ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৩০+৩১

0
184

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩০
শাশুড়ির সঙ্গে রাগারাগির পর থেকেই মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট হচ্ছিলো অপর্ণার, খেতেও ইচ্ছে করছিলো না, তাও জোর করে কিছু মুখে দিয়ে, কোনো রকমে কাজ কর্ম সেরে, নিজের ঘরে এসে চুপ করে শুয়ে ছিলো অপর্ণা।

এই মুহূর্তে শাশুড়ি নয় বরং ভীষণ অভিমান, রাগ হচ্ছে মায়ের ওপরে, শাশুড়ির তো খুব বেশি দোষ নেই। এরকম খবর শুনলে কেই বা চুপ করে থাকে, উনি তো তাও হয়ত নিজের স্বার্থেই মুখ বন্ধ রেখেছেন। কতো বার ও চেষ্টা করেছিলো তখন, মাকে বলেছিল ছেলের বাড়িতে জানিয়ে করতে সব কিছু, কিন্তু কিছুতেই মাকে রাজি করতে পারেনি। আজ তো কষ্ট পাচ্ছে ওই, ওর কষ্টটা তো কেউ নিতে পারবে না। যদি মা সেদিন বাবার কথা পুরোটা না শুনেই ওরকম চিৎকার চেঁচামেচি না করতো তাহলে কি পাশের বাড়ির জ্যেঠিমা কিছু শুনতে পেতেন। ওখানে সবাই জানে দিগন্ত দার মায়ের স্বভাব, তিল কে তাল করা ওনার অভ্যেস, উনি যে এটা ছড়িয়েছেন সেটা তো বুঝতেই পারছে ও, সেটাও তো মায়ের জন্যেই অনেকটা! কবেই তো ওকে একদিন কলেজ যাবার সময়ে জিজ্ঞেস করেছিলো সৃজা, জানতে চেয়েছিল ওর সমরের সঙ্গে রেজিষ্ট্রি হয়ে গেছে কিনা! তখন তো ওর সৌমিক এর সঙ্গে বিয়েই ঠিক হয়নি!

মাকে ফোন করে বলতে ইচ্ছে করছিলো অপর্ণার, মনে হচ্ছিলো বলে, দেখো তুমি আমার ভালো করতে গিয়ে আসলে কতো খারাপ করে ফেলেছ! অসহায় রাগে ফোনটা হাতে নিয়েও নিজেকে সামলালো অপর্ণা, বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো, অনেক কষ্টে সুস্থ হচ্ছে মানুষটা এখন এরকম খবরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে যদি! কাকে মনের কথা বলবে ও, সৌমিক কে ফোন করতে ইচ্ছে করছে খুব, মনে হচ্ছে কারোর সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারলে একটু ভালো লাগবে।

কিছুক্ষন শুয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত সৌমিক কে ফোন করে ফেললো অপর্ণা, বেশ খানিকক্ষন বাজার পরে ফোন তুলে সৌমিক হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্বভাব মতোই জিজ্ঞেস করলো অপর্ণা,

তুমি কি ব্যস্ত?

সৌমিক ব্যস্ত গলাতেই উত্তর দিলো,

হ্যাঁ, খুব! কিছু জরুরী দরকার? নাহলে পরে ফোন করছি!

জরুরি দরকার নাই জানিয়ে অপর্ণা ফোন রেখে দিল। রাখার পরেই মনে হলো যদি সৌমিক ব্যস্ত নাও থাকতো তাহলেই বা ঠিক কি বলতো ও! ওকি সৌমিক কে এই কথাটা একবারও বলতে পারতো যে ওর এই মুহূর্তে শাশুড়ি নয় মায়ের ওপরেই রাগ হচ্ছে! শাশুড়ির ওপরে রাগ হলে ও যতো সহজে সেটা সৌমিক কে বলতে পারে নিজের মায়ের ওপরে রাগ, অভিমান হলে সেটা ততো সহজে বলা যায় কি!

বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে শুয়ে ছিলো অপর্ণা, চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে আসা জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছিল। কতক্ষন এই ভাবে শুয়ে ছিলো মনে নেই, হটাৎ জানলা দিয়ে মিতার গলার স্বর শুনতে পেলো অপর্ণা, মিতা ছাদের আলসেতে হেলান দিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে আছে। গলার আওয়াজে অপর্ণা মুখ তুলে তাকালো, মিতার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, মিতা অবাক গলায় বললো,

তুমি কাঁদছো নাকি! কি হয়েছে অপর্ণা?

অপর্ণা তাড়াতাড়ি চোখ মুছতে চেষ্টা করে মাথা নাড়লো,

না, তো!

মিতা আরো সামনে এগিয়ে এলো, নিচু গলায় বললো,

আমি তোমার দিদির মতো, কি নিয়ে কষ্ট পাচ্ছ, বলো আমাকে? তবে তুমি না বললেও বুঝি আমি, কম দিন তো চিনিনা তোমার শাশুড়ি কে, কাউকে ভালো থাকতে দেখতে ওনার অসুবিধা হয় বোধহয়!

অনেকক্ষন ধরে চেপে রাখা কষ্ট, কারোর কাছে বলতে না পারার যন্ত্রণা, বোধহয় এই সহানুভূতিটুকুর জন্যেই অপেক্ষা করছিলো, মন খুলে কষ্টের কারণ বলতে না পারলেও, নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে জানলার সামনে এগিয়ে এলো অপর্ণা, গ্রিলে মাথা রেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো,

সব সময় আমার সঙ্গেই সব খারাপ হয় কেনো মিতাদি, আমি তো কখনো কারো খারাপ চাইনি!

অপর্ণা যতক্ষন ধরে সামলালো নিজেকে, ততক্ষন মিতা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, একটা কথাও বললো না, তারপরে ধীরে ধীরে গলা নামিয়ে বললো,

নিজেকে ভালো রাখতে নিজেকেই জানতে হয় অপর্ণা, অন্য কেউ তোমাকে সেটা করে দেবে না! সারাদিন বাড়িতে বসে থাকো, ক্লাসে যাও আর বাড়িতে ঢোকো, তোমার কি কোন জীবন নেই এর বাইরে? নিজেকে সময় দাও, বেড়াও, আনন্দ করো! সারাজীবন কি রান্নাঘরেই কাটাবে নাকি?

অপর্ণা আর কথা বাড়তে দিলো না, এবার সে ঘুমিয়ে পড়বে জানিয়ে হটাৎ বেরিয়ে আসা আবেগটুকু সামলে নিয়ে একটু হেসে সরে এলো জানলার কাছ থেকে। কিন্তু শুয়ে শুয়েও একই কথা ভাবছিলো অপর্ণা, সত্যি বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে জীবনটা, ইউনিভার্সিটি আর বাড়ি এর বাইরে কতটুকু দেখেছে ও কলকাতা শহরটা! নিজের পাড়া টুকুও তো ও ভালো করে চেনে না এখনও! মিতা বোধহয় ঠিকই বলেছে, ওর নিজেকে কিছু সময় দেওয়া দরকার।

পরের দিন সকালে অনিন্দিতা এসে যাওয়ায় অপর্ণার চাপ ছিলো না, তবু সৌমিকের সঙ্গে না গিয়ে একাই বেরিয়ে ছিলো অপর্ণা। সৌমিক এর তাড়া ছিলো, সেও জোর করেনি খুব একটা, শুধু বেরোনোর আগে বলেছিলো,

মাসীরা আসবে আজ মনে আছে তো? চেষ্টা করো তাড়াতাড়ি ফিরতে!

অপর্ণা ঘাড় নেড়েছিলো,

আছে! তুমিও ফিরবে তো তাড়াতাড়ি?

সৌমিক মাথা নেড়েছিল,

নাহ! আমার মনে হয় হবে না!

ক্লাস শেষ হতে হতে প্রায় পাঁচটা হলো অপর্ণার, বাইরে এসে দেখলো আকাশ কালো করে এসেছে, বৃষ্টি নামবে নামবে করছে। ওকি সৌমিক কে ফোন করে দেখবে একবার, নাকি নিজেই চলে যাবে অপেক্ষা না করে, অন্য মনস্ক হয়ে ভাবছিলো অপর্ণা, আচমকা ওর গা ঘেঁসে একটা গাড়ি এসে থামলো। অপর্ণা চমকে তাকালো, গাড়ির কাঁচ নামিয়ে মিতা মুখ বার করলো,

অপর্ণা! বাড়ি যাবে তো? উঠে এসো, এক্ষুনি বৃষ্টি আসবে!

অপর্ণা কি করবে ভাবার আগেই বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তে লাগলো, আর ভেবে সময় নষ্ট না করে মিতার খুলে ধরা দরজা দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লো ও। গাড়ি চলতে শুরু করতেই মিতা ড্রাইভার কে রাস্তা বলে দিয়ে ফোন করলো কাউকে,

আসছি মিনিট পনেরোর মধ্যে, অপর্ণা সঙ্গে আছে আমার।

অপর্ণা একটু অবাক হলো, মিতা ওকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে, ওর তো ফেরার তাড়া আছে আজ! মিতা বোধহয় বুঝতে পারলো, জানালো ওকে দশ মিনিটের জন্যে একটা জায়গায় যেতে হবে, সেখানে একটা ছোট্ট কাজ আছে ওর। এই মুহূর্তে গাড়িতে উঠে পড়ার পরে আর কিছু করার ছিলো না অপর্ণার অগত্যা মাথা নাড়লো অপর্ণা,

ঠিক আছে! কিন্তু তুমি আমার নাম বললে কেনো? যাঁর বাড়িতে যাবো তিনি কি আমাকে চেনেন?

মিতা হাসলো,

সারপ্রাইজ!

অপর্ণা একটু চিন্তায় পড়লেও আর কিছু বললো না, দেখাই যাক ওকে কোথায় নিয়ে যায় মিতা! জানলার বাইরে তাকিয়ে অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে বসেছিলো অপর্ণা, বেশ কিছুক্ষন পরে মিতার গলার আওয়াজে চমকে উঠে তাকালো, মিতা ওকে নামতে বলছে।

অপর্ণা আশে পাশের বাড়ির দিকে তাকালো, চারপাশের পরিবেশ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা একটা পুরনো পাড়া। গায়ে গায়ে লাগানো বাড়িগুলোর মধ্যে খুব বেশি ফাঁক নেই, তার মধ্যেই দু একটা বাড়ি কে ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। পাড়ার ভেতরের রাস্তা যথেষ্ট সরু, মুখোমুখি দুটো গাড়ি পেরোনোর জায়গা নেই। বৃষ্টি ধরে গিয়েছিলো, খানিকটা দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মিতা ওর দিকে ইশারা করলো,

চলো!

অপর্ণা আশে পাশে চারদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটতে লাগলো, মিতার দিকে তাকিয়ে বললো,

আমরা কোথায় যাচ্ছি? কার বাড়িতে?

মিতা হাসলো,

চলোই না!

রাস্তার প্রায় শেষ প্রান্তে যেখানে রাস্তাটা ঘুরে গিয়েছে, সেখানে একটা ছোটো ফ্ল্যাট বাড়ি, খুব বেশিদিনের নয় সেটা গায়ে রঙের প্রলেপ দেখে বোঝা যাচ্ছে। মিতা সেখানের একতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল টিপলো, দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন তাকে দেখেই অপর্ণা চমকে উঠলো, রীতা পিসি! মহিলা জানতেন ওরা আসবে তিনি অপর্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন,

এসো!

একটু ইতস্তত করেই ঘরে ঢুকলো অপর্ণা, সেদিনের মহিলার কথা থেকেই ও বুঝেছে ওনার সঙ্গে শাশুড়ির খুব বেশি সদ্ভাব নেই। একে ও মিতার সঙ্গে এসেছে, এটা জানতে পারলেই শাশুড়ি বিরক্ত হবেন, তার মধ্যে আবার রীতা পিসির বাড়ি! কিন্তু এই মুহূর্তে ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই! ওকে বসিয়ে রেখে রীতা পিসি রান্না ঘরে গেছে, মিতা বাথরুমে, ঘরে বসে বসে চারপাশটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো অপর্ণা। বেশ ছিমছাম গোছানো পাশাপাশি দুটো ঘর, বাথরুম, রান্নাঘর, ব্যালকনি নিয়ে ফ্ল্যাট, একা একজন মানুষ হাত পা ছড়িয়ে থাকার জন্যে যথেষ্ট শুধু নয় বেশ বড়ই লাগলো অপর্ণার।

অপর্ণা মনে মনেই একটু আশ্চর্য্য হচ্ছিলো, সেদিন ভদ্রমহিলা ওর কি করে চলে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, একা মানুষের আবার খাওয়ার চিন্তা কি! কিন্তু আজকে ওনার বাড়ি দেখে সেটা মনে হচ্ছে না! এতো সুন্দর সাজানো গোছানো ঘর, দেওয়ালে লাগানো বড়ো স্ক্রিনের টিভি, ঘরের এক পাশে একা মানুষের বাড়িতে ডবল ডোরের ফ্রিজ, দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি যথেষ্টই স্বচ্ছল জীবন যাপন করেন! স্বাভাবিক কৌতূহল থেকেই অপর্ণা উঠে দাঁড়ালো, এই ঘরের মধ্যে দিয়েই পাশের ঘরে যাবার দরজা, সেখানে যথেষ্ট দামী পর্দা ঝুলছে! পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকেই অবাক হলো অপর্ণা, ঘরের এক পাশে জানলা ঘেঁসে বড়ো ডবল বেডের ডিভান, ঠিক তার মাথার ওপরেই লাগানো এসি, এক পাশে দেওয়াল জুড়ে ওয়ার্ডরোব তাতে আয়না লাগানো। জানলার উল্টো দিকের দেওয়ালে একটা বড়ো করে বাঁধানো ছবি, ছবির মহিলা কে অপর্ণা চেনে, উনি সৌমিকের ঠাকুমা! আর ওই ছবিটার ঠিক নিচে রাখা একটা শো কেস, যার ওপরে আর একটা ফটো ফ্রেম স্ট্যান্ডে রাখা ছবি, সেটা সৌমিকের বাবার!

অপর্ণা ছবি দুটো দেখতে দেখতে একটু অন্য মনস্ক হয়ে পড়ছিলো, ওখানে শাশুড়ির কোনো ছবি নেই! ভদ্র মহিলা কি তার মানে এতটাই অপছন্দ করেন রীনা কে যে শ্বশুর মশাইয়ের একা ছবি ফ্রেমে রেখেছেন, সঙ্গে রীনার ছবি রাখতে চান নি!

ওঁরা আমার ভগবান, ওনাদের জন্যেই আমি বেঁচে আছি!

অপর্ণা চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখলো রীতা পিসি ওর পেছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন ও খেয়াল করেনি! ওনার হাতের থালায় লুচি, তরকারি, প্লেটে রাখা মিষ্টি! হাতের প্লেট টা অপর্ণার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে রীতা হাসলেন,

খেয়ে নাও, সেই কখন খেয়ে ক্লাসে বেরিয়েছ! এতক্ষনে তো খিদে পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই! এখানে তো আর মা নেই যে পেছন পেছন খাবার নিয়ে ঘুরবে, নিজেরটা নিজেকেই করে নিতে হবে বুঝলে!

কয়েক মুহূর্তের জন্যে এই আন্তরিকতার ছোঁয়া টুকু ভালো লাগলো অপর্ণার, সত্যি তো কতদিন ওকে কেউ হাতে ধরে খাবারের থালা এগিয়ে দেয়নি! তবু এখন খাওয়া মানে আরও দেরি হয়ে যাবে, তাই অপর্ণা একটু থতমত খেলো। ওকে অন্য মনস্ক দেখে রীতা হাসলেন,

আরে খেয়ে নাও, বেশিক্ষন লাগবে না!

অগত্যা হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিতে নিতে অপর্ণা হাসলো, ছবিগুলোর দিকে ইশারা করে বললো,

আপনি খুব শ্রদ্ধা করেন বোধহয় বাবা আর ঠাকুমা কে!

রীতা হাসলেন,

হ্যাঁ! ভীষণ! ওঁরা না থাকলে তো কবেই ভেসে যেতাম! নিজের বাড়ির লোক তো কেউ আসেনি বিপদের দিনে, অথচ রক্তের সম্পর্কে কেউ না হয়েই মাসীমা এগিয়ে এসেছিলেন সেদিন! সেই ঋণ ভুলি কি করে! আর তোমার শ্বশুর মশাই তো দেবতুল্য মানুষ, ওনার কোনো তুলনাই হয়না!

অপর্ণা এ ব্যাপারে সহমত হলো,

ঠাকুমা কে দেখিনি নিজে তবে বাবা সত্যিই খুব ভালো মানুষ! ভীষণ কম কথা বলেন যদিও, কোনো ব্যাপারেই খুব বেশি মাথা ঘামান না! তবুও আমার ওনাকে বেশ ভালো লাগে!

রীতা মাথা নাড়লেন, আফসোসের গলায় বললেন,

আসলে তোমার শাশুড়ি এতো মিস বিহেভ করে ওঁর সঙ্গে, কথা বলা মানেই তো বিতর্কে যাওয়া! সারা জীবন এই ভাবেই চলেছে, অশান্তি এড়ানোর জন্যে চুপ করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন! কি করবে বলো স্ত্রী, সংসার ফেলে কোথায় যাবে আর!

রীতা পিসির কথার মধ্যে বড্ড বেশি সংসরিক আলোচনা এসে যাচ্ছিলো তাই অপর্ণা চুপ করে রইলো। রীতা সম্ভবত বুঝতে পারছিলেন, তাই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিলেন নিজেই। অপর্ণা ওনার পেছন পেছন সোফায় এসে বসলো থালা হাতে, ততোক্ষনে মিতাও এসে বসেছে। মিতা হেসে হাতে থালা তুলে নিলো, রীতার দিকে তাকিয়ে বললো,

রীতা পিসি ভীষণ ভালো রান্না করে জানো তো! ছোটবেলায় যখন ঋজুর সঙ্গে খেলতে যেতাম তখন ঠাকুমা আর পিসি আমাদের কতো কি করে খাওয়াতো!

রীতা হাসলেন,

ছাড় ওসব! আজ অপর্ণার কথা শুনি! বলো অপর্ণা কেমন লাগছে শ্বশুরবাড়ি?

মিতাও সহমত হলো, অপর্ণার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অপর্ণা তোমার গল্প বলো? শ্বশুরবাড়ি, হাসব্যান্ড সব কেমন লাগছে? কোথায় গেলে হানিমুনে? কেমন কাটলো হনিমুন? কোথায় কোথায় বেড়ালে এতদিন?

অপর্ণা একটু অস্বস্তিতে পড়লো, হনিমুনে তো যায়নি ও, এমনকি কোথাও বেড়াতে যাওয়াও তো হয়নি আজ পর্যন্ত! প্রথমে তো সৌমিক যেতে না চাওয়ায় ও খুশিই হয়েছিলো, নিজের মনও সায় দেয়নি বেড়াতে যেতে, কিন্তু তারপরে তো ওর যেতে ইচ্ছেও করেছে অনেকবার, কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সৌমিক এর নতুন জায়গায় ট্রান্সফার, ব্যস্ততা, নিজের পড়াশুনা এমনকি শাশুড়ির ঠিক করা পুরোহিতের দোষ কাটানোর নিদানে এসব ঘোরা বেড়ানো বাকি থেকে গেছে। ও ও ভয় পেয়েছে যদি গেলে সত্যি কিছু হয়ে যায়! কিন্তু এসব কথা তো আর অন্য কে বলা যায় না, তাই কি উত্তর দেবে ঠিক করতে না পেরে অপর্ণা চুপ করে রইলো। মিতা এবং রীতা পিসি দুজনেই অপর্ণার উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে ছিলো, ওকে চুপ করে থাকতে দেখে মিতা একটু অবাক হলো,

তুমি হানিমুনে যাওনি নাকি? আজ পর্যন্ত কোথাও যাওনি?

অপর্ণা যুৎসই কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে শেষে ঘাড় নাড়লো,

নাহ!

মিতা হটাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেলো,

হুমম! ওই মহিলা যেতে দেয়নি নিশ্চয়ই? ঠিক কোনো অজুহাত বার করেছে?

অন্য কেউ হলে হয়ত এটাকেই মেনে নিত, কিন্তু অপর্ণা অন্য ধাঁচের, যে কাজটা সত্যি শাশুড়ি করেন নি, তার জন্যে তাঁকে দায়ী করতে অপর্ণার বাধল, সে তাড়াতাড়ি মিতাকে থামিয়ে দিলো,

না, না, আসলে আমরা নিজেরাই যেতে চাইনি, ওর তো বিয়ের জন্যে অনেক ছুটি গিয়েছিলো তাই অসুবিধা হচ্ছিলো, আর ছুটি ও নিতে চাইছিলো না!

সৌমিক ছুটি নিতে চায়নি এই কথায় মিতার মুখে একটা অদ্ভুত স্বস্তির ছাপ পড়লো। তাকে আর কোনো কথা না বলে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপর্ণার মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করতে লাগলো। মিতা কি ভাবলো সৌমিক ইচ্ছে করে ওকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বেড়াতে যায়নি। ওকি অপর্ণার সঙ্গে সৌমিকের সম্পর্ক সহজ নয় বলে ভাবছে! যতোই বুদ্ধিমতি হোক না কেনো, সদ্য তরুনী অপর্ণার কাছে মিতার চোখের এই দৃষ্টি খুব অপমানজনক লাগলো হটাৎ, মিতা কি ওকে দয়ার পাত্র মনে করছে! ভাবছে সৌমিক ওকে ভালোবাসে বলে অপর্ণার সঙ্গে হানিমুনে যায়নি! কিন্তু সেটা তো সত্যি নয়! ওর কি মিতার এই ভাবনাটা কে ভুল প্রমাণিত করা উচিত নয়! কয়েক মুহূর্ত মিতার দিকে তাকিয়ে থেকে অপর্ণা নিজে থেকেই বললো,

আসলে ও যেতে চেয়েছিলো পরে, কিন্তু আমারই খুব বেশি ইচ্ছে ছিলো না তখন! ও অনেকবার জোর করেছিলো আমাকে কিন্তু আমিই যেতে চাইনি! পড়াশুনার যা চাপ, কোথাও যাওয়ার উপায় নেই!

মিতার খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো, সে অপর্ণার মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে থালা রেখে উঠে দাঁড়ালো, আর এ প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে রীতা পিসির দিকে তাকালো,

পিসি, অসুবিধা হলে জানিও, হেজিটেট কোরো না! নিজে থেকে না বললে বুঝবো কি করে?

রীতা অপর্ণার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে ঘাড় কাত করলো, অপর্ণা বুঝলো মিতা সম্ভবত রীতাকে টাকা পয়সা দিতে এসেছিলো। প্রসঙ্গ ঘুরে যেতে দেখে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কোনো রকমে বেসিনে হাত ধুয়ে বেরোতে বেরোতে বললো,

আসি পিসি! আজ বাড়িতে মেজো মাসীরা আসবেন, আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩১
দুপুরের পর থেকেই আকাশ কালো হয়ে আসছিলো, ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন রীনা, মেজদির আসার সময় হয়ে গিয়েছে প্রায়। প্রায় পিঠোপিঠি এই দিদির সঙ্গে অন্য বোনেদের থেকে তাঁর সম্পর্ক অনেকটাই আলাদা। তাঁর জীবনের সব ওঠাপড়ায় সাক্ষী এই দিদি, মনের কথা বলার এক মাত্র সঙ্গী।

প্রথম সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে মেজদি প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলো, তাঁকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও বাচ্চাটি বাঁচেনি। তারপরে অনেক রকমের সমস্যা এড়িয়ে একটু বেশি বয়সে হওয়া এই মেয়েটিকে দিদির পাশাপাশি রীনা নিজেও ভীষণ ভালো বাসেন, নিজের ছেলে মেয়েদের থেকে একটুও আলাদা করে ভাবেন না। এর বিয়ে ঠিক হওয়া থেকেই তাই অনেকটা নিজে যেচেই প্রায় সব দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। বিয়ের বাজার থেকে নিমন্ত্রণ পর্ব সব তাঁর বাড়ি থেকেই হচ্ছে।

বৃষ্টি শুরু হবার বেশ অনেকক্ষন আগেই অবশ্য মেজদি রা পৌঁছে গেলেন, রীনার পায়ের অবস্থা তাঁদের জানা ছিলো, তাই এই সময় আসবেন কিনা চিন্তা ভাবনা করছিলেন। রীনা অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিলেন যে অনিন্দিতা এসে যাবে সকালে ফলে কোনো অসুবিধা হবে না। অনিন্দিতা সময়মতোই চলে এসেছিলো, এসব ব্যাপারে তার সময় জ্ঞান খুব প্রবল। যে কারণে তার যাওয়া সেই মা এখন অনেকটাই সুস্থ আছেন তাই তার ফিরে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

রীনার ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে যাওয়ার অবস্থা ছিলো না, তাই অন্যরা বাইরে বসে গল্প করলেও রীনার মেজদি বোনের ঘরের খাটে বসে গল্প করছিলেন। ইতিমধ্যে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিলো, রীনা ছেলে, বউয়ের জন্যে চিন্তা করছিলেন, এই বৃষ্টিতে বাইক নিয়ে কি করে আসবে ওরা! বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষার পরে আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ছেলে কে ফোন করে ফেললেন রীনা, সৌমিক জানালো অপর্ণার সঙ্গে তার কথা হয়েছে সে কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে, তবে সে এখনও বেরোতে পারেনি, বৃষ্টি থামলে বেরোবে।

অপর্ণাই বা কিভাবে আসবে এই বৃষ্টিতে, মায়ের এই প্রশ্নের উত্তরে সৌমিক একটু ইতস্তত করে জানালো যে ওর সঙ্গে মিতার রাস্তায় দেখা হয়েছে ও ওর গাড়িতে উঠে গিয়েছে। সৌমিক এর যদিও এই কথা বলার কোনো ইচ্ছে ছিলো না তবু ও ভয় পাচ্ছিলো যদি মা অপর্ণা কে গাড়ি থেকে নামতে দেখে তাহলে প্রবল অশান্তি হবে। তার চেয়ে আগেই বলে দেওয়া ভালো। কিছুক্ষন আগেই যখন অপর্ণা ওকে ফোন করে জানিয়েছিল ও মিতার সঙ্গে ফিরছে তখনই মনে মনে প্রমাদ গণেছিলো সৌমিক, অপর্ণা কে একটু দূরে নামতে বলবে ভেবেও মনে পড়েছিলো ও নিজে আগেরদিন মিতার গাড়ি থেকে গলির মোড়ে নেমেছিলো বলে অপর্ণা বিরক্ত হয়েছিলো, বলেছিলো লুকিয়ে কিছু করা তার একটুও পছন্দ নয়!

রীনা ফোন নামিয়ে রেখে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন,

এই মেয়েটা বড্ড বেয়াড়া, একটা কথাও শোনে না! ওকে বেছে বেছে ওই গাড়িতেই উঠতে হলো! আর ওই মিতা মেয়েটাকে দেখো ঠিক তক্কে তক্কে থাকে, সুযোগ পেলেই ঢুকে পড়ে!

রীনার মেজদি বোনকে থামানোর চেষ্টা করলেন,

এই বৃষ্টিতে কোনো উপায় না দেখেই হয়ত উঠে পড়েছে, অতো রাগারাগি করিস না! কিন্তু ওই মেয়েটা তো দিল্লিতে থাকছিল, এখানে ফিরলো কবে?

রীনা মিতার বাবার মৃত্যুর খবর জানিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন,

আর ওখানে থেকে কি করবে! যে জন্যে যাওয়া সেই তো হলো না! ঋজু কে নিয়ে যেতে পারলো না বলে এখানেই ফিরেছে আবার! শুনলাম এখানে নাকি চাকরিতে জয়েন করেছে আবার, মিনতি বললো!

মেজদি অবাক হলেন,

ভদ্রলোক মারা গেছেন নাকি! মনে আছে তুই ওনাকে অনেক কথা বলেছিলি?

রীনার মুখে কালো ছায়া পড়লো,

মানুষ মারা গেলেই কি মহান হয়ে যায় মেজদি? সারা জীবন ওরা আমার শাশুড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাকে ছোটো করেছে! আমার শাশুড়ির তো মুখের ভাষাই ছিলো মিতার মায়ের মতো মেয়ে নাকি উনি বউ হিসেবে চেয়েছিলেন। সব সময় এক কথা, তোমাকে বৌমা হিসেবে পাইনি তো কি হয়েছে তোমার মেয়ে কে আমি নাত বউ করে আনবো। অথচ দেখো এতো বছর পাশের বাড়িতে থাকলো, ওর শ্বশুর, শাশুড়ি কে কিন্তু একদিনের জন্যেও দেখতে পেলাম না! শুধু শুনলাম আজ শ্বশুর অসুস্থ, কাল শাশুড়ি অসুস্থ, এই করে তাঁরা নাকি মারাই গেলেন, আমাদের কখনো চোখে তাঁদের দেখা হলো না। অথচ তাও সেই আমার শাশুড়ির চোখে সেরা বৌমা থেকে গেলো, দিনরাত মাসীমা মাসীমা করে, তরকারির বাটি পাঠিয়েই সে মন জয় করে নিলো, আর এতো বছর মুখ বুজে থেকেও আমি কখনো ভালো হতে পারলাম না!

মেজদি হাসলেন, এসব ঘটনা তাঁর জানা। ছোটো থেকে মিতাকে আমার নাত বউ করবো বলে বলেই ঋজুর মধ্যে ওই ফিলিংস ঢুকিয়ে গিয়েছেন ওর ঠাকুমা। একটা সময় বাড়িতে তাঁর বোনের কোনো কিছু মুখ ফুটে বলার উপায় ছিলো না, মিতার মাও এই সুযোগে এই বাড়ির সব চেয়ে প্রয়োজনীয় দুজন, বোনের শাশুড়ি এবং রীতাকে হাত করে নিজের মেয়েকে এ বাড়ির ছোটো ছেলের বউ করে পাঠাতে চেয়েছিলেন। তাতে তাঁরও অনেক সুবিধা ছিলো, সারা জীবন মেয়েকে কাছে পেতেন। রীতাও এ ব্যাপারে তাঁকে বরাবরই সাহায্য করেছে। মিতা এ বাড়ির বউ হবে এই ভাবনা থেকেই তাকে আলাদা করে ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়ানো, একটু অন্য নজরে দেখে এসেছে বরাবরই। কারণ এই বাড়িতে রীনাকে দমিয়ে টিকে থাকতে গেলে পরের প্রজন্মের বউ কে কাছে পাওয়া তার দরকার ছিলো।

ঋজু মিতার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতে না চাওয়ায় রীনা যখন একদম ভেঙে পড়েছিলেন, মিতা এলে তাঁর সাজানো সংসার আবার রীতার হাতে চলে যাবে ভেবে দিদির কাছে কান্নাকাটি করছিলেন, তখন তিনিই তো কথা বলেছিলেন ঋজুর সঙ্গে। মেজো মাসি কে খুব ভালোবাসলেও ঋজু নিজের জেদ ছাড়েনি, এতো বছরের সম্পর্ক শুধু মায়ের পছন্দ নয় বলে সে ভাঙতে পারবে না! বোন তখন বিয়ের কোনো জোগাড় করতে চাইছিলো না, তিনিই অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন বোন কে, এর মধ্যেই ঋজুর সঙ্গে মিতার যে গন্ডগোল চলছে এই খবর তাঁর মেয়ে জলি তাঁকে দিয়েছিলো, সে এই খবর অনিন্দিতার কাছে পেয়েছিলো। গন্ডগোলের খবর পেয়েই তিনি বোনকে বলেছিলেন ছেলের সঙ্গে কথা বলতে, বোন জানিয়েছিল ঋজু অন্য জায়গায় বিয়েতে মত দিয়েছে। আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বিয়ে দিয়ে দিতে বলেছিলেন বোনকে।

মেজদি কে হাসতে দেখে রীনা একটু অবাক হলেন,

তুই হাসলি যে?

রীনা র মেজদি আবারও হেসে ফেললেন,

তুই মায়ের কাছে মাসীর বাড়ির গল্প করছিস! এসব কি আমার কাছে নতুন কথা! তাও কেউ মারা গিয়েছেন শুনলে খারাপ লাগে। এই তো জীবন, মানুষ কতো কিছু করে নিজের স্বার্থের জন্যে, ভাবেই না আজ আছি কাল নেই! এই মিতার বাবার কথাই ধর, উনি মারা গেছেন তাও ওনার কৃতকর্ম তুই ভুলতে পারছিস না! উনি তো সত্যিই সারাজীবন তোর কাছে খারাপ মানুষ হয়েই থাকবেন! একথা তো সত্যিই যে একদিন উনি নিজের স্বার্থেই তোকে কতো ছোটো করেছেন। তোর সামনে যেকোনো দরকারে রীতার সঙ্গে আলোচনা করেছেন, এমনকি রীতা আর তোর শাশুড়ি যখন মিতাকে বউ করার কথা বলতো তখনও সেটাতে সায় দেবার আগে ওনার কখনো মনে হয়নি যে ছেলে তোর, তার ব্যাপারে যেকোনো আলোচনা তোর সঙ্গে করা উচিত!

রীনা চোখের জল মুছলেন,

বাইরের কাউকে দোষ দিইনা রে মেজদি, আমার তো ঘর শত্রু বিভীষণ! আশুতোষ যদি ঠিক থাকতো তাহলে কি অন্য কারোর এই সাহস হতো! ইন্ধন তো ওই যুগিয়ে এসেছে সব সময়! আমি রীতাকে একটা কথা বললেও ও যে ভাবে সামনে এসে দাঁড়াতো, তাতে রীতার তো আমাকে অপমান করার সাহস হবেই! আর ওর মাও তো ইচ্ছে করেই এই সম্পর্ক টাকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে সারাজীবন, তাতে ওনার সংসারে আধিপত্য রাখতে সুবিধা হয়েছে। আজ যদি মিতা এই বাড়িতে আসতো তাহলে আশুতোষ তো সবচেয়ে বেশি খুশি হতো বোধহয়, আমাকে আবার কথায় কথায় কোণঠাসা করার সুযোগ পেতো!

রীনার মেজদির মুখে বিরক্তির ছায়া পড়ছিলো,

তুই তো আরো ন্যাকা! এতো কিছুর পরেও ও বাড়িতে অসুস্থ হয়ে বসে সেবা নিয়ে যাচ্ছে, আবার নিয়মিত রীতাকে খরচ পত্রও দিচ্ছে, এগুলো মেনে নিস কেনো!

রীনা ম্লান হাসলেন,

কি করবো বল তো! জানলে জামাই বউদের কথা ছেড়ে দে, ছেলে মেয়ের সামনে কি করে দাঁড়াবো! ওই সুযোগটাই তো নিচ্ছে! মিতার সাহসের কথাও ভাব না! ওর তো কোনো লজ্জা শরম নেই, যতো দায় আমার! সেই ঋজুর বিয়ের সময় হওয়া অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে আশুতোষ বাড়ি থেকে বেরোতে পারছেনা বলে, আমি বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে আসছিলাম। এখন পড়ে গিয়ে এই মাসটা যেতে পারিনি তাই আশুতোষ কে ফোন করে বলছে! বলছে না দিতে গেলে নাকি বাড়িতে এসে বলবে!

মেজদি অবাক হয়ে তাকালেন, ভয়ের গলায় বললেন,

সেকি রে! তাহলে তো সর্বনাশ! তুই অনলাইনে দিয়ে দে না! জলি তো করে দেখি!

রীনা মাথা নেড়ে হতাশ গলায় বললেন,

আমি ওসব পারিনা, তাহলে ঋজু বা ঋষি কেই বলতে হবে, সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। খুব টেনশনে আছি জানিস তো! তার মধ্যে শুনলাম মিতার বাবার শ্রাদ্ধে নাকি রীতা গিয়েছিলো, নিশ্চয়ই ওখানে অপর্ণার সঙ্গে দেখা হয়েছে। মেয়েটা না একটু বেশি সরল, কিন্তু বড্ড জেদ, অনেকটা ঋজুর মতোই! এই মিতার সঙ্গে কিভাবে এক সময়ে দেখা হলো কে জানে! ইচ্ছে করেই ওকে তুলতে গিয়েছে হয়ত! মিতা মেয়েটাকে আমি একটুও বিশ্বাস করিনা, বেশ ধুরন্ধর! অপর্ণা কিছুতেই বুঝতে পারছে না! বেশি বললেই আবার তর্ক জুড়ে দেবে!

রীনার মেজদি মাথা নাড়লেন,

আজ আমরা রয়েছি, আজ আর কিছু বলিস না! মন খারাপ হয়ে যাবে, পরে একদিন বুঝিয়ে বলিস! আর টাকাটা কি আমি গিয়ে দিয়ে আসবো তাহলে?

রীনা চিন্তিত গলায় বললেন,

আছিস তো এখন কয়েকদিন, ভেবে দেখি!

অপর্ণা কে নিয়ে মিতা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই রীতা ঘরে ঢুকে এলো, ফোন হাতে তুলে আশুতোষ কে বললো,

তোমার ছোটো ছেলের বউ আজ আমার বাড়ি এসেছিলো মিতার সঙ্গে! যদিও তোমার খুব প্রশংসা করলো তবু বউ কিন্তু খুব চালাক! তোমার বউ সম্পর্কে কোনো মুখ খুললো না! আগের দিনও দেখেছি, আজও দেখলাম! ভাবতাম গ্রামের মেয়েরা একটু সরল সিধে হয় তবে এ কিন্তু বেশ বুদ্ধি ধরে! কলকাতার জল গায়ে লেগে গেছে নাকি!

আশুতোষ চুপ করে শুনলেন কোনো কথা না বলে, ফোন নামিয়ে রাখার আগে বললেন,

বাড়িতে গেস্ট আছে!

রীতা আপত্তি করলো না, রীনার মেজদি, জামাইবাবুর সামনে আশুতোষের তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয় সে জানে, শুধু নামিয়ে রাখার আগে বললো,

বউ কে বোলো এখানে অপর্ণা এসেছিলো, তাহলে টাকা যে করে হোক পাঠিয়ে দেবে!

ফোন রেখে সোফায় বসে ঘরের চারদিকে দেখলো রীতা, এই প্রথম ওকে মিতার কাছে সাহায্য নিতে হলো! আশুতোষের প্রতি টান তার বহু বছরের, কিন্তু তখন তার কিছু করার ছিলো না, কারণ যেদিন সে প্রথম আশুতোষের মুখোমুখি হলো, তখন সে নিজেই বিয়ের কনে! সে তার বিয়ের রাতেই প্রথম দেখেছিলো আশুতোষ কে, মায়ের সঙ্গে তাঁর বান্ধবীর মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলো। বরাবর উচ্চাকাঙ্খী রীতার নিজের সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত স্বামীকে কখনো পছন্দ ছিলো না। কিন্তু তার বিধবা মায়ের পক্ষে অসাধারণ সুপুরুষ, বড়লোক বাড়ির ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। রীতার দাদারাও খুব বেশি কিছু সাহায্য করতে পারেনি, তাই ওই বিয়েকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিল রীতা।

এরপরে আশুতোষের বিয়ে হয়ে গেলো, মায়ের কাছে সে খবর পেয়েছিলো রীতা। বৌমার সঙ্গে যে মাসিমার বনিবনা হচ্ছে না সেখবরও তার কাছে ছিলো। কিন্তু এসব খবরে তার কিছু করার ছিলো না, সেও তার সংসারে মানিয়েই নিয়েছিলো মোটামুটি, এমন সময় তার স্বামী অসুস্থ হলো।

তাকে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করার খবর রীতার মায়ের কাছে শুনে আশুতোষ এর মা বান্ধবীর মেয়েকে তার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন, হাসপাতালে যাতায়াতের সুবিধার জন্যে। কলকাতার রাস্তা না চেনার সুবাদে যতদিন স্বামী হাসপাতালে ভর্তি রইলো ততদিন সে আশুতোষের সঙ্গে যাতায়াত করতে লাগলো। আশুতোষ এর প্রতি তার মুগ্ধতা যেমন তার মায়ের নজরে পড়ছিলো তেমনি আশুতোষেরও। তখন প্রথম সন্তানের জন্ম দিতে রীনা বাপের বাড়ি গিয়েছেন, এই সুযোগে রীতা এবং আশুতোষ অনেকটা কাছাকাছি এসে গেলেন। এরপরে স্বামী সুস্থ হলেও রীতার সঙ্গে তার সম্পর্ক আর সুস্থ হলো না কারণ ততদিনে সে আশুতোষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।

আশুতোষ এর মায়ের তাঁর পুত্রবধূ কে কখনো পছন্দ ছিলো না, যতোই তিনি অনেক ভেবে চিন্তে কলকাতা থেকে অনেক দূরে বাপের বাড়ি, বাড়িতে সেরকম দাপুটে কেউ নেই দেখে নিজের পছন্দেই নিয়ে আসুন না কেনো! তিনি যা ভেবে ছেলের বউকে বাড়িতে এনেছিলেন, সেই রকম পায়ের তলায় পড়ে থাকার মেয়ে রীনা ছিলেন না।

তাই ছেলের অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া দেখে তিনি একটুও আটকালেন না বরং এটাকে আরো উস্কে দিতে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হতে থাকায় রীতা যখন বাড়ি ছাড়ার পরিকল্পনা করছিলো তখন তার ভাইরা তাতে মদত দিতে না চাইলেও তিনি রীতাকে নিজের বাড়িতে এনে তুললেন। রীতা সেই সুযোগের পূর্ন সদ্ব্যবহার করেছিলো, নিজের মতো করে পরিকল্পনা মাফিক, মাসীমা কে ম্যানেজ করে, মিতাকে হাতে রেখে গুটি সাজিয়েছিল।

কিন্তু সব কিছু হিসাব মতো হয়না, ছেলেরা বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে রীনা যখন পায়ের তলার মাটি শক্ত করছিলেন, তখনই তাঁর যে মিতা কে পছন্দ নয় সেটা রীতা বুঝতে পারছিল এরপর তাকেই ঘর ছাড়া হতে হয়েছিলো, কিন্তু মিতা কে এই বাড়ির বউ হিসেবে ঢুকিয়ে নতুন করে এ বাড়িতে ফিরে আসার পথ খুঁজছিলো রীতা। তার জানা ছিলো পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এই সম্পর্কটাই রীনা ভাঙতে চেষ্টা করবেন। মিতা কে সামনে রেখে মিতার বাবা, মা বা রীতা নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করুক এটা তিনি কখনই হতে দেবেন না। তার আশঙ্কা কে সত্যি করেই রীনা এই সম্পর্কে আপত্তি জানিয়ে মিতার বাবাকে একদিন অপমান করলেন। তাঁর বহু বছরের জমানো ক্ষোভ, হতাশা, মিতার মাকে সামনে রেখে করা শাশুড়ির অপমান, এবং তাতে মিতার বাবা মায়ের নিজেদের স্বার্থেই প্রচ্ছন্ন সায়, সব কিছু মিলিয়ে প্রবল রাগ বাইরে বেরিয়ে এলো।

তখন রীতার কাছেই ছুটে গিয়েছিলো মিতার মা, অনেক বছর ধরে একদম গভীর মেলামেশার কারণে রীতার সঙ্গে আশুতোষের সম্পর্কের কথা মিতার মায়ের অজানা ছিলো না। এই জন্যেই তো তিনি বরাবর রীনা কে নয়, গৃহকর্ত্রী হিসেবে রীতাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। বুদ্ধি রীতাই দিয়েছিলো, ঋজু কে দিয়ে চাপ দিয়ে রীনা কে মেনে নিতে বাধ্য করেছিলো মিতা।

রীতা খুব ভালো করে জানতো, যে ছেলে মেয়ের মুখ চেয়ে রীনা এতো বছর মুখ বন্ধ রেখেছেন তার বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকির সামনে নত হওয়া ছাড়া রীনার কিছু করার নেই। এ ব্যাপারে আশুতোষের কোনো আপত্তি থাকবে না রীতা জানতো, তাই রীনা যখন বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিলেন তখন সে আশুতোষ কে দিয়ে মিতার বাবার কাছে ক্ষমা চাইয়ে নিয়েছিল।

এই পর্যন্ত সব প্ল্যান মাফিক ছিলো কিন্তু এর পরে মিতা বেঁকে বসলো, ক্ষমা চেয়েছে ঋজুর বাবা, মা তো চায়নি। তাই সে কিছুতেই ওই বাড়িতে ওনার সঙ্গে থাকবে না, ঋজু কে ট্রান্সফার নিয়ে দিল্লি যেতে হবে। ঋজু বরাবরের জেদী ছেলে, মায়ের জেদ যেমন সে মেনে নেয়নি, মিতার ক্ষেত্রেও মেনে নিলো না।

এই জেদাজেদীর মধ্যেই রীতা আশুতোষের মুখে খবর পেয়েছিলো যে তাঁকে রীনা প্রায় সব ঠিক করে একটি মেয়েকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছেন। সেখানে আশুতোষের কোনো বক্তব্য রাখার জায়গা ছিলো না, রীতা এবং মিতার মা কি করবে ভাবার আগেই মাত্র এক মাসের মধ্যে রীনা ছেলের বিয়ে দিয়ে ফেললেন। সেই বিয়েতে প্রায় অনাহুতর মতোই রীতা গিয়েছিল, দু একবার বউয়ের কাছাকাছি হবার চেষ্টাও করেছিল কিন্তু সম্ভব হয়নি। আজ অপর্ণা কে দেখে তার সাহায্যে নতুন করে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ার সুযোগের সন্ধান পেয়েছে রীতা, অপর্ণা তাকে ঢুকতে যদি সাহায্য নাও করতে চায় রীনা অন্তত ছেলের বউয়ের সব কথা জানার সম্ভাবনায় ভয় পেয়ে যাবে, এবং তার এ মাসের টাকা যে করেই হোক পাঠিয়ে দেবে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।
ক্রমশ