#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২১
জীবনের সব জটিলতা গুলো হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যেতে পারে না? উড়ে যেতে পারে না শিমুল তুলোর মতো?
শেষ বিকেল। ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মুসকান। বৃষ্টির পর মুহুর্তে প্রকৃতি বিলাস করতে ভালোবাসে সে। দুপুর থেকে ঝুম বৃষ্টি ছিল। যতক্ষণ বৃষ্টি পড়ছিল ঠিক ততক্ষণ সময়ই বসে ছিল রুমে। জানালার পাশে। আকাশ চিড়ে বৃষ্টি ফোঁটাদের মৃত্তিকা ভেজানো দৃশ্য দেখেছে মন ভরে। বৃষ্টি থামতেই ছুটে চলে এসেছে ছাদে। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ দেখতে। বিষণ্ন হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হিসেবনিকেশ করল জীবনের জটিলতা। সবকিছু হঠাৎই কেমন বদলে গেল। চেনা ঘরটা হলো আরো চেনা। চেনা মানুষ গুলো হয়ে ওঠল আপন থেকেও বড়ো বেশি আপন। তার নিঃসঙ্গ পৃথিবীটায় আজ সঙ্গের অভাব নেই। গতকাল সন্ধ্যায় ইমনের বাবা। তার বড়ো চাচা মোজাম্মেল চৌধুরী এসেছেন। স্ত্রী, কন্যা সহ। বাড়ির গৃহপরিচারিকাকে ছেলের বউ করতে ঘোর আপত্তি থাকলেও ছোটো ভাইয়ের মেয়েকে ছেলের বউ করতে আপত্তি নেই বড়ো চাচার। যেখানে তার একমাত্র পুত্র ভালোবাসে মুসকানকে৷ সেখানে আর আপত্তি করে লাভ নেই। যা নিয়ে আপত্তি ছিল তা মিটে গেছে এখন৷ ইমন চৌধুরীর বউ হওয়া নিয়ে এ বাড়ির কারোরি আর আপত্তি নেই। এ বাড়ির মেয়ে হিসেবে তাকে মেনে নিতে পারছে না শুধু ইয়াশফা আর মেজো কাকিই। ভাই দু’জন এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি৷ মেজো কাকি এখনো বাপের বাড়ি থেকে আসেনি। ইয়াশফা সেই যে ঘরমুখো হয়েছে। প্রয়োজন ব্যতীত না বের হচ্ছে আর না কথা বলছে কারো সাথে। মুসকানের মুখ দর্শনও করেনি সে। অথচ এতকাল অন্যান্যদের চেয়ে ইয়াশফাই তাকে বেশি ভালোবাসত। আকস্মিক ধাক্কাটা সামলাতে সময় লাগবে। জানে মুসকান। তাই কারো প্রতিক্রিয়াতেই তার খারাপ লাগছে না। এই যে সবাই তাকে বাড়ির মেয়ে বলে এত খাতির যত্ন শুরু করেছে। এ ব্যাপারটা নিয়েও মনে মনে অস্বস্তিতে ভুগছে। ইভান, ছোটো চাচি, দাদুভাই সবাই তাকে নিচতলা থেকে উপরতলার ঘরে ওঠতে বলেছিল। সে রাজি হয়নি। ইমন নিষেধ করেছিল কারণ টা আসলে এমন নয়৷ এত বছর যে ঘরে থেকেছে। সে ঘরকে অসম্মান করতে পারেনি। ত্যাগ করতে পারেনি বহু বছরের মায়া। সেই সাথে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে বিলাসবহুল রুমের প্রতি তার কোনো লোভ নেই। সে আগে যেমন সাধারণ জীবনযাপন করেছে এখনো ঠিক তাই করবে৷
গতকাল রাতে বাড়ির তিন ছেলে আর দাদুভাই বৈঠক করেছেন। সেখানে ইমনও উপস্থিত ছিল৷ মুসকানের সাথে তার বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা এগিয়েছে। এখন পর্যন্ত মুসকানের সাথে এ বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলেনি৷ কিন্তু মুসকান অপেক্ষা করছে কেউ তার সঙ্গে কথা বলুক। অন্তত দাদুভাই। এতে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে সুবিধা হবে। সবার মতো ইমনও হয়তো ভাবছে মুসকান এবার তাকে স্বচ্ছন্দে বিয়ে করতে রাজি হবে। তার ভাবনাটা ভুল। মুসকান রাজি হবে না। ইমনের ভুলটা সে ভাঙাতে চায়। জানাতে চায়, বোঝাতে চায় বিয়েতে রাজি হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি। সে এ বাড়ির মেয়ে। এই সত্যিটা প্রকাশের সঙ্গে তাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা চৌধুরী বাড়ির মেয়ের পরিচয় কারো যোগ্যতা হতে পারে না৷ এই সত্যিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সবাইকে। রুদ্ধশ্বাস ফেলল মুসকান। পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমি খুব দুঃখীত ছোটো সাহেব। ‘
***
‘ মুসকান আপু, তোমাকে ডাকছে। ‘
ইমার কথায় রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো মুসকান। দেখতে পেল, দাদুভাই, ইমন আর বড়ো চাচা বসে আছেন। সে উপস্থিত হতেই দাদুভাই পাশে বসতে বলল। মুসকান নিঃশব্দে বসলে মোজাম্মেল চৌধুরী সরাসরি বললেন,
‘ পুরোনো দিনে যা কিছু ঘটে গেছে তা মনে রেখে লাভ নেই। অতীতকে আঁকড়ে থাকলে সামনে আগানো যায় না। তুমি আমার ভাইয়ের মেয়ে। এ বাড়িরই অংশ। ইমনের ব্যাপারে নতুন করে বলার নেই। তোমাদের মধ্যে বোঝাপড়া আছে তাই বেশি কিছু ভেঙেও বলতে হবে না। আমরা তোমাদের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে চাই৷ তোমার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? ‘
নড়েচড়ে বসল মুসকান। আড়চোখে একবার দেখে ইমনের দীপ্তিমান চোখদুটোতে। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছটফট করতে থাকা হৃৎপিণ্ড চেপে ধরে শ্বাস রোধ করে বলল,
‘ আপত্তি আছে। ‘
বিস্মিত হলো মোজাম্মেল চৌধুরী। হতভম্ব হলো ইমন। দাদুভাই নির্লিপ্ত। মুসকান সকলের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে দম ছাড়ল। ঢোক গিলে বলল,
‘ আমি এখন বিয়ে করতে চাই না৷ শুধুমাত্র এ বাড়ির পরিচয় নিয়ে আমি কারো জীবনে প্রবেশ করতে চাই না। ‘
দাদুভাই, বাবা দু’জনকে উপেক্ষা করে ইমন সরাসরি দৃষ্টিতে মুসকানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টির কবলে পড়ে মুসকানের হৃৎস্পন্দনে কম্পন শুরু হলো। তবু দমে রইল না। স্পষ্ট গলায় বলল,
‘ ছোটো সাহেবের যোগ্য না হয়ে তাকে স্বামী রূপে গ্রহণ করতে পারব না আমি। ‘
‘ তুমি কি পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চাইছ? ‘
মাথা ঝাঁকাল মুসকান। বলল,
‘ নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে কারো জীবনে ঢুকতে চাইছি না। ‘
কেন যেন মুসকানের সিদ্ধান্ত মনে ধরল মোজাম্মেল চৌধুরীর। এবার তার সত্যি সত্যি মনে হলো মুসকান তাদেরই বংশধর। দম আছে মেয়েটার। চোখ দু’টোতে আগুন আছে৷ ঠিক তার মায়ের মতো আগুন৷ যে আগুনে জ্বলেপুড়ে তারা দু’ভাই খাঁটি হয়েছে। দূর্ভাগ্যবশত একজন হতে পারেনি। সে হতে পারেনি বলেই আজ মুসকান তাদের বংশের অংশ হয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মোজাম্মেল চৌধুরী। বলল,
‘ এমন একটি সিদ্ধান্ত তুমি নেবে অভাবনীয় ছিল। আমরা সব সময় তোমার পাশে আছি। ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। ‘
মোজাম্মেল চৌধুরী কথাগুলো বলে ইমনের দিকে তাকাল৷ দাদুভাইও ইমনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইমনের দৃঢ় চাউনি তখনো মুসকানের দিকে স্থির। মুসকান লক্ষ্য করল ঠিকি কিন্তু বুঝতে দিল না কাউকেই। মোজাম্মেল চৌধুরী তখন ছেলেকে বললেন,
‘ওর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত। এছাড়া আমার মনে হয় তোমারো নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করা উচিত। যা করছ এটাই শেষ নয় বরং শুরু। আমি তোমাকে আরো বড়ো পর্যায়ে দেখতে চাই। তুমি আমার গোল্ড চাইল্ড ইমন। তোমাকে আমি কাপরাম হিসেবে দেখতে চাই না। ‘
ইমন একই স্থানে একই রূপে বসে। মোজাম্মেল চৌধুরী কথা শেষ করে ওঠে দাঁড়ালেন। বলা যায় স্পেস দিলেন ছেলেকে। বাবাকে ইশারায় বললেন, ওদেরকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেয়া উচিত। বাবা, ছেলে কয়েক পল সময়ের মধ্যেই ড্রয়িং রুম থেকে সরে গেল। জগতের সকল অস্বস্তি জাপ্টে ধরল মুসকানকে। ইমনের দৃঢ় দৃষ্টি তার বুকের ভেতর অজানা ভয়ের জন্ম দিল। বুকের ভেতর বাজনা বাজল দ্রিমদ্রিম। ওঠে চলে যাবে নাকি বসেই থাকবে? ইমন কি কিছু বলবে তাকে? বিপাকে পড়ল খুব৷ এক সময় মনস্থির করল ওঠেই যাবে। ঠিক সেই মুহুর্তেই ইমন বলল,
‘ আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম। তোমার পরিচয়, যোগ্যতা কোনো কিছু নয়। যদি পরিচয়, যোগ্যতাই ম্যাটার করত তাহলে বহু অপশন ছিল। তুমি সবার কথা ভাবলে এক আমি ছাড়া। তুমি সবাইকে গুরুত্ব দিলে শুধু আমি ছাড়া। কতটা ভেলুলেস আমি তোমার কাছে হাহ! ‘
কণ্ঠে দুঃখ, কষ্ট, অভিমান নাকি তীব্র রাগ? বুঝতে পারল না মুসকান। শুধু বুকের ভেতর চিনচিনে এক ব্যথা সৃষ্টি করল ইমনের কণ্ঠে বলা একেকটা বাক্য। কয়েক মুহুর্ত নীরবতায় কাটল ওদের। মুসকান থমথমে মুখে তাকাল ইমনের দিকে৷ ইমন ওর চোখে আর চোখ রাখল না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে মেঝেতে স্থির রাখল। আকস্মিক ফিচেল হাসল সে। যে হাসি দেখে মুসকানের বুক ধক করে ওঠল। ইমন একই ভঙ্গিতে আসক্তিহীন গলায় বলল,
‘ ভালোবাসা শব্দটার গভীরতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই মুসকান। আর যার মাঝে ভালোবাসা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সে আমার জন্য নয়। তুমি আমাকে ভালোবাসোনি। আমি ভুল। ইয়েস আই এম রং, ইউ ডিডেন্ট লাভ মি মুসকান। ইউ ডিডেন্ট লাভ মি! ‘
সহসা ওঠে দাঁড়াল ইমন। ঝড়ের গতিতে চলে গেল মুসকানের সামনে থেকে। শেষ বাক্যটি শুনে বুক কেঁপে ওঠল মুসকানের। ইমনের বলা প্রতিটি কথা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে লাগল। ধীরে ধীরে বুক ভার হয়ে ওঠল তার। হাত, পায়ে শুরু হলো মৃদু কম্পন। না চাইতেও চোখের কার্ণিশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা অশ্রুজল। মনে মনে বলল,
‘ আমি কি সত্যি আপনাকে ভালোবাসিনি? ‘
ইমন বিশ্বাস করে দু’জন মানুষ যদি সমানভাবে দু’জনকে চায় তাহলেই দু’জন এক হওয়া সম্ভব। সে মুসকানকে যেভাবে ভালোবাসে, যেমন করে চায়। মুসকান সেভাবে চায়নি কখনো। মুসকানের প্রতি তার অনুভূতির যে গভীরতা। সেই গভীরতা তার প্রতি মুসকানের নেই। বুকের ভেতরটা আজ বড়ো হাহাকার করছে ইমনের। তবে কি এক তরফা ভালোবাসা ছিল? এক তরফা ভালোবাসা এতটাই পীড়াদায়ক?
নিজের ঘরে ছটফট করছে ইমন। ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে স্থির হলো যে, সে যতদ্রুত সম্ভব চাকরিতে রিজাইন দেবে। এরপর চলে যাবে এ বাড়ি থেকে। মুসকানের থেকে দূরে। যাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য এত গুলো বছর ধরে ছটফট করছে। আজ শেষ সময়ে এসে এত চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া হবে না৷ মেনে নিতে পারল না সে৷ মুসকানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মানে আরো কয়েকটা বছর অপেক্ষা করা। কিন্তু এই অপেক্ষার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? মুসকান কি পারত না তার বউ হয়ে ক্যারিয়ার তৈরি করতে? ওর বউ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হলে কি মান সম্মান চলে যেত? এই বাড়ির ওপর থাকা অভিমান গুলো সে তার ওপর ঝাড়ল। একবারো তার ভালোবাসার মর্যাদা দিল না? ক্রোধে, জেদে জর্জরিত হয়ে মুসকানকে একটি ম্যাসেজ করল ইমন।
‘ সম্মানে ভালোবাসা তরল, উপেক্ষায় দূরহ। ‘
ম্যাসেজটি সেন্ট করে ফোন ছুঁড়ে মারল বিছানায়৷ গোছাতে শুরু করল নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজ মনে বলল,
‘ সর্ব মহলে কঠিন, দাপুটে আমার উচিত হয়নি তোমার কাছে নত স্বীকার করা। প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছিলাম আমি। ভালোবাসায় উন্মাদ। পুরুষের অতিরিক্ত ভালোবাসা নারী সহ্য করতে পারে না। তোমাকে আর সহ্য করতে হবেও না। আমার ভালোবাসা যে সইতে পারেনি সে আমার কাঠিন্যতা কীভাবে সহ্য করে তাই দেখব। ‘
সাতসকালে ইমনের জন্য কফি করে এনেছে মুসকান। ইমন তখন ঘুমে ছিল। ভিতর থেকে দরজা আটকানো। বিষয়টা খুব অবাক করল মুসকানকে। বুঝে নিল তার সাহেবের রাগের মাত্রাটুকু৷ একবার ভাবল ফিরে যাবে। আবার ভাবল রোজ সকাল বিকাল তার হাতের কফি খাওয়ার স্বভাব ইমনের৷ এমনিতেই অনেক কিছু সহ্য করছে। অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটুকু থেকে নাই বা করল বঞ্চিত। ভেবে নিয়ে দরজায় টোকা দিল। বারকয়েক টোকা দিতেই ভিতর থেকে গমগমে কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘ কে বিরক্ত করছে কে? ‘
বুক ধক করে ওঠল মুসকানের। যে মানুষটা তার জন্যই দরজা আটকে ঘুমায়নি কখনো। সে মানুষটা আজ দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। নক করলে আবার এভাবে ধমকও দিচ্ছে। যারপরনাই অবাক হলো সে। ঢোক গিলে নরম গলায় বলল,
‘ আমি কফি এনেছি। ‘
পাক্কা এক মিনিট পর কপাল কুঁচকে দরজা খুলল ইমন৷ মুসকান ধীর পায়ে ভিতরে ঢুকে ডেব সাইট টেবিলে কফির মগ রাখল। ইমন চোখ ডলতে ডলতে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। মুসকান তার অগোছালো বিছানা গুছাতে উদ্যত হলে ইমন ওয়াশরুমের দরজা আটকানোর পূর্বে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার এসব করার প্রয়োজন নেই। আগামী সাতদিন আশিকা খালাকে বলবে আমার কফি করে দিতে। ‘
আগামী সাতদিন? মুসকান অবাক চোখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ইমন বেশ শব্দ করে বাথরুমের দরজা আটকে দিল৷ আকস্মিক কাণ্ড চোখ খিঁচে ফেলল মুসকান। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ঢোক গিলে বিছানা ঠিকঠাক করে নেমে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল,
রুমের এক কোণায় বড়ো বড়ো দু’টো লাগেজের দিকে। হৃৎপিণ্ডটা তড়াক করে লাফিয়ে ওঠল ওর। আগামী সাতদিন আবার দু’টো লাগেজ। অজানা আশঙ্কায় বুকে কাঁপন ধরল তার। নিঃশব্দে চুপচাপ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল ইমন বের না হওয়া পর্যন্ত। তোয়ালে ঝুলিয়ে যখন ইমন বের হলো দেখতে পেল মুসকান চিন্তান্বিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি তার লাগেজের দিকে স্থির। বুকের ভেতর অসহ্য ক্রোধ, অভিমান টগবগিয়ে ফুটল তার। ইচ্ছে করল নিজের সমস্ত ক্রোধ এই মেয়েটার ওপর ঢেলে দিতে৷ গাল দু’টো চেপে ধরে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল, কেন তার ভালোবাসাকে এতটা মূল্যহীন করে ফেলল সে? যে তৃষ্ণায় বুক চৌচির তার। সেই তৃষ্ণা কেন ওর হৃদয়ে নেই? ইচ্ছে গুলো মাটিচাপা রইল। ধপাধপ্ পা ফেলে কাভার্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। কপাট খুলে নিজের সবচেয়ে অপছন্দীয় পোশাক বের করে ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। কেঁপে ওঠল মুসকান। ভয়ে মনের কৌতূহল মুখে বেরিয়ে এলো৷
‘ এই লাগেজ গুলো কীসের? আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন? ‘
‘ তোমায় কেন বলব? কে তুমি? ‘
প্রথম প্রশ্নটি শান্ত গলায় বললেও শেষ প্রশ্নটা তপ্ত মেজাজে বেরিয়ে গেল। কে তুমি? প্রশ্নটিতে ভেতরটা নড়ে ওঠল মুসকানের। আচমকা চোখ দু’টো ছলছল হয়ে ওঠল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘আমি শুধু সময় নিয়েছি। আপনি বোধহয় ভুল বুঝছেন আমাকে। ‘
‘ আই আন্ডারস্ট্যান্ড পারফেক্টলি মুসকান। ‘
ঠাণ্ডা স্বরে কথাটা বললেও মুসকানের ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল ঐ স্বরে। ইমন পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর পানে তাকিয়ে আরো বলল,
‘ তুমি কি ভেবেছ তুমি সময় নিবে। আর আমি খুশিতে নৃত্য করতে করতে তোমার সাথে প্রেম লীলা চালাব? কী মনে হয় তোমার আমাকে? আমার মেরুদণ্ড নেই? তুমি যা বলবে যা সিদ্ধান্ত নেবে সব মানতে হবে আমাকে? ইমন চৌধুরীকে এতটাই সস্তা ভাবো তুমি এতটাই? ‘
চ্যাঁচানো স্বরে কথাগুলো বলায় মুসকান তো কেঁপে ওঠলই। পুরো রুমটাও থমথমে হয়ে রইল। ওর উচ্চস্বরে ধমক শুনে পাশের ঘর গুলো থেকে ইভান, ইমা সহ সবাই বেরিয়ে এলো। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ভাবতে লাগল ভেতরে আসলে হচ্ছে টা কী?
এদিকে জীবনে প্রথমবারের মতো ইমনের এমন আচরণের সম্মুখীন হয়ে মাথা ঘুরতে লাগল মুসকানের। দম আঁটকে এলো। সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করল থরথর করে। এই ইমনকে সে চেনে না৷ এই ইমন সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ। আর সহ্য করতে পারল না সে। ওড়নার আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না আঁটকে এক ছুটে বেরিয়ে গেল। গলায় ঝুলানো তোয়ালেটা একটানে খুলে ফেলল ইমন। অতিরিক্ত রাগে শরীর কাঁপছে তার৷ কপালের রগ ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। রাগ নিয়ন্ত্রণে নিজেকেই গালাগাল করল। সত্যি বলতে মুসকানকে কষ্ট দিয়ে সে নিজেই ঠিক থাকতে পারল না। আবার ভেতরে থাকা রাগ, অভিমান গুলোও ফুঁসে ওঠল। দু-হাত কোমরের দুই পাশে রেখে ঘরজুড়ে ঘুরপাক খেতে শুরু করল। শ্বাস নিল বড়ো বড়ো করে। তার পেশি বহুল বুকটা ঘনঘন ওঠা-নামা করছে। হঠাৎ বুকের বা পাশে দৃষ্টি স্থির হলো তার৷ ওপাশটায় চিনচিন করছে। ওপাশে সযত্নে থাকা রানিটা যে এখন কাঁদছে। অনুভব করল সে। বিড়বিড় করে বলল,
‘ বিয়ে করবে না৷ অথচ বউয়ের মতো ট্রিট করবে। এবার দেখো বিয়ে না করে বউয়ের মতো ট্রিট করার দহন কতটা তীব্র হয়। ‘
চলবে…
#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২২
হুট করেই সব কেমন সুনসান হয়ে গেল। আজ সাতদিন হলো ইমন বাড়ি ছাড়া। এই নিয়ে আর কারো মাঝে প্রভাব না পড়লেও মুসকানের মাঝে পড়ল৷ দাদুভাই গতকাল আশ্রমে ফিরে গেছে। মুসকান যেতে চাইলে বেশ দৃঢ়চিত্তে তিনি জানিয়েছেন,
‘তোমার সব সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিয়েছি গিন্নি। এবার তোমাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাই। আমি চাই না তুমি আশ্রমে গিয়ে থাকো। এ বাড়িতে নিজের খেয়াল রেখে চলবে, পড়াশোনা করবে মন দিয়ে। দুঃশ্চিন্তা করো না। সব সময় মনে রাখবে যা তোমার তা শুধু তোমারি।’
দাদুভাইয়ের শেষ কথাটি শুনে বুক থেকে পাথরটা সরে গিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে আবারো অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করে নিয়েছে তাকে। বাড়িতে অনেকেই আছে। তবু নিজেকে সম্পূর্ণ একা মনে হচ্ছে। দাদুভাই নেই, ইমন নেই। এই দু’জন মানুষের অভাবে মনে রুক্ষতা জন্মেছে। সেদিন সকালের ঘটনাটুকু মনে পড়ছে বারবার। কেঁপে ওঠছে বুক। ইমনের দু-চোখে যে অভিমান দেখেছে। সে অভিমান হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়েছে তার। এ অভিমান ভাঙবে কী করে? সাধ্য আছে কি ও অভিমান ভাঙানোর? যে অভিমানের পেছনে তার জেদ দায়ী সে অভিমান কি ভাঙবে তার ভালোবাসা পেলে? মন, মস্তিষ্ক জুড়ে সর্বক্ষণই ইমনের বিচরণ। মানুষটা দূরে গিয়ে যেন আরো বেশি করে কাছে এসেছে। কে বলে সে তাকে ভালোবাসে না? তার মাঝে যার সর্বক্ষণের বিচরণ চলে। তাকে ভালো না বেসে উপায় আছে? দিন গুলো কাটছে বিষণ্ণ। রাতগুলো নির্ঘুম, নিঃসঙ্গ। এভাবেই কেটে গেল একটি মাস। চৌধুরী বাড়িতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। সবাই ব্যস্ত সবার জীবনে। মেজো কাকি বাড়ি ছেড়ে যাবার নয়দিনের মাথায়ই ফিরে আসেন৷ বড়ো ছেলে গিয়ে নিয়ে এসেছে মাকে। সে বাড়িতে আসার পর মুসকানের সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক মুখও দর্শন করে না৷ মুসকানও যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে তাকে। শুধু তাকে নয় নিজের জন্মদাতা এবং সৎ ভাই, বোন সবাই এড়িয়ে চলে সে। কারণ তারা তাকে পছন্দ করে না৷ এই অপছন্দটিকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নেয় মুসকান। তবে এ বাড়িতে যারা তাকে খুব সহজে গ্রহণ করেছে তারা হলো ছোটো কাকি আর তার ছেলেমেয়ে। ইদানীং ইভানকে দেখা যায় তাকে বেশ যত্ন নিতে৷ যদিও সুযোগ দেয় না মুসকান৷ তবু যতটা পারে করে দেখায়। ইমাও কাজিন হিসেবে এখন যথেষ্ট সম্মান দিচ্ছে। কারো সাথে তার সম্পর্ক জটিল হয়েছে। কারো সাথে বা খুবই সহজ হয়েছে। এতকিছুর ভীড়ে মন পুড়ছে কেবল একজনের জন্যই। সে হলো তার মনের মানুষ ইমন চৌধুরী।
এক শুক্রবারে দাদুভাই এলেন। খবর দিলেন, ইমন স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। মুসকান বুঝে নিল, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ বাড়ি মুখো হবে না মানুষটা। বুক টনটন করে ওঠল তার। চোখ দুটো টলমল। যা সকলের থেকে আড়াল করে নিল সযত্নে। ড্রয়িংরুমে তখন ইভান, ইমা উপস্থিত। দাদুভাই মুসকানের সাথে গল্প করছিলেন৷ তাদের কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে ইভান বলল,
‘ইমন এটা একদম ঠিক করল না। এত জেদ ভালো না৷ এমন কিছু হয়ে যায়নি যার জন্য এ ধরনের আচরণ দেখাতে হবে। সবই শুনেছি, বুঝেছি। আর দেখেছিও ওর রুড আচরণ গুলো।’
শেষ কথাটা মুসকানের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল সে। যেন ইমনকে নিয়ে মুসকানের মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করাটাই তার মূল উদ্দেশ্য। মুসকান নড়েচড়ে ওঠল। কাজের বাহানা দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল দরজা আঁটকে। মনকে স্বান্তনা দিল, যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে। সব ভালোর জন্যই হচ্ছে। ইমনকে আরো এগিয়ে যেতে হবে। অনেকটা পথ আগাতে হলে কখনো কখনো এক কদম পিছুতে হয়৷ ইমন এক কদম পিছিয়েছে। সবার ভাষ্যে মুসকান বাধ্য করেছে পেছাতে। কিন্তু মুসকানের বিশ্বাস ভবিষ্যতে এর ফল সবাই দেখতে পারবে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে ইমনকে সেরার সেরা দেখতে চায় সে। খুব ছোটোবেলায় শুনেছিল ইমনকে নিয়ে ইমনের মায়ের স্বপ্ন। যেই স্বপ্ন এখনো পূরণ করতে পারেনি ইমন। মুসকানকে ভালোবেসে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে যে ভাবেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়ানোকে প্রাধান্য দিয়েছিল ইমন। ভুলেই গিয়েছিল তার মায়ের স্বপ্নকে। তার পরিবারের চাওয়াকে। চৌধুরী বাড়ির ছোটো ছেলেকে নিয়ে সবার প্রত্যাশা একটু বেশিই। যে প্রত্যাশায় এতদিন ভাঁটা পড়েছিল। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে সব। অনেকটা সময় নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে নিজেকে বোঝাল মুসকান। এরপর ওঠে বসল আচমকা। ফোন হাতে নিয়ে কল করল ইমনের ফোনে। বরাবরের মতোই রিং হলো৷ কিন্তু ওপাশের মানুষটা অভিমানের দেয়াল ভেঙে ফোনটা আর রিসিভ করল না। ফলশ্রুতিতে বুকের কষ্ট দৃঢ় হলো মুসকানের। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল৷ ঘুম ভাঙল ঠিক রাত এগারোটায়। ইভানের ডাকে৷ ঘুম কাতুরে দৃষ্টি মেলে তাকাল মুসকান। খোলা জানালা ঘেঁষে দাঁড়ানো ইভান। জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল মুসকান। ঢোক গিলে গলায় ওড়না জড়িয়ে নিল ত্বরিত। ইভান মৃদু হেসে বলল,
‘রাতে খেতে হবে না?’
চমকাল মুসকান৷ মনে পড়ে গেল সে সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছে। রাতের খাবার খাওয়া হয়নি। পরোক্ষণেই ইভানের দিকে হুঁশ এলো। মেজাজটা চরম খারাপ করল হঠাৎ। এতদিন ইভানের ভালো মানুষি সহ্য করলেও আজ করতে পারল না। যেদিন থেকে ইভান জানতে পেরেছে মুসকান চৌধুরী বাড়ির সন্তান। মেজো কাকার ছোটো মেয়ে। সেদিন থেকেই তার আচরণ বদলে গেছে৷ হয়তো এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে এ মুহুর্তের এই আচরণটুকু মোটেই স্বাভাবিক ঠেকল না। সে খেল কি খেল না এদিকে ইভানের নজর দেয়ার কথা নয়৷ তবু দিয়েছে। রুম খোলা পায়নি বলে খোলা জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ কে জানে যতক্ষণ ঘুমিয়েছিল ততক্ষণ গায়ের কাপড় ঠিক ছিল কিনা! ইভান কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল? বিশ্রী একটা অনুভূতি হলো মুসকানের। ত্বরিত ফোনে সময় দেখে নিয়ে বিছানা ছাড়ল। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আশিকা খালা আর ইভান ঘুমায়নি।
মুসকান খেতে গেলে আশিকা খালা খাবার বাড়তে শুরু করল৷ বলল,
‘ওইঠা গেছ মা। তুমি ঘুমাই গেছিলা তাই আর ডাকিনাই।’
মুসকান চুপচাপ চেয়ার টেনে বসল। এ বাড়িতে এখন তাকে কোনো কিছুই করতে হয় না। রান্নার দায়িত্বটাও আশিকা খালার। সবাই যার যার মতো খেয়েদেয়ে চলে গেছে। বাকি আছে সে নিজেই। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে খেতে শুরু করল। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই উপস্থিত হলো ইভান। আশিকা খালা তাকে খাবার বেড়ে দিলে মুসকান স্তম্ভিত হয়ে তাকায়। তার চাউনি দেখে ইভান ভাতে আঙুল চালাতে চালাতে বলল,
‘সবাই নিজেদের মতোন খেয়ে নিল। তুমি ছিলে না। তাই আমিও খাইনি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’
ইভানের কথায় প্রচণ্ড আশ্চর্যান্বিত হলো মুসকান।
নিজের আশ্চর্য চোখ দু’টো ইভানের দুরন্ত চোখে স্থির করল আচমকা৷ খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আবৃত ফর্সা চোয়ালজোড়া খাবার চিবানোর ফলে নড়চড় করছে। এ বাড়ির প্রতিটি ছেলেই সুদর্শন। তন্মধ্যে ইমন আর ইভান একটু বেশিই আকর্ষণীয়। রূপের ঝলকে কেউ কারো থেকে কম না হলেও চরিত্রের দিকে ইভান ইমনের ধারেকাছেও নেই। কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল মুসকান। ইভান খেতে খেতে নানারকম গল্প করল। মুসকান যতটা সম্ভব তাড়া নিয়ে খাবার শেষ করে ওঠে পড়ল। ঠিক সে মুহুর্তেই ইভান ডাকল,
‘মুসকান শুনছ?’
চোখ, মুখ শক্ত করে দাঁড়াল মুসকান। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বুঝে ফেলল, ইভান সুযোগ নিতে চাইছে। ওর চাউনি, কথাবার্তা, আচরণ বলে দিচ্ছে শুধুমাত্র কাজিন পরিচয়ের জন্য এমন করছে না। এর পিছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেসব ভাবতেই ভাবতেই তক্ষুনি মনে পড়ল, পুরোনো দিনের আচরণ গুলো। যা তাকে বারবার অনুভব করায় ইভান খুব বাজে মনের ছেলে। গোপনে নিঃশ্বাস ফেলল সে৷ দাঁড়িয়ে রইল কিছু শোনার জন্য। ইভান খাওয়া শেষ করে প্লেট ঠেলে দিল আশিকা খালার দিকে৷ আশিকা খালা প্লেটগুলো নিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালে সে মুসকানে সম্মুখে এসে দাঁড়াল। বলল,
‘তোমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগই পাচ্ছি না৷ মুসকান, ইতিপূর্বে যা কিছু হয়েছে সবকিছুর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করি আমাকে নিয়ে মনের ভিতর কোনো রাগ পুষে রাখবে না৷ তুমি এই বাড়ির মেয়ে, আমিও এই বাড়ির ছেলে। আমরা একে অপরের খুব আপন। আপনজনদের সাথে অজান্তে করা ভুল গুলোর জন্য আমি অনুতপ্ত।’
তাচ্ছিল্য ভরে হাসল মুসকান৷ ইভানের স্বল্প জ্ঞান ধরতে পারল না সে হাসির অর্থ। পর বলেই একটা অসহায় মেয়ের সাথে ঘৃণ্য আচরণ করতে হবে? আর আপন হলে দিতে হবে সম্মান, মূল্যায়ন? মন থেকে ইভান অনুতপ্ত হয়েছে কিনা জানে না মুসকান। জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই। তারা একই পরিবারের সদস্য। মনে যাই থাকুক প্রকাশ্যে সম্পর্ক গুলো আর খারাপ না হোক। তাই ভদ্রতার সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ইট’স ওকে।’
এরপরই হাত ধুতে চলে গেল। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে হাসল ইভান৷ শব্দ করে দম ছেড়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘একবারে বেশি খেতে গেলে কমও পাওয়া যায় না। তোকে খুব মেপে চলতে হবে ইভান। আজ এ পর্যন্তই থাকুক।’
____________________
দশটা থেকে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইমনকে কল করতে করতে অস্থির সায়রী। ছেলেটা এমন ছন্নছাড়া হয়েছে আজকাল। রাত করে বাসায় ফেরে৷ কোথায় থাকে কী করে কিচ্ছু বলে না। দুঃশ্চিন্তায় দিহানের সঙ্গে একচোট ঝগড়া লাগল তার৷ বউয়ের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে ইমনকে ম্যাসেজ করে গালি দিল সে। ইমন না কল রিসিভ করল আর না ম্যাসেজের রিপ্লাই। ইমন ফেরেনি মধ্যরাতে বিছানায় গেল সায়রী। দিহান তার গা ঘেঁষে শুয়ে বলল,
‘সায়ু ও বোধহয় বাবার বাসায় আছে। আজ আর ফিরবে না।’
সায়রী আস্তে করে হুম বলল। দিহান তাকে কাছে টেনে গালে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
‘রাগ করেছিস?’
সায়রী ওর থেকে ছোটার চেষ্টা করে বলল,
‘না ভালো লাগছে না ছাড়।’
দিহান ছাড়ল না। আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হতে উদ্যত হলো। সায়রী বাঁধা দিয়ে বলল,
‘এখন না।’
দিহান শুনল না। ওর ঠোঁটে ঠোঁটে ডুবানোর পূর্বে শুধু বলল,
‘যখন ফিলিংস আসে তখন না করাটা জঘন্য অপরাধ সায়ু৷ আর যখন ফিলিংস থাকে না তখন খোঁচাখোঁচি করাটা বদ অভ্যাস।’
ইমন বাসায় ফিরল রাত আড়াইটার দিকে। কলিং বেল টিপল বেশ কয়েকবার। কিন্তু দরজা খুলল না কেউ। প্রকৃতি এখন শান্ত। কিন্তু দিহান খুবই অশান্ত। প্রকৃতিতে তাণ্ডবলীলা থামলেও সায়রীর শরীরে দিহানের প্রণয় তরঙ্গ থামেনি তখনো। টানা দু’ঘন্টা বৃষ্টিতে ভেজার ফলে শরীর কাঁপছে ইমনের। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। শেষ কয়েকবার কলিং বেল টিপে দরজার সামনেই শরীর ছেড়ে দিল সে।
সায়রী, দিহানের পারিবারিক বিয়ে হয়নি। বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে তারা নিজেরাই বিয়ে করেছে। তাদের বিয়েটা হয় ইমনের নিজস্ব ফ্লাটে। ইমনের জোরাজোরিতে সেখানেই সংসার পাততে বাঁধ্য হয় ওরা৷ দিহান এখনো ঠিকঠাক কোনো কর্ম যোগাড় করতে পারেনি৷ সায়রী স্কুল টিচার। তাদের ছোট্ট সংসারে কোনো প্রকার অশান্তি নেই৷ দু’জন ম্যাচিওর ছেলেমেয়ে নিজেদের সুখী রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। সেই দু’জনের সংসারে হঠাৎ করেই ইমনের আগমন। একই শহরে তার বাবা থাকলেও সেখানে যায় না ইমন। সে তার জীবনের পরবর্তী প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার জন্য দিহান, সায়রী দিচ্ছে পূর্ণ সমর্থন। সে যেমন কঠিন সময়ে বন্ধুদের পাশে থেকেছে৷ বন্ধুরাও তার জীবনের দুঃসময়ে পাশে রয়েছে।
চারিদিকে ফজরের আজান ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সেই ধ্বনিতে জেগে ওঠল ইমন। দুর্বল শরীরে ওঠে দাঁড়াল। কলিং বেল টিপে ভিতরের মানুষ দু’টোকে আবারো জাগানোর চেষ্টা করল। ঠিক দু’মিনিটের মাথায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দরজা খুলল দিহান। ইমনকে দেখে বিস্মিত চোখে তাকাল সে। উত্তেজিত স্বরে বলল,
‘কী অবস্থা তোর!’
দিহান জাপ্টে ধরল ইমনকে। ইমন দুর্বল গলায় বলল,
‘শা লা তিনঘণ্টা ধরে কলিং বেল টিপছি।’
বড়ো বড়ো করে তাকাল দিহান। ধরে ধরে ভিতরে নিয়ে এলো। বলল,
‘ফোন করবি তো?’
বাঁকা হাসল ইমন। তার ফোন কোথায় সে নিজেও জানে না৷ দিহান ওকে শুইয়ে দিল সোফায়। এরপর ত্বরান্বিত হয়ে দরজা আঁটকে বেড রুমে চলে গেল। সায়রীকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘তাড়াতাড়ি শাওয়ার নে সায়ু। ইমন ফিরেছে অবস্থা খুব খারাপ।’
ইমনের শরীর থেকে ভেজা পোশাক খুলে দিল দিহান। রুমে নিয়ে গিয়ে কোমড়ে তোয়ালে জড়িয়ে দিল। এরপর গায়ে কাঁথা টেনে সায়রীকে বলল,
‘প্রচণ্ড জ্বর। হসপিটাল নিব?’
চিন্তান্বিত কণ্ঠে সায়রী বলল,
‘কিছু খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস কর।’
ইমনের কানের কাছে মুখ নিয়ে দিহান জিজ্ঞেস করল,
‘রাতে খেয়েছিলি?’
ইমন বাঁকা হাসল। দিহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায়রীকে বলল,
‘ওর মাথা আসলেই গেছে। তুই খাবার গরম কর। আপাতত নাপা এক্সট্রা ট্রাই করি।’
সায়রী চলে গেল। নিজের রুমে গেল ওষুধ নিতে। এমন সয়ম আবারো কলিং বেলের শব্দ পেল। দরজা খুলল সায়রী। দেখতে পেল নিচতলার বাচ্চা ছেলেটা। এবার ক্লাস এইটে পড়ে৷ নাম টুটুল। ছেলেটা একটি মোবাইল এগিয়ে দিল। সায়রী খেয়াল করল মোবাইলটা ইমনের। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
‘কোথায় পেলে! ‘
ফোনের স্ক্রিন ভেজা। ওড়নার কোণা দিয়ে মুছতে শুরু করল সায়রী। ছেলেটা বলল,
‘গেটের কোণায় পড়েছিল। লক স্ক্রিনে ভাইয়ার ছবি দেখে বুঝতে পারলাম ইমন ভাইয়ার ফোন তাই দিয়ে গেলাম।’
সায়রী মাথায় বুলিয়ে বলল,
‘কী ভালো ছেলে তুমি। থ্যাংকিউ সো মাচ।’
টুটুল লাজুক হেসে চলে গেল। সায়রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা আঁটকে দিল। ফোনটা বন্ধ। কী যেন ভেবে ফোন খুলল সে। এরপর একের পর এক ম্যাসেজ এসে ভরে গেল৷ দিহানের ম্যাসেজের পর মুসকানের নাম্বার থেকেও ম্যাসেজ এলো দু’টো। সায়রী জানে ইমন মুসকানের সাথে যোগাযোগ রাখছে না। মেয়েটা নিয়ম করে রোজ ফোন করে, ম্যাসেজ করে। অথচ ইমন ভুল করেও একটিবার ফোন রিসিভ করে না। আর না দেয় ম্যাসেজের রিপ্লাই। রান্নাঘরে যেতে যেতে মুসকানের উতলীয় ম্যাসেজ দেখল সে। বেচারি ফোন বন্ধ পেয়ে ঘাবড়ে গেছে। ভাবছে তার প্রতি বিরক্ত হয়ে ইমন ওকে ব্লক করে দিয়েছে। আসলে তো এমনটা নয়। সায়রীর ভাবনার মাঝেই কল এলো মুসকানের। কোনোকিছু না ভেবেই রিসিভ করল সায়রী। সঙ্গে সঙ্গে মুসকানের ক্রন্দন ধ্বনি শুনল সে। সায়রীর মায়া হলো খুব। বলল,
‘এই মেয়ে কাঁদছ কেন?’
আকস্মিক সায়রীর কণ্ঠ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল মুসকান। পরোক্ষণেই মনে পড়ল ইমনের অভিমানের পাহাড়কে। তাই শান্ত হয়ে গেল। ইমন ইচ্ছে করেই তার ফোন ধরেনি। আজ বিরক্ত হয়ে সায়রীকে দিয়ে ধরিয়েছে। ধরাক না সমস্যা কী? সে না হয় সায়রী আপুর থেকেই খোঁজ নেবে মানুষটার। মুখে হাত চেপে কান্না আটকালো মুসকান। কাঁপা গলায় বলল,
‘সায়রী আপু উনি কেমন আছে? ‘
সায়রী প্রথমে ভাবল কিছু বলবে না৷ পরোক্ষণেই মাথায় বুদ্ধি চাপল এই দু’টোকে একসাথে করার। পাশাপাশি পরীক্ষা করতে মন চাইল ইমনের প্রতি মুসকানের অনুভূতির প্রগাঢ়তা। ইমনের ভাষ্য অনুযায়ী মুসকানের তার প্রতি কোনো অনুভূতি নেই। সেই ভাষ্য কতখানি সত্যি একটু যাচাই করা যাক। যেখানে ইমন মুসকানকে পাগলের মতো ভালোবাসে। সেখানে মুসকান ওর প্রতি এতটাই ভাবলেশহীন? এই ফোন, ম্যাসেজ শুধু মাত্র ভদ্রতার খাতিরে? সায়রীর তীক্ষ্ণ জ্ঞান যা করতে বলল সে ঠিক তাই করল। মুসকানকে স্পষ্ট বাক্যে বলল,
‘তোমার সাহেব তো সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে বাসায় ফিরেছে৷ জ্বরে গা পুড়ছে। একে নিয়ে এখন আমি কী করি বলো তো?’
শুয়েছিল মুসকান। আকস্মিক ওঠে বসল। কথাটা শুনে বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠেছে তার। এমনিতেই সারারাত ঘুম হয়নি। মাথার মধ্যে ইমনকে নিয়ে নানারকম দুঃশ্চিন্তা কিলবিল করেছে। বুকের ভেতরটা কাল থেকেই কেমন কেমন করছিল। আজ ইমনের এ খবর শুনে পুরো পৃথিবীই ঘুরতে লাগল তার। এতদিনের ধৈর্যের বাঁধটা ভেঙে গেল এক নিমিষেই। শব্দ করে কেঁদে ফেলল সে। সায়রী তার উৎকন্ঠা আরো বাড়াতে বলল৷
‘ওর শরীরটা কেমন করে যেন কাঁপছে। আমার খুব ভয় করছে মুসকান৷ এত্ত জেদ ওর। আমি আর দিহান মিলে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। ফা জিলটা যেতেই চাচ্ছে না। শুধু একটু পর পর মা মা বলে গোঙাচ্ছে। তুমি বলো আন্টি তো নেই। আমি তাকে এ মুহুর্তে এনে দিব কী করে?’
এ পর্যন্ত বলেই হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,
‘একটু আগে দিহান বলল কয়েকবার নাকি মুসকান, মুসকানও করেছে।’
ফুঁপিয়ে ওঠল মুসকান। সে ফুঁপানোর শব্দ শুনে সায়রী বলল,
‘আচ্ছা ও কি অতি আবেগি হয়ে পড়লে তোমায় আদর করে মুসু ডাকে? আমি মুসু ডাকতেও শুনেছি। ইস খুব খারাপ লাগে বুঝছ। বেচারা এই দুরাবস্থায় না পাচ্ছে মাকে কাছে আর না পাচ্ছে ভালোবাসার মানুষকে। ওর আসলে কপালটাই মন্দ।’
হেঁচকি ওঠে গেল মুসকানের। সায়রী হঠাৎ চ্যাঁচিয়ে বলল,
‘হায় আল্লাহ গো ইমন বমি করছে! এই ইমন তোর কী হলো ভাই আল্লাহ রক্ষা করো।’
টুট টুট টুট! ফোন কেটে গেল। ভয়ে শিউরে ওঠল মুসকান। কাঁপতে শুরু করল থরথর করে। নিজেকে আর আঁটকে রাখতে পারল না মেয়েটা। উন্মাদের মতো বিছানা ছেড়ে তৈরি হয়ে নিল৷ এরপর কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইমনের কাছে পৌঁছাতে হবে তাকে।
চলবে…
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।