#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — ছাব্বিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
গাড়ি থেকে নেমে অবাক করা এক দৃশ্যের সাক্ষী হলো শিহাব। একই বাড়ি, একই ডিজাইন, একই কাঠের ঘর। শুধু নেমপ্লেটে লেখা ‘সুখনীড়’। নিচের নামদুটো পড়েই শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম ছুটল তার। বিস্মিত চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল নামের দিকে। রংচঙ উঠে গেলেও দুটো নামই স্পষ্ট। এমদাদ কায়ছার ও ইরফান হায়দার। কুঞ্চিত ভ্রু ও বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে কাঠের ঘরটার দিকে তাকাতেই অবুঝ মনের ভেতর হাজারও প্রশ্নেরা ভীড় জমাল। সব ঠিক মনে হলেও, পার্থক্য চোখে পড়ল একটা জায়গায়। তাদের নতুন বাড়ির সামনে রঙবেরঙের ফুলের বাগান আর এখানে দুটো বড়ো বড়ো চৌবাচ্চা। তাতে ছোটাছুটি করছে কয়েক ধরনের ছোটো বড়ো ও মাঝারি মাছ ও মাছের পোনা। সে বিস্মিত চোখেই গাছের উপরে থাকা সেই পুরনো কাঠের ঘরটা মাহদিয়াকে দেখিয়ে বলল,
-‘ওই ঘরটা কার দিয়াপি? এরকম হুবহু একটা ঘর আমাদের নতুন বাড়িতেও আছে।’
দুঃশ্চিন্তায় তখন দিশেহারা অবস্থায় ছিল মাহদিয়া। শিহাবকে কার কাছে, কোথায় রেখে আসবে এটাই ভেবে পাচ্ছিল না। শুধু কানে বাজছিল, শাদাবের কথা। ওকে একটু সঙ্গ দেয়ার কথা। এইটুকু ভেবে ও এখানকার ঝামেলার কথা ভেবে অচেনা একটা জায়গায় শিহাবকে একা রেখে আসার সাহস হয়নি তার। তাই কোনোদিক বিবেচনা না করেই চলে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই যে অবুঝ বাচ্চার মুখে এমন একটা আশ্চর্যজনক কথা শুনতে হবে, এ-ও কল্পনাতে আনেনি। তবে মনে মনে সাহস ও বুদ্ধি সঞ্চয় করে রেখেছিল। এক ফাঁকে চুপিসারে নূরুন্ নাহারকে ফোন করে, কিছু সমাধান ভেবে রেখেছে। কোনোভাবেই অসুস্থ শিহাবের মনের ওপর আজেবাজে প্রভাব পড়তে দিবে না। তাই কোনোপ্রকার দ্বিধা ছাড়াই বলল,
-‘একই ডিজাইনের বাড়ি কত আছে! চলো, ভেতরে চলো।’
হ্যাঁ! একই ডিজাইনের বাড়ি আছে। একই নামের মানুষও আছে। একই নামের ভাই ও বোনও আছে। তবুও কোথাও যেন মনের ভেতর একটা কিন্তু এসে জন্ম নিল। শিহাব সেটাকে পাত্তা দিল না। আবার এড়িয়েও যেতে পারল না। মাহদিয়ার হাত ধরেই ‘সুখনীড়’-এর ভেতরে পা রাখল। গুটি গুটি পা ফেলে ভেতরে আসতেই দরজার সামনে ছুটে এলেন নূরুন্ নাহার। মাহদিয়া তাকে চোখ দিয়ে ইশারা করেই ঝটপট শিহাবকে ভদ্রমহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কী কী বলেছি, মনে আছে?’
নূরুন্ নাহার মাথা নাড়লেন। শিহাব এখানে তার প্রিয় নাহার খালাকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। হাত ধরে ভেতরে এগোতে এগোতে বলল,
-‘তুমি এখানে থাকো খালা? আমাকে আগে কেন ঠিকানা দাওনি? জানলে আমি ভাইয়াকে নিয়ে ছুটে আসতাম।’
নূরুন্ নাহার তার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে, শায়লা সুলতানা ও কায়ছার সাহেবের নজর এড়িয়ে মাহদিয়ার রুমের দিকে পা বাড়ালেন। তিনি যতই লুকিয়ে-চুরিয়ে কাজ করতে গেলেন, ততই ব্যাপারটা কায়ছার সাহেবের চোখে আরও বেশি করে লাগল। তিনি জরুরী কাজ ফেলে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
-‘ওই ছেলেটা কে নাহার?’
আওয়াজ শোনে শায়লা সুলতানা সামনে তাকালেন। শিহাবকে দেখেই স্থির হয়ে গেলেন। নূরুন্ নাহার আমতা-আমতা করে কিছু বলবার আগেই চট করে দু’হাত সামনে মেলে বাঁধা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাহদিয়া। মুখে হাসি টেনে বলল,
-‘ওসব তোমার জানার দরকার নেই বড়ো মামা। তুমি বরং যে কাজে ব্যস্ত, সেটাই কোরো।’
শিহাবের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
-‘রুমে গিয়ে বোসো। দিয়াপি তোমার জন্য নাশতা নিয়ে আসছে।’
নূরুন্ নাহার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ঝড়ের বেগে ড্রয়িংরুম ক্রস করলেন। শিহাব পিছন ঘুরে একবার কায়ছার সাহেবের দিকে তাকাল। তিনিও তাকিয়ে ছিলেন। চোখাচোখি হতেই নিষ্পাপ মুখ নিয়ে হাসল শিহাব। তবে সেই হাসি ও মুখের ভাবভঙ্গি, শরীরের ফিটনেস দেখে কায়ছার সাহেবের তখনই মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। তিনি দপ করে বসে পড়লেন সোফায়। মাহদিয়া কাছে আসলো। উকিল সাহেবের কাছ থেকে দলিলপত্র টেনে নিয়ে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তেই চোখে বিস্ময়, রাগ ও হাজারও প্রশ্নেরা এসে ঘুরপাক খেতে লাগল মাথায়। দলিল নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াল। শক্ত কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি কি রাস্তার ফকির? তোমার টাকা-পয়সার অভাব? এতগুলো বছর বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে ইনকাম তোমার জন্য করে ব্যাংকভর্তি টাকা জমিয়েছে, তা দিয়ে তুমি আরও এক যুগেরও বেশি সময় পায়ে পা তুলে খেতে পারবে কোনো কাজকর্ম ছাড়া। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও অনেক জায়গাজমি আছে। তোমার নিজেরও ইনকাম আছে। এত টাকা-পয়সা চারপাশে থাকার পরও এই বাড়ির সম্পত্তির দিকে হাত বাড়ানোর সাহস হয় কী করে তোমার? সম্পত্তি দরকার বাবাকে বোলো। দুই ভাইয়ের প্রাপ্ত হক্ব কেন নষ্ট করে দিচ্ছ তুমি?’
মাহদিয়ার এই রাগী ও মেজাজী স্বর শিহাবের কানে গেল না। ততক্ষণে তাকে রুমে নিয়ে মিউজিক প্লেয়ার অন করে দিয়েছেন নূরুন্ নাহার। ড্রয়িংরুমের কোনো শব্দই সে আর শুনবে না। শিহাব না শুনলেও মেয়ের এই চিৎকারে কেঁপে উঠলেন শায়লা সুলতানা। কী বলবেন ভেবে পেলেন না! তিনি এখনও বুঝতে পারছেন না, মাহদিয়া এসব জানল কী করে? মেয়েটা শাদাবকেও পেয়ে গেল, দলিল ও সম্পত্তির কথাও জেনে গেল! এখন কীভাবে সবকিছু সামলাবেন? কী বলে মেয়েকে বুঝাবেন? গলা শুকিয়ে তক্তা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। তিনি আহত চোখে কায়ছার সাহেবের দিকে তাকালেন। কায়ছার সাহেব বোধহয় জবাব তৈরী করেই রেখেছিলেন। মাহদিয়ার কথার পিঠে তিনি-ই উত্তর দেন,
-‘যাদেরকে আমি মৃত বলেই মানি, তাদের আবার কীসের হক্ব? মৃত মানুষের হক্ব বলতে কিছু নেই!’
মাহদিয়া হাসিমুখে কথা মেনে নিল। দু’জনার সামনে দাঁড়িয়েই দ্বিতীয়বার দলিল ছিঁড়ে ফেলার মতো দুঃসাহস দেখাল। টুকরো টুকরো অংশগুলো কায়ছার সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কথায় আছে না, ‘রাখে আল্লাহ্, মারে কে!’ এইবেলায়ও এটাই ঘটেছে। আল্লাহ্ চাইলে, কি-না হয়! যাদের তুমি মৃত বলে ধরে নিয়েছ, তারা বেঁচে আছে। জীবিত সন্তানের হক্ব নষ্ট করার মতো অন্যায় তুমি করতে পারো না। অবশ্য তোমার কাছে পাপপুণ্য ও ন্যায়-অন্যায়ের মূল্য কীসের! তুমি তো পনেরো বছর আগেই নিজের না আসা সন্তানকে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই মেরে ফেলতে চেয়েছিলে!’
-‘তুমি এত নিশ্চিত কী করে ওরা বেঁচে আছে?’
উপরের দিকে আঙুল তুলে মাহদিয়া বলল,
-‘ওইযে, মাছুম বাচ্চাটাকে দ্যাখলে! সে-ই তোমার ঔরসজাত সন্তান। যাকে তুমি সম্মান ও অহমিকার বাহানা দ্যাখিয়ে মে রে ফেলার মতো বাজে একটা কাজ করেছিলে।’
শায়লা সুলতানা ডানহাতে মুখ ও কপাল মুছলেন। তিনি বুঝতেই পারছেন না, মাহদিয়া এতকিছু কী করে জানে! যদি এটা জানে যে, শাদাব প্রতি সপ্তাহে ইতালিতে ফোন করে নিজের বৈধ স্ত্রীর সাথে কথা বলতে ও তার ছবি দেখতে চাইত, তখন মেয়েটা কতটা রি’অ্যাক্ট করবে? শাদাব যেহেতু সঙ্গে ছিল, এসব তো জেনে যাওয়ার কথা! আতঙ্কে যেন জমে যাচ্ছেন তিনি। মায়ের হাবভাব ও তার ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ বড্ড চোখে লাগল মাহদিয়ার। মস্তিষ্ক এসব নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সিগন্যাল দিল না। সে মায়ের কাছে এসে মিষ্টি স্বরে বলল,
-‘বলেছিলাম না, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে? এটাই তোমার সারপ্রাইজ। আমি ওদের খোঁজ পেয়েছি মা। এই শিহাবই সায়রা আন্টির কষ্ট ও ধৈর্যের ফল। চিন্তাভাবনা সৎ থাকলে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে নিরাশ করেন না। আমার ধৈর্য ও এত বছরের অপেক্ষা বিফলে যায়নি মা। আমি ঠিকই ওদের খোঁজ পেয়েছি।’
মাহদিয়ার কথায় ভয় দূর হলো তাঁর। মেয়ে তাহলে কিছুই জানে না। শুধু খোঁজই জানে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তিনি বললেন,
-‘তুই সত্যি বলছিস দিয়া? ওই বাচ্চাটা সায়রা আপার সন্তান? ও বেঁচে আছে। আপা কেমন আছেন জানিস? কোথায় আছেন?’
মাহদিয়া খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
-‘আছেন। খুব ভালো আছেন।’
যতটা আবেগ ও ভালোবাসা মিশিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল, ততটাই রাগ ও জেদ থেকে দ্রুত ছেড়ে দিয়ে বলল,
-‘এটা কী করতে যাচ্ছিলে মা? আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি এইসব দলিল…!’
কথা শেষ করার আগেই শায়লা সুলতানা বললেন,
-‘এসব তো তোর বড়ো মামা জোরপূর্বক গছিয়ে দিচ্ছেন। বার বার বলছেন, কতদিন আর বাঁচবেন, টোটোনের অংশটা তোর নামে থাকলে তোর অধিকারটাও এই বাড়িতে চিরস্থায়ী থাকল। এই ভেবেই।’
মাহদিয়া মলিনমুখে বলল,
-‘জায়গা-সম্পত্তির অধিকার দিয়ে কী করব মা? যার জন্য ছুটে আসা, তাকেই তো অধিকার দিয়ে আজও নিজের করতে পারলাম না।’
এবার সত্যি সত্যিই চমকালেন শায়লা সুলতানা। যে শাদাব তার ‘ভ্রমর’ বলতে অজ্ঞান সে কেন তার স্ত্রীকে কাছে পেয়েও নিজের বলে দাবী করছে না। বিস্ময় নিয়েই জানতে চাইলেন,
-‘কী বলছিস? কেন?’
-‘শাদাব আমাকে দুটো অপশন দিয়েছে। একটাকে বাছাই করতে হবে আমায়। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা। সম্মান করি। আমাদের বন্ধনটা সারাজীবন অটুট থাকুক এটাই সব সময়ের প্রার্থনা আমার। কিন্তু শাদাবকেও ত্যাগ করার মতো এত সাহস আমার নেই। আমি ও’কে ভালোবাসি। কিন্তু বুঝাতে পারছি না। ওর একটাই কথা, ‘হয় তুমি তোমার মা’কে বেছে নাও, নয় আমাকে।’ আমিও বলে দিয়েছি, আমার তোমাদের দু’জনকেই চাই।’
শায়লা সুলতানা নির্ভার হাসলেন। জয় এবার নিশ্চিত। শাদাব কিছুই করতে পারবে না। মেয়ে মা’কে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে, এইটুকুর চেয়ে কঠিন সত্য আর কী আছে! কোনোমতে উদ্দেশ্য সফল করে চলে যেতে পারলেই হলো। তিনি মাহদিয়াকে আরেকটু বাজিয়ে দেখতে বললেন,
-‘তুই এক কাজ কর, ও’কে বল আমার সামনে আসতে। কেন এমন একটা অপশন দিল আমিও জিজ্ঞেস করব ও’কে।’
মনে মনে হাসল মাহদিয়া। দু’জনকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে। কে মিথ্যে, কে সত্যি এটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। সে-ও মায়ের সামনে ধোঁয়াশা রেখে বলল,
-‘আসবে তো, একটু পরই এখানে আসবে।’
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন শায়লা সুলতানা। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে বললেন,
-‘কী? ও কেন এখানে আসবে?’
মায়ের স্বরে কিছু একটা ছিল! মাহদিয়ার চোখমুখে বিস্ময়, যন্ত্রণা ও হাহাকার নেমে এসে পুরো মুখখানি মলিন হয়ে গেল। বুকটা কেঁপে উঠল তার। মন ডুকরে কেঁদে উঠল। তবুও মুখে হাসি টেনে বলল,
-‘উকিলের সাথে কথা বলে ওর প্রাপ্য অংশটুকু নিজের নামে লিখিয়ে নিবে।’
ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে মাহদিয়া। খোদার দরবারে কাকুতিমিনতি করছে। তার ধারণা ভুল হয়ে যাক। সামান্য সম্পত্তির জন্য আজকের এই দিন সত্যি না হোক। সে মাকে সন্দেহ করতে চাইছে না। সম্পত্তির প্রতি মায়ের কোনোপ্রকার লোভ আছে কি নেই, শুধু এটা দেখতে চাইছে। নয়তো সে যাওয়ার পরই কেন এত তাড়াহুড়ো করে দলিলপত্র তৈরী করতে হবে! দেশে তো তিনমাসের জন্য এসেছে। অল্পসময়ে কেন এত অধৈর্য্য হচ্ছেন তিনি? কেনই-বা বার বার সম্পর্কটাকে অস্বীকার করার কথা বলছেন! কিছুই বুঝতে পারে না তার মন। সন্দিহান মন নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। শায়লা সুলতানা মেয়ের কথায় থম মেরে থাকেন প্রথমে। পরক্ষণেই নাটুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে চোখেমুখে ওড়না চেপে বললেন,
-‘ভাইজান, আপনাকে কত করে নিষেধ করলাম আমি! কতবার বললাম, ওদের কথা ভাবতে। ওরা আপনার সন্তান। আপনি ওদের অংশটুকু, দুই ভাইয়ের নামেই লিখিয়ে আনেন।’
এমদাদ কায়ছার কিছুই বললেন না। তিনি শুধু চান, এই সম্পত্তির মালিক মাহদিয়া হোক। যেহেতু সে শাদাবের বিবাহিতা স্ত্রী ও এই বাড়ির বউ। সেই হিসাবেই। তবে এই সম্পত্তির অংশ ছেলেদের নামে দিতে পারবেন না। ওই ছেলেটা যে তাঁর নিজেরই সন্তান, এটাই তো তিনি মানতে পারছেন না। প্রচণ্ড বিরক্তি ও রাগের সাথে বললেন,
-‘আমার কোনো সন্তান নেই। যে ছিল সে পনেরো বছর আগেই মারা গেছে।’
-‘কিন্তু ওই ছেলেটা! ও’কে কী করে অস্বীকার করবেন আপনি?’
-‘কেউ এসে নিজেকে আমার সন্তান দাবী করলেই আমি তা বিশ্বাস করে নিব কেন? হতেও তো পারে, এটা আমাকে রাস্তায় বসানোর একটা টেকনিক। তোমার মেয়ে বার বার আমাকে অপমান করছে। অথচ আমি ও’কে এই বাড়ির বউ হিসেবেই সম্পত্তির ভাগ দিতে চাইছি।’
মাহদিয়া দু’হাতে তালি বাজাল। বলল,
-‘খুব সুন্দর কথা বলেছ বড়ো মামা। সন্তানকে মৃত মানো, আবার মৃত সন্তানের বিবাহিতা স্ত্রীকে বাড়ির বউয়ের সম্মান দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ। রাস্তায় তো তুমি সেদিনই বসেছ, যেদিন নিষ্পাপ তিনটে প্রাণকে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে! ওইদিন ওই মানুষগুলোর সাথে সাথে তুমিও রাস্তায় বসেছ। তোমার ধন-সম্পদ থাকলেও মানুষ হওয়ার যে স্বচ্ছ একটা বিবেক ও সুন্দর মনের দরকার, সেটাই তোমার নেই। বিবেকহীন মানুষ সবসময় পশুর সমান হয়। তুমি তার থেকে ব্যতিক্রম কেউ নও।’
ঠাস করে শব্দ হলো শুধু। সেদিনের মতো মায়ের হাতের আরও একটা চড় খেল মাহদিয়া। খেয়াল ছিল না বলে, টি-টেবিলের ওপরেই পড়ে গেল। কাঁচের টেবিল ভেঙে কপালেও খানিকটা ব্যথা পেল। হাত রাখতেই রক্তে ভরে গেল তার হাত। ব্যথিত চোখে মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
-‘বুঝতে পারি না মা, একজন বিবেকহীন মানুষের জন্য তুমি বার বার আমার গায়েই কেন হাত তুলো!’
শায়লা সুলতানা ধৈর্যের সীমা ভুলে চেঁচিয়েই বললেন,
-‘যে পুরুষ সন্তানকে নিজের মায়ের থেকে আলাদা করতে চায়, তুই তার হয়ে সাফাই গাইবি আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব, তা কী করে হয় দিয়া? পনেরো বছর আগে অমানুষ যদি ভাইজান হয়েও থাকেন, তবে পনেরো বছর পর আজ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে টোটোন নিজেও। ওর উদ্দেশ্য যদি ভালো হোতো, এমন অহেতুক অপশন তোকে দিত না। একটা খারাপ মনের মানুষের জন্য তুই নিজের পিতৃতুল্য বাবার সাথে বেয়াদবি করছিস! ছিঃ।’
চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল মাহদিয়া। শব্দহীন কান্না সাথে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে। রান্নাঘরে গিয়ে মুখে পানিঝাপটা দিয়ে কপালের কাটাছেঁড়া অংশ পরিষ্কার করে, ঝটপট শিহাবের জন্য সামান্য নাশতা বসাল। ততক্ষণে উকিল সাহেব সেখান থেকে চলে গেলেন। শায়লা সুলতানা নিজেই তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদায় করে দিলেন।
***
টাচ্ ফোন নষ্ট হলেও, পুরনো সেই নোকিয়া ফোনটা তখনও ব্যবহার করত শাদাব। ওটা সবসময় তার সাথে থাকত। আজও ছিল। ওটাতে পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সব নম্বর সেইভ করা আছে। তাই অন্য ফোন নষ্ট হলেও নম্বরের জন্য তাকে খুব বেশি জ্বালাযন্ত্রণা কিংবা ভোগান্তিতে পড়তে হোতো না। শো-রুমে যাওয়ার পথেই জাইমাকে ফোন করেছিল, শিহাব ঘুম থেকে উঠেছে কি-না এটা জানার জন্য। এরমধ্যেই জাইমা শুধু বলেছে, ‘ভ্রমর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে মাত্র…।’ ঝড়তুফান কিংবা প্রাকৃতিক তাণ্ডবের দরকার নেই, শাদাবকে ভেতর থেকে তছনছ করে দিতে এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল! কীসের শো-রুম, কীসের ফোন, যেভাবে বেরিয়েছিল ওভাবেই মাঝপথে গাড়ি ঘুরিয়ে ‘সুখনীড়’-এর পথে রওনা দিয়েছে সে। ওখানে বেশিক্ষণ থাকা মানে, শিহাবের জীবন ঝুঁকি। ফুলস্পীডে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে চারপাশে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনি শাদাব। দৌড়ের ওপর সোজা মূল দরজার সামনে এসে পা থামিয়েছে। ভেতরের থমথমে পরিস্থিতি ও দুই মুখোশধারী মানুষের চিরচেনা রূপ দেখে চোখ ঘুরিয়ে শিহাবকে খুঁজল। ডানে-বামে, সামনে-পিছনে কোনোদিকেই ভাইকে না পেয়ে ভয়ে-আতঙ্কে প্রায় হুংকার ছাড়ল শাদাব। চিৎকার করে শিহাবকে ডাকল,
-‘শিহাব, কোথায় তুমি? ভাইয়া এসেছি। ফিরতে হবে আমাদের। তাড়াতাড়ি এসো।’
আচমকাই শাদাবের গলার আওয়াজে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো মাহদিয়া। নাশতাটা এখনও তৈরী হয়নি। ছেলেটা নিজের বাড়িতে প্রথম এলো, কিছু না খেয়ে চলে গেলে কেমন দেখায়! সে শাদাবের সামনে এসে বলল,
-‘তুমি বোসো, আমি ও’কে ডেকে আনছি।’
মেজাজটা চরম খারাপ! মাহদিয়াকে বকতেও পারছে না, কিছু বলতেও পারছে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার ঘৃণা হচ্ছে। ক্রমশ রাগ বাড়ছে। সবকিছু ভেঙেচুরে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজের রাগ ও আত্মসম্মানবোধ থেকে চোখ গরম করে মাহদিয়ার দিকে তাকাল। বলল,
-‘মাথামোটা মেয়ে! ও’কে নিয়ে আসার আগে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করবে না? যদি ওর কিছু হয়…।’
বাকি কথা বলতে পারল না শাদাব। টেনশনে বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। শাদাবের চিৎকার ও রাগ দূর থেকেই দেখছিলেন নূরুন্ নাহার। তিনি ঝটপট শিহাবকে বাইরে নিয়ে আসলেন। শাদাবের হাতে তাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-‘যত তাড়াতাড়ি পারো চলে যাও। আর এই শহরে এসো না। এখানে যদি খু নাখু নিও হয়ে যায়, তবুও আসবে না। যাও…!’
শিহাব তখনও কিছু বুঝতে পারছে না। সে ভাইয়ের রাগ ও মাহদিয়ার রক্তাক্ত মুখ দেখে চমকে গেল। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
-‘দিয়াপি, কী হয়েছে তোমার? ব্যথা পেয়েছ কী করে?’
শাদাব নিজেও তা লক্ষ্য করল ঠিকই, কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চাইল না। এখনও রাগ ও মেজাজকে সে কন্ট্রোল করতে পারছে না। দুটো হাতকে মুঠোবন্দী করে রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। শিহাবের প্রশ্নের উত্তরে মাহদিয়া মন খারাপের সুরে বলল,
-‘মা আমাকে একটু বেশি-ই ভালোবাসে তো! এটা সেই ভালোবাসারই দাগ!’
জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে শিহাব ফের বলল,
-‘ভালোবাসার দাগ এমন হয়?’
-‘হয় তো, খুব হয়! যারা তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসে, সুযোগ পেলে তারাই খুব বেশি কষ্ট দেয়।’
এখানে যে একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার সম্পর্কে কোনো আইডিয়া হলো না শাদাবের। তবে এটা বুঝল, কোনো কারণে শায়লা সুলতানা নিজের মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন। সে দু’হাতে শিহাবকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে মাহদিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘মাথার মধ্যে যদি গিলু বলে কিছু থাকে, তবে আজকের বিষয়টা নিয়ে একটু ভালোমতো ভাবনাচিন্তা করে, সিদ্ধান্ত নিও। আজ যে ভুল তুমি করেছ, এরপর আমি আর যোগাযোগ করব না। কোনোভাবেই না।’
শাদাবের কথা শোনে মনে ব্যথা পেলেও হাসল মাহদিয়া। কিছু বলে নিজের দিকটা পরিষ্কার করার সুযোগ নিল না। দু’জনের দৃষ্টি ও অভিমানের সীমা-পরিসীমা দেখে নূরুন্ নাহার বললেন,
-‘দিয়ার কোনো দোষ নেই টোটোন। আমি-ই ও’কে আসতে বলেছি। বড়ো ভাইজান সব সম্পত্তি শায়লা আপার নামে দিতে চাইছিলেন, তাই।’
এইটুকু বলে তিনি শাদাবের ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করলেন। শাদাব কতটা বুঝল, সেটা তার শান্ত, অবিচল ও স্থির চোখই জানান দিল। কথা বাড়িয়ে দেরী করতে চাইল না। শিহাবকে নিয়ে সদর দরজার সামনে এগোতেই পিছন থেকে কায়ছার সাহেব হুমকি দিয়ে বললেন,
-‘তোমার সাহস তো কম নয়! আমার বাড়িতে এসে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে গলাবাজি করছ! তোমার ভাগ্য ভালো যে, আমি এখনও তোমার গলায় ছু রি বসাইনি।’
পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাইছিল শাদাব। কোনোমতে শিহাবকে এখান থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে! অথচ তা আর হলো না। এমদাদ কায়ছারের এই জঘন্য কথা শোনে ধৈর্যের সবটুকু বাঁধ ভেঙে গেল তার। পিছু ঘুরে চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘ছু রি চালানোর মতো সাহস আপনার আছে? কাপুরষ কোথাকার! নিজের মাথায় বুদ্ধি নেই? বাইরের মানুষের কথায় যে নিজের স্ত্রীর ওপর হাত উঠায়, তার আবার বাহাদুরি আসে কোথা থেকে! লজ্জা হওয়া উচিত আপনার। শুধুমাত্র আপনার জন্য যে খারাপ পরিস্থিতি আমার ওপর দিয়ে যাচ্ছে তার প্রত্যেকটা দিনের হিসেব চুকিয়ে ছাড়ব আমি। দ্যাখব, কে কার গলায় ছু রি বসায়!’
ঠিক একইভাবে শায়লা সুলতানার দিকেও তাকাল। ওনার ভীতিগ্রস্ত মুখের ঢোক গেলা ভাব দেখে চোখ নাচিয়ে বলল,
-‘আপনি ভয় পাবেন না। আপনার সম্পর্কে যতটুকু প্রমাণ আমার হাতের মুঠোয় আছে, তা দিয়ে চাইলে এক্ষুণি মা ও মেয়েকে চিরদিনের জন্য আলাদা করে দিতে পারি আমি। নেহাৎ আমি ওই কাপুরষটার মতো নই! নয়তো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতেই পারতাম। কারও সরলতার সুযোগ নিয়ে, ভালো মানুষীর মুখোশ পরে তার বুকে ছু রি বসিয়ে বিশ্বাসে আঘাত করার মতো সুযোগসন্ধানী, লোভী মনও আমার নেই।’
উদ্ভট পরিস্থিতি দেখে ভয় পাচ্ছে শিহাব। কার কথা শুনবে, কাকে কীভাবে বুঝবে, কিছুই তার ছোটো মাথায় ঢুকছে না। থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে শাদাবের কোমরের কাছটায় শক্ত করে ধরল সে। কেঁপে কেঁপে বলল,
-‘ভাইয়া, আমি বাড়ি যাব।’
চটজলদি শিহাবের দিকে নজর দিল শাদাব। তার অসহনীয় চাহনি ও ভয়মাখা মুখশ্রী দেখে আঁৎকে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল শিহাব। ঢলে পড়ল শাদাবের দু’হাতের মাঝখানে। তার সমস্ত শরীরে কাঁপুনি বেড়ে গিয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে গেল। অস্ফুটস্বরে ‘ইন্না-লিল্লাহ্’ পড়ে তড়িঘড়ি তাকে হাঁটুর ওপর রেখে মেঝেতে বসল শাদাব। নূরুন্ নাহারকে তাড়া দিয়ে বলল,
-‘খালা, একটা শুকনো টাওয়েল দাও, কুইক।’
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — সাতাশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
যখন শিকড়ে টান লাগে, রক্ত কথা বলে, তখন হিংসাত্মক মনোভাবাপন্ন মানুষের মনের কোণেও দয়ামায়া জেগে উঠে। নাড়িরটান যেমন অস্বীকার করা যায় না, রক্তকেও তেমন অস্বীকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে মানুষ। শিহাবের এই আচমকা মূর্ছা যাওয়াতেই কায়ছার সাহেবের মনের ভেতর ফেলে আসা দিন, সন্তানের প্রতি মায়া-মমতা ও আত্মিক টান থেকেই পিতৃত্ব জেগে উঠে। ভুল-সঠিকের বিচার ভুলে গিয়ে তিনি স্তব্ধ চোখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকেন অবুঝ বাচ্চাটার দিকে। বুকের ভেতর যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করছে। সেই আঘাতের ভারে তিনি হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে অস্থির মন নিয়েই অগ্রসর হোন বাচ্চাটার দিকে। পিতৃত্বের টান ও একজন সাধারণ বিবেকবান মানুষের ন্যায় ছুটে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁয়ে জানতে চান,
-‘কী হয়েছে ওর?’
মেজাজ এমনিতেই চড়া ছিল শাদাবের। নাকের ডগায় রাগ, ঘৃণা ঝুলেছিল। সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে এলো তা। যেভাবে তিনি ডানহাত বাড়িয়ে শিহাবকে ছুঁতে চেয়েছিলেন, সেভাবেই শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কায়ছার সাহেবের হাত চেপে ধরল শাদাব। আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলন্ত চোখ ও টগবগে রাগকে ঠোঁটের সামনে রেখে চিৎকার করে বলল,
-‘একদম ছোঁবেন না ও’কে। ও শুধু আমার ভাই! কোনো অমানুষের সামান্যতম অধিকার নেই ওর গায়ে হাত দেয়ার। যেদিন নিজের সন্তানকে মে রে ফেলার মতো দুঃসাহস দ্যাখিয়েছেন, সেদিনই ওর ওপর থেকে সমস্ত অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন আপনি।’
এটা যে শাদাব তিনি নিশ্চিত ছিলেন। হাতের সেই কালসিটে দাগ দেখেই। যা শাদাবের জন্মদাগ হিসেবেই পরিচিত। এই দাগটা প্রথমে ছোটো ছিল। সে যত বড়ো হয়েছে, তত কনুই ঘিরে বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। গুটানো শার্টের হাতা ও শাদাবের হাতের কালসিটে দাগ খেয়াল করেই তিনি ফিরে গেলেন ছেলের জন্মদিনের দিনটায়। কত আনন্দ, কত সুখ নিয়ে এই ছেলে পৃথিবীতে এসেছিল। পিতৃত্বের স্বাদ দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিল তাঁর বুকখানি। অথচ দীর্ঘবছর ধরে আদরের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন না তিনি। আচানক এই শূণ্যতা তাঁকে দুর্বল করে দিল। তিনি ভাঙা গলায় উচ্চারণ করলেন,
-‘কিন্তু টোটোন…!’
-‘ব্যস…। আপনার পাপী মুখ দিয়ে ওই শব্দটা আর একবারও উচ্চারণ করবেন না। আপনার চেনা টোটোন পনেরো বছর আগেই মারা গেছে। যে আছে, সে শুধু তার মায়ের একার সন্তান। ওই নামে শুধু তার মায়েরই ডাকবার অধিকার আছে। দূরে যান আপনি। নয়তো আপনার এই পাপিষ্ঠ হাত আমি এক্ষুণি ভে ঙে ফেলব!’
কায়ছার সাহেব সরে গেলেন। একমুহূর্তও আর ওই স্থানে থাকার মতো ধৈর্য পেলেন না তিনি। ঝটপট হাতে শিহাবের পরনের টি-শার্ট খুলে ফেলল শাদাব। কম্পনরত শরীরটাকে একপাশে কাত করে রেখে দিল। মুখের সবটুকু লালা ঝরে যাওয়ার সুযোগ করে দিল। সম্পূর্ণ শরীর ততক্ষণে ঘেমে-নেয়ে একাকার। একটা সময় কাঁপুনি থামল। খিঁচুনি থামার পর বেশ খানিকক্ষণ তাকে শান্ত হয়ে থাকার সুযোগ দিল শাদাব। সিলিংফ্যানের বাতাসেও তার শরীরের ঘাম থামছিল না। টাওয়েল ভিজিয়ে পুরো শরীর মুছে দিল। মাহদিয়া একটা হাতপাখা এনে সেটা দিয়ে বাতাস করল। একটা সময় স্থির শিহাব স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করে ঘুমঘোর চোখদুটো টেনে খোলবার চেষ্টা করল। শরীরের সবটুকু শক্তি তার হারিয়ে গেছে। পুরো শরীর টলছে। সে তখনও বুঝতে পারছে না কোথায় আছে। শুধু জ্ঞান ফেরার পর শাদাবকে চিনতে পেরে আধবোঁজা চোখেই বলল,
-‘মা কোথায় ভাইয়া?’
আগামী কয়েকটা ঘণ্টা শিহাব বেহুঁশের মতোই আচরণ করবে। এমনটা প্রায়শই করে। বছরে দুই থেকে তিনবার। এত ডক্টর, এত ট্রিটমেন্ট, তবুও তার এই সমস্যাটা শেষই হচ্ছে না। ভাইয়ের কথা শোনে তাকে সোজা করে বসিয়ে দু’হাত দিয়ে আগলে নিয়ে বলল,
-‘মা তো বাড়িতে।’
চোখ পিটপিট করে পূণরায় চারপাশে তাকাল শিহাব। কিছুই চিনতে পারল না। সামনের মানুষজনকেও চিনল না। নরম স্বরে বলল,
-‘আমরা কোথায় আছি? বাড়ি যাব কখন?’
শাদাবের ইচ্ছে হলো বলতে, ‘একটা জাহান্নামে আছি’ কিন্তু ভাইয়ের অসুস্থতার দিক ভেবে এড়িয়ে গেল। বলল,
-‘এইতো, এক্ষুণি চলে যাব। এখন কি একটু ভালো লাগছে?’
ঠোঁট চেপে দু’দিকে মাথা নাড়ল শিহাব। তার মাথা ঘুরছে। পেটের ভেতর ঘুলিয়ে আসছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো বমি করে ভাসিয়ে দিবে। শাদাব এটা জানে! তাই অপেক্ষা করছে ওর বমিটা হচ্ছে কি-না এটা দেখার জন্যই। নয়তো এতক্ষণে গাড়িতে উঠে যেত। কয়েক মিনিট পরই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল শিহাব। শাদাব সেই সুযোগটাই কাজে লাগাল। দু’হাতে ভাইকে কোলে তুলে দ্রুতপায়ে বাড়ি থেকে বের হলো। নূরুন্ নাহার ও মাহদিয়াও এগিয়ে এলো। সুবিধামতো শিহাবকে গাড়িতে শুইয়ে খুলে রাখা টি-শার্ট আবারও পরিয়ে দিল। মাহদিয়া হাত বাড়িয়ে অবুঝ বাচ্চাটার গাল ছুঁয়ে তার অসুস্থ মুখখানির দিকে তাকিয়ে অনুশোচনার স্বরে বলল,
-‘আ’ম স্যরি শাদাব। বুঝতে পারিনি এরকম কিছু হবে।’
শাদাব কিছু বলল না। আপাতত রাগ দেখানোর কিংবা সময় নষ্ট করার মতো পর্যাপ্ত সময় তার নেই। রিসোর্টে ফিরেই শিহাবকে পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। এরপর সুস্থসবল দেখলে তবেই রাতের মধ্যে ‘ছাতক’ রওনা দিবে। মাহদিয়ার কথা এড়িয়ে গিয়েই ডোর খুলে অন্যপাশে বসে গাড়ি স্টার্ট করল। মাহদিয়া অসহায় চোখে চেয়ে থেকে বলল,
-‘আজই চলে যাবে?’
-‘কী করব? আজ যদি না যাই, ওর ভেতরে যত প্রশ্ন জমা হয়েছে, যত ভয় ঢুকেছে সেসব এত সহজে দূর করতে পারব না। আগামী তিনদিন ও সব ভুলে থাকবে। অসুস্থ হওয়ার আগে কী হয়, না হয় সব ভুলে যায়। কিন্তু এরপরই শুরু করবে জ্বালানো। হয়তো আমাকে জ্বালাবে না। কিন্তু নিজেকে কষ্ট দিবে।’
এরকম পরিস্থিতি আসলেই ভয় পায় শাদাব। শিহাব নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়। সামনে থেকে দেখাবে ভালো আছে, কিন্তু ভেতর দিয়ে সে দুঃশ্চিন্তা ও হতাশায় শেষ হয়ে যায়। তার এই মানসিক সমস্যার কারণেই সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে শাদাব। ভাইকে পর্যাপ্ত যত্নে রাখে, আদরে রাখে। সব ধরনের ভয়ভীতি থেকে দূরে রাখে। কিন্তু তবুও পারা যায় না। মাঝেমধ্যে তার মাথায় উদ্ভট প্রশ্ন ভীড় জমায়! সে সেই প্রশ্নের উত্তর জানতেই ঝিম মেরে বসে থাকে। একা একা হিসাব কষে! সবদিকে তখন তার বেখেয়ালি আচরণটাই চোখে লাগে বেশি। এজন্য সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখতে হয়। কখন কার সাথে মিশে সবটাই খেয়াল রাখে। কোনো ধরনের মেন্টালি প্রেশার তাকে দেয়া হয় না। সে যেন সুস্থ ও ফ্রেশ মন-মেজাজ নিয়ে দৌড়াতে পারে, এই কারণেই সময়ে-অসময়ে নিজের কাজ ফেলে ভাইকে নিয়ে ট্যুরে বের হয় শাদাব। শুধু শিহাবের মানসিক সুস্থতার কথা ভেবেই!
এই পরিস্থিতির জন্য মাহদিয়া নিজেকেই দায়ী ভাবছে। শাদাবও হয়তো তাকে দোষী ভাবছে। ফের কবে দেখা হবে, কথা হবে, এসব জানার জন্য উশখুশ শুরু হলো তার। একটা সময় দ্বিধা নিয়েই বলল,
-‘পৌঁছে ফোন করবে তো?’
-‘আমি তোমাকে অপশন দিয়েছিলাম!’
-‘অপশন বেছে না নিলে যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে?’
-‘কিছু কিছু কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মানুষকে প্রচণ্ড ধৈর্য্যশীল হতে হয়। তুমি একদমই তা নও। এতটা সাহসও নেই তোমার, যতটা সাহস থাকলে আপন মানুষদের থেকে দূরে থাকার মতো মনোবল পাবে। এজন্যই বলেছিলাম, আর কাছে এসে আমাকে দুর্বল কোরো না। তুমি তো নাছোড়বান্দা। আমার একটা কথা মেনে চলার চেষ্টাও করলে না। নিজে তো ধৈর্য্য ধরতে পারলে না, আমার ধৈর্যের বাঁধটাকেও ভেঙে ফেললে। এখন আর করণীয় কিছু নেই। অপশন বেছে নিতে না পারলে বিচ্ছেদই সমাধান। তবে আমি স্ব-জ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে কোনোদিন চাইব না, যে মানুষগুলোর কারণে শিহাবের এই অবস্থা, তাদের কারও সাথে পূণরায় যোগাযোগ কিংবা কোনোপ্রকার সম্পর্ক তৈরী হোক।’
শাদাবের এই কঠিন কথাগুলো সহজেই গ্রহণ করতে পারল না মাহদিয়া। মা ও মেয়ের মাঝখানে আসা অপশন নামক এই অহেতুক দেয়াল টেনে আনার কারণ জানতে বলল,
-‘কোনো কারণে মায়ের ওপর রেগে আছো তুমি? মা কি কোনো অন্যায় করেছেন? মানুষ তো এমনিতেও অসুস্থ হয়। এরজন্য কেউ কেন দায়ী হবে? হ্যাঁ, বড়ো মামা দোষী! ওইদিন হয়তো ভুল ঔষধ খাইয়েছিলেন। বাচ্চাটাকে মে রে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা! মায়ের কী দোষ? একজনের ভুলে আরেকজন কেন শা স্তি পাবে?’
শাদাবও শক্ত কণ্ঠে বলল,
-‘ঠিক এটাই। একজনের ভুলে আরেকজন কেন শা স্তি পাবে! উত্তরটা তোমার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিও। তাঁকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, শিহাবের দোষ কী! কেন সে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই কারও শত্রু হয়ে গেল! কেন তিনি একজনের ওপর রাগ-ক্ষোভ দ্যাখাতে গিয়ে আমার সাথে অন্যায় করলেন! কেন, আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন! এরপরও যদি তুমি উত্তর খুঁজে না পাও, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারো, তবে আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে নাহার খালাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমার জীবনে ‘ভ্রমর’ বলে কেউ একজন ছিল, সেটা আমি চিরদিনের জন্য ভুলে যাব। একদম ভুলে যাব।’
হতভম্ব হয়ে গেল মাহদিয়া। হারানোর ভয়ে সমস্ত মন-প্রাণ কেঁদে উঠল তার। মুখফুটে কিছু বলতেও পারল না। চোখের পলকে গাড়ি নিয়ে সবসময়ের জন্য আরও একবার ‘সুখনীড়’ ত্যাগ করল শাদাব। মাহদিয়া শুধু দেখল। আটকাতেও পারল না। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেও পারল না। শুধু অসহায়, ব্যথিত চোখদুটো দিয়ে নূরুন্ নাহারের দিকে তাকিয়ে দু’হাতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘আমি কী করব খালা? কার কাছে যাব? কার কাছে নিরাপদ থাকব আমি? কাকে বিশ্বাস করব? এখনও নিজের মাকে বুঝতে পারছি না। কেন এমন করছেন তা-ও জানি না! তোমার টোটোন তো রাগ দ্যাখিয়ে চলে গেল, ঠিকানাটা অবধি দিয়ে গেল না। কীভাবে যোগাযোগ করব আমি?’
***
মাহদিয়ার কপালের কাঁটাছেড়া অংশ পরিষ্কার করে তাতে যত্ন করে ঔষধ লাগিয়ে দিয়েছেন নূরুন্ নাহার। তখন থেকেই নীরব হয়ে বসে আছে সে। কারও সাথে কথা বলছে না। শুধু একাধারে চোখের জল ফেলছে। একটা সম্পর্ক এত সহজে ভেঙে যাবে, এটা সে মেনে নিতে পারছে না। শাদাবকে ফোন করছে, কিন্তু বার বার নম্বর সুইচড অফ আসছে। একটা সময় খেয়াল হয়, ওই ফোনটাই তো নষ্ট। বাটন ফোনের নম্বরটা জানা নেই তার। এই মুহূর্তে সে প্রচণ্ড অসহায় ও একা। নীরবে গোপনে যে বিরহ তাকে পোড়াচ্ছে সেটা মা হয়েও বুঝতে পারছেন না শায়লা সুলতানা। কাছে থেকে মেয়ের এই নীরবতা দেখছেন। ঔষধ লাগানো শেষ হলে রুমে চলে গেল মাহদিয়া। সুযোগ পেয়ে হুংকার ছাড়লেন তিনি। নূরুন্ নাহারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে শিখেছ নাহার? এক্ষুণি ব্যাগ গুছাও আর বের হও এই বাড়ি থেকে। তোমার মতো দু’মুখো কালসাপের এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই!’
নূরুন্ নাহার চমকালেও চমৎকার করে হাসলেন। বললেন,
-‘কেন আপা? আমি আবার কখন দুটো মুখ দ্যাখালাম?’
-‘একটা জরুরী কাজে তুমি দিয়াকে কেন এখানে টেনে আনলে?’
-‘ওমা, টানব না? দুটো বাচ্চার হক্ব ও তাদের পূর্বপুরুষের সম্পদ থেকে তাদের বঞ্চিত করার মতো দুঃসাহস দ্যাখিয়েছেন আপনি! চোখের সামনে এত বড়ো অন্যায় তো হতে দিতে পারি না, আপা। তাই দিয়াকে জানিয়েছি। এ-ও বুঝাতে সক্ষম হয়েছি, সব মেয়েরা নারী হলেও সব নারী পরিপূর্ণ মা হয় না। কিছু নারী আপনার মতো হয়। যারা সারাক্ষণ বিষ সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আবার সুযোগ বুঝে সেই বিষে নিজের মেয়ের সুখ-সংসারও বিষাক্ত করে দেয়!’
সাহস বেড়ে গেল শায়লা সুলতানার। তাৎক্ষণিক হাত উঠিয়ে নূরুন্ নাহারের গায়ে হাত তুলতে গেলেন তিনি। নূরুন্ নাহার ঘাবড়ালেন না। বরং শক্ত হাতে সেই হাত চেপে ধরে বললেন,
-‘এই বাড়িতে এত বছর ধরে আছি। কোনোদিন বেগম সাহেবা আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেননি। কখনও আমাকে ছোটো করে কোনো অপবাদ দেননি। আজ আপনার মতো একটা গিরগিটি এসে আমাকে এত কথা বলবে আর আমি হজম করে নেব, আমাকে এতটা বোকা ভাবলে ভুল করবেন শায়লা আপা।’
শায়লা সুলতানা থামলেন না। পূণরায় চেঁচিয়ে বললেন,
-‘এখান থেকে যাবে কি-না? তুমি এই বাড়ির কেউ নও। নির্লজ্জের মতো পরের বাড়িতে থাকো কী করে তুমি? ফকির কোথাকার!’
-‘ফকির বলেন আর যা-ই বলেন, আপনি আমাকে চলে যেতে বললে তো হবে না আপা। আমি তখনই যাব, যখন ওয়াদার বন্ধন থেকে মুক্তি পাব। নয়তো আমি সারাজীবন এই বাড়ির ভেতরে থেকে এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করব।’
ড্রয়িংরুমে এসে এই দৃশ্য দেখে চমকালেন হায়দার সাহেব। এতক্ষণ তিনি মাদরাসাতে ছিলেন। জরুরী কাজ পড়ায়, শিক্ষকদের মিটিং হওয়াতে তাকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। মিটিং শেষে তিনি রিসোর্টে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাহদিয়াই তাকে বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ করেছে। এখানে একটা তাণ্ডব ঘটে গেছে, সেটাও বলেছে। শায়লা সুলতানা যে কতটুকু খারাপ সেটা শাদাবের মুখ থেকেই শোনেছেন। কিন্তু এটা ভাবেননি, তাদের বাড়ির সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষটার সাথেই তিনি এমন বেয়াদবি ও অন্যায় করবেন। তিনিও সহজসরল কথাটাই একটু ঘুরিয়েপ্যাঁচিয়ে শায়লা সুলতানার দিকে অদৃশ্য ছু রি চালাতে বললেন,
-‘আপনি এই বাড়ির কে শায়লা আপা? কেউ নোন। সামান্য এক আত্মীয় মাত্র। তা-ও স্বল্পদিনের চেনা! আজাদ ভাই আমাদের বিশ্বস্ত মানুষ হলেও আপনি এতটাও বিশ্বস্ত মানুষ নোন যে, আপনাকে আমরা এখানে মাথায় তুলে রাখব। ফকির তো নাহার নয়, আপনি। যেচেপড়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকছেন আবার তাদের সহায়-সম্পত্তির দিকে হাতও বাড়াচ্ছেন! ভাবিজান যাকে ভরসা করে বাড়ির দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন, তার দিকেই আপনি আঙুল তুলছেন! দুঃখিত আপা, মাফ করবেন! আমি ভাইজানের মতো মিনমিনে স্বভাবের কাপুরষ নই। যে আমার বাড়ির মানুষ ও সম্পদের দিকে হাত বাড়াবে, তাকে আমি এখানে আর একমুহূর্তও সহ্য করব না। বাইরে থেকে এসেছি। ফ্রেশ হই। পনেরো মিনিটের মধ্যে ঘর ছাড়েন। এই বাড়ি কোনো সার্কাসহাউস নয় যে, এখানে দিনরাত কোনো জোকারের সার্কাস দ্যাখব। বের হোন এখান থেকে।’
শেষটুকু তিনি বেশ জোরেই চিৎকার দিয়ে বললেন। ধমক শোনেই রুমের বাইরে আসলো মাহদিয়া। কায়ছার সাহেবও এসে উপস্থিত হলেন। শায়লা সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বললেন,
-‘দ্যাখলি তো মা! এই মহিলার জন্য তোর ছোটো মামা আমাকে কত খারাপ খারাপ কথা শোনাল আজ। আমি না-কি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে বসে বসে খাচ্ছি আবার ওদের সম্পদের দিকে হাত বাড়িয়েছি। শুধু তোর জন্য আমাকে এত কথা শুনতে হচ্ছে। নিজের যা হক্ব তা তুই নিবি না, উলটে তারজন্য আমাকেই ফকির-মিসকিন গালি শুনতে হোলো। এই মুখ আমি কোথায় লুকাব!’
মায়ের এই নাকিকান্না সহ্য হলো না মাহদিয়ার। একেই তো শাদাবের সাথে তার অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্ছেদ, তারমধ্যে শিহাবের অসুস্থতা। নিজের শরীর ও মনের দফারফা অবস্থা। সব মিলিয়ে এখন আর মনের জোর নেই একফোঁটা। তর্ক না করে সে হায়দার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘কী হয়েছে ছোটো মামা?’
হায়দার সাহেব ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে এগোতে এগোতে মাহদিয়াকে বললেন,
-‘নাহার এই বাড়ির সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও কাছের মানুষ। তোর মা তার সাথেই খারাপ ব্যবহার করেছে। আজ অবধি আমরা কেউ তাকে কটুকথা বলিনি। অথচ তোর মা তাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছে। তুই জিজ্ঞেস কর, এই বাড়ির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো সাহস ও অধিকার উনি কোথায় পেয়েছেন!’
গটগট পা ফেলে চলে গেলেন তিনি। মাহদিয়া মায়ের দিকে তাকাল। নূরুন্ নাহারকেও দেখল। নতমুখী হওয়া নূরুন্ নাহারের কাঁদোকাঁদো মুখখানি দেখে শায়লা সুলতানাকে বলল,
-‘তুমি খালাকে চলে যেতে বলেছ?’
-‘হ্যাঁ বলেছি। ওর জন্যই টোটোন আজ এই বাড়িতে এসে তোর বড়ো মামাকে শাসিয়ে গেল! সায়রা আপার নাম করে এত বছর ধরে এই বাড়ির সম্পত্তির দিকে নজর দিয়ে রেখেছে ওই মহিলা। আজ যখন দ্যাখল, সব সম্পত্তি তোর বড়ো মামা আমার নামে লিখে দিচ্ছেন, তখনই সে জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যেতে লাগল। কার্যসিদ্ধি করতে তোকে ফোন করিয়ে এনে আমাকে অপমান করাল। বেশ করেছি, চলে যেতে বলেছি। কেন থাকবে সে এখানে? কীসের অধিকারে?’
নূরুন্ নাহার শান্ত চোখে কায়ছার সাহেবের দিকে তাকালেন। ভাবলেন, হয়তো তিনি কিছু বলবেন। কিন্তু কায়ছার সাহেব নীরব। এই মানুষটার জন্যই সায়রা করীমের অনুরোধে তিনি এই বাড়িতে দাঁত কামড়ে পড়ে আছেন। নয়তো তার নিজের মেয়েরও সুন্দর একটা বাড়ি আছে। তিনি আরামসে সেখানে থাকতে পারেন। আজ যখন তার থাকার ও অধিকারের প্রশ্ন উঠল তখনই কায়ছার সাহেবের নীরবতায় অনেক উত্তর পেয়ে গেলেন তিনি। নীরবে প্রস্থান করে নিজের রুমে ঢুকলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যাগপত্র গুছিয়ে ঘর-সংসার আগলে রাখার যে চাবির গোছা, সেটা কায়ছার সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-‘বেগম সাহেবা বলেছিলেন বলেই আমি এত বছর এখানে ছিলাম ভাইজান। এই বাড়ি, বাড়ির মানুষের খেয়াল রাখার যে দায়িত্ব আমার কাঁধে ছিল, তা থেকে স্বেচ্ছায় মুক্তি নিলাম। আজকের দিনে আপনার কাছ থেকে এই ব্যবহারটা আশা করিনি। এখনও আপনি কতটা অন্ধকারে আছেন, সেটা হয়তো নিজেও জানেন না। যেদিন জানবেন, আলোতে ফেরার পথ খুঁজে পাবেন না। ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। বাচ্চাদের ওপর রাগ-ক্ষোভ জমিয়ে রাখবেন না। ওদের ওপর অবিচার করেছেন বলেই ওরা আপনাকে ঘৃণা করে। যদি ভালোবেসে কাছে টেনে নিতেন, এই ‘সুখনীড়’-এর সুখ চিরকাল থাকত। আপনি তো মানুষকে ভালোবাসতে জানেন না, শুধু জানেন অপমান করতে।’
মাহদিয়ার কাছে গিয়ে তার পুরো মুখজুড়ে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
-‘ভাগ্য যদি তোমার সহায় হয়, আবারও সব ঠিক হবে। ভয় পেয়ো না, নিজেকে কখনও একা ভেবো না। দূরে থাকলেও সবসময় আমার প্রার্থনা তোমার সাথে থাকবে। ভালো থেকো।’
মাহদিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল,
-‘তুমি যেয়ো না খালা। তুমি ছাড়া কেউ আমাকে বুঝবে না।’
-‘বুঝবে। আরও একজন বুঝবে। শুধু একবার সবকিছু গোড়া থেকে ভাবো।’
নূরুন্ নাহার সময় নষ্ট করলেন না আর। তড়িঘড়ি পা চালিয়ে বিদায় নিলেন। কায়ছার সাহেব তাকিয়েই রইলেন। কিছু বললেন না। হায়দার সাহেব ফিরে এসে যখন নূরুন্ নাহারকে পেলেন না। তখনই রেগে গেলেন। শায়লা সুলতানার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে মূল দরজার সামনে নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন বাইরে। মাহদিয়া অবাক। কী হলো কিছুই বোধগম্য হলো না তার। আটকাতেও পারল না। তার আগেই শায়লা সুলতানার প্রয়োজনীয় ব্যাগপত্র এনে বাইরে ফেলে দিয়ে দড়াম করে মূল দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। মাহদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘তুইও যাবি? যা। এই বাড়ি অনেক আগেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। আজ আবারও হবে। যার যার কারণে এই সংসারে আগুন লেগেছে, সবাইকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে তবেই শান্ত হব। আমার ভাতিজাদের হক্ব নষ্ট করতে এসেছে। ডা ই নী কোথাকার। তার এতবড়ো সাহস। এতদিন খুব সম্মান দ্যাখিয়েছি, এখন থেকে আর দ্যাখাব না। এবারে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।’
***
চলবে…