তুমি আমি দুজনে পর্ব-৫১+৫২

0
622

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৫১

তুরা ঢুলু ঢুলু পায়ে ঘরে ঢুকলেই আহান পেছন থেকে ধপ করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। হকচকিয়ে তাকালো তুরা, আহান চোখ দু’টো ছোট করে নিচের ঠোঁট টা কামড়ে রেখে ভীষণ কড়া চাহনিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তুরা বিব্রত হলো খানিক, বেটা রেগে আছে? কিন্তু কেনো? ও তো আজ একটাও অকাজ করেনি!
আহানকে এগিয়ে এসে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তুরা ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।
মিনিট পাঁচেক বাদে ফ্রেশ হয়ে বেরলে দেখল আহান খাটে আধশোয়া হয়ে সেই বইটা নাড়াচাড়া করছে। তুরা চুল বেঁধে খাটের উপর উঠে বসলো,আহান তাকাচ্ছেও না ওর দিকে। নিজের মতো বই খুলে পায়ের উপর পা তুলে নাচাচ্ছে।
তুরার মনোক্ষুণ্ণ হলো খানিক, একটা বার ও তাকাচ্ছে না তা বলে? রাইমার সামনেও কেমন ধমকা ধমকি করলো। পরক্ষণেই ভাবলো তাতে কি ভালই তো হয়েছে, তুরা তো নিজেই পালিয়ে বেরাচ্ছিল আহানের থেকে।
কিন্তু তাও এবার তুরার একেবারেই ভাল্লাগছে না। আহান কেনো তাকাচ্ছেনা ওর দিকে? কেনো কথা বলছে না,কেনো জড়িয়ে ধরছে না!
মন খারাপ হলেও প্রকাশ করলো না,ওপাশ করে শুয়ে পরলো চুপচাপ, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এলো না,একবার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কিছুতেও আর ঘুম আসতে চাইছে নাহ।
শুয়ে থেকে খানিক ছটফট করে উঠে বসলো তুরা, আড়চোখে তাকালো এখনো বই নিয়ে স্থির বসে থাকা আহানের পানে।
রাগ অভিমানে মিশ্রিত বুদ অনুভূতি হলো। কথা বলার প্রবল ইচ্ছে হলেও এক প্রকার জড়তা কাজ করছে। বারবার সন্ধ্যায় ওই মহিলার বলা কথা গুলো মনে পরছে,তবে সত্যিই কি বাচ্চা না দিলে আহানও তাকে ভালোবাসবে না? এখনই তো কেমন গোমড়ামুখে বসে আছে। আর কিছুদিন গেলে তো তাকাবেও নাহ! অহেতুক চিন্তায় মাথা জড়ো হলো তুরার,আড়চোখে তাকাচ্ছে বারবার আহানের দিকে

-এভাবে চোরের মতো তাকাচ্ছ কেনো

বইয়ে চোখ রেখেই বলল আহান,তুরা চমকালো কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ না করে ধিমি স্বরে বলল

-ঘুমাচ্ছেন না কেনো?

-তাতে তোমার কি, তুমি চুপচাপ ঘুমাও

কাঠ কাঠ গলায় বলল আহান,তুরার মন আচমকা খারাপ হয়ে গেলো আহানের এরূপ বাচনভঙ্গি দেখে। ঠোঁট গুঁজে রইলো। আবারও একইভাবে বলল

-কি হয়েছে আপনার,এমন কেনো করছেন?

আহান তবুও তাকালো নাহ,বইয়ে মুখ গুঁজে রেখে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বলল

-আমার কি হয়েছে তাতে কি কারো যায় আসে, আপুর সাথে থাকো গিয়ে

তুরা ছলছল নয়নে তাকালো। আহান এভাবে কেনো কথা বলছে,একটু না হয় থেকেছিলো রাইমার সাথে। তীব্র মন খারাপ ঠেলে তবুও ধরা গলায় বলল

-আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন,আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন আপনি?

বলেই ঠোঁট ভেঙে বসে রইল। আহান বইটা ভাঁজ করে তাকালো তুরার দিকে,বেচারি মুখ ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আসে,চোখ দুটো পানিতে টইটম্বুর যেনো একটি টোকা দিলেই গড়িয়ে পরার অপেক্ষায়। আহান ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, এই মেয়ে পাগলী!
হাত বাড়িয়ে তুরার কোমর চেপে এক টান দিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরলো, বৃদ্ধাঙ্গুলি ওর থুতনিতে রেখে আলতো ঘষে দিয়ে বলল

-এত বোকা কেনো তুমি? কিছু বোঝো না?

তুরা প্রত্যুত্তর করলো না,নিঃশব্দে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আহান থুতনিতে চাপ গাঢ় করে বলল

-আরেকদিন যদি দেখেছি আমাকে ছেড়ে অন্য ঘরে শুয়েছ তাহলে আজ তো শুধু চিমটি দিয়েছি এবার ঠ্যাং খোরা করে দেব

তুরার চোয়াল আলগা হয়ে গেলো, চমকিত দৃষ্টিতে ছিটকে সরে গেলো। কড়া চোখে তাকিয়ে আহানের দিকে আঙ্গুল উচিয়ে চিকন কণ্ঠে মৃদু চেঁচিয়ে বলল

-এই আপনি! আপনি আমাকে চিমটি দিয়েছিলেন তাই তো? কত্ত বড় খারাপ হইলে মানুষ এ ধরনের কাজ করতে হবে ভাবা যায়!
আমাকে চিমটি দিয়ে আবার আপুর সামনে আমাকেই আবল তাবল বললেন। খুব তো? আপনি আসলেই একজন ব’জ্জাত মানুষ

একদমে হড়বড়িয়ে বলল তুরা, আহান জবাব দিলো না,স্থির বসে রইলো বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে। স্থবির চাহনিতে তাকিয়ে শুধু তুরার কথা গুলোই শুনছে। প্রত্যুত্তর না পেলেও তুরা আবার বলল

-কি হলো এখন চুপ করে আছেন কেনো। আপনার মতো জাঁদরেল আমি দুটি দেখিনি,আপনি সবসময় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, ঘুমটা তো ভেঙে দিয়েছেন ই আবার পেটটাও ফুটো করে দিয়েছেন ইস এখনো ব্যথা করছে আমার

বলেই ব্যথাতুর মুখশ্রীতে তাকিয়ে পেটে হাত বুলালো।আহান চাপা হাসি দিলো,তবুও জবাব করলো নাহ। স্তিমিত হয়ে খানিক অবলোকন করলো তুরার অস্থিরচিত্ত। জোরে সোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল

-ঝগড়া করো নাহ। কাছে আসো, জড়িয়ে ধরো দুটো চুমু দাও তো!

হুট করেই একরাশ অস্থিরতা জেঁকে ধরলো তুরাকে, লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। নড়াচড়া করলো না একচুল ঠাঁই বসে রইলো। স্থিততার সঙ্গে কথার খেই ও হারিয়ে ফেলেছে। আহান তুরার বাহু ধরে টেনে আনলো,সচকিত নয়নে তাকালো তুরা। আহান তুরার মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করে কপালের চুল কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল

-আমার বলা দুটো শব্দেই তো মিইয়ে যাও,আবার ঝগড়া করতে আসার সাহস কিভাবে হয়

তুরা আর তাকিয়ে থাকতে পারলো নাহ,শ্বাস প্রশ্বাসের নিনাদে অতিষ্ঠ বোধ করলো, সরে আসতে গেলে আহান এক হাত কোমরে আরেক হাত ঘাড়ের পেছনে রেখে পেচিয়ে ধরলো।

-আমার বউ,আমি চিমটি দেব,কামড় দেব, আদর দেব যা খুশি করবো তোমার কি হুহ!

কথার সাথে খুব তীব্র ভাবে তুরা অনুভব করলো আহানের গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের নিনাদ,উত্তপ্ত গরম শ্বাসে বুক ভারি হলো তারও,ঘন হয়ে আসলো প্রশ্বাস। আহান মুখ এগিয়ে আনলো, তুরার গালের সাথে গাল ঘষা দিয়ে মোহাগ্রস্থ গলায় বলল

-সারাদিন পালিয়ে বেড়াও,এখন একটা চুমু দাও তো,বড় করে

তুরার দম বন্ধ হয়ে এলো, এলোথেলো অনুভূতিতে ঝিলিক দিয়ে উঠছে সমস্ত কায়া! খামচে ধরলো আহানের পরনের শার্ট। ঘাড় মৃদু কাত করে তুরার গালে অধর ছোঁয়ালো আহান। কয়েকপল স্থির হলো নরম গালে আহানের পুরু স্পর্শের স্থায়িত্ব।
ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে শুইয়ে দিলো তুরাকে। ওর ভরে আসা চোখে অনিমেষ চেয়ে বলল

-দাও না রে একটা চুমু

মুদে আসলো চোখ,খিঁচিয়ে ধরলো নয়ন। আহানের শব্দ বাক্য নেশার মতই লাগছে৷ ঘাড় উচালো সামান্য কম্পিত অধরযুগল এগিয়ে উষ্ণ ঠোঁটের কাঁপা স্পর্শে ছুঁয়ে দিলো আহানের থুতনি, তুরার এহেন হৃদয়স্পর্শী ছোট্ট চুম্বনে বেসামাল হলো আহান,,
এক ঝটকায় অবস্থান ঘুরিয়ে তুরার ছোট শরীর টা রাখলো নিজ বুকের উপর, তুরা সরে আসতে গেলে ঘাড়ের পেছনে হাত সন্তপর্ণে রেখে টেনে নিলো নিকটে, পুরু ঠোঁটের মাঝে আবদ্ধ করলো তুরার পাতলা কম্পিত অধর যুগল, হৃদবক্ষে টাইফুন তুললো তুরার, আহানের উথাল-পাতাল চুম্বনে শ্রান্ত হয়ে গেলো নরম দেহ।
নরম আবেশে ছুঁয়ে দিতে লাগলো তার ওষ্ঠদ্বয়। হাতের স্পর্শ পিঠ থেকে নামতে নামতে কোমর পর্যন্ত গেলো, নরম দেহে আরও চাপ দিয়ে মিশিয়ে নিলো নিজের ভেতর, অবাধ্য স্পর্শের বিচরণ ছড়িয়ে গেলো সারা শরীরে।
বদনে ঝিলিক দিয়ে উঠলো তুরার সমগ্র দুনিয়াটা। মিশে যেতে লাগলো,হারিয়ে যেতে লাগলো স্বামী নামক মানুষটির সর্বত্র ভালোবাসায়,অন্য এক দুনিয়ায়

••••

হালকা কমলা বর্ণের আকাশে তুলার ন্যায় মেঘের বিচরণ, সূর্যের অস্তিত্ব সারা ধরণীতে ছড়িয়ে দিতে মত্ত। প্রস্ফুটিত ফুলের মতো স্নিগ্ধ সকাল। একজোড়া চড়ুই দাঁড়ানো গাছটার ডালে বসে ঝিমুচ্ছে। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দোতালা বাড়িটার সামনে দাঁড়ালো। সিড়ি বেয়ে উঠে দরজায় বেল চাপতেই মিনিট খানেকের মধ্যে খুলে গেলো।

-আরে সাদমান আজ সকাল বেলায় চলে এলে যে?

-জি আন্টি,আসলে পরীক্ষা শেষ তো তাই ভাবলাম এই কয়দিন ঝুমঝুমকে সকালে পড়িয়ে যাই, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে

রিমঝিম কে ঝুমঝুম বলায় বিব্রত হলো নাহ রিমঝিমের মা অনিতা, এই কয়দিনে এটুকু ভালই বুঝতে পেরেছে যে সাদমানের রিমঝিম নামটা মনে রাখা হয়তো বেশিই কষ্টসাধ্য, বারবারই ঝুমঝুম বলে ফেলে।

-আরে না না,কোনো আপত্তি নেই। বরং আরও ভালো, পরে পরে ঘুমাই বেলা ভরে তুমি রোজ এসো এই সময়ে বাবা

বলেই দরজা থেকে সরে সাদমানকে জায়গা করে দিলো। সাদমান ঢুকতে ঢুকতে অনিতা আবারও বলল

-তুমি বসো,আমি এক্ষুনি ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি

সাদমান ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে পড়ার ঘরে টেবিলে গিয়ে বসলো। কৌতুহলী দৃষ্টি কিছু একটার খোঁজে নজর বুলালো সারা বাড়িতে,তবুও ক্ষান্ত হলো না যেনো।
চুপচাপ টেবিলে বসে রিমঝিমের নোটবুক দেখতে লাগলো

-সাদমান ওয়াহিদ, রাইট?

ভরাট বয়স্ক পুরুষালি ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে চমকিত নয়নে ঘুরে তাকালো, উপস্থিত ব্যক্তিকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো,

-বসুন বসুন স্যার। দাঁড়াতে হবে নাহ

বলেই এগিয়ে আসলো হালকা কমলা রঙের ফতুয়া আর সাদা প্যান্ট পরিহিত হাট্টাকাট্টা গড়নের লোকটি। ইনি ফারিহার বাবা,বেশ কয়েকবার দেখলেও সামনা-সামনি কথা হয়নি সাদমানের। ফিরোজ ইসলাম এগিয়ে এসে সামনের চেয়ার টাতে বসতে বসতে বলল

-আপনার আপত্তি না থাকলে কিছুক্ষণ গল্প করি আপনার সাথে? আপনার স্টুডেন্ট আসলেই চলে যাব,সিউর

সাদমান অপ্রতিভ হলো,তবুও সৌজন্য হেসে,ঘাড় নাড়িয়ে বলল

-না না আপত্তি নেই বসুন নাহ। আর আমাকে তুমি করেই বলবেন,আপনি আমার গুরুজন

ভদ্রলোক মাথা নাচিয়ে হাসলো। বেশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিমা লোকটির কথাবার্তায়, সকলের সাথে খুব কম কথা বলেই সাদমান জানে,আজ হঠাৎ তার সাথে কথা বলার কারণটা ঠিক বোধগম্য গলো নাহ।

-তো, মিস্টার সাদমান ওয়াহিদ। বাড়িতে কে কে আছে?

-মা আর সাত বছর বয়সী ছোট বোন

-বাহ বেশ বেশ৷ তোমার মা কে আমার সালাম জানাতে ভুলো না কিন্তু

সাদমান হাসলো শুধু, আবারও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। এক মাঝে অনিতা বেগম এসে দুজনকে চা দিয়ে গেলো।
ফিরোজ ইসলাম একের পর এক নানান প্রশ্ন করছে সাদমানকে আর সাদমান উত্তর দিচ্ছে, ভেতর ভেতর জড়তা কাজ করলেও তা অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট নাহ। বেশ মিনিট দশেক কথা বলার পর রিমঝিম এলো ঢুলতে ঢুলতে,দেখেই বোঝা যাচ্ছে জোর করেই তার ঘুম ভাঙানো হয়েছে, রিমঝিম এলেই ফিরোজ ইসলাম উঠে দাঁড়ালেন

-আচ্ছা আমি তাহলে আসি,তোমার অনেকটা সময় নিয়ে ফেললাম

সাদমান হেসে ভদ্রতা মূলক কথা বলে রিমঝিমকে পড়ানো শুরু করলো। পড়ানোর মাঝে হঠাৎ করে জিজ্ঞাসা করলো

-তোমাদের বাড়িতে কি গেস্ট এসেছে কোনো? মানে কোনো কাজিন?

কলম থামিয়ে তাকালো রিমঝিম, ঘুমের দরুন চোখ দু’টো এখনো ফোলা, আলসে স্বরে বলল

-হ্যাঁ, ওই ফারিহা আপুর মামাতো ভাই, চিটাগং থাকে

বলে আবারও লিখা শুরু করলো, সাদমান খানিক চুপ থেকে আবারও বলল

-ওহ,তোমার আপু কোথায়?ও কি কাল কোথাও গেছিলো?

-আপু তো ঘুমাচ্ছে, কাল কোথায় গেছিলো কিনা জানি নাহ,তবে বাড়ি ফিরেছিলো বিকেলে

বলেই ফট করে সাদমানকে জিজ্ঞাসা করলো

-কিন্তু আপনি এসব জিজ্ঞাসা করছেন যে? আপনার বান্ধবীর সাথে কি আপনার কথা হয়না?

সাদমান ভড়কালো,তবে তা দমিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল

-না কিছু না,তুমি ম্যাথ করো

-আপনি কি এখন থেকে রোজ এত সকালেই পড়াতে আসবেন স্যার?

ভীষণ আলস্যের ভঙ্গিমায় জিজ্ঞাসা করলো রিমঝিম, সাদমান ঘাড় উপর নিচ করে সম্মতি দিলো। রিমঝিমের মুখাবয়ব ভীষণ অসন্তষ্ট দেখালো,এত সকাল করে উঠে পড়তে বসার চেয়ে জঘন্যতম বিড়ম্বনা আর দুটো নেই বলে তার ধারণা।

•••

দুপুর বেলা করে খাওয়া শেষে ড্রয়িং রুমেই বসে সকলে, শুধু শুধু নয়,ইনসাফ মাহবুব ডেকেছে,কিছু দরকারী কথা বলবেন বলে। আহান ঘরে বসে ভার্সিটির পরীক্ষার খাতা গুলো দেখছিলো,এত ব্যস্ততার মাঝে ডাকায় তিনি বেশ বিরক্ত তার মুখাবয়ব দেখেই স্পষ্ট। সিঙ্গেল সোফায় বসে চুপচাপ পায়ের উপর পা তুলে নাচাচ্ছে। তুরা আর রাইমা সোফাতে বসে ফুসুরফাসুর গল্প শুরু করেছে

-মিনু ফোন দিয়েছিল আজ সকালে,তোমরা এ ব্যাপারে কিছু জানো মা?

ইনসাফ মাহবুব এর কথায় সচকিত হলো আমেনা খাতুন, পান খাওয়া অবস্থায় ই বললেন

-কই না তো, কিছু বলেছে?

বার কয়েক মাথা নাড়ালো ইনসাফ। এক হাতে হেলান দিয়ে বসে বলল

-সকালেই ফোন করেছিলো ও, ফুয়াদ মানে ওর বড় ছেলের বিয়ে। মাস দুয়েক আগেই ফিরেছে বিদেশ থেকে। হুট করেই বিয়ের আয়োজন করেছে। সকালে মিনু ফোন দিয়েছিল সকলকে কালকেই রওয়ানা দিতে বলেছে

-কালকে,খাগড়াছড়ি তো অনেক দূরের পথ হুট করেই?

রুবি খাতুন প্রশ্ন করলে ইনসাফ বলল

-হ্যাঁ তা তো বুঝেছি। কিন্তু মিনুকে তো চেনোই। বারবার বলেছে,তোমাদের ও ফোন দিবে বলল ব্যস্ততার জন্য সময় করে উঠতে পারেনি। কিছুদিন আগেই এসে ঘুরে গেলো ও,যতই দূর হোক বড় বোন তো। না গেলে তো কষ্ট পাবে।

-তোমরা কি কালই যাচ্ছ তাহলে বাবা?

আহানের প্রশ্নে তুরা মুখ ফিরে তাকালো,ওর চোখে মুখে কেমন বিরক্তি। ইনসাফ মাহবুব বলল

-আমরা না,তুমিও যাচ্ছ। ওরা বারবার করে বলে দিয়েছে তুরা আর তোমাকে যাওয়ার কথা

-আমার ভার্সিটি এক্সামের খাতা গুলো এখনো দেখা হয়নি। ছুটিও বেশিদিন নেই। এর মাঝে বিয়েতে গেলে আমার কাজ গুলো কে করবে?

এতক্ষন চুপচাপ শুনলেও রুবির মুখ থেকে খাগড়াছড়ির নাম শুনে তুরার চোখ বড় হয়ে গেলো, আহানকে আর বলতে না দিয়েই ও লাফিয়ে বলল

-খাগড়াছড়ি? বিয়ে খাগড়াছড়িতে হবে?

-হ্যাঁ মিনু ফুফুর বাড়িই তো খাগড়াছড়িতে

রাইমার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলো তুরা, ব্যকুল হয়ে বলল

-বাবা আমি যাব,আমার কত শখ খাগড়াছড়ি ঘুরতে যাওয়া কক্ষনও যাইনি আমি চলো না চলো না কালই যাই

তুরার উচ্ছ্বসিত হওয়া দেখে হাসলো সকলে। ইনসাফ আহানকে উদ্দেশ্য করে বলল

-দেখ তুরাও যেতে চাই। এ সুযোগে ঘোরাঘুরি ও হবে, বিয়ের পর থেকে কোথাও ই তো যাইনি ও।এ নিয়ে আর কোনো না শুনব না আমি

বলেই উঠে দাঁড়ালো। ফোন বের করে কথা বলতে বলতে ঘরে গেলে,অন্যরাও উঠে দাঁড়ালো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও আহানকেও মানতে হলো।
চোখ মুখ কুচকে আছে। তবে তুরার আর কি। ও তো আনন্দে রীতিমতো নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৫২

বাসের ঝাঁকুনিতে মৃদু নড়েচড়ে উঠলো তুরা,তবুও ঘুম ভাঙার নাম নেই। আহান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো, বা হাতের আঙুল তুলে মুখে উপচে পরা চুলগুলো সরিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলো।
তুরা মৃদু নড়চড় করে আবারও আহানের বুকের মধ্যে মিশে রইলো।
বাসের সীটে ঘাড় এলিয়ে দিলো আহান ,এই মেয়ে এত কি করে ঘুমাতে পারে মাথায় আসেনা আহানের। সেই রাত থেকে ঘুমে কাদা হয়ে আছে, আহান সরাতে গেলেও একচুল নড়াতে পারেনি ওকে। দুহাতে আহানের পেট জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে, ডান পাশটা অসার হয়ে গেছে আহানের,কিন্তু তুরার ঘুমন্ত মুখটা দেখে আর ওকে সরানোর ইচ্ছে হলো নাহ। কতক্ষণ ধরে যে তাকিয়ে ছিলো তুরার মুখের দিকে সেসময় বেহিসেবী।
তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে টুপ করে একটা চুমু দিলে তুরা নড়েচড়ে উঠল। তুরার ঘুমন্ত চোখের পাতায় আবারও আলতো ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো আহান,এ দিয়ে যে কতবার তুরার মুখশ্রীতে অধর ছুঁয়ে দিলো তা হয়তো আহানের ও হিসেব নেই। কিন্তু সেই বা কি করবে তুরার গোলগাল মুখটা যখন ঘুমে বুদ থাকে, নিচের ঠোঁট কামড়ে মৃদুমন্দ নিঃশ্বাস ছাড়ে আহান বড্ড বেসামাল হয়ে যায়, আদুরে মুখ খানা দেখলে বারবার ছুঁয়ে দিতে মন চাই।
বাসটা আবারও ঝাঁকি দিয়ে উঠলে ঘুম নড়বড়ে হলো তুরার, চোখ বন্ধ রেখেই উষ্ণ আলিঙ্গনের স্পর্শ টের পাচ্ছে তুরা,ফুরফুরে হাওয়ার আদলে শরীরে যে শীতলতার সৃষ্টি হচ্ছে তা এমন নিবিড় আলিঙ্গনে অনেকটাই কেটে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে চোখ জোড়া খুললো তুরা, নিজেকে আবিষ্কার করলো আহানের বুকের মাঝে, আস্তেধীরে মাথা তুলে তাকালো, সীটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে আছে আহান।ঘুমাচ্ছে কিনা সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না তুরা, চুলগুলো ছড়িয়ে আছে কপালে, একদম শান্ত বাচ্চার মতো লাগছে আহানকে,চোখ সরাতে ইচ্ছে করলো না একদমই তুরার। মৃদু হাসলো তুরা আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিলো আহানের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আবৃত গাল।
নিজের অবস্থান বুঝে নজর বুলালে দেখলো আহান এক হাতে তার কোমর ঝাপটে ধরে রেখেছে আরেক হাত পায়ের উপর রাখা। নিজের পায়ের অবস্থান দেখেই ভড়কে গেলো তুরা, এক পা আহানের এক পায়ের উপর তুলে রেখেছে। এমা ছিছি! লজ্জায় কান গরম হলো তুরার।
তড়িঘড়ি করে ছিটকে সরে আসলে আহান চোখ খুললো, এমন তরস্ত হয়ে সরে যাওয়ায় আহানের সবেমাত্র ঘুমে লেগে আসা চোখ খুলে গেলো। লালচে হয়ে ফুলে আছে চোখ গুলো,দেখেই মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাইনি

-এভাবে লাফালাফি শুরু করেছ কেনো তুমি

তুরা গাল ফুলালো,সে কখন লাফালাফি করলো,সরেই তো এসেছে শুধু। আহানের কথার উত্তর না দিয়ে জানালার দিকে সরে গেলো। জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে, বিশাল খাদ আর সরু পথের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়িটি। বাইরের পরিবেশ টা দারুণ মোহনীয়,পূর্ব দিগন্তে উঠি উঠি সূর্যটাও মনমাতানো দৃশ্য লাগছে।
হুট করে আহান তুরার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে সরিয়ে আনলো, তুরা অবাক প্রসন্ন হয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আহান বলল

-ওভাবে জানালার দিকে সরে যাচ্ছ কেনো। বাসের ঝাঁকিতে তো উড়ে গিয়ে খাদে পরবা

তুরা চোখ কুচকে ফেললো, গোমড়া মুখ করে বলল

-আমি কি কোনো বাচ্চা যে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাব ঝাঁকিতে

-তোমাকে দেখলেই তো গুবলু বুবলু পিচ্চি টাইপ ফিলিং আসে, উড়ে যেতেই পার নট ইম্পসিবল।

তুরা মুখ ভেংচালো, আহান কে ছাড়িয়ে আবারও জানালার ধারে সরতে গেলে আহান চেপে ধরে রাখলো। তুরা ছোটখাটো হওয়ায় মাথাটা আহানের গলা পর্যন্ত ঠেকলো। আহান তুরার মাথায় নিজের গাল ঠেকিয়ে হেলান দেওয়ার মতো করে সীটে মাথা এলিয়ে দিলো, চোখ বন্ধ করে বলল

-এইটুখানি পিচ্চি বউ, কাঁধে তো মাথা রাখা যায় নাহ, একচুল নড়াচড়া করবা না,ঘুমাব আমি

-তো আপনি ঘুমান নিষেধ কে করেছে, আমাকে এভাবে চেপে রাখছেন কেনো

-সারারাত আমার বুক দখল করে ঘুমিয়েছ তখন কি আমি কিছু বলেছি? এখন আমি ঘুমাব, ডোন্ট মুভ

বলেই চুপ করে গেলো, তুরাও আর কথা বাড়ালো নাহ।
তখন প্রায় সকাল হতে শুরু করেছে,হয়তো ছয়টা/সাড়ে ছয়টা হবে সময়। প্রায় এক দেড় ঘন্টা পরে বাসটা এসে ব্রেক কষলো স্ট্যান্ডে। মৃদু ঝাঁকুনিতে আহান চোখ খুলে তাকালো। তুরাকে বলে উঠে দাঁড়ালে দুই সীট সামনে থেকেই মাহিদ ও উঠে দাঁড়ালো।
আহান, তুরা, মাহিদ তিনজনেই এসেছে শুধু। আমেনা খাতুনের হাঁটু কোমরের ব্যথার জন্যে তিনি ঠিক করে হাঁটতে অব্দি পারেন না,তাই এত দূরের পথ জার্নি করা তার পক্ষে অসম্ভব। রাইমাকেও এমতাবস্থায় সূদুর পথ ভ্রমন করায় একমত না ইমানসহ তার পরিবার। ইনসাফ আর রুবিও অসুস্থ মাকে শুধুমাত্র চুমকির ভরসায় রেখে আসতে পারেনি,তারা দুজন আসবেন তবে বিয়ের দিন যদি সম্ভব হয়।মাহিদ আসতে না চাইলেও সকলের অনুরোধ আর তুরার জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে এসেছে। কয়েকদিন ছুটিতে আছে এ সুযোগে একটু ঘুরাঘুরি হলেও মন্দ হয়না!
আশেপাশে মানুষের প্রচন্ড ভীড়, আহান এক হাতে লাগেজ আর আরেক হাতে তুরার হাত ধরে নামলো। বাস থেকে নামতেই দুটো অতি পরিচিত চেহারা দেখেই তুরার গাল প্রসারিত হয়ে এলো

-আহা অল্প বউউ! কতদিন পর দেখলাম..আসো বুকে আসো

বলে বিহান এগিয়ে আসতে লাগলেই আহান বিহানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল

-কল হার ভাবি, বউ বললে মুখ ভেঙে দেব

বিহান মেকি ঘাবড়ানোর ভঙ্গিমায় বলল

-এহ দিল টুট গ্যায়া,কই ভাবলাম অল্প বউ আসলে ওকে দেখেই বউ দেখার চক্ষুতৃষ্ণা মেটাব,মাঝখান থেকে আমার বিয়ে বিদ্বেষী ভাইটা বউ বলে দিলো

বিহানের বলার ভঙ্গিতে ফিক করে হেসে উঠলো তুরা, আরমান এগিয়ে এসে তুরার সাথে কথা বললে আহান মাহিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো ওদের। বিহান আরমানের সাথে আরও একটা ছেলে এসেছে। মিনু ফুফুর দেবরের ছেলে নাম সিয়াম। সকলে স্বাগতভাষণ সরূপ কথা বলে গাড়ি ঠিক করে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো।

বাড়িতে পৌঁছাতেই চেনা পরিচিত কয়েক জোড়া মুখ দেখে তুরা খুশিতে ডগমগ হয়ে গেছে, বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই তনু রুহি জায়মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো

-ভাবি ভাবি,,আই মিসড ইউউউ,, আসতে এত দেরি কেনো করলে বলো তো। আমরা এসে থেকে ওয়েট করছি তোমার জন্য

বরাবরের মতোই চঞ্চল স্বভাবের রুহি হড়বড়িয়ে বলল, তনুও যোগ দিলো দুজন মিলে এমন গল্প জুড়ে দিলো যেনো উঠোনে দাঁড়িয়েই সব কথা সেড়ে ফেলবে। ততক্ষণে গাড়ি থেকে ব্যাগপত্র নামিয়ে আহান,মাহিদ,আরমান, বিহান সহ সিয়াম সকলে ঢুকলো। মাহিদ ঢুকে সামনে তাকাতেই স্তব্ধ হলো যেনো

-দেখি সর তো, আমার ছেলে বউকে বাইরের দাঁড় করিয়ে রাখবি তোরা?

পরিচিত নারী কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই তুরা সচকিত তাকালো। গোলগাল চেহারার প্রজ্জ্বলিত মুখ খানা দেখেই অধর বিস্তৃত করে হেসে এগিয়ে গেলো। মিনুর কাছে,দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল

-কেমন আছ ফুফুআম্মা। তোমাকে ভীষণ মিস করেছি আমি

পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো মিনু, তুরার কপালে আদর দিয়ে কপট অভিমান করে বলল

-থাক থাক,কত যে মিস করেছ,ফুফুকে তো মনেই পরে না তোমাদের

-আমার তো ঠিকই মনে পরে,কিন্তু এমন একটা জল্লাদ ছেলে তোমার কোথাও নিজে তো আসতেই চাইনা আমাকেও নিয়ে আসেনা

আরমান, বিহান মিলে ওদের ব্যাগ নিয়ে ঘরের ভেতর গেলো। আহান এগিয়ে এসে ফুফুকে সালাম দিলো, সাথে মাহিদ ও।

-ফুফু ও মাহিদ তুরার..

-তুরার ভাই তাইতো? এ তো আরেক আরমান,প্রথমে দেখে তো আমি আরমান ই ভেবে বসেছি।

আহানকে থামিয়ে বলল মিনু। হেসে উঠলো সকলে। আসলেই মাহিদের চেহারা টা কিছুটা আরমানের মতো, শুধু সাস্থ আর উচ্চতায় একটু বেশি হবে। সকলের কথাবার্তা চলমান তখনই হাতভর্তি মিষ্টির ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করলো আরেকজন

-আরে প্রফেসর সাহেবের আগমন ঘটলো তাহলে

এগিয়ে এসে মিনুর হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো আহানকে,মাহিদের সাথেও কুশল বিনিময় করলো,তুরার দিকে তাকিয়ে বলল

-আসসালামু আলাইকুম ভাবিজান।আমিও এই বাঁদর গুলোর মতই আপনার দেবর। বয়সে আহানের চেয়ে কয়েক মাসের বড় হলেও জীবন যুদ্ধে পিছিয়ে বিয়ের পিড়িতে দেরিতে বসতে হচ্ছে আরকি

তুরা খিলখিল করে হেসে উঠলো ফুয়াদের কথা শুনে। সালামের উত্তর দিলে ফুয়াদ বলল

-সম্পর্কে সকলের বড় একমাত্র ভাবি আপনি। কিন্তু আহান ভুল কিছু বলেনি দেখতে কিন্তু ক্লাস এইট নাইনে পড়ুয়া বাচ্চাদের মতই

বলেই সশব্দে হেসে উঠলো ফুয়াদ।সাথে বাকি সকলেও। তুরা আড়চোখে তাকালো আহানের দিকে,ব’জ্জাত টাও ঠোঁট টিপে হাসছে। তুরার ভীষণ রাগ হলো। লোকটার হাড়ে হাড়ে ইতরপনা। কত বড় জাঁদরেল হলে এসব বলে বেড়ায় ভাবা যায়,তাও আবার নিজের বউয়ের নামে!

•••

এ বাড়িতে এসে পৌঁছাতে সকাল নয়টা বেজে গেছিলো। এখন দুপুর তিনটা, দুপুর বললে ভুল হবে প্রায় বিকেল হতেই চলল। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে বড় ঘরে বসে আছে তুরা সকলের সাথে।
এবাড়িতে খুব বেশি লোকজন নেই। মিনু ফুফু তার স্বামী আর ফুয়াদ।সাথে ফুয়াদের চাচা চাচী আর দুই ছেলে মেয়ে। সিয়াম আর ওর ছোট বোন। এ বাদে যারা আছে তারা সকলে আত্মীয়। তনু, জায়মা রুহি,বিহান, আরমান আর আজ তুরা আহান আর মাহিদ এসে যোগ দিয়েছে।মাহিদ এসে ঘরেই বসে ছিল শুধু খাবার সময় বেরিয়েছে, ওর চোখ মুখ কেমন অন্যরকম ঠেকলো তুরার কাছে। মাহিদ তো বড়ই মিশুক স্বভাবের ছেলে,আর এখানে যারা আছে তারা সবাই তো ওর মতই। তবুও কেমন একটা অস্বস্তি দেখলো তুরা মাহিদের চোখে। ওকে দু তিনবার জিজ্ঞাসা করলে বলেছে জার্নি করাতে ক্লান্ত। তবে তুরা আহানের চোখে মুখে ক্লান্তি কম বিস্ময় আর হতবিহ্বলতা বেশি দেখেছে।

-পিচ্চি ভাবি, আপনাকে আহান ভাই ডাকছে

ছোট ছোট শব্দের বাচ্চা কণ্ঠস্বরে তুরার চিন্তা কাটিয়ে সচকিত হলো। তার পাশেই সায়মা দাঁড়িয়ে, সিয়ামের বোন।হবে হয়তো ছয় সাত বছর বয়স,মাথায় দুটো ঝুটি করা, পরনে ফ্রক।

-আহান ভাই দেখি বউ ছাড়া থাকতেই পারছেনা,যাও ভাবি যাও

তনু রম্যক গলায় বলল। সাথে সকলে হেসে উঠলো। তুরার বড্ড অস্বস্তি হলো,লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে যেন। এই লোকটা এত ব’জ্জাতপনা শুরু করেছে যে কিছুতেই মান সম্মান থাকছে নাহ। এ দিয়ে দুবার ডাকতে পাঠালো তুরাকে। এখানে আহানের সব কাজিন সহ, ফুয়াদের চাচীও বসে আছে। সকলের সাথে বসে গল্প করছিলো তুরা, কি এত কাজ যে বারবার ডেকে পাঠাচ্ছে লোকটা

-তুমি গিয়ে তোমার আহান ভাইকে বলো আমি আসতে পারব নাহ

খিটমিট করে বলল তুরা, মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে তার, সকলের সামনে আর মুখ থাকলো নাহ।

-ওকে পিচ্চি ভাবি

বলে দৌড়াতে নিকেই জায়মা ওর হাত ধরে বলল

-এই এই দাঁড়া,,তুই ভাবিকে পিচ্চি ভাবি কেনো বলছিস

-ভাইয়া বলেছে

-কোন ভাইয়া

-আহান ভাইয়া,আমাকে বলল যে তোর ভাবিকে বল আমি ডাকছি। আমি যখন বললাম আমিতো চিনি না ভাবি কে তখন বলল, ওখানে গিয়ে দেখবি যেই মেয়েটা দেখতে সবচেয়ে পিচ্চি সেটাই তোর ভাবি। তাই উনি পিচ্চি ভাবি

বলেই ঝুটি নাচাতে নাচাতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো মেয়েটা। সায়মার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ থ মেরে তাকিয়ে থেকে হাহা করে হেসে উঠলো সকলে।

-লাইক সিরিয়াসলি, ভাই কিন্তু মোটেও ঠিক করেনি এটা,দুদিন পরেই একটা পিচ্চির মা হবে অথচ তোমাকেই পিচ্চি বলছে

তুরা ভীষণ ক্ষেপে গেলো। লোকটা এখানে এসে বেশি ইতরামি শুরু করেছে। পদে পদে হেনস্তা করছে, গাট হয়ে বসে রইলো। কিছুতেই যাবে না সে ওমন জাঁদরেল লোকটার কাছে। কিন্তু তুরার ভাবনা ভঙ্গুর করে আবারও সায়মা এলো

-পিচ্চি ভাবি ভাইয়া তোমাকে এখনই যেতে বলল নাতো ঠ্যাং খোরা করে দেবে নাকি

সায়মার কথায় তুরা হতভম্ব হয়ে গেলো, লোকটা কি শুরু করলো! পাগল টাগল হয়ে গেছে নাকি রীতিমতো। তুরা বসে থাকা অবস্থায় মিনু এলো
তুরার হাতে নাস্তার প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলল

-এত বার করে যখন ডাকছে শুনেই আসো না। আর আহানতো খুব বেশি তেল মশলা দেওয়া খাবার খায়না,দুপুরেও একদম একটুখানি খেয়েছে,এই নাস্তা নিয়ে ওকে দিও

অগত্যা উপায়হীন হয়ে তুরা প্লেট হাতে নিলো। ফুফুকে না বলার স্পর্ধা, ইচ্ছে কোনোটাই তার নেই। মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে হাঁটা ধরলো ঘরের দিকে।
ঘরে ঢুকেই ধপ করে প্লেটটা রাখলো। কোমরে দুহাত গুঁজে দাঁড়ালো আহানের দিকে তাকিয়ে। আহান একবারও তাকালো না,চিত হয়ে শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখছে। এতক্ষণ ধরে ডেকে এখন তুরার দিকে তাকাচ্ছে পর্যন্ত নাহ, রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো তুরার, অগ্নিমূর্তি হয়ে টিভির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো একদম,আহান ডানে বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেও তুরা টিভি দেখতে দিলো নাহ। থপ করে রিমোট টা রাখলো। মাথার চুলে হাত চালিয়ে বলল

-আই নো আ’ম সো হ্যান্ডসাম, বাট এভাবে হা করে না তাকালেও চলবে, তোমারই বর।কেও ছিনিয়ে নিয়ে যাবে না

তুরার মেজাজ আকাশচুম্বী হয়ে গেলো। থপথপ করে এগিয়ে এসে আহানের চুল টেনে ধরে বলল

-আমি পিচ্চি না? আমি পিচ্চি?আমাকে মানুষের সামনে অপমান করা, বুড়ো লোক কোথাকার। পেট মোটা মাস্টার মশাই কি সাধে বলেছি।

আহান এক হাতে তুরার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওর দুহাত চেপে ধরে বলল

-আরে কি করছ কি,চুলগুলো ছিড়ে ফেলবে নাকি

তুরা ছুটাছুটি করার চেষ্টা করলেও আহানের শক্তির সাথে পেরে উঠলো নাহ,শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে ধপ করে বসলো খাটের উপর, রাগের চোটে ফোসফাস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ঘনঘন। আহান স্থবির চাহনিতে তাকিয়ে থেকে মুখ এগিয়ে ফু দিলো তুরার সারা মুখে, শীতল কণ্ঠে বলল

-রাগ কমেছে বউ?

তিরতির করে উঠলো তুরার সারা শরীর। আহানের এরূপ নরম গভীর কণ্ঠস্বরে দুম করেই মেজাজ খারাপ উড়ে গেলো। তবুও প্রকাশ করলো নাহ,মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। আহন হাসলো নিঃশব্দে, এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শাড়ির আঁচল ভেদ করে নরম পেট জড়িয়ে ধরলো,ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল

-শাড়ি পরে তো এমনিতেই হট লাগছে,তার উপর যদি মেজাজ ও হট করে ফেলো।এত হটনেস সামলাতে গেলে তো পাগল হয়ে যাব বউ

প্রচন্ড মোহাগ্রস্থ নেশাক্ত শোনালো আহানের গলা,চোখ খিঁচিয়ে নিলো তুরা, আহানের হাতের উপর হাত রেখে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আহান আরও জোরে চেপে ধরলো

-ক্ কি করছেন,কেও দেখে ফেলবে

-দেখুক,আমার বউকে আমি ধরেছি,এতে দোষের কিছু নেই,যদি দোষ করেই থাকে তবে সে করবে যে আমাদের রোমান্স দেখবে

তুরা ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে বলল

-কোনো রোমান্স না,ছাড়ুন আমাকে। আপনি ভীষণ খারাপ। ভীষণ ভীষণ ভীষণ খারাপ। আপনার সাথে কোনো কথা নেই আমার। আপনি সকলের সামনে আমাকে পিচ্চি বলেছেন,আবার বলেছেন ঠ্যাং খোরা করে দেব

গাল ফুলিয়ে বলল তুরা, আহান তুরাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে করলো, তুরা হাত দুটো নিজের বুকের উপর রেখে কোমর পেচিয়ে ধরে বলল

-এসে থেকেই তো গল্প করে বেড়াচ্ছ,তোমার যে একটা স্বামী আছে সে খেয়াল আছে? কতবার ডাকছি বলো তো

-কেনো ডেকেছেন,দেখছিলেন না আমি সকলের সাথে গল্প করছিলাম কেনো ডাকবেন

-আমার বউ পাচ্ছে তাই

-বউ আবার কিভাবে পাই?

চোখে মুখে উপচে পরা কৌতূহল নিয়ে বোকা বোকা মুখ করে বলল তুরা, আহান ঠোঁট কামড়ে হাসলো,মুখটা আরও এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল

-ওটা বোঝানোর জন্যেই তো ডেকেছি

বলেই ঠোঁট দুটো আস্তে আস্তে এগিয়ে নিতে লাগলো তুরার দিকে। তুরা চোখ টিপে বন্ধ করে আহানের শার্ট খামচে ধরলো, দুজনের ঠোঁট ছুঁইছুঁই হতেই দরজার কাছ থেকে শব্দ এলো

-ভাইয়ায়া??

ফট করে সরে গেলো তুরা,আহানের বুকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনই ধপ করে দরজা টা খুলল সায়মা। ওদের দুজনকে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে বলল

-কি হয়েছে? তোমরা দুজন এমন করে আছ কেনো?
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️