মহাপ্রস্থান পর্ব-২৬ এবং শেষ পর্ব

0
400

#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_২৬ (অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
পৃথুলার প্রাণহীন দৃষ্টির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে আরশান, শীলা এবং শিমুল। পুলিশ অফিসার ছিল পৃথুলার পাশাপাশি। আচমকাই পৃথুলা পুলিশ অফিসারকে টেনে পেছন থেকে গলা চেপে ধরে। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনে ধারালো ছু’রি। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় সকলেই।

আ’গু’ন ঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে পৃথুলা বলে,

“আমাকে যদি ম’র’তেই হয় তাহলে আরেকজন পুলিশ অফিসারের জীবন নিয়েই ম’র’ব।”

শীলা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার কী বোন কী হয়ে গেছে। ভীতু গোছের সেই মেয়েটি এখন আর ভয় পায় না। ভয় বলতে কোনো শব্দ তার ডিকশনারিতে নেই। এমনকি মানুষের জীবন নিতেও সে দু’বার পিছুপা হয় না। অতীতের এই জঘন্যতম ঘটনার প্রতিশোধ নেবে বলে সে ওকলাতি পড়েছে। আইনের মাধ্যমে সে শোধ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পৃথুলা বেছে নিয়েছে অন্য পথ। সম্পূর্ণ অন্য পথ; যেই পথ থেকে তাকে কখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বাঁচানো সম্ভব নয়। পৃথুলা এখন আর পাঁচটা মানুষের মতো সাধারণ মানুষ নয়। তার গায়ে লেগে আছে দে’শ’দ্রো’হীর তকমা। এই দেশ, দেশের আইন তাকে বাঁচতে দেবে না। সে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এখন ক্ষতিকর। আইনের হাতে তুলে দিলে একজন দে’শ’দ্রো’হী হওয়ার দরুণ ওকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মা’রা হবে। সবদিক বিবেচনা করে বুকে পাথর বেঁধে শীলা আরশানের উদ্দেশ্যে বলে,

“শ্যুট হার!”

আরশান বিস্মিত নয়নে তাকায়। শীলা ফাঁকা ঢোক গিলে বলে,

“পৃথুলা দেশের জন্য ক্ষতিকর। পুলিশের হাতে দিলেও লাভ নাই। কোনো না কোনোভাবে ঠিকই পালানোর চেষ্টা করবে। নতুবা ওকে তিলে তিলে ম’র’তে হবে। তাই এখানেই পৃথুলার সাবজেক্ট ক্লোজ করে দাও।”

আরশান কিছু বলল না। এখনো তার পিস্তল পৃথুলার দিকে তাক করা। শীলা আবারও ফোর্স করল গু’লি করার জন্য। এবার সত্যি সত্যিই গু’লি করে আরশান। প্রচন্ড শব্দে সবাই চোখ বন্ধ করে ফেলে। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে পুলিশ অফিসার। পৃথুলা চোখ মেলে দেখে গু’লিটা তাকে নয় বরং পুলিশ অফিসারের পায়ে করা হয়েছে। র’ক্তা’ক্ত পা নিয়ে পুলিশ অফিসার মাটিতে কাৎ হয়ে কাতরাচ্ছে।

শীলা অবাক হয়ে বলে,

“এটা কী করলে তুমি? আমি পৃথুলাকে গু’লি করতে বলেছি।”

পৃথুলার হাত থেকে ছু’রিটা পড়ে গেছে। তাই দেখে শীলা বারবার ফোর্স করে,

“শ্যুট হার, শ্যুট হার, শ্যুট হার!”

আবার গু’লির শব্দ হয় বিকট।

গু’লিটা আরশান শীলাকে করেছে এবার। তবে মে’রে ফেলার জন্য নয়। পায়ে করেছে যাতে সেও পৃথুলাকে আটকাতে না পারে। শীলা মাটিতে পড়ে যায়। পি’স্ত’ল নামিয়ে আরশান পৃথুলার উদ্দেশ্য বলে,

“পালাও পৃথুলা!”

শীলা ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বলে,

“ইউ ফুল! তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? তুমি জানো তুমি কী করছ?”

আরশান ফের বলে,

“পালাও পৃথুলা!”

“আরশান ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”

“পৃথুলা! সময় নষ্ট কোরো না। পেছনের দরজায় কোনো পুলিশ নেই। তুমি ঝামেলাবিহীন পালাতে পারবে। যাও।”

“আরশান, তুমি কি ভুলে গেছ তোমার ভাই জেলখানায়? আমার স্বীকারোক্তি ছাড়া কিন্তু ওকে ছাড়াতে পারবে না। তারচেয়েও বড়ো কথা, তুমি একজন দে’শ’দ্রো’হী’কে পালাতে সাহায্য করছ। তুমি ভাবতেও পারছ না এজন্য তোমার কী শাস্তি হতে পারে। সারাজীবন জেলখানায় পচে ম’র’তে হবে তোমাকে।”

কথাগুলো বলতে বেশ বেগ পেতে হয় শীলাকে। হাঁপিয়ে পড়েছে। পা থেকে প্রচণ্ড র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। পৃথুলা তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। আরশান বলল,

“পৃথুলা কেন যাচ্ছ না? প্লিজ গো! তুমি যাওয়ার পর আমি শীলাকে নিয়ে হাসপাতালে যাব। ওর পা থেকে র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। দেরি হলে ওর জীবনও চলে যেতে পারে। দেরি কোরো না।”

পৃথুলা নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৌঁড়ে চলে যায়।
.
.
“হিমেল, আমি বলছি তুমি দাঁড়াও। আমি কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই গু’লি করব।”

হিমেল যেন হঠাৎ করেই বধির হয়ে গেছে। দুনিয়াবি কোনো শব্দই তার কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। অথবা সে ইচ্ছে করেই দোলার ডাক শুনতে নারাজ। দরজার নব ঘুরাতেই দোলা পরপর তিনটা গু’লি করে, যেগুলো হিমেলের বুক ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সমস্ত শক্তি হারিয়ে সে ঢলে পড়ে ফ্লোরে। অনেক কষ্টে ফিরে তাকায় দোলার দিকে। অদ্ভুত ব্যাপার হিমেলের চোখেমুখে হাসির রেখা।

হিমেল তার র’ক্তা’ক্ত হাতটি মেলে ধরে দোলার দিকে। উন্মাদের মতো দৌঁড়ে আসে দোলা। হাউমাউ করে কাঁদছে সে। হিমেল হাসতে হাসতে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

“থ্যা..ঙ্কি..উ আমাকে এমন সুখের মৃ’ত্যু দেওয়ার জন্য। একটা ডায়েরি আছে তোমার রু…”

আর কিছু বলার পূর্বেই দোলার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে হিমেল। দোলার মনে হচ্ছিল, হিমেল নয়; বরং তার নিজের জীবন বিসর্জন দিল সে। আকাশ-পাতাল এক করে সে চিৎকার করছে। তার আহাজারিতে কেঁপে উঠছে যেন পাখিদের ছোট্ট হৃদয়। ততক্ষণে পুলিশের দলও বাড়িতে পৌঁছে যায়। তাদের কাছে ইতোপূর্বে খবর চলে গেছিল যে, দোলার স্বামীই দে’শ’দ্রো’হী হিমেল।
______
হাসপাতালের করিডোরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আরশান। অতীতের কথাগুলো ভীষণ মনে পড়ছে। সবকিছু সাজানো-গোছানো ছিল। পরিকল্পনার মাঝে ছিল। তবুও কেন এমন মনে হচ্ছে যে, গল্পটা অন্যরকম হলেও পারত! এই অভিনয়ের মাঝেও কি অন্য কিছু ছিল? একদম ভিন্ন কিছু। হয়তো ছিল। কিন্তু কী সেটা? ভালোবাসা? তার বুক ভেঙেচূড়ে আসছে। বারবার পৃথুলার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে আর্তনাদ করে ওঠে। হৃদয়ের র’ক্ত’ক্ষরণের সাথে সে পেরে উঠছে না। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতরটায়। বারবার কেন মনে হচ্ছে এই যন্ত্রণাটুকু কেবল মাত্র পৃথুলাই দূর করতে পারবে। কেবলমাত্র পৃথুলার আলিঙ্গনই পারে তাকে সকল দুঃখ, যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখতে।

সে আরও জোরে চুলগুলো চেপে ধরে। সে তো জানতো, পৃথুলার দুষ্টুমি, কান্না, আদর, ভালোবাসা সমস্ত কিছুই অভিনয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবুও কেন সে মিছে ভালোবাসার মায়ায় আটকে গেছে? নিজের সঙ্গে, নিজের মনের প্রশ্নগুলোর সামনে আর পেরে উঠছে না আরশান। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,

“তুমি দে’শ’দ্রো’হী হও আর আমার সেই বোকা নারীই হও না কেন, আমি তো শুধু তোমাকেই ভালোবাসি পৃথু।
আমি ফুল ভেবে তোমায় ছুঁতে গিয়ে, কাঁটার আঘাতে জর্জিত হলাম। তবুও পিছু না হটে সেই র’ক্তে’র বিনিময়ে হলেও বলব, এরপরও আমার শুধু তোমাকেই চাই।”

শিমুল হন্তদন্ত হয়ে দৌঁড়ে আসে আরশানের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

“পৃথুলা! পৃথুলা…”

“কী হয়েছে পৃথুলার?”

“পৃথুলা সেচ্ছায় পুলিশের কাছে গিয়ে ধরা দিয়েছে।”

“হোয়াট!” উত্তেজনায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে আরশান।

শিমুল বলে,

“হ্যাঁ। লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। সব জায়গায়, টিভি নিউজে এখন শুধু ওদের নিয়েই কথা হচ্ছে।”

আরশান দৌঁড়ে লাইভ দেখতে গেল। পৃথুলাকে দেখে তার বুকটা ফের কেঁপে ওঠে। দিকবিদক হারিয়ে সে এখন জ্ঞানশূন্য। কী করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

এদিকে সাংবাদিকের একটা দল হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে। তারা আরশান, শিমুল, পুলিশ অফিসার এবং শীলার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। আরশানের কথা বলার মতো কোনো অবস্থা নেই এখন। সে চুপচাপ বসে আছে। ঘটনার আদ্যপ্রান্ত বললেও শীলা এবং পুলিশ অফিসার কেউই এটা বলেনি যে, আরশানই পৃথুলাকে পালাতে সাহায্য করেছিল। বরং তারা এটা বলেছে, পৃথুলা ওদেরকে গু’লি করে সেখান থেকে পালিয়েছে। এখন পালিয়ে গিয়েও আবার ঠিক কী কারণে নিজেই আবার পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এই ব্যাপারে তারা কেউই কিছু জানে না।

এই একই প্রশ্ন পৃথুলাকেও করা হলেও কোনো উত্তর কেউ পায়নি। একজন দে’শ’দ্রো’হী হওয়ার অপরাধে বাকিদের মতো পৃথুলারও শাস্তি হিসেবে মৃ’ত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই খবর শুনে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে আরশান। পাগল হয়ে যায় সে। পৃথুলার মৃ’ত্যুর খবর সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। এটাও জানে, পৃথুলার পক্ষ নেওয়ার কেউ নেই। নিয়েও লাভ নেই। কারণ পৃথুলা নিজেই আদালতে সবকিছুর স্বীকারোক্তি দিয়েছে। সব গোপন আস্তানার খবরও জানিয়ে দিয়েছে। অন্য কোনো অপরাধী হলে হয়তো নিশ্চয়ই পৃথুলা কিংবা তাদের সঙ্গীদের শাস্তি কমানো যেত, অথবা বাঁচানো যেত। কিন্তু দে’শ’দ্রো’হীর শাস্তি মওকুফ করা অসম্ভব!

আরশান পৃথুলার সঙ্গে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে গেছিল। তবে কোনোভাবেই একজন দে’শ’দ্রো’হীর সঙ্গে দেখা করার পারমিশন সে পাচ্ছিল না। দিনকে দিন তার পাগলামির পরিমাণ বাড়ছিল। পৃথুলাকে একবার দেখতে না পারলে, কথা বলতে না পারলে সে নিঃশেষ হয়ে যাবে। ওর এরকম অবস্থা দেখে শীলা আদালতে জজের কাছে সুপারিশ করে। নিজে দায়িত্ব নিয়ে একবার শুধু অনুরোধ করে পৃথুলার সঙ্গে দেখা করার। অবশেষে কোর্ট থেকে পারমিশন মঞ্জুর করা হয়।
.
পৃথুলাকে দেখে শীলা কিংবা আরশান কেউই স্থির থাকতে পারল না। তারা বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে। মাঝখানে লোহার দণ্ড। চাইলেই একটাবার বুকে জড়ানো যাবে না। শীলা কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। কোনো রকমে শুধু সে পৃথুলার হাত ধরে কান্না করে বলে,

“আমাকে তুই মাফ করে দিস বোন! মাফ করে দিস। তোর জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি।”

পৃথুলা মুখে কিছু বলল না। অন্য হাতটি শুধু শীলার হাতের ওপর রাখল। শীলা ডুকরে ওঠে। পৃথুলার হাতে চুমু খেয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।

আরশান কেমন মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“কেন এমনটা করলে পৃথুলা? কেন সেদিন পালিয়ে গেলে না?”

পৃথুলা মুচকি হেসে বলে,

“আপনার জন্য।”

“আমার জন্য?”

“হ্যাঁ। আমি যদি পালিয়ে যেতাম তাহলে আজ আমার জায়গায় আপনাকে থাকতে হতো। আপনার ফাঁ’সি হয়ে যেত।”

“হলে হতো। তাতে তোমার কী? তুমি কেন পালালে না?”

“যাকে ভালোবাসি তার মৃ’ত্যু সহ্য করব কীভাবে?”

আরশান বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। পৃথুলা মৃদু হেসে বলে,

“কখন যে আমিও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। বুঝতামও না, যদি না আপনি সেদিন নিজের জীবনের পরোয়া না করে আমাকে পালাতে বলতেন। আপনার চোখে আমার প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা আমি দেখেছি। পালানোর সময় অনুভব করলাম, আপনার মৃ’ত্যু’র খবর আমি সহ্য করতে পারব না। আমি দেশের জন্য ক্ষতিকর। আমার বেঁচে থাকায় দেশের খারাপ বৈ ভালো কখনো হবে না। তাই আমার জীবনের চেয়ে আপনার জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আমার মৃ’ত্যু’তে কেউ কাঁদবে না। কিন্তু আপনার মৃত্যুতে হাজারও পথশিশু, এতিম শিশু কাঁদবে। ওদের জন্য হলেও আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে।”

আরশান পৃথুলার হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ওসি এসে জানায়, কথা বলার সময় শেষ। এমনিতেও ফাঁ’সি’র আসামির সাথে বিশেষ করে একজন দে’শ’দ্রো’হী’র সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষেধ।

“স্যার, সময় শেষ আসুন।”

আরশান যায় না। শক্ত করে পৃথুলার হাত ধরে রেখেছে। পৃথুলার চোখে পানি কিন্তু ঠোঁটে হাসি। সে আরশানের হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

“আর মায়া বাড়াবেন না। চলে যান!”

“না, পৃথু! আমি মানতে পারব না।”

কয়েকজন পুলিশ এসে আরশানকে জোরজবরদস্তি করে আনতে গেলে প্রচন্ড ক্ষোভে আরশান একজন পুলিশের নাক বরাবর ঘু’ষি বসিয়ে দেয়। তবু সে পৃথুলার হাত ছাড়তে চায় না। উপায় না পেয়ে তার হাতে আঘাত করে সেন্ট্রি। তবুও সে পৃথুলার হাত ছাড়ে না। পৃথুলাই পরে জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

“প্লিজ! তাকে আঘাত করবেন না।”

আরশানকে কয়েকজন পুলিশ জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। সে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলে,

“আমি তোমাকে ভালোবাসি পৃথু!”

পৃথুলা অশ্রুশিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে। আরশানের ভালোবাসি কথা শুনে নেত্রপল্লব বন্ধ করে। গাল বেয়ে ঝুপঝুপিয়ে নামে অশ্রুধারা। চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে আরশানের সাথে কাটানো প্রথম সময়ের ঘটনাগুলো। সে হাউমাউ করে কেঁদে নিচে বসে পড়ে বলে,

“আপনার পৃথুও আপনাকে ভালোবাসে আরশান!”
____________
পরিশিষ্টঃ
“তোমাকে কতটা ভালোবাসি বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমি নিরুপায়। দলের সাথে বেঈমানি করলেও আমি তোমার সাথে, আমাদের ভবিষ্যৎ বাচ্চার সাথে সুখে বাঁচতে পারব না কখনো। পুলিশের হাতে হলেও আমায় ম’র’তে হবে, ওদের হাতে হলেও ম’র’তে হবে আমায়। আমার কোনো কূলেই বাঁচার উপায় নেই। আজ চলে যাচ্ছি। তবে দলে ফিরে নেয়। সারাজীবনের জন্য অনেক দূরে চলে যাব। এতটা দূরে চলে যাব, যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। ভালোবাসি আমার দোলা।”

হিমেলের মৃত্যুর তিনদিন পর ডায়েরিটা খুঁজে পেয়েছিল দোলা। সবটা জেনে-বুঝেই হিমেল চিঠিটা লিখে গেছিল। সে জানত এর অন্তিম সমাপ্তি। নিজের হাতে নিজের স্বামী, নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে সে মে’রে ফেলেছে। কী অভাগা নারী সে! তবে এখন আর সে আইনের লোক নয়। একজন দে’শ’দ্রো’হীকে মা’রা’র সুবাদে তাও আবার নিজের স্বামী হওয়া সত্ত্বেও সে আইনের সাথে, দেশের সাথে বেঈমানি করেনি বলে চারদিকে তার জয়জয়কার। কিন্তু এসব দোলাকে টানে না। বরং দিনকে দিন মানসিক অত্যাচার করে। অনেকবার চেষ্টা করেছিল নিজেকে শেষ করে দেওয়ার। কিন্তু পারেনি। যেদিন জানতে পারল তার ভেতর আরেকটা প্রাণ আছে সেদিন থেকেই নিজের সাথে, নিজের মন ও স্নায়ুর সাথে কঠিন যুদ্ধে নেমেছে দোলা। হিমেলের শেষ স্মৃতিকে আগলে ধরেই সে বাকিটা জীবন পার করে দেবে। তার সন্তান দে’শ’দ্রো’হীর সন্তান নয়। হিমেল এবং তার ভালোবাসার ফসল। দোলা পুলিশের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকে। পাশাপাশি একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করছে।

বারান্দায় আকাশপানে তাকিয়ে সে হিমেলের উদ্দেশ্যে বলে,

“আমায় কি দেখতে পাচ্ছ হিমেল? দেখো, আমার পেট কেমন একটু একটু করে ফুলে বড়ো হচ্ছে। জানো এখানে কে আছে? তোমার দেওয়া সবচেয়ে বড়ো গিফ্ট। আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। যে না এলে হয়তো এতদিন পৃথিবীর মুক্ত হাওয়ায় আমি নিঃশ্বাস নিতে পারতাম না।”

সে থামে। ঠোঁট কামড়ে ধরে ফুঁপিয়ে বলে,

“বলো তো, কী হতো গল্পটা অন্যরকম হলে?”
.
.
“পৃথু, তুমি কি মেমসাহেব বইটা পড়েছ?”

“না। আমার এত বইটই পড়ার অভ্যাস নেই। আমি তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া আর কাউকে চিনিও না মনে হয়।”

আরশান মুচকি হেসে বলল,

“মেমসাহেব উপন্যাসের একটা লাইন আছে আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। শুনবে?”

পৃথুলা আগ্রহ প্রকাশ করে বলল,

“অবশ্যই। আমার প্রিয় মানুষটার প্রিয় লাইন শুনব না? বলুন তাড়াতাড়ি।”

পৃথুলার আগ্রহ ও উত্তেজনা দেখে আরশানের হাসি প্রসারিত হলো। সে পৃথুলার একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

“জীবনে যে ভালবাসা পায়, সে আর কিছু পায় না; যে জীবনে আর সব কিছু পায়, সে ভালবাসা পায় না।”

হঠাৎ পৃথুলার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে আবারও লাইনটা শুনতে চাইল। আরশান পূণরায় লাইনটি বলার পর পৃথুলা মনে মনে কথাগুলো আওড়াল। থমথমে মুখে বলল,

“এর মানে কী? আপনি জীবনে সবকিছুই পেয়েছেন। তাহলে কি ভালোবাসা পাবেন না? আমি কি আপনাকে ভালোবাসি না? আমার ভালোবাসা মিথ্যে?”

আরশান পৃথুলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“শান্ত হও। এই লাইনটার দুটো মিনিং আছে। তুমি নেগেটিভ মিনিংটাকেই কেন ক্যাচ করলে? দেখো, তুমি জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছ। অনেক কিছুই পাওনি। সব না পেয়েও তুমি ভালোবাসা পেয়েছ। আমি তোমাকে ভালোবাসি পৃথুলা।”

কিছুটা হলেও অভিমান কমল পৃথুলার। সে আলতো করে আরশানের বুকে মাথা রেখে বলল,

“সেটা তো ঠিক আছে। কিন্তু দ্বিতীয় মিনিংটা?”

আরশান মুচকি হেসে বলল,

“দ্বিতীয় মিনিংটা ভুল। আর এজন্যই আমি বলেছিলাম, লাইনটা আমার প্রিয় ছিল। কারণ তখন তুমি আমার জীবনে ছিলে না। ভালোবাসাও ছিল না। এখন তুমি আর ভালোবাসা দুটোই আমার জীবনে আছে। তাই লাইনটি আর আমার প্রিয় নয়।”

এবার পৃথুলার হাসি প্রশস্ত হলো।

আরশানও আচমকা হেসে উঠল। পরক্ষণেই তার হাসি থেমে যায়। মাত্রই তো পৃথুলা এখানে ছিল। কিন্তু এখন নেই! আরশান বারান্দার দরজায় বসে পড়ে। পৃথুলার ফাঁ’সির দিন থেকে এখনো পর্যন্ত সে এই বাংলো বাড়িতেই আছে। এখানেই মিশে রয়েছে পৃথুলার সমস্ত স্মৃতি। অতীতের খুনসুটি, দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়াগুলো সে প্রায়ই এখানে বসে বসে কল্পনা করে। কল্পনার জগতেই এখন সে পৃথুলাকে কাছে টানে। জড়িয়ে ধরে। খুব বেশি কষ্ট হলে পৃথুলার সাথে আগের কথোপকথনগুলো মনে করে। তার মনে হয়, পৃথুলা তার কাছেই থাকে সবসময়।

আরশানের বাবা-মা অনেকবার চেষ্টা করেও ছেলেকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারেনি। অস্বাভাবিক জীবন-যাপনই বেছে নিয়েছে আরশান। কে জানত ভালোবাসার অভিনয়ও এমন দুর্বিষহ জীবন উপহার দিতে পারে? অবশ্য, অভিনয়ই বা বলছি কেন। অভিনয়ের আড়ালে যেই নিখাদ ভালোবাসা দুজনের মনেই ধীরে ধীরে বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল তা তো এই দুই জগতের দুটি মানুষ তখন ক্ষুনাক্ষরেও টের পায়নি। আর যখন বুঝতে পারল তখন সময়, পরিস্থিতি তাদের আয়ত্তে ছিল না। আজ ভালোবাসার মানুষটিও তার থেকে বহু দূরে।

শীলা তার কথা রেখেছে। রাফসানকে জেলখানা থেকে মুক্ত করেছে। যদিও সত্যিই রাফসান অপরাধী ছিল! এখন আবারও রাফসান তার ক্যারিয়ার, সিনেমা জগৎ নিয়ে ব্যস্ত আছে। সবাই সবার জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছে। শুধুমাত্র কিছু মানুষের সময়গুলোই যেন থমকে গেছে। তবে এতকিছুর মাঝেও শিমুল আরশানকে ছেড়ে যায়নি। সে আরশানকে শুধু স্যারই নয় বরং বড়ো ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। আরশানের করুণ, নিঃস্ব অনুভূতি সম্পর্কে আর কেউ অবগত না হলেও সে অবগত। দুজন মানব-মানবীর ভালোবাসার সাক্ষী। সত্যি বলতে এই বাংলো বাড়িতে তার মন টেকে না। দম আটকে আসে। বারবার মনে হয়, ঐতো পৃথুলা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এখনই শিমুল তুলা বলে ডাকবে। আরশানের সঙ্গে অভিমান করে তাকে কথা শোনাবে। এখনই বোধ হয় মেয়েটার খিলখিল হাসির শব্দে পুরো বাড়িটা মুখরিত হয়ে যাবে। কিন্তু এমন কিছুই হয় না। কখনো হবেও না। মেয়েটার নিঁখুত অভিনয়ও যে এমনভাবে হৃদয়ে গেঁথে যাবে শিমুল সেটা কল্পনাও করেনি।

বাড়ির কলিংবেল বাজছে। সে লম্বা করে দম নিল। দরজা খুলে দেখে পৃথুলা দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকটা ধক্ করে ওঠে। পরক্ষণেই মনের ভুল ধারণা ভাঙে। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি পৃথুলা নয়। শীলা। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিল। শীলা জানতে চাইল,

“আরশান কোথায়?”

“তার ঘরে আছে।”

“কোনো উন্নতি হলো?”

“না। আগের মতোই।”

শীলার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তার ক্যারিয়ার উঁচু পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে। সেও এখন নাম করা এডভোকেট। সবাই এখন তাকে এক নামেই চেনে। কিন্তু এত নাম-যশ, খ্যাতি কোনো কিছুই শীলাকে ঠিক স্বস্তি দিতে পারছে না। কোথাও সে শান্তি খুঁজে পায় না। পৃথুলার জন্য তার মন খুব কাঁদে। রাতে ঘুম হয় না। বারংবার সে পৃথুলাকে দেখতে পায়। তার খুব ইচ্ছে করে একটাবার পৃথুলাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেতে। তার ভীষণ আফসোস হয়, যদি সে পারত পৃথুলাকে একটা সুন্দর জীবন দিত। কিন্তু এটা না সম্ভব ছিল আর না কখনো সম্ভব হবে। তবে সে চাইলেই হয়তো আরশানের জীবনটা বদলে দিতে পারে। পৃথুলার চোখেমুখে আরশানের জন্য শীলা তীব্র ভালোবাসা দেখেছে। সে জানে না, মানুষ মৃ’ত্যু’র পর এই পারের জীবন সম্পর্কে কিছু জানে নাকি, দেখে নাকি। যদি দেখে থাকে তাহলে পৃথুলা নিশ্চয়ই সুখে নেই আরশানের এহেন অবস্থা দেখে। আরশান যদি সুখে থাকে, ভালো থাকে তাহলে পৃথুলাও হয়তো পরপারে ভালো থাকবে।
সে গোপনে ছোট্ট করে শ্বাস নিয়ে বলল,

“আমাকে কেমন লাগছে শিমুল?”

“আপনি কি পৃথুলার মতো সাজতে চাইছেন?”

“পৃথুলার একান্ত ভালোবাসার মানুষ আরশানের দুঃখ দূর করতে চাইছি।”

শিমুল উত্তরে কিছু বলল না। সে চুপচাপ সোফায় বসে আছে। তাকে রেখেই শীলা আরশানের রুমে গেল। পুরো রুম অন্ধকার। সিগারেটের গন্ধে ভরে আছে চারদিক। লম্বা দম নিয়ে নিজেকে সামলে নিল শীলা। এক পা, দু’পা করে এগিয়ে গিয়ে আরশানের পাশে বসল। পৃথুলার মতো ছটফটে স্বভাব এনে আরশানের হাত ধরে বলল,

“এই, আপনি সিগারেট খাচ্ছেন কেন? জানেন না, সিগারেট আমার পছন্দ না? ফেলুন বলছি। এক্ষুণী ফেলুন।”

শীলা নিজেই সিগারেটটি ফ্লোরে ফেলে দিল। আরশান শান্ত দৃষ্টি মেলে শীলার দিকে তাকাল। একই চোখ, একই মুখ, চুল, হাসি। সত্যিই যেন পৃথুলা বসে আছে তার সামনে। শীলা চোখে চোখ রেখে বলল,

“চলুন না আমরা বিয়ে করে ফেলি? আপনার সব কষ্ট আমি মুছে দেবো।”

আরশান হাসল। শীলার থেকে নিজের হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে ফ্লোর থেকে সিগারেটটি তুলল। বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিয়ে বলল,

“তুমি হুবুহু দেখতে পৃথুলার মতো হতে পারো। কিন্তু আমার পৃথু হতে পারবে না কখনো।”

শীলা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাকে প্রত্যাখান করার জন্য সে কাঁদছে না। সে কাঁদছে পৃথুলার প্রতি আরশানের অনুভূতি এবং ভালোবাসা দেখে। তার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ এটা ভেবেই, এত ভালোবেসেও কেন দুটো মানুষ এক হতে পারল না? কী এমন হতো যদি, সত্যি গল্পটা পালটে যেত? শীলা আর সেখানে দাঁড়াল না। সেখান থেকে প্রস্থান করল।

আরশানের দৃষ্টি বাইরে। গভীর জঙ্গলের মাঝে নিবদ্ধ। সে যেন পৃথুলার বলা কথাটি শুনতে পাচ্ছে,

“আপনার পৃথু আপনাকে ভালোবাসে।”

আরশান সিগারেটে টান দিয়ে বলে

“তোমার মহাপ্রস্থান ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটায়নি, নতুন করে ভালোবাসার সূচনা ঘটিয়েছে। ভালোবাসি তোমাকে পৃথু। ভালোবাসি!”

(সমাপ্ত)
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।