এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ১৪
সানজিদা মাহি
_____________________________________
শ্রদ্ধাভাজনেষু,
আপনি কেমন আছেন জানি না৷ তবে আমি ভালো নেই। অনুশোচনায় ভুগছি বারবার। কেন বুঝতে পারছেন তো? আপনি মহৎপ্রাণ মানুষ। ভুলে যেতেই পারেন। আচ্ছা, আমি নিজেই মনে করিয়ে দিচ্ছি। সেদিন স্টেশন ঘরের সামনে ফিরোজা রঙের শাড়ি পরা, ছোট-খাটো গড়নের, গৌরবর্ণা, দূরন্ত সেই মেয়েটিকে মনে পড়ে? আপনার কাছে বোকাইনগর পৌছে দেবার জন্য সাহায্য চাইছিলো যে? হ্যা, ঠিক ধরেছেন। আমি-ই সেই মেয়েটি। সেদিন আপনি এত বড় একটা উপকার করলেন অথচ অকৃতজ্ঞের মতো একটা ‘ধন্যবাদ’ ও দেয়া হয়নি। মাফ চাওয়ার যোগ্যতা হয়তো হারিয়েছি ইতোমধ্যেই। তবু বলব প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন! আর একজন অপরিচিতাকে সাহায্য করবার জন্য এত্তো এত্তোগুলো ধন্যবাদ আপনাকে। এখন বলুন, মাফ করে দিয়েছেন তো?
ইতি
শান্তা মজুমদার
চিঠিটা দ্বিতীয়বারের মতো পড়লো মাহমুদ। হ্যা এটা ঠিক, সেদিন মেয়েটার ব্যবহারে তার কিঞ্চিৎ রাগ হয়েছিলো বৈকি কিন্তু তাই বলে মাফ চেয়ে চিঠি আসবে এতটাও ভাবেনি। মেয়েটার নিজেকে বর্ণনা করার ব্যাপারটা দেখে তার হাসি পেল খুব। সেদিন সে অতো ভালো করে দেখেনি তাকে। তবে এতো বিশদ বর্ণনা না দিয়ে শুধু বোকাইনগরের কথাটা বললেই চেনার জন্য তা যথেষ্ট হতো। ‘দূরন্ত মেয়েটি’ শব্দ দুটো পড়ে সে অনুচ্চ শব্দে হেসে ফেলল। সেদিন তো দেখে এতটাও চঞ্চল মনে হয়নি মেয়েটাকে। কিন্তু আজকের চিঠি অন্য কথাই বলছে। মাহমুদ চিঠিটা খাতার ভেতর ভাঁজ করে রেখে দিল। চিঠির জবাব দেয়া প্রয়োজন তা মনে আসেনি তখুনি। কিন্তু পরদিন হঠাৎ মনে হলো জবাব না দিলে অপমান করা হবে। অগত্যা ক্ষমা করে দিয়েছে এই মর্মে একটা ফিরতি চিঠি পাঠিয়ে দেয়া জরুরি বলে পুনঃ পুনঃ তাগাদা দিল মন। সকালের ট্রেনটা চলে যেতেই ছোট একটা চিঠি লিখে সে শহরের দিকে রওয়ানা হলো চিঠিটা ডাকে দেবার জন্য।
শুয়ে শুয়ে বইয়ে চোখ বুলাচ্ছিল শান্তা। তারপর কাজের মেয়েটা বেডসাইড টেবিলে চা রেখে যেতেই উঠে পড়লো। নাস্তা করে পড়তে বসেছে এক ঘন্টা হয়েছে। পড়তে বসেছে না বলে শুয়েছে বলাই ভালো। ওর এই একটি অভ্যাস কিছুতেই বদলাতে পারে না। বই নিয়ে বিছানায় কখনো বসে পড়া হয় না। বসার কিছুক্ষণ পরই দেখা যায় শুয়ে পড়েছে বেখেয়ালে। শুয়ে শুয়ে পড়ার ভঙ্গিটাও বেশ মজার। কখনো পা ভাঁজ করে বালিশ রেখে তার উপর বই রেখে পড়বে। কখনো চিৎ হয়ে আবার কখনো দেয়ালের সাথে বই হেলান দিয়ে রেখে, একপাশ হয়ে শুয়ে পড়বে। আর টেবিলে বই রেখে চেয়ারে বসলে, চেয়ার না দুলিয়ে স্থির হয়ে বসতেই পারে না। বাবা মাঝে মাঝে বলে ” এতো অস্থিরমতি মেয়ে তুই! ”
শান্তা তখন হেসে বলবে, ” তোমার মতো গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়ালে ভালো লাগতো? ”
” না। তা মোটেই লাগতো না। তুই অস্থিরমতি বলেই এই গম্ভীর স্বভাবের বাপটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিস ”
” পারি কই আর! তুমি আমার কথা শুনো? এই ঔষধ খেয়েছো তো? ”
অমনি শুরু হয়ে যায় শান্তার দায়িত্ব পালন। কর্তব্যের খাতিরে বাবার উপর জেরা করা।
চা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। ডাকবাক্সের দরজা খুলে একবার উঁকি দিল। গত দুইদিন ধরেই এ কাজটা করছে৷ আজও ডাকবাক্স ফাঁকা। নতুন কোনো চিঠি আসেনি। শান্তার রাগ হলো খুব৷ রাগের আতিসহ্যে নাকের পাটা ফুলতে লাগলো মুহুর্মুহু। লোকটা কি তার সাথে ভাব নিচ্ছে? না হয় সে একটু ভুল করেই ফেলেছে। তাই বলে মাফ করে দেয়া যায় না?
বাবাকে শাস্তি দেবার জন্য একটা অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করতে চেয়েছিল শান্তা। অভিযোগটা এই যে খালামনি তার বান্ধবীর ছেলেকে ওর জন্য পছন্দ করেছে। পাত্র জার্মানিতে পিএচডি করতে যাবে। বিয়ে করে স্ত্রীসহ যেতে চায়। আর অমনি খালামনি ওর পিছনে লাগা শুরু করে দিল। এই ছেলের মতো ভালো ছেলে আর হয় না। তাছাড়া স্ট্যাবলিশড, স্মার্ট ছেলে সহজে পাওয়া যায়? খালামনি এসে বাবাকে এসব বোঝাতেই তিনিও লেগে পড়লেন কন্যার বিয়ে ঠিক করতে। খালামনির ওপর তো তার রাগ হলোই বাবার রাজি হওয়া দেখে মেজাজ একেবারে তিরিক্ষি হলো। সবে কলেজে উঠেছে সে। এখনই বিয়ে? আর সে বাবাকে ছেড়ে অতদূরে গেলে তাকে দেখবে টা কে? সবচেয়ে বড় কথা খালামনি পাত্রের ছবি দেখাতেই দুর্বিষহ রাগে গরম তেল ফুটতে লাগলো যেন মাথার ভেতর৷ এই হাবলার মতো দেখতে ছেলেকে কিনা খালামনি বলছে স্মার্ট? কঠিন স্বরে জানিয়ে দিল সে মোটেই এই ছেলেকে বিয়ে করবে না। কিন্তু কেউ যেন ওকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বাবাকে খালামনির কথায় উঠবস করতে দেখে সে আর সইতে পারলো না। আমার ভালোটা যখন তোমরা বেশি বুঝো তখন তোমরা থাকো ভালোটা নিয়েই, আমি চললাম- এই মনোভাবে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলো। যাবার মতো আর কোনো জায়গা নেই বলে দাদাবাড়ীটাই একমাত্র অবলম্বন হলো।
শান্তা একা একা ঢাকার ভেতর ঘুরেছে খুব কমই। যেখানে যেতে ইচ্ছে হতো খালামনিকে বললেই নিয়ে যেত। প্রতি শুক্রবারে ওদের বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা থাকে৷ শুক্রবার সকাল সকাল শান্তা রিকশায় চড়ে খালামনির বাসায় চলে আসে। দুপুরে ওর জন্য খালামনি বিশেষ কোনো পদ রান্না করেন। খাওয়ার পর জিরিয়ে নিয়ে দুজনাতে বেশ ঘুরাঘুরি হয়। সন্ধ্যার পূর্বেই খালামনি তাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে ফিরে যান। খালুজান বাসায় থাকেন খুব কম সময়। নিজের কাজের কারণে তাকে এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়াতে হয়৷ নিঃসন্তান দম্পতি হওয়ায় শান্তা তাদের সন্তানের স্থানটা বেশ একটু ভালো মতোই দখল করেছে বলা যায়। সেদিন সকালে সে খালামনির বাড়িতে গিয়ে ওর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো। যখন দেখলো আগের চিন্তা একটুও বদলায়নি তখন সুযোগ বুঝে ডায়েরিতে চিঠি রেখে এলো। কোথায় যাচ্ছে সেটুকু না জানালে বাবা চিন্তায় স্ট্রোক করে বসতে পারেন। এই ভাবনা থেকেই কাজটা করেছে। খালামনির বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে এলো। সেখান থেকে গৌরিপুর জংশন। পুরোটা রাস্তা বাবার প্রতি দুশ্চিন্তা, নতুন অভিযানের রোমাঞ্চকর অনুভূতি, একা এতটা পথ পাড়ি দেবার ভয়, উৎকন্ঠা সারাটাক্ষন দোদুল্যমান ছিল মনের ভেতর। দাদাবাড়ীতে দুদিন বেশ ভালো কেটেছে। দু’দিন পর দাদাজান নিজে ওকে বাড়ি দিয়ে গেলেন। ও বাড়ি থেকে বের হবার পর সে ভেবে রেখেছিলো স্টেশন মাস্টার ছেলেটিকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসবে। কিন্তু স্টেশনে আসতেই সে কথা ভুলে গেল। দাদাজান ওকে প্লাটফর্মে বসিয়ে নিজে টিকিট কিনতে গিয়েছিলেন। ট্রেনটা যখন দুলতে শুরু করেছে তখন মনে পড়লো, ইশ লোকটাকে তো বলে আসা হয়নি! অনুশোচনা থেকে সে দাদাজানের কাছ থেকে কৌশলে লোকটির নাম জেনে চিঠি পাঠিয়েছিল। অথচ এতো অহংকার তার যে চিঠির উত্তরটা পর্যন্ত দিল না! দুর্দমনীয় আক্রোশে শান্তা ডাক বাক্সের দরজাটাকে ধাক্কা দিল একগুঁয়ে, স্বঘোষিত মনের তাড়নায়। দরজাটা করাত করে লেগে আবার সঙ্গে সঙ্গে খুল গেল। জেদের উষ্মা ফুটে উঠলো ওর চোখেমুখে। শান্তা আর দাঁড়ালো না৷ ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে এসে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিল।
চিঠিটা এলো পরদিন। শান্তা সেদিন যায়নি ডাকবাক্সের কাছে চিঠির অনুসন্ধানে। আনোয়ার সাহেব শরীর খারাপ করায় শুয়েছিলেন নিজের ঘরে। আজ তার একটা চিঠি আসার কথা। মেয়েকে পাঠিয়ে বললেন, তার কোনো চিঠি এসেছে কিনা দেখতে। বাবার চিঠি দেখতে গিয়েই শান্তা খুঁজে পেল “মাহমুদ” নামে জ্বলজ্বল করা সে আকাঙ্ক্ষিত চিঠিখানা। চিঠিটাকে নিজের ঘরে রেখে সে বাবাকে তার চিঠি দিয়ে এলো। শান্তা হয়তো অবচেতন মেনে ভেবে বসেছিলো চিঠিটা যথেষ্ট বড় হবে। যদিও তার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তবু ছোট চিঠিটা পড়ে তার ভালো লাগলো।
অপরিচিতা,
আমি ভালো আছি। আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন বলুন, ভালো আছেন তো? সত্যি বলতে, ক্ষমা চেয়ে কেউ চিঠি পাঠাবে এমনটা ভাবতেও পারিনি। আপনার আসলে একার দোষ নেই। আমার নিজেরও দোষ ছিল। সেদিন আমার উচিত ছিল আরও কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করা। তা না করেই চলে এলাম। এরজন্য আমি নিজেও ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা করা যায় কি?
ইতি
মাহমুদ
আশ্বিন মাসের খনখনে রোদ জ্বলমলে দিনে হঠাৎ পলকা বাতাস এসে শান্তার গোলাপি পিতল বর্ণ গাল দুটোকে অনুরাগে রাঙিয়ে দিল। শান্তা বালিশের ওপর চিঠি রেখে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিল। সিলিংফ্যানের হাওয়ায় দু’পাশে টেনে রাখা সফেদ পর্দা তিরতির করে উড়ছে। বাইরে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া অত্যুষ্ণ, ঝাঁঝালো রোদ। বাগানের কাঁটাযুক্ত হাজারি গোলাপের উপর নানা রঙা নকশায় আঁকিবুঁকি করা প্রজাপতি গুলো ডানা মেলে মুক্তির স্বাদে আকুন্ঠ ডুবে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে অগ্নিময়, অত্যুজ্জ্বল রোদ্দুর গায়ে মেখে। শান্তার মন ভালো হয়ে গেল মুহূর্তেই। আজ দিনটা এতো সুন্দর! প্রখর গরমেও ঘর্মাক্ত, প্রাঞ্জলহীন দুপুরটাকে ভীষণ ভালো লেগে গেল তার।
চিঠি আদান- প্রদানের শুরুটা ছিল এমনই। শান্তার ভাষায় সাধারণ অথচ বিশেষ। সেই প্রথম চিঠিটায় এমন কিছুই ছিল না যা দিয়ে কাউকে মুগ্ধ করা যায়, বিশেষ কিছু অনুভব করানো যায়। কেবল লেখার জন্য লিখতে হলো বলে এই অল্প কয়টা বাক্য দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চিঠি সাজাতে হলো মাহমুদকে।
এই প্রথম নিজের গন্ডির বাইরে অপরিচিত একজন মানুষ পরিচিত’র তালিকায় প্রচ্ছন্নভাবে ঢুকে পড়লো অথচ প্রথমটায় শান্তা বুঝতেও পারলো না। তার শুধু অপেক্ষা করতে ভালো লাগতো। অপেক্ষা যে এতো মিষ্টি হয় সে আগে জানতোই না। ধীরে ধীরে মাহমুদ হয়ে পড়লো তার অসমবয়সী চিঠি বন্ধু। কলেজে দু-তিন জন সহপাঠীর সাথে সে মোটামুটি মিশেছে। কিন্তু বন্ধু ঠিক বলা যায় না কাউকেই। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে দুটো করে চিঠি জমতে লাগলো শান্তাদের একতলা সাদা বাড়ির সম্মুখের দরজার পাশে লাগানো ছোট্ট ডাকবাক্সটায়। রোজ কলেজে যাবার আগে ডাকবাক্সের দরজা একবার খোলা চাই-ই। যদিও রোজ চিঠি আসা সম্ভব না এ সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অবগত তবু কাজটা করতে তার কি যে ভালো লাগে! আর যেদিন চিঠি পাওয়া যায়? সেদিনটা যেন হয়ে ওঠে ওর সবচাইতে সুন্দরতম দিন। রঙিন পাটের কারুকাজে সজ্জিত ব্যাগটাকে কাঁধের একপাশে ঝুলিয়ে এক হাতে আলতো করে ছুঁয়ে হাঁটে সে। যেন ভেতরে থাকা চিঠিটাকে অনুভব করে। সদ্য তরুণ জীবনে পদার্পণ করা শান্তার কাছে পৃথিবীটা তখন অন্যরকম। আবেগ দিয়ে সবকিছু মুড়ে দিতে চায় সে। যে কেউ ওর অনুভূতি শুনলে হাসবে বলে সবটা অতি যত্নে, অকঠোর হাতে সস্নেহে আড়াল করে রাখে নিজের মাঝে। চিঠিতে আহামরি কিছুই থাকে না। দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো গল্পগুলোই চিঠির উপজীব্য বিষয়। মাহমুদের জীবনে নতুন ঘটনাপ্রবাহ কম থাকে বলে তার চিঠিগুলো শান্তার চিঠির চেয়ে যথেষ্ট ছোট থাকে। অথচ বেশ গোছানো পরিপক্ব হাতের চিঠিগুলো হয়ে উঠতো শান্তার গুপ্ত সম্পদ।
রোজ বিকেলে বারান্দায় রাখা বেতের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চিঠিগুলো একসঙ্গে জড় করে সে। তারপর পুরনো চিঠিগুলো দেখতে থাকে এক দৃষ্টিতে। কখনো খুলে খুলে দেখে, পেলব হাতে ছুঁয়ে দেয়। যেন এই পরিচিত শব্দের ভেতরে আরও কিছু আছে যা সে দেখতে পাচ্ছে না, পড়তে পারছে না। শান্তার তরুণ মন সাধারণকে অসাধারণ ভেবে নিজের চতুর্দিকে অদৃশ্য অনুভূতি দ্বারা বেষ্টন করে রাখতো নিজেকে। মাহমুদকে সে মাত্র একদিন দেখেছে। ওই অতটুকু সময়ের জন্য কাউকে বিশেষ মানুষদের তালিকায় নেয়া যায় না। অথচ এই চিঠিগুলো তার কল্পনার রাজ্যকে বিস্তৃত করে দিয়েছিল। সেখানে ডালপালা মেলতে মেলতে কাহিনীর রূপ বদলাতে থাকে। ওর সারা চেতনা জুড়ে একটা মানুষ জড়িয়ে যায় আনমনে। যাকে বেশিক্ষণের জন্য দেখেনি, যার সম্মুখে মুগ্ধ হবার মতো বাক্যালাপ হয়নি। শুধুমাত্র এই চিঠিগুলোই বদলে দিতে থাকে মননে বিরাজমান সমস্ত স্বাভাবিকতা।
আনোয়ার সাহেব লক্ষ্য করেছেন মেয়েটার আচার-আচরণ আজকাল অন্যরকম ঠেকছে। তার ভীষণ অস্থিরমতি মেয়েটা সারাক্ষণ প্রফুল্লচিত্তে ছুটে বেড়ায় ঘরের প্রতিটি কোণে। বাবার দায়িত্বে আগের চেয়ে বেশি করে নিয়োজিত করে নিজেকে। শুধু কি সম্বন্ধ বাতিল করে দেয়ায় এই পরিবর্তন? ভাবতে গিয়ে দুশ্চিন্তায় তার চোখ সংকুচিত হয়, ভ্রু কুঞ্চিত হয়। অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর মৃদু তোলপাড় ওঠে। আনোয়ার সাহেব তার একমাত্র মেয়ের গতিবিধি লক্ষ্য করেন তার অলখে। কিছু একটা খোঁজেন, অদৃশ্য বদনে হাতড়ে বেড়ান। দিনশেষে বৃথা হয় সমস্ত প্রচেষ্টা। এই বয়সী মেয়েদের নিয়ে বাবা-মায়ের ভয় থাকা দোষের কিছু নয়। এই বয়সটাই যে এমন। কখন পা ফসকে পড়ে যাবে তার সন্তান সে নিয়ে ভারী উদ্বীগ্ন থাকতে হয় সর্বদা প্রত্যেক সচেতন বাবা-মাকে। কিংবা বলা যায় না কখন না বুঝে পঁচা শামুকে পা কেটে ফেলে একটা বিশ্রি অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। আনোয়ার সাহেব শান্তার আড়ালে তার খালামনির সাথে কথা বলেন। খালামনি হেসেই উড়িয়ে দেয় তার সন্দেহ।
” দুলাভাই! আপনি দেখছি দিন দিন দুশ্চিন্তা বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। শান্তাকে আমার চেয়ে কে ভালো চিনে বলুন? ”
এ কথার পর আর কথা চলে না। কারণ আনোয়ার সাহেব জানেন নিজের মেয়েকে তিনি যতটা চেনেন তারচেয়ে বেশি ওর খালামনি ওকে চেনে। তাই বাধ্য হয়ে তাকে আশ্বস্ত হতে হয় তাকে।
***
চায়ের দোকানের সম্মুখে রাখা কাঠের টুলে বসে আছে মাহমুদ আর নজু। এতরাতে চায়ের দোকান খোলা রাখা হয় না। কিন্তু দোকানদান টুলু মিয়া আজ সাত সকালে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছে। সেই রাগ বজায় রাখতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ বাড়ি ফিরবে না। দোকানেই থেকে যাবে। নজুর সাথে টুলু মিয়ার যথেচ্ছা ভাব। হয়তো নিজের বাবাকে সবসময় কাছে পায় না বলেই টুলু মিয়ার সন্তানসম স্নেহই তার প্রতি নজুর টানটা তৈরি হয়ে গেছে আপনাতেই। দোকান খোলা দেখে মাহমুদ এসে যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে। ওকে দেখে বাকি দু’জনের মুখে হাসি ফুটলো।
” স্যার বন “, টুলু মিয়ার কন্ঠে সুখপূর্ণ উষ্মা প্রকাশ পেল।
” কি ব্যাপার টুলু ভাই! বাড়ি যাননি যে আজ? ”
” আপনার চাচির লগে কাইজ্জা কইরা আইছি। আইজকা আর যামু না ”
কথার মাঝখানে নজু ফিক করে হেসে ফেলল। টুলু মিয়া নিজের ভুল বুঝতে না পেরে উত্তরের আশায় ওরদিকে চাইলো। নজু হেসে বলল,
” কাকা, আপনি স্যারের ভাই অইলে কাকি কেমনে তার চাচী অয়? ”
টুলু মিয়া নিজের দোষ স্বীকার করলেন না।
” ওই একটা অইলেই অইছে ”
মাহমুদ আকাশের দিকে চাইলো। গোল থালার মতো চাঁদ নিজের সৌন্দর্য বিলিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে না আজ। জোছনা প্লাবনে উদ্ভাসিত চতুর্দিক। মাথার উপরে জ্বলজ্বল করে থাকা চাঁদটা জানান দিচ্ছে আজ শুক্লপক্ষ। সারাদিন প্রচন্ড গরমের পর সন্ধ্যা নামতেই ঝুপ করে গরমভাবটা কমতে লাগলো। গাছের পাতারা নাচছে খুশিমনে বাতাসের তালে তালে। চারদিকে বেশ একটা ঠান্ডাভাব৷
” তা কি নিয়ে ঝগড়া করলেন টুলুভাই? ”
যে রাগ-অভিমানে একদিনের জন্য ঘর ছেড়েছে টুলু মিয়া তা নিশ্চিত খুব একটা মজার হেতু হবে। এই অভিপ্রায়ে মাহমুদ জানতে চাইলো ঝগড়ার কারণ।
” কি আর কমু! বেহেন বেলায় বাজারতে মেলা দাম দিয়া এক কেজি ইছা মাছ কিইনা নিয়া গেছিলাম। তাই দেইখা তার ঘর কাঁপানি চিল্লানি। কয়, ফান্তা আনতে নুন ফুড়ায় আর আমনে কিনা এত্তগুলান ট্যাকা খরচ কইরা ইছা মাছ আনতে গেছেন। তড়াক কইরা রাগ উইঠা গেলো তহুনি। ফতিদিন তো আর ভালা মন্দ খাওন অয় না। একদিন যহন শখ কইরা আনছি ওই অতো চিল্লানের কি আছে কন দেহি? কইলাম, আমার মন চাইছে তাই আনছি, তুমার রান্দনের কাম তুমি রানবা। কিন্তু না। তার কতা অইলো এগুলা ফিরোত দিয়া ট্যাকা লইয়া আনতাম। কন এডা কি সম্ভব? আমিও কম যাই না। কইলাম ঠিক আছে খাইতাম না ইছা মাছ, ফিরোতও দিতাম না। তুমি এগুলান লইয়া বইয়া থাহো। রাগ দেখাইয়া আইয়া ফড়লাম দোকানে। আইজকা আর যামু না ”
সকালের ক্ষোভটা আবারও প্রকাশ পেল টুলু মিয়ার চোখে। হারিকেনের আধো আধো আলোতে মাহমুদ যেন অন্যকিছু দেখলো চোখ গুলোতে। ভালোবাসায় মাখা অভিমান। এমন ছোটখাটো ঝগড়া গুলোই সম্পর্কে মিষ্টতা আনে।
” মাথা ঠান্ডা করে তিন কাপ চা বানান টুলু ভাই ”
টুলু মিয়া জোর হাতে চা বানাতে লেগে যায়। কেতলিতে লিকার দিয়ে স্টোভের চুলার ওপর বসায়। তিন কাপ চা হয়ে যায় অল্প সময়েই। তিনজন চায়ের কাপে চুমুক দেয়। কথা হয় না দীর্ঘক্ষণ। পোকাদের নিরন্তর ডাক আর ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ভাসতে থাকে বাতাসে অনুরণন তুলে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মাহমুদের আজ হঠাৎ বিবাগী হতে ইচ্ছে হলো। ভরাট কন্ঠে গেয়ে উঠলো সে,
ও চাঁদ, তোমায় দোলা দেবে কে!
ও চাঁদ, তোমায় দোলা–
কে দেবে কে দেবে তোমায় দোলা–
আপন আলোর স্বপন-মাঝে বিভল ভোলা॥
কেবল তোমার চোখের চাওয়ায় দোলা দিলে হাওয়ায় হাওয়ায়,
বনে বনে দোল জাগালো ওই চাহনি তুফানতোলা॥
আজ মানসের সরোবরে
কোন্ মাধুরীর কমলকানন দোলাও তুমি ঢেউয়ের ‘পরে।
তোমার হাসির আভাস লেগে বিশ্ব-দোলন দোলার বেগে
উঠল জেগে আমার গানের কল্লোলিনী কলরোলা॥*
মাহমুদ থামে। বাকি দু’জন বিমুগ্ধ চাহনিতে মাদকতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মাহমুদ টুলু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” টুলু ভাই রাত হয়েছে বাড়ি যান। হয়তো ভাবী চিংড়ি মাছ রান্না করে আপনার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে ” নজুকে লক্ষ্য করে বলল,
” নজু আয় তো আমার সঙ্গে। কাজ আছে ”
মাহমুদ উঠে পড়ে। তাকে অনুসরণ করে নজু। কিছুক্ষণ পর মাহমুদ প্লাটফর্মের সিমেন্টের বেঞ্চে বসে দেখতে পায় টুলু মিয়া দোকানের ঝাঁপ ফেলে টর্চ হাতে বাড়ির দিকে পা চালিয়েছে। একটা স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে ওর ওষ্ঠের কিনারায়।
চলবে ইন শা আল্লাহ…