#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪৭
৪৭!!
প্রথমবার ঘোরের মাঝেই দু’জন কাছে এসে পড়েছিল। পরেরবার যেন নেশা হয়ে গিয়েছিল, একে অপরকে পাবার নেশা। এ নেশা যে বড্ড খারাপ, দুজনকে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে পেরেও একে অপরকে আটকে পারেনি। তৃতীয়বারে একটু কাছে এসেই দুজনেই আর দূরে এগোয়নি। দু’জনেই বুঝতে পেরেছিল কতো বড়ো ভুল করেছে। এ ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না।
পরবর্তীতে যাতে এমন ভুল না হয় সে কারণে গত দুই মাস যাবত দু’জন শুধু ফোনেই কথা বলেছে, দেখা করেনি এক মুহূর্তের জন্যও। ওরা বুঝে গিয়েছিল দুজন দুজনার জন্য কতটা পাগল। একে অপরের নেশায় পুরোপুরি আসক্ত। দেখা করলে আবার যাতে ঐ ভুল না হয় সে কারণে দেখা করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু বলে না কিছু ভুল শুধু ভুল না মস্ত বড়ো পাপ। তাকে শোধরানো যায় না কোনো মতে। ওদের দুই বারের ভুলই ছোট্ট একটা প্রাণে রূপ নিয়ে নিয়েছে ততদিনে।
প্রথম মাসে পিরিয়ড অফ যাওয়ায় তূবা সামান্য চিন্তিত হলেও, নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে বিষয়টা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছিল। শ্রাবণকেও কিছু জানায়নি। দ্বিতীয় মাসেও যখন পেরিয়ে যায় তখন তূবার টনক নড়ে। তাছাড়া ততদিনে ছোট্ট ভ্রুনটা নিজের অস্তিত্বের কথা তূবার শরীরকে বারবার জানিয়ে দিচ্ছিল। তূবা একা একা বসে ভাবছে কী করেছে? কিন্তু এখন কী করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। টেনশনে বারবার মাথা ঘুরাচ্ছে। পেটে হাত দিয়ে বারবার অনুভব করার চেষ্টা করছে ওর ভিতরে থাকা ছোট্ট প্রাণটাকে।
সকালে রেজাল্ট পজেটিভ দেখে ওর মনে শ্রাবণকে নিয়ে কোনো ভয় ছিল না। ও জানে শ্রাবণ মাঝ পথে ওর হাত ছাড়বে না, কিন্তু ভয়টা দুই পরিবারের লোকদের নিয়ে। শ্রাবণের পরিবারের চেয়েও অধিক ভয় ছিল, নিজের পরিবার আর বাবাকে নিয়ে।
তূবা, তামিমাকে ডেকে সবটা বলল। তামিমা, তূবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো। এই প্রথম তামিমা, তূবার গায়ে হাত তুলল। তামিমা রাগী কণ্ঠে বলল,
‘বেইমান! আমার ভালোবাসা বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলি? তোর জন্য আমি কখনো দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার কথা ভাবিনি। তোর অযত্ন হবে বলে। আমি নিজের ছেলের চেয়ে তোকে বেশি খেয়াল রেখেছি। তোর সব আবদার পূরন করেছি। তার এই দাম দিলি?
তোকে কতমাস যাবত বারবার সর্তক করেছি শ্রাবণের থেকে দূরে থাক। কতভাবে বুঝিয়েছি। কতরকমভাবে তোকে অনুরোধ করেছি। আর তুই কী করলি? অবৈধ বাচ্চা গর্ভে নিয়ে ঘুরছিস! এর চেয়ে আল্লাহ তোকে বন্ধা করতে চেয়েছিলেন তাই করতেন। অন্তত এই পাপ তোর পেটে আসত না। শ্রাবণ এখন মানবে তোকে? কখনো না! আজকালকার ছেলেদের আমার চেনা আছে।’
তূবা কোনো কথা বলল না। বলার মতো মুখ ওর নেই। তামিমা আরও অনেককিছু বলে রুম থেকে চলে গেল। তূবা ফোনটা হাতে নিয়ে শ্রাবণকে কল করল। শ্রাবণ কল রিসিভ করে বলল,
‘হুম বলো।’
‘শ্রাবণ!’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি আমার হাত ছেড়ে দিবা না তো?’
শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ছেড়ে দেওয়ার হলে, বুঝি পুরো পরিবারকে জানাতাম? তোমার যাতে কোনো রকম সমস্যা না হয় তার জন্য এতো চেষ্টা করতাম? তুমি প্লিজ টেনশন করো না। আমি সবসময় তোমাকে বলেছি, আজও বলছি, তোমাকে কোনো টেনশন নিতে হবে না। সবকিছু আমি দেখব। তুমি শুধু আমার উপর ভরসা রেখো।’
‘আমার খুব ভয় হচ্ছে। বাবা যদি রাজি না হয়? তোমার যদি কোনো ক্ষতি করে বসে?’
‘ফালতু টেনশন করো না। থিংক পজেটিভ।’
‘এতো কিছুর পর মাথায় পজেটিভ চিন্তা আসে না।’
‘হুম বুঝতে পারছি।’
‘দোষটা আমার। সেদিন কেন যে তোমাকে একা বাসায় ডাকতে গেলাম? না আমি সেদিন ডাকতাম আর না আমরা এমন ভুল করতাম।’
‘প্রথমবার ভুল ছিল শ্রাবণ, দ্বিতীয়বার না।’
‘তূবা, তোমাকে নিজের করে পাওয়াটা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। সেই তোমাকে যখন পুরোপুরি নিজের করে পেয়েছিলাম আমার মাথা ঠিক ছিল না। বারবার শুধু তোমাকে কাছে পেতেই মন চাইতো। কিন্তু ঐ ভুল যাতে পরে আর না হয় সে কারণে গত দুই মাসে এতো কষ্ট হবার পরও তোমার সাথে দেখা করিনি। মনে হতো দেখা হলে যদি আবার তোমার প্রতি আসক্ত হয়ে যাই। সব দোষ আমার।’
‘সব দোষ তোমার কীভাবে? আমি তো ছোটো বাচ্চা মেয়ে নই। যা হয়েছিল দু’জনার সম্মতিতে হয়েছিল। তুমি তো জোর করোনি। ভুল তো আমার হয়েছে, তোমার কথামতো ইর্মাজেন্সি পিলস নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে হয়তো…! কিন্তু আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আমি কখনো মা হতে পারব না।’
‘দোষ কখনোই তোমার না, সব দোষ আমার। নিজের দোষ কখনো দিবা না। এখন পিছনের কথা ভেবে প্লিজ নিজেকে কষ্ট দিও না। তুমি নিজের আর আমাদের বেবির খেয়াল রাখো। বাকি সারা পৃথিবীকে দেখার, বুঝানোর, রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। তুুমি শুধু আমাকে ভরসা করো।’
“রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”
অর্ডার করেছেন তো?
৪৮!!
নিহাদ আর বর্ষণ গেল তারিক সাহেবের সাথে দেখা করতে। ওদের দেখে তারিক সাহেব বেশ খুশি হয়ে বলল,
‘আরে, বর্ষণ আর জামাই যে আসো বসো।’
ওরা বসতেই তারেক সাহেব তার দোকানের ছেলেটাকে পাঠালেন ওদের জন্য ঠান্ডা আনতে। তারেক সাহেবের অনেক বড়ো চাউলের আড়ৎ। পারিবারিক ব্যবসা। তিন ভাই মিলে ব্যবসা করলেও মেজ ভাই আলাদা থাকেন। তারেক সাহেব আর তার ছোটো ভাই একসাথে থাকে।
তারেক সাহেব ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী খবর তোমাদের? কেমন আছো?’
বর্ষ বলল,
‘এই তো চাচ্চু ভালো। চাচ্চু আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা ছিল।’
‘হ্যাঁ বল।’
বর্ষণ কিছুটা ইতস্ততা বোধ করছিল। নিহাদ বলল,
‘চাচ্চু, ব্যাপারটা এখানে না বলে নিরিবিলি কোথাও বললে ভালো হবে।’
তারেক সাহেব ভ্রু কুচকে বলল,
‘এমন কী কথা?’
নিহাদ বলল,
‘তূবার বিষয়ে। প্লিজ চাচা দোকান থেকে অন্য কোথাও চলেন।’
এবার তারিক সাহেব উঠে নিজের ছোটো ভাই আরিফকে দোকানের খেয়াল রাখতে বলে, ওদের বলল,
‘আচ্ছা। চলো।’
তারা টুকটাক কথা বলতে বলতে বাজার থেকে অনেকটা দূরে এসে নিরিবিলি জায়গায় থাকা বেঞ্চে বসল। তারিক সাহেব বলল,
‘হ্যাঁ বলো, কী করেছে আমার তূবা?’
বর্ষণ বলল,
‘তূবা কিছুই করিনি। আমরা তূবাকে আমাদের ঘরের বউ করে নিতে চাই।’
তারিক সাহেব ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন,
‘তোদের ঘরের কোন ছেলের জন্য নিবি? তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে, এক ছেলের বাবাও তুই। আর শ্রাবণ তো বাচ্চা মানুষ।’
বর্ষণ ঢোক গিলে বলল,
‘শ্রাবণের বউ হিসাবেই নিতে চাই।’
তারিক সাহেব হা হা শব্দ করে হাসল। তারপর বলল,
‘চাচার সাথে মজা করছিস? এ যুগে রহিম রূপবানের গল্প নতুন করে লিখবি নাকি?’
বর্ষণ ভয়ে ঘামছে। তা দেখে নিহাদ বলল,
‘চাচ্চু, শ্রাবণ, তূবা একে অপরকে ভালোবাসে। বেশ কিছু বছর যাবত ওদের মাঝে সম্পর্কও চলছে।’
তারিক সাহেব বেশ বিস্মিত হয়ে তাকালো। তারপর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘এ অসম্ভব! এটা কী সত্যি?’
বর্ষণ বলল,
‘হ্যাঁ।’
তারিক সাহেব বেশ রাগ করে বলল,
‘আমি এ সম্পর্ক কখনো মেনে নিব না। আমি এক সপ্তাহের মধ্যে তূবার বিয়ে দিব।’
তারপর তিনি বেশ ধমকের সুরে বলল,
‘বর্ষণ তোর ভাইকে বলিস, নিজের জীবনের মায়া থাকলে আমার মেয়ের চারপাশে যেন না দেখি। নিজের ভাইয়ের ছেলের গলায় কোপ দিতে আমার কষ্ট হবে কিন্তু হাত কাঁপবে না। কথাটা ওকে বলে দিস।’
নিহাদ বলল,
‘চাচ্চু, সব সিদ্ধান্ত রাগ করে হয় না।’
তারিক সাহেব, নিহাদকে ধমক দিয়ে বলল,
‘নিহাদ, তুমি জামাই, তাছাড়া আমার মেয়ের শিক্ষক ছিলা, তোমাকে আমি সম্মান করি। তুমি তেমনই নিজের সম্মান বজায় রেখে থাকো। আমি আর তোমাদের কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করছি না।’
বর্ষণ, নিহাদ দুজনেই তূবার প্রেগনেন্সির খবর তাকে জানাতে চায়নি। ভেবেছিল বিষয়টাকে শান্তভাবে নিয়ন্ত্রণে আনবে কিন্তু তারেক সাহেব যে পরিমাণ ঘাড়ত্যাড়া লোক তাতে তাকে সত্যিটা না বললে রাজি করানো যাবে না। নিহাদ একরকম বাধ্য হয়েই বলল,
‘চাচ্চু, তূবা প্রেগনেন্ট।’
তারেক সাহেব প্রথমে ভাবল, তিনি হয়তো ভুল শুনছে। সে কারণে বলল,
‘কী বললা?’
‘তূবা প্রেগনেন্ট। আর বাচ্চার বাবা শ্রাবণ।’
তিনি বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘বিয়েতে রাজি করানোর জন্য তোমরা এ নোংরা মিথ্যাটা বলছো তাই না?’
বর্ষণ বলল,
‘না চাচ্চু। তূবা সত্যি প্রেগনেন্ট।’
‘অসম্ভব! ডাক্তার বলেছিল ও কখনো মা হতে পারবে না।’
নিহাদ বলল,
‘ডাক্তার বলেনি মা হতে পারবে না। বলেছিল চান্স কম। চাচ্চু, এ বিষয়টা চিল্লাপাল্লা করে সমাধান করার বিষয় না। আপনি ঠান্ডা মস্তিষ্কে চিন্তা করুন। আমরা একটা উপায় বের করেছি, যাতে লোক জানাজানিও হবে না। আর তূবার বাচ্চাকেও সমাজ অবৈধ ভাববে না।’
তারিক সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘তূবা সত্যি প্রেগনেন্ট?’
নিহাদ, বর্ষণ একসাথে বলল,
‘হ্যাঁ। আমরা আজ ওর চেকাপও করিয়েছি।’
বর্ষণ বলল,
‘চাচ্চু আমাদের কথাটা পুরোপুরি শুনুন তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
তারিক সাহেব আর এক মুহূর্তও ওদের সামনে দাঁড়ালো না। হনহন করে তার দোকানের দিকে চলে গেলেন। বর্ষণ, নিহাদ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর নিহাদ বলল,
‘ভাইয়া, আমাদের বাড়ি গিয়ে দ্রুত বাবা, মাকে নিয়ে তূবাদের বাসায় যাওয়া দরকার। চাচ্চুর মতিগতি ভালো দেখলাম না।’
‘হুম চলো।’
তারিক সাহেব তার বাইক নিয়ে দ্রুত তার বাড়ি আসল। তূবা তখন রুমেই বসা, তামিম ওর সাথে বসা। তামিমা অন্য রুমে। তিনি তূবার রুমে ঢুকলেন। তার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে হয়ে আছে। তিনি বেশ রাগি কণ্ঠে বলল,
‘তূবা?’
তূবা যেন কিছু আঁচ করতে পেরে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ, বাবা।’
‘তুই প্রেগনেন্ট?’
তূবার শরীর এবার থরথর করে কাঁপছে। এমনভাবে কাঁপছে যেন যে কোনো সময় বেহুশ হয়ে যাবে। তূবা বেশ আস্তে করে বলল,
‘হ্যাঁ।’
সাথে সাথে তারিক সাহেব প্রচণ্ড জোরে তূবার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। তূবা ছিটকে পড়ল ফ্লোরে। তামিম রুম থেকে বের হয়ে ওর মাকে ডেকে আনল। তামিমা রুমে এসে দেখল, তারিক সাহেব তূবাকে ধরে দাঁড় করিয়ে আরেকটা চড় মেরে বলল,
‘আমার বিশ্বাস, ভরসার এই মূল্য দিলি? আমার দেওয়া স্বাধীনতার এমন অপব্যবহার করলি?’
দুটো থাপ্পরেই তূবার মাথা প্রচণ্ড ঘুরছে। ঠোঁটের কোণ ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। তামিমা, তূবাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘দাদা, করছেন কী? এত বড়ো মেয়ের গায়ে হাত তুলছেন?’
তারিক সাহেব বেশ জোড়েই বললেন,
‘ওকে আজ খুন করে আমি নিঃসন্তান হবো।’
তামিমা বলল,
‘দাদা, চিল্লাপাল্লা করে সমাধান হবে না। এটা চিল্লাপাল্লা করার মতো বিষয় না।’
তারিক সাহেব তার কথা শুনলেন না। বরাবরই তিনি তার রাগের কাছে হেরে যান। আজ তো তিনি তার অতিমাত্রায় রাগের কাছে গো হারান হেরে যাবেন। তারিক সাহেব তূবাকে টেনে এনে আরেকটা চড় মারল। তূবা আবারও নিচে পড়ে গেল। এবার তারিক সাহেব ভয়াবহ কাণ্ড করলেন। তূবার পেটে লাথি মা* র* লে* ন। তূবা মা বলে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। তারিক সাহেব বললেন,
‘তোর পেট থেকে এই পাপ আমি বের করে ফেলব।’
তামিম ততক্ষণে দৌড়ে শ্রাবণদের বাসায় চলে গেল। নিহাদ, বর্ষণ তখন বাসার সবার সাথে কথা বলছিল। তামিম ঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘শ্রাবণ ভাই, বড় আব্বু তূবা আপুকে ভীষণ মারছে। আজ বোধ হয় মেরেই ফেলবেন।’
কথাটা শুনে শ্রাবণ এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দৌড় দিলো তূবাদের বাড়ির দিকে। শ্রাবণের পিছু পিছু বাকি সবাই। শুধু শ্রাবণী, নীড়াকে বলল,
‘নীরা, তুই বাবুকে নিয়ে ঘরে থাক। এখন সন্ধ্যার সময় বের হতে হবে না। আমরা দেখছি বিষয়টা।’
নীরার ছেলের বয়সও প্রায় ছয়মাস।
শ্রাবণরা যখন তূবাদের বাড়ি পৌঁছালো তখন ওদের ঘরের আশে পাশে বেশ কিছু লোক। তূবার বাবার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। শ্রাবণ আর এক মুহূর্তও বাইরে দাঁড়ালো না। দৌড়ে ভিতরে চলে গেল। তূবা তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তামিমা ওর মাথা কোলে নিয়ে কাঁদছে আর বলছে,
‘দাদা, এটা আপনি কী করলেন? মেয়েটা তো এখন মরে যাবে। ওকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।’
তারিক সাহেব বেশ রাগ করে বলল,
‘যাক মরে। ওর মতো কুলাঙ্গার সন্তান মরে গেলে আমার কিছু আসে যায় না।’
শ্রাবণ, তূবার রুমে ঢুকে তূবার ঐ অবস্থা দেখে তূবার কাছে গিয়ে বলল,
‘কী হয়েছে?’
তামিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘দাদা, ওর পেটে লাথি মেরেছে, অনেক মেরেছেন তিনি।’
শ্রাবণ কথাটা শুনে ভয়াবহ কেঁপে উঠল। শ্রাবণ, তূবাকে স্পর্শ করার আগেই তারিক সাহেব শ্রাবণকে উঠিয়ে মারতে লাগল। বেশ কয়েকটা চড় মারলেন। নিহাদ, বর্ষণ, শ্রাবণের বাবা সোহেল তাকে ধরলেন, কিন্তু তিনজন মিলেও যেন তার সাথে পেরে উঠছে না। শ্রাবণ, তূবাকে কোলে নিয়ে বেশ চিৎকার করে বলল,
‘আপনার সাহস কী হয় আমার স্ত্রীর গায়ে হাত দেওয়ার?’
‘আমরা প্রাপ্ত বয়স্ক। নিজেদের ইচ্ছায় যাকে ইচ্ছা বিয়ে করতে পারি। আপনি ওর গায়ে হাত দিলেন কী করে?’
তারিক সাহেব বেশ রাগ করে বলল,
‘তোদের দুজনকে আমি খুন করব। তারপর দেখব তোরা কতদূরের প্রাপ্তবয়স্ক।’
‘করে দেখুন। দেখি আপনার কতো সাহস। আমার স্ত্রী আর বাচ্চার যদি কিছু হয় আমি আপনাকে ছাড়ব না।’
শ্রাবণ, তূবাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। কথা, শ্রাবণী কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ওরাও শ্রাবণের সাথে সাথে যেতে লাগল।
তারিক সাহেব সবার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দা নিয়ে আসল শ্রাবণকে মা* র* বে বলে, কিন্তু শ্রাবণের কপাল ভালো, বাইরে থেকে বেশ কয়েকজন লোক ঘরে ঢুকে তাকে ধরল। শ্রাবণ তার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করল না। ওর পুরো খেয়াল শুধু তূবার দিকে। তূবাকে বলল,
‘তোমার কিছু হবে না। আমরা এখনই হসপিটালে যাবো।’
তূবা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলল,
‘শ্রাবণ, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
শ্রাবণ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘কিছু হবে না তোমার!’
শ্রাবণী বাইরে থাকা সব লোকদের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। ওরা বিষয়টাকে সম্পূর্ণ চুপচাপভাবে সমাধান করতে চেয়েছিল, কিন্তু মুর্খ লোকটার কারণে সব শেষ হয়ে গেল। এ জন্যই বলে মুর্খ রাগী লোক যত ধনীই হোক না কেন, সে শান্তির কথা বুঝে না।
শ্রাবণ, তূবাকে নিয়ে গাড়িতে বসল। নিহাদ ড্রাইভ করতে লাগল আর কথা ওর পাশে বসা। বাকিরা অন্য গাড়িতে আসছে। তূবা যন্ত্রণায় ছটফট করছে আর ওর যন্ত্রণা দেখে শ্রাবণ!
চলবে।
#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪৮
৪৯!!
তূবাকে হসপিটালে আনার পর ডাক্তার জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে উনার?’
শ্রাবণ কিছু বলার আগেই নিহাদ বলল,
‘পরে গিয়ে পেটে আঘাত লেগেছে। ও প্রেগনেন্ট।’
ডাক্তার জিজ্ঞেস করল,
‘রোগী আপনাদের কী হয়?’
শ্রাবণ বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘আমার ওয়াইফ।’
ডাক্তাররা তূবাকে ভিতরে নিয়ে গেল। শ্রাবণ দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। কথা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ওর ছোটো ভাইটাকে। যে এখন মোটেও ছোটো নেই। যে দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। যে ভরসা রাখতে শিখে গেছে। যে মানুষের সাহস হতে পারে। হুট করে কথার কেন জানি তূবাকে নিয়ে ভয় আর কষ্টটা কমে গেল। মনে হলো পৃথিবীতে আর কেউ তূবার পাশে থাকুক না থাকুক শ্রাবণ থাকবে। তূবাকে আগলে রাখবে নিজের সবটা দিয়ে। কথার আর নিজের ভাইয়ের প্রতি কোনো ক্ষোপ রইল না।
আর পাঁচটা ছেলের মতো সে অন্যায় করে অন্যায় থেকে পালায়নি, অন্যায়টাকে অস্বীকার করেনি। বরং নিজের অন্যায়টাকে স্বীকার করে দায়িত্ব নিতে শিখেছে। আর যে নিজের অন্যায় স্বীকার করে, শাস্তি গ্রহণ করার সাহস রাখে, সে চাইলে নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ হতে পারে। কথা, শ্রাবণের দিকে তাকালো। তারিক সাহেবের মারার কারণে শ্রাবণের ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে। আঙুলের দাগগুলো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। ঠোঁটের কোনটা একটু কাটা। তবুও ওর নিজের দিকে খেয়াল নেই। পুরো খেয়াল তূবার দিকে।
অনেকক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে আসলেন। শ্রাবণ ভয়ে ডাক্তারকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। নিহাদ জিজ্ঞেস করল,
‘ম্যাডাম তূবার কী অবস্থা?’
ডাক্তার বললেন,
‘অবস্থা ভালো দু’জনার। আল্ট্রাসনো করে দেখলাম বেবিও ঠিক আছে। তাছাড়া উনার ব্লিডিংও হচ্ছে না। সব কিছুই ঠিক আছে। তবে পড়ে যাওয়ার কারণে ওনার পেটে যন্ত্রণা করছে। যদি ব্লিডিং হতো তবে ব্যাপারটা ভয়ের হতো। আপাতত একদিন এখানে থাক। আর আগামী একমাস ফুল বেডরেস্ট। অধিক প্রয়োজন ছাড়া হাঁটাচলা একদম নিষেধ। উনার ব্যথাটাও নাকি এখন একটু কমছে। আশাকরি শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।’
ডাক্তার শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি তো তার হ্যাজবেন্ড। আমার সাথে আসুন।’
শ্রাবণ, কথার দিকে তাকাল। কথা বলল,
‘যা।’
শ্রাবণ ডাক্তারের চেম্বারে বসার পর ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন,
‘সত্যি কি আপনার ওয়াইফ পড়ে গেছিলেন নাকি অন্য কোনো ঘটনা?’
‘কেনো?’
ডাক্তার সুমা সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কিছু একটা ভেবে বলল,
‘না। কিছু না। আপনার জন্য কিছু কথা আছে।’
‘জি বলুন।’
‘লাকিলি আপনাদের বেবি বেঁচে গেছে। নয়তো প্রেগনেন্সির শুরুর দিকে পেটে আঘাত পেলে খুব কম বাচ্চাই বাঁচে। মিসক্যারেজ হয়ে যায়। যেহেতু বেবির কোনো ক্ষতি হয়নি, তাই আপনাদের এখন বেবির সেফটির কথা ভেবে খুব সর্তক হয়ে চলতে হবে।’
‘জি চলব। আপনি বলে দিন কীভাবে চললে বেটার হবে।’
‘প্রথমত উনার খুব খেয়াল রাখবেন। এখন মরনিং সিকনেস বা অসুস্থতা বেশি থাকবে। পাঁচ মাসের পর ঠিক হয়ে যাবে। উনাকে ভারী কাজ একদম করতে দিবেন না। একদম না মানে একদম না।গ আপাতত একমাস ফুল বেড রেস্ট। ও হ্যাঁ দুই মাস আপনারা ফিজিক্যাল রিলেশন থেকে একদম দূরে থাকবেন।’
লজ্জায় শ্রাবণের কান গরম হয়ে গেল। লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল,
‘আচ্ছা।’
‘আরও অনেক নিয়ম কানুন আছে। আমি ফুল চার্ট দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে খাওয়া দাওয়া থেকে বাকি কিছুর বিষয়ে লেখা আছে। মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।’
‘আচ্ছা।’
শ্রাবণ মনে মনে বলল,
‘স্বামী আর বাবাদের অনেক দায়িত্ব। আমি কী পারব সে দায়িত্ব পালন করতে? ভুল করে ফেলেছি, চাইলেও শুধরাতে পারব না। দায়িত্ব আমাকে নিতেই হবে। হে করুণাময়, আমাকে ক্ষমা করো। আমাকে সাহস দাও, শক্তি দাও এতো বড়ো দায়িত্ব পালন করার।
শ্রাবণ যখন ডাক্তারের চেম্বারে, কথা আর শ্রাবণী তখন তূবার কাছে গেল। তূবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। ডাক্তার ঘুমাতে বলেছিল, কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ঘুম আসা কী এতটাই সহজ? কথা তূবার পাশে বসে ওর দিকে তাকাল। ফর্সা মুখে চড়ের দাগগুলো নীল হয়ে গেছে। গাল ফুলে আছে। কথা, তূবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তূবা চোখ তুলে কথার দিকে তাকাল। কথা জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন লাগছে এখন?’
‘হুম।’
‘পেট ব্যথা কমছে একটু?’
‘এখন অনেক কম, কিন্তু মাথা ঘুরাচ্ছে।’
শ্রাবণীও, তূবার অপরপাশে বসে ওর হাত ধরে বলল,
‘প্রথম দিকে মাথা সবসময় ঘুরায়। তুই বিশ্রাম নে। তাহলে ভালো লাগবে।’
তূবা, শ্রাবণীর দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নিচু করে বলল,
‘চাচি, তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার মুখ আমার নেই। তোমাদের সবার বিশ্বাস আমরা ভেঙেছি। এতো বড়ো অন্যায় করেছি যে যার ক্ষমাই হয় না।’
শ্রাবণী, তূবার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘তোকে ক্ষমা চাইতে হবে না। যা ভুল করেছিস তার শাস্তি অলরেডি পেয়ে গেছিস। আমি তোদের উপর খুব কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু তবুও তোদের খুব ভালোবাসি। আর মা সন্তানদের ভালোবাসায় সবসময় অন্ধ থাকে। তাদের সব ধরণের অন্যায় ক্ষমা করে দেয়। আমিও তোদের ক্ষমা করে দিব।
তোকে অলরেডি ক্ষমা করে দিয়েছি, তোর গাধা বয়ফ্রেন্ডটাকে করিনি, করবোও না সহজে। তবে তুই ওর কারণে আজ যে কষ্ট পেলি, নিজের পরিবারসহ সব হারালি, তোকে ক্ষমা না করলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। তোর বাবাকে বুঝিয়ে আজ তোদের রেজিট্রি করিয়ে আজই তোকে ঘরের বউ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোর বাবার মাত্রাতিরিক্ত রাগ তো সব ঘেঁটে ঘ করে দিয়েছে। তবে তোদের রেজিট্রি আজই হবে, হসপিটালে বসেই হবে। কাল যখন তুই আমার বাড়ি যাবি আমার ছেলের আইনগত বউ হয়েই যাবি। দেখি তোর বাপ কী করে? কথা, তুই তূবার পাশে থাক। আমি নিহাদ, বর্ষণ আর তোর বাবাকে বলছি রেজিট্রি করার ব্যবস্থা করতে।
ডাক্তারের কাছ থেকে এসে শ্রাবণ, তূবার কাছে যাবার সাহস পাচ্ছে না। ওর খুব ভয় করছে। যদি তূবা বলে, কেন নষ্ট করলে আমার জীবনটাকে? তখন কী উত্তর দিবে ও? শ্রাবণের অস্বস্তি নিহাদ বুঝতে পারল। কোথাও না কোথাও নিহাদও এমন অস্বস্তিকর পরিবেশের সম্মুখীন হয়েছিল। ও শ্রাবণের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘গিয়ে কথা বল। তোদের কথা বলা জরুরি।’
‘সাহস হচ্ছে না।’
নিহাদ হেসে বলল,
‘তোরই বাচ্চার মা। বড়োজোর অনেক্ষণ কাঁদবে, চিল্লাবে, তোকে কয়টা মা* ই* র দিবে। এর বেশি কিছু না।’
শ্রাবণ স্মিত হেসে কেবিনের মধ্যে গেল। শ্রাবণকে দেখে কথা বের হয়ে গেল। শ্রাবণ, তূবার পাশে এসে বসে চুপ করে রইল। তা দেখে তূবা বলল,
‘চুপ করে আছো কেন?’
‘আমার বলার মতো কোনো ভাষা নেই।’
‘তাহলে তুমি তোমার ভাষায় বলো?’
শ্রাবণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তূবাকে জড়িয়ে ধরল তারপর বলল,
‘আমি কখনো চাইনি তোমার সাথে এমন কিছু হোক।’
‘আমি জানি।’
‘আমি কখনো ভাবিনি তোমার বাবা নিজের মেয়ের সাথে এমনটা করবে।’
‘কেউই ভাবেনি।’
‘বাইরের লোকের সাথে যা খুশি করুক, তাই বলে নিজের একমাত্র মেয়ের সাথে?’
‘বাবার রাগ সম্পর্কে আমাদের আগেই ধারণা করা উচিত ছিল। ভুলে গেছিলাম আমার বাবার রাগ তার মেয়ের চেয়েও বড়ো।’
‘আমাদের কর্মকাণ্ডে তার রাগ করা স্বাভাবিক, কিন্তু এটা কেমন রাগ? যে রাগে মানুষের জীবনের কথাও দুই বার ভাবে না? আমরা মস্তবড়ো ভুল করেছি, কিন্তু আমরা ভুলটাকে শুধরে নিতে চেয়েছিলাম, তিনি সে সুযোগটা পর্যন্ত দিলেন না।’
তূবা, শ্রাবণের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘এবার চুপ করো।’
‘কীভাবে চুপ করি? এই অপরাধবোধ আমাকে সারাজীবন কুড়ে কুড়ে খাবে যে, আমার কারণে তুমি এতো কষ্ট পেয়েছো।তুমি তোমার পরিবার হারিয়েছো। আমার কারণে তোমার এতো বদনাম হয়েছে। সবাই জেনে গেছে বিষয়টা। হয়তো আমাদের নিয়ে আজে বাজে কথাও বলা শুরু করেছে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তূবা বলল,
‘আজ বা কাল সবাই এমনি বুঝতে পারতো। লোকে কথা বানানোর তা এমনিই বানাতো। তোমার সাথে বিয়ের পর বানাতো, ছেলে ছোটো মেয়ে বড়ো সেসব কাহিনী, তারপর যখন বিয়ের পর সময়ের আগে বেবি হতো তখন এমনিই বুঝতে পারতো বাচ্চা বিয়ের আগের। তখন কথা এমনিই রটতো। তারচেয়ে আগে জেনে যা বলার বলে নিক। আমার আর এখন কারো কথায় ভয় লাগে না।’
শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘তোমাকে কেউ বাজে কথা বললে আমাকে বলবে, আমি তাকে দেখে নিব।’
তূবা, শ্রাবণকে নিজের কাছে ডেকে ওর কপালে চুমু এঁকে বলল,
‘আজ বাবার সামনে তোমার যে সাহস, দৃঢ়তা আমি দেখেছি, অতো সাহস হয়তো আমি মরে গেলেও করতে পারতাম না।’
‘আমি তো জানি, আমার তূবা ভীতুর ডিম। সে জন্য সবসময়ই বলেছি তুমি ভয় পেও না, কোনো টেনশন করো না, আমাদের রিলেশনের সব সমস্যা আমি সমাধান করবো। তুমি কেন চাচ্চুকে সত্যি বলতে গেলে। মিথ্যা বলে দিতে।’
‘মিথ্যা বললেও বাবা তো পরে জানতোই যে মিথ্যা বলছি।’
‘বিয়ের পর জানলে কিছু হতো না। তখন বিষয়টা অন্য ভাবে নিতো। তবে দেখতে গেলে এখানেও দোষ আমাদের। বর্ষণ ভাইয়া, আর নিহাদ ভাইয়াকে পাঠানো উচিত হয়নি। বোঝা উচিৎ ছিল উনি তারিক জোমাদ্দার। ঘ্যাড়ত্যাড়ামি আর রাগ তো এদের রক্তে।’
তূবা মলিন হেসে বলল,
‘সব দোষ নিজেদের ঘাড়ে নিও না। আর তুমি আমি দুজনেই একই বংশের। কথা হচ্ছে তোমার পরিবারের চিন্তা ভাবনা আমার পরিবারের চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত। আর বাবাকে তো জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি তার রাগই তার সব। তার রাগের কারণে মাকেও তো কম ভুগতে দেখিনি। যেদিন আমার ভাই হলো তার আগের দিন বাবার সাথে মায়ের ঝগড়া হয়েছিল খুব। বাবা রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেলেন। ফিরলেন তখন আর মা নেই।
মা’ কে সঠিক সময়ে কেউ হসপিটালে নিলে হয়তো মা বেঁচে যেতেন। কিন্তু কে নিতো তখন? বাবাকে তখন ফোন করে, খোঁজ নিয়ে পাওয়া যায়নি। ছোটো চাচি তখন বাবার বাড়ি। অন্যরা যে নিয়ে যাবে তা-ও দাদি মাকে হসপিটালে নিতে দেয়নি। আমি বারবার মায়ের কাছে গিয়ে তার যন্ত্রণা দেখে কেঁদেছিলাম। তাকে ছটফট করতে দেখেছিলাম। দাদির অবহেলা আর বাবার রাগ আমাকে মা হারা করেছিল। ছোটোবেলা থেকে মা কে হারানোর পর, বাবার প্রতি আমার পাহাড় সমান ক্ষোপ থাকা সত্ত্বেও কখনো প্রকাশ করিনি, কিন্তু আজ বাবা আমার সাথে যা করলেন সে কথা আমি আর কখনো মনে করতে চাই না। মনে পড়লেই যেন ভয়ে গা শিউরে ওঠে।’
তূবা কাঁদতে লাগল। শ্রাবণ, তূবার চোখের কোণের অশ্রু মুছে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘পিছনের কথা ভেবো না।’
‘শ্রাবণ!’
‘তুমি কখনো আমার হাত ছাড়বা না তো? এখন তো তুমি আর ছাড়া তোমার পরিবার আমার আর কেউ নেই। আমার পরিবার হয়তো কখনো আর আমার মুখও দেখবে না।
শ্রাবণ শক্ত করে তূবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কখনো ছাড়ব না। দেখো মৃত্যু পূর্বেও আমি শুধু তোমার কথাই ভাববো।’
তূবা শুয়েই ছিল। শ্রাবণ ওকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা দিয়ে রইল।
অনেকটা সময় এভাবেই কেটে গেল। কথা ভিতরে ঢুকে মৃদু হেসে গলা খাকরি দিয়ে বলল,
‘কথা শেষ হয়েছে তোদের?’
শ্রাবণ বলল,
‘হুম।’
‘তাহলে শোন। এটাই তোদের শেষবার জড়িয়ে ধরা। বাবু না হওয়া পর্যন্ত তোরা একে অপরকে টাচ পর্যন্ত করতে পারবি না। রেজিট্রি করার জন্য কাজী চলে এসেছে। কিছুক্ষণ পর তোদের রেজিট্রি হয়ে যাবে। তারপর আগামী সাত আট মাস তোদের কঠিন পরীক্ষা শুরু। একই বাড়িতে থেকেও তোদের দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কী রে পারবি তো? এবার আর আমাদের ভরসা ভাঙিস না।’
দুজনেই লজ্জায় কথার দিকে তাকাল না। কথা বলল,
‘শ্রাবণ এখন তুই বের হ। আমি তূবাকে একটু ফ্রেশ করিয়ে দি।’
শ্রাবণ টুপ করে তূবার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘এটাই শেষ আপু।’
কথা হাসল। তূবাও লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর,
শ্রাবণের পরিবারের উপস্থিতিতে তূবা আর শ্রাবণের বিয়ের রেজিট্রি হয়ে গেল। কণে পক্ষ হলো কথা আর নিহাদ। আইনিভাবে আজ থেকে ওরা স্বামী স্ত্রী। যদিও ধার্মিক দিক থেকে এ বিয়ে শুদ্ধ নয়, সে কথা সবাই জানে। এটা বাইরের লোকের মুখের কটু কথা বন্ধ করার একটা সাধারণ টোটকা মাত্র।
বিয়ের পর সবাই বাড়ি চলে গেল, তূবার সাথে থেকে গেল কথা আর শ্রাবণ। কথা, শ্রাবণকেও চলে যেতে বলেছিল, কিন্তু শ্রাবণ নাছোড়বান্দ, ও তূবাকে না নিয়ে হসপিটাল থেকে নড়বে না।
কথা আর তূবা দু’জন গল্প করছিল, শ্রাবণ দূরে বসে তূবার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর আনন্দ লাগছে এটা ভেবে যে, তূবাকে সারাজীবনের জন্য পেয়ে গেছে। নিজেদের করা অন্যায়টা করার পর থেকে মনে সবসময় ভয় লেগে থাকত যে তূবাকে পাবে তো? যদি না পায় তবে কী হবে? এর বেশি ভাবতে পারতো না শ্রাবণ। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরতো ও ব্যতিত আর কেউ তূবাকে স্পর্শ করতে পারবে না। সেসব শ্রাবণ ভাবতে গেলেই কেমন দম আটকানো অনুভূতি হতো ওর। আজ থেকে তেমন কোনো দমবন্ধ হওয়া অনুভূতি হবে না। তূবাকে হারানোর ভয়ও হবে না। তূবা সারাজীবনের জন্য শ্রাবণের।
গভীর রাত,
শ্রাবণ, তূবার পাশে বসে ওর হাত ধরে ওর মুখের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে। তূবা গভীর ঘুমে ডুবে আছে। শ্রাবণের তাকিয়ে থাকা দেখে কথা আস্তে করে বলল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?’
‘আপু, ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে। মনে অদ্ভুত প্রশান্তি পাই।’
কথা মৃদু হেসে বলল,
‘এটাই হয়তো ভালোবাসার প্রশান্তি।’
৫০!!
তারিক সাহেব মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগে তিনি খবর পেয়েছেন তূবা শ্রাবণের বিয়ের। অদ্ভুতভাবে তার রাগ হচ্ছে না বরং নিজের করা কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে। তাছাড়া তামিমা, আরিফ সেই সন্ধ্যা থেকে তাকে অনেক কথা শুনিয়েছে। তখন মাথা গরম করে তিনি যা তা করে ফেলেছেন, কিন্তু এখন রাত যত গভীর হয়েছে তার রাগ তত ঠান্ডা হচ্ছে আর তার অনুশোচনা তত বাড়ছে। মেয়ে অন্যায় করেছে ঠিক, তবে তিনি কী ঠিক কাজ করেছেন?
“রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”
অর্ডার করেছেন তো?
চলবে।