৃথুলাও রুমে এসে উপস্থিত হয়। তৎক্ষণাৎ শিমুল তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। ভূত দেখার মতো চমকে গেলেও নিজেকে ধাতস্থ করল পৃথুলা। মনের রাগ মনেই পুষে রেখে আরশানের কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে তখন দেখে আরশানও ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে।
পৃথুলা এবার চোখ বড়ো বড়ো করে বলে,
“একি! আপনারা দুজনে একসাথে ওয়াশরুমে কী করছিলেন? ছি, ছি!”
আরশান দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
”শিমুল ওকে চুপ করতে বলো।”
পৃথুলা দাপটের সঙ্গে বলে,
“কেন চুপ করব হ্যাঁ? আমি সর্বদা সত্য কথা বলব এতে যাই হোক না কেন। আপনারা এত্ত খারাআআআআপপ!”
খারাপ শব্দটি টেনে বলল সে। আরশান রাগে কয়েক পা এগিয়ে যায় পৃথুলার দিকে। পৃথুলা ভয়ে পিছিয়ে যায়। দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে থাকে কাচুমুচু হয়ে। আরশান দাতে দাঁত চেপে বলে,
”কানের নিচে ঠাঁটিয়ে এক থা-প্প-ড় বসাব, সব উলটা-পালটা চিন্তা মাথা থেকে বের হয়ে যাবে। হাতে-পায়েই বড়ো হয়েছে শুধু। ঘঁটে একটুখানিও বুদ্ধি নাই। বয়স তো কম হলো না, ম্যাচিউরিটি লেভেল এত লো কেন?”
”খবরদার! ফাউল কথা বলবেন না। আমি অবশ্যই একজন ম্যাচিউর মেয়ে। আর আপনি আমার বয়স নিয়ে কথা বলছেন কেন? জানেন না, মেয়েদের বয়স নিয়ে কিছু বলতে হয় না?”
”এত ফালতু সময়ও নেই আমার। জাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, উলটা-পালটা চিন্তা-ভাবনা বাদ দিন।”
কথা শেষ করে আরশান চলে যাওয়া ধরে, তখন পৃথুলা বলে,
“আপনারা উলটা-পালটা কাজ করতে পারবেন, আর আমি উলটা-পালটা ভাবলেই দোষ?”
আরশান কিছু বলার পূর্বেই পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে শিমুল বলল,
‘আপনার ভুল হচ্ছে। আমি জানতাম না যে, স্যার ওয়াশরুমে আছেন। আর দরজাও লক করা ছিল না। যখন বের হচ্ছিলাম তখনই আপনি এই ঘরে আসেন।”
পৃথুলা ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে থেকে বলে,
“আমি প্রতিবার শুধু ভুলই বুঝি?”
শিমুল অসহায়বোধ করল। বিষন্নস্বরে বলল,
“আমিও বুঝতে পারছি না, কেন যে বারবার আপনার সামনেই ভুলটা হয়ে যাচ্ছে।”
“ভুল হয়ে যাচ্ছে আবার কী কথা? আমি কি ভুলাভুলি দেশের লোক? শুধু ভুলটা আমার সামনেই হবে?”
“এটা আবার কোন দেশ?”
আরশান বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমিও কি এই মেয়ের মতো বোকা হয়ে যাচ্ছ নাকি? কীসব জিজ্ঞেস করছ।”
পৃথুলা ক্ষেপে বলল,
“আপনি আমাকে অপমান করে কথা বলছেন কেন? খারাপ লোক কোথাকার!”
আরশান নিজের রাগ কোনোভাবেই কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না। এদিকে সে মেয়েদের গায়ে হাতও তোলে না। নয়তো এতক্ষণে পৃথুলা হয়তো মাটির নিচে থাকত। আরশানের রাগ বাড়ছে বুঝতে পেরে শিমুল পৃথুলাকে বলল,
“আপনি নিজের রুমে যান।”
পৃথুলাও কম ঘাড়ত্যাড়া নয়। সেও নিজের জেদ বজায় রেখে বলল,
“কেন যাব? আপনারা খারাপ, খারাপ, খারাপ! আমার ভাবনার চেয়েও খারাপ।”
আরশান চোয়াল শক্ত করে পৃথুলার একদম নিকটে চলে গেল। ভয়ে পৃথুলা ঢোক গিলল। আরশান আগুনঝরা দৃষ্টিতে পৃথুলার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি কিংবা আমরা যদি খারাপই হতাম তাহলে আপনি এখনও অক্ষত অবস্থায় এখানে থাকতেন না। আপনার সঙ্গে ঠিক কী কী করতে পারি সেই সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনাকে বিস্তারিত বলতে হবে না?”
আরশান সরে দাঁড়াল। পৃথুলা কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল,
“তাহলে আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন?”
“সারাজীবন ধরে রাখব তো বলিনি। সময় হলেই ছেড়ে দেবো। আপনার কোনো ক্ষতি আমরা করব না এতটুকু শিওর থাকুন।”
পৃথুলা হতাশ হয়ে বলল,
“বেশ তো! তাহলে আমার ফোনটা আমাকে দিয়ে দিন।”
“যেদিন ছেড়ে দেবো সেদিন পাবেন।”
পৃথুলা দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“আর এতদিন কি আমি আপনাদের দুজনের রাসলীলা দেখব এখানে?”
আরশান পৃথুলার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পূর্বেই পৃথুলা দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে আরশান বলল,
“রা-বি-শ! মেয়েটা এক্সট্রিম লেভেলের অ-স-ভ্য! যার কপালে আছে তার জীবন শেষ।”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]