অর‌ণ্যে রোদন পর্ব-৪৯+৫০

0
308

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪৯

তা‌রিক সা‌হেব একা একা ভাব‌তে লাগ‌লেন, কাজটা তি‌নি মো‌টেও ঠিক ক‌রে‌নি। তূবা‌কে চড় মারা পর্যন্ত মানা গে‌লেও ওর পে‌টে লা‌থি মারা মো‌টেও উচিত হয়‌নি তার। মে‌য়েটা গর্ভবতী। তার শরী‌রে আঘাত করার আগে তার ভাবা উচিত ছিল। যে মে‌য়ে মা হ‌তে পার‌বে না বলে, সে সৃ‌ষ্টিকর্তার নিকট তার এতো অভি‌যোগ কর‌তো, সেই মে‌য়ে মা হ‌চ্ছে। এবং তি‌নি সে সন্ত‌ান‌কে হত্যা কর‌তে চেয়ে‌ছিল। বিষয়টা তার জন্য পৃ‌থিবীর সব‌চে‌য়ে আন‌ন্দের সংবাদ হ‌তে পারত, কিন্তু হলো সব‌চে‌য়ে রাগের সংবাদ।

তার বুঝদার মে‌য়েটা কী ক‌রে এতো ব‌ড়ো ভুলটা করল তি‌নি সেটাই ভে‌বে পান না! তার‌ সব‌চে‌য়ে বে‌শি রাগ হ‌য়ে‌ছে তার মে‌য়ে নি‌জের চে‌য়ে ছো‌টো ছে‌লের সা‌থে সম্প‌র্কে কীভা‌বে জড়া‌লো? আর সম্প‌র্কে জ‌ড়ি‌য়েও থে‌মে যায়নি, তার সন্তান পর্যন্ত গ‌র্ভে ধ‌ারণ ক‌রেছে। এতো‌কিছুর পর তা‌রিক সা‌হেব নি‌জের মাথা ঠিক রাখ‌তে পা‌রেন‌নি।
কী করে রাখ‌বেন, তি‌নি তূবা‌কে প্রচণ্ড ভরসা কর‌তেন। এই পৃ‌থিবী‌তে একমাত্র তূবাই তার সব‌চে‌য়ে আপন, তূবা‌কেই সে সব‌চে‌য়ে বে‌শি ভা‌লোবাস‌তো, ভরসা কর‌তো, বিশ্বাস কর‌তো, তার সেই মে‌য়ে তার বিশ্বাস ভে‌ঙে গু‌ড়ি‌য়ে দি‌লো। বিষয়টা হজম করতে পা‌রে‌নি তা‌রিক সা‌হেব।

বরাবরই তার রা‌গের কা‌ছে তি‌নি খুব অসহায়। এই রা‌গের কার‌ণে তি‌নি তার স্ত্রী এবং দ্বিতীয় সন্তান‌কে হা‌রি‌য়ে‌ছিল, আর এই রাগই তার প্রথম সন্তান এবং পৃ‌থিবীতে বেঁ‌চে থাকার একমাত্র অবলম্বন‌কে দূর ক‌রে দি‌লো। তি‌নি কী পার‌বে কখ‌নো তূবার সা‌থে কথা বল‌তে? যে পে‌টে লা‌থি মে‌রে তূবার বাচ্চা‌কে মে‌রে ফেলতে চে‌য়ে‌ছিল, সেই বাচ্চা পৃ‌থিবীতে আসার পর তা‌কে নানাভাই বলে ডাক‌লে, সে কী সে ডাক অগ্রাহ্য কর‌তে পার‌বে? না‌কি তখন প‌রি‌স্থি‌তি সম্পূর্ণ আলাদা হ‌বে?’

তা‌রিক স‌া‌হেব কঠিন ম‌নের মানুষ। তি‌নি কখ‌নো কাঁদতে পা‌রে না। তার স্ত্রীর মৃত্য‌ু‌তেও এক ফোঁটা চো‌খের জল ফেলে‌নি। আজ তার মে‌য়ের কাছ থে‌কে তি‌নি সব‌চে‌য়ে বে‌শি কষ্ট পে‌য়ে‌ছে। স্ত্রী‌কে হা‌রি‌য়ে তি‌নি সে‌দিন যেমন কষ্ট পে‌য়ে‌ছিলেন, আজও তদ্রুপ কষ্ট পে‌য়ে‌ছেন, কিন্তু আজও তার চোখ থে‌কে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরেনি।
তি‌নি ব‌সে রইল তূবার শূণ্য রুমটায়। মে‌য়েটার স্মৃ‌তিগুলো কেমন তা‌কে ঝাপ‌টে ধর‌ছে। তূবার রু‌মে ওর ব্যবহৃত প্র‌তিটা বস্তু যেন বারবার তা‌কে বাবা বাবা ডাক‌ছে। চিৎকার ক‌রে ডাক‌ছে। তা‌রিক সা‌হেব তূবার রুম দ্রুত ত্যাগ কর‌লেন। নয়‌তো দমবন্ধ হ‌য়ে ম‌রে যেত হয়‌তো।

রাত চারটা,
কে‌বি‌নের ম‌ধ্যে থাকা দু‌টো বে‌ডের একটা‌তে কথা ঘুমা‌চ্ছে, আরেকটা‌তে তূবা। শ্রাবণ, তূবার পা‌শে ব‌সে থাক‌তে থাক‌তে বসা অবস্থায়ই ওর বে‌ডে মাথা দি‌য়ে ঘু‌মি‌য়ে গে‌ছে। তূবার ঘুম ভ‌াঙল। আস্তে ক‌রে উঠল। দেখল শ্রাবণ ওর বে‌ডে মাথা দি‌য়েই ব‌সে ব‌সে ঘুমা‌চ্ছে।

তূবা, শ্রাব‌ণের মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে দি‌তে লাগল। ম‌নে ম‌নে বলল,
‘‌কেন আমায় এতো ভা‌লোবাস‌লি শ্রাবণ? এতো ভা‌লো না বাস‌লেও হতো! আমার খুব ভয় ক‌রে, ভীষণ ভয়। তোর এই মাত্র‌তি‌রিক্ত ভা‌লোবাসা সর্বদাই আমার ভ‌য়ের কারণ ছিল, আজও আছে। তোর এতো ভা‌লোবাসাই আমা‌কে সবসময় পাগল ক‌রে রে‌খে‌ছে। না জা‌নি ভ‌বিষ্য‌তে কী হয়? তোর এই মাত‌াল করা ভা‌লোবাসার কার‌ণেই তো এতো ব‌ড়ো ভুলটা হ‌লো। কাউ‌কে নি‌জের পু‌রো অস্তিত্ব দি‌য়ে ভা‌লোবাস‌তে নেই। সে জন্যই সে‌দিন না আমি নি‌জে‌কে আটকা‌তে পে‌রে‌ছিলাম, না তো‌কে। তোর এতো ভা‌লোবাসা ফি‌রি‌য়ে দেওয়ার মতো সাহসটা আমার কখনোই ছিল না।’

তূবা আস্তে ক‌রে নি‌চে নামল। নি‌চে নে‌মে বুঝল তখন প‌ড়ে গি‌য়ে পা‌য়ে যে চোট পে‌য়ে‌ছিল তার ব্যথাটা একটু বে‌ড়ে‌ছে। এতক্ষণ শু‌য়ে ছিল বলে অনুভব হয়নি, এখন বেশ বুঝ‌তে পার‌ছে। ত‌বে তবুও ধীরে ধী‌রে বাথরু‌মে গি‌য়ে ফ্রেশ হ‌য়ে আসল। কথা, আর শ্রাবণ‌কে ইচ্ছা ক‌রে উঠায়‌নি। সেই সকাল‌ থে‌কে কম তো ধকল যায়নি ওদের।

তূবা, শ্রাব‌ণের পা‌শে দাঁ‌ড়ি‌য়ে ওর গা‌লে হাত রে‌খে ধী‌মি আওয়া‌জে ডাকল,
‘শ্রাবণ!’
শ্রাবণ ধরপ‌রি‌য়ে উঠে বলল,
‘কী হ‌য়ে‌ছে? কো‌নো সমস্যা? তু‌মি ঠিক‌ আছো?’

তূবা স্মিত হে‌সে বলল,
‘কিছ‌ু হয়‌নি। তুমি এই বে‌ডে শু‌য়ে পড়ে। আমি কথার পা‌শে গি‌য়ে শু‌য়ে প‌ড়ি।’
‘না না। এতোটুকু বে‌ডে দুজন শু‌তে পারবা না। তারপর তু‌মি পড়ে যাবা।’
‘‌কিছু হ‌বে না।’
শ্রাবণ মৃদু ধমক দি‌য়ে বলল,
‘চুপ।’

শ্রাবণ নি‌জেই তূবা‌কে বে‌ডে উঠি‌য়ে শুই‌য়ে দিয়ে বলল,
‘লক্ষী মেয়ের ম‌তো ঘু‌মি‌য়ে পড়ো। সকাল হ‌তে বে‌শি বা‌কি নেই।’
‘শ্রাবণ!’
‘হুম।’
‘আই লাভ ইউ।’

শ্রাবণ হে‌সে বলল,
‘বাহ্! বি‌য়ে হ‌তে না হ‌তেই ম্যাডাম দেখ‌ছি লক্ষী বউ হ‌য়ে গেছে। এত বছর যাবত তো বো* ম মা* র‌* লেও আগে ভা‌লোবাসার কথা ব‌লো‌নি, আজ মেঘ না চাই‌লেই বৃ‌ষ্টি।’
তূবা লাজুক হাসল।’
শ্রাবণ ওর হাত ধ‌রে বলল,
‘এখন ঘুমাও।’

খুব সকালবেলা,
‌ভোর হ‌তে না হ‌তেই তূবার ছো‌টো ফু‌পি তহ‌মিনা এসে হাজির হ‌লো, তূবা‌দের বাড়ি। তি‌নি এসে দুই দন্ডও বস‌লে না বরং পু‌রো বা‌ড়ি মাথায় তু‌লে ফেল‌লেন। তূবার করা কর্মকা‌ন্ডের কথা চে‌ঁচি‌য়ে করে বলতে লাগল,
‘আ‌মি আগেই জানতাম এই মে‌য়ে বং‌শের নাম ডুবা‌বে। ভাইয়া লাই দি‌য়ে দি‌য়ে মাথায় তু‌লে রে‌খে‌ছি‌লেন। এত স্বাধীনতা মে‌য়ে‌দের দি‌লে সে মে‌য়ে তো নষ্ট হ‌বেই। আর মে‌য়ের কী চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! কথা মো‌টে মা‌টি‌তে পড়‌তে দিতো না। কিছু বল‌তেই পারতাম না। বল‌লেই কালনা‌গিনীর ম‌তো ফনা তু‌লে ফস ক‌রে উঠত।

এখন তো বি‌য়ের আগে পেট বাঁ‌ধি‌য়ে‌ছে। তা-ও নি‌জের ছো‌টো ভাই এর সা‌থে। ছি ছি আমার তো ভাব‌তেই গা গোলা‌চ্ছে। সম্পর্ক কর‌বি কর, তাই ব‌লে নি‌জের ছো‌টো ভ‌াই এর সাথে?’

তা‌মিমা বেশ রাগ ক‌রে বলল,
‘শ্রাবণ ওর ভাই নয়, চাচা‌তো ভাই আর এখন তূবার স্বামী। চাচা‌তো ভাই‌কে বি‌য়ে করা কি জা‌য়েজ নয়? আপনার ছে‌লের জন্যও তো তূবা‌কে নি‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন। যেখা‌নে আপ‌নি ওর আপন ফুপু, শ্রাব‌ণের বাবা তো আপনা‌দের আপন ভাইও না। তাহ‌লে ওদের ভিতর বি‌য়ে হ‌লে সমস্যা কী?’

‌’ওসব বাদ দাও। শ্র‌াবণ তো ওর চে‌য়ে ছো‌টো।’
‘‌তো কোন হা‌দি‌সে লেখা আছে বয়‌সে ছো‌টো ছে‌লে‌দের বি‌য়ে করা যা‌বে না?’
এবার তহ‌মিনা রে‌গে বলল,
‘এ‌তো জা‌য়েজ না জা‌য়েজ কর‌ছিস, তোর শ‌খের মে‌য়ে যে পে‌টে নাজা‌য়েজ বাচ্চা বাঁ‌ধি‌য়ে‌ছে তা নি‌য়ে কী বলবি?’

তা‌মিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘বাচ্চা নাজা‌য়েজ তখন হ‌তো যখন বাচ্চার বাবা বাচ্চা‌কে অস্বীকার কর‌তো। শ্রাবণ কিন্তু তা ক‌রে‌নি। বা‌ড়ি ভ‌র্তি সক‌লের সাম‌নে দাঁ‌ড়ি‌য়ে বলে‌ছে তূবার গ‌র্ভের বাচ্চা ওর। শুধ‌ু তাই না, গতকাল রা‌তে তো ওদের বি‌য়েও হ‌য়ে গে‌ছে। যেখা‌নে বাচ্চার বাবা নি‌জে বাচ্চা‌কে স্বীকৃ‌তি দি‌য়ে‌ছে সেখা‌নে আপ‌নি আমি তা‌কে নাজা‌য়েজ বলার কে?’

তহ‌মিনা এবার চ‌ুপ হ‌য়ে গেল। তা-ও বেশ ব‌ড়ো গলায় বলল,
‘‌কিন্তু ঐ মে‌য়ের কার‌ণে আমা‌দের বংশের নাম ধূ‌লোয় মি‌শে গে‌ছে।’

তামিমা বেশ রাগ ক‌রেই বলল,
‘তার জন্য আপনার ব‌ড়ো ভাইয়ার রাগ দায়ী। হ্যাঁ তূবা মস্ত ব‌ড়ো অন্যায় ক‌রে‌ছিল, কিন্তু ওরা অন্যায়টা‌কে শুধ‌রে নি‌তে চে‌য়ে‌ছিল, যার সু‌যোগ ভাইয়া দেয়‌নি। শ্রাবণ আর ওর প‌রিবার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নী‌রবভা‌বে সমাধান করতে চে‌য়েছিল যা‌তে লোক জ‌ানাজা‌নি না হয় বং‌শেরও বদনাম না হয়, কিন্তু ভাইয়ার মাত্রার অধিক রাগ সব শেষ করে দি‌য়ে‌ছে। লোকজ‌ড়ো হ‌য়ে‌ছিল তার চেঁচা‌মে‌চির কার‌ণে। তি‌নিও চাই‌লে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা সমাধান কর‌তে পার‌তেন। তা‌তে লোক জানাজা‌নিও হ‌তো না, বং‌শের নামও খারাপ হ‌তো না। এখন ব‌লেন দোষ কার?’

তহ‌মিনা এবার পু‌রোপু‌রি চুপ হ‌য়ে গেল। তা‌মিমার কথার উপর কথা বলার ম‌তো কো‌নো কথা তি‌নি খুঁ‌জে পেল না। ভিত‌রের রু‌মে ব‌সে সবটা শু‌নেও চুপ ক‌রে বসে ছি‌লেন তা‌রিক সা‌হেব।

বিড়‌বিড় ক‌রে বলল,
‘আমার নি‌জের বোন এ ধর‌ণের কথা বল‌ছে তাহ‌লে তো বাই‌রের লোক নানা রক‌মের আজে বা‌জে কথা বল‌বে। আমার কথা না হয় বাদ দিলাম, তূবা কি সহ্য কর‌তে পার‌বে সেসব কথা? মানু‌ষের কথা বি‌ষের চে‌য়েও বিষময়। আমার মে‌য়েটা কি পার‌বে, সে বিষাক্ত কথা সহ্য ক‌রে টি‌কে থাকতে? আমি নি‌জেই নি‌জের মে‌য়ের জীবনটাকে বিষময় ক‌রে ফেললাম। কেন যে নি‌জের রা‌গের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখ‌তে পা‌রি না! কাল‌কে য‌দি আমি মু‌র্খের ম‌তো আচরণ না করতাম ত‌বে বিষয়টা এতো খারাপ হ‌তো না। কেন করলাম ঐ ভুল? আমার মে‌য়ে জঘণ্য অন্যায় ক‌রেছে, কিন্তু আমিও তার চে‌য়ে কম কিছু ক‌রি‌নি।’

তা‌রিক সা‌হেব আজ আর বের হ‌লেন না। তি‌নি সিদ্ধান্ত নি‌লেন ক’‌দিন ঘর থে‌কে বের হ‌বেন না। তূবার খবরটা নেওয়া দরকার। মে‌য়েটা‌কে এতো আঘাত ক‌রে‌ছে, মে‌য়েটা সুস্থ আছে তো? তার গ‌র্ভের সন্তান ঠিক আছে তো? তা‌রেক সা‌হেব কা‌কে যেন কল ক‌রে বলল, তূবার সব খবর যেন তা‌কে দেওয়া হয়।

৫১!!
ডাক্তার আস‌লেন তূবার চেকাপ কর‌তে। ডাক্তার সুমা বলল,
‘আ‌মি রোগীর সা‌থে একা কথা বল‌তে চাই।’
কথা আর শ্রাবণ ডাক্তার সুমার কথা শু‌নে কে‌বিন থে‌কে বাই‌রে চ‌লে গেল।

ডাক্তার সুমা তূবার পা‌শে ব‌সে বলল,
‘এখন শরীর কেমন লাগ‌ছে আপনার?’
‘‌জি ভা‌লো।’
‘‌পে‌টে ব্যথা ক‌মে‌ছে?’
‘‌জি।’
‘‌কিছু কথা জি‌জ্ঞেস ক‌রি? মাইন্ড কর‌বেন না এবং স‌ত্যি বলবেন। আপ‌নি স‌ত্যি বললে আমি আপনার হেল্প কর‌তে পারব।’
‘‌জি করুন।’

‘আপ‌নি কী স‌ত্যি প‌ড়ে গেছি‌লেন? মা‌নে আপনার শ্বশুর বা‌ড়ির লোক তো তা-ই বলল।’
‘‌কে‌নো বলেন ‌তো?’
‘আমার ধারণা আপনার সা‌থে খারাপ কিছু হ‌য়ে‌ছে। আপনার শ্বশুর বা‌ড়ির লোক কিছু ক‌রে‌ছে।’

তূবা ভ্রু কুচ‌কে বলল,
‘এমন কেন ধারণা হলো?’
‘আপনার গালে চ‌ড়ের দাগ। ঠোঁট ফে‌টে গেছিল। হা‌তেও বেশ ব্যথা পে‌য়ে‌ছেন। লা‌কি‌লি আপনা‌র বে‌বির কিছু হয়‌নি। হয়‌তো তারা আমা‌দের থে‌কে স‌ত্যিটা গোপন কর‌ছেন। মে‌বি তারা আপনা‌কে মে‌রে‌ছেন এবং আপনা‌কে স‌ত্যি না বলার জন্য ভয় দেখি‌য়ে‌ছে। আপ‌নি স‌ত্যিটা বলুন, প‌রের বিষয়টা আমি দেখব। ঘ‌রের বউ‌দের যারা অত্যাচার ক‌রে তা‌দের মো‌টেও ছে‌ড়ে দেওয়া উচিত না।’

তূবা দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বলল,
‘আমার আর শ্রাব‌ণের মা‌নে আমার স্বামীর বি‌য়ে গতকাল আপনা‌দেরই হস‌পিটা‌লে ব‌সে হ‌য়ে‌ছে।’
ডাক্তার সুমা চম‌কে তাকাল। তারপর বলল,
‘কাল বি‌য়ে হ‌লে আপনা‌দের বাচ্চা?’
‘‌বি‌য়ের আগে আমা‌দের করা ভু‌লের ফসল। আর আমার কিংবা আমার স্বামীর শরী‌রে যে আঘা‌তের চিন্হ তা আমার বাবার করা। আমার শ্বশুর বাড়ির লোক আমা‌দের বি‌য়েটা মান‌তে পার‌লেও আমার বাবা পা‌রে‌ননি।’

তারপর তূবা, ডাক্তার সুমা‌কে সং‌ক্ষে‌পে পু‌রো ঘটনা খু‌লে বলল। সবশু‌নে ডাক্তার সুমা বেশ অবাক হ‌লেন। সব‌চে‌য়ে বে‌শি অবাক হ‌লেন, এতো কিছুর পরও শ্রাবণ, তূবা‌কে ছা‌ড়ে‌নি জে‌নে। শক্ত ক‌রে তূবার হাতটা ধ‌রে রে‌খে‌ছে জে‌নে। অথচ গতকাল থে‌কে উনি শ্রাবণ‌কে নি‌য়ে যা নয় তাই ভে‌বে‌ছেন।

স্ত্রীর উপর নির্যাতন কর‌ার জন্য ম‌নে ম‌নে গালাগাল ক‌রে‌ছেন। বারবার সুন্দর ছে‌লে‌দের গু‌ষ্ঠি উদ্ধার ক‌রেছে। ডাক্তার সুমা এ পর্যন্ত যতগুলা অধিক সুন্দর ছে‌লে দে‌খে‌ছিল সবগুলার কো‌নো না কো‌নো অন্যায় পে‌য়ে‌ছেন। তি‌নি ম‌নে ম‌নে ভে‌বে নি‌য়ে‌ছি‌ল জীব‌নে সুন্দর ছে‌লে‌দের বি‌য়ে কর‌বে না। এগুলা একেকটা মিচ‌কে শয়তান। তার প্রাক্তনও তো সুন্দর ছিল, সা‌থে এক নাম্বারের মিচকা শয়তান।

তার ম‌নে একটা স্থায়ী ধারণা হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছিল সুন্দর ছে‌লেদের চ‌রি‌ত্রে সমস্যা থা‌কে। এরা বিশ্বাস ধ‌রে রাখ‌তে পারে না। অথচ তূবার মু‌খে শ্রাব‌ণের কথা শু‌নে তার ম‌নে হলো, তার চিন্তাধারা বদ‌লা‌নো উচিত।
‌তি‌নি মুচ‌কি হে‌সে তূবার চেকাপ ক‌রে চলে গে‌লেন।

‌বিকালবেলা,
তূবা‌কে বা‌ড়ি নেওয়ার তোর‌জোর চল‌ছে। শ্রাবণী, তূবার জন্য লাল র‌ঙের বি‌য়ের শা‌ড়ি পা‌ঠি‌য়ে‌ছে। কথা, তূবা‌কে শা‌ড়ি পরা‌তে পরা‌তে বলল,
‘মা ব‌লে‌ছেন বা‌ড়ির নতুন বউ নতুন বউএর ম‌তোই বা‌ড়ি‌তে প্রবেশ ক‌রবে। তুই অসুস্থ না হ‌লে তো‌কে পার্লার থে‌কে সা‌জি‌য়ে নি‌য়ে যেতাম। এখন কষ্ট ক‌রে একটু শা‌ড়িটা সহ্য কর। জা‌নি এ তপ্ত গর‌মে শা‌ড়ি সামলানো খুব ঝা‌মেলার। মাত্র ঘন্টাখানিক থাক। তারপর পা‌ল্টে ফেল‌বি।’
তূবা মাথা নে‌ড়ে সায় দি‌লো।

হস‌পিটাল থে‌কে সব কিছু গু‌ছি‌য়ে যখন ওরা বের হ‌লো তখন বিকাল সা‌ড়ে চারটা বা‌জে। তূবা‌কে নি‌তে নিহাদ, কথা এ‌সে‌ছিল। শ্রাবণ তো আগে থে‌কেই তূবার কা‌ছেই ছিল। গতকাল থে‌কে একমুহূ‌র্তের জন্যও তূবা‌র থে‌কে দূ‌রে যায়‌নি শ্রাবণ।

গা‌ড়ির ম‌ধ্যে ব‌সে শ্রাবণ আল‌তো ক‌রে তূবার পে‌টে হাত রাখল। তূবা খা‌নিকটা চমকে হাত স‌রি‌য়ে দি‌তে চাই‌লে, শ্রাবণ হাত রে‌খেই ফিস‌ফিস জ‌রে বলল,
‘আ‌মি আমার বাবুকে স্পর্শ কর‌ছি। তু‌মি চ‌ুপ ক‌রে ব‌সে থা‌কো।’
‌নিহাদ গা‌ড়ি চালা‌তে চালা‌তে ওদের কান্ড দে‌খে হে‌সে কথার হাতে হাত র‌াখল।

হস‌পিটাল থে‌কে বা‌ড়ির দূরত্ব বিশ মি‌নি‌টের পথ। পাঁচটার ম‌ধ্যে ওরা বা‌ড়ি‌তে পৌঁছা‌লো। বা‌ড়ির গে‌টের সাম‌নে নে‌মে বা‌ড়ির ম‌ধ্যে অনেক লোক দে‌খে তূবা বেশ ঘাব‌ড়ে গেল।

চল‌বে…

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৫০

তূবা বেশ ভয় পে‌তে লাগল, এই লোকগু‌লো ওকে কী না কী ব‌লে? এই লোকগু‌লো‌কে ও ছো‌টো‌বেলা থে‌কে চি‌নে জা‌নে, এদের কথার ধরণ, মানুষ‌কে ছো‌টো করার, বিদ্রুপ করা, তিরষ্কার করার, বা‌জে কথা বলার ধরণ ও ভা‌লো ক‌রে জা‌নে ও। সমা‌জের বাই‌রের লে‌াকগু‌লো সব মু‌খি‌য়ে থা‌কে প‌রের ঘ‌রে কী হ‌চ্ছে তা দেখার জন্য!

এতো‌দিন তূবা অন্যেকে ছোটো কর‌তে দে‌খে‌ছে এদের। দে‌খে‌ছে সব জে‌নেশু‌নেও প্রশ্ন‌বিদ্ধ ক‌রে কষ্ট দি‌তে। উত্তর জানা স‌ত্ত্বেও একই প্রশ্ন বারবার ক‌রে কষ্ট দি‌তে। আজ তূবা‌কে প্রশ্ন করার দিন, ওকে কষ্ট দেওয়ার দিন। আর যখন শো‌নে একটা মে‌য়ে বি‌য়ে ছাড়াই মা হ‌তে যা‌চ্ছিল, তা‌কে যে সমাজ কতটা বা‌জে কথা বল‌তে পা‌রে, সে সম্প‌র্কে তূবার ধারণা আছে।

শ্রাবণ গা‌ড়ি থে‌কে নে‌মে তূবা‌কে নাম‌তে বলল। তূবা মাথা নে‌ড়ে না বলল। ওর ভয় কর‌ছে। শ্রাবণ হাত বা‌ড়ি‌য়ে বলল,
‘হাত ধ‌রে ভিত‌রে চ‌লো। কেউ তোমা‌কে কিছু বল‌লে উত্তর আমি দিব।’
কথাও, শ্রাব‌ণের পা‌শে দাঁড়ি‌য়ে বলল,
‘হুম, ভিত‌রে চল। দে‌খি কে কী ব‌লে? ভয় পাস‌নে।’

তূবা, শ্রাব‌ণের হা‌তে হাত রে‌খে গা‌ড়ি থে‌কে নামল। লাল র‌ঙের বি‌য়ের বেনার‌সীতে তূবা‌কে অনবদ্য লাগ‌ছিল। দূর থে‌কে শ্রাবণী দে‌খে বলল,
‘মাশাআল্লাহ্। দেখ নীরা, আমার ছে‌লেটা পরীর ম‌তো বউ পে‌য়ে‌ছে।’
নীরা হে‌সে বলল,
‘হ্যাঁ। স‌ত্যি দু’জন‌কে দারুণ মা‌নি‌য়ে‌ছে।’

শ্রাবণ, তূবার হাত ধ‌রে ধী‌রে ধী‌রে হাঁ‌টি‌য়ে নি‌য়ে যা‌চ্ছে। তূবার পা‌য়ে ব্যথা দ্রুত হাঁট‌তে পার‌ছে না। অল্প একটু পথ। বা‌ড়ির গেট থে‌কে ঘর পর্যন্ত। হিসাব কর‌লে ক‌য়েক সে‌কে‌ন্ডের পথ, কিন্তু তূবা ভিতরে ভিত‌রে এতটাই ভীত যে কয়েক সে‌কে‌ন্ডের পথ ওর কা‌ছে ক‌য়েক মাইল ম‌নে হ‌চ্ছে।

প্রচণ্ড ভ‌য়ে তূবা ঘাম‌তে লাগল, প্রেশার নাম‌তে লাগল। ঘ‌রে প্র‌বেশ করার দু কদম আগে তূবা আর নি‌জে‌কে সাম‌লে রাখ‌তে পা‌রল না। কথার উপর বেহুশ হ‌য়ে প‌ড়ে গেল। শ্রাবণ ধ‌রে ফেলল। কথা বলল,
‘ভাই কো‌লে নে ওকে।’

শ্রাবণ কো‌লে নি‌য়ে ভিত‌রে ঢু‌কল। তূবা‌কে বেহুশ দে‌খে, শ্রাবণী বেশ ঘাব‌ড়ে গি‌য়ে বলল,
‘কী হ‌য়ে‌ছে ওর?’
কথা আন্দা‌জেই ব‌লল,
‘মা, আমার ধারণা বাইরের মানুষ দে‌খে ও প্রচণ্ড ভয় পে‌য়ে সেন্স‌লেস হ‌য়ে গেছে। এতো লোক কেন মা?’
‘বু‌ঝিস না, তামাসা দেখ‌তে আস‌ছে। আরও ছিল, আমি বহুকথা ব‌লে তা‌দের ভাগি‌য়ে‌ছি। এরা ব‌সে আছে নতুন বউ দেখ‌বে ব‌লে।’

শ্রাবণ রাগ ক‌রে বলল,
‘নতুন বউ দেখার কী আছে? তূবা‌কে ওরা ছো‌টো‌বেলা থে‌কে দে‌খে আস‌ছে। বি‌য়ের পর দেখার কী আছে? ওর কি নতুন ক‌রে ডানা গজাই‌ছে? মা, ওরা য‌দি তূবা‌কে উল্টা পাল্টা কিছু ব‌লে, আমি কিন্তু ছাড়ব না।’
‘তুই চুপ থা‌কিস, যা বলার আমি বল‌বো। আমি থাক‌তে তূবা‌কে কেউ বা‌জে কথা বল‌তে পার‌বে না। তুই ওকে তোর রু‌মে নি‌য়ে যা।’

শ্রাবণ, তূবা‌কে নি‌জের রুমে বিছানায় নি‌য়ে গি‌য়ে শুইয়ে দিয়ে এসি অন ক‌রে দি‌লো। কথা, তূবার পা‌শে ব‌সে চো‌খে মু‌খে পা‌নির ঝাপটা দি‌লো।

তূবার জ্ঞান ফি‌রলে কথা প্রেশার মে‌পে ‌বলল,
‘বল‌ছিলাম না, ভ‌য়ে প্রেশার লো হ‌য়ে বেহুশ হ‌য়ে গে‌ছে। এই মে‌য়েটা এতো ভীতু!’
শ্রাবণ স্ব‌স্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কথা, শ্রাবণ‌কে বলল,
‘ওর পা‌শে বস। আমি ওর জন্য থ্রি পিচ নি‌য়ে আসি। গর‌মে শা‌ড়ি প‌রে ঘে‌মে একাকার হ‌য়ে গে‌ছে।’

শ্রাবণী, তূবার মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে বলল,
‘এতো কেন ভয় পে‌লি?’
তূবা কিছু বল‌তে পারল না।
শ্রাবণ, তূবার দি‌কে তা‌কি‌য়ে ধমক দি‌য়ে বলল,
‘এই তু‌মি, এতো ভীত‌ুর ডিম কেন? ইদা‌নিং তো আরও বেশি ভীতু হ‌য়ে‌ছে।’
শ্রাবণী, শ্রাব‌ণের দি‌কে রাগী চো‌খে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘ওর সিচু‌য়েশন তুই বুঝ‌তে পার‌বি না। কো‌নো ছে‌লেই পার‌বে না। এমন প‌রি‌স্থি‌তি‌তে ভয় পাওয়া স্বাভা‌বিক।’

শ্রাবণ বলল,
‘‌কেন ভয় পা‌বে? কই আমার সা‌থে প্রেমের শুরুর দিকে তো ক‌তো সাহসী ছিল! আর আমি যখন ওর পিছ‌নে ঘুরতাম, তখন তো আমা‌কে কতো মা ই র দিতো, দৌড়ানি দিতো। কতবার নাক ফা‌টি‌য়ে‌ছে, কপাল ফা‌টি‌য়ে‌ছে, তখন সাহস কোথা থে‌কে‌ আসত?’
শ্রাবণী মুখ টি‌পে হে‌সে বলল,
‘বেসরম ছে‌লে। নীরা চলতো।’

শ্রাবণী আর নীরা যে‌তেই শ্রাবণ বলল,
‘কী হ‌লো ব‌লো? এখন কেন এতো ভয় তোমার? আমা‌কে মারার সময় তো কখ‌নো ভয় পে‌তে দে‌খি‌নি।’
‘আ‌মি জানতাম তো‌মাকে যা-ই ক‌রি না কেন, তুমি কখ‌নো আমার ক্ষ‌তি কর‌বা না, আমা‌কে কষ্ট দি‌বা না। কারণ জানতাম তু‌মি আমার, কিন্তু আমা‌দের আত্মীয়-স্বজন তোমার ম‌তো নয়। আ‌মি যা-ই বল‌বো না কেন, তারা সেটা দো‌ষে নি‌বে।’

‘‌মেজাজ খারাপ করবা না তো? তারা দো‌ষে নি‌লে তোমার কী আসে যায়? তারা দো‌ষে নিলে তোমার জন্য কি অক্সি‌জেন নেওয়া বন্ধ হ‌য়ে যা‌বে? না‌কি তোমার বয়স ক‌মে যা‌বে? যারা দো‌ষে নেওয়ার তারা সবসময়ই নি‌বে। তা‌দের কথায় খেয়াল না ক‌রে নি‌জের খেয়াল রা‌খো।’
তূবা মুচ‌কি হে‌সে বলল,
‘তু‌মি আমাকে ধমকা‌চ্ছো।’
শ্রাবণ হে‌সে বলল,
‘একশবার ধমকা‌বো।‌ এখন তো আর বয়‌ফ্রেন্ড নেই, তোমার হ্যা‌জবেন্ড আর আমা‌দের বাচ্চার বাবা।’
তূবা লজ্জা পেল।

কথা এসে শ্রাবণ‌কে বলল,
‘রুম থে‌কে বের হ। তূবা‌কে চেইঞ্জ করা‌বো। আর আজ তোর প্র‌য়োজনীয় সব‌কিছু এই রু‌ম থে‌কে গেস্ট রু‌মে সিফট কর‌বি।’
‘‌কেন?’
‘আজ থে‌কে তূবা এ রু‌মে থাক‌বে।’
‘তূবার এ রু‌মে থাকার সা‌থে আমার জি‌নিস কেন গেস্টরু‌মে শিফট কর‌তে হ‌বে?’
‘কারণ তুই গেস্টরু‌মে থাক‌বি।’
‘অসম্ভব! আমি আমার বউ আর রুম কো‌নোটা ছাড়া থাক‌তে পারব না।’

কথা, শ্রাব‌ণের কান ধ‌রে বলল,
‘‌বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছে ঠিকই, কিন্তু একসা‌থে থাকার পার‌মিশন তোরা পাস‌নি। সেটা পা‌বি বাবু হওয়ার পর।’
তূবা বলল,
‘কথা, আমি গেস্টরু‌মে থা‌কি, ও নি‌জের রু‌মে থাক।’
শ্রাবণ বলল,
‘আস‌ছে সা‌জেশন দি‌তে। তু‌মি এ রু‌মেই থাকব‌া। তোমার জন্য আমি সব‌কিছু ছাড়‌তে পা‌রি, এ পৃ‌থিবীটাও ছাড়‌তে পা‌রি। এ রুম তো নগণ্য কিছু। রা‌তে সব শিফট কর‌বো। এখন তূবা‌কে কাপড় পা‌ল্টে দে। দেখ ঘে‌মে কেমন ভি‌জে গে‌ছে। নয়‌তো ঠান্ডা লাগ‌বে।’

কথা, তূবা‌কে একটা থ্রি পিচ দি‌য়ে বলল,
‘‌নি‌জে দাঁ‌ড়ি‌য়ে চেইঞ্জ কর‌তে পার‌বি না‌কি আমি হেল্প কর‌বো? মাথা ঘুরা‌চ্ছে এখনও?’
‘পার‌বো।’
‘আচ্ছা ত‌বে আমি রু‌মের বাই‌রে যা‌চ্ছি।’
তূবা জামাটা হা‌তে নি‌য়ে বলল,
‘এগু‌লো কী তোর থ্রি‌-পিচ?’
‘‌কেন?’
‘তাহ‌লে তো আমার বড়ো হ‌বে অনেক। তুই তো আমার চে‌য়ে অনেক লম্বা।’

কথা হে‌সে বলল,
‘জা‌নি তুই একটা ছো‌টো খা‌টো পুতুল। এগু‌লো তোর জামা। সকা‌লে মা গি‌য়ে তোর প্র‌য়োজনীয় সব‌কিছু কি‌নে এনে‌ছেন। আরও আছে রা‌তে দেখা‌বো।’
কথা দুষ্ট‌ু‌মি হে‌সে বলল,
‘বাই দ্যা ওয়ে ভা‌বি, তোর বয়‌ফ্রেন্ড, উফস স‌রি ‌তোর স্বামী ‌কিন্তু তোর ফুল ব‌ডির মাপ জানেন। জামার সাইজ তি‌নিই ব‌লে‌ দি‌য়ে‌ছিল।’
কথা দুষ্ট‌িমি ক‌রে চোখ টি‌পে মিথ্যা বলে বলল,
‘এমনকি তোর সব সি‌ক্রেট ওয়্যারের সাইজও জা‌নেন।’
তূবা লজ্জায় লাল হ‌য়ে গেল। চোখ তু‌লে তাকা‌তেও পারল না।

রা‌তে শ্রাবণী ঘ‌রের সবাই‌কে ডে‌কে বলল,
‘এগা‌রোদিন পর শ্রাব‌ণের পরীক্ষা শেষ। তার ঠিক পাঁচ‌দিন পর শুক্রবার, ব‌ড়ো ক‌রে রি‌সিপশ‌নের আয়োজন ক‌রা হ‌বে। সব আত্মীয় স্বজন নিমন্ত্রণ ক‌রে শ্রাবণ, তূবার বি‌য়ের কথা জানা‌বো। যে‌হেতু বি‌য়ে ঘ‌রোয়াভাবে হ‌য়ে‌ছে তাই রি‌সিপশ‌ন ব‌ড়ো ক‌রে আয়োজন করা হ‌বে। কো‌নো আত্মীয় স্বজন যা‌তে নিমন্ত্রণ থে‌কে বাদ না যায়।

আর শ্রাবণ, তুই যা এখন পড়তে বস। পরশু তোর পরীক্ষা। গত কাল সকাল থেকে তো বই এর চেহারাও দে‌খিস‌নি। কপাল ভা‌লো দু‌দিন তোর বন্ধ ছিল। পরীক্ষায় খারাপ কর‌লে তো‌কে আমি বা‌ড়ি থে‌কে বের করে দিব। তোর বউ বাচ্চা এখা‌নে থাক‌বে, তো‌কে তা‌দের সা‌থে দেখাও কর‌তে দিব না। রি‌সিপশ‌নের কো‌নো আয়োজ‌নে তোর থাক‌তে হ‌বে না। যা করার আমর‌া করব।’

শ্রাবণ বিনা বা‌ক্যে মা‌য়ের কথা মে‌নে নি‌লো। এছ‌াড়া কো‌নো উপায় নেই। ওর করা এতো ব‌ড়ো অন্যায়ের পরও যে, ওর প‌রিবার ওদের মে‌নে নি‌য়ে‌ছেন, সব রক‌মের সাপোর্ট কর‌ছেন, ভা‌লোবাস‌ছেন, তূবার এতো কেয়ার করছে, তূবা‌কে প্রাপ্য সম্মান দি‌চ্ছেন, সেটাই ওর জন্য অনেক। এমন প‌রিবার বা‌টিচালান দি‌য়েও খুঁ‌জে পাওয়া যা‌বে ব‌লে ম‌নে হয় না।

শ্রাবন নি‌জের সকল ধ্যান জ্ঞান লা‌গি‌য়ে দিলো পড়া-‌লেখার পিছ‌নে। দেখ‌তে দেখ‌তে ওর পরীক্ষা শেষ হ‌লো, তূবাও সুস্থ হলো। ধুমধাম ক‌রে ওদের রি‌সিপশনও হ‌য়ে গেল। তা‌রিক সা‌হেব রি‌সিপশ‌নে আস‌লেন না ঠিকই কিন্তু প‌রিবা‌রের বা‌কিরা এসে‌ছিল। তূবার মে‌ঝো আর ছো‌টো চাচা, চা‌চি, বা‌কি কা‌জিনরা। তূবা বাবা‌কে দেখ‌তে না পে‌য়ে কষ্ট পে‌লেও, বা‌কি‌দের পে‌য়ে খুব খু‌শি হ‌য়ে‌ছিল।

তূবা-শ্রাবণ‌কে নি‌য়ে সবাই আড়া‌লে কথা বল‌লেও সাম‌নে কথা বলার ম‌তো সাহস কা‌রো হয় না। তা‌রিক সা‌হেব তূবার সাম‌নে গি‌য়ে দাঁড়া‌তে পা‌রে না। তার ভয় হয়, লজ্জা লা‌গে, খা‌নিকটা রাগও হয়, মে‌য়ের প্রতি তীব্র অভিমানও র‌য়ে‌ছে। সব মিলি‌য়ে তীব্র জ‌ড়োতায় মে‌য়ের সাম‌নে যেতে পা‌রেন না। তি‌নি তূবার সা‌থে কথা না বল‌লেও তূবার সব খবর রা‌খেন। তূবা, শ্রাব‌ণের বা‌ড়ি‌তে খুব ভা‌লো আছে। শ্রাবণ, তূবার খুব খেয়াল রা‌খে। আর শ্রাব‌ণের প‌রিবারও তূবা‌কে নি‌জের মে‌য়ের ম‌তো স্নেহ ক‌রেন।

৫২!!
‌কে‌টে গেল তিনমাস…
কথা বাথরুম থে‌কে বের হ‌য়ে প্রেগ‌নে‌নন্সি টেস্ট‌কিটটা নিহাদের হা‌তে দি‌লো। রেজাল্ট প‌জে‌টিভ দে‌খে নিহাদ, কথা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে ছো‌টো বাচ্চা‌দের ম‌তো হাউমাউ ক‌রে কাঁদ‌তে লাগ‌ল। কথা মৃদু হে‌সে নিহা‌দের পিঠে হাত বু‌লি‌য়ে দি‌তে লাগল। নিহাদ কান্নারত অবস্থায় বলল,
‘এ‌তো কিছু হওয়ার পর আমি কখ‌নো ভা‌বি‌নি তু‌মি আমা‌কে বাবা হওয়ার সৌভাগ্য প্রদান কর‌বে। আমি তোমা‌কে কী বল‌বো বুঝ‌তে পার‌ছি ন‌া! কী ব‌লে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব?’
‘‌তোমা‌কে কিছু বল‌তে হ‌বে না। শুধু ওয়াদা করো আর কখ‌নো কষ্ট দিবা না।’
‘ওয়াদা করলাম। আমি তোমা‌কে ভা‌লোবা‌সি কথা। খুব ভা‌লোবা‌সি।’
‘আ‌মিও।’

কথা প্রেগ‌নে‌ন‌ন্সি টেস্ট‌কিটটা একটা গিফ্ট ব‌ক্সে র্যা‌পিং ক‌রে ও শাশু‌ড়ি মো‌মেনার সাম‌নে রে‌খে বলল,
‘মা, তোমার জন্য ছো‌ট্ট উপহার।’
‌মো‌মেনা হে‌সে বক্সটা খু‌লে প্রেগ‌নে‌ন‌ন্সি টেস্ট‌কিটের রেজাল্ট প‌জেটিভ দে‌খে তি‌নিও নিহা‌দের ম‌তো খু‌শি‌তে বাচ্চা‌দের ম‌তো কেঁ‌দে ফেলল। খু‌শি আর কান্নার কার‌ণে তি‌নি কো‌নো কথাই বল‌তে পার‌লেন না। শুধ‌ু কথা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে কাঁদ‌লেন।

কথার প‌রিবার আজ প‌রিপূর্ণ। একটা অনাগত বাচ্চা যেন সু‌খের বার্তা নি‌য়ে এসে সব ঠিক ক‌রে দি‌লো। এতোদিন সুখদুঃখ যেমনই থাকুক না কেন ওরা একে অপ‌রে আক‌ড়ে ধ‌রে ছিল। ভুল হ‌য়ে‌ছে, শা‌স্তি দি‌য়ে‌ছে প‌রে জীব‌নের প‌থে এগি‌য়ে‌ছে।

ভুলটা‌কে ধ‌রে রে‌খে ব‌সে থে‌কে দূ‌রে চ‌লে যা‌য়নি। নিহাদ পরকীয় ক‌রে‌নি। পরকীয়া তো নি‌জের স্ত্রী‌কে দি‌নের পর দিন ধোকা দি‌য়ে অন্য নারীর সা‌থে সম্পর্ক স্থাপন করা‌কে বুঝায়। বরং কথা‌কে হারা‌নোর প্রচণ্ড ভয় থে‌কে ভুলটা ক‌রেছিল। কথা প্রথ‌মে রাগ, জেদ, অভিমান যা-ই করুন না কেন, বিষয়টা‌কে ভা‌লোভা‌বে দে‌খে‌ছে, বু‌ঝে‌ছে, জে‌নে‌ছে তারপর সিদ্ধান্ত নি‌য়ে‌ছে। নিহাদ‌কে শা‌স্তিও কম দেয়‌নি।

একসময় কথার ম‌নে হয়ে‌ছে নিহাদ‌কে একটা সু‌যোগ দেওয়া দরকার। কথা নি‌জের মন ম‌স্তিষ্ক খা‌টি‌য়ে যেটা‌কে উত্তম ম‌নে ক‌রে‌ছে সেটা ক‌রে‌ছে। নিহাদও, কথার ভুল ত্রু‌টি মে‌নে নি‌য়েছে, শুধ‌রে দি‌য়ে‌ছে। দুজন দুজন‌কে জে‌নে‌ছে, বু‌ঝেছে। যখন বুঝ‌তে পারল একে অপর‌কে ছাড়া ঠিক নয়, বরং ভুলটা‌কে শুধ‌রে নি‌তে পার‌লে ওরা একে-অপ‌রের সা‌থেই সুখী হবে।

সম্পর্ক ভাঙা কো‌নো সমাধান না। আবার কিছু সম্পর্ক চাই‌লেও জোর ক‌রে টি‌কি‌য়েও রাখা যায় না। আবার কিছু সম্পর্ক টি‌কি‌য়ে রাখাও ঠিক না। কিছু সম্পর্ক শরী‌রে তৈরী হওয়া পঁচা ঘা‌য়ের ম‌তো। য‌দি সে অঙ্গটুকু র‌াখ‌তে চায়, তাহ‌লে ঘা ক্যা‌ন্সা‌রে প‌রিণত হয় এবং সারা শরী‌রে ছ‌ড়ি‌য়ে প‌রে। তাই অংশটুকু কে‌টে ফেলাই উত্তম। সে ক্ষে‌ত্রে ক্যান্সরযুক্ত সম্পর্ক থে‌কে বের হ‌য়ে আসাই উত্তম।

‌কিন্তু যে সম্প‌র্কে অনাকা‌ঙ্ক্ষিতভা‌বে ভুল হয়, এবং ভুল করা ম‌ানুষটা ভুলটা করার পর পস্তায়, শা‌স্তি প্রার্থণা করে, তওবা ক‌রে এবং ম‌নে প্রা‌ণে ভুলটা শুধ‌রে নি‌তে চায় তা‌দের একটা সু‌যোগ তো দেওয়াই যায়। কারণ একটা সু‌যোগ পাওয়ার অধিকার সবার আছে। অন্তত যারা নি‌জে‌দের ভুল বুঝতে পে‌রে শুধ‌রে নি‌তে চায়, তা‌দের তো সু‌যোগ পাবার অধিকার আছে।

মা‌টির মানুষ, রক্ত মাং‌সের মানু‌ষের ভুল তো হ‌বেই। ভুল যেমন হয়, তেমন ক্ষমাও তো করা যায়। সয়ং সৃ‌ষ্টিকর্তার যেখা‌নে তওবা করলে ক্ষমা ক‌রে দেয়, সেখানে আপ‌নি আমি নগণ্য মানুষমাত্র।

‌নিহা‌দের ভুলটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। সি‌ন্থিয়ার ট্রা‌পে প‌ড়ে, কথা‌কে হারা‌নোর ভ‌য়ে ভুল ক‌রেছিল কিন্তু প‌রে নি‌জে‌র করা ভু‌লের জন্য তীব্র মাত্রায় অনুশোচনা করে‌ছে। নি‌জে‌কে নি‌জে শা‌স্তি দি‌য়ে‌ছে। কথা যা শাস্তি দি‌য়ে‌ছে মাথা পে‌তে নি‌য়ে‌ছে।

কথাও ভুল কর‌তে যা‌চ্ছিল কিন্তু নিহাদ চায়‌নি কথা সারাজীবন নি‌জের কা‌ছে অপরাধী থাকুক, সে কার‌ণে কৌশ‌লে কথা‌কে ভুল করা থে‌কে আট‌কে‌ছে। নিহাদ জানে অপরাধ‌বোধ নি‌য়ে বাঁচার মা‌নে। ও যে অপর‌াধ ক‌রেছে তা ব‌য়ে বেড়া‌তে হ‌বে সারাজীবন।

কথা কিংবা সবাই ক্ষমা করলেও নিহা‌দের ম‌নে তৈরি হওয়া আত্মগ্লা‌নি তো কম‌বে না। সেটা নিহাদ ব‌য়ে বেড়া‌বে মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত। হয়‌তো মৃত্যুর পরও ক‌ঠিন শা‌স্তি ভোগ কর‌বেন। ভুল ক‌রে যে অনু‌শোচনায় ভো‌গে তা‌কে একটা সু‌যোগ দেওয়া উচিৎ কি না?

চল‌বে…