বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-১৪+১৫

0
492

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — চৌদ্দ

মেজাজে আগুন জ্বলছে। মনের রাগ তীব্র থেকেও তীব্রতর হলে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিতে হিমশিম খায় মাহদিয়া। ভুল কি ঠিক, তখন মন তাকে যা করতে বলে সেটাই করে। কয়েকঘণ্টা আগেই তীব্র রাগের প্রকাশটা তুফানের মতো উড়িয়ে দিয়েছে শাদাবের ওপর। যে ছেলে মায়ের সম্মান বাঁচাতে, মায়ের গর্ভে থাকা ছোট্ট ভ্রুণকে বাঁচাতে স্বেচ্ছায় নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে দূরে গিয়ে বাঁচার পথ খুঁজে নিতে পারে, সে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া দীর্ঘ বছরের এই বিচ্ছেদ টানবে না! হুট করে দূরে সরে যাওয়ার কারণে নয়তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য অন্যকোনো যৌক্তিক কারণ আছে নিশ্চয়ই! নয়তো নিজের দেয়া কথা, নিজে কেন রাখবে না? এতদিনের জমানো রাগ তাকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে দিয়েছিল। তাই শুধু নিজের দিক বিবেচনা করে ওই মুহূর্তে শাদাবকে ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। অপরপক্ষকে কিছু বলবারও সুযোগ দেয়নি। শুয়ে-বসে বিশ্রাম নেয়ার ফাঁকে ফাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় এসব ভাবছিল মাহদিয়া। তখনই মস্তিষ্ক তাকে সিগন্যাল দিল, কাজটা ঠিক হয়নি। সময় নিয়ে, ধৈর্য্য নিয়ে, তাকে কিছু বলবার সুযোগ দেয়ার দরকার ছিল। যদি যৌক্তিক কোনো কারণ না থাকত, তবে শাদাব তার প্রশ্নের উত্তরটাকে কঠিন ও দীর্ঘ বিস্তৃত বলত না। একটা সাধারণ প্রশ্নের উত্তর এত কঠিন কেন হবে? কী যুক্তি তার? তখন যদি এতবেশি রূঢ় আচরণ না করত, এখন ফোন দিয়ে কথা বলতে পারত। রাগের মাথায় ফোন নম্বরটাও নিতে ইচ্ছে হয়নি, অথচ এখন জানতে ইচ্ছে করছে, পিছনে ঠিক কী কী ঘটেছে তার সাথে! সে তো বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিল। আদরে-আহ্লাদে ছিল। একটা পুরুষের কঠিন মুহূর্ত নিজের চোখে দেখেনি, তাই জানেও না ওই দুর্লভ মুহূর্ত কীভাবে সামলে এসেছে একটা মানুষ! এখন এসব জানবার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠল মাহদিয়া। ইন্টারকমের মাধ্যমে রিসেপশনে কল করে বলল,

-‘আহমাদ শাদাবকে একটু ডেকে দেয়া যাবে?’

কয়েক সেকেন্ড কল ওয়েটিংয়ে রেখে দিল রিসেপশনিস্ট। শাদাবের রুমে কল করে তাকে পেল না। শিহাব জানাল, সে রিসোর্টের বাইরে পুলসাইডে আছে। খোঁজ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেটা মাহদিয়াকে জানিয়ে দিল লোকটা। মাহদিয়া তাকে ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে ফোন রেখে দিল। ব্যথাতুর পা নিয়ে বিছানা ছেড়ে নিজের বেশভূষার দিকে নজর দিল একবার। তখন পায়ের রক্ত প্লাজোতেও লেগেছে অনেকখানি। ঔষধ খাওয়ার পর ব্যথা সামান্য কমই আছে। রাতে কী হবে কে জানে! কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে কাভার্ডের কাছে গেল। লং কুর্তি, জিন্স ও একটা তিনকোণা স্কার্ফ বের করে কষ্ট করে পরনের পোশাকটা পালটে নিল। চুলের অবস্থা এতক্ষণে ক্যারোসিন। কাঁকড়া ক্লিপ ও কোঁকড়াচুলে ঝট বেঁধে গেছে। ধীরে ধীরে সবগুলো ক্লিপ খুলে বিনুনির প্যাঁচ সরিয়ে চিরুনী চালিয়ে চুলের ফোলা ফোলা ভাব দূর করার চেষ্টা করল। কোঁকড়া চুল যেভাবে ফুলে থাকে তাতে সারাক্ষণ তেল ও চিরুনী চালিয়ে রাখলেও চুলগুলো পরিপাটি হয় না। যেমন ফোলা তেমনই থেকে যায়। তবুও বার দুয়েক চেষ্টা করে ফোলা চুল নিয়েই বের হলো সে। এই চুল আবার খোঁপা করলেও অশান্তি। ছেড়ে রাখলেও অশান্তি। বেঁধে রাখলেও অশান্তি। কোনোভাবেই ঠিকঠাক থাকতে চায় না। সবসময় পাখির বাসা অথবা একগাদা খড়ের গাদার মতো উঁচু হয়ে থাকে। যতই এলোমেলো, অগোছালো হোক, নিজের চুলটা তার ভীষণ প্রিয়। এই কারণে নিজের পছন্দমতো হেয়ার স্টাইল নিয়ে চলাফেরা করে সবসময়। এভাবেই চলতে অভ্যস্ত সে। এভাবেই থাকতে ভালোবাসে।

রিসোর্টের সামনের দিকে বেরিয়ে ঘড়িতে দৃষ্টি দিল মাহদিয়া। রাত এগারোটা বাজতে চলেছে। পুলসাইডে মানুষ থাকলেও খুব কমই। কয়েকজন কাপল বসে বসে জ্যোৎস্নাবিলাসের ফাঁকে গল্প জমিয়েছে। সেখান থেকে দুষ্টুমি, খুঁনসুটি, হাসিঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। কাটাছেঁড়া পা নিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে বেশ অবাক হলো সে। কিটকটে হেলান দিয়ে আনমনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে শাদাব। তার চেহারার উদাসীনতার ছাপ স্পষ্ট। পুরো চোখমুখ জুড়ে উপচেপড়া মায়া। একমুহূর্ত ওই উদাসী চেহারা দেখে বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যেতে লাগত মাহদিয়ার। অমন করে কোনো পুরুষের চোখের দিকে সে তাকায়নি। এত কাছ থেকে চোখের ভাষা বুঝে ওটার চেষ্টা করেনি। অথচ কয়েকঘণ্টার চেনায় এই ছেলের অব্যক্ত চোখের ভাষা যেন বুঝতে সক্ষম হলো সে। কেউ কীভাবে এত মায়া লুকিয়ে রাখে চেহারায়? এত আকুলতা, এত টান, কীভাবে আগলে রাখে মানুষ? কয়েক সেকেন্ড স্থির চোখে তাকিয়ে একসময় গলা দিয়ে আওয়াজ বের করল মাহদিয়া। অস্ফুটস্বরে, কেঁপে কেঁপে বলল,

-‘এখানে কি একটু বসতে পারব?’

সম্বিত ফিরে পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দু’হাত দূরে মাহদিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত চোখেই তাকিয়ে রইল শাদাব। কোথায় বসবার অনুমতি চাইল মেয়েটা? প্রশ্ন না করেই ঝটপট উঠে দাঁড়াল সে। মাহদিয়াকে বসার জায়গা দিয়ে নিজের জন্য বাড়তি একটা চেয়ার নিয়ে আসলো। বলল,

-‘অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে আসলে কেন? আমাকে ডাকলেই পারতে!’

মাহদিয়ার ম্লানমুখেও হাসি ফুটল। বলল,
-‘রুমে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না।’

তখনকার সব কথা ভুলে যেতেই এখানে এসে নীরবতার মাঝে শান্তি খুঁজে নিতে চাইছিল শাদাব। মাহদিয়ার কথায় মিথ্যে নেই, ভুল নেই, তাই তার ওপর অহেতুক রাগ দেখানো যায় না। রাগ দেখানোর জন্যও অধিকার লাগে। যা তার নেই। জেনে-বুঝে কাউকে অস্বস্তি কিংবা অশান্তির দিকে ঠেলে দেয়ার মতো দুঃসাহস নেই বলেই তাৎক্ষণিক দূরে সরে আসা। কেউ তারজন্য কাঁদুক, কষ্ট পাক, এটা সে কোনোকালেই চায় না। মাহদিয়া তখন তার সামনে যতখানি শক্ত ছিল, ভেতরে ভেতরে ততখানি-ই ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছিল মেয়েটা। এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই তার সিদ্ধান্তকে সহজেই গ্রহণ করে নিয়েছিল। যে সম্পর্কের লেনদেন মনের ভেতর প্রভাব ফেলেনি, সেই সম্পর্ক জোরপূর্বক বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না। এতে দু’দিকের মানুষই চিরকাল অসুখী থাকবে। তারচেয়ে মন যা বলে, সেটাই করা উচিত।

একধ্যানে শাদাবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মাহদিয়া। ছেলেটা তার দিকে তাকাচ্ছেই না। একাধারে ফোন টিপছে। কী জানি কী করছে! হয়তো কাজের বাহানা দেখাচ্ছে। এতক্ষণ তো দিব্যি বসে বসে আকাশ দেখছিল। সে আসতেই ব্যস্ততা বেড়ে গেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই মাহদিয়া বলল,

-‘তুমি অনেক পালটে গিয়েছ। একদম চেনা যাচ্ছে না। আগে তো অনেক মোটা ছিলে! এত পালটালে কী করে?’

আচমকা ‘তুমি’ সম্বোধনে চমকে গেল শাদাব। তাদের দু’জনার সম্পর্ক তুমিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আজ হঠাৎ করেই মাহদিয়া ‘আপনি’ সম্বোধন টেনে এনেছিল। চোখের আড়াল হলেও যে মানুষ মনের আড়াল হয়ে যায়, এই একটা সম্বোধনই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার ‘তুমি’ ডাক শোনে ঠোঁটে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করল শাদাব। ফোন পকেটে রেখে বলল,

-‘কিছু খাবে?’

-‘কফি নিতে পারি।’

-‘যাক। আমি তো ভাবলাম, তখনকার মতো এটাও এখন রিজেক্ট করে দিবে। চিনি চলবে?’

মাহদিয়া মাথা নাড়ল। পুলসাইডে যারা ছিল কেউ কেউ কফি, কুলড্রিংকস পান করছিল। ওয়েটার হরদম সেখানে আসা-যাওয়া করছে। শাদাব একজনকে ডেকে দু’কাপ কফি চাইল। একটাতে চিনি ছাড়া ও অন্যটাতে চিনসহ কফি দিতে বলল। মাহদিয়ার দিকে না তাকিয়েই স্বাভাবিকভাবে চেয়ারে বসে থেকে বলল,

-‘মেডিক্যালে অ্যাডমিশন নেয়ার পরও দিনদিন অনেকটা মোটা হয়ে যাচ্ছিলাম। প্রায় দেড়শো কেজি ওজন হয়ে গিয়েছিল। এত বেশি মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতাম যে, নিজের খাওয়ার ওপর কোনো কন্ট্রোলই ছিল না। ক্লাসে, ক্যাম্পাসে বন্ধুরা সবাই মজা নিতে শুরু করল। হরদম আমাকে নিয়ে বডিশেমিং শুরু হলো। মানুষের এসব কানাঘুঁষাতে বড্ড বিরক্ত হতে লাগলাম। জেদ চাপল মাথায়। ডায়েট চার্ট ম্যানটেইন করা শুরু করলাম। মিষ্টিজাতীয় খাবার-দাবার সম্পূর্ণ ত্যাগ করলাম। চা-কফি যা-ই খাই, লিমিট মেপে। এরপর ধীরেধীরে ওজনকে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে আজকের এই আমি। এইতো…।’

মাহদিয়া শোনে গেল। মাঝখানে কোনো কথা বলল না। তবে একটা মানুষের ভেতরের দুঃখ আন্দাজ করতে পারল। কিছু কটু কথা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে আসতে পারে। অবশ্য এতে শাদাবেরই ভালো হয়েছে। অতিরিক্ত মোটা হওয়া সু-স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট ক্ষতিকর। ওজনটা ঠিকঠাক থাকলে, খাবার-দাবার নিয়ম মেনে খেলে শরীরে রোগজীবাণু বাসা বাঁধবে কম। খারাপ লাগল এইভেবে যে, নিজেকে এই রূপে ফিরিয়ে আনতে, শাদাব নিজের পছন্দের খাবার ছেড়ে দিয়েছে। সে নিজেও শাদাবকে মোটা হওয়া নিয়ে কথা শোনাত একসময়। বার বার তার মোটকু চেহারা নিয়ে তাকে খোঁচাখুঁচি করত। নিজের এই বোকা বোকা ব্যবহারের কথা মনে হওয়াতেই অস্বস্তি বাড়তে লাগল মাহদিয়ার। মুখ নামিয়ে নিচুস্বরে বলল,

-‘স্যরি।’

কত-শত মার খাইয়েছিল মাহদিয়া তাকে একদিন! অথচ এরজন্য কখনও দুঃখিত হয়নি, স্যরিও বলেনি। আজ হঠাৎ কীসের জন্য স্যরি বলল মেয়েটা! সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাহদিয়া নরম গলায় বলল,

-‘একসময় আমিও তোমাকে মোটা হওয়া নিয়ে অনেক খোঁচাখুঁচি করেছি। তখন আসলে বুঝতাম না, কাউকে সরাসরি এসব বললে তার মনে খারাপ লাগা জন্ম নিতে পারে।’

-‘আমি এসব গায়ে মাখতাম না কখনও। সবসময় নিজের মতো করেই বাঁচবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু একটা সময় মনে হলো, আসলেই পরিবর্তন দরকার। নয়তো…।’

কিছু কারণে শাদাব চায়নি, মাহদিয়া তাকে দেখলে আর চিনতে পারুক। বডি শেমিং ব্যাপারটা তাকে যত কষ্ট দিচ্ছিল, তার থেকে বেশি কষ্ট ছিল এই মেয়েটার মুখোমুখি হওয়া নিয়ে! সেজন্য একটু একটু করে নিজের মধ্যে থাকা পুরনো সেই শাদাবকে ধীরে ধীরে বিলীন করে দিতে চাইছিল সে। মন ও মস্তিষ্ক কখনওই চায়নি, কোনোদিন কোনো পরিস্থিতিতে মাহদিয়ার মুখোমুখি দাঁড়াক। নিয়তি যে দু’জনকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়, সেটা অনেক আগেই বোঝা হয়ে গিয়েছিল তার। সমস্ত চেষ্টা ও অধিকারবোধকে গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছিল। কে জানত, এই সময়টা জীবনে আসবে! মাহদিয়া তার সামনে আসবে! এমন একটা মুহূর্তকে সরাসরি গ্রহণ করতে হবে! এইসব কিছুই তো অবিশ্বাস্য, অনাকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন, তবুও যে বাস্তব, সত্য সেটা এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।

কথা বলতে গিয়ে বার বার বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছিল শাদাব। মাহদিয়া পাশে থেকে তা লক্ষ্য করছিল। ওয়েটার কফি নিয়ে আসলে তার হাতে কফির কাপ তুলে দিল শাদাব। নিজের দিকটা আর বলবার আগ্রহ পেল না। এড়িয়েই গেল। কথা ঘুরাতে জানতে চাইল,

-‘তারপর, কী সিদ্ধান্ত নিলে? পড়াশোনা শেষ?’

মাহদিয়া কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
-‘হ্যাঁ! গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। আর এগোতে ইচ্ছে করছে না। তবে ইতালি ব্যাক করলে, পূণরায় ভাবতে পারি কিছু।’

-‘খুব ভালো সিদ্ধান্ত।’

আর কোনো কথা খুঁজে পেল না শাদাব। জানবার আর কিচ্ছু নেই। নিঃশব্দের এই সময়টা দু’জনেই কফির কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে রাখল। নীরবতার এই মুহূর্তটুকু ভালো লাগছিল না মাহদিয়ার। একটা সময় বলল,

-‘আন্টি কেমন আছেন?’

-‘ভালো।’

ছোট্ট শব্দে জবাব দিল শাদাব। মাহদিয়া উশখুশ মেজাজে বসে রইল। আর কী জিজ্ঞেস করা যায়, ভাবতে লাগল। সরাসরি বলতেও পারছে না, সম্পর্ক নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নিল! সে নিজেই কয়েকঘণ্টা আগে উল্টাপাল্টা আচরণ করেছে। এখন আবার এই নিয়ে আলাপ তুলতেও বাঁধছে। অনেক সময় বসে থেকে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন মনে সাজিয়ে নিল মাহদিয়া। ধীরস্থির গলায় প্রথম প্রশ্ন করল,

-‘শিহাবের জন্ম কবে?’

ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরাল শাদাব। বিস্ময়ভরা চোখে মাহদিয়াকে দেখল। উত্তরের আশায় মাহদিয়াও চেয়ে আছে তার চোখের পানে। মনের ভেতর অসংখ্য প্রশ্ন কুণ্ডলী পাকিয়ে এক হয়ে যেতে লাগত তার। সে কণ্ঠে বিস্ময় নিয়েই বলল,

-‘ওর জন্ম কবে তুমি জানো না?’

মাহদিয়ার দৃষ্টি থমকে গেল। স্থির হয়ে বসে রইল নিজের জায়গায়। পরক্ষণেই শাদাবের প্রশ্ন বুঝে নড়েচড়ে বসে নিজের দিকে আঙুল রেখে বলল,

-‘আমার জানার কথা ছিল? আমি তো জানি-ই না আন্টি কেন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন! কেউ কিছু বলেনি আমায়। দেশে ফেরার পর ছোটো মামার মুখ থেকে শুনলাম।’

অস্ফুটস্বরে ‘ও মাই গড’ উচ্চারণ করল শাদাব। এই মেয়ে তাহলে কিচ্ছু জানে না। এখন আর কী বলবে সে? যা-ই বলবে, মাহদিয়া সব অবিশ্বাস্য ভাববে। মিথ্যে ভাববে। ভাববে সে, মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে তারজন্য ফাঁদ তৈরী করছে। কিন্তু এত বড়ো সত্যি তো মাহদিয়ার অনেক বছর আগেই জানার কথা! কেন কেউ তাকে কিচ্ছু জানাল না? এই সম্পর্কে যে বিশ্বাসের ছিঁটেফোঁটাও নেই। কঠিন এই সত্যিই তার মুখ থেকে শোনে কোনোভাবেই বিশ্বাস করবে না মাহদিয়া। এমনিতেই কথা না রাখার অপরাধে তাকে মিথ্যুক, স্বার্থপর, কতকিছু উপাধি দিয়ে দিয়েছে। এখন এসব বললে তো নির্ঘাত চরম লেভেলের খারাপ ও লোভী ভেবে বসবে! নিজেকে এমন একটা কঠিন মুহূর্তের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতে গিয়ে ধীরে ধীরে চেহারার উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলল শাদাব। কপালের একপাশের রগ ফুলে ফুলে উঠল। রেগে গেলে ঠিক কতটা ভয়ানক সে হয়, সেটা শুধু সায়রা করীম ভালো জানেন। আর কেউ তার রাগী ও ভয়ঙ্কর রূপ সরাসরি দেখেনি। হাতে থাকা কফির কাপটাকে এমনভাবে চেপে ধরল, যেন হাতের এই কঠিন আক্রমণেই কাপটা ভেবগে গুড়িয়ে যাবে। আচমকা এমন দৃশ্য দেখে ভরকাল মাহদিয়া। হুট করে এত রেগে গেল কেন মানুষটা! ঢোক গিলে ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ নিয়ে বলল,

-‘কী হয়েছে?’

-‘কিছু না।’

মাহদিয়া ভয়মিশ্রিত গলায় আবারও বলল,
-‘তুমি ঠিক আছো?’

-‘হ্যাঁ!’

মাহদিয়ার গলার পরপর আওয়াজ পেয়েই স্বাভাবিক হলো শাদাব। এই মুহূর্তে রেগে গেলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। মাহদিয়া কিছুই জানে না, তাই দোষটাও তার নয়। ঝটপট নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ কফির কাপে চুমুক দিল শাদাব। মাহদিয়া এবার দ্বিগুণ ভয় পেল। এমন অদ্ভুত আচরণের মানুষ সে আর দেখেনি। এক্ষুণি রেগে গিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলছিল ছেলেটা! কার ওপর যে রাগটা পড়ত কে জানে! এরমধ্যেই এত স্বাভাবিক কী করে হলো? তবুও এই স্বাভাবিক রূপটাই বড্ড অস্বাভাবিক লাগল তার কাছে। মনের ভেতর যত প্রশ্ন জমা করে রেখেছিল, ভুলে যেতে লাগল সে। তাকে এমন থমথমে মুখে বসে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাদাব। বলল,

-‘কিছু বলতে এসেছিলে?’

মনে ভয় নিয়েই উপরনিচ মাথা নাড়ল মাহদিয়া। শাদাব বলল,
-‘কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি রুমে যাও। তোমার পর্যাপ্ত বিশ্রামের দরকার।’

অনেক কষ্টে মনে একটুখানি সাহস সঞ্চয় করল মাহদিয়া। যেভাবে কথাগুলো ভেবেছিল, সাজিয়েছিল, সেভাবে বলতে পারল না, তা-ও গলায় জোর এনে বলল,

-‘হঠাৎ করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলে তুমি। আমি বাবা-মাকে বার বার জিজ্ঞেস করতাম, দেশ থেকে কেউ কল করছে কি-না। কেউ কোনো উত্তর দিতেন না। এভাবে ফোনের অপেক্ষায় মাসের পর মাস কেটে গেল। একদিন মা বললেন, আন্টি ও তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছ। কোথায় আছো, কেমন আছো, কেউ কিচ্ছু জানে না। রোজ একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমি। এইবুঝি ফোন এলো। ওপাশ থেকে কেউ জিজ্ঞেস করল, ‘এ্যাই তুমি চুল কেন স্ট্রেইট কোরো না? দ্যাখতে ভালো লাগে না।’ কতবার, কতদিন, কত মুহূর্ত যে অপেক্ষায় অপেক্ষায় কেটেছে, সেটা শুধু আমি-ই জানি। তখনও আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কিচ্ছু ভাবিনী, কিন্তু তোমার সাথে কথা বলা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সেই অভ্যাসটা ত্যাগ করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার। মানতেই পারছিলাম না, তুমি বাড়িতে নেই। বয়সটা এতই কম ছিল যে, দেশে একা ছুটে আসব সে-ই সাহসটুকুও ছিল না। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে যায়, আমি অপেক্ষায় থাকি, কখন একটু বড়ো হব। কখন বুঝতে শিখব। কখন একা দেশে ফিরতে পারব। কখন নিজের জীবন নিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারব। কিন্তু বড়ো হওয়া যে এত ধৈর্যের ও কষ্টের বুঝতে পারিনি। শেষমেশ আমিও বড়ো হলাম। বুঝতে শিখলাম। সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ভাবতে গিয়ে একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি আমি। এইযে, আমাদের মধ্যে একটা নামহীন সম্পর্ক ছিল, এই সম্পর্কের বিশ্বস্ত কোনো খুঁটি ছিল না। আমাদের সম্পর্কটা শুধু কাগজ ও কলমে। মনের ভেতর এর কোনো প্রভাব পড়েনি কোনোদিন। কিন্তু তবুও, আমি এই সম্পর্কটাকে অস্বীকার করতে পারছিলাম না। বড়ো হওয়ার পর যখন, চারপাশ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করল, পরপুরুষের নজর থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াল, তখন আশ্চর্যজনকভাবে আমি প্রত্যেকটা পুরুষকে আটকাতে পেরেছি কেবল একটা বাক্য দিয়ে। যখন আমি মুখ দিয়ে বলতাম, ‘স্যরি, আ’ম এ্যানগেজড’ তখন বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে থাকা অদৃশ্য একটা টান অনুভব করতাম। ওই টানটাই আমাকে স্বস্তি দিত, শান্তি দিত। দিনশেষে আমি নিরাপদ থাকতে পারতাম। কিন্তু এখন, তোমাকে দেখে, তোমার সামনে বসেও আমি সেই টানটা অনুভব করতে পারছি না। কেন বলতে পারো?’

মাহদিয়া আরও কিছু বলতে চাইছিল। এত কথা বলে ছোট্ট একটা প্রশ্নই আবার শাদাবের দিকে ছুঁড়ে দিল সে। মনে মনে বিড়বিড় করল, ‘সাতদিনের পরিচয়ে যে শাদাবকে আমি আমার জীবনে পেয়েছিলাম, দীর্ঘ বছরের বিচ্ছেদে সে পুরোটাই হারিয়ে গেছে।’ শাদাব পাশে থেকেও তার মনের কথা শুনল না। গভীর মনোযোগ দিয়ে মাহদিয়ার অন্য কথাগুলো শুনল। বুঝল। বলল,

-‘কারণ আমাদের মধ্যে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভরসার অভাব আছে। সম্পর্কে টান এমনি এমনি আসে না। বিশ্বাস থেকে আসে। একটা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বিশ্বাস। আমাদের সম্পর্কে সেই বিশ্বাসটারই অভাব। এই কারণেই আমরা কাছে থেকেও দূরে।’

গভীর করে শ্বাস টেনে নিজের মনের ভারটুকু লাঘব করার চেষ্টা করল মাহদিয়া। সম্পর্কে বিশ্বাস নেই! এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে তার। কেন যেন শাদাবের এই কথা সে মেনে নিতে পারল না। কণ্ঠে কিছুটা জেদ ও অভিমান মিশিয়ে বলল,

-‘বিশ্বাস গড়ে তুলতে দু’জন দু’জনকে চেনা জরুরী ছিল। আমি নাহয় অবুঝ ছিলাম, তাই সম্পর্ককে কীভাবে আগলে রাখতে হয়, বুঝিনি। তুমি তো বুঝতে। তুমি কীভাবে জেনে-বুঝে দূরত্ব টেনে আনলে? বিশ্বাস স্থাপনের জন্য দু’জনার নিত্য আলাপ হওয়াটা জরুরী ছিল না? নিজে যোগাযোগ বন্ধ রেখে এখন বিশ্বাস খুঁজতে চাইছ!’

এমন অভিমানী কথা শোনে মুচকি হাসল শাদাব। বলল,
-‘তুমি এত নিশ্চিত কীভাবে, আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি? তোমার কী ধারণা, সম্পর্ক নিয়ে তুমি শুধু একাই ভোগান্তিতে পড়েছ, আমি পড়িনি?’

মাহদিয়া কথা বুঝল না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। শাদাব পূণরায় বলল,
-‘এই সম্পর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যতটুকু চেষ্টা আমি একা করেছি, তার এককোণাও তুমি কোরোনি। কে বলেছে আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি? খোঁজ রেখেছ কিছুর? রাখোনি! আজ এতগুলো বছর পর এসে জানতে চাইছ, যোগাযোগ কেন বন্ধ করেছি! হাস্যকর।’

শাদাবের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারল না মাহদিয়া। স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
-‘কী বলছ তুমি এসব? কীসের খোঁজ রাখব আমি? কার কাছ থেকে রাখব?’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শাদাব। কফির কাপ চেয়ারে রেখে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে পুলসাইডে হাঁটতে শুরু করল। মাহদিয়ার প্রশ্ন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ তার এই হাঁটাহাঁটি দেখল মাহদিয়া। অসহ্য লাগল। বিরক্তি ধরে এলো। দুঃশ্চিন্তায় শরীর মন ভেঙে আসতে লাগল। তা-ও উত্তরের জন্য শাদাবের দিকেই কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাখল সে। শাদাব সেই দৃষ্টিকে ভয় পেল না। উলটে মাথা নাড়িয়ে হাসল। বলল,

-‘যেদিন বিশ্বাস জন্মাবে সেদিন উত্তর জানতে এসো। এর আগে আমি তোমাকে যা-ই বলব, তারজন্য তুমি আমাকে একশোটা খারাপ গালি শোনাবে।’

মাহদিয়ার রাগ বাড়ল। সে কিটকট থেকে উঠে এক’পা এক’পা করে শাদাবের দিকে এগোল। পা টেনে টেনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চোখমুখ শক্ত করে হাত বাড়িয়ে তার কলার টেনে ধরল। বলল,

-‘নিজেকে কী ভাবো তুমি? সিনেমার নায়ক? খুব বেশি ভাব বেড়ে গিয়েছে! আমার সাথে এত বাহাদুরি দ্যাখাতে এসো না। এই মাহদিয়া তোমার গলায় ঝুলতে আসেনি। এসেছে মুক্তি নিতে।’

শাদাব চারপাশে তাকাল। অনেক কাপল থাকলেও সবার দৃষ্টি এদিকে নেই। প্রত্যেকেই নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। সে আলগোছে কলার থেকে মাহদিয়ার হাত সরিয়ে আনল। বলল,

-‘ডিভোর্স চাও তো, দূরে দূরে থাকো। বার বার কাছে আসছ কেন?’

চোখ কটমট করে তাকাল মাহদিয়া। শাদাব শব্দ করে হাসল। বলল,
-‘রুমে যাও। বিশ্রাম নাও। এসব কথা জানা এত জরুরী নয়। তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো। আমাকে এই ক’টাদিন সময় দাও। বাড়ি ফিরে কোর্টে গিয়ে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে দেব। মাত্র তিনদিন সময় চাইছি তোমার কাছে। এরপরই তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে।’

***

চলবে…

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — পনেরো

সকালের নাশতা করতে নিচে এসেছে মাহদিয়া। পায়ে ব্যথা থাকায় ঘুম ভেঙেছে দেরীতে। রাতে সামান্য জ্বর আসলেও সেটা তাকে খুব একটা দুর্বল করতে পারেনি। মাঝরাতে এপাশ-ওপাশ করলেও শেষরাতে গভীরঘুমে ঢলে পড়েছিল। লম্বা ঘুমে ভোর হলো তার ঠিক সাড়ে নয়টায়। এরমধ্যে হায়দার সাহেব তাকে অনেকবার কল করেছেন, ম্যাসেজ করেছেন। শাদাবও তাকে ফোন করেছে। রুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে নিজের লিমিট ও সীমা-পরিসীমা দেখে ফিরে এসেছে। চাচা-ভাতিজা তিনজনে একসাথে সকালের নাশতা শেষ করেছেন, এরপরই মাহদিয়ার আগমন ঘটল সেখানে। অতিরিক্ত ঘুমের দরুন মাহদিয়ার চোখগুলো ফুলে ঢোল হয়ে আছে। দীঘল কালো লম্বা পাপড়ির আবরণে থাকা বাদামী চোখের চারপাশটা লালচে রং ধারণ করেছে। চোখের পাতায় হাতের দুটো আঙুলের সাহায্যে অল্প ম্যাসাজ করে খালি একটা চেয়ারে বসল মাহদিয়া। বসেও স্বস্তি পাচ্ছিল না সে। একাধারে চোখে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল। শাদাব তার এই অস্বস্তি ভাব দেখেও বেখেয়ালি হওয়ার ভান ধরে বসে রইল। হায়দার সাহেব বললেন,

-‘চোখে আবার কী হলো?’

হাত সরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে তাকাবার চেষ্টা করল মাহদিয়া। চোখ জ্বলছে, চুলকাচ্ছে আবার পানি জমছে। এরমধ্যেই চোখ মারাত্মক ফুলে গেছে। হায়দার সাহেব আঁৎকে উঠে বললেন,

-‘সর্বনাশ। তোর চোখে কি এলার্জি আছে?’

মাহদিয়া মাথা নাড়ল। কুর্তির লম্বা হাত কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে দুটো হাতের কবজিসহ দেখালো। সম্পূর্ণ হাতেই চাকা চাকা দাগ হয়ে ফুলে গিয়েছে। মারাত্মকভাবে চুলকাচ্ছে পুরো হাতে। নিজের শরীরের এই অবস্থা দেখে চোখ পাকিয়ে শাদাবের দিকে তাকাল মাহদিয়া। ঠোঁট বাঁকিয়ে কপট রাগের সাথে বলল,

-‘রাতের খাবারে গোরুর গোশত দিতে বলেছিলে?’

ভেজালটা কোথা থেকে শুরু হয়েছে, সেটা বুঝতে পেরেই অসহায় অবস্থায় পড়ে গেল শাদাব। সে তো জানত না এই মেয়েটার এলার্জির কথা। জানলে কি আর গোরুর গোশত অর্ডার করত? পান্তাভাত আর মরিচপোড়া খাওয়াত। জেনে-বুঝে যেহেতু এই কাজ করেনি, সেহেতু নিজের দিক পরিষ্কার করা দরকার। সে সারেন্ডারের ভঙ্গিতে হাত উপরে তুলে বলল,

-‘তোমার অ্যালার্জি আছে এটা আমি জানতাম না। খাওয়ার সময় একটু দ্যাখেশোনে খাবে না? বেহুঁশের মতো খেয়েছ না-কি, কী খাচ্ছ, না খাচ্ছ, টের পেলে না?’

মেজাজ এমনিতেই গরম ছিল মাহদিয়ার। মাথার মধ্যে কেউ যেন আগুন ঢেলে দিয়েছে। শাদাবের কথা শোনে দপ করে সেই আগুন দিগুণ বিস্তৃত হলো। সে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,

-‘খাবার অর্ডার করার আগে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে! এতবেশি আদিখ্যেতা দ্যাখাতে কে বলেছে তোমায়?’

শাদাব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চেয়ার টেনে এগিয়ে আসলো মাহদিয়ার দিকে। দু’হাত ধরে ভালোমতো এপিঠ-ওপিঠ ও চোখ চেক করে বলল,

-‘রোগের দায়ভার যখন আমার, ট্রিটমেন্টও আমি দিচ্ছি।’

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল মাহদিয়া। একবার এই অ্যালার্জি হলে সহজে ভালো হতে চায় না। ইতালিতে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে। হরদম কি আর ঔষধ চালিয়ে যাওয়া যায়? একটু শান্তিতে তো জীবন কাটানো উচিত। ঔষধপত্র বরাবরই দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে মাহদিয়া। এসব গিলতে তার ভালো লাগে না। নিজেকে বারোমাসি রোগী মনে হয়। এই কারণে বার বার এমন বিপদের হাত থেকে বাঁচতে সব ধরনের অ্যালার্জিযুক্ত খাবার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে। যা কিছুতে অ্যালার্জি আছে, সেসব এড়িয়েই চলে। কিন্তু গতকাল অসুস্থ থাকায়, পেটে ক্ষিধে থাকায়, খাওয়ার সময় খেয়াল ছিল না কী খাচ্ছে! তাছাড়া, খাবারটা এত সুস্বাদু ছিল যে, পেট ভরেই খেয়ে নিয়েছিল। ফলস্বরূপ আজকের এই ফোলা ফোলা চেহারার মাহদিয়া। এই চেহারা নিয়ে বাইরে আসতেও অস্বস্তি হচ্ছিল তার, কিন্তু শাদাবকে রাগ দেখাতেই নিচে আসা। ঘাড়ের ওপর বিপদ চাপিয়ে দিয়ে এখন আসছে সেবাযত্নের বহর দেখাতে। এসব সেবাযত্নে সে মোটেও গলে গেল না। উলটে রাগ তার শিরা-উপশিরায় নেচে নেচে উঠল। চোখমুখ শক্ত করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

-‘হয়েছে থাক্। আর ট্রিটমেন্ট দিতে হবে না। নিজের সমস্যার সমাধান আমি নিজেই খুঁজে নিতে পারব।’

মাহদিয়ার কথায় কান দিল না শাদাব। রিসোর্টের একজন কর্মচারীকে ডেকে ইমার্জেন্সি কিছু ঔষধ, চোখের ড্রপ ও অ্যালার্জির মলম নিয়ে আসতে বলল। মাহদিয়া মাঝখানে আর কোনো কথা বলল না। তার কিছু ভালো লাগছে না। কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না। একদিকে পায়েও সমস্যা, এখন আবার হাত ও চোখ। বিপদ বোধহয় তার সামনে এসে নাচানাচি করছিল। সুযোগ পেয়েই একেবারে কোলে চড়ে গেছে এখন। ঘুরতে এসে এমন বাজে অভিজ্ঞতা হবে জানলে, ঘর ছেড়ে বের হতো না। এসেছিল শান্তির জন্য, স্বস্তির জন্য। চব্বিশ ঘণ্টা পেরোবার আগেই সব শান্তি অশান্তিতে রূপ নিল তার। জীবনে মানুষ কেন যে সম্পর্কে বাঁধা পড়ে! একটা সম্পর্ক গড়া যেমন কঠিন, ভাঙাও কঠিন। মনের ওপর আর জোর দিতে পারছে না। ক্রমশ তার চারপাশটা অসহ্যকর পরিবেশে রূপ নিচ্ছে। কিচ্ছু ঠিক ছিল না জীবনে। হাসি-আনন্দ যা ছিল, একটা কঠিন সত্যের কাছে সেটাও হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে গিয়েছে। বিয়ে, বন্ধন, ভালোবাসা এসব জীবনে না আসলেই বোধহয় একটা মানুষ সুখী থাকে। কার ভাবনা কেমন, জানে না মাহদিয়া। শুধু জানে যে কঠিন সত্যের মুখোমুখি সে দাঁড়িয়ে আছে, নিয়তি তাকে যে সত্যকে সামনে এনে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস তার নেই। কিন্তু হুট করে গ্রহণ করে নিবে, এই নিয়েও সৎ সাহসের অভাব টের পাচ্ছে সে। একটা মানুষকে পুরোপুরি না জেনে হয়তো বিচ্ছেদ টেনে দেয়া যায়, কিন্তু পুরোপুরি না জেনে তাকে গ্রহণ করা যায় না। এই কয়েকঘণ্টায় শাদাবকে সে পুরোটা বুঝতে না পারলেও, অল্প একটু যা বুঝেছে, তাতে নিশ্চিত হতে পেরেছে, তাদের সম্পর্কে কোথাও কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি আছে। খোলা চোখে যা সে দেখতে পাচ্ছে না, ধরতে পারছে না, উপলব্ধিও করতে পারছে না। যার কারণে, সম্পর্ক থেকে বার বার মুক্তি চাইছে। যেকোনো সম্পর্ক থেকে মুক্তি নেয়া কি এত সহজ? চাইলেই কি মানুষ মুক্তি পায়? অস্বীকার করতে পারে সম্পর্ককে? যদি এমন হতো, তবে পৃথিবীর সব সম্পর্ককে মানুষ নির্দ্বিধায় অস্বীকার করে যেত।

শাদাবের সাথে একান্তই কিছু কথা বলা জরুরী মনে করল মাহদিয়া। কিন্তু শিহাবের কারণে তা হয়ে উঠল না। একটু ফাঁক পেলে হয়তো বিস্তারিত আলোচনায় নামা যেত। গতকাল রাতেও চেয়েছিল কথা বলতে। কিন্তু কোথা থেকে যেন ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে গেল। বলা তো হলোই না, মনের অশান্তিও দূর করা গেল না। এখন আবার জনসম্মুখে ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনায় যাওয়ার মতো রুচি হচ্ছে না। সবমিলিয়ে বড্ড পেরেশানিতে পড়েছে মাহদিয়া। তবে নিজের হাবভাব ও কথাবার্তায় সেসব বুঝতে দিল না। শান্ত মেয়ের মতো নাশতা শেষ করল। কর্মচারী ঔষধ নিয়ে আসলে সেগুলো বিনাবাক্যে খেয়ে নিল। রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। সমাধান খুঁজতে হবে। এই ভাবনা মনে উদয় হওয়া মাত্রই শাদাবের দেয়া ফ্রি ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিল সে। নাশতা খাওয়ার ফাঁকেই পায়ের ব্যান্ডেজ পালটে দিয়েছে শাদাব। মাহদিয়া নীরবে সেটা লক্ষ্য করেছে। বুঝার চেষ্টা করেছে, শুধু অপরাধবোধ কমানোর জন্য এই সেবাশুশ্রূষা না-কি অন্যকিছু! গতরাতে শাদাব বলেছিল, সম্পর্কটা বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল সে। কতটুকু চেষ্টা ছিল, সেটা বলেনি। এড়িয়ে গিয়েছে। এই এড়িয়ে যাওয়ার কারণটা যেদিন জানতে পারবে সেদিন সে-ও বুঝে যাবে আজকের এই সেবাযত্ন শুধু দায়িত্ব-কর্তব্যের খাতিরে করেছে না-কি মনের টান ও সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থেকে করেছে! আসলে এই ছেলের মনে কী চলছে! ইশ্, সে যদি মন পড়তে জানত! আফসোস ঝরে পড়ল কণ্ঠস্বর থেকে। ব্যান্ডেজ বেঁধে চোখ তুলে উপরের দিকে দৃষ্টি দিল শাদাব। স্থির, অবিচল, শান্ত, স্বচ্ছ দৃষ্টি। রাতের বেলা তারার ঝিকিমিকিতে যে দু’চোখে অপার মায়া টের পেয়েছিল, আজ দিনের বেলা সূর্যের কিরণে সেই দু’চোখে কাঠিন্যতা দেখেও ভরকাল না মেয়েটা। শান্ত চোখে চেয়ে থাকল। সামান্য বিব্রত হলো না, বিচলিতও হলো না। তাকিয়েই রইল। শাদাব নিজেই বিব্রত হলো। অমন গভীর চোখের ভাষার মায়ায় সে বেশিক্ষণ ডুবতে চাইল না। চোখ ফিরিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসল। মাহদিয়া মনে মনে হাসল। ওই কঠিন চোখের ভাষা সে না বুঝলেও বিড়বিড় করল,

-‘যে দু’চোখে আমি অন্য সবকিছুর জন্য উপচেপড়া মায়া-মমতা ও কোমলতা দ্যাখেছি, সে দু’চোখে নিজের জন্য কেন এত কঠোরতা দ্যাখতে পাচ্ছি!’

গালে হাত দিয়ে প্রথমে এই দু’জনার কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল শিহাব। কালও মাহদিয়া তার ভাইকে আপনি আপনি সম্বোধন করেছে। টুরিস্ট গাইড হিসেবে দূরে দূরে রেখেছে। শাদাবও ঠিক একইভাবে কথা বলেছে। নিজের লিমিট বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু আজ এদের মাঝ থেকে আপনি-আজ্ঞে দূরে গিয়ে সরাসরি তুমি চলছে। সেইসাথে রাগ তো আছেই। এই দু’জনের কথাবার্তা ও সম্পর্কের মধ্যে থাকা জটিল হিসাবটা মিলাতে পারছে না সে। একবার ভাইকে দেখছে আরেকবার মাহদিয়াকে। তাদের কথাবার্তাতে স্পষ্ট, তারা পূর্বপরিচিত। কিন্তু তার ঢিলে মাথায় এসব সূত্র কোনোভাবেই সমাধান খুঁজে এনে দিচ্ছে না। সে ভাবুক নয়নে তাকাতে তাকাতে একসময় অধৈর্য হয়ে বলল,

-‘নিউটনের মাথায় আপেল পড়াতে তিনি কঠিন কঠিন সূত্র ও সমাধান আবিষ্কার করে আমাদের মতো বাচ্চাদের মাথায় চাপ সৃষ্টি করেছেন। তবে কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, আমার মাথায়ও যদি একটা আপেল পড়ত, তবে নিশ্চয়ই তোমাদের দু’জনার মাঝখানে থাকা সমস্ত সূত্রের প্যাঁচ খুলে ফেলতাম।’

শিহাবের গভীর চিন্তাভাবনা ও কথাবলার ধরন দেখে চিন্তিত মন নিয়েই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মাহদিয়া। আজ তার মুখে মাস্ক নেই। তবে স্কার্ফের সাহায্যে মুখটা আগলে রাখা। মুখের ফোলা ফোলা ভাব ও নিজেকে আড়াল রাখার যে ক্ষুদ্র চেষ্টা থাকে, সেটা তখনও বিদ্যমান ছিল। তবে চেহারার মাঝে অস্বস্তি ভাব নেই একটুও। চারপাশের দিকে নজরও নেই। কেমন যেন নিশ্চিত মনে হচ্ছিল তাকে। কেউ তাকে দেখছে কি-না, এই নিয়েও দুঃশ্চিতার ভাঁজ ফুটে উঠেনি কপালে। স্নিগ্ধ, সুন্দর ও ঝলমলে রোদের মতোই হাসি ছিল তার। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল সে। এত অসুস্থতার মাঝেও শিহাবের বলা কথা যেন একটুখানি মনের জোর ও শক্তি হয়ে উঠেছিল। ভুবনভুলানো হাসি দিয়ে ভুলেই গিয়েছিল, কেউ তার দিকে তাকাতে পারে। যখন একজোড়া নিষ্পলক চোখের বিস্ময়মাখা মুখে নজর গেল তার, তখন হাসি আরও বিস্তৃত হলো। ভ্রু নাচিয়ে শাদাবকে বিব্রত করতে চাইল। শাদাব কড়া চোখে তাকালে সে-ও মুখ ভেংচি কাটল। ওই কড়া চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,

-‘ছোটোন, নিউটনের মতো তোমার মাথায় আপেল না পড়লেও আমাদের মধ্যে থাকা জটিল সূত্রের প্যাঁচ তুমি খুলতে পারবে। যদি তোমার ভাইকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন কোরো।’

শিহাব কৌতূহলী চোখে তাকাল। হায়দার সাহেব এদের ঝগড়া, হাসি-আনন্দের মাঝে নীরব শ্রোতা হয়ে থাকতে থাকতে একসময় চলে গেলেন। মাহদিয়া ফাঁক পেয়ে শিহাবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

-‘তুমি তোমার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস কোরো, আমি তার কী হই!’

আগ্রহী হয়ে উঠল শিহাব। ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘তোমরা কি পূর্বপরিচিত?’

মাহদিয়া জবাব দিল না। ইশারায় শাদাবের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়তে বলল। শিহাবও নড়েচড়ে বসে গম্ভীর মেজাজে বলল,
-‘ভাইয়া, একটা কথার ঠিকঠাক উত্তর দাও তো!’

দু’জনের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না শাদাব। ফিসফিস কথাও কানে আসেনি তার। তবে ঝামেলা যে একটা বাঁধবে সেটা ঠিকই বুঝে গিয়েছে। সে প্রশ্ন শোনবার জন্য কান পেতে রইল। দু’হাতের ফাঁকে ফোন রেখে নিউজফিড স্ক্রল করতে করতেই বলল,

-‘আগে প্রশ্ন শুনি, তারপর ভেবে উত্তর দিব।’

যেকোনো প্রশ্নের উত্তর তার তাৎক্ষণিক চাই। নাহলে মস্তিষ্কে চাপ দিতে দিতে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই এমন কোনো প্রশ্ন সে মনে ঠাঁই দেয় না, যা তার অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এইমুহূর্তের প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারছিল না দেখে উত্তর জানতে উঠেপড়ে লাগল শিহাব। সুযোগ পেয়ে ঝটপট বলল,

-‘তুমি দিয়াপিকে আগে থেকে চিনো? সম্পর্কে কী হয় আপি তোমার? গতকাল অবধি তুমি আপির টুরিস্ট গাইড ছিলে। আজ পারসোনাল ডক্টর হয়ে গিয়েছ। একদিনে কেউ কারও এত চেনা হয়! তাছাড়া, তুমি গতকাল আপিকে ‘ভ্রমর’ বলে ডেকেছিলে!’

মাহদিয়া শুধু শাদাবের মুখ থেকে একটা কথা জানতে চেয়েছিল, এইজন্য শিহাবকে এইভাবে বলা। কিন্তু এই ছেলেটা যে সবকিছু খেয়াল করেছে, সেটা এতক্ষণেও মাথায় আসেনি তার। একটা প্রশ্নের বদলে কতকিছু বলে ফেলল অবুঝ বাচ্চাটা। মনের ভেতর প্রশ্ন না জাগলে, সন্দেহ তৈরী না হলে, এতসব কিছু সে নোটিশ করতও না। উত্তর শোনার জন্য অধৈর্য্য হয়ে উঠল মাহদিয়া। শিহাবের মতো সে-ও স্থির চোখে শাদাবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। শাদাব প্রশ্ন শোনে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে কপালে হাত রেখে নিজের মেজাজকে সামলাতে লাগল। চেয়েছিল মাহদিয়াকে একা ফেইস করতে। কিন্তু হচ্ছে না। সবকিছু শিহাবের চোখে পড়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এখন বড্ড লজ্জার হয়ে দাঁড়াল। সে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলল,

-‘তুমি ঠিকই ভেবেছ, আমরা পূর্বপরিচিত। তবে আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। বহু বছর আগে তোমার দিয়াপিকে একটা জায়গায় দেখেছিলাম, সেখান থেকেই পরিচয়। এইটুকুই।’

‘ওহ’ বলে ঠোঁট গোল করে মাথা নাড়ল শিহাব। পরক্ষণেই বলল,
-‘আর ‘ভ্রমর’ সেটা!’

-‘তোমার দিয়াপি সবসময় কোঁকড়াচুলকে এলোমেলো করে রাখত। এখনও রাখে। দ্যাখলেই মনে হোতো কোনো এক কীটপতঙ্গ কিংবা পোকামাকড়ের কথা। যার কারণে তাকে আমার নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে হোতো না। তবে সেদিন তাকে ফুলের বাগানের কাছে দেখে মনে হয়েছিল, একটা মৌমাছি ফুলের ওপর বসে বসে মধু সংগ্রহ করছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, ‘ভ্রমর’। আর কিছু নয়। আমি আসলে ও’কে রাগানোর জন্য ‘ভ্রমর’ বলে ডাকি। তবে এখন থেকে আর ডাকব না।’

শাদাব নিজের মনের কথাগুলো বলেনি। সেদিন সে ভেবেছিল এক, আজ মুখে বলছে আরেক, একটু ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে, যেন মাহদিয়ার মনে আর কোনো অস্বস্তি না জন্মায়। এমনিতেই এই ডাক শুনলে মেয়েটা রেগে যায়, পিছনের ব্যাখ্যা যদি শোনে আরও রাগ করবে! তারচেয়ে থাক। কিছু মিথ্যে জেনেই দিন কাটুক। এতে যদি কারও মনে স্বস্তি ফিরে আসে। সে কথা শেষ করতেই দেখল শিহাব সন্তুষ্টির চোখে তাকিয়ে হাসছে। তবে মাহদিয়ার মুখের হাসি হারিয়ে গেছে। সব কথার মধ্যে একটা কথাই তার গায়ে লেগেছে খুব। দু’জনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। সে ভেবেছিল, শিহাবের সামনে অন্তত বলবে, ‘ও আমার স্ত্রী’। তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিল শাদাব। সম্পর্ক বাঁচাতে এই ছেলে কোনো চেষ্টাই করেনি। সব মিথ্যে বলেছে। মাহদিয়ার আহত চোখে মেঘ জমল। চোখ ভরে উঠল টলটলে পানিতে। সে চোখ ঘুরিয়ে মনকে মানিয়ে নিতে চাইল। আসলেই কোনো সম্পর্ক নেই আর! ছোট্ট একটা শব্দ ‘কবুল’, তারও জোর কমে আসছে বোধহয়। কী অদ্ভুত! এই সামান্য কথা শোনেই চোখ ও মনকে কন্ট্রোল করা দায় হয়ে পড়েছে। যখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, তখন কী হবে! সম্পর্কে ভালোবাসা নেই, বিশ্বাস নেই, ভরসাও নেই। এগিয়ে নেয়ার মতো কোনো সমাধানও তার জানা নেই। সে শুধু জানে, মুক্তি নিয়ে দূরে যেতে হবে তাকে। এই মুক্তি কি তাকে সুখ দিবে? স্বাধীন ও সুন্দর জীবন দিবে?

শিহাব আর কোনো প্রশ্ন করল না। সন্তুষ্টমনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মাহদিয়াকে বলল,
-‘আজকে ওফিং হিল যাচ্ছি। তুমি যাবে আমাদের সাথে?’

মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারল না মাহদিয়া। গলার সমস্ত শক্তি হারিয়ে গিয়েছে তার। সবগুলো যন্ত্রণা এসে তাকে শব্দহীন করে দিয়েছে। সে শুধু দু’দিকে মাথা নাড়ল। শিহাব সেই কথা অগ্রাহ্য করে বলল,

-‘চলে এসো না, প্লিজ। তুমি থাকলে অনেক আনন্দ করতে পারব। ভাইয়া আপাদমস্তক বোরিং একজন মানুষ। ছবিটবি তুলে না। হৈ-হুল্লোড় করে না। তার সাথে ট্যুরে আসলেও ঠিকঠাক জমে না।’

ভাইয়ের মুখে অভিযোগ শোনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল শাদাবের। জীবনের সব সুর, সব তাল, সব ছন্দ তার কবেই কেটে গেছে সেটা তো শুধু সে ও তার মন জানে। আর জানেন বিধাতা। এসব ট্যুর তাকে মনে শান্তি এনে দিলেও পুরোপুরি সুখ এনে দেয় না। সুখ যেখানে ছিল, সেখানে আজ চোখ ফেরানো, মন ডোবানো মানা। সে মন খারাপের সুরে বলল,

-‘আমার সাথে ট্যুর জমে না, এটা তো এতদিন বলোনি। আমি বরাবরই এমন, সেটা তুমি জানো। এসব নিয়ে আমার ওপর অভিযোগ থাকলে সেটা আমাকেই বোলো, বাইরের মানুষের সামনে বোলো না। কেমন?’

শিহাবের অবুঝ মন ভাইকে ব্যথা দিতে চায়নি। বাচ্চা মানুষ। তার তো এখন হেসেখেলে, আনন্দে বাঁচবার বয়সই। ট্যুর মানেই তো আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়। শাদাব তাকে সব জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায় ঠিকই, তবে ভাইকে সবসময়ই এসব ব্যাপারে শান্ত থাকতে দেখে দুঃখ পায় সে। কখনও সেভাবে বলা হয়ে উঠে না, ‘ভাইয়া, তুমিও আমার মতো ট্যুর ইনজয় কোরো।’ সাহস হয় না তার। আনন্দের মুহূর্তে কেউ মন খারাপ করে রাখছে, হৈচৈ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে, এসব দেখলেই তার মনটা বিষিয়ে যায়। মাহদিয়াকে পেয়ে গতকাল সে চমৎকার সময় কাটিয়েছিল। তাই ভেবেছিল, আজও সঙ্গে নিবে। মাহদিয়া না বলাতেই সে মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, ভাই সাথে থাকলে ট্যুর জমে না। আসলে তার মনের কথা এটা ছিল না। এতকিছু ভেবেও সে বলেনি। মুখে এসেছে, বলে দিয়েছে। ব্যস। কিন্তু এটা যে ভুল হলো, সেটা বুঝল শাদাবের আহত স্বর শোনে। ছোট্ট করে বলল,

-‘আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি ভাইয়া। খুব দুঃখিত।’

-‘দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আমি মোটেও কষ্ট পাইনি, বরং খুশি হয়েছি তোমার সততা ও সহজসরল প্রকাশভঙ্গি দ্যাখে।’

শিহাব এসে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘চলো আমরা যাই।’

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল শাদাব। শিহাব শেষ একবার মাহদিয়াকে বলল,
-‘তুমি যাবে না?’

দু’দিকে মাথা নাড়ল মাহদিয়া। বলল,
-‘তোমরা যাও। তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝখানে বাইরের মানুষ না থাকা-ই ভালো। এতে তোমাদের সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে।’

-‘দূর। ভাইয়া রাগের মাথায় কী না কী বলল, তুমিও সেটা ধরে বসে থাকবে?’

মাহদিয়া নিজের পা দেখাল। হাত ও চোখ দেখিয়ে বলল,
-‘এসব নিয়ে ঘুরতে যাওয়া ঠিক হবে? আমি রিসোর্টেই থাকি। তুমি ঘুরে এসো। যা যা দ্যাখবে, ছবি তুলে আনবে। প্রত্যেকটা জায়গার ছবিসহ স্থানের নাম আমাকে চিনিয়ে দিবে।’

হাসিমুখে মাথা নেড়ে বিদায় নিল শিহাব। দৌড়াতে দৌড়াতে গাড়ির সামনে চলে গেল সে। শাদাব কিছুক্ষণ মাহদিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তার মনোঃকষ্ট বুঝতে পেরে বলল,

-‘শিহাবকে যত স্বাভাবিক তুমি দ্যাখছ, ও ততটা স্বাভাবিক নয়। ও’কে সুস্থজীবন দেয়ার জন্য অনেককিছুই ওর কাছ থেকে লুকিয়ে যাচ্ছি আমি। আমাদের মধ্যে যা-ই সম্পর্ক থাকুক, আমি চাই না, সেটা ওর সামনে আসুক। এই সম্পর্ক ও পিছনের অধ্যায়ের প্রভাব ওর ওপর পড়তে দিব না বলেই, কিছু তিক্ত সত্য আমি এড়িয়ে যাই সবসময়। তারমধ্যে তুমিও এক সত্য। যে সম্পর্ক কোনোদিন জোড়া লাগবে না, তার পরিপূর্ণ ব্যাখা আমি ওর সামনে টেনে আনতে পারব না। অনুরোধ করছি তোমায়, এসব বিষয় নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তুমি ওর ছোট্ট মনে জাগিয়ে দিও না। আমিও আগামী কয়েকটাদিন সতর্ক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করব।’

***

চলবে…