#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪০
মোমেনার কথার উপর কথা আর নিহাদ কিছু বলার সাহস পায়নি। তবে কথা খুব কষ্ট পেয়েছে তার ওমন ব্যবহারে। কারণ কথা নিজের মায়ের মতো তাকে বিশ্বাস করে নিজের জীবনের খুটিনাটি সব বলতো। এমনকি নিজের মাকে যা বলেনি তা-ও তাকে বলেছে। নিজের মাকে বলতো না, ভাবতো কষ্ট পাবে, কষ্ট পেয়ে ইমোশনাল কোনো সিদ্ধান্ত নিবে, তাই সব কথা মোমেনাকে বলতো, যাতে সে ওকে সঠিক বুদ্ধিটা দিতে পারে।
সবসময় নিজের মায়ের মতো তাকেও ভেবেছে, কিন্তু তার এ কঠোরতায় কথা বুঝে গেল কোথাও না কোথাও মোমেননাও শাশুড়ি হয়েই আছে। যদি কথাকে মেয়ে ভাবতো তাহলে নিশ্চয়ই কথার এমন কঠিন সময়ে ওর ভরসা হতো শক্তি হতো। কিন্তু তিনি পুরানো কথা টেনে কথার কষ্টটা আরও খুঁচিয়ে দিলেন। মোমেনা শাস্তি অবশ্য শুধুমাত্র কথাকে দেয়নি, বরং তার একমাত্র ছেলে নিহাদকেও বরাবর শাস্তি দিয়েছেন। যদিও তিনি জানেন দোষটা কোথাও না কোথাও তার ছেলের। তার ছেলের র্নিবুদ্ধিতাই ভুলের সূচনা করেছিল।
কথা আর এ বিষয়ে মোমেনাকে কিছু বলেনি। সেদিনের মতো এখন পর্যন্ত র্নিবাকই আছে। ওর-ও খুব অভিমান হয়েছে মোমেনার প্রতি। সে কারণে কথাও আর সেধে সেধে মোমেনার সাথে কথা বলতে যায়নি। নিহাদ অবশ্য মোমেনার সাথে কথা বলে। তবে মোমেনা, নিহাদের কথা শুনে যায় শুধু, কোনো উত্তর দেয় না। কথা আর নিহাদকে তার কিছু বলার হলে তা নিহাদের বাবাকে দিয়ে বলায়। নিহাদের দাদি আর বাবা বিষয়টা নিয়ে বিরক্ত। যে পরিবারে শাশুড়ি পুত্রবধূর সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল, অথচ আজ সে পরিবারে দুজনার মনের মধ্যে হাজারো কিলোমিটারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। একই বাড়িতে পাশাপাশি রুমে থেকেও দু’জনার মনের মাঝে কত দূরত্ব!
নিহাদের দাদি, ফাতিমা এবং নয়ন শাশুড়ি বউমাকে মিলানোর চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা বুঝতেই পারছে না দুজনার মাঝে সমস্যাটা কোথায়? রোগ না জেনে চিকিৎসা কীভাবে সম্ভব? না কথা কিছু বলে আর না মোমেনা কিছু বলে। দুজনকে এক করে হোক বা আলাদা করে, কিছু জানতে চাইলে দুজনই বলে ব্যাপারটা আমাদের শাশুড়ির বউমার আমরা বুঝে নিব। দয়া করে আপনারা কেউ কথা বলবেন না। তখন নয়ন এবং ফাতিমা চুপ হয়ে যায়। কী বলবে এদের যখন এরা নিজেরাই এদের সমস্যা সমাধান করতে চায় না। তাই সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে ব্যাপারটা সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে হয়তো দুজনার মনোমালিন্য কমবে।
“রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” শীঘ্রই পাঠানো শুরু হবে। আপনার কপি অর্ডার করেছেন তো?
৪১!!
ভার্সিটির এক কোণায় তূবা চুপ করে বসে আছে। শ্রাবণও ওর পাশে চুপচাপ বসে আছে। দুজন যেন বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। অনেকক্ষণ নীরবতায় কাটানোর পর শ্রাবণ বলল,
‘আর কয়টা পরীক্ষা আছে তোমার?’
‘দুইটা।’
‘তোর সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট কবে দিবে?’
‘সামনের মাসে।’
‘শ্রাবণ!’
‘হুম।’
‘আমার তো গ্রুজুয়েশন শেষ। বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। বলেছি মাস্টার্স করে তারপর।’
‘তুমি মাস্টার্স শেষ করার আগেই তোমার পরিবারে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিব।’
‘কীভাবে?’
‘সব মিলিয়ে দেড় বছরে মাস্টার্স শেষ হবে তখন তুই কেবল ফোর্থ ইয়ারে থাকবি।’
‘সেটা তোমার দেখার বিষয় না, আমি দেখব। বলেছি না আমি থাকতে তোমার কোনো চিন্তা করতে হবে না।’
‘আচ্ছা তাহলে এখন যাই।’
‘আমার সাথে যাবে?’
‘চল তাহলে।’
‘আমি সাইকেল আনিনি। দাঁড়াও রিকশা ডাকি।’
শ্রাবণ রিকশা ডাকতে গেল। তূবা, ওর যাবার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথার দূর্ঘটনার পর থেকেই ওদের সম্পর্কটা কেমন যেন শীতল হয়ে গেছে। দুজন দুজনকে ভালোবাসে না, তা নয় তবে কোথাও যেনো চাঞ্চল্য, উচ্ছ্বলতা হারিয়ে গেছে।
কথা যখন হসপিটালে ছিল কেউ তূবার দিকটা খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে দেখত কথার মতো তূবাও সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় কতটা ছটফট করেছে। তূবা ভেবেই নিয়েছিল কথার সন্তানই ওর সন্তান। কথার সন্তানের মাধ্যমে নিজের মা হবার শোক কাটাবে। সেদিন তূবার ছটফটানি কেউ বুঝতে পারেনি। শ্রাবণও না। অবশ্য শ্রাবণকে দোষ দেওয়া যায় না। নিজের একমাত্র বোনের ওমন অবস্থা দেখে কোনো ভাই-ই ঠিক থাকতে পারবে না।
নিজের ভিতরের সব ছটফটানি চেপেও কথা সেদিন শ্রাবণীকে, শ্রাবণকে সামলেছিল। শ্রাবণ যখন তূবাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল তখন তূবা শ্রাবণকে সামলেছিল, কিন্তু সেদিন কেউ বুঝতে পারেনি তূবার কষ্ট। সেদিন সন্তান কেবল কথা একা হারায়নি, তূবাও হারিয়েছিল।
কথার দূর্ঘটনার পর থেকে শ্রাবণ কেমন বদলে গেল। আগের দুষ্টু শ্রাবণ যেন নীরব হয়ে গেল। তূবাকে সময় দেওয়া কমিয়ে দিলো। কথা বলা কমিয়ে দিলো। দেখা করা তো একেবারে কমিয়ে দিলো। আর যাওবা দেখা হতো তখন তূবার প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ কাজ করতো, যে দুষ্টুমি করতো, সেগুলো যেন একেবারে কমে গেল।
যেহেতু তূবাও, কথার দূর্ঘটনার কষ্টে ছিল, সে কারণে ও-ও এসব বিষয় তেমন খেয়াল করতো না। কিন্তু ইদানিং সম্পর্কের এ শীতলতা তূবার ভালো লাগছে না। নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে শ্রাবণ দূরে চলে যাচ্ছে। তূবা তো বরাবরই নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখতো, শ্রাবণই নিজেকে মেলে ধরত, তূবাকে চঞ্চল রাখতো, কিন্তু ইদানিং সম্পর্কে শ্রাবণের এ শীতলতা মেনে নিতে পারছে না।
কেন জানি মনে হচ্ছে, শ্রাবণের ওর প্রতি যে আকর্ষণ ছিল তা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তূবার অলস মস্তিষ্ক সারাদিন উলটা পালটা ভাবে। মাঝে মাঝে ভাবে হয়তো শ্রাবণ বুঝতে পেরেছে সন্তান কি জিনিস! হয়তো কথার সন্তান হারানোর মাধ্যমে বুঝতে পেরেছে সন্তান কতটা জরুরি। সে কারণে হয়তো নিজ থেকে সম্পর্কে শীতলতা এনেছে। কারণ তূবার তো সন্তান ধারণ ক্ষমতা নেই বললেই চলে।
তূবার মাঝে মাঝে খুব বলতে ইচ্ছা করে, ‘শ্রাবণ আমার আগের শ্রাবণকে ফিরিয়ে দে।’
কিন্তু মুখচোরা তূবা তা বলতে পারে না। কষ্টগুলো তখন দলা পাকিয়ে গলায় আটকে থাকে। কথা আর বলতে দেয় না। নিজ কষ্ট নিজ মাঝে গোপন রেখে আপন মনে প্রতি মুহূর্তে জ্বলতে থাকে তূবা।
শ্রাবণ রিকশা নিয়ে আসলে, ওরা রিকশায় উঠে বসলো। আগে রিকশায় একসাথে বসলে শ্রাবণ কত কত কথা বলতো, কাঁধে হাত রাখত, দুষ্টুমি করতো, অথচ এখন নীরব থাকে।
তূবা শ্রাবণের হাতে হাত রাখল। শ্রাবণ হাতটা সরিয়ে নিলো। অভিমানে তূবার চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসতে চাইল কিন্তু শক্ত তূবা আটকে দিলো নিজের চোখের বহিত অশ্রু ধারা। ইদানিং তামিমকে পড়াতে গেলেও শ্রাবণ ওকে পড়িয়েই চলে আসে। আগের মতো কারণে অকারণে মিথ্যা বাহানায় তূবার রুমে যায় না।
তূবার কেন জানি মনে হচ্ছে ওর দিক থেকে শ্রাবণের ভালোলাগার মোহটা কেটে গেছে। ইদানিং তো ওর বড্ডো বেশি মনে হয়, ও শ্রাবণের ভালোলাগা ছিল মাত্র। ভালোলাগাকে, শ্রাবণ ভালোবাসা ভেবে তূবার জন্য পাগলামি করছে। এখন হয়তো শ্রাবণের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভালোলাগা আর ভালোবাসার পার্থক্য বুঝতে পেরেছে। সে কারণে তূবার প্রতি ভালোলাগার মোহটা কেটে যাচ্ছে। তাই সম্পর্কের উচ্ছ্বলতাও কমে গেছে। তূবার মনে পড়ছে না, শেষ কবে শ্রাবণ ওকে ভালোবাসি বলেছে।
বাড়ির সামনে আসতেই শ্রাবণ, তূবাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তূবার খুব কষ্ট লাগল। শ্রাবণ কিছু বলেও গেল না। তূবা, নিজের চোখের অশ্রু নিয়ন্ত্রণ করে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
দুদিন পর,
সন্ধ্যার পর শ্রাবণ পড়াতে আসলে তামিম বলল,
‘ভাইয়া?’
‘হুম।’
‘আপুর সাথে তোমার কী কিছু হয়েছে?’
‘না তো কেন?’
‘বিকালে জানালা দিয়ে দেখলাম খুব কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি। তুমি তো জানো আপুকে আমি ভয় পাই। তবে তার কষ্ট দেখলে আমার খুব কষ্ট লাগে। আজ বিকালে যেভাবে কাঁদল তাতে মনে হচ্ছে খুব কষ্টে আছে।’
তামিমের কথাগুলো শুনে শ্রাবণ চুপ করে রইল। বেশ কিছুমাস যাবত তূবাকে কোনো সময়ই ও দিতে পারে না। সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা গেল। সে কারণেই কিছু মাস যাবত খুব ব্যস্ত ছিল। কথার দূর্ঘটনার পর পরিবারের আনন্দগুলো কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে। সবার জীবনে প্রভাব ফেলেছে কথার দূর্ঘটনাটা।
শ্রাবণও কিছুমাস খুব কষ্টে ছিল। বিশেষ করে যখন দেখতো কথা খুব কষ্টে আছে, তখন কথার কষ্টে ও-ও কষ্ট পেত খুব। নিজের একমাত্র বোন বলে কথা। দুই ভাইয়ের জান কথা। সে বোনের এমন কষ্ট দুই ভাইকেই ভিতরে ভিতরে খুব নাড়িয়ে দিয়েছে।
ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হলেও আগের সে উচ্ছ্বলতাটা কমে গেছে। সে প্রভাব ফেলেছে তূবা, শ্রাবণের সম্পর্কেও। শ্রাবণ তো বুঝতেও পারেনি কথার দূর্ঘটনায় তূবা কতটা কষ্ট পেয়েছে। ও তো তা ভেবেও দেখেনি এতটা। প্রথম কয়মাস কথা দূর্ঘটনা আর পরিবারিক বিভিন্ন ঝামেলায় পড়ালেখা হয়ে ওঠেনি। তারপর পড়ল পড়ার প্রচণ্ড চাপ। গণিত নিয়ে অনার্স করাতো মুখের কথা না। কয়েকমাসের পড়া সব কাভার করতে হয়েছে। দিনরাত ডুবে ছিলো পড়ায়। সাথে মায়ের কোচিং তো চালিয়েছেই।
পড়ালেখা, পরিবার, কোচিং, কথা এতসব সামলাতে গিয়ে তূবার দিকটা একদম খেয়াল দিতে পারেনি। তূবার কথা যে শ্রাবণ ভাবেনি তা নয়। তূবার কথা ভেবেই পড়ালেখায় বেশি ডুবে ছিল। একে তো তূবার চেয়ে ছোটো, তারপর যদি ক্লাসে ফেল করে তাহলে তো আরও মুশকিল। যদিও ইয়ার গ্যাপ যাবে না। তবুও শ্রাবণ বরাবরের মতো সব বিষয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করতে চায়। তূবাকে পেতে হলে আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
এত সবের মধ্যে শ্রাবণ ভুলে গেছিল ওদের সম্পর্কটাকেও সময় দেওয়া দরকার। যে সম্পর্কের জন্য এতো কিছু করছে সে সম্পর্কটাকেও যত্ন নেওয়া দরকার। হুট করে শ্রাবণ বয়সের তুলনায় বড়ো হতে গিয়ে নিজের চাঞ্চল্য হারিয়ে ফেলেছে। যেটা শ্রাবণের চোখে ধরা না পড়লেও পড়েছে তূবার চোখে। আর শ্রাবণের এই বড়ো হওয়ার বিষয়টাকে তূবা ভেবে বসেছে শ্রাবণ ওকে ইগনোর করছে। অথচ আজও তূবাই, শ্রাবণের জান।
তামিমকে পড়ানো শেষে শ্রাবণ, তূবার রুমে গেল। তামিমা ঘরে থাকায় শ্রাবণ দরজা বন্ধ করল না বা তূবাকে তেমন কিছু বলতেও পারল না। তূবার দিকে তাকাতেই শ্রাবণের বুকটা কেমন হুঁ হুঁ করে উঠল। বিষন্নতা ছেয়ে আছে চোখে মুখে।
শ্রাবণ, তূবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাল দুপুরের পর তৈরি হয়ে বের হয়ো। তোমার সাথে কথা আছে।’
তূবার খুব অভিমান হলো। অভিমান করে ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল, ‘কাল দুপুরের পর আমার পরীক্ষা আছে।’
‘ওহ। তাহলে পরীক্ষার পর আমি তোমার কেন্দ্রের সামনে থাকব।’
‘না। পরীক্ষা শেষ হতে হতে পাঁচটা বেজে যায়। তোর সাথে দেখা করতে গেলে দেখা যাবে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে। বাবা, চাচি হাজারটা প্রশ্ন করবে। আমি পারব না।’
শান্ত কণ্ঠে শ্রাবণ বলল, ‘তাহলে কবে দেখা করতে পারবে?’
‘মঙ্গলবার আমার পরীক্ষা শেষ। তারপর একদিন দেখা করতে পারব।’
‘আচ্ছা তোমার যেদিন সময় হবে সেদিন বলো।’
‘আচ্ছা।’
শ্রাবণ যেতে যেতে বলল, ‘বাপারে! ভয়াবহ রেগে আছে। শ্রাবণ, এবার রাগ ভাঙাতে বেশ বেগ পেতে হবে তোকে।’
পরের কয়েকদিন তূবা, শ্রাবণের সাথে কথাই বলা বন্ধ করে দিলো। শ্রাবণ কল করলেও রিসিভ করে না। মেসেজের উত্তর দেয় না। তামিমকে পড়াতে গেলেও বাইরে বের হয় না। হয় রুমে থাকে, না হয় চাচির সাথে কাজে ব্যস্ত থাকে, নয়তো ওর মেজো চাচিদের বাসায় গিয়ে বসে থাকে। শ্রাবণ অনেক চেষ্টা করেও তূবার সাথে যোগাযোগ করতে পারল না। তূবা যেন দুজনার মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ হলো বিশদিন হলো অথচ তূবা, শ্রাবণকে সমান তালে এড়িয়ে চলছে। কোনো কথাই বলছে না।
এর মধ্যে শ্রাবণ খবর পেল তূবাকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে। পাত্র বিসিএস ক্যাডার। শুনলো তূবার পরিবারের সবারই ছেলে খুব পছন্দ। তারাও তূবাকে খুব পছন্দ করেছে। কথাবার্তাও একরকম পাকা হয়ে গেছে। এখন ছেলে মেয়ে দুজন একসাথে দেখা করার পর তারা যদি হ্যাঁ বলে তবে শীঘ্রই বিয়ে হয়ে যাবে।
এসব কথা শুনে শ্রাবণ পাগল প্রায়। ওর মনে হচ্ছে কলিজাটা ছিড়ে কেউ নিয়ে যাচ্ছে। ও তূবার সাথে যোগাযোগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বারবার যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কেউ নিজ থেকে যোগাযোগ করতে না চাইলে তার সাথে তো যোগাযোগ করা তো সম্ভব না। তূবা, শ্রাবণের মেসেজগুলো পর্যন্ত দেখে না। শ্রাবণের দিশেহারা লাগছে। বারবার ভাবছে কী এমন অন্যায় করল যার শাস্তি হিসাবে তূবা ওকে মৃত্যুদন্ডের চেয়েও কঠিন শাস্তি দিচ্ছে?
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪১
যখন তূবার সাথে যোগাযোগের সকল পথ বন্ধ মনে হলো, তখন শ্রাবণ নিজের কিছু কথা চিঠিতে লিখল। তারপর তামিমকে ডেকে বলল,
‘একটা হেল্প করবি?’
‘বলেন, ভাইয়া।’
‘এই চিঠিটা নিয়ে তূবাকে দিবি সাথে এটা বলি এই চিঠি যদি সাথে সাথে না পড়ে, আমাকে মেসেজ না করে তবে আমি খারাপ কিছু একটা করে ফেলব।’
তামিম বলল, ‘আচ্ছা।’
কিছুক্ষণ পর তামিম, তূবার রুমের কাছে গিয়ে বলল, ‘আপু আসব?’
‘হ্যাঁ আয়।’
তামিম, তূবার কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে চিঠিটা দিয়ে বলল, ‘শ্রাবণ ভাই এটা তোমাকে দিতে বলছেন। আর বলেছেন তুমি যদি এটা পড়ে এখনই তাকে মেসেজ না করো তাহলে সে খারাপ কিছু করে ফেলবে। ভীষণ রেগে আছে দেখলাম।’
তূবা বেশ ভয় পেলেও তামিমকে বুঝতে না দিয়ে বলল, ‘তুই যা আমি দেখছি।’
তূবা চিঠিটা খুলে পড়তে নিলো। কাটা কাটা শব্দে লিখা। লেখার ধরণেই বোঝা যাচ্ছে প্রচুর রেগে আছে। তূবাকে কাছে পেলে বেশ বকা দিতো।
শ্রাবণ লিখেছে,
“তূবা ঠিক পাঁচটার পর যদি তুমি আমাদের বাড়ি না আসো, আমি তবে সোজা তোমার বাবার কাছে গিয়ে বলব, তোমার আমার সম্পর্ক চলছে। শুধু সম্পর্ক না আমাদের মাঝে সবকিছু হয়ে গেছে। তারপর সব শুনে তোমার রাগী বাবা যদি আমাকে মার্ডার করেন তার জন্য দায়ী হবে তুমি। সিদ্ধান্ত তোমার। হয় আমাদের বাসায় আসো নাহয় বাকিটা বুঝে নিও।
আমার কথাকে মিথ্যা বা মজা ভেবে ভুল করো না। আমি পাঁচটা থেকে ছয়টা তোমার জন্য অপেক্ষা করব তারপর তুমি না আসলে সোজা তোমার বাবার আড়তে চলে যাব। তিনি তো সেই সময়ে তোমাদের আড়তেই থাকেন। তারপর ঐ জায়গায় বসে সব লোক জড়ো করে চিৎকার করে বলব আমি তূবাকে ভালোবাসি। বাকিটা তোমার বাপ বুঝবে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার।
আমি যে কতটা রেগে আছি তা চিন্তাও করতে পারবে না। চিঠিটা পড়ে আসবে কি আসবে না তা মেসেজ করবে। যদি বলো আসবে না তবে এখনই তোমাদের আড়তে যাব। তারপরের ঘটনা তোমার বাপের মুখ থেকে শুনে নিও।’
চিঠি পড়ে তূবার প্রচণ্ড রাগ হলো। কোথায় সরি টরি বলবে তা না হুমকি দিচ্ছে। মেজাজ খারাপ করে বলল, ‘দেখি ও কতদূরের হুমকি দিতে পারে।’
তূবা সাথে সাথে ফোন অন করে মেসেজ করল, “আমি আসব না।”
শ্রাবণ একটা ভয়েস মেসেজ পাঠালো, “ঠিক আছে ভালো থেকো। এরপর যা হবে তার জন্য কেবল তুমি দায়ী। আর হ্যাঁ আই লাভ ইউ।”
শ্রাবণের কণ্ঠস্বর শুনে তূবা চমকে গেল। শ্রাবণের এমন রাগী কণ্ঠ ও কখনো শোনেনি। তূবা দ্রুত শ্রাবণকে মেসেজ করল, “পাগলামি করিস না।”
কিন্তু মেসেজ সিন হলো না। তূবা কল করল শ্রাবণকে কিন্তু শ্রাবণের ফোন বন্ধ। ভয়ে তূবার কলিজা শুকিয়ে গেল।
ও দ্রুত বোরকাটা পরে, দৌড়াতে দৌড়াতে গায়ে ওড়না পেচালো। বোরকা পড়ল যদি শ্রাবণ ওর বাবার আড়তে যায়। তাহলে সেখানে যাবে। তারপর দ্রুত ছুটতে লাগল শ্রাবণদের বাড়িতে। শ্রাবণদের বাড়িতে গিয়ে দেখল শ্রাবণী দরজায় তালা দিচ্ছে।
তখন তূবা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘চাচি, কোথায় যাচ্ছো?’
‘আমার তো রোজই এসময় একটা টিউশনি থাকে।’
তাড়াহুড়ো করে তূবা বলল, ‘ওহ হ্যাঁ। ভুলে গেছিলাম। চাচি শ্রাবণ কোথায়?’
‘ও তো মাত্র সাইকেল নিয়ে রাস্তার মোড়ে গেল। বলল, তোদের আড়তে যাবে, তোর বাবার সাথে দেখা করবে।’
তূবা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ছুটতে লাগল। একটা রিকশা পেয়ে বলল, ‘চাচা জলদি চলেন।’
রিকশা দ্রুত ছুটে চলছে আর তূবার মনে চিন্তারা বাসা বাঁধছে। তূবার মনে হচ্ছে চিন্তার দরুণ ওর মাথার রকগুলো ফেটে যাবে। বুকের ভিতর কেউ জোরে জোরে হাতুটি পিটা করছে।
কিছুদূর যেতে দেখল, শ্রাবণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। তূবা রিকশা থামিয়ে শ্রাবণের সামনে নামল। চোখে মুখে রাজ্যের ভয়, চিন্তা, রাগ, অভিমান সব জড়ানো। তূবাকে দেখে শ্রাবণ দুষ্টু হাসল। তূবা রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়েই রইল।
কিছুক্ষণ শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থেকে রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চাচা কত টাকা?’
‘পনেরো টাকা।’
তূবা, শ্রাবণকে বলল, ‘উনার ভাড়া দে। আমি টাকা নিয়ে বের হইনি।’
শ্রাবণ ঠোঁট টিপে হেসে টাকা দিলো। তূবা আবার রিকশায় উঠে বসে বলল, ‘চাচা যেখান থেকে উঠাইছেন সেখাান দিয়ে আসেন।’
রিকশা চলতে শুরু করল আর শ্রাবণ সাইকেল নিয়ে রিকশার পাশে পাশে আসতে লাগল। তূবা, শ্রাবণের বাড়ির সামনে নেমে হনহন করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। শ্রাবণ আবার রিকশাওয়ালাকে টাকা দিয়ে বিদায় করে নিজেও বাড়ির মধ্যে ঢুকলো।
তূবা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রাবণ ওর কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলল। তূবা ভিতরে গেল। এ বাড়ির সবাই চাকরিজীবি। তাই সকালে বের হয় একেবারে সন্ধ্যার পর ফিরে। শ্রাবণী সারাদিন বাসায় বসে কোচিং করালেও এসময় একটা বাচ্চা মেয়েকে বাড়ি গিয়ে পড়ায়। কারণ মেয়েটা প্রতিববন্ধী। দুটো পা’ই পঙ্গু। সে বাচ্চাটা বাড়িতে পড়তে আসতে পারে না বিধায় শ্রাবণীর খুব মায়া হলো, তাই তাকে এ সময় বাড়ি গিয়ে পড়ায়।
শ্রাবণ ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তূবার দিকে ঘুরতেই তূবা ঠাস করে গালে দুটো চড় লাগিয়ে দিলো। তারপর বুকে পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো চড় থাপ্পর আর কিল। শ্রাবণ অনেক কষ্টে তূবাকে সামলে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো। এবার শুরু হলো তূবার ফুপিয়ে কান্না। উপচে পড়া চোখের পানিতে ভাসিয়ে দিতে লাগল এতদিনের রাগ, অভিমান, অনুযোগ।
কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কেন যাচ্ছিলি বাবার কাছে বল? ম* রা* র খুব শখ হয়েছে তোর। আয় আমি তোকে মে* রে ফেলি।’
শ্রাবণ আস্তে করে বলল, ‘আচ্ছা মে* রে ফেলো।’
তূবা সত্যি সত্যি শ্রাবণের গলা চে* পে ধ* র* ল। শ্রাবণ হাসতে লাগল। তূবা রাগের চোটে শ্রাবণের বুকে জোরে একটা কা* ম* ড় বসিয়ে দিলো। এবার শ্রাবণ ব্যথা পেলেও চুপ করে রইল। কামড় দিয়ে তূবা র* ক্ত* ই বের করে দিলো। শ্রাবণ বলল, ‘এখন রাগ কমছে?’
তূবা আবার কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এখন কেন বাবার কাছে যাচ্ছিলি? আমার প্রতি তোর কোনো ভালোবাসা আছে? আমি তো তোর ক্ষণিকের মোহ ছিলাম মাত্র। সেটা এখন কেটে গেছে। এখন আর আমাকে ভালো লাগে না, তাই ইগনোর করছিস। আমাকে এড়িয়ে চলছিস। বুঝিতো আমি সব। আমি শুধু তোর ভালোলাগা, ভালোবাসা না। সেটা এতদিনে বুঝতে পারছিস তাই তো…!
শ্রাবণ এতটা সাহস প্রথমবার দেখাল। সম্পর্কের এতদিন হবার পরও শ্রাবণ কখনো এমন ঐদ্ধত্য করেনি। সবসময় তূবার অনুমতির অপেক্ষা করেছে। আজ আর শ্রাবণ তূবার অনুমতির ধার ধারল না। তূবার মুখটা দুহাতে আবদ্ধ করে ওর ঠোঁটে আলত করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। তূবা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্রাবণ স্তব্ধ তূবাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘ভালোলাগা নয়, ভালোবাসা। তা-ও একজীবনে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একজনার প্রতি যে ভালোবাসা থাকে সেই ভালোবাসা।’
তূবা ফিসফিস করে বলল, ‘এটা তুই কী করলি শ্রাবণ।’
শ্রাবণ বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘যে আমার আছে, এবং আমারই থাকবে তাকে একটুখানি নিজের করে নিলাম।’
তূবা ফিসফিস করেই বলল, ‘কাজটা ঠিক করলি না।’
‘তো কী করতাম? যেভাবে ক্ষেপছিলা, থামানোর আর কোনো পথ ছিল?’
তূবা পাশে থাকা সোফায় বসল। শ্রাবণ পাশে বসে বলল, ‘রাগ করছো?’
‘কেন করলি এমন?’
‘এত কেন অভিমান তোমার? তুমি আমার ভালোবাসাটাকে এখনও বুঝলে না? এত কেন বোকা তুমি? ‘
তূবা আবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তো কী করবো নাচবো? আর আমি তো বোকাই। বোকা না হলে কেউ নিজের চেয়ে তিন বছরের ছোটো ছেলের সাথে রিলেশন করে? তা-ও আবার কাজিন।’
শ্রাবণ হেসে বলল,
‘হুম যাকে কিনা ল্যাংটু দেখছো। যার টুনটুনি পাখি ধরে টানছো।’
তূবা ভয়াবহ লজ্জা পেয়ে শ্রাবণের পিঠে কিল বসিয়ে বলল, ‘খবরদার কথার মাঝে কমেডি করবি না। এখন ভালোবাসা উতলে উঠছে। অথচ এতদিন কত অবহেলা করছিস।’
‘মোটেও না। তোমাকে অবহেলা করার কথা আমি কখনো ভাবতেও পারি না।’
‘তাহলে এতদিন কী ছিল ঐসব? ঠিকভাবে কথা বলিসনি, দেখা করা তো দূরের কথা। কল করলেই ব্যস্ত। রাতে কল করলে পড়ছি। দিনে কল করলে পড়াচ্ছি। ভার্সিটিতেও তেমন দেখা পেতাম না। আমাদের বাসায় গেলে তামিমকে পড়িয়েই দৌড়।’
শ্রাবণ শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি ভালো করে জানতা এসব কেন করছি? কথা আপুর দূর্ঘটনার পর আমাদের পরিবারের অবস্থা তুমি ভালো করে জানতা। সে শোক কাটিয়ে উঠার আগে ইনকোর্স পরীক্ষা শুরু হলো, তারপর নির্বাচনী পরীক্ষা, তারপর ইয়ার ফাইনাল গেল। নিজের পড়া, প্রাইভেট তারপর মায়ের কোচিং-এ জয়েন করেছি। আপুর ঘটনার পর মায়ের কোচিং এর চাপ সম্পূর্ণভাবে আমার উপর পড়ল। তাছাড়া ভার্সিটিতে এতদিন আমাদের ক্লাস রুটিন একদম ভিন্ন ছিল। চাইলেও দেখা করতে পারতাম না। তা-ও যখন সময় পেতাম তোমার কাছে চলে আসতাম।’
তূবা রাগ করে বলল, ‘পরীক্ষা তুই একা দিসনি আমিও দিয়েছি। কথার দূর্ঘটনায় কষ্ট কেবল তোরা একা পাসনি আমিও সমান কষ্ট পেয়েছিলাম। তুই ভালো করে জানতি কথার বাচ্চাদের নিয়ে আমার কত কত স্বপ্ন ছিল। ওর বাচ্চাদের নিজের ভাবতে শুরু করেছিলাম। কারণ আমি তো…!’
শ্রাবণ, তূবার মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘এ কথা বলতে নিষেধ করেছিলাম না?’
তূবা নিজের মুখ থেকে শ্রাবণের হাত সরিয়ে বলল, ‘আর এত তাড়াতাড়ি তোকে কে বলছে এত চাপ নিতে? কোচিং প্রাইভেট কী দরকার এত দ্রুত এত কিছু করার?’
শ্রাবণ নিচে বসে তূবার হাত দুটো মুঠোবন্দী করে বলল, ‘তোমাকে পেতে হবে। সে জন্য আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমার কাছে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যথেষ্ট সময় থাকলেও তোমার বিয়ের সময় কম। হুট করে কে কখন তোমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে যায় সে ভয়ে অস্থির থাকি সবসময়।’
“রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” কিন্তু প্রকাশিত হয়ে গেছে। আপনার কপি অর্ডার করেছেন তো?
শ্রাবণের কথা শুনে তূবা শ্রাবণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, ‘এতই যখন ভালোবাসিস তাহলে আমাকে একটু সময় কেন দিসনি?’
‘ভুল হয়েছে। সরি। এই দেখো কান ধরছি। আর কখনো হবে না।’
তূবা আবার শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরল। শ্রাবণও, তূবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমার বিয়ের কথা কী শুনছি? কোন বিসিএস ক্যাডার ফ্যাডার নাকি আসছে? শোনো তুমি শুধু আমার। কোন ক্যাডার তোমার বাড়ি তোমাকে দেখতে যায় তাকে আমি দেখে নিব। ঐ বিসিএস ক্যাডারকে আমি খোড়া ক্যাডার করে দিব। কোন শালা যাচ্ছে তোমাকে দেখতে।’
তূবা হেসে বলল, ‘আসবার কথা ছিল। এখন আর আসবে না।’
‘কেন?’
‘আমি বাবাকে নিষেধ করেছি।’
‘কী বলে নিষেধ করছো?’
‘বলেছি নিজে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করব না। আর ছেলে পক্ষকে ফোন করে কেউ একজন বলেছে মেয়ে কোনো দিন মা হতে পারবে না। সে কারণে তারাও বিয়ে ভেঙে দিছে।’
‘কে এমন ফালতু কথা বলে বিয়েতে ভাঙানী দিছে? ভাঙানী দেওয়ার জন্য কথার অভাব আছে?’
তূবা মুখ টিপে হেসে বলল, ‘আমিই ফোন করে ভাঙানি দিছি।’
‘কী?’
‘তো কী করতাম? বিয়ে করে নিতাম? তোকে ছাড়া কাউকে নিজের পাশে ভাবতেই পারি না। আর ঐ ছেলের এবং তার পরিবারের আমাকে দেখে এত পছন্দ হয়েছিল যে, যেদিন দেখতে আসবে সেদিনই আকদ সারতে চেয়েছিল। ছেলেতো পুরা পাগল বিয়ে করার জন্য। তো কীভাবে বিয়ে ভাঙতাম? মেয়ে যতই সুন্দরী হোক, তার এমন ত্রুটি থাকলে তাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। তাই সেটাই কাজে লাগাম। আজ সকালেই বিয়ে ভেঙেছে। খবরটা অবশ্য বাইরে এখনও তেমন ছড়ায়নি।’
শ্রাবণ বলল, ‘তোমার কোনো ত্রুটি নেই। তুমি আমার কাছে বৃষ্টির মতো বিশুদ্ধ, পবিত্র। যে শুধু ভালোবাসা দিতে জানে। তুমি ফোন করে ঐ ফালতু কথাটা না বললেই হতো।’
তূবা হেসে বলল, ‘এবার ছেলে যেমন পিছে পড়ছিল তাতে এটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।’
শ্রাবণ হেসে বলল, ‘এতে তো দোষ ছেলের না। তুমি দেখতে এতটা মিষ্টি যে, যে কেউ তোমাকে দেখলেই ফিদা হয়ে যায়।’
তূবা হাসল। শ্রাবণ বলল, ‘রাগ কমছে?’
‘হুম।’
শ্রাবণ হেসে উঠে ভিতরে স্যাভলন পানি এনে তূবাকে বলল, ‘এখন যে জায়গা কামড়ে রক্তাক্ত করছো সেখানটা ক্লিন করে দাও।’
শ্রাবণ শার্টের বোতাম খুলে বুক উন্মুক্ত করতেই তূবা আৎকে উঠল। বেশ রক্ত বের হয়েছে। অথচ শ্রাবণ এতক্ষণ যাবত নীরবে তূবার সব রাগ, অভিমান, অভিযোগ সহ্য করছিল। তূবা চোখ ভরে এলো।
কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, ‘সরি। আমি বুঝতে পারিনি।’
শ্রাবণ হেসে বলল, ‘সরি বলতে হবে না। বরং নিজের উডবির কাছ থেকে প্রাপ্য ফাস্ট লাভ বাইট।’
কথাটা শুনে তূবা এত লজ্জা পেল যে শ্রাবণের চোখের দিকে আর তাকালই না।
তূবা সুন্দর করে স্যাভলন দিয়ে কামড়ের জায়গাটা পরিষ্কার করে সেখানে বেশ কয়েকটা চুমু খেলো। শ্রাবণ বলল, ‘একটা কামড়ের পর যদি এতো চুমু পাওয়া যায় তাহলে নেও আমার সারা বুক পিঠ কামড়ে দাও।’
তূবা, শ্রাবণের মাথায় মারল। শ্রাবণ বলল, ‘কদিন বাসার কারও সামনে শার্ট খোলা যাবে না।’
‘কেন?’
শ্রাবণ দুষ্টু হেসে বলল, ‘এই কামড়ের দাগ দেখলে কী না কী ভেবে বসে।’
তূবা লজ্জায় কুকড়ে গিয়ে বলল, ‘আমি বাড়ি যাই।’
শ্রাবণ নিজের কাছে টেনে বলল, ‘এহ আসছে বাড়ি যাই। কেবল সাড়ে পাঁচটা বাজে ছয়টা পর্যন্ত থাকবা আমার সাথে। কতমাস পর দুজন এমন করে কাছে থেকে সময় কাটাচ্ছি বলো তো?’
‘সেটা সম্ভব না। তোর টেনশনে বাসায় কিছু বলে আসিনি। আর এত মাস তোর দোষে তুই সময় কাটাসনি।’
শ্রাবণ হেসে বলল, ‘আসলে তেমন কিছু না। আমি সবকিছু গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সবকিছু গোছাতে গিয়ে, না চাইতেও তোমাকে সময় কম দিয়ে ফেলেছি। আসলে আমি নিজেও বুঝতে পারিনি তোমাকে এতটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু কদিন যাবত তোমার আমাকে এড়িয়ে চলাটা বুঝিয়ে দিলো, আমি আসলে তোমাকে কষ্ট দিয়েছিলাম। সরি তূবা।’
তূবা স্মিত হেসে বলল, ‘আর ওমন করিস না প্লিজ। এমনিতেই আমাদের সম্পর্ক নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকি তারপর যদি তুই মিন করিস তাহলে আমার কী হয় ভাব তো?’
শ্রাবণ, তূবার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, ‘আর এমন হবে না।’
তূবা হেসে বলল, ‘সত্যি সত্যি আজ বাবার কাছে গিয়ে ঐসব বলতি?’
‘তুমি না আসলে সত্যি যেতাম। সব বলতাম। আজ যা হবার হতো। হয় এসপার, নাহয় ওসপার।’
তূবা, শ্রাবণের চুল এলোমেলো করে বলল, ‘পাগল একটা।’
‘তা তুুমি বোরকা পরে কেন?’
তূবা হেসে বলল, ‘তুই যেমনে রাগ করছিলি ভয় পেয়ে গেছিলাম, বাসার জামা পাল্টানোর সময় ছিল না। তাই কোনমতে বোরকা পরে ওড়না পেচিয়ে দৌড়েছি।’
শ্রাবণ হেসে বলল, ‘এত কেন ভালোবাসলে?’
তূবা লাজুক হাসল। কিছু প্রশ্নের আলাদা করে কোনো উত্তর হয় না। অনুভব ও অনুভূতিতে মিশে থাকে না বলা কথাগুলো।
৪২!!
কথা গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিল। যেতে যেতে হঠাৎ সিন্থিয়ার মতো কাউকে দেখে দ্রুত গাড়িটা থামাতে বলল ড্রাইভারকে।
“রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” শীঘ্রই পাঠানো শুরু হবে। আপনার কপি অর্ডার করেছেন তো? ৩৫% ছাড়ে অর্ডার করতে আমাকে করুন। এ অফার আর সীমিত সময়ের জন্য আছে।
চলবে…