#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৬ (বোনাস)
-একি ভাবি? তোমার পায়ে কি হয়েছে?
বলেই ছুটে তুরার কাছে আসল,তুরা এখনো মেঝেতে পরে আছে, অনেক্ষণ ধরে তুরাকে না দেখতে পেয়ে রুহি ডাকতে এসেছিল ওকে, ঘরে ঢুকতেই দেখল তুরা মেঝেতে বসে আছে,আর পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরচ্ছে
-দেখি,,পা টা তো অনেক খানি কেটে গেছে ভাবি কি করে হলো এসব? তুমি দাঁড়াও আমি এক্ষুনি সাবাইকে ডেকে আনছি
একদমে কথা গুলো বলে উঠতে নিলেই তুরা রুহির হাত ধরে বলল
-থাক রুহি,সবাই ভীষণ ব্যস্ত এসবের মাঝে এই কথা বলে বিব্রত করার দরকার নেই,রাইমা আপু শুনলেই ব্যস্ত হয়ে পরবে
-কিন্ত এভাবে তো তোমাকে থাকতে দিতে পারব না ভাবি, অনেক রক্ত বেরচ্ছে
রুহির কথায় তুরা খানিক দম নিল,পায়ের তিরতির করে বাহিত রক্ত আর সূক্ষ্ম কাঁচের আঘাতে ভীষণ জালাপোড়া ধরেছে, ঠোঁট কামড়ে ব্যথা দমন করে রুহিকে হাতের ইশারায় সামনের টেবিল দেখিয়ে বলল
-ওই ড্রয়ারে ফার্স্ট এইড বক্স আছে, ওটা আনো
তুরার কথামতো রুহি ড্রয়ার থেকে বক্স বের করে এনে তুরার সামনে বসল। বক্স থেকে তুলা বের করে স্যাভলনে লাগিয়ে ক্ষত স্থানে ধরল। লিকুইডের কড়া গন্ধ আর ঠান্ডা স্পর্শে ভীষণ জ্বলন ধরল তুরার ক্ষত স্থানে,,তবুও নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে চুপচাপ বসে রইল,,রুহি বেশ সময় নিয়ে ক্ষত স্থানে স্যাভলন চেপে ড্রেসিং করে অ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে শুভ্র পাতলা কাপড়ের আস্তরণে ব্যান্ডেজ করে দিলো।
-আমাকে একটু উঠিয়ে দাও তো
তুরার কথামতো ওর হাত ধরে রুহি উঠিয়ে দাঁড় করাল তুরাকে। শাড়ির আঁচল আর পায়ের দিকে পাড়ে অনেক খানি রক্ত লেগে গেছে, এ অবস্থায় বাইরেও যেতে পারবে না। রুহির সাহায্য পরনের শাড়ি টা পালটে একটা কুর্তি আর লং স্কার্ট পরে নিল, স্কার্টটা লং হওয়ায় পায়ের ব্যান্ডেজ টাও বোঝা যাবে নাহ।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে বেশ অনেক্ষণ আগে। রাইমাকে সবাই মিলে মাথায় পানি ঢেলে ঘরে এনেছে। মেহমান রা খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে একে একে চলে গেছে, এখন রাইমার মেহেন্দির অনুষ্ঠান। রাইমাকে এনে স্টেজে বসিয়ে ওর চারপাশে ঘিরে বসল মেয়েরা,রাইমার পরনের হলুদ শাড়ি পালটে সবুজ রঙের একটা জামদানী আর হালকা গয়না পরিয়ে সাজিয়েছে। আরমান সাউন্ড বক্সে গান বাজাচ্ছে ‘mehendi hain rachne wali hathon mein gehri lali’
রুহি তুরাকে ধরে নিয়ে বসাল সবার মাঝে। একে একে আরমান,জায়মা,তনু,বিহান, রুহি সকলে বসল। তুরা কৌতুহলী চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, তুরাকে এভাবে বেচইন হয়ে কিছু খুঁজতে দেখে বিহান টুসকি মেরে বলল
-এদিক ওদিক কি খুঁজো অল্প বউ। আমিতো আছিই বরকে কেনো খুঁজতে হবে হানি
বিহানের কথায় তুরা না চাইতেও ফিক করে হেসে দিল। জায়মা আর রুহি উঠে নাচা শুরু করেছে তার সাথে তনু আর আরমান ও। আরমানকে ওরা ভিডিও করতে লাগিয়েছে, কিন্তু ও ক্যামেরা হাতে ভিডিও কম নাচছে বেশি। আরমানের উদ্ভট ভঙ্গিমায় নাচা দেখে তুরা হাহা করে হেসে উঠল। তনু নাচার মধ্যেই এগিয়ে এসে তুরাকে নাচার জন্য ডাকল তুরা কয়েকবার না করলেও তনু তুরার হাত ধরে টেনে তুলতেই তুরা আহ্ করে আর্তনাদ করে উঠল। মুহুর্তেই নাচ গান থামিয়ে এগিয়ে আসল ওরা সবাই
-ভাবি কি হয়েছে? কি হলো তোমার?
জায়মা এগিয়ে এসে বলল, তুরা উঠতে গিয়ে ক্ষত স্থানে চাপ লেগে প্রচন্ড যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠল, ব্যথায় চোখ মুখ কুচকে রইল,বিহান তুরার হাত ধরে পাশে বসিয়ে পায়ে হাত দিলে শুভ্র কাপড়ের ব্যান্ডেজটা চোখে পরতেই তড়িঘড়ি করে রাইমা বলল
-একি! তুরা,পায়ে কি হয়েছে তোর? ব্যান্ডেজ কেনো?
রাইমার অস্থিরতা দেখে তুরা নিজেকে সামলে রাইমাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-আপু শান্ত হও,কিচ্ছু হয়নি। সামান্য একটু লেগেছে চিন্তার কিছুই নেই
তনু তুরার সামনে বসে পায়ের ব্যান্ডেজ টা ভালো করে দেখে বলল
-ব্যান্ডেজ টা দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক খানি কেটেছে,এসব কখন হলো ভাবি,বলনি কেনো তুমি?
অনুষ্ঠানে রমরমা হওয়া এতক্ষণের পরিবেশ টাতে মুহুর্তেই দুশ্চিন্তার ছাপ পরে গেলো সকলের মুখে, তুরা মোটেও এমনটা চাইনি। এই জন্যেই তো বলতে চাইনি ওদের
-তোমরা প্লিজ এত হাইপার হইয়ো না, সামান্য কেটেছে আর আমি ওষুধ লাগিয়েছি তো
-কিন্ত এতটা কাটলো কি করে ভাবি?
আরমানের প্রশ্নে তুরা মুখটা কাচুমাচু করে বলল
-আসলে আমার হাত থেকে কাঁচের জগটা পরে ভেঙে গেছিল,অসাবধানতা বশত হাঁটতে গিয়ে পায়ে বিঁধে গেছে
-কি যে করিস তুরা, একটু সাবধানে চলবি না। কাঁচে কেটেছে, ব্যাথাও হবে খুব। মা অথবা ফুফু শুনলে কত চিন্তা করবে
রাইমার কথায় তুরা ওর হাত ধরে বলল
-তুমি প্লিজ মা কিংবা ফুফু আম্মাকে এসব বলোনা৷ উনাদের শুধু শুধু চিন্তিত করতে চাইনা আমি। এইটুকুই তো কেটেছে, ঠিক হয়ে যাবে। তুমি প্লিজ বলোনা প্লিজ!
তুরার এমন বাচ্চামো আবদারে রাইমা সামান্য হেসে বলল
-আচ্ছা ঠিকাছে বলছি না, কিন্তু এবার থেকে সাবধানে থাকবি কিন্তু, আমার একমাত্র ভাবি তুই, তুই ই যদি পা কেটে বসে থাকিস তাহলে কি করে হবে বল তো
-আচ্ছা আর এমন করব নাহ,এখন তোমরা এমন মনমরা হয়ে বসে থেকো না তো প্লিজ
তুরার কথায় আবারও সবাই নাচ গান শুরু করল। জায়মা আর রুহি মিলে রাইমার দুহাতে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে, আর তনু আরমানের সাথে উড়াধুড়া নাচ দিচ্ছে। জায়মার মেহেদী পরানো হলেই রুহি উঠে তুরার সামনে এসে বসে বলল
-দেখি হাত দাও তো ভাবি তোমার হাতেও মেহেদী পরাব
-না না,আমি মেহেদী দিব না থাক না
-কোনো থাক না,কিসের থাক রুহি ওকে জোর করে দিয়ে দে তো
রাইমার কথায় রুহি আরও উচ্ছ্বাস নিয়ে তুরার হাত ধরে মেহেদী দিতে লাগল। মেহেদী দেওয়া শেষে রুহি উঠে ওদের সাথে নাচতে গেলে তুরা নিজের হাতের দিকে তাকাল,এতক্ষণ খেয়াল করেনি বলে দুষ্টুমি করে রুহি হাতের একদম মাঝখান টাই আহানের নাম লিখে দিয়েছে। একনজরে চেয়ে রইল মেহেদীর টকটকে রঙে লিখা আহানের নামের দিকে। আহান! এই মানুষ টা তো তার স্বামী, যার জন্য বাধবাঙা পাখির মতো ডানা ঝাপটানো অনুভূতিরা ছেয়ে যাচ্ছে।
তুরা ওদের সাথে হাসাহাসি করলেও তার চোখ জোড়া তৃষাতুর পথিকের মতো আশেপাশে ঘুরে খুঁজে চলেছে একটি চেহারা, বারবার অবাধ্য নেত্রযুগল একই আনন দেখবার জন্য আকুল হচ্ছে। তবুও মানুষটার পাষাণ মন যেন এক বিন্দু গলে না, যার পাহাড় সমান গূঢ় ব্যক্তিত্ব একটু বেশিই কঠিন। তুরার পেলব অনুভূতি গুলোকে বারবার মুষড়ে দেয়, বারবার যার ক্রোধের আনলে তুরার মোমের মতো মনের অনুভূতি গুলো উবে গেলেও বেহায়া মনের জিরিজিরি আবেগেরা না চাওয়া বৃষ্টির মতোই বারবার ফিরে আসে,বারিধারায় সিক্ত করে বিয়োগান্তক পরিণতি।
••••
সন্তপর্ণে ধাক্কা দিয়ে দরজা টা খুলল আহান। ঠেলে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকল। ক্লান্ত জীর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ডিমলাইটের আলোতেও স্পষ্ট বিছানাতে ঘুমে বুদ হয়ে থাকা চেহারার পানে। মন্থর গতিতে এগিয়ে গেলো বিছানায় শুয়ে থাকা তুরার দিকে। হাঁটু গেড়ে বসল তুরার সম্মুখ বরাবর। নিষ্পলক অবলোকন করল তুরাকে খানিকটা সময়। এক হাত বাড়িয়ে চোখে মুখে উপচে পরে থাকা চুল গুলো যত্ন সহকারে সরিয়ে দিল। হালকা নীল রঙের আলোতে মেদুর গাল আর ঘন নেত্রপল্লবের কম্পন স্পষ্ট।
বেশ দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল তুরার আননে। কেন এমন লাগে, সে তো বিয়েটা মানে না তবুও কেনো মেয়েটাকে কারো পাশে একদম সহ্য হয়না,কেনো ওর দিকে কেও তাকালেও মাথায় খুন চড়ে যায়,কেনো? সে তো তাকে বউ ও মানে না। স্বামী স্ত্রীর পারস্পারিক প্রাকৃতিক সম্পর্কও তো নেই তাদের,তবুও কেনো এই শক্ত মলাটে আবৃত মনটাতে প্রলয়ের ঝড় তোলে এই ছোট্ট চেহারা টা,, কেনো ইদানীং এই নির্দিষ্ট মানুষ টাকে ঘিরে তার যান্ত্রিক অনুভূতি গুলো নিমজ্জিত হয় ভাবনার নিরালোকে! তার টগবগে মেজাজ অনুভূতিকে শৈথিল্য করতে যেনো এই এক ফালি চেহারায় যথেষ্ট। কেনো লাগে এমন কেনো? ইদানীং তুরাকে ঘিরে আবিভূত হওয়া পুঞ্জীভূত হওয়া অনুভূতির মেঘ গুলো যেনো আহানের রক্তিমা আকাশের হরিদ্রাভ সূর্যকে ডুবি ডুবি করিয়েছে।
ভাবনার মাঝেই চোখ গেলো মেহেদী রাঙা তুরার হাতের দিকে,যার উপর পৃষ্ঠে বড় বড় অক্ষরে ‘Ahan’ শব্দটি লিখা। আনমনেই মুচকি হাসলো আহান, পরক্ষণেই মনে হলো নামটা তো তারই, কিন্তু তুরার হাতে লিখা নামে তো তার কোনো প্রভাব বা অধিকার নেই! তুরা তো নিজের স্বামীর নাম লিখেছে নিজ হাতে যে স্বামীর উপর তার পূর্ণ হক আছে, অধিকার আছে
আবছা আলোর ঘরটা জুড়ে নিদারুণ নিরবতা, তুরার নিঃশ্বাসের শব্দ আহানের কানে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরছে, দ্বিধাদ্বন্দ্বিত হাত এগিয়ে বাড়াল তুরার দিকে, ছুঁয়ে দিলো রেশমের মতো নরম কপোল আর কম্পমান অধর যুগল, তড়িৎ ইষৎ কেঁপে উঠল আহান,ঘামে লিপ্ত শরীর টাতেও রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেলো শিহরণ। তৈলাক্ত চেহারায় চিকচিকে নাক আর ঘুমের ঘোরে কামড়ে রাখা ঠোঁট দেখে হঠাৎই আহানের মতো নিষিদ্ধ ইচ্ছেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, দপদপ করে উঠল শিরা উপশিরায় প্রবল জোয়ার বয়ে গেলো। দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলল, নিজেকেই নিজের ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করল আহানের, তার প্রখর ব্যক্তিত্বে যেনো কলঙ্ক লেগে যাচ্ছে,মনের বেহায়াপনা বেড়েই চলেছে দিনদিন, স্বচ্ছ চরিত্রের প্রতিচ্ছবি ধূলিসাৎ করে বক্ষপিঞ্জরের অবাধ অনুভূতিরা তাকে ব্যাপক বিড়ম্বনায় ফেলছে ইদানীং।
পায়ের ঠান্ডা শীতল স্পর্শ পেয়ে ঘুম হালকা হয়ে এলো তুরার। স্পর্শ টা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতেই পায়ের গোড়ালির দিকটাতে তরতর করে জ্বলন ধরল। চোখ খুলে উঠে বসল তুরা, পা টান দিতে নিলেই তালুতে রাখা বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শ আরও শক্ত করে চেপে ধরে আহান বলল
-একদম নড়াচড়া করবে না,ওষুধ লাগাতে দাও
ভরাট কণ্ঠস্বরের অতিমাত্রায় শীতলতায় তুরা জমে গেলো। আকস্মিক ঘুম ভাঙায় ঘোরের মধ্যে থাকলেও আবছা আলোতে সামনে বসে থাকা আহানকে দেখে তা তড়িৎ গতিতে সরে তার জাগায় ছেয়ে গেলো একরাশ অস্থিরতা, সাথে একীভূত হলো নাম না জানা অভিমানের পাহাড়, এতক্ষণ কোথায় ছিল লোকটা?যখন ফেলে চলে গেলো তখন চিন্তা হয়নি? এখন কেনো এসেছে, লাগবে না ওষুধ লাগানো। ফট করে পা সরিয়ে নিলো তুরা, আহান বিরক্তি নিয়ে তুরার পানে চেয়ে বলল
-পা সরাচ্ছ কেনো আজব,দেখছ না ব্যান্ডেজ টা লাগাচ্ছি
বলে আবারও পা টেনে নিয়ে ব্যান্ডেজ করতে লাগলে তুরা পা টেনে গুটিয়ে নিলো। আহানের ক্রুর দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে অন্যদিকে ঘুরে রইল।আহান চোখ বাকিয়ে তুরার দিকে তাকাল। ওর কার্যকলাপ শান্ত চোখে খানিক অবলোকন করে কণ্ঠস্বরের খাদ বহাল রেখেই বলল
-কি সমস্যা ব্যান্ডেজ টা করতে দিচ্ছ না কেনো তুমি?
-লাগবে না
অন্যদিকে তাকিয়েই বলল তুরা। আহান জড় করা ভ্রু যুগল প্রসারিত করল, তুরার দিকে একবার চেয়েই পায়ের কাছ থেকে উঠে এগিয়ে এসে একদম কাছ ঘেঁষে বসল।
-কি হয়েছে? এদিকে ঘোরো
-কিছু না
গাল ফুলিয়েই বলল তুরা, তুরার এমন কপট রাগ আর অভিমান দেখে আহান বেশ বিব্রতবোধ করল। তুরা গালে হাত দিয়ে মুখ তার দিকে ঘুরিয়ে বলল
-ওদিকে কেনো ঘুরেছ
-কিছুনা ঘুমাব আমি
বলেই তুরা থপ করে শুয়ে পরল। আহান এবার বেশ ক্রুদ্ধ হলো। মেয়েটা তাকে ইগনোর করল? আবার ব্যান্ডেজ ও করতে দিলো না। তখন তো শুধু শুধু বকেনি, কেনো হাত দিলো ছেলেটা ওর গালে।তা না হলে তো সে এত রাগ করত না,আর নাইবা এতকিছু হত
-তুরা! এদিকে ফেরো
তবুও কোনো রা করল না তুরা, ঠাঁই শুয়ে রইল ওপাশ করে। আহান এবার এক ঝটকায় তুরাকে টেনে নিজের দিকে ফিরাল। দুই হাত তুরার দুপাশে দিয়ে ঝুকে বলল
-এদিক ফিরতে বলিনি? কথা কানে যায়না? ব্যান্ডেজ টা কেনো করতে দিচ্ছ না
একে তো অভিমানে বুক ভার হয়ে আছে,তার উপর আহানের এমন কাঠ কাঠ কথায় তুরার সব বাধ ভেঙে গেলো, ধরে আসা গলায় বলল
-কেনো ঘুরব,কার দিকে ঘুরব। লাগবে না আমার ব্যান্ডেজ,যখন কেটেছিল তখন তো দেখতে আসেননি এখন কি দরকার। লাগবে না কারো দয়া আমার
কথার সাথে দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রুজল বাধ ভেঙে গড়িয়ে পরল, তুরার নিজের উপরই রাগ হলো, কেনো সে কাঁদল,কাঁদতে চাইনি তো এমন পাষাণ মনের মানুষের সামনে সে কিছুতেই আর কাঁদতে চাইনি। কিছুতেই লোকটার সাথে কথা বলবে না,আবারও অন্যদিকে ফিরতে গেলে আহান ওর দু বাহু চেপে ধরে বলল
-আমি দয়া দেখাচ্ছি?
-দয়া না তো কি, আমি কে যে আমার জন্য চিন্তা হবে? বউ তো মানেন না তবুও ঘরে থাকতে দিয়েছেন,এটাই অনেক। আমার কারো দয়া আর লাগবে না আমি একা..
-চুপ! একদম ফালতু বকবে নাহ,বেশি কথা শিখেছ তুমি? কি যা তা বলছ। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, দয়া হোক আর মায়া, অধিকার হোক আর অনাধিকার চর্চা সবটাই আমি করব,শুধু মাত্র এই আহান ই করবে। যদি কোনো ছেলে ভুলেও ছোঁয়ার চেষ্টা করে তো মে’রে ফেলব
-কেনো,আমিতো যা তা,ষ্টুপিড, ফালতু তাহলে যা খুশি করি না কেনো
-শাট আপ, আরেকটা কথা বললে ঠ্যাং খোরা করে দেব। দেখি এদিকে আসো তো
বলে তুরাকে এক হাতে আগলে ধরে উঠে বসালো। এক হাতে তুরার দু চোখের পানি মুছে দিয়ে পা টান করে আধ সম্পূর্ণ করা ব্যান্ডেজ টা ভালো করে লাগিয়ে দিলো। তুরা নাক টেনে ভেজা ভেজা দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকাল। আহান তুরার দিকে তাকালে দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো, তুরাকে আহান এক হাতে নিজের বুকেই চেপে রেখেছে যার দরুন দুজনের মধ্যবর্তী দূরত্ব নিতান্তই কিয়ৎপরিমান। আহানের উষ্ণ শ্বাস আর গায়ের পুরুষালি ঘ্রাণ দুটোই ভীষণ কড়াভাবে ভেদ করছে তুরার নাসারন্ধ্র।
তুরার অপলক চেয়ে থাকার মাঝেই আহান তর্জনী উঠিয়ে মুখে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে শুইয়ে দিলো তুরাকে। এক হাত তুরার পিঠের নিচে দিয়ে আরেক হাত পাশে রেখে ঝুকেই রইল ওর মুখের উপর, বিরতীহীন অপলক চেয়ে আলতো হাতে স্পর্শ করল তুরার গাল। একটু আগেও কেমন বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছিল মেয়েটা। কান্নার দাপটে লাল হয়ে যাওয়া নাক,গাল,কান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল আহান। নজর গিয়ে ঠেকলো তুরার ফুলিয়ে রাখা ওষ্ঠের খুব গভীরে, দৃষ্টি সরাতে অক্ষম হলো আহান।
আবারও, আবারও একই ভাবে অনুভূতি গুলো বাধছাড়া হলো, স্ব স্ব গন্ডিতে আগলে রাখা তীব্র বাসনা গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই ওঠাপড়া চাহিদা গুলো তাকে গ্রাস করে ফেলেছে, কিন্তু তুরার দিকে চোখ যেতেই দেখল ঘুমন্ত তুরার মায়াবী মুখ খানায়।এইটুকু সময়ে মেয়েটা ঘুমিয়েও গেছে? ঘুমন্ত চেহারা দেখে অদ্ভুত নিগূঢ়তম মায়া চেপে ধরল আহানকে,আদুরে ওষ্ঠদ্বয় আর ছোঁয়া হলো নাহ,নিজেকে বহুকষ্টে সংযত করল আহান,রয়েসয়ে তপ্ত নিঃশ্বাসের সাথে নিজের অবাধ্য বাসনাকেও ঝেরে ফেলল
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
Humu_♥
#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৭
ইনসাফ মাহবুব বাড়িতে আজ বিয়ের আমেজ,রাইমা আর ইমানের বিয়ে। মাহবুব বাড়িতে বিয়ের আয়োজনে রমরমা, সকাল থেকে সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। কারো দুদন্ড বসার জো নেই,এসবের মাঝেও তুরা ঠাঁই বিছানায় দু পা ভাজ করে বসে আছে। নিচে যাওয়া তো দূর মাটিতে পা রাখাও নিষেধ। নিষেধাজ্ঞা টা অবশ্যই তার গণ্যমান্য ব’জ্জাত বরটাই দিয়েছে,সবাই কত কত কাজ করছে অথচ তুরা একা ঘরের মধ্যে বসে আছে বিরক্তি আর আলসেমিতে তুরার ঝিম ধরে আসছে। এভাবে বসে থাকতে কার ভাল্লাগে? একটুই তো কেটেছে, এ নিয়ে এমন সাত দফা জারি করার কি আছে! লোকটাকে তো আর সাধে ব’জ্জাত বলে না তুরা।
সকাল বেলা উঠে ব্যথাযুক্ত পা নিয়েই খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে ওয়াসরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরতেই আহানের ঝারি শুনতে হয়েছে, সে নাকি সবকিছুতেই পাকনামি করে। আরে তো সকালে উঠে ফ্রেশ হতে হবে এটাকে পাকনামির কি আছে আজব। তুরা কিছু বলতে নিবে তার আগেই দু ধমকে ওকে বসিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে আহান,আর যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছে বিছানা থেকে যেনো না নামে। এখন বাড়িতে বিয়ে আজ,সবার কাজে দম ফেলার সুযোগ নেই আর সে কি না বসে বসে ঝিমুবে!
আহান বের হওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই রুবি আর মিনু ফুফু এসেছিলো, রুবি অল্প কিছু বললেও মিনু ফুফু আচ্ছা মতো বকেছে তুরাকে, এতো বড় একটা ঘটনা ঘটলো আর সে কি না কাওকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো নাহ। অসাবধানতা বশত আরও বড় কিছুও তো হতে পারতো!
একা একাই বসে বিড়বিড়াচ্ছে তুরা,মনে মনে আহানকে হাজার বার ভৎসনা করছে, সব দোষ লোকটার কে বলেছিলো মা আর ফুফুকে বলতে, এভাবে বসে থাকতে কার ভাল্লাগে। পা টা সামন্য ঘুরিয়ে ক্ষত স্থান টা পরখ করে দেখলো তুরা। একেবারেও ভুল বলেনি আহান। কালকের তুলনায় আজকে ব্যথাটা অনেকটাই বেড়েছে, কাটা স্থান টা গোড়ালি হওয়ায় পাও ফেললে যন্ত্রনায় টনটন করছে।
বসে থেকে থেকে গলা শুকিয়ে এলো তুরার। পাশের টেবিলেই পানির জগটা রাখা। এক হাত বাড়িয়ে নিতে গেলেও খানিকটা দূরে হওয়ায় নাগাল পেলো না। এক পা নামিয়ে হাতে ভর দিয়ে উঠতে নিলেই দরজার সামনে আহানকে আসতে দেখে ধপ করে আগের জাগায় বসে পরলো।
আহান কতগুলো মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকতে তুরার দিকে লক্ষ্য করলে ওকে অপ্রস্তুত ভাবে বসে থাকতে দেখে আড়চোখে তাকালো। আহানকে তাকাতে দেখে তুরা মেকি একটা হাসি দিলো,আহান মিষ্টির প্যাকেট গুলো রাখতে রাখতে বলল
-এভাবে বাঁদরের মতো দাঁত কেলাচ্ছ কেনো?
মুহুর্তেই তুরার মেকি হাসি দেওয়া মুখ খানা চুপসে গেলো, কত্ত বড় ব’জ্জাত হলে এভাবে অপমান করতে পারে ভাবা যায়!
-চোখের সামনে আস্ত উগান্ডা আসলে তো বাঁদরের মতো দাঁত কেলাবই
বিড়বিড়িয়ে বলল তুরা, আহান প্যাকেট গুলো সাজিয়ে রেখে তুরার দিকে ফিরে তাকালো । দু হাত মাজায় রেখে বলল
-এসব বাঁদরামি বাদ দাও। এসে থেকে একটার পর একটা অঘটন ঘটিয়েই যাচ্ছ, তোমার সাথে থাকলে কোনদিন আমাকেই তুমি স্বর্গবাসী করে দিবে।
তুরার আহানের কথার ভ্রু কুচকালেও পরমুহূর্তেই মেকি হেসে ভঙ্গিমা করে বলল
-ওগো,আপনি এমন অশুভ কথা মুখেও আনবেন না গো,আপনি স্বর্গে গেলে আমার কি হবে!
তুরার এমন মাত্রাতিরিক্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলা দেখে আহান মুহুর্তেই নাক কুচকে বলল
-হোয়াট, কি যা তা বলছ তুমি ষ্টুপিড
-সে আমি ইস্টুপিট হই আর সিস্টুপিট হোক আমি তো আপনাকেই স্বামী মানি গো, আপনি স্বর্গবাসী হলে যে এই ধরণীতেই আমাকে আরেকটা স্বামী দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে,সে আমি কি করে মানবো গোওও!!
-শাট আপ, তুমি আসলেই একটা বাঁদর
বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো। আহানের যাওয়ার পানে তুরা হা করে চেয়ে থেকেই ও দৃষ্টির সীমানার বাইরে যেতেই পেট ধরে হাহা করে হেসে উঠলো তুরা,,পেটে খিল ধরার মতো হাসি পেয়েছিলো তুরার আহানের বিব্রতকর চেহারা টা দেখে।
-আর যাই হোক মাস্টার মশাইকে খেপানো কিন্তু তুরি বাজানোর চেয়েও সোজা
একা একাই বলে আবারও হাহা করে হেসে দিল তুরা।
-কি ব্যাপার, এভাবে একাই একাই হাসছে যে আমার ভাবিটা,,কিসে এতো হাসি পেলো আমাকেও বলো,আমিও হাসি
মেয়েলি কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই হাসা থামিয়ে ফিরে তাকালো তুরা,রাইমা দরজা থেকে এগিয়ে এসে তুরার পাশে বসে আবারও বলল
-কি নিয়ে এতো হাসছিস রে তুরা, আহানকে দেখলাম মুখটা বাংলার পঁচিশ বানিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো
-সে তুমি মাস্টার মশাইকেই জিজ্ঞাসা করোনা আপু
বলেই আবারও খিলখিল করে উঠলো তুরা, হাসি যেনো থামছেই নাহ
-মাস্টার মশাই! এটা তুই আহানকে বলিস নি তো?
-কেনো বললে কি হবে গো ননদিনী
তুরা বেশ রসিকতা করে টুসকি মেরে বলল রাইমাকে।
-এই না না,তাইলে কিন্ত আহান ফায়ার হয়ে যাবে। এই মাস্টার মশাই ডাকটা ও একেবারেই পছন্দ করে না বললেই ক্ষেপে যাবে।
-তাহলে কিন্ত তোমার ভাইকে এটাই বলবো আমি
-তুরা, তুই কিন্তু দিনদিন ভারি দুষ্টু হচ্ছিস
রাইমার কথার পৃষ্ঠে তুরা কিছু বলবে তার আগেই তনু আর রুহি হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো ঘরের ভেতর,এসেই রুহি রাইমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল
-এই তোমাকে আমি কত জাগায় খুঁজে বেরাচ্ছি,আর তুমি এখানে বসে ভাবির সাথে গল্প জুড়েছ
-তাই ই তো। কয়টা বাজে দেখোতো, গোসল কখন করবে তুমি,পার্লার থেকে লোক এলো বলে
তনু রাইমার হাত ধরে বলল। রাইমা উঠার বদলে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো
-উফ,এই বিয়ে করা এতো ঝামেলা কেনো বল তো। এতো কাহিনি ভাল্লাগছে না তো
রুহি রাইমার পাশে কাত হয়ে আধশোয়া হয়ে বলল
-তাইলে তোমার হয়ে বিয়েটা আমিই করে ফেলি কি বলো আপু? এমনেও বাড়ি থেকে বিয়ে টিয়ে দিচ্ছে না তার উপর তোমার বর কে কিন্তু আমার হেব্বি পছন্দ হয়েছে
-তাই না খুব শখ তোর বিয়ে করার।
বলেই কান টেনে ধরলো রাইমা। রুহি এক হাতে কান ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
-তুমিই তো বললে বিয়ে করা ঝামেলা তাই তো..
-তোদের দুটোকে পাঠালাম রাইকে ডেকে আনতে আর তোরা কিনা বসে গল্প জুড়েছিস।
মাঝবয়েসী হাস্যজ্বল চেহারায় দাঁড়িয়ে দরজার সামনে৷ নারী কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই উঠে বসলো রাইমা আর রুহি,তনু সরে দাঁড়াতেই ঘরে প্রবেশ করলো আহানের ফুফু ইলা বেগম।
-ও মা আমিতো আপুকেই ডাকতে এসেছি, ওই তো বলছে এসব বিয়ের ঝামেলা নাকি ওর ভাল্লাগছে নাহ,বলি আমাকেই বিয়ে দিয়ে দাও না ইমান ভাইয়ের সাথে আপুর বদলে
-চুপ কর,,এই তোরা সবগুলো খুব বদমাশ হয়েছিস। যা শিগগির রাইকে নিয়ে যা বেলা হয়ে যাচ্ছে তো।
ইলার কথা মতো রুহি আর তনু রাইমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ইলা বেগম আবারও বলল
-শোন, প্রেমা এসেছে ওর বাবার সাথে
প্রেমা নামটা শুনে,তনু আর রুহির মুখ জুড়ে কালো আধার নেমে আসলো। রাইমাও বেশ বিরক্ত বোধ করলো বোধ হয় নামটা শুনেই।
-হোয়াট! ওই ন্যাকা টা আবার কেনো এসেছে
-এসব কেমন কথা, ও আসবে না কেনো। ওউ তো তোদের বোন ই হয়
-প্লিজ মা, ওই ন্যাকা টার কথা বাদ ই দাও।এবার না জানি কি নাটক শুরু করে
বলেই তুরার দিকে এক পলক তাকালো তনু, তারপর আবারও ওরা বেড়িয়ে গেলো। ওরা বেরতেই ইলা বেগম তুরার পানে চেয়ে চমৎকার হাসি দিলো। ইলা বেগম ও তার ভাই ইনসাফের মতোই নরম স্বভাবের। তুরার পাশে এসে বসে মমতাময়ী স্পর্শে মাথায় হাত রেখে বলল
-পায়ের ব্যথা কমেছে মা?
-জ্বি ফুফু আম্মা কমেছে
-ইশ কি মিষ্টি তুমি। এত সুন্দর করে তো রাই আর আহান ও ডাকে না আমায়।
প্রশংসার প্রত্যুত্তরে গাল এলিয়ে হাসলো তুরা, পরক্ষণেই কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো
-প্রেমা কে ফুফু আম্মা? ওরা এমন বিরক্ত কেনো হচ্ছিল নাম শুনে?
-প্রেমা আহানের বাবার দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের মেয়ে, সিলেটের বাড়িতে আমাদের পাশেই ওদের বাড়ি তাই তোমার শ্বশুরের সাথে প্রেমার বাবা রায়হানের বেশ ভালো সম্পর্ক।
ঠোঁট গোল করে ওহ বলে উত্তর দিলো তুরা। পরক্ষণেই ইলার হাত ধরে বলল
-ফুফু আম্মা, আমাকে একটু নিচে নিয়ে চলুন নাহ। এভাবে বসে থাকতে একদম ভালো লাগছে না, পায়ে তো অল্প ব্যাথা,একটু ধরলেই হবে। কিছুই হবে না আমার
তুরার এমন বাচ্চামো আবদার ইলা ফেলতে পারলো নাহ। এক হাতে তুরাকে ধরে ঘরের বাইরে আনলো। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গেলে সামনে চোখ যেতেই থমকে গেলো তুরা, মুখ জুড়ে কালো আধার নামলো সামনের দৃশ্য দেখে। ড্রয়িং রুমে আহান দাঁড়িয়ে আর তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে একটা মেয়ে, আহান তাকে না ধরলেও মেয়েটা একেবারে চিপকে আছে ওর সাথে। থমথমে মুখ করে তুরা সিড়ি বেয়ে নেমে এলো। মেয়েটাকে আহান নিজে থেকে ছাড়িয়ে নিলেও আহানের গালে হাত রেখে বলল
-আহান! হোয়াটস আপ? আই মিসড ইউ। কেমন আছো,কত দিন পর দেখা হলো বলো তো!
আহানে বেশ বিব্রতবোধ করলো। এভাবে লোকজনের ভেতরে জড়িয়ে ধরাটাকে কেও ভালো চোখে দেখবে নাহ। তুরা রীতিমতো ফুঁসছে। মেয়েটার এসব লীলাকান্ড দেখে গা জ্বলছে,কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো এই পেত্নী। তুরার ভাবনার মাঝেই জায়মা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে খোঁচা দিয়ে বলল
-এইটা হলো প্রেমা, রায়হান আংকেলের মেয়ে,এই প্রেমার আবার আহান ভাইকে দেখলে একটু বেশিই প্রেম উতলে পরে, এইটার থেকে দূরে থাকবা আর তোমার বরকেও দূরর রাখবা
বলেই আবারও সরে গেলো। তুরা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলো কেনো তখন ওরা মুখ কালো করছিলো। আহান প্রেমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলল
-তুই কখন এসেছিস
-আজই,রাইমার বিয়ের জন্য পাপা আসলো। কিন্তু আমিতো তোর জন্যে এসেছি
প্রেমার কথায় আহানের অস্বস্তি বেড়ে গেলো, কাজের অযুহাত দেখে বেরিয়ে যেতেই প্রেমা নামের মেয়েটা জায়মা রুহি আর তনুর দিকে এগিয়ে বলল
-হেই,কেমন আছো তোমরা? আমিতো লন্ডন থেকে ব্যাক করেই চলে এসেছি তোমাদের সাথে মিট করবো বলে।
-এই যে বললে আহান ভাইয়ের জন্য এসেছ
রুহির কথায় প্রেমা মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে হেসে বলল
-ওর জন্য তো এসেছিই, তোমাদের জন্যেও এসেছি
এবার জায়মা কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্রেমার ফোন বেজে উঠলে ও ‘এক্সকিউস মি’ বলেই বেরিয়ে গেলো। তনু আর রুহি দুটো মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো নিজ কাজে। তুরা এখনো মুখটা থমথমে করে দাঁড়িয়ে আছে, মেজাজ টা যেনো তুঙ্গে চড়ে গেলো মেয়েটা তো আচ্ছা শাকচুন্নী!
•••
অপরাহ্নের মাঝ সময়, পুরো বাড়িতে ‘বর এসেছে বলে উল্লাসী আওয়াজে ঝংকার তুললো। তুরা জায়মা তনু ইলা রুহি সবাই রাইমার ঘরে, ওকে ঘিরে আছে। রাইমার পরনে মোটা পারের টকটকে লাল বেনারসি। গা ভর্তি সোনার গহনায় জড়ানো। আরমান, বিহান, আহান সবাই নিচে খাওয়ার দিক টাই তদারকি করতে ব্যস্ত। বিয়ের বাড়ির গমগমে ভিড়ে আর কাজের চাপে এমুখো হবার সু্যোগ হয়নি তাদের।
তুরার পরনে খয়েরী রঙের একটা লেগেঙ্গা। জরজেটের কাপড়ে চিকচিকে মুক্তার মতো পুথির কাজ করা,লেগেঙ্গার উপরের অংশে এমব্রয়ডারির নিখুঁত কাজের সাথে গায়ের হালকা পাতলা গয়নায় তুরার সুনিপুণ চেহারার চমক আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। টকটকে রঙে ঠোঁটের উপর প্রলেপ দেওয়া, আধখোপা করা চুলে পাথরের ক্লিপ বসানো। পার্লারের লোকেরা রাইমার সাথে তনু জায়মা আর রুহিকেও সাজিয়েছে, আর ওদের জোরাজুরিতে তুরাও বাধ্য হয়ে সেজেছে,তার নিজেরও মন্দ লাগছে নাহ!
নির্বিঘ্নে শেষ হলো রাইমা আর ইমানের বিয়ে, বিদায়ের সময়ে সবাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে রাইমা। ইমান থামাতে গেলেও ফারিন থামিয়ে দেয়। সে নিজেও তো মেয়ে, তাই এ মুহুর্তে একটা মেয়ে কতটা আবেগ বশিভূত থাকে সেটা তার ও ঢের জানা। বিদায় বেলায় মা,বাবা তুরা সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আহানের সামনে যেতেই কান্নার বেগ আরও বেড়ে যায় রাইমার। একমাত্র ভাই তার বড় আদরের। ছোট থেকে একসাথেই মানুষ, আহানের পড়াশোনার প্রক্ষাপট ছাড়া কখনও আলাদা থাকতে হয়নি দুজনের। বোনের বিদায়ে আহান নিজেও শত কষ্ট পেলেও তা প্রকাশ করে নাহ। নিজে হাত ধরে গাড়িতে উঠিয়ে দেয় রাইমাকে। শুধু ইমানের হাত ধরে বলেছিলো
-আমার বোনটা আজ থেকে আপনার জিম্মায়, ওকে দেখে রাখবেন,আর কোনো দিনও যেনো ওকে কাঁদতে না হয়
প্রেক্ষিতে ইমানও প্রাপ্তির হাসি হেসে আহানের হাত আরও শক্ত করে ধরে বলেছে
-তোমার বোন কে বউ করে নিয়ে যাচ্ছি। আমার সাধ্যমতো রাণী করে রাখবো ইনশাআল্লাহ।
~
সকলের দোয়া আর ভালোবাসা নিয়ে বিদায় হলো রাইমা আর ইমান,সাথে আসা মেহমান। বিয়ে বাড়ির সকল ঝামেলা মেহমান, আপ্যায়ন চুকিয়ে আহানের ঘরে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো। ইনসাফ, ইউসুফ তার মা ফুফু চাচী সকলেই আগেই এসেছে। অনুষ্ঠানে ভরা রমরমা পরিবেশ এখন অনেকটা ঠান্ডা।
বাড়িতে এখন লোকজন বলতে তারা নিজেরা, আর প্রেমা। প্রেমার বাবা রাইহান চলে গেলেও প্রেমা এখানে কয়েকদিন থাকবে বলে রয়ে গেছে, প্রেমা আর আহান প্রায় সমবয়সী। একই কলেজ থেকে পড়লেও গ্র্যাজুয়েশনের জন্য ভিন্ন দেশে ছিলো দুজনেই। প্রেমার বাবার ব্যাবসায়ীক কারণে বিদেশেই বেশি থাকা হয়,সেজন্য ওর মধ্যে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব বেশি। জড়িয়ে ধরা,হ্যান্ডসেক,গায়ে পরা এসব ওদের কাছে বেশ স্বাভাবিক হলেও এখানকার সবাই আড়চোখে দেখবে এটাই স্বাভাবিক।
ড্রয়িং রুম আপাতত ফাঁকা। কাজ সেড়ে বড়ড়া ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে,আর আরমান, বিহান সহ মেয়েরা সবাই ছাদে বসেছে আড্ডার আসরে। আহান ঘর্মাক্ত শরীরে সোজা ঘরে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়েই বেরোলো। এ্যাডিডাস এর একটা নেভি ব্লু টি-শার্ট আর ধুসর বর্ণের ট্রাউজার পরে ছাদের দিকে হাঁটা দিলো।
রূপালি পূর্ণ থালার আকৃতির চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে আশপাশ। দক্ষিণা বাতাস আর চাঁদের নরম আলোতে মাদুর পেতে বসেছে সবাই ছাদে, সবার পরনে এখনো আগের পোশাক। বিয়ের পর্ব চুকিয়ে সন্ধ্যার পরেই সবাই বসেছে আড্ডার আসরে। তুরা সবার সাথে হাসাহাসি করলেও আহানের আগমনে চুপ করে গেলো। আহান এসে বসতেই কোত্থেকে প্রেমা এসে ওর গা ঘেঁষে বসে পরল। তুরা চোখ মুখ কুচকে নিতেই রুহি পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল
-দেখলে তো ভাবি তখন ডাকলাম বলল আমার এসব বোরিং গসিপিং ভাল্লাগে না।আর ভাই আসতেই কেমন চিপকে গেলো।
তুরা নিজেও বেশ বিরক্ত মেয়েটার উপর। ওর পোশাক দেখেই তো গা জ্বলে যাচ্ছে তুরার। এক তো পাতলা মশারীর মতো শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে তার উপর ব্লাউজ টার হাতাও একদম চিকন ফিতার,বলি ওটুকু আর ঢাকার দরকার কি ছিলো। তবুও চুপচাপ গাল ফুলিয়ে বসে রইলো তুরা। আড্ডার সাথে কোল্ড ড্রিংকস আর স্ন্যাকস ও এনেছে সকলে। প্লেট থেকে একটা ফ্রাই তুলে মুখে দিতেই প্রেমার কাশি শুরু হয়ে গেলো,
-দিস ইস টু মাচ স্পাইসি! ওয়াটার,ওয়াটার প্লিজ!
বলেই বসে থেকেই লাফানো শুরু করলো প্রেমা। আহান সামনে থেকে পানির গ্লাস তুলে ওর সামনে ধরতেই প্রেমা আহানের হাত সহ গ্লাসটা চেপে ধরে ঢকঢক করে গিলে ফেলল।
-থ্যাংকিউ সো মাচ আহান
প্রেমার ঢং দেখে তুরার মনে হলো বোতলের সব সস গুলো মুখে ঢেলে দিয়ে বলতে সো মাচ স্পাইসি। কিন্তু তা তো করা সম্ভব না,রাগে অসহ্য হয়ে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো তুরা
-কি হলো ভাবি?
জায়মার কথায় তুরা মুখ ভার করে বলল
-আমার খুব ক্লান্ত লাগছে,ঘুমাতে চাই
-আচ্ছা ঠিকাছে, তোমার পায়ের ব্যাথা টাও তো পুরোপুরি সারেনি। চলো
বলেই বাকিরাও উঠে দাঁড়ালো। মেজাজ দেখিয়ে জোরে সোরে তুরা এক পা ফেলতেই গোড়ালিতে লেগে ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করলেই আহান এসে ওকে ধরে বলল
-আমি সাহায্য করছি
তুরা এক ঝটকাই আহানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
-ইটস ওকে থ্যাংকিউ
টেনে টেনে কথাটা বলেই রুহির দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি কি আমায় একটু ধরে ঘর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে?
রুহিও তুরার কথামতো ওকে ধরে এনে ঘরে দিয়ে গেলো। একে তো মেজাজ তুঙ্গে চড়ে আছে তার উপর এই ভাড়ি লেহেঙ্গা পরে গরমে যা তা অবস্থা। এটা এক্ষুনি পালটানো দরকার। ব্যাগ থেকে একটা পাতলা জামা বের করে নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আহান ঘরে ঢুকতেই দরজা লাগানোর ধড়াম শব্দে চমকে উঠলো। এই মেয়ের কি হলো!
মিনিট দশেক বাদে তুরা বেরিয়ে এলো ওয়াসরুম থেকে। আহান ফোন নিয়ে বসেছিলো। দরজা খোলার শব্দে তাকাতেই তুরার এলোমেলো অবস্থা দেখে অবাক হলো। এক হাতে মুঠো করা গায়ের গয়না গুলো থপ করে রাখলো ড্রেসিং টেবিলের উপরে। খোপা করা চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খুলে আছে। লেহেঙ্গার ওড়না টা কোনো রকম পেচিয়ে রেখেছে, চোখে মুখে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে আয়নার সামনে উল্টো করে দাঁড়িয়ে ঘাড় আয়নার দিকে ঘুরিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে
-কি করছ তুমি এসব?
-মুজরা করছি,করবেন?
তুরার নিকট এ ধরনের উত্তর নেহাত অপ্রত্যাশিত ছিলো আহানের, হঠাৎ এমন রণচণ্ডী হওয়ার কারণ টা কিছুতেই বোধগম্য না হলেও তুরা যে ব্লাউজের হুকটা খুলার চেষ্টায় করছে অনেক্ষণ ধরে এইটা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলো আহান। উঠে গিয়ে তুরার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল
-দেখি পেছনে ঘুরো
তুরা থতমত খেয়ে আহানের দিকে তাকালো, নিজের অবস্থা টা পরখ করেই এবার হুস ফিরলো, এতক্ষণ তো রাগের বসে ধুপধাপ করে বেরিয়ে আসলোও,কিন্তু জলজ্যান্ত মানুষটা যে বসে আছে,সে খেয়াল তার হয়নি। কিন্তু সে কেনো পিছু ফিরবে,কি করবে লোকটা?
-কি বললাম শুনতে পাওনি, পিছে ঘোরো?
বলেই তুরার অপেক্ষা না করে ওর দুবাহু ধরে পেছনে ঘুরিয়ে দিলো। তুরা এখনো ব্লাউজের পেছনে হাত দিয়ে রেখেছে, আহান তুরার হাতটা ধরে নামিয়ে দিলো। ব্লাউজের ফিতায় এক টান দিতেই খুলে গেলো ফিতা, সাথে সাথে ফর্সা পিঠ উন্মুক্ত হয়ে গেলো
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
Humu_♥