বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-২৪+২৫

0
427

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — চব্বিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

শো শো শব্দে বাতাস বইছে। হুলস্থুল শুরু হয়েছে উদ্যানের অভ্যন্তরে। জান-প্রাণ বাঁচাতে দিকবিদিক ছাড়িয়ে দৌড়াচ্ছেন পর্যটকেরা। আসন্ন ঝড়-তুফান থেকে রক্ষা পেতে কেউ কেউ হুড়মুড়িয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছেন, হোঁচট খাচ্ছেন। শব্দের ঝনঝনানি ও বাতাসের তীব্র দাপটে গাছের ডালপালাসহ ঝুমঝুম আওয়াজে নুয়ে পড়তে চাইছে। কোনো কোনো উঁচু গাছ ইতোমধ্যেই অর্ধেকের বেশি ও কম ভেঙে রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে মানুষ। কোনোমতে নিরাপদ আশ্রয় পর্যন্ত যেতে পারলেই রক্ষা। এই বাতাসের মধ্যেও কোনোপ্রকার ভয়-ডর নেই মাহদিয়ার মধ্যে। সে দু’হাত মেলে দিয়ে প্রজাপতির ডানায় ভর দিয়ে উড়ে বেড়াতে চাইছে। শাদাব সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে শিহাবকে খুঁজল। ভয় ঢুকে গেল মনে। আশেপাশে কোথাও শিহাব ও হায়দার সাহেব নেই। কোনদিকে আছেন সেটাও বুঝতে পারছে না। শিহাব ট্রেইলে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। যদি ওইদিকে গিয়ে থাকে ফিরবে কী করে! দুঃশ্চিন্তায় আধপাগল অবস্থা হলো তার। তড়িঘড়ি ফোন করল। নেটওয়ার্কের বেহাল দশা। ঠিকঠাক সিগন্যাল লাগছে না। দম আটকে আসার মতো একটা কঠিন যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। মাহদিয়ার দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে ভাইকে অবহেলা করে ফেলল না তো? একটা ছোট্ট অপরাধবোধ জন্ম নিল অন্তরে। সেইসাথে দিশেহারা অবস্থাও হলো। ফোনের সিগন্যাল লাগার বদলে শিহাবের নম্বর থেকেই কল আসলো। সে বেশ ভয়ভীতিকে সঙ্গী করে জানতে চাইল,

-‘ভাইয়া, কোথায় তুমি? মনে হয় ঝড়তুফান আসবে। আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত!’

শিহাবের কণ্ঠস্বরে কাঁপন টের পেয়ে দ্বিগুণ ভয় পেল শাদাব। বলল,
-‘কোথায় তুমি? আমি তোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি ট্রেইলে গিয়েছিলে?’

ফিক করে হেসে ফেলল শিহাব। বলল,
-‘আমি অলরেডি গাড়িতে বসে পপকর্ণ খাচ্ছি! তুমি খাবে? তাড়াতাড়ি এসো। গাছপালা যেভাবে দুলছে, যেকোনো সময় মাথায় ভেঙে পড়বে।’

ভয় দূরে সরিয়ে শাদাব নিজেও শব্দ করে হাসল। বলল,
-‘তো তুমি যাওয়ার আগে একবার আমাকে ফোন করবে না? আমি কত ভয় পাচ্ছিলাম!’

-‘ভয় পাওয়ার কী আছে? চাচ্চু সাথে ছিলেন তো। এইযে, ক্লান্ত হয়ে ডগডগ করে পানি গিলছেন! তোমরা কোথায়? চলে এসো তাড়াতাড়ি। ঝড়বৃষ্টি বেড়ে গেলে রাস্তায় অনেক সমস্যা হতে পারে।’

কে বলে এই ছেলের মাথায় বুদ্ধি নেই? মাথাভর্তি যে দুষ্টু বুদ্ধি নিয়ে চলাফেরা করে দিনরাত, তার আর বাড়তি বুদ্ধির দরকার পড়ে না-কি! ভাইয়ের এমন যৌক্তিক ও পাকা পাকা কথা শোনে শাদাব আর ঘাটাল না বেশি। দুঃশ্চিন্তা সরিয়ে বলল,

-‘কিছুক্ষণ অপেক্ষা কোরো। আসছি।’

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মাহদিয়ার দিকে নজর দিল শাদাব। মেয়েটা তখনও দু’হাত মেলে শূণ্যে তাকিয়ে আছে। তার টপসের উপরে থাকা ফ্লাওয়ার নেটের কটি দমকা হাওয়ায় উড়ছে। প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাসে, চোখে একরাশ মুগ্ধতা নামিয়ে কেউ এত নির্ভার মনে নিজেকে মেলে ধরতে পারে! ভয়হীন এই মানবীকে এমন এলোমেলো প্রকৃতির মাতাল করা রূপে দেখে নিজেকেও তার বড্ড এলোমেলো মনে হলো। ইচ্ছে হলো, দুটো হাতে হাত রেখে সে-ও পিছনে গিয়ে দাঁড়াক। সুখকর কিছু মুহূর্তের সাক্ষী হোক। মন যতই কাছে যেতে চায়, বিবেক ততই তাকে দূরে সরে আসতে বাধ্য করে। অনুভূতি সত্য ও গভীর জেনেও দূরে সরে থাকা কম ধৈর্যের ব্যাপার না। তার সমস্ত সত্ত্বায় যে ‘ভ্রমর’ লুকিয়ে আছে, তাকে অস্বীকার করার সাধ্য যেমন নেই, কাছে টেনে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে সম্পর্কটাকে সহজ করার মতো দুঃসাহসও নেই। যতক্ষণ না শায়লা সুলতানার মুখোশ টেনে খুলতে পারছে, ততক্ষণ বিবেক তাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়াবে। সীমাহীন যন্ত্রণা নিয়ে লুকানো মনের সবটুকু অনুভূতি চার দেয়ালের ভেতরে ছটফট করতে করতে একদিন তাকে নিঃশেষ হয়ে দিবে। না তাকে প্রকাশ করা যাবে, আর না সমস্ত অধিকার দিয়ে তাকে নিজের জন্য চাইতে পারবে। সুখ যে ক্ষণিকের মেহমান এটা সে নিশ্চিত। কারও জীবনেই সুখ চিরস্থায়ী নয়! আজ কেউ সুখী হলে, কাল দুঃখী হয়ে যায়। সময় ও নিয়তি তাকে সবসময় একই গন্তব্য উপহার দেয় না। চোখের সামনে যে সুখ তার সমস্ত অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছে, কিছু কঠিন সত্যের সাথে সেই সুখটাও তাকে ফাঁকি দিবে। ভাঙন নিশ্চিত, এটা জেনেও কীভাবে মনকে ধোঁকা দিবে সে! থাক্ তার অনুভূতি গোপন, থাক্ অপ্রকাশ্য। সাময়িক মোহ ও ক্ষণিকের সুখকে আঁকড়ে ধরার লোভে মা ও মেয়ের মাঝে চিরদিনের জন্য অদৃশ্য বিচ্ছেদ না আসুক। ভেতরটা তার কাঁদছে, তবুও মুখফুটে বলতে পারছে না,

-‘বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা কী, তা এখনও গভীরভাবে উপলব্ধি কোরোনি, ভ্রমর। সামনে যে কঠিন মুহূর্ত তোমার ও আমার মাঝখানে আসবে, তাতেই আমার ওপর থেকে সমস্ত বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে তুমি। নাড়িরটান অস্বীকার করা ও জন্মদাত্রী মা’কে ঘৃণা করে বাঁচবার মতো ধৈর্য্যশীল মেয়ে তুমি নও। বেঁচে থাকতে একজনকে ত্যাগ করতেই হবে তোমায়।’

সম্পর্কটা পবিত্র, অনুভূতি স্বচ্ছ, তবুও দিনশেষে শূণ্যতা বুকে নিয়ে অব্যক্ত মনের হাজারও আকুতি বাক্সবন্দী করে তার না হওয়া ‘ভ্রমর’কেই তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখছিল শাদাব। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। মাহদিয়া তখনও চঞ্চলা হরিণীর মতো লাফঝাঁপ দিচ্ছে। মানুষের দৌড় ও নীড়ে ফেরার তাড়া তাকে খুব একটা টানছে না। সে একমনে ডুব দিয়েছে প্রকৃতির এই সৌন্দর্যে। বৃষ্টির মাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো ঠাস ঠাস শব্দে বজ্রপাত শুরু হলো তখনই সমস্ত চঞ্চলতা থামিয়ে দিল মাহদিয়া। ভীতিকর পরিবেশ ও চারপাশের নির্জনতা তাকে কিছুক্ষণের জন্য থমকে দিল। ধক করে কেঁপে উঠল বুকখানি। পিছন ফিরতেই জনমানবশূন্য এই বৃষ্টিমুখর পরিবেশে একজোড়া নিষ্পলক চোখের মাঝে উত্থাল হৃদয়ের সবটুকু আবেগকে জেগে উঠতে দেখে সাহস নিয়ে দু’পা কাছে এগিয়ে এলো মাহদিয়া। ধীরকণ্ঠে বলল,

-‘তোমার বিবেক তোমাকে কী বলে শাদাব? দীর্ঘ বছরের সম্পর্ককে অস্বীকার করার মতো কী এমন যুক্তি দেয়, যার কারণে কঠিন অপশনের মাধ্যমে তুমি সম্পর্কের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছ? তুমি কি জানো, প্রতিনিয়ত এই দেয়াল ভাঙতে না পারার যন্ত্রণায় আমি ছটফট করছি? অথচ দিনকেদিন এই অদৃশ্য দেয়াল আমাদের সম্পর্কের খুঁটিটাকে গোড়া থেকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে।’

শাদাব শান্তচোখে বলল,
-‘আমাদের সম্পর্কটা অনেক আগে থেকেই নড়বড়ে হয়ে আছে। আমি যত চেষ্টাই করি না কেন, সব চেষ্টা বৃথা যাবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি নিজের মা ও ভাইয়ের সাথে হওয়া সমস্ত অন্যায়ের উপযুক্ত জবাব দিতে পারব। পৃথিবীতে দুটো মানুষকে প্রচণ্ড ঘৃণা করি আমি। ওই দুটো মানুষের ছায়াকে সারাজীবনের জন্য দূরে সরাতে গিয়ে যদি তোমাকে হারাতে হয়, তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ হবে না আমার। সম্পর্ক নড়বড়ে হোক কি ভেঙে যাক, সামান্যতম অনুশোচনাও হবে না এটা নিশ্চিত থাকো।’

-‘আমার ফিরে আসাকে এতটা তুচ্ছ করে দিলে? এতগুলো বছরের অপেক্ষার কোনো মূল্য নেই? তুমি এত পাষাণ, এত নিষ্ঠুর!’

-‘সম্পর্ক বাঁচানোর যত তাড়া তোমার মাঝে আছে, অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত সামনে আসার পর, তত শীঘ্রই মুক্তি চাইবে তুমি। আজ যত ভালোবাসা তুমি দ্যাখাচ্ছ, শীঘ্রই তা ঘৃণায় রূপ নিবে। এই কারণেই দুটো অপশন দিয়েছিলাম তোমায়!’

-‘তুমি এত নিশ্চিত কীভাবে, আমি শীঘ্রই মুক্তি চাইব?’

-‘পিছন থেকে কেউ তোমাকে ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে, সেটা জেনেও, সেই মানুষকে চিনেও পুরো পৃথিবী তোমার কাছে সুন্দর মনে হবে? তখন শুধু মনে হবে, এই পৃথিবীর আপনপর সবাই স্বার্থপর। স্বার্থের জন্য মানুষ নিজের সন্তানের সাথেও অন্যায় করতে দু’বার ভাবে না। আর সে যদি হয়, পরম বিশ্বস্ত একজন মানুষ। তখন তো আর কোনো কথা-ই থাকে না।’

শাদাব এত কঠিন হতে পারবে? বিশ্বাস হচ্ছে না মাহদিয়ার। মন বলছে, কোথাও কিছু একটা ভুল আছে। কারণ এই ছেলে মুখে বলছে এক অথচ তার চোখের ভাষা আরেক। গভীর ও বিশ্বস্ততায় মোড়ানো দৃষ্টি। ওই চোখে তাকালে শুধু সম্পর্কের প্রতি টান ও অনুভূতির গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। কোনো বিশ্বাসঘাতক কিংবা স্বার্থপর মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা যে ইচ্ছাকৃত একটা কথা ও দূরে সরানোর ছোট্ট একটা দৃশ্য সেটা বুঝতে দেরী হলো না মাহদিয়ার। যত কঠিন স্বরে শাদাব ওই কথাগুলো প্রকাশ করেছে, তত সহজভাবেই সেসব কথাকে মনে ঠাঁই দিয়ে, চোখ দিয়ে মনের ভেতরের অব্যক্ত কথা টেনে আনতে দৃঢ়স্বরে বলল,

-‘তুমি কি জানো, অভিনয়ে তুমি কতখানি কাঁচা? পাকা অভিনেতা হতে গেলে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয় শাদাব। দৃষ্টি সরিয়ে বাহাদুরি দ্যাখাতে হয় না।’

সত্যি সত্যিই দৃষ্টি সরিয়ে নিল শাদাব। মাহদিয়া আরও কাছে ভীড়ল। আলগোছে চিবুক ছুঁয়ে এড়িয়ে চলা দৃষ্টি নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে বলল,

-‘আমার দিকে তাকাও, সত্যি করে বোলো, তুমি আমাকে ঘৃণা কোরো? তুমি ঘৃণা কোরো, এটা জানার পর আমি আর এক মুহূর্ত দেরী করব না। সম্পর্কের ইতি টেনে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাব। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিব, সব ভালোবাসা দ্বিপাক্ষিক হয় না। কিছু ভালোবাসা সারাজীবন একপাক্ষিক থেকে যায়।’

পূণরায় দৃষ্টি সরিয়ে নিল শাদাব। চোখ, মুখ এমনকি মন, কোনোকিছু দিয়েই শাদাব নিজেকে প্রকাশ করল না। কোনো জবাব না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাহদিয়া। চারপাশের ঝড়তুফান, বজ্রপাত, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকানো, প্রকৃতির শান্ত পরিবেশকে যতখানি অশান্ত করেছে, তারচেয়েও বেশি অশান্তি, বেশি বজ্রপাত ও বিদ্যুতের ঝলকানিতে তার হৃদয়পুরী জ্বলেপুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে। নীরবতাকেই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করে নিল অভিমানিনী। কণ্ঠে হাজারও আকুলতা মিশিয়ে বলল,

-‘আমি কি একবার তোমায় জড়িয়ে ধরতে পারি? এরপর আর কিচ্ছু চাইব না।’

বিস্মিত চোখ নিয়েই অভিমানী মুখের আবদার শোনে হৃৎপিণ্ড তড়াক করে লাফিয়ে উঠল তার। অনুমতি নিয়েও সময় নষ্ট করার প্রয়োজনবোধ করল না মাহদিয়া। দু’হাতে প্রথম ও শেষবারের মতো ভালোবাসার মানুষকে ছুঁয়ে দেয়ার মতো সাহস ও স্পর্ধা দেখিয়ে খুব করে তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও বজ্রপাতের ভয় তাকে এতক্ষণ দমিয়ে রাখলেও প্রিয় পুরুষের বক্ষস্থলে লুকিয়ে যে অত্যাধিক অনুভূতি অনুভব করার সাক্ষী হলো, তাতে তার সমস্ত শরীর জুড়ে না পাওয়ার তীব্র আর্তনাদ নেমে এলো। যতবার বজ্রপাতের শব্দ তার কানে আসছে, ততবারই হাতের বাঁধন মজবুত করছে মাহদিয়া। মানুষ কত নিষ্প্রাণ হয়, তা শাদাব প্রমাণ করে দিল। আসলেই তার ফিরে আসাতে শাদাবের কিছুই যায় আসে না। নয়তো এমন মুহূর্তে কেউ কীভাবে হাত গুটিয়ে থাকতে পারে! সান্ত্বনা না দিক, পাশে না থাকুক, বিচ্ছেদ হয়ে যাক, একবার তো মাথায় হাত রাখতেই পারত। অথচ তা-ও রাখল না! অভিমানে চোখে অশ্রুরা ভীড় জমাল। মাথা তুলে শাদাবকেও একবার দেখল। বন্ধ চোখের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা আঁচড়ে পড়ছে। তবুও তাকাচ্ছে না এই ছেলে। ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো চোখের কোণেও অশ্রু আছে। বৃষ্টির পানিতে তা ধুয়েমুছে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবেগঘন স্বরে ডাকল,

-‘শাদাব…।’

-‘শুনছি।’

-‘খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?’

-‘কেন? কষ্ট হবে কেন?’

-‘বুকের ভেতর এত ভালোবাসা জমিয়ে রেখেও আমাকে অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস দ্যাখালে! তোমার চোখমুখ বলছে, আমার যত কষ্ট হচ্ছে, তারচেয়েও দ্বিগুণ কষ্টে তুমি ছটফট করছ। একটু কাঁদো, শাদাব। কাঁদলে চোখের পানির সাথে অনেক যন্ত্রণা বেরিয়ে আসবে।’

সহসাই চোখ মেলে তাকাল শাদাব। এতক্ষণের সবটুকু অনুভূতিকে দূরে ঠেলে দেয়ার বাহানায় ভারিক্কি স্বরে বলল,
-‘মোটেও কষ্ট হচ্ছে না আমার। কষ্ট কেন হবে? আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না-কি? অযথা কথা বলে, জোরপূর্বক কাছে এসে আমাকে দুর্বল করে দিতে চাইছ।’

-‘ওহ। দুঃখিত। এই শেষ। এরপর আর কাছে আসব না। দূরেই চলে যাব। অনেক দূরে।’

ঝড়ো বাতাসের মধ্যে ধুপধাপ পা পেলে সামনে দিকে এগিয়ে গেল মাহদিয়া। পিছনে রেখে গেল এক অপেক্ষারত প্রেমিককে। যে ভালোবাসে, কিন্তু ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অপমানের তীর বুকে বিঁধবার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাসের সাথে উগড়ে দেয় সবটুকু কষ্টকে। পা ফেলে এগোয় সামনে। ডালপালা যেভাবে দুলছে, যেকোনো বিপদ হবে নিশ্চিত। মাহদিয়া তো ডানে-বায়ে তাকাচ্ছেও না। দৌড়াচ্ছে। বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে যেতেই ধুম করে আওয়াজ হলো আকাশে। সেই আওয়াজ ও বাতাসের ঝাপটায় গাছ ভাঙল। সামনে এমন বড়োসড়ো গাছ এসে পড়তেই ভরকে গেল বেচারী। দু’পা পিছনে ফিরতেই ধাক্কা খেল। মুহূর্তেই শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহের চওড়া বুকে জায়গা হলো তার। প্রথমে খামছে ধরে ভয় দূর করল, পরক্ষণেই তখনকার কথা মনে পড়তেই দূরে সরে গেল। অভিমানী কণ্ঠে বলল,

-‘আমি ইচ্ছে করে কাছে ঘেঁষতে চাইনি। না পিছালে ডাল উপরে এসে পড়ত।’

এই অহেতুক স্বীকারোক্তির দরকার ছিল না। কিন্তু অভিমান দমিয়ে রাখতে পারছিল না বলেই জেদ থেকে বলেছে। অথচ মন চাইছে, ওখানেই আশ্রয় গড়ে উঠুক তার। কেন যে এটা সম্ভব নয়, বুঝতে পারল না মাহদিয়া। শাদাবের কথার আগামাথাই তার বোধগম্য হয় না। তবে এইটুকু নিশ্চিত, এই ছেলে সীমাহীন অনুভূতি, সম্পর্কের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা আগলে নিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে জানে। কেউ যদি নিজের অনুভূতি লুকিয়ে ভালো থাকতে চায়, তাহলে তাকে সেভাবেই ভালো থাকতে দেয়া উচিত। আজকের পর আর সম্পর্ক বাঁচানোর কোনো চেষ্টা সে করবে না। অনেক তো করেছে। নিজেকে প্রকাশও করেছে। অনুভূতি যে মিথ্যে ও মোহ নয়, তা-ও বুঝানোর চেষ্টা করেছে। সম্পর্ক ভাঙার পর, তার দিকে কোনোপ্রকার দোষের আঙুল উঠতে দিবে না, এই বিষয়ে সে স্পষ্ট। জোর করে সব হয় না। ভালোবাসায় তো জোরাজোরি একদমই চলে না। শত ভাবনা ও মন খারাপকে সঙ্গী করে রাস্তার সামনে থাকা ডাল সরাতে যাচ্ছিল মাহদিয়া। বেশ মোটা ও ওজন। দু’হাতে ধরে তাকে সরানোর মতো শক্তি তার একার শরীরে নেই। যেদিকেই যাচ্ছে, সেদিকেই ডালের ফাঁকফোকরে পথ হারিয়ে ফেলছে। বৃষ্টিও থামছে না। ক্রমাগত বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। একটা নিরাপদ আশ্রয়ের বড্ড অভাব টের পেল সে। কাছেপিঠে চোখ ঘুরিয়ে আশ্রয় নেয়ার মতো কিছুই পেল না। ঠাণ্ডায় এবার শরীরে কাঁপুনি ধরে এলো তার। সব শক্তি হারিয়ে গেল। মনের ওপর জোর একদমই নেই, এবার শরীরও হাল ছেড়ে দিল। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতেই ডাল সরানোর চেষ্টা করল আবারও। শাদাব নিজেই তাকে সাহায্য করল। ডাল সরিয়ে রাস্তা উন্মুক্ত করে দিল। মাহদিয়া অসহায় চোখে চারপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করল। শাদাব বলল,

-‘কী দ্যাখছ? এগোও। এখানেই থাকার প্ল্যান আছে না-কি? ‘সাতছড়ি’-তে থাকার মতো কোনো কটেজ নেই, বিশ্রামকেন্দ্র নেই। এখনই গাড়ি অবধি না গেলে, এখানেই ঝড়বৃষ্টি ও ভাঙা গাছপালার সাথে দিন কাটাতে হবে।’

দুর্বল শরীর নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করল মাহদিয়া। এক’পা, দু’পা এগোতে গিয়েও শারিরীক দুর্বলতার কারণে পারল না। হাল ছেড়ে দিয়ে মাঝপথে বসে পড়ল। শাদাব অবাক হয়ে বলল,

-‘কী হলো?’

-‘কিছু না। তুমি এগোও।’

-‘কোনো অসুবিধা হচ্ছে? শরীর খারাপ? হাঁটতে পারবে?’

তাচ্ছিল্যের সুরে মাহদিয়া বলল,
-‘পারব। তোমাকে এত মাথা ঘামাতে হবে না।’

আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। ঝড়বৃষ্টি থামছেই না। এরমধ্যে যদি এই মেয়ে দুর্বল হয়ে এখানেই থেমে যায়, তবে বাকিপথ এগোবে কীভাবে! সে নিজেও কিছুটা পিছিয়ে এসে মাহদিয়ার পাশে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বলল,

-‘এসো।’

-‘মাথা খারাপ কোরো না। যাও এখান থেকে। আমি একাই যেতে পারব।’

-‘তাহলে বসে পড়লে কেন?’

-‘বৃষ্টির পানি, ঝড়তুফান, বজ্রপাত এসব খেতে বসেছি। তুমি খাবে? ভীষণ ইয়াম্মি।’

কখন রাগে, কখন খুশি থাকে বুঝারই উপায় নেই। বাধ্য হয়ে শাদাব নিজেই তাকে পাঁজাকোলে তোলবার জন্য হাত বাড়াতেই রেগেমেগে তার হাতে ধাক্কা মারল মাহদিয়া। বলল,

-‘একদম কাছে আসবে না। দূরে থাকো।’

মেজাজে যে ইতিমধ্যে আগুন ধরে গেছে সেটা দিব্যি বুঝে গেল শাদাব। বলল,
-‘ভালো বুদ্ধি তো। আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছ।’

মাহদিয়া কিছু বলল না। দু’হাঁটুর ভাঁজে মুখ লুকিয়ে রইল। শাদাব ফের বলল,
-‘ঝড়তুফান বাড়ছে মাহদিয়া। প্লিজ ওঠো। চাচ্চু গাড়িতে অপেক্ষা করছেন। এতক্ষণে কতবার ফোন করেছেন। আমার ফোন অলরেডি ভিজেটিজে আধমরা। ওটাকে জীবিত করতে হবে।’

মুখ তুলে মাহদিয়া বলল,
-‘একটা মানুষ মরে যাচ্ছে, তারদিকে কোনো লক্ষ্য নেই। তুমি তোমার ফোন নিয়েই ভাবছ!’

দু’হাতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল মাহদিয়া। টালমাটাল, বেসামাল শরীরটাকে কোনোমতে নিয়ন্ত্রণ করে হাঁটতে লাগল। একবার হোঁচট খেতে গিয়েও ব্যালেন্স ধরে নিজেকে সামলে নিল। শাদাব হাত বাড়িয়েছিল মাত্র। ফিরেও তাকায়নি। উলটে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘যে হাত তুমি নিজেই ছাড়িয়ে নিয়েছ, সেই হাতে ভর দিয়ে নিজেকে আর অন্যের ওপর নির্ভরশীল দ্যাখতে চাই না। আমি একটা বিশ্বস্ত হাত চেয়েছিলাম, সম্পর্ক ও তোমার প্রতি অনুভূতি ভুল নয়, এটাও বুঝাতে চেয়েছিলাম। অথচ তুমি তা গ্রহণ করতে চাইছ না। বার বার বুঝিয়ে দিচ্ছ, আমি তোমার ওপর জোরজবরদস্তি করছি! তোমার কাছে আমি কেন, আমাদের সম্পর্কটাই মূল্যহীন।’

-‘তুমি ভুল ভাবছ।’

নিজের দিক স্পষ্ট করার জন্য বলল শাদাব। মাহদিয়া হাসল। জানতে চাইল,
-‘তাহলে সঠিক ভাবনাটা আমাকে বুঝাও!’

হাঁটা থামিয়ে মাহদিয়ার মুখোমুখি হলো শাদাব। আলতো হাতে বৃষ্টিতে ভেজা মুখখানি ছুঁলো। মাহদিয়া বাঁধা দিল না। আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রইল। কাতর গলায় ভেসে এলো,

-‘আমাদের সম্পর্কটাকে আমি অনেক সম্মান করি। আমিও চাই, এই সম্পর্কটা জোড়া লাগুক। তোমাকে কষ্ট দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, তবুও বার বার না চাইতেও কষ্ট দিয়ে ফেলছি। আমি বড্ড অসহায় ভ্রমর। একটু বোঝো আমায়।’

চোখ পিটপিট করে তাকাল মাহদিয়া। বলল,
-‘কী করে বিশ্বাস করব, তুমিও আমায় চাও?’

-‘এখন এর প্রমাণও দিতে হবে?’

-‘তুমি নিজেকে প্রকাশ করছ না, অথচ বার বার…।’

ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল শাদাব। এলোমেলো কোঁকড়াচুল ভিজে সমস্ত মুখে লেপটে আছে মাহদিয়ার। আঙুলের আলতো স্পর্শে চুলগুলো সরিয়ে উন্মুক্ত কপালে অধর ছোঁয়াল। কাঙ্ক্ষিত পুরুষের প্রথম স্পর্শ, অনুভূতির প্রথম প্রকাশ। হতবাক মাহদিয়া চোখ বন্ধ করতে গিয়েও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,

-‘কী হলো এটা?’

-‘কিছু হয়নি।’

-‘কিছু তো একটা হলো।’

-‘যা হলো, খুব খারাপ হলো!’

ঘোর লেগে গেল চোখে, মনে। সমস্ত শরীর জুড়ে উপচেপড়া ভালো লাগার ঢেউ বইতে লাগল। কাঁপুনি বেড়ে গেল মাহদিয়ার। টালমাটাল দেহখানি নিয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই নিজেকে শূণ্যে আবিষ্কার করে সমস্ত অভিমান দূরে সরিয়ে মুখ লুকাল নিরাপদ জায়গায়। শাদাব এগোতে এগোতে মনে মনে হিসাব কষতে লাগল, কীভাবে শায়লা সুলতানাকে টেনেহিঁচড়ে তার মায়ের পায়ের কাছে নিয়ে ফেলবে!

***

চলবে…

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — পঁচিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

পনেরো বছরের সম্পর্ক বাঁচানোর জন্য পঁচিশ বছরের নাড়িরটানকে অস্বীকার করার মতো ধৈর্য্যশক্তি, সাহস, মনোবল, কিছুই মাহদিয়ার নেই। নিজের মাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। বিশ্বাস করে। মা তাকে কতখানি ভালোবাসেন এটাও সে জানে। উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু শাদাবের কথাতে একটা বিষয় সে নিশ্চিত হতে পেরেছে, সুন্দর জীবন হোক কি না, বাঁচতে হলে তাকে দু’জনের মধ্য থেকে একজনকে নিয়েই বাঁচতে হবে। কেন নিজের মা ও স্বামীকে সে একসাথে চাইতে পারবে না, এই কঠিন ও জটিল পয়েন্টটাই ধরতে পারছে না মাহদিয়া। না জেনে না বুঝে নিজের মাকে কী করে কষ্ট দিবে! কী করে তার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিবে? জীবনে ভালোবাসাই কি সব? মায়ের স্নেহ-মায়া-মমতার কোনো দাম নেই? শাদাব তো বুঝে মায়ের মূল্য! জেনে-বুঝে কেন মা-মেয়েকে সে দূরে সরানোর মতো এমন বাজে একটা অপশন দিল? অস্থির মন নিয়েই এসব ভাবছিল মাহদিয়া। বার বার নিজের কপালে হাত রাখছিল। অল্প সময় নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুর মাধ্যমে ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিল শাদাব। কয়েক ঘণ্টা আগেই সে নিশ্চিত হতে পেরেছে, শাদাবও তাকে ভালোবাসে। পবিত্র বন্ধনকে ঘিরে দু’জনার অনুভূতি-ই দ্বি-পাক্ষিক। সম্পর্ক ও অর্ধাঙ্গিনীকে ঘিরে সীমাহীন অনুভূতি থাকার পরও, কঠিন অপশন দিয়েছে। কারণ সে নিশ্চিত, কেউ নিজের মায়ের সাথে সহজেই বিচ্ছেদ টানবে না! দ্বিপাক্ষিক অনুভূতি থাকার পরও সম্পর্ক নড়বড়ে, মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তি! আড়ালে এমন কে আছে, যার জঘন্য রূপের কারণে শাদাব তাকে মায়ের সাথে বিচ্ছেদ টেনে আনার মতো অহেতুক অপশন দিল! এত ভালোবাসা থাকার পরও তা অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস দেখাল!

রুমের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতেই এসব অযাচিত ভাবনা মনে জমিয়ে রেখে নিজের মায়ের নম্বরে ডায়াল করল মাহদিয়া। ঝটপটই রিসিভ হলো সেটা। মমতাময়ী মায়ের উদ্বিগ্ন স্বর শোনেই বুঝল, মা পরম ভরসা ও বিশ্বাসের জায়গা। স্পষ্ট শুনতে পেল, শায়লা সুলতানা বলছেন,

-‘সেই সকালে ঘুরতে বের হলি! এরপর আর ফোন করলি না। আমার কত চিন্তা হচ্ছিল দিয়া। কেমন আছিস এখন? রিসোর্টে ফিরেছিস মা? আমি কি আসব? ভালো একজন ডাক্তার দ্যাখাবি!’

-‘কিছু হয়নি মা। আমি ঠিক আছি।’

মেয়ে যত সহজেই বলুক, সে ঠিক আছে। আসলে সে ঠিক নেই। যেখানে শাদাব আছে, সেখানে কিচ্ছু ঠিক থাকার কথা নয়। যত ভয়, যত ঝামেলা, যত নাটেরগুরু ওই একটাই। তা-ই ভয়, পাছে মেয়েটা সব জেনে যায়! তাহলেই তো বিপদ। এত সহজে শাদাব সব ভুলে যাবে না, সব হিসাব চুকিয়েই ছাড়বে এই ছেলে! যা সব কাণ্ডকারখানা করছে, তাতে তিনি নিশ্চিত, কয়দিন পর মাহদিয়াও হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে। ভয়ে এখনই তাঁর চরম অবস্থা। তবুও মেয়েকে বুঝাতে, সামলাতে, তিনি কিছুটা আদর ও স্নেহ মিশিয়ে বললেন,

-‘দেশে ফিরতে না ফিরতেই অসুখ বাঁধিয়ে বসে আছিস। বাকি দিনগুলো কীভাবে থাকবি? এই দেশের আবহাওয়া একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে! হুট করে এখানে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই। খুব বেশি দেরী করার দরকার নেই। আমরা শীঘ্রই ইতালি ব্যাক করব।’

মাহদিয়া আজও বুঝে না, মা কেন তাকে দেশে আসতে দিতে চাননি। এখন আবার তাড়াতাড়ি ব্যাক করতে চান। দেশে কী এমন জিনিস আছে, যার কারণে মেয়েকে দেশের আবহাওয়া ও দেশের প্রতি মেয়ের আত্মিক টান জেনেও তাকে সেখান থেকে দূরে রাখতে চান! মাকে নিয়ে কোনোপ্রকার সন্দেহকে মনে জায়গা দিতে চাইছে না মাহদিয়া। কিন্তু তার মায়ের কথাবার্তাও তাকে সেই সুযোগ দিচ্ছে না। উলটে ভাবতে বাধ্য করছে, মা কেন এমন করছেন তার সাথে? সে ইতালি যাওয়ার কথা শোনেই বলল,

-‘এত তাড়াতাড়ি কী করে যাই বোলো? যাদের জন্য ছুটে এলাম, তাদের খোঁজ না পেয়েই চলে যাব? এখনও অনেক হিসাব বাকি মা। সম্পর্কের একটা দিক না দ্যাখে এত সহজে আমি ইতালি ফিরছি না।’

-‘কিন্তু তুই তো এখানে অসুস্থ হয়ে পড়ছিস।’

-‘রোগ হলে রোগের ট্রিটমেন্ট আছে মা। রোগের ভয়ে দায়িত্ব-কর্তব্য অবহেলা করতে পারব না। তুমি সম্পর্ককে কীভাবে দ্যাখো জানি না, তবে আমি ওই দুটো মানুষ ও আমাদের সম্পর্কটাকে অনেক সম্মান করি।’

-‘সে তো আমি জানি। আর জানি বলেই তো ফিরে আসা।’

-‘কিন্তু তুমি চাওনি, আমি বাংলাদেশে ফিরি! কেন চাওনি মা?’

শায়লা সুলতানার বেহুঁশ হওয়ার মতো অবস্থা। কথা খুঁজে না পেয়ে তিনি আমতা-আমতা শুরু করলেন। শাদাব বলছিল, সম্পর্ক বাঁচাতে সে চেষ্টা করেছে! এরজন্য নিশ্চয়ই তাকে ইতালিতে ফোন করে খোঁজ নিতে হয়েছে। যদি সে খোঁজ নিয়েই তাকে, তবে মাহদিয়া কেন সেই খোঁজ অবধি পৌঁছাতে পারেনি! সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই নড়বড়ে ও তাতে তৃতীয় ব্যক্তি জড়িত। সেই তৃতীয় ব্যক্তি যদি গোড়া থেকে জড়িয়েই থাকে, তাহলে এতদিন কেন সে তা টের পায়নি? শাদাবের কথা ও হায়দার সাহেবের ভাষ্যমতে সম্পর্কের তৃতীয় ব্যক্তির কারণেই এই দূরত্ব। যদি তৃতীয় ব্যক্তি কায়ছার সাহেব হোন! এইটুকু ভেবেই পূণরায় মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘কী হলো? চুপ করে আছো কেন মা? বলো, কেন চাওনি আমি দেশে আসি?’

-‘অযথা হয়রানি হচ্ছে না? এই কারণে!’

-‘একটা পবিত্র সম্পর্ক তোমার কাছে অযথা মনে হচ্ছে?’

শায়লা সুলতানা এবারও নীরব হয়ে গেলেন। মাহদিয়া ফের বলল,
-‘একজন মায়ের কাছে তার সন্তান অনেক দামী তাই না, মা?’

-‘অবশ্যই দামী। সন্তান ও মা একে-অন্যের পরিপূরক।’

আসলেই তাই। মা ও সন্তান একে-অন্যের পরিপূরক। যদি এমনটাই হয়, শায়লা সুলতানা কেন সায়রা করীমের কাজকে সাপোর্ট করলেন না? কেন তাকে ভুল ও খারাপ মানুষ ভাবতে বাধ্য করলেন? ইতালির সব কথা মনে পড়ল মাহদিয়ার। কীভাবে মা তাকে দিনের পর দিন ভুল বুঝিয়ে সম্পর্কটাকে ভেঙে ফেলবার মতো নানা ধরনের উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন। আজ সেসব কথা-ই যেন তাকে ক্ষণে ক্ষণে ভাবাচ্ছে আর ভাবতে বাধ্য করছে, তাদের সম্পর্কে আসা অদৃশ্য তৃতীয় ব্যক্তি তার মা নিজে। ভেবেচিন্তে ঠাণ্ডা মাথায় মাহদিয়া উত্তর দিল,

-‘তাহলে একজন মা যদি নিজের সন্তানকে বাঁচাতে কাপুরুষ স্বামীকে ত্যাগ করে চলে যান, সেখানে তো আমি ওই মা ও সন্তানের কোনো দোষ দ্যাখছি না। যদি সায়রা আন্টি ও টোটোনের কোনো দোষ না থাকে, যদি তাদের সিদ্ধান্ত ও ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ভুল না হয়, তবে তুমি কেন আমাকে বুঝিয়েছ, ওই দুটো মানুষ নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেছে, বড়ো মামার সম্মানের কথা ভাবেনি? আমার তো মনে হয়, যেকোনো মায়ের কাছে ওই মুহূর্তে সম্মানের চেয়ে সন্তান বড়ো হওয়া উচিত। যেহেতু সন্তানটা বৈধ ও পবিত্র সম্পর্কের বিশেষ নি’আমাত। আন্টি ঠিক কাজটাই করেছেন। কোনো ভুল করেননি। দুটো মানুষ সম্পর্কে আমার মনে কেন এই ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছিলে মা? কেন বুঝিয়েছিলে, টোটোন ও সায়রা আন্টি মানুষ ভালো না?’

দড়াম করে বাজ পড়ল শায়লা সুলতানার মাথায়। যা ভয় পাচ্ছিলেন তা-ই হচ্ছে। নিজের পেটের মেয়ে হয়ে মাহদিয়া তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। একবার যদি এই সন্দেহ গাঢ় হয়ে যেতে শুরু করে, তবেই তো ঝামেলা বাঁধবে। বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি মেয়েকে উল্টাপাল্টা বুঝানোর জন্য বললেন,

-‘তোর বড়ো মামা আমাকে যেভাবে বলেছেন, আমিও সেভাবেই বলেছি দিয়া।’

-‘তাই বলে তোমার বিবেক তোমাকে ভুল সংজ্ঞা বুঝাবে? তুমি তো মা, তোমার তো উচিত ছিল, সায়রা আন্টির জায়গায় থেকে তাঁর দিকটা বিচার করা! তুমি একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর মন বুঝতে পারলে না! এটা কী করে হয় মা? তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও ধৈর্য্যশীল একজন নারী। তুমি তো বড়ো মামাকে বুঝাতে পারতে! সেটা কেন করলে না?’

-‘আমি তো তখন সামনে ছিলাম না দিয়া! তা-ই ঘটনা কী সেটা বুঝিনি। বুঝলে কি আর তোর সায়রা আন্টির সম্পর্কে ভুল ভাবতাম? আপা আমার কত কাছের মানুষ ছিলেন!’

মায়ের দীর্ঘশ্বাস ও গলার স্বর শোনে মন খারাপ হয়ে গেল মাহদিয়ার। দুটো মানুষের সম্পর্ক এত চমৎকার ছিল যে সেখানে এত সহজে দূরত্ব ও ভাঙন আসার কথা নয়! অথচ সেই কাছের মানুষটার সম্পর্কেই ভুল ধারণা মনে নিয়ে বেঁচে ছিলেন এতদিন। সে নিজেও খানিকটা মন খারাপ ও দীর্ঘশ্বাসের সুরে বলল,

-‘এখনও কাছের তাই নয় কী! মানুষ দূরে থাকলেই কি সম্পর্কে দূরত্ব আসে মা? আসে না। সায়রা আন্টি ও তুমি দূরে থাকলেও এখনও একে-অন্যের মনে ঠিকই আছো!’

শায়লা সুলতানা থতমত খেয়ে গেলেন! এই আহ্লাদী স্বর ও দূরে থাকার কথা ঠিকমতো না বুঝে বললেন,
-‘হ্যাঁ! কত কাছে। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, এইতো আমি সায়রা আপার সাথে বসে বসে গল্প করছি।’

-‘ঠিক এমনটাই আমারও মনে হয়! শাদাব আমার থেকে দূরে ছিল। দৃষ্টিসীমার বাইরে ছিল। কিন্তু মনের ভেতর এখনও ওর প্রভাব আগের মতোই আছে। চোখ বন্ধ করলেই আমি ওর অস্তিত্ব টের পেতাম। উপলব্ধি করতাম। দূরে থেকেও আমরা অনেক কাছে ছিলাম।’

শাদাবের জন্য এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছে। মায়ের সাথে এমন রহস্য করে কথা বলছে। তিনি হাসিমুখে মেয়ের এই কথাগুলো হজম করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। মেয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে আটকাতে হবে। যেভাবেই হোক। দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারা নিয়েই বললেন,

-‘ওসব বাদ দে দিয়া। তোকে আমি কতবার বলেছি, বুঝিয়েছি। আর কীসের অপেক্ষা করছিস তুই! সম্পর্কটা থেকে মুক্তি নে। ওদের খুঁজে পাবি না। ওরা যদি তোকে চাইত, ওদের পরিবারের একজন ভাবত, তবে নিশ্চয়ই ফোন করে খোঁজ নিত। সত্যি কী জানিস, আমরা ওদের যত আপন ভাবছি, ওরা আমাদের তত আপন ভাবছে না। এই কারণেই কোনো খোঁজখবর নেয়নি। যোগাযোগ রাখেনি।’

মায়ের এমনতর কথায় ভীষণ চমকায় মাহদিয়া। কে মিথ্যে বলছে বুঝে আসে না! শাদাবের কথাতে স্পষ্ট, সে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু নিয়তি তাকে চরম ধোঁকা দিয়েছে। তাছাড়া, শাদাবের সেদিনের কথা! শিহাবের জন্ম তারিখ সে জানে না, এটা শোনে ভীষণ চমকেছিল শাদাব। যেন মাহদিয়ার ওসব জানার কথা! মায়ের আচরণে সন্দেহ না হলেও বার বার তার মনে হচ্ছে, অপশনটা অহেতুক নয়! এর পিছনে বড়োসড়ো কোনো রহস্য আছে। আপন মানুষ পিছন থেকে ছুরিকাঘাতে কাকে ক্ষতবিক্ষত করছে? তাকে না-কি শাদাবকে! যদি সে হয়, তবে সেই আপন মানুষ কে! তার বাবা না-কি মা? নিজের বাবা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান আছে মাহদিয়ার। তিনি কতটুকু ভালো মন-মানসিকতার মানুষ, সেই সম্পর্কেও ধারণা আছে। বাবাকে কোনোমতেই সন্দেহ করা যায় না। আবার মা’কে কীভাবে! ভাবতে পারে না মাহদিয়া। নিজেকে তার ভীষণ স্বার্থপর ও খারাপ মনে হয়। নিজের সুখের কথা ভাবতে গিয়ে মায়ের প্রতি সন্দেহ জাগিয়ে তুলছে মনে! ছিঃ ছিঃ। নিজেই যেন নিজেকে ধিক্কার দেয়! আবার শাদাবকে দোষতে গিয়েও তার আচরণ, কথাবার্তা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে মনে হয়, ওই পুরুষ আপাদমস্তক বিশ্বাসে মুড়ানো। তাকে অবিশ্বাস করা মানে, অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করা! কিন্তু নিজের মাকে! এখানেও তো বিবেকের কাছে সে দোষী হয়ে যাচ্ছে! কীভাবে এত জটিল সমস্যার সমাধান পাবে, এইভেবে দিশেহারা হয়ে যায় সে। মাকে বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। নিশ্চুপে ভাবতে থাকে। মেয়ের নীরবতা দেখে তিনি আবারও বললেন,

-‘বাড়ি ফিরছিস কবে? এখানের ঝামেলা শেষ হয়ে গেলেই আমরা ইতালি ব্যাক করব। ওই সম্পর্কটা নিয়ে এত ভাবিস না, মা। খামোখাই নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস তুই। ওরা কেউ তোকে চায়নি কোনোদিন, চাইবেও না।’

শাদাব তাকে কতখানি চায়, সেটা আজ স্পষ্ট। তাই এই নিয়ে মায়ের সাথে তর্কাতর্কিতে যেতে ইচ্ছে করছে না। সত্য ও মিথ্যার মধ্যে থাকা পার্থক্য যতক্ষণ না ধরতে পারছে, ততক্ষণ সম্পর্ক ভাঙাগড়া নিয়ে কোনোপ্রকার ইঙ্গিত সে মাকে দিবে না। প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার সাথে সেদিক এড়িয়ে গিয়েই বলল,

-‘আমাকে আরেকটু ভাবতে দাও মা। এখনও অনেককিছু জানা বাকি আমার!’

আঁৎকে উঠলেন শায়লা সুলতানা। বললেন,
-‘আর কী জানা বাকি?’

-‘তেমন কিছু না। সায়রা আন্টির সেই বাচ্চার কী হলো, তা তো জানি না। তিনি বেঁচে আছেন না-কি মারা গেছেন, এ-ও জানি না। নিজের সন্তানের জন্য স্বেচ্ছায় ‘সুখনীড়’ ত্যাগ করা নারী শেষমেশ সন্তানকে বাঁচাতে পেরেছিলেন তো! এটাই ভাবাচ্ছে মা। তুমি এত চিন্তা কোরো না। আমি এই সম্পর্কের মধ্যে থাকা সমস্ত অদৃশ্য দূরত্ব ও তৃতীয় ব্যক্তিকে নিজ হাতে দূরে সরাব। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র!’

ফোন রেখে ঝটপট নিজের বাবার নম্বরে ডায়াল করল মাহদিয়া। ওপাশ থেকে সেটা রিসিভ হলো না। দশ থেকে পনেরো মিনিট চেষ্টা করে, ব্যর্থ হলো। শেষে উপায়ন্তর না পেয়ে ম্যাসেজ পাঠাল। লিখল, ‘তুমি শিগগির দেশে ফিরো বাবা। তোমার সাহায্য আমার খুব দরকার।’

***

দুটো মানুষ মুখোমুখি বসে কফি খাচ্ছে। হাসছে। কত-শত গল্পগুজব করছে। যেন অনেকদিন পর আচমকা ফিরে পাওয়া কোনো সোনালী দিনকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। সকালের নাশতা করতে এসে, দূর থেকে দুটো মানুষের এই হাসি ও গল্পের দৃশ্য দেখে মনে ব্যথা পেল মাহদিয়া। মেয়েটার হাসি, সৌন্দর্য, রূপ ও ফিটনেস সবকিছুই দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হলো সে। এত সুন্দর একটা মেয়ে! তা-ও শাদাবের সামনে বসে হাসিমুখে কথা বলছে! এত হাসিখুশি তো শাদাব তার সামনে থাকে না! মুখখানা সবসময় হুতুমপেঁচার মতো করে রাখে। দেখলে মনে হয়, অমাবস্যার সমস্ত আঁধার নেমে এসেছে ওই মুখে। অথচ আজ দেখছে উলটা। এই ছেলে এত চমৎকার হাসতে পারে! মন খুলে কথা বলতে পারে! দু’পা এগোনোর সাহস হলো না মাহদিয়ার। ভাবল ফিরে যাবে। অমনি মেয়েলী স্বরে ভেসে এলো,

-‘তুমি ভ্রমর না? মুখে হাসি নেই কেন? তোমাকে দ্যাখব বলে, সেই রংপুর থেকে ছুটে এলাম! খুব বেশি ভাগ্যবতী না হলে, আমার কপালটা ফুটা করে দিতে না।’

মাহদিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটা তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘মাশা’আল্লাহ্! ভীষণ সুন্দর তুমি। আমার ভাবনার চেয়েও সুন্দর। আমি তো ভাবতাম, সুন্দর আমি একাই। অথচ শাদাব আমার সমস্ত ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।’

শাদাবের দিকে তাকিয়ে রইল মাহদিয়া। সে একমনে সদ্য নষ্ট হওয়া ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখে নিজেকে ব্যস্ত পুরুষ দাবী করছে। দু’জনার মাঝখানে বসবে কি-না, এই নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেল বেচারি। এই মেয়েটাই বা কে! কী তার পরিচয় সেটা জানার জন্য কৌতূহল বাড়ল। তার সমস্ত ভাবনার মধ্যে জল ও বিস্ময় ঢেলে দিয়ে মেয়েটা বলল,

-‘মেডিক্যালে আমরা একসাথে ছিলাম। আমি ও’কে প্রপোজও করেছি। জানো, নবাবজাদা আমাকে সাতদিন ঘুরিয়েছে। এরপর একদিন পা ধরে লটকে গিয়ে বলে, ‘মাফ কর জাইমা। আজ থেকে তুই আমার বড়ো আপা। যেহেতু বয়সে তুই আমার দুই মাসের বড়ো। তাই তোকে আপা বলেই ডাকব। ছোটো ভাইয়ের দিকে ভুলভাল দৃষ্টিতে তাকাতে নেই। আমি বিবাহিত ব্যাচেলর। আমার বউ আছে। তুই সুন্দর এটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমার কাছে আমার বউ-ই পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। হ্যাঁ, সে তোর মতো রূপবতী নয়। কিন্তু যখনই আমি তার মায়াবী মুখখানি কল্পনা করি, তখনই আমার বুকের বামপাশে চিনচিনে এক ব্যথা শুরু হয়। এই ব্যথার নাম ভালোবাসা কি-না জানি না। ভালোবাসা না হলেও ‘ভ্রমর’ ছাড়া আমার জীবনে দ্বিতীয় কোনো নারী আসবে না। ও আমার প্রথম ও শেষ অনুভূতি।’ আমি তো ওর কথা বিশ্বাস করলাম না। ধরে নিলাম, ও আমাকে মিথ্যে বলছে। কারণ বয়স কম। বিয়ে কেন, ওই বয়সে কেউ কেউ তো প্রেমে পর্যন্ত জড়ায় না। শেষে ওর নিজের পুরনো মোবাইলে তোমার বেশকিছু ছবি দ্যাখাল। সেদিন থেকে আমি দেবদাসের বিরহে পারবতী হয়ে ছ্যাঁকা খেয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরছি আর হাউমাউ করে কাঁদছি।’

মাহদিয়া অবাক হয়ে তাকাল। দু’দিন ধরে যে শাদাবকে সে দেখেছিল, তার সাথে এই মেয়েটার বলা শাদাবের কোনো মিল নেই। কেউ নিজের প্রিয় অনুভূতির সাথে এইভাবে প্রতারণা করতে পারে? জেনে-বুঝে তাকে কষ্ট দিতে পারে? জাইমা এসব না বললে, কখনওই মুখফুটে কিছু বলত না শাদাব। এড়িয়েই যেত। ভাবনার অতলে হারিয়ে গেল মাহদিয়া। এমন সময় জাইমা আবারও বলল,

-‘শাদাব আমার কথা বলেনি না? বলবে কী করে? ওর মাথায় সারাক্ষণ তুমি! আমি যে ওর খুব ভালো বন্ধু ছিলাম, সেটা হয়তো ভুলেই গেছে।’

জাইমা কিছুটা কান্নামাখা রূপ ধারণ করে, ভাব দেখিয়ে নিজের চোখের পানি মুছল। মাহদিয়া এসব শোনে প্রথমে অবাক হলো। এরপর খুশি হলো। ঠোঁটে হাসি থাকলেও সমস্ত রাগ গিয়ে জমা হলো শাদাবের ওপর। আচমকাই পিছনে গিয়ে চুল ধরে টানাটানি শুরু করল। চমকে গেল শাদাব। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে নিল। পিছনে হাত বাড়িয়ে মাহদিয়াকে টেনে সামনে এনে পাশের চেয়ারে বসাল। বলল,

-‘এত ক্ষ্যাপছ কেন?’

-‘তো কী করব? নিজের অনুভূতি প্রকাশ না করে এইভাবে আমার ওপর টর্চার করেছ! আমার প্রতি এখন আর কোনো অনুভূতি-ই নেই তোমার। সব ফিঁকে হয়ে গেছে।’

গাল ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে আরও একগাদা অভিযোগ ঢালল মাহদিয়া। জাইমা মিটিমিটি হাসল এসব দেখে। শাদাবকে বলল,

-‘তুই নিজের অনুভূতিটুকু এখনও প্রকাশ করিসনি?’

জাইমার কথার উত্তরে শুধু নির্ভার হাসল শাদাব। মাহদিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল,
-‘স্ত্রীর প্রতি আমার সব শ্রদ্ধা, সম্মান ও অনুভূতি এখনও আগের মতোই জীবিত আছে, কিচ্ছু ফিঁকে হয়নি। যেদিন তার সাথে আমার আত্মিক ও বৈবাহিক সম্পর্ক পাকাপোক্ত হবে, যেদিন সে পুরোপুরি আহমাদ শাদাবের অর্ধাঙ্গিনী ও তার চিরচেনা ‘ভ্রমর’ হয়ে ধরা দিবে, সেদিনই আমার সব লুকায়িত অনুভূতি ডালপালা মেলবে।’

মাহদিয়া এবার শব্দ করে কিল বসিয়ে দিল শাদাবের হাতে। পরমুহূর্তে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে বসে রইল। শাদাব তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘তুমি যে এত হিংসুটে আমি জানতাম না।’

তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিল মাহদিয়া,
-‘এখানে হিংসার কী দ্যাখলে?’

শাদাব দু’দিকে মাথা নেড়ে মুচকি হেসে মাহদিয়ার নাকের ডগা সামান্য টিপে দিয়ে বলল,
-‘ও বিবাহিতা। দুই বাচ্চার মা। চাপ নিও না।’

বিস্ফোরিত চোখে তাকাল মাহদিয়া। কী থেকে কী ভাবল ইশ! মেয়েটা তাকে ভুল না বুঝলেই হলো! তার এই লাজুক লাজুক হাসি দেখে শাদাব নিশ্চিন্তমনে বলল,

-‘বসো চুপচাপ। নাশতা শেষ করো। আমার একটু শো-রুমে কাজ আছে। তুমি জাইমাকে সময় দাও। ছোটোন ঘুম থেকে উঠলে, পারলে ও’কেও একটু সঙ্গ দিও। চাচ্চুর জরুরী ফোন এসেছে, তা-ই তিনি চলে গেছেন। কখন ফিরবেন জানি না।’

তৎক্ষনাৎ চেয়ার ছাড়ল শাদাব। গতকাল বেখেয়ালিতে ফোনটা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একেবারে শেষ। জরুরী ফোন আসবে এতে। রোগী, হসপিটাল, কত-শত কাজ। আধমরা ফোন পকেটে ঢুকিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো চেক করে নিল একবার। তার এই তড়িঘড়ি কাজ দেখে মাহদিয়া অসহায় চোখে জানতে চাইল,

-‘এখুনি শো-রুমে কেন? ফিরবে কখন?’

-‘দু’ঘণ্টা লাগবে। নতুন ফোন কিনব। এটা অলরেডি নষ্ট হয়ে গেছে।’

পরক্ষণে জাইমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তোরা বসে গল্প কর। ফিরলে কথা হবে। পারলে তোর হাজব্যান্ড ও বাচ্চাদের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিস। নয়তো নদীনালা ভেসে যেতে পারে।’

মায়াভরা মুখ নিয়ে ঝলমলিয়ে হেসে উঠল জাইমা। শাদাব বলল,
-‘হাসছিস কেন বড়ো আপা?’

জাইমা বলল,
-‘তোদের এই টম এন্ড জ্যারি মার্কা ঝগড়াঝাটি দ্যাখে না হেসে পারা যায় না ভাই। কী কপাল আমার দ্যাখো! নব্য তারুণ্য মন নিয়ে যার প্রেমে পড়েছিলাম, সে আমাকে আপা বলে ডাকছে।’

মাহদিয়া নিজেও ভুবনভুলানো হাসি দিল। শাদাব আর দেরী করল না। বিদায় নিল। জাইমা বলল,
-‘এ্যাই ভ্রমর একদম হাসবে না। আমার কষ্ট তুমি ফিল করতে পারছ না।’

-‘আমি ফিল করে কী করব আপু? যে করার সে-ই তো করল না। উলটে বড়ো আপা বানিয়ে দিল।’

জাইমা হাসিমুখে বলল,
-‘বড়ো আপা হই আর যাই হই, তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। ও কিন্তু সত্যিই তোমায় ভালোবাসে। ভাগ্যবতী, সুখী হও।’

মাহদিয়া হাসল। নিজেকে এখনও সে ভাগ্যবতী ভাবতে পারছে না। ভয় হচ্ছে। খুব ভয়। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙন আসার ভয়। হারানোর ভয়। দূরে চলে যাওয়ার ভয়। সম্পর্কটাকে ঝুলন্ত রেখে চলে যাওয়ার ভয়! কত-শত ভয় ও যন্ত্রণা এসে উঁকি দিচ্ছে মনে। দীর্ঘশ্বাস হয়ে বুকের ভেতর লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। তাকে এইভাবে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে জাইমা বলল,

-‘কী ভাবছ ভ্রমর?’

-‘ভাবছি, সত্যিই ভাগ্যবতী কি-না! দীর্ঘ বছরের বিচ্ছেদের পর যখন দেশে ফিরলাম, তখনই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কী হবে জানি না, তবে ভীষণ ভয় পাচ্ছি।’

জাইমা সব জানে বলেই মাহদিয়ার মন খারাপের কারণটা ধরতে পারল। বলল,
-‘প্রকৃত ভালোবাসা ও পারফেক্ট জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনী সব মানুষের ভাগ্যে জুটে না। যারা এই শুদ্ধ ভালোবাসার দ্যাখা পায়, তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতী। সেদিক থেকে, তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী। শাদাব তোমাকে ভালোবাসে, এই কারণে ভাগ্যবতী বলছি না! দিনশেষে নিজের একটা বিশ্বস্ত মানুষ তুমি খুঁজে পাচ্ছ, এইজন্য বলছি। পৃথিবীর সব জায়গায় সুখ ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস নেই, যতখানি সুখ ও বিশ্বাস একজন প্রকৃত পুরুষের মাঝে আছে। ও প্রকৃত পুরুষ। যে নিজের মাকে সম্মান দিতে জানে, ভাইকে ভালোবাসতে জানে, বিচ্ছেদ নিশ্চিত জেনেও সম্পর্ককে মূল্য দিয়ে অপেক্ষা করতে জানে, তার ভালোবাসা পেয়েও নিজেকে অসুখী মনে কোরো না। ভয় দূরে সরাও। মন থেকে প্রার্থনা কোরো, একদিন সমস্ত দূরত্ব শেষ হয়ে যাবে ইন-শা-আল্লাহ্!’

জাইমার কথা ও সহমর্মিতায় খানিকটা সাহস পেল মাহদিয়া। উপরনিচ মাথা নেড়ে হাসল। একসাথে কফি খেল। শিহাব আসল সে-ও নাশতা করল। আড্ডা ও হাসি-ঠাট্টার মাঝেই মাহদিয়ার ফোন বেজে উঠল। নূরুন্ নাহার কল করেছেন দেখে কালক্ষেপণ সময় ব্যয় না করেই রিসিভ করে কানে ঠেকাল। ওপাশ থেকে নূরুন্ নাহারের ভীতিগ্রস্ত স্বরের কয়েকটা কথা শোনে স্তব্ধ হয়ে গেল মাহদিয়া। ফোন রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। শিহাবকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়ার মনঃস্থির করল। যা হয় হবে, আজ একটা হিসাব-নিকাশ হয়েই যাক। যাওয়ার আগে জাইমাকে বলল,

-‘আপু, আমি ছোটোনকে সাথে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। শাদাব ফিরলে ও’কে বোলো, ও যেন যত তাড়াতাড়ি পারে ওখানে পৌঁছায়।’

***

চলবে…