জলফড়িং পর্ব-১৮

0
299

#জলফড়িং
#Roja_islam
#পর্ব ১৮

আকাশ ভর্তি আজ শুভ্র তুলো তুলো মেঘ। চন্দ্র পূর্নিমার আলোয় ভেসে থাকা ছোট ছোট মেঘগুলো কী যে সুন্দর লাগছে। দুচক্ষু ভর্তি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ইরা প্রাণ জুড়ানো অম্বরবক্ষে। পাশের আম বাগান যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে বুনো পোকার ঝনঝন শব্দে। রাতের পরিবেশ আজ ভীষণ স্নিগ্ধ, মনমুগ্ধকর, মোহময়ী। তবুও ইরা’র অভ্যন্তরীণ ভীষণ অশান্ত, ক্লান্ত, বিষণ্ণতায় ঘেরা।

সে-ই রাতে’র পর আজ দু’দিন আদি বাড়ি ফিরেনি। রাদে’র সঙ্গেও কথা হয়নি। বড়বাবা রাদে’র মায়ের নাম্বার পেয়ে কী করেছেন সে-ই বিয়ষেও ইরা অজ্ঞাত নয়। এদিকে বড়মা আদি’র চিন্তায় রীতিমতো অসুস্থ হ’য়ে যাচ্ছেন ফলাফল ইরা নিজের মায়ের চক্ষে যেন বিষে পরিনত হয়েগিয়েছে ক্ষনে ক্ষনে, নীলা বেগম অসংখ্য অভিশাপ ইতিমধ্যেই বর্ষণ করে ফেলেছে মেয়ে’র উপর, উনার একটা-ই কথা ইরা’র বেয়াদবি’র কারণে আজ উনার গোছানো সোনার সংসারে ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। এ-ই মেয়ে’র কখনো ভালো হবে না ইত্যাদি। পারিবারিক সমস্যার সৃষ্টি’র কারণে বাড়ি’র পরিবেশ ভীষণ থমথমে ইরা’র দম আঁটকে আসে চিরপরিচিত এ-ই বাড়িতে। শ্বাসরুদ্ধকর লাগে। বেহায়া মনটা এক্ষুণি প্রাণপুরুষের নিকট ছুঁটে চলে যেতে ইচ্ছে করে। যা অসম্ভব কিছু বটে।

দু’হাতে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ইরা। মায়ের বিষাক্ত বাণী গুলো কানে ঠিক ঝিঁঝিঁ পোকা’র ন্যায় বেজে উঠে। নিশ্বাসটুকু ত্যাগ করে ফেলতে ইচ্ছে করে। পাপ বলে-ই স্থির আছে ইরা নাহলে কখন নিজ প্রাণটুকু নিজে কেড়ে নিতো। কিয়ৎপ্রহর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কান্নাকাটি’র পর শ্যাম কপোলদ্বয় রগড়ে মুছে নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো ইরা। ফলাফল শ্যাম মুখশ্রী জুড়ে রক্তিম আস্তরণে ভারী লাগছে। সপ্রতিভ হ’য়ে ঘন নিশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে তুলে নেয় রেলিঙের উপর থেকে। খুঁজে খুঁজে আদিত্যে’কে ফোন দেয় ইরা। এযাবৎ কারো ফোন রিসিভ করেনি ঘাড়ত্যাড়া প্রকৃতির গম্ভীরমুখো ছেলে’টা। ইরা’র বিশ্বাস নয়, ও নিশ্চিত আদি ওর ফোনের অপেক্ষায়। ওর ফোন ঠিক তুলবে দাম্ভিক গম্ভীর ছেলে’টা। ঠিক তা-ই হলো দু’বার রিং বেজেই পরপর গম্ভীর রাশভারী একটি গলা ভেসে এলো,

–” কী বলবি দ্রুত বল। ”

নিরুত্তাপ উদাসীনতা ঠিকরে পড়ছে আদি’র রাশভারী গলা’র স্বর হতে। ইরা কিঞ্চিৎ ভরখে গেলো, আড়ষ্টতার সঙ্গে এক হাতে কানে ফোন চিপে ধরে চঞ্চল দৃষ্টি চারপাশ ঘুরালো। পড়নের সাদা কামিজ’টা টেনেটুনে অনার্থক ঘামতে থাকা অন্য হাতে ঘষাঘষি করে নরম তালু লালিত করে ফেলল। শেষে টলটল নয়নে উদাস চেয়ে অনুযোগের সুরে বলল,

–” বাসায় ফিরে এসো প্লিজ। বড়মা কান্নাকাটি করছে অসুস্থ হ’য়ে যাচ্ছে। প্লিজ ভাইয়া আমার জন্য বড়মা’কে এভাবে কষ্ট দিও না..!”

কঠোর অথচ বরফ ঠান্ডা বজ্রগম্ভীর গলায় ওপাশ থেকে আদি শুধালো,

–” আমি তোকে কখনো বোনের চোখে দেখিনি কিংবা স্নেহময় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করিনি। ফার্স্টলি আমাকে ভাইয়া ডাকা বন্ধ কর। এন্ড সেকেন্ডলি বুঝতে-ই যখন পারছিস তোর জন্য নিজের জন্মদাত্রী’কে কষ্ট দিচ্ছি। তখন এটা বুঝতে পারছিস না তোকে না পেলে আমি বাড়ি ফিরবো না। ”

আদি’র মুখনিঃসৃত এক একটা বাক্যে শিরদাঁড়া বেয়ে বিদ্যুৎ ঝলকানি খেলে গেলো তৎক্ষনাৎ। প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেলো ইরা। কম্পিত গলায় অস্ফুটে বলল,

–” এ-সব কী বলছো ভা..? ”

আদি দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে গর্জে উঠলো,

–” ভালোবাসি তোকে ইরা। আমার ভালোবাসা তোর চোখে পড়েনা? ”

ইরা ঘনঘন শ্বাস ফেলল, চক্ষুদ্বয় থেকে কর্ণধার অব্ধি গরম হ’য়ে গিয়েছে ওর কুণ্ঠাবোধে। বর্তমান কথোপকথন গুলো ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো। অক্ষিকোটর ছাপিয়ে গেলো চাপা বিরক্তি, রাগ, কান্না। আদি’কে আজ বড্ড স্বার্থপরও লাগছে বটে। আদি ওকে ভালোবাসে তবে ইরা, রাদ! ওদের ভালোবাসা? এ-র কোনো মূল্য এ-ই ঘাড়ত্যাড়া প্রকৃতির গম্ভীরমুখো মানুষটার কাছে নেই। সুতরাং এ-র সঙ্গে এ-ই মুহূর্তে অযথা পাগলের প্রলাপে কিচ্ছুটি বদলে যাবেনা। বরং বিষয়’টা আরও ঘোলাটে হবে। রাদে’র মতো আজ ইরা’র মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ পুরোপুরি সচল হলো। রাদ ওকে শিখিয়েছে তাপ উত্তাপ ছাড়া-ও শান্ত মস্তিষ্কে কিভাবে পরিস্থিতি বদলে দেওয়া যায়৷ নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো ইরা। সে-ই পুরনো ছোট্টো ইরা’র নরম মিষ্টি গলা ফিরিয়ে এনে আওড়ালো,

–” তুমি বাসায় ফিরে এসো প্লিজ, ভাইয়া! এখন আমার হাতেও কিচ্ছু নেই। আমি বললেও তো সব বদলে দিতে পারবোনা। বড়বাবা তোমার উপর রেগে গিয়েছে এটা সত্যি। তা-ই বলে আমার বিয়ে রাদে’র সঙ্গে হ’য়ে যাচ্ছে না। এখনো তো রাদ’কে তোমরা কেউ দেখোনি ভাইয়া। এমন কেন করছো? যদি তোমাদের রাদ’কে অপছন্দ হয়, তোমাদের কারো বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করবো না আমি। বাবা’কে প্রমিস করিছিনা? ”

লম্বা শ্বাস ফেলে থামলো ইরা। ঠোঁট টিপে রইলো স্তিমিতনেত্র জোড়া ঘোলাটে করে। আদি’র প্রতিক্রিয়া বুঝিয়ে দিবে আপাদমস্তক কতটা মন ভোলাতে পেরেছে ইরা এ-ই গম্ভীর কঠোর প্রকৃতি’র ছেলেটার। কিয়ৎকাল নিস্তব্ধ সব চুপচাপ। শুধু নিশ্বাসের তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে মৃদুমন্দ শব্দে।
__________

মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠে বাক্যগুলো শুনতে শুনতেই আদি কিছু-টা নরম হ’য়ে এসেছিলো, আসলেই। পরক্ষণেই চোখের পাতায় খেলে গেলো বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের ন্যায় কিছু স্মৃতি। ইরা’র ফোনে রাদে’র ফর্মাল নম্র ভদ্র মার্জিত লুকগুলো, সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ, পুরুষালী ছোট্ট হাসিতেও ছেলেটার কঠোর ব্যাক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে। যে কেউ অন্ধের মতো রাদ’কে এক দেখায় বলে দিবে ওর যোগ্যতা ভীষণ ভারী। সাধারণ ঘরের ছেলে নয় রাদ। যতটা সাধারণ নম্র ভদ্র দেখতে, ততটাই সম্ভ্রান্ত, রহস্যময়। তবে যোগ্য পাত্র সে। ইরা’র মতো নিষ্পাপ মেয়ে’র যোগ্য, মানায় দু’জন’কে পাশাপাশি ভীষণ ভাবে। যে কোনো মেয়ে’র স্বপ্ন রাদ, ঠিক আকাশ ছোঁয়ার মতো। ভাবতে ভাবতে আদি’র হৃদপিণ্ড’টা ঝলসে গেলো। অচিনপুরের রাজপুত্র কোথা থেকে চলে এলো ওর ভালোবাসা’র মানুষটাকে ওর নাকের ডগা থেকে ঘোড়ায় চড়িয়ে কেড়ে নিয়ে যেতে? ভুল ভাবলো হয়তো আদি। ওর ভালোবাসা না তো৷ ইরা তো ওকে ভালোবাসে না। বড় হ’য়ে গেছে সে-ই ছোট্ট অগোছালো ন্যাকামি, আহ্লাদী মেয়ে’টা। ভালোবাসা’র যোগ্য মানুষ বেছে নিয়েছে। আজ কিভাবে গোছানো কথায় বুদ্ধিদীপ্ত রণকৌশলে ওর মন ভোলাতে চাইছে ছোট্ট সে-ই মেয়ে’টা। ইরা’র মধ্যে রাদের গোছানো ভারী ব্যাক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট খুঁজে পেলো আদি। এতটা মিশে গেছে ইরা রাদে’র সঙ্গে? এতটা? দুজনের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব’টা নিজের কাছে-ই বড্ড তিতকুটে লাগছে।

কিছু বলতে গিয়েও একটু গলা’টা কেঁপে উঠলো কী? কঠোর শক্ত ব্যাক্তিত্ব ছাপিয়ে চক্ষুদ্বয়ের কোণা ভিজে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা ভাবনাতেই যেন ভবিতব্য পরিষ্কার হয়ে উঠলো থিয়েটারের মতো অক্ষিকোটরের সম্মুখে। অসিম সংযমের সঙ্গে নিজের আবেগ সামলে নিলো আদি। পরিষ্কার বিষয়’টি নিয়ে আরও চাপাচাপি করলে হয়তো আদি ছ্যাচড়া প্রেমিক হ’য়ে যাবে এক লাহুমায়। নিজের কঠোর ব্যাক্তিত্ব ছাপিয়ে সেটা আদি পারবেনা। আত্মসম্মানহীন ব্যাক্তিত্ব নিয়ে আদি হয়তো স্বাভাবিক জীবন কল্পনাও করতে পারেনা। এ-র থেকেও বড় বিষয়টি হলো ইরা’কে রাদ ওর থেকে-ও হাজার গুণে ভালোবাসবে, ভালোরাখবে। কেন না রাদ আদি’র মতো কখনোই ইরা’কে অবহেলিত চোখে দেখেনি হয়তো পাশে থেকেছে। বুঝতে চেষ্টা করেছে শ্যামাঙ্গিনী’র সুন্দর নিষ্পাপ ছোট্ট মন। ভালোবেসেছে ওর সরলতা’কে নাক ছিটকায়নি ওর মতো ন্যাকামি বলে। বিরক্ত হয়নি কখনো। আদি যেন কিছু না যেনেও সব যানে, রাদ ইরা’র সম্পর্কে’র ভিত্তি গভীর প্রেম, কঠোর বিশ্বাস, প্রগাঢ় ভালোবাসা। একে একে স্বচ্ছ জলের মতো স্পষ্ট কেন ইরা রাদ বলতে পাগল। কেন এতো এতো ভালোবাসা যা ওদের সকলের ভালোবাসা ছাপিয়ে ভয়ভীতি ভুলে ছোট্ট ইরা রাদ বলতে আজ প্রতিবাদী। গলায় দলাপাকিয়ে উঠা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। কয়েক সেকেন্ডে একটি পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো আদি। তবে মনকুঠুরির মধ্যে অবস্থিত ভালোবাসা যে অবিচল, শ্যাম কন্যার সঙ্গে আরেকটু কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার লোভটুকু গিলে নিতে পারলো না আদি। লম্বা সময়ের নিস্তব্ধতা ভেঙে ইরা’র কথার রেশ ধরেই চিরপরিচিত গাম্ভীর গলায় বলল,

–” আর যদি রাদ’কে সবার পছন্দ হ’য়ে যায় তাহলে? ”

কিঞ্চিৎ থতমত খেলেও ইরা হড়বড়িয়ে আওড়ালো,

–” তাহলে কথার কোনো ভিত্তি আছে ভাইয়া। সেটা তখন দেখা যাবে। তুমি কী এখন আসবে? ”

প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না আদি। বরং উল্টো প্রশ্ন করলো অদ্ভুত ভঙ্গিতে,

–” যদি রাদ’কে পছন্দ না হয় বাবা’র। তোর কষ্ট হবে না? ”

ধড়ফড়িয়ে উঠে ইরা’র ছোট্ট হৃদপিণ্ড’টা। এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না মোটেও হকচকিয়ে জ্ঞানশূন্য ফ্যাকাসে মুখে কোনরকম ভাবে কম্পিত গলায় বলল,

–” এখনো তো দেখেনি বাবা ওকে…!”

রুদ্ধশ্বাসে ঠোঁট টিপে স্তব্ধ হ’য়ে দাঁড়িয়ে রইলো ইরা। আদি কিঞ্চিৎ হাসলো বিষাদমাখা আবেগহীন হাসি। যতই চেষ্টা করুক ইরা নিজের সরলতা মুছিয়ে ফেলতে পারবেনা। স্মিত হাসির শব্দে প্রথমে চমকে উঠলেও পরমুহূর্তেই আদি’র রাগ নিভে গিয়েছে স্পষ্ট টের পেলো ইরা। এতে সাহস সঞ্চয় হলো ছোট্ট হৃদয়ে। কাতর গলায় অনুরোধ করলো পুনরায়,

–” প্লিজ এখন বাসায় ফিরে এসো। ”

দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আদি। অতঃপর শক্ত গলায় স্পষ্ট করে বলল,

–” আসবো! আমি অবশ্যই ফিরে আসবো। যদি রাহুল বাড়ি ফিরে আসে তবে আমিও খান বাড়ি ফিরে আসবো। এ-ই কথা’টা তোর বড়মা বড়বাবা’কে জানিয়ে দিবি। আর শোন আমি বদমেজাজি মানুষ হয়তো সেদিন বাবা’কে অপমানিত হতে দেখে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হ’য়ে উঠেছিলাম। যার জন্য সত্য মিথ্যা যাচাই-বাছাই আজ অব্ধি করতে পারিনি। যেহেতু সত্যিটা জানতি তুই চাইলেই পারতি রাহুল’কে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে কেন আনিসনি আমি জানিনা। হয়তো তোর ভাই মানা করে দিয়েছে। তবে এবার আনবি যেভাবেই হোক তোর ভাইকে বাসায় ফিরিয়ে আনবি। তোর ভাইয়ের সঙ্গে মিলেমিশে-ই নাহয় তোর বিয়ে দিবো তোর পছন্দের মানুষের সাথে..! শোন ঠাণ্ডা মাথায় বাবা’কে সব বুঝিয়ে সত্যিটা খুলে বলবি। এ-র পর রাহুলের ঠিকানা দিবি বাবা’কে। বাকিটা বাবার কাজ। ভয় পাবিনা আমি তোর পাশে আছি। ”

প্রথমে চমকে উঠলেও। শেষে ঠোঁট কামড়ে নৈশব্দ্যে গুমোট কান্নায় ভেঙে পড়লো ইরা। বরাবরের মতোই আদি’কে বুঝতে পারেনা ও। নিজে-ই ওকে অপমান, আঘাত, অবহেলা, বিরক্তবোধ করবে। আবার নিজে-ই কেমন অদৃশ্য ভাবে ওর পাশে থাকবে। এমন কেন মানুষটা! কী হয় একটু মেজাজ ঠাণ্ডা করে চললে। আদি ইরা’র গুমোট কান্না’র মৃদুমন্দ শব্দ মন দিয়ে শুনলো। শুনতে শুনতে আচমকা নরম গলায় শুধালো,

–” আই আ্যম স্যরি ইরা। আমাকে, আমার ভুল গুলো’কে ক্ষমা করে দিস প্লিজ..! আচ্ছা এখন রাখছি। বাসায় কিছু হলে অবশ্যই ফোন দিয়ে যানাবি! ”
___________

কিছু অসম্পূর্ণ কথা অসম্পূর্ণ রেখেই আদি ঝট করে যান্ত্রিক লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিলো। ইরা ঝুমঝুমি পুনরায় কান্নাকাটি করলো কিয়ৎপ্রহর। পূর্ণিমার আলোয় নিস্তব্ধ ছাঁদে দাঁড়িয়ে ওর কেঁপে কেঁপে উঠা কেউ দেখলো না, কেউ জানলো না। যখন গভীর রাত প্রায় হতে চলল। ছাঁদ ত্যাগ করে নীচে নামার আগে মুহূর্তে কী মনে করে রাদে’র নাম্বারে একটা কল দিতে ভুললো না মেয়ে’টা। অবাক বিষয় আজ দু’দিন পর রাদে’র ফোনে কল ঢুকেছে। এবং কয়েকবার রিং হতে-ই রিসিভ ও হলো। পরপর রাদে’র ঝংকার তুলে দেওয়া অবিচল, অচঞ্চল, শ্রান্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,

–” তোমার ফোন ওয়েটিং এ ছিলো। কার সাথে এতো রাতে কথা বলছিলে? ”

ইরা কান্না, অভিমানে ভারী গলায় রিনরিনে শুধালো,

–” আদিত্য ভাইয়া’র সাথে। ”

রাদ স্বাভাবিক গলায় আওড়ালো,

–” তুমি কাঁদছিলে ইরা, বাসায় সব ঠিক আছে? ”

–” হ.. হ্যাঁ! ”

–” ইরা!”

ইরা কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,

–” হু! ”

রাদে’র শান্ত গলা গম্ভীর, রাশভারী শোনালো,

–” মিথ্যে কেন বলছো? ”

সচারাচর রাদ ইরা’র সঙ্গে গম্ভীর কণ্ঠে কথা বলে না। যখন রেগে কিংবা সিরিয়াসলি কিছু হয় তখনই এভাবে কথা ব’লে। আজও কী সিরিয়াস কিছু হয়েছে? ইরা থতমত খেয়ে নরম গলায় সব খুলে বলতে শুরু করলো তৎক্ষনাৎ। সব শুনে রাদ একটি বাক্য বলল না, নিস্তব্ধ রইলো। ইরা একমুহূর্তে’র জন্য ভাবলো রাদ কী ওর ফোন ওয়েটিং পেয়ে রেগে গেলো? অসম্ভব এটা! রাদ মুক্তমনা মানুষ এটা হতে-ই পারে না। তবুও অভ্যন্তরীণের খচখচানিটা থামাতে পারলো না। সাহসা নিস্তব্ধতা ভেঙে অনুযোগের সুরে বলল,

–” রাদ ফোন ওয়েটিং পেয়ে রেগে গিয়েছো? ”

রাদ কিঞ্চিৎ চিন্তিত অপরদিকে অনুশোচনার আগুনেও ধিকিধিকি জ্বলছিলো। ইরা’র এহেন প্রশ্ন বড্ড ছেলেমানুষী লাগলো। বাস্তবতা ভুলে স্মিত একটা হাসি ঠোঁটের কোণে না চাইতেও ফুটে উঠলো। বিগলিত, মোলায়েম গলায় আওড়ালো,

–” কেন রাগ করবো জান? তোমার প্রয়োজন থাকতেই পারে। ”

প্রেমিক পুরুষের নরম আওয়াজে ইরা’র মন মোমের মতো গলে যেতে গিয়েও গেলোনা। দুদিনের অবহেলা স্পষ্ট মনে পড়ছে। ফলাফল নরম মন’কে পাত্তা না দিয়ে পুনরায় অভিমানে ভারী গলায় শুধালো,

–” আরও কিছুদিন পরে-ও ফোন অন করলে পারতে। ”

রাদে’র পূর্বের থেকে-ও অত্যন্ত মোলায়েম গলা ভেসে এলো,

–” আই আ্যম স্যরি.. আচ্ছা, তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মেনে নিলাম! ”

ইরা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ঠোঁট চিপে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রাণপুরুষ’টা একটু অভিমান করারো সুযোগ দিবেনা ওকে। ভুল করেছে তো কী হয়েছে একদম স্যরি ব’লে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। একটু ইগোও তো দেখাতে পারে। নাহ্ এসব কিছু না শাস্তিও হাত পেতে চেয়ে নিচ্ছে। এমন মানুষের সঙ্গে অভিমান করে থাকা যায়? এতোটা ভালো’কে হতে বলেছে ওর মানুষটাকে। সর্বদা ভুলের পর ভুল করলে-ও নিরুত্তাপ গলায় অবলীলায় ক্ষমা চেয়ে নিবে সে। একবিন্দু সংকোচ থাকেনা তখন রাদে’র গলায়। বরং ক্ষমা চাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বড্ড জ্বালাপোড়া অনুশোচনায় ভোগে রাদ।
রাদ ইরা’র নিস্তব্ধতা টের পেয়ে পুনরায় নরম গলায় বলল,

–” কিছু তো বলো ইরানী? ”

নাহ্ আর পারা গেলো না। এভাবে ইরানী ব’লে ডাকলে যে ইরা ঠিক থাকতে পারেনা। রাদে’র মুখে এ-ই ডাক অত্যন্ত আদুরে, ভালোবাসার এবং পছন্দের। স্মিথ হাসি ঠোঁটে ফুটলেও। ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

–” উমম, আচ্ছা ঠিক আছে তোমার শাস্তি হলো। আগামী দু-মাস আমাকে পড়াশোনার জন্য চাপাচাপি করতে পারবে না। ”

রাদ কিঞ্চিৎ হতাশ গলায় শুধালো,

–” ফাঁকিবাজি’র একটা স্টেপ তুমি বাদ রাখলে না জান। ”

কান্নাকাটি করে ফুলোফুলো শ্যাম শুকনো মুখশ্রী জুড়ে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো এবার। মিষ্টি হাসির শব্দে রাদ ওর ইরানী’কে আর কিছু বলতে পারলো না। যেহেতু সত্যি ভুল’টা ওর। বারবার বুঝে-ও এক ঘটনা রাদ পুনর্বার ঘটিয়ে গিয়েছে, সাপোর্টের সময় ইরা’কে সম্পূর্ণ একা করে দিয়েছে। অনুশোচনা মর্মাহত রাদ। এটুকু তো মেনে নিতে-ই হবে। কিন্তু পাগলী মেয়ে’টা বুঝলো কই এতে রাদে’র থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ইরা নিজে হলো। বলাবাহুল্য রাদ ইরা’র জীবনে এন্ট্রি নেওয়ার পর থেকে-ই পড়াশোনায় ইরা’র হিস্ট্রি’তে ইম্প্রুভমেন্ট এসেছে চূড়ান্ত ভাবে। ব্যাকবেঞ্চার স্টুডেন্ট থেকে এখন ফার্স্টক্লাস স্টুডেন্ট বলাই যায় ওকে৷
__________

–” ভীষণ মিস করছিলাম তোমাকে। তুমি এতটা পাষাণ একটা ম্যাসেজ পর্যন্ত দাওনি আমাকে। ”

রাদ অপরাধী’র মতো মিইয়ে যাওয়া গলায় শুধালো,

–” স্যরি জান, তুমি জানো রেগে গেলে আমি এমন হ’য়ে যা-ই! ”

মৃদু রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো ইরা,

–” তোমার এ-ই বোবা রাগ’টা একদিন আমি কচকচ করে চিবিয়ে খাবো, তুমি দেখো। ”

পুরুষালী ভারী গলায় ঝংকার তুলে একটু হাসলো রাদ। রাদ’কে হাসতে দেখে পুরোপুরি গলে ঘি হ’য়ে গেলো ইরা। কিয়ৎকাল দু-দিনের জমে থাকা একান্ত কিছু কথোপকথন চালিয়ে গেলো দু’জন নিভৃতে। যদি-ও ইরা বলছিলো রাদ শুনছিলো বেশী মাঝেমধ্যে হু হা করছিলো। ইরা প্রথমে দু’দিন পূর্বের সন্ধ্যার ঘটনা’টা রাদ’কে বলেনি। পরে যখন কথায় কথায় আদি’র থাপ্পড়ের কথাটা বলল রাদে’র চোয়ালের পেশীগুলো না চাইতেও শক্ত হয়ে গেলো শুনে। চক্ষুদ্বয় জ্বলে উঠলো ওর। যেটা প্রাণপুরুষের সঙ্গ পেয়ে সরল ইরা টের পেলো না। ইরা আরও কিছু বলার আগেই রাদ সাহসা দৃঢ় গলায় বলল,

–” কাল আমি রাজশাহী ফিরছি। ”

আকস্মিক এহেন কথায় ইরা ভারী অবাক হলো। অস্ফুটস্বরে বলল,

–” মানে তুমি এখন কোথায়? ”

–” বলেছিলাম তোমাকে আগেই তরীর বিয়ের কথা ভুলে গিয়েছো? ”

ইরা সুর তুলে শুধালো,

–” ওওওহ্ হ্যাঁ..! বলেছিলে তো..! কাল চলে আসবে যে বিয়ের ডেট তো ২৯-তারিখ? আজ সবে ২৭-তাখির। ”

–” ইরা তোমার বড়বাবা মা’কে ফোন দিয়েছিলেন। দুদিনের মধ্যে উনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। তা-ই তরীর বিয়ে ইনকমপ্লিট রেখে ফিরে আসছি। ”

ইরা’র পেটে পাক খেয়ে গেলো একটা চূড়ান্ত টেনশন। যেটা ছড়িয়ে পড়লো সম্পূর্ণ অঙ্গপ্রতঙ্গে যেন দুদিন পর ওর বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট আসবে। মুখে একটা শব্দ আওড়াতে পারলো না। ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগের আদি’র কথাটা। যদি রাদ’কে পছন্দ না করে বড়বাবা। ভাবতে পারলো না ইরা কিছু ওপাশ থেকে পুনরায় ভেসে এলো ঝংকার তুলে দেওয়া পুরুষালী গম্ভীর গলা,

–” খুব দ্রুত তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো ইরা। যেখানে আমার জন্য কেউ তোমাকে কষ্ট দিবে না। আঘাত করবে না। কথা শোনাবে না। আমি আজ প্রমিস করছি মৃত্যু’র আগ পর্যন্ত আমি তোমার হাত কখনো ছাড়বো না। ”

ইরা ছোট্ট হৃদয়’টা ছলাৎ করে উঠলো। এক লাহুমায় সকল টেনশন ছাপিয়ে ইরা যেন পরিপূর্ণ হ’য়ে গেলো। পরিতৃপ্তির নিশ্বাসের সঙ্গে ইরা রাদে’র ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস, স্পৃহা নিশ্বাসের সঙ্গে টেনে টেনে শুষে নিলো। যেন ওর সকল কষ্ট আঘাত বিষাক্ত স্মৃতি ভাগাভাগি করে নিচ্ছে রাদ অল্প কিছু বাক্যে। এগুলোকে বাক্য বললেও যে ভুল হবে। একেকটা শব্দ যেন রাদে’র ভালোবাসা’র বহিঃপ্রকাশ। সেদিন ইরা জানতো না রাদ ইরা’কে দেওয়া কথা’টা কঠোর বাস্তবেও রাখবে। ছাড়বে না ওর হাত’টা। যে কোনো পরিস্থিতিতে ছাড়বে না!

চলবে!