#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ১৪)
কলমে #রেহানা_পুতুল
কেমন যেন চেনা লাগছে লোকটাকে। বুভুক্ষুর ন্যায় সে আমার দিকে নয় খাবারের দিকে চেয়ে আছে। কেবল ঘোলাটে চোখে আমাকে একবার দেখল রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে। মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ। বিদীর্ণ চেহারা। উসকোখুসকো চুল। ময়লা ছেঁড়া পোশাক। রুগ্ন শরীর।
জিজ্ঞেস করলাম আপনিইই…?
কন্ঠকে খাদে নামিয়ে আস্তে করে জবাব দিল।
শিলা আমি এহসান।
আমি ইতিউতি তাকালাম। সরে এলাম তার সামনে থেকে। মাঠের একপাশে একটা কাঠের বেঞ্চে বসলাম পায়ের উপর পা তুলে। না দেখার ভান করে এহসানকে দেখছি উপেক্ষার চোখে। সে মাথা নিচু করে খেয়েই যাচ্ছে। ক্ষুধা এমন এক জিনিস। সমস্ত লজ্জা,সংকোচকেও ছাড়িয়ে যায়।
আমি একবার এক অনাহারীর মুখে শুনেছি। সে বস্রহীন হয়েও থাকতে রাজী। তবুও তাকে কেউ একবেলা আহার দিক। আমার ভিতর থেকে তপ্তস্বাশ বেরিয়ে এলো।
উদ্যানের বৃক্ষগুলোর দিকে চেয়ে মনে হলো,
মানুষ মানুষের কোন ভুল বা অন্যায় ক্ষমা করে দিলেও প্রকৃতি দেয়না।
প্রকৃতি মানুষের চেয়েও বড় পরাক্রমশালী। সে কড়ায় গন্ডায় পইপই করে হিসাব নিতে জানে। প্রকৃতি যেমন উদার তেমনি নিষ্ঠুর ও।
বর্তমানে আমি বেশ আছি। তাই বলে আমার গ্লানিময় দুঃসহ অতীত ভুলে যাইনি। অতীকে ভুলে যেতে নেই। অতীতকে মনে করেই সামনে এগিয়ে যেতে হয় প্রতিটি খাদে পড়া মানুষকে। যেন সেই কালো অতীতের পুনরাবৃত্তি না ঘটে জীবনে৷ খাবার পরিবেশনার দায়িত্বে থাকা ছেলেমেয়েদের একজনকে ডাক দিলাম।
আদেশ দিয়ে বললাম,
ফতুয়া পরা ওই লোকটিকে একটু যত্ন করে খাওয়াও।
এই মুহুর্তে ওর প্রতি আমার করুণা ও সহানুভূতি ছাড়া আর কিছুই কাজ করছেনা।
এখানে এদের সবার কাছে এহসান অন্যদের মত অপরিচিত দরিদ্র অনাহারী। ছেলেটি আমাকে বলল,
ম্যাম উনি আপনার পরিচিত?
হুম।
সবাই খেয়ে খোলা উদ্যানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। দেখলাম এহসান ও সরে গেল। আমি ওদের বিদায় দিয়ে উদ্যানের একটু ভিতরে গেলাম। উদ্দেশ্য প্রকৃতির মাঝে একটু নিরিবিলি থাকা।
সেখানে গিয়ে সবুজ ঘাসের চত্বরে বসলাম। খানিক পরেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। নাক সিঁটকে জিজ্ঞেস করলাম,
আপনি এখানে কেন? কি চাই?
এহসান আর্তির সুরে বলল,
আমি তোমার কাছে কিছু চাইতে আসিনি। কিছু জানতেও আসিনি। কিছু জানাতে এসেছি। দয়া করে শুনবে?
আমি নিঃশ্চুপ হয়ে আছি।
আমার মৌনতায় সে বুঝল এতটুকু দয়া তাকে করছি আমি।
সে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসল। দূর্বল কন্ঠে বলতে লাগল।
আমার অপরাধ ও ভুলের জন্য আল্লাহ আমাকে শাস্তি খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে। আমি লজ্জিত। অনুতপ্ত। আমার অন্যায়ের চাবুকের আঘাতে প্রতিমুহূর্তে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছি। আত্মীয় স্বজন বোনেরাও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
যার অর্থ থাকেনা। তখন সে এমনিতেই সবার অপ্রিয় হয়ে যায়। আর অপ্রিয় মানুষ থেকে সবাই দূরে থাকতে চায়।
সব কিছু হারিয়ে আমি যখন একাকী হয়ে পড়লাম। তখন কোন কাজ ও করতে মন সায় দিতনা। দোকানে যেতাম না। পা চলতনা। শরীর অসাড় হয়ে থাকত সারাক্ষণ। এভাবে দোকানের ভাড়া জমে যায়। ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে দোকানের ভাড়া পরিশোধ করি। দোকান ও ছেড়ে দিই। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরেও যাইনি। যাওয়ার প্রয়োজন যে ফুরিয়ে গেল আমার দোষেই। ব্যাংক থেকে তুলে আনা জমানো টাকা এক সময় শেষ হয়ে যায়। বাসা ভাড়া ও নিজের সব খরচ টেনে। চারমাস আগে বাসাও ছেড়ে দিই। বাসার জিনিসপত্র সব বেচে দিয়েছি। শরীরে নানারোগ বাসা বেঁধেছে। আর নতুন বাসায় তেমন কিছু ছিলওনা।
এরপর থেকে হাইকোর্ট মাজারের ভিতরেই থাকি। সেখানে নিঃস্বদের আশ্রয় দেয়া হয়। সেটাই এখন আমার শেষ আশ্রয়স্থল। ভাইজান ও তুমি নতুন বাসায় উঠেছে। তাই তোমাদের অনেক খুঁজেও আর পাইনি। তবে অনেক দূর থেকে তোমাকে মাঝে মাঝে দেখতাম দোকানের ভিতরে। এশা, মাহিন, আয়রাকে দেখতাম মাঝে মাঝে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে। তুমি মোবাইল নাম্বার ও চেঞ্জ করে ফেলেছে।
তুমি সঠিক ছিলে। আমি ভুল ছিলাম। তোমার সফলতা দেখে ভালো লাগছে। আসলে প্রথম ও শেষ ভালোবাসা বলে কিছুই থাকেনা। একজন মানুষের বিয়ের পর সন্তান ও স্ত্রী বা স্বামীই হলো সব।
এই উদ্যানে মন চাইলেই এসে বসে থাকি। কেউ তাড়িয়ে দেয়না। আজ যখন সকালে আসলাম। তখন দেখি এখানে আস্তে আস্তে ভীড় বাড়তে থাকে কিছু গরীব মানুষের। জিজ্ঞেস করলাম কেন আসছে তারা। বলল তাদেরকে এক বড়লোক ম্যাডাম দুপুরে খাওয়াবে। তারপর তাদের সাথেই থাকি। যখন তোমার ভলান্টিয়াররা আসল।
জিজ্ঞেস করতেই বলল,
শিলা ম্যাডাম খাওয়াচ্ছে।
তখন আমি খাওয়ার জন্য ও তোমাকে কিছু বলার জন্য অপেক্ষা করি।
লক্ষ্য করলাম এহসানের গলা ধরে আসছে। আর কথা বলতে পারছেনা। কন্ঠ বেশ জড়িয়ে যাচ্ছে। ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করা তার দুচোখে থেকে গলগলিয়ে অশ্রু নির্গত হচ্ছে অবিরাম ধারায়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে আরও বলল,
আমার সন্তানদের বলো তাদের বাবাকে পারলে যেন ক্ষমা করে দেয়। তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও পারলে। নয়তো অভিশাপ দিও। দোয়া করো আর কোনদিনও যেন তোমাদের সামনে আমার পড়তে না হয়। তোমরা ভালো থেকো। এই বলে এহসান উঠে দাঁড়ালো,
পকেট থেকে পুরোনো একটি রুমাল বের করলো। ঝাপসা হয়ে আসা চোখদুটো ঢলে মুছে নিল। নিঃশব্দ পায়ে প্রস্থান করল আমার সামনের থেকে। আমি চেয়ে আছি এহসানের ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়ার দিকে। নিজের অজান্তেই আমার দুচোখ নোনাজলে ভরে গেল। একটু গিয়ে এহসান ফের আমার দিকে তাকাল। আমিও ঠাই চেয়ে রইলাম তার দিকে। দুজন দুজনের দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলাম। হয়তো চিরদিনের জন্য। হয়তো এ দেখাই শেষ দেখা আমাদের।
আমরা মানুষ। আমাদের মন আছে। মায়া আছে। আবেগ আছে। একসময় আমাদের অতি প্রিয় থাকা মন্দ মানুষটা যখন দুর্দিনে পৌঁছায়। তখন ভিতরে ভুল করে হলেও অতীতের মায়াটা ফিরে আসে। তবুও সেই মায়ায় আমার #ফেরার_কোন_পথ_নেই।
আমি নরম হতে চাইনা। আমি পাহাড়ের মত অবিচল থাকতে চাই। আমাকে বরফ কুচির মত গুড়ো গুড়ো হলে চলবেনা। মনে মনে বললাম,
আমিতো পুষ্পপত্রের ন্যায় কোমল থাকতে চেয়েছিলাম। সারাটিজীবন খুশবু ছড়িয়ে তোমাকে ভালোবাসায় মাতিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু হয়েছে তার উল্টোটা। আমি কোমল থেকে ক্রমাগত পাথর হয়ে গিয়েছি। এখন আমি চাইলেও মোমের মতো গলে গলে পড়বনা। ফুলের মত কোমল হবনা। পেঁজা তুলোর মত হালকা হবনা। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। রিকসা নিয়ে চলে এলাম বাসায়। মা ও বাচ্চাদের সব জানালাম।
মা বলল,
ক্ষমা মানুষের মহৎগুণ। আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে দিতেও বাপ লাগে। নাকি…
মায়ের কথা শেষ হতে দিলনা তরুণী এশা। সাফ সাফ জানিয়ে দিল তাদের জীবনে এহসান নামক কারো প্রয়োজন নেই। সব ভুলের ক্ষমা হয়না। হওয়া উচিত নয়। এতে অন্যরা প্রশ্রয় পাবে। বরং পরকিয়া ও দ্বিতীয় বিয়ে করলে কি পরিণতি হতে পারে। তা একজন এহসানকে দেখে বাকিদের উপলব্ধি হউক। এশার কথার সাথে তাল মিলিয়ে মাহিন বলল,
আপুর কথাই আমার কথা। আয়রাও বলে উঠল,আমিও আপু ভাইয়ার দলে।
আমি মানসিক দোটানায় পড়ে গেলাম অল্প। কেমন যেন লাগছে। বুঝেও বুঝতেছিনা।
সেদিন সন্ধ্যা বাদে সেজো খালা ফোন দিল মায়ের ফোনে। মা খালাকে কি বলিস! বলে আমার হাতে ফোন দিল।
খালা বলল,
তোরা খবরের কাগজ পড়িসনা?
আগে পড়তাম খালা। এখন পড়িনা।
আয় হায়। কি যে অবস্থা। শোন মিতা যে চরের ওদিকে থাকতো একলা। সেখানে তার ঘরে গিয়ে পাঁচজন যুবক ছেলে নাকি তাকে ধ’ র্ষ’ ণ করছে সারারাত ভরে। মিতার অবস্থা খারাপ। হাসপাতালে এখন। পত্রিকায়তো আসছে এই ঘটনা। আল্লায় জানে এখন কি হয়? নাকি মিতাই মরে যায়।
আমি চমকে উঠলাম। এত ভয়ংকর পরিণতি হবে এহসান ও মিতার। এ আমার কল্পনাতীত ছিল। না জানি আরো ভয়ংকর কিছু ঘটার অপেক্ষায়।
চলবে।