#অরণ্যে_রোদন
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪২
কথা গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিল। যেতে যেতে হঠাৎ সিন্থিয়ার মতো কাউকে দেখে দ্রুত গাড়িটা থামাতে বলল ড্রাইভারকে। গাড়ি থামিয়ে কথা গাড়ি থেকে নেমে সিন্থিয়াকে পিছন থেকে ডাকল, ‘সিন্থিয়া!’
সিন্থিয়া পিছু ফিরে তাকাতেই দেখল কথা ওর দিকে আসছে। কথা ওর কাছে আসতেই ছোটো খাটো একটা ধাক্কা খেলো। এ কোন সিন্থিয়াকে দেখছে কথা! কোথায় সেই আগের মতো উপছে পড়া সৌন্দর্য? শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মেয়েটা। গায়ের রঙ আগের চেয়ে অনেক শ্যামলা হয়ে গিয়েছে। রুক্ষ শুষ্ক চেহারা, চুলগুলোও রুক্ষ, গায়ের জামাটা, জুতা দেখলেই বোঝা যায় খুব সস্তা। চেহারায় নেই আগের সে কোমলতা, মলিন মুখটা দেখলেই যেন মায়া লাগে। কথা কী বলবে ভেবে পেল না না।
তাই জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন আছিস?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিন্থিয়া বলল,
‘এইতো ভালো আছি। তুই?’
‘হ্যাঁ, ভালো আছি। তুই তো যেন গায়েবই হয়ে গেলি। হুট করে ভার্সিটি ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে গেছিল? গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিলি? আর চেহারার এমন অবস্থা কেন?’
কথার কথাগুলো সিন্থিয়ার জন্য যেন কাটা ঘা’য়ে লবনের ছিটা দেওয়ার মতো। সিন্থিয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘আমার মতে তুই সবই জানিস। না জেনে পারিস না। কারণ তোর সাথে ঐ সব করার পর আমার ধারণা, তুই আমার সব খবরই রাখতি।’
কথা বিদ্রুপ হেসে বলল,
‘আমার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তোর খোঁজ রাখতে যাব! যার জন্য আমার জীবনটাই ওলট পালট হয়ে গেছে, তার খোঁজ রাখতে যাব! আমি কী তোর খোঁজ রাখার জন্য টাকা পাই? জানিস তুই যখন আমাদের জীবনে ঝড় আনলি তখন আমি প্রেগনেন্ট ছিলাম। জমজ সন্তান ছিল আমার। কিন্তু তারা কেউ বেঁচে নেই। কোথাও না কোথাও তুই-ই দায়ী এ জন্য। আমি বা আল্লাহ কখনো ক্ষমা করব না তোকে। কোনো দিনও না। আমার জীবনে ঝামেলা বাঁধিয়েছিস, দেখিস আল্লাহ তোর জীবনটা জাহান্নাম করে দিবেন।’
সিন্থিয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘গত দুই বছর যাবত আমি জাহান্নামেই আছি। আর তোর কথা শোনার সময় নেই আমার। আমার কাজ আছে।’
সিন্থিয়া চলে যেতেই কথা বিড়বিড় করে বলল,
‘আমার তো সময় অঢেল। যত্তসব। আল্লাহ ওকে ক্ষমা করো না, কখনো না।’
সিন্থিয়া যেতে যেতে একা একা বলল,
‘আমার সুখের জীবনটা যারা নষ্ট করেছে তাদের আমি ছেড়ে দিব ভাবছিস কথা? তোর সকল খোঁজ আমি রাখতাম। তোকেও একটা মোক্ষম শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার আগে তুই নিজেই শাস্তি পেলি। তোকে তাই ছেড়ে দিলাম।
এখন আছে জবা চৌধুরি। তাকে তো খুন না করা অব্দি আমি শান্তি পাব না। আমার আর ইরফানের জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিয়েছে কুত্তিটা। ওর জীবনে আর বেশি দিন বাকি নেই। প্রথমে ওকে মারব তারপর ওর মেয়েকে। তারপর ওরই সম্পত্তিতে আমরা রাজ করব। জবা চৌধুরিকে মারার লম্বা ছক কষা হয়ে গেছে। জাস্ট প্ল্যানমাফিক কাজ করা বাকি।’
সিন্থিয়া আপনমনে হেসে বলল,
‘কথা মজার কথা শুনবি? আমারও পরিকল্পনা ছিল তোর বাচ্চাদের মারা। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না কীভাবে মারব? কিন্তু আমার ভাবার আগেই তোর দূর্ঘটনাটা হয়ে গেল। কুল না!
রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার কথাটা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। যেখানে প্রকৃতি আমাকে শাস্তি দিবে, তা না দিয়ে তোকে আর নিহাদ স্যারকে দিয়েছে। প্রকৃতি আমার সাথে যা খারাপ করার তা তো করেই ফেলছে। এখন আমার সাথে যারা খারাপ করেছে, তাদের অবস্থা খারাপ করার পালা। বাদ যাবে না আমার বাবা-মা, বোনও।’
সিন্থিয়া ভয়াবহ ভঙ্গিতে হাসল। ওর ঐ বিভৎস হাসি দেখলে হয়তো সুস্থ মানুষের গায়ে ভয়ে কাটা দিতো। হাসতে হাসতে সিন্থিয়া বলল,
‘বাই দ্যা ওয়ে তোর নিহাদকে ছাড়ার পরিকল্পনা আমার এখনও নেই। নিহাদের কাছে আর একবার হলেও যাব। হি ইজ টু গুড!’
(সিন্থিয়া, জবা চৌধুরি, ইরফান চৌধুরিকে নিয়ে নতুন থ্রিলার উপন্যাস লেখা হবে এই উপন্যাসটা শেষ হলে। আর আমার নতুন বইটা অর্ডার করেছেন তো?’
বাইরের কাজ সেরে কথা বাড়ি ফিরে, রাতে খেতে বসে দেখল, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক, মুসুরি ডাল আলু দিয়ে চচ্চরি, রুই মাছের ঝাল আর আমের চাটনী। কথা খাবার দেখে মুচকি হাসল।
ও জানে এগুলো মোমেনা ওর জন্য রান্না করছে। সকালে যাবার পূর্বে কথা কাঁচা বাজারের মধ্যে কচুশাক দেখে, কাজের মেয়ে জেবুকে বলেছিল ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুশাক রান্না করতে। কথাটা কথা কাজের মেয়েকে বললেও ওর উদ্দেশ্য ছিল শাশুড়িতে শোনানো।
ইদানিং বড়োই বিচিত্র ভঙ্গিতে দুজনার মাঝে কথা হয়। যেমন: কথা কচুশাক মুখে দিয়ে ওর শ্বশুরকে বলল,
‘বাবা, কাউকে বলে দিন কচুশাক খুব মজা হয়েছে। আমের চাটনীটাও খুব ভালো হয়েছে।’
নয়ন, মোমেনার দিকে ঘুরে বলল,
‘এই কেউ একজন, কচুশাক খুব মজা হয়েছে। আমের চাটনীটাও খুব ভালো হয়েছে।’
মোমেনা চোখ পাকিয়ে নয়নের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার কান আছে শুনেছি। তুমিও কাউকে বলে দাও যেটাকে রুই মাছের ঝাল ভাবছে সেটা আসলে রুই মাছ না পাঙ্গাস মাছ। পাঙ্গাস মাছ সে খায় না। তার জন্য আলাদা করে তেলাপিয়া মাছ ভূনা করা হয়েছে, জেবু যা তো রান্না ঘর থেকে নিয়ে আয়।’
কথা বলল,
‘বাবা, মাছের ঝাল কেন করা হয়েছে? কারো গ্যাস্টিকের সমস্যা ইদানিং খুব বেড়েছে। সেটা কি সে ভুলে গেছে? সে যেন একটু বুঝে শুনে খায়।’
দুজনার কান্ড দেখে ফাতিমা বিড়বিড় করে নিহাদকে বলল,
‘নিহাদ, এ নাটক আর কদিন চলবে?’
নিহাদ বলল,
‘কি জানি দাদি? দুজনার কাউকেই কিছু বলার সাহস পাই না। কিছু বললেই ফস করে ওঠে। মাকে কিছু বললে কথা ফস করে ওঠে, কথাকে কিছু বললে মা। তারচেয়ে বরং দুজনকে সময়ের উপর ছেড়ে দাও। আগের চেয়ে অনেকটা তো ঠিক হয়েছে। কদিন পর দেখবা পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে।’
খাবার পর কথা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। নিহাদ পাশে এসে বসতেই কথা বলল,
‘আমার অফিস যাওয়াটা জরুরি?’
‘জরুরি না। তবে মাঝে মাঝে যেতে হবে। বাবার রিসেন্টলি তো সেটাই বললেন। তার সব সম্পত্তি আমার আর তোমার নামে সমানভাগে লিখে দিয়েছেন। সে কারণে না চাইতেও তোমাকে মাঝে মাঝে অফিসে যেতে হবে।’
‘আমার ভালো লাগে না।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
‘কদিন পর তো তোমার মাস্টার্সও শেষ হয়ে যাবে। বাইরে চাকরি না করে তুমি আমাদের অফিসে জয়েন করতে পারো। এক কাজ করো, তূবাকেও আমাদের অফিসে জয়েন করতে বলো।’
কথা মৃদু হেসে বলল,
‘তাহলে সেটা অফিস না আমার আর তূবার আড্ডাখানা হবে।’
নিহাদ হালকা হেসে বলল,
‘তাও ভালো। সেই সুযোগে যদি তুমি একটু একটু করে আগের কথা হয়ে ওঠো।’
কথা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিহাদ, কথার পাশে শুয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলো। নিহাদ, কথার কপালে চুমু খেলো। কথার এবার আগের মতো নীরব পাথরের মতো থাকল না। অনুভূতিরা একটু সারা দিয়েছে। কথাও নিহাদের কপালে চুমু আঁকল। নিহাদ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘কত দিন পর।’
কথা আরও একটু ঘনিষ্টভাবে নিহাদকে জড়িয়ে ধরল। ভালোবাসা একটু একটু করে গভীর হতে লাগল দুজনার। অনেকদিন পর যেন দুজন দুজনার কাছে নিজেদের মেলে ধরতে লাগল। নিহাদ গভীর আবেশে কথাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ভালোবাসি।’
কথা ফিসফিস করে বলল,
‘আমিও।’
৪৩!!
ভার্সিটি থেকে ফিরছে তূবা। কদিন পরই মাস্টার্স এর ফাইনাল পরীক্ষা। কিছু জরুরি কাজে ভার্সিটিতে গিয়েছিল। তূবাকে, তারিক সাহেব স্কুটি কিনে দিয়েছেন। তাতে করেই তূবার আসা যাওয়া। ফেরার পথে রাস্তার মোড়ে শ্রাবণকে দেখে বলল,
‘কি জনাব লিফ্ট লাগবে?’
শ্রাবণ হেসে বলল,
‘লেডি ড্রাইভারের লিফ্ট মিস করা মানে বড় ধরণের লস। আমি এ লস করতে চাই না।’
শ্রাবণ পিছনে উঠে বসল। তূবার চুল বাঁধা দেখে শ্রাবণ চুলের কাটটা খুলে দিলো। এলো স্লিক্লি চুলগুলো বাতাসে উড়ে শ্রাবণের মুখে পড়তে লাগল।
তূবা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘শ্রাবণ, চুল খুললি কেন?’
‘তোমার চুলগুলো যখন উড়ে উড়ে আমার মুখে ছুঁয়ে যায়, আমার তখন ভীষণ ভালো লাগে।’
তূবা স্কুটি থামিয়ে বলল,
‘তোর ভালো লাগার চক্করে চুল যদি চোখে উড়ে পড়ে তাহলে এক্সিডেন্ট হবে ইডিয়েট।’
শ্রাবণ আবার তূবার চুলগুলো বেঁধে কাটাটা আটকে দিলো। তূবা হেসে বলল,
‘ধন্যবাদ।’
শ্রাবণ চারদিকে চোখ বুলিয়ে গলার পিছনে টুপ করে একটা চুমু খেলো। তূবা ভয়াবহ কেঁপে উঠে বলল,
‘ইদানিং তোর সাহস খুব বেড়েছে। কোনদিন জানি আবার একদফা ধোলাই খাস আমার হাতে।’
শ্রাবণ হেসে বলল,
‘তুমি যতবার মে* রে* ছো তারপর তারচেয়েও বেশি আদর করেছো। এ জন্য তোমার মা* ই* র আমার কাছে শুভ লক্ষণ।’
তূবা হেসে বলল,
‘পাগল একটা।’
শ্রাবণ পিছন থেকে শক্ত করে তূবার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
‘চলো ড্রাইভার, আমি শক্ত করে ধরে বসেছি।’
তূবা হেসে বলল,
‘হাত সরা। নয়তো হাত ভেঙে দিব। এলাকার রাস্তায় বসে কেমন ফাজিলের মতো কোমর জড়িয়ে ধরছে। লোকে দেখতে কী ভাববে?’
’কিছু ভাববে না। তুমি চলো। আর কোমর কোথায় ধরছি? পরে আছো তো কামিজ, আমি কামিজের উপর হাত দিয়ে আছি। যদি শাড়ি পরতা তাহলে বলতে পারতা কোমর ধরছি।’
তূবা রাগি কণ্ঠে বলল,
‘এবার কিন্তু আমি সত্যি সত্যি রেগে যাচ্ছি।’
শ্রাবণ কোমর ছেড়ে বলল,
‘আচ্ছা চলো।’
শ্রাবণকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেওয়ার সময় বর্ষণ তখন বাড়ির গেটের সামনেই দাঁড়ানো ছিল। দুজনকে একসাথে দেখে বর্ষণ বলল,
‘শ্রাবণ, তূবা ভিতরে আয়। মানে বাগানের চেয়ারে আয়। তোদের সাথে আমার জরুরি কথা আছে।’
দুজনেই বেশ ভয় পেয়ে গেল। তা-ও দুজনই বর্ষণের পিছু পিছু গেল। বর্ষণ বলল,
‘বস।’
দুজন বসার পর বর্ষণ, তূবার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘সরি টু সে তূবা, কিন্তু তোর থেকে আমি এটা আশাকরিনি।’
তূবা ভয়ার্ত চোখে বর্ষণের দিকে তাকাল। বর্ষণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আমি এতোদিন জানতাম শ্রাবণ তোর পিছনে ঘোরে, কিন্তু তোরা যে এতদিন যাবত রিলেশনে আছিস সেটা কিছুদিন আগে জানলাম।
তূবা, তোর মতো ম্যাচিওর মেয়ে এমন অসম অনিশ্চিত একটা সম্পর্কে কী করে জড়ালো? শ্রাবণের কথা নাহয় বাদ দিলাম, ও ইমম্যাচিওর, ছোটো, বয়স কম, ভালো লাগাটাকে ও ভালোবাসা ভেবে বসে আছে, কিন্তু তুই ম্যাচিওর বয়সের হয়েও কী করে ভুল করলি?’
শ্রাবণ বলে উঠল,
‘ভাইয়া, আমার বয়স কম বাট আমি ইমম্যাচিওর নই। আর আমার এতটুকু বোঝার বয়স হয়েছে কোনটা ভালোলাগা আর কোনটা ভালোবাসা!’
বর্ষণ ধমক দিয়ে বলল,
‘তুই চুপ থাক। আমি তূবার সাথে কথা বলছি। তুই আর একটা কথাও বলবি না। বেটার হয় তুই ঘরে যা।’
রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” শীঘ্রই পাঠানো শুরু হবে। আপনার কপি অর্ডার করেছেন তো? ৩৫% ছাড়ে অর্ডার করতে আমাকে করুন। এ অফার আর সীমিত সময়ের জন্য আছে।
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪৩
বর্ষণ ধমক দিয়ে বলল,
‘তুই চুপ থাক। আমি তূবার সাথে কথা বলছি। তুই আর একটা কথাও বলবি না। বেটার হয় তুই ঘরে যা।’
শ্রাবণ বেশ কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘আমি কোথাও যাব না। তূবাকে যা বলার আমার সামবে বলো।’
বর্ষণ বেশ কড়া ভাষায় বলল,
‘তাহলে তুইও শোন। তূবা, তোদের এ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?’
তূবা নিশ্চুপ। শ্রাবণ বলল,
‘আমরা বিয়ে করব।’
বর্ষণ আবারও ধমক দিয়ে বলল,
‘তোকে কথা বলতে নিষেধ করছি না? এখানে থাকবি থাক। কিন্তু চুপ করে থাকবি একদম। আমি যা বলার তূবাকে বলব। তুই একটা কথা বললে তোকে থা* প* ড়া* বো।’
তূবাও বলল,
‘শ্রাবণ, তুই চুপ থাক।’
শ্রাবণ চুপ করে বসে রইল। বর্ষণ বলল,
‘বল কিছু, তূবা?’
‘কী বলব, ভাইয়া?’
‘তোদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?’
‘আমি জানি না।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বর্ষণ বলল,
‘কেন জেনেশুনে তোরা আগুন নিয়ে খেলছিস বল? গতসপ্তাহে তোর বাবা একটা ছেলেকে পিটিয়ে তার দুটো পা-ই ভেঙে দিয়েছিল। কারণ ছেলেটা তোকে বিরক্ত করত। ছেলেটা আর জীবনে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। এ পূর্বেও বেশ কিছু ছেলের একই অবস্থা করেছিলেন চাচ্চু। কারণ একটাই তোকে বিরক্ত করা। সেখানে যদি তোর আর শ্রাবণের সম্পর্কের কথা শোনেন তাহলে বুঝতে পারছিস শ্রাবণের কী অবস্থা হবে?’
‘তূবা নিশ্চুপ।’
বর্ষণ অাবার বলল,
‘এসব কিছু না হয় বাদ দিলাম। বর্তমানে দুই পরিবারের সম্পর্ক কত সুন্দর! একে অপরের বাড়ি যাওয়া আসা চলছে। যে কোনো রকম অনুষ্ঠানে দুই পরিবার এক হচ্ছে, একে অপরকে দেখে হাসি খুশি ভাবে কথা বলছে। এমন কি যে জমিটা নিয়ে এত বছর যাবত ঝামেলা চলে আসছিল। সেটা নিয়েও সমাধান হয়েছে। দুই পরিবারই কোর্টের রায় মানতে রাজি হয়েছে। তোরা কী চাস তোদের কারণে সুন্দর সম্পর্কটা আবার নষ্ট হোক?’
শ্রাবণ বলল,
‘সম্পর্কটা আমাদের কারণেই সুন্দর হয়েছে। আমি আর তূবা চেষ্টা করে সুন্দর করেছি। নয়তো তোমার কি মনে হয় দাদার আমল থেকে চলে আসা এত ঝামেলা হুট করে নিজে নিজে ঠিক হয়ে গেল? আমাদের সম্পর্কটা যাতে পূর্ণতা পায় সে কারণেই অনেক চেষ্টা করে সব সম্পর্কগুলো সুন্দর করেছি।’
বর্ষণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘এতো কিছু করেছিস তারপরও কি মনে হয় তোদের সম্পর্ক সবাই মেনে নিবে? তূবা তোর কি মনে হয় তোর বাবাকে রাজি করাতে পারবি?’
আমার নতুন বই “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” সংগ্রহ করেছেন তো?
তূবা কিছু না বলে চুপ করে উঠে চলে গেল। শ্রাবণ ওর যাবার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বর্ষণকে বলল,
‘ভাইয়া, ওকে এসব বলা জরুরি ছিল? ও এমনিতেই ভীষণ ভীতু। দেখা যাবে আবার আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে।’
বর্ষণ যেতে যেতে বলল,
‘সেটাই বেটার হবে।’
শ্রাবণ চুপ করে বসে রইল।
তূবা বাড়ি গিয়ে সারাদিন বর্ষণের কথাগুলো ভাবলো। রাতের বেলা তামিমাকে রুমে ডেকে বলল,
‘চাচি, কিছু কথা বলি?’
‘বল।’
‘আগে ভালো করে শুনবা। তারপর তুমি যেটা বেটার হয় সেটা বলবা।’
‘আচ্ছা।’
‘চাচি, আমার এক বান্ধবী একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসে।’
‘তো সমস্যা কোথায়? আজকাল রিলেশন তো কমন ব্যাপার।’
‘সমস্যা হলো আমার বন্ধবী ছেলেটার চেয়ে দুই তিন বছরের বছর।’
‘কী?’
‘হ্যাঁ।’
‘আরেকটা সমস্যা হচ্ছে ওদের দুই পরিবারের মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে মনোমালিণ্য ছিল। বর্তমানে তা নেই। এখন মেয়েটা ভয় পাচ্ছে ওদের রিলেশনের কথা পরিবার জানলে দুই পরিবারের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। তোমার কী মনে হয়?’
তামিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘শুধু সম্পর্কই খারাপ হবে না। তোর বাবা হয়তো শ্রাবণকে মেরে ফেলবে।’
তূবা চমকে তামিমার দিকে তাকাল। তামিমা বলল,
‘কী ভাবছিস আমার চোখের সামনে তুই আর শ্রাবণ সম্পর্ক চালাবি আর আমি সেটা বুঝতে পারব না? বুঝতে অনেক আগেই পেরেছি। তোকে আকার ইঙ্গিতে বারবার ফিরে আসতেও বলেছি, কিন্তু তুই বুঝিসনি।
তামিমের এসএস সি শেষ হবার পর ইন্টারে ভর্তি হলো, ওকে শ্রাবণের কাছে উচ্চতর গণিত পড়তে না দিয়ে কোচিং-এ দিলাম। কেন? কারণ যাতে আমাদের বাসায় শ্রাবণের আসা যাওয়া কম হয়। তোকে কতভাবে আকার ইঙ্গিতে বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে তুই ভুল করছিস, কিন্তু তুই আমার কোনো কথা বুঝতে পারিসনি নাকি বুঝতে চাসনি সেটা তুই ভালো জানিস। তুই নিজে ভাব তোরা দুজন চাচাতো ভাই-বোন। শ্রাবণ তোর চেয়ে তিন বছরের ছোটো। তো কীভাবে সম্ভব বল? তোর মনে হয় তোর বাবা জীবনে রাজি হবে?’
তূবা এবারও চুপ করে রইল। বর্ষণ কিংবা তামিমা দুজনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ওর কিংবা শ্রাবণের চেয়ে অনেক বেশি। আর তারা ভুল কিছুও বলেনি। তূবা মাথাটা চেপে ধরে বসে রইল।
কদিন যাবত তূবা সত্যি সত্যি শ্রাবণকে অনেকটা এড়িয়ে চলছে। যদিও ফোনে কথা বলছে। তবে সময় খুব কম দিচ্ছে, দেখা করছে না। শ্রাবণ বুঝতে পারছে এটা কোথাও না কোথাও বর্ষণের কথার কারণেই।
আজ শ্রাবণের বন্ধুর এক ফ্ল্যাটে দুজন দেখা করবে। তূবা দেখা করতে চেয়েছে। নীরা সাত মাসের প্রেগনেন্ট। ওর কিছু সমস্যার কারণে ডাক্তার ফুল বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। সে কারণে জব ছেড়ে দিতে হয়েছে। নীরা এখন সবসময়ই ঘরে থাকে, সাথে নীরার দেখা শোনার জন্য শ্রাবণী। এখন আর চাইলেও শ্রাবণ, তূবা, শ্রাবণদের বাসায় একসাথে দেখা করতে পারে না। সে কারণে শ্রাবণ ওর এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে দেখা করে।
ফ্ল্যাটে বসে অনেকক্ষণ ওরা নিজেদের সম্পর্কের বিষয়ে অনেক কথা বলল। তূবা, শ্রাবণকে বারবার বলতে লাগল সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার কথা। কিন্তু শ্রাবণ বুঝার পাত্র না। ওর একই কথা, ও পুরো বিষয়টা দেখবে তূবাকে কিছু ভাবতে হবে না। ওর কারো সাথে কোনো কথা বলতে হবে না। যা বলার ও-ই সবার সাথে বলবে। কিন্তু তূবাও শ্রাবণের কথা শুনল না।
বারবার বলল,
‘এত বছর পর দুই পরিবারের সম্পর্ক এতো ভালো হলো, আমি চাই না, তা আর নষ্ট হোক।’
‘নষ্ট হবে না, তূবা। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।’
তূবা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘এটাই আমাদের শেষ কথা শ্রাবণ’
‘না।’
‘হ্যাঁ।’
‘প্লিজ তূবা।’
‘সম্ভব না শ্রাবণ।’
তূবা চলে যেতে নিলে শ্রাবণ ওর হাত টেনে ধরল। তারপর নিজের কাছে এনে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরল। শ্রাবণের চোখ দিয়ে বইতে লাগল শ্রাবণের জলধারা। তূবা চোখ থেকেও ঝড়ছে অর্নগল অশ্রু। শ্রাবণ বলল,
‘প্লিজ তূবা।’
‘না।’
‘তোমার কিছু চিন্তা করতে হবে না। পরিবার সমাজ সব আমি দেখব। সবটা আমি সামলাবো। তুমি শুধু আমায় ভালোবাসো। আর কিছু করতে হবে না তোমার।’
তূবা অনেকক্ষণ শ্রাবণের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তূবা পা উচু করে শ্রাবণের চোখে চুমু খেলো। তারপর শ্রাবণের পায়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। চোখ বন্ধ করে দুজনেই অনুভব করতে লাগল দুজনার অমৃত শুধা। কিছুক্ষণ পর তূবা শ্রাবণকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘আমার জমানো সব ভালোবাসা তোকে দিয়ে দিলাম। এরপর তুই আর আমার কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসবি না।’
শ্রাবণ, তূবার গালে হাত দিয়ে বলল,
‘আসব, হাজার বার, লক্ষবার আসব, কোটি কোটি বার আসব। তুমি আমার একমাত্র ভালোবাসা আকাশ। আমার পুরোটা জুড়ে তো বিস্তৃত। তোমাকে কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে যাব না তো কার কাছে যাব?।’
‘না আসবি না।’
শ্রাবণ তূবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আসব। আসব। আসব। তুমি শুধু আমার। আর কারও না।’
‘হ্যাঁ আমি শুধু তোর। আর কারও না। তবে আমাদের সম্পর্কের ইতি এখানেই টানতে হবে।’
‘না। না। না।’
তূবা আর দাঁড়াল না। দরজা খুলে চলে যেতে নিলে শ্রাবণ আবার ওকে জড়িয়ে ধরল। তূবা কান্নাভাজা কণ্ঠে বলল,
‘এমন বাচ্চামি করিস না, শ্রাবণ।’
‘করব। একশ বার করব।’
‘ছাড় আমাকে।’
‘না। ছাড়ব না। তুমি আমার। তোমার সবকিছু আমার।
‘প্লিজ শ্রাবণ, যেতে দে আমাকে।’
‘না।’
তূবা এরকম জোর করেই শ্রাবণের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে গেল। শূণ্য ফ্ল্যাটে শ্রাবণ বসে রইল একা। সম্পূর্ণ একা।
আমার নতুন বই “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” সংগ্রহ করেছেন তো?
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪৪
৪৪!!
মান অভিমান যতই চলুক সময় চলতে থাকে তার গতিতে। সে কারও মান অভিমানের ধার ধারে না। সে চলে আপন গতিতে। তূবার এবারের সিদ্ধান্তে শ্রাবণেরও ভীষণ অভিমান হলো। কী পেয়েছে কী তূবা ওকে? যখন মর্জি ভালোবাসবে, কাছে টানবে, যখন মর্জি তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে ছেড়ে দিবে, দূরে সরিয়ে দিবে?
না শ্রাবণ তা আর হতে দিবে না। শ্রাবণের ব্যক্তিত্ব কী এতটাই হালকা? এবার শ্রাবণও দুই নদীর মাঝে থাকা সম্পর্কের মাঝে ডোর কেটে দিলো। অভিমানের দেয়াল তুলে দিলো সম্পর্কের মাঝে। এবার আর শ্রাবণ সে দেয়াল ভাঙবে না। নিজ থেকে যাবে না তূবার কাছে। কেটে যাওয়া ডোর বাঁধবে না। এবার অভিমানের দেয়াল ভাঙতে হবে তূবাকে। কেটে যাওয়া বাঁধণও বাঁধতে হবে।
দেখতে দেখতে কথা আর তূবার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। এতদিন পরীক্ষার পড়ার চাপে শ্রাবণকে যে করে হোক ভুলে থেকেছে তূবা। কিন্তু এখন তূবা দিনকে দিন কষ্টে জর্জরিত হচ্ছে। নিজের সব খেয়াল চাকরির পড়ায় মনোনিবেশ করতে চাইলেও পারল না। বারবার শ্রাবণের খেয়াল মনে আঘাত করতে লাগল।
কতদিন হলো শ্রাবণকে ঠিকমতো দেখে না। রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝে দুই একবার দেখা হলেও শ্রাবণ, তূবাকে দেখলে এমনভাবে এড়িয়ে যায় যেন ওকে চেনেই না। শ্রাবণের এ এড়িয়ে চলাটা তূবার জন্য আরও অধিক কষ্টের, কিন্তু সে জন্য শ্রাবণকে কিছু বলতেও পারে না। কারণ এ কষ্টের জন্য দায়ী ও নিজেই।
অন্যসময় হলে শ্রাবণকে দুটো থাপ্পড় মেরে বলত,
‘তোর সাহস কী করে হয়, আমাকে ইগনোর করার? তুই শুধু আমাকে ভালোবাসবি। ইগনোর কেন করবি? আমি তোকে মারি কাটি যা খুশি করি, তা-ও তুই আমাকে ভালোবাসবি। আমি অভিমান করলে, মান ভাঙাবি, তুই কেন আমাকে এড়িয়ে চলবি?’
কিন্তু তূবা তা বলতে পারে না। মনের কথা থেকে যায় মনের অন্তরালে।
শ্রাবণের এবার ব্যবহারে তূবা সত্যি বিস্মিত। তূবা ভেবেছিল বরাবরেও মতো এবারও শ্রাবণ নিজ থেকে তূবার কাছে আসবে, কিন্তু এবার শ্রাবণ যেন তূবার চেয়েও বেশি কঠিন হয়ে গেছে। তূবাকে এবার বুঝিয়ে ছাড়বে শুধু শ্রাবণই, তূবার জন্য পাগল না, তূবাও, শ্রাবণের জন্য ততটাই পাগল।
একদিন শ্রাবণী, তূবাকে বাসায় ডাকল। শ্রাবণের সাথে শেষ কথা হওয়ার পর তূবা আর ওদের বাসায় যায়নি। কিন্তু আজ শ্রাবণী এমনভাবে জরুরি তলব করল যে, না গিয়ে পাড়ল না। তূবা, বাসায় বেল বাজানোর পর দরজা খুলল শ্রাবণ। শ্রাবণ তূবাকে দেখে দরজা খুলেই রুমে চলে গেল। এমন ভাব করল যেন তূবা সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ। তূবাও আর শ্রাবণের দিকে তেমন খেয়াল করল না। খেয়াল করলেই কষ্ট বাড়ে।
তূবা, শ্রাবণীর রুমে গিয়ে দেখল, শ্রাবণী, নীরার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। নয় মাস চলছে নীরার। যে কোনো সময় হসপিটালে যেতে হতে পারে। তূবা, শ্রাবণীর কাছে গিয়ে বলল,
‘চাচি ডেকেছিলা?’
‘হ্যাঁ। বস। কেমন আছিস?’
তূবা বসতে বসতে বলল,
‘ভালো। তোমরা?’
‘আমরাও ভালো আছি। তবে তোর চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না, ভালো আছিস?’
‘না চাচি, ভালোই আছি।’
‘সরাসরি সোজা কথা বলি, সোজা করে উত্তর দিবি।’
‘আচ্ছা।’
‘শ্রাবণের সাথে তোর কী হয়েছে?’
তূবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘কই কিছু নাতো। ওর সাথে আমার আবার কী হবে?’
‘কিছু হয়নি?’
‘না।’
‘তাহলে দু’জনার চেহারার এমন ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা কেন?’
‘আমার তো পরীক্ষা ছিল। তাই নিজের যত্ন নিতে পারিনি। আর শ্রাবণেরটা অামি কী করে বলবো?’
‘ওহ।’
শ্রাবণী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘তোদের কি মনে হয়, আমরা বড়োরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলি?’
‘মানে?’
‘মানে? বছরের পর বছর তুই আর শ্রাবণ প্রেম করে যাবি, আর আমরা বড়োরা কিছুই বুঝব না? কী ভাবিস আমরাদের? বোকা নাকি মুর্খ?’
তূবা মাথা নিচু করে রইল। শ্রাবণী বলল,
‘তোদের বিষয়ে আমি অনেক আগে থেকেই টের পেয়েছি, কিন্তু তোদের কাউকে বুঝতে দেইনি। কারণ তোদের সম্পর্ক নিয়ে আমার কোনো আপত্তি ছিল না।’
তূবা চোখ তুলে শ্রাবণীর দিকে তাকাল। শ্রাবণী মুচকি হেসে বলল,
‘বর্ষণের কথা শুনে তুই আমার শ্রাবণকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?’
তূবা এবারও চোখ তুলে তার দিকে তাকাল। শ্রাবণী বলল,
‘নীরা আমাকে সবটা বলেছে। বর্ষণের ভয় যেমন সত্যি তোদের সম্পর্কটাও তো তেমন সত্যি! কেউ কিছু বললেই কেন ভয়ে একে অপরের হাত ছাড়তে হবে? এসব ছোটো ছোটো ঝড়েই যদি একে অপরের হাত ছেড়ে দিস তাহলে বড়ো ঝড় সামলাবি কী করে তোরা?’
তূবা এবার কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘বাবা মানবে না, চাচি।’
শ্রাবণী বেশ আসস্ত কণ্ঠে বলল,
‘সেটা আমি দেখব। তুই শুধু আমাদের শ্রাবণটাকে কষ্ট দিস না। ও আমাদের সবার খুব প্রিয়। ও সব চাওয়া আমারা পূর্ণ করি। সেখানে তুই ওর সবচেয়ে বড়ো চাওয়া। এটা পূর্ণ না করি কী করে বল?’
তূবা কাঁদতেই লাগল। শ্রাবণী বলল,
‘তোদের মাঝে কী হয়েছে আমি জানি না। জানতেও চাই না। তবে কতদিন যাবত ছেলেটা আমার কষ্টে নীল হয়ে আছে। ওকে আর কষ্ট দিস না। তোর পরিবারের সাথে আমি শীঘ্রই কথা বলবো। কয়েকমাস পর শ্রাবণের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হবে। পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে তার পরের দিন আমি তোর বাবার সাথে কথা বলবো।’
তূবা, শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরল। শ্রাবণী বলল,
‘এবার নিজেদের মাঝে ঝামেলা মিটমাট করে নে।’
তূবা চোখ মুছে বলল,
‘আচ্ছা চাচি।’
তূবা, শ্রাবণের দরজায় নক করল। শ্রাবণ দরজা খুলে তূবাকে দেখে বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘এখানে কী চাই?’
‘তোকে?’
শ্রাবণ ঠাস করে তূবার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। তূবা মৃদু হেসে বলল,
‘বাপরে ভয়াবহ রেগে আছে।’
শ্রাবণ দরজা বন্ধ করলেও ভিতর থেকে লক করল না। তূবা দরজা খুলে ভিতরে ঢুবে দরজা লক করল। শ্রাবণ তখন হাতে শার্ট নিয়ে একটা হাতা ঢুকিয়েছে। তূবা ওকে পিছন দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘সরি।’
শ্রাবণ, তূবার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দরজা খুলে সোজা বাইরে চলে গেল। এতদিন শ্রাবণ, তূবার রাগ ভাঙাত। এবার তূবা, শ্রাবণের অভিমান ভাঙাচ্ছে। বেচারির সারাদিন কল দিচ্ছে। শ্রাবণ বারবার কেটে দিয়েছে। মেসেজ করে মেসেজ বক্স ফুল করে ফেলেছে। শ্রাবণ কলও ধরছে না, মেসেজের উত্তরও দিচ্ছে না। প্রচণ্ড অভিমান করেছে এবার তূবার উপর।
এভাবে অভিমানে চলে গেল কয়েকদিন। একদিন তূবা, নীরার সাথে ফন্দি আটল। কখন শ্রাবণ বাড়িতে একা থাকে, তখন যেন ওকে ফোন করে। তো নীরা ফোন করার সাথে সাথে তূবা চলে গেল। নীরা দরজা খুলে বলল,
‘মা’কে চালতা খাবার বাহানায় পাশের বাড়ি পাঠিয়েছি। যা করার জলদি করবি।’
তূবা লজ্জা পেয়ে বলল,
‘কিছুই করব না। শুধু রাগ ভাঙাব।’
‘ঐ তো, একই কথা।’
তূবা, শ্রাবণের রুমে ঢুকল। শ্রাবণ ওকে দেখে বের হয়ে যেতে নিলে, তূবা দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা বুকের মধ্যে রাখল। শ্রাবণ রাগী কণ্ঠে বলল,
‘ভদ্রমেয়ের মতো চাবি দাও। নইলে আমি নিজে নিয়ে নিব।’
তূবা সামনে এগিয়ে বলল,
‘আচ্ছা নিয়ে নাও।’
শ্রাবণ খানিকটা পিছিয়ে গেল। তূবা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘এখন আর রাগ করে থেকো না। প্লিজ।’
শ্রাবণ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘তূবা, চাবি দাও।’
‘দিব না। আগে রাগ ভুলে আমাকে জড়িয়ে ধরো।’
শ্রাবণ কর্কশ কণ্ঠে বলল,
‘আসছে এখন রাগ ভাঙাতে। আমাকে তুুমি পেয়েছো কী? যখন তখন তুমি দূরে সরিয়ে দিবে, আবার কাছে টানবে। কেন আমি কী তোমার খেলার পুতুল নাকি? আমি নিজের কোনো মন মর্জি নেই?’
‘সরি বললাম তো।’
‘ঐ সরিতে এবার চিড়ে ভিজবে না।’
‘তাহলে কী চাই?’
‘চাবি দাও আমি রুম থেকে বের হতে চাই।’
তূবা মন খারাপ করে চাবিটা দিয়ে দিল। শ্রাবণ সত্যি সত্যি রুম থেকে চলে গেল।
চলবে…