#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — বত্রিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
ঘরকে সবসময় প্রাণবন্ত রাখে যে মানুষ, তাকে ছাড়া ঘর কখনও ঘর মনে হয় না। ঘর হয় প্রাণহীন, প্রাণীহীন শূণ্য বালুচর। তাই ঘরকে প্রাণের স্পন্দনে বাঁচিয়ে রাখতে, নিজেরাও প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে, নূরুন্ নাহারকে ধরেবেঁধে পূণরায় ‘সুখনীড়’-এ ফিরিয়ে এনেছেন, হায়দার সাহেব। এরপর মাহদিয়াকেও বাড়ি ফিরতে বলেছেন। বাবা সমতুল্য এই মানুষটার আদর, শাসন, বকা, ভালোবাসা দূরে ছুঁড়ে ফেলা সম্ভব নয় দেখেই গতকাল রাতেই রিসোর্ট থেকে নিজের সবকিছু নিয়ে চলে এসেছিল। রাতের খাবার পর বেশ খানিকক্ষণ সময় শিহাব ও শাদাবের সাথে কথা বলার পর থেকে মন-মেজাজ একদম ফুরফুরে তার। হাসছে, নাচছে, ডানামেলে উড়ছে। যেন আজ সে স্বাধীন পাখি। মুক্ত হওয়ার আনন্দে খোলা আকাশের বুকে ছুটে বেড়াচ্ছে। পুরো দিনটাই কাটল তার, সুখে-আনন্দে।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যখনই পুরোপুরি তৈরী হয়ে বাইরের যাওয়ার জন্য নূরুন্ নাহারের থেকে বিদায় নিতে ড্রয়িংরুমে এসে পা ফেলল, তখনই সেখানে শায়লা সুলতানার থমথমে মুখখানি দেখে ও তাকে স্ব-শরীরে পূণরায় ‘সুখনীড়’-এ দেখে অবাক হলো মাহদিয়া। জোরপূর্বক মুখে হাসি ধরে রেখে বলল,
-‘তুমি? কেন এসেছ? কেউ তোমাকে ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পরও তোমার লজ্জা হলো না? এত নির্লজ্জ তুমি কী করে হচ্ছ মা?’
শায়লা সুলতানা মেয়ের দিকে তাকালেন। আপাদমস্তক তাকে দেখলেন। মেয়ের বেশভূষাই বলে দিচ্ছে, সে বাইরে কোথাও যাচ্ছে। দু’দিন ধরে নাড়িছেঁড়া ধন তাঁর সাথে কথা বলে না। কষ্টে বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে মেয়েকে হারানোর যন্ত্রণায়। শেষমেশ না পেরে, লোকলজ্জার মাথা খেয়ে আবারও ছুটে এসেছেন ‘সুখনীড়’-এ। মেয়ের মুখের এই কথায় তিনি বুঝতে পারলেন, মায়ের এখানে আসাটা মেয়ের পছন্দ নয়। তিনি আহতস্বরে বললেন,
-‘যে বাড়ি থেকে তোর মা’কে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তুই সেখানে বেহায়ার মতো পড়ে আছিস কেন? তোরও তো লজ্জা হওয়া উচিত।’
-‘হচ্ছে না তো। একদমই হচ্ছে না। কেন হবে বোলো? এটা তো আমার শ্বশুরবাড়ি। স্বামীর বাড়ি। এখানে তোমার অধিকার না থাকলেও আমার অধিকার ঠিকই আছে।’
-‘তুই ওই বিয়েটাকে বিয়ে মানিস দিয়া?’
-‘বয়স কম ছিল, তাইবলে বন্ধনটা কি অপবিত্র? অচ্যুত? এসব তো কিছুই নয়। বিয়েটা পবিত্র ও মজবুত বন্ধন। আমি তোমার সন্তান এটা যেমন সত্য, বাল্যকালের সেই বিয়েটাও ঠিক ততটাই সত্য। সত্য কি আর বালিচাপা দিয়ে আটকে রাখা যাবে? যাবে না। তা…তুমি এখানে কেন এসেছ? কার মুখ দ্যাখতে?’
মাহদিয়ার প্রত্যেকটা কথায় তিনি আঘাত পাচ্ছেন। মেয়ে তাকে এত পর করে দিয়েছে! এত পর? আজ ওই ভুলেগড়া সম্পর্কই আপন। মা নয়? মা কীভাবে এত পর হতে পারে? অমন কথা ভাবতেই যে কলিজা কেঁপে উঠল তাঁর। তিনি ম্লানমুখে বললেন,
-‘আমি তোকে নিতে এসেছিলাম।’
-‘নিয়ে কী করবে? আরও পনেরো বছর আটকে রাখবে? জীবনের অর্ধেকটা সময়ই ভুল ভাবনাকে মনে প্রবেশ করিয়ে সম্পর্ক ও সুখ থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত করে দিয়েছ। আজ যখন আমি মনের ডাকে পবিত্র সম্পর্কটাকে মূল্য দিতে চাইছি, তুমি বাঁধা তৈরী করছ। কেন মা? আমি তো তোমার মেয়ে! আমার ওপর এই অবিচার কেন করলে তুমি? কেন শাদাবের এতগুলো ফোনকলকে মিথ্যে বাহানা দ্যাখিয়ে ফিরিয়ে দিলে? ওর দোষ কী ছিল? আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল? আমার ছবি দ্যাখতে চেয়েছিল? ও’কে ফিরিয়ে না দিয়ে, শুধু একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে, আমি কী চাই!’
মেয়ের এতগুলো প্রশ্নের একটা উত্তরও ঠিকঠাক দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন না শায়লা সুলতানা। চুপ করেই রইলেন। মাকে চুপ থাকতে দেখে সত্য-মিথ্যার মধ্যে থাকা দুর্বোধ্য দেয়ালটাও এবার দৃষ্টির সম্মুখে পড়ল মাহদিয়ার। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বলল,
-‘তুমি নিজের মেয়েকেও বুঝতে পারোনি মা। চেষ্টাও কোরোনি বুঝার। উলটে, দিনের পর দিন একটা মানুষকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে, সম্পর্কে দূরত্ব তৈরী করেছ। এতে লাভ কী হলো? পেরেছ আমাদের দূরে সরাতে? মাইলের পর মাইল যে দূরত্ব ছিল, সেটা মনের কাছাকাছি এসে নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। আমরা দূরে থাকলেও সবসময় একে-অন্যের অনেক কাছে ছিলাম মা। মনের মধ্যে ছিলাম। এই কাছে আসাটা, তুমি কোনোদিন আটকাতে পারবে না।’
শায়লা সুলতানা গম্ভীরমুখ নিয়ে বললেন,
-‘কোথাকার কোন ছেলে, তার কথায় নিজের মা’কে অবিশ্বাস করছিস তুই। সন্দেহ করছিস। অথচ আমি এসব কিছুই করিনি। টোটোন তোকে মিথ্যে বলেছে মা।’
মাহদিয়া মায়ের মুখোমুখি হলো। চোখে চোখ রেখে স্পষ্টকণ্ঠে বলল,
-‘কী মিথ্যে বলেছে?’
-‘এইযে, ও ফোন করত। তোর ছবি দ্যাখতে চাইত। এসব মিথ্যা মা। বানোয়াট। শুধু মায়ের ওপর থেকে তোর বিশ্বাস সরিয়ে নিতেই এই কথা বলেছে।’
মায়ের কথা শোনে মাহদিয়া রহস্যময় হাসি ফুটাল ঠোঁটে। বলল,
-‘ও ফোন করত না? একদিনও করেনি?’
-‘না। করেনি। সব মিথ্যে।’
-‘তাই? আচ্ছা। তাহলে তো তোমার নিশ্চিন্ত থাকা উচিত। রিল্যাক্স থাকো। যদি ও মিথ্যে বলে থাকে, তবে ওই মিথ্যের জন্য ও শাস্তি পাবে। আর যদি তুমি মিথ্যে বলে থাকো! সব সত্যি গোপন রেখে থাকো, তবে শাস্তিটা তুমিও পাবে।’
-‘তুই খুব বাড়াবাড়ি করছিস দিয়া। কতবার বলব, এই সম্পত্তির ওপর আমার কোনো লোভ নেই, কিচ্ছু নেই। তুই তবুও নিজের মায়ের দিকে অপরাধের আঙুল তুলছিস।’
-‘আঙুলটা আমি তুলিনি মা। তুমি বাধ্য করেছ। তুমি-ই চাওনি, আমি কোনোদিন দেশে ফিরে আসি। কেন এত ভয় তোমার? দেশে ফিরলে কী এমন ক্ষতি হবে? শাদাব আমাকে তোমার থেকে কেড়ে নিবে? এই ভয় ছিল মা?’
কথা থামিয়ে ঘড়ি দেখল মাহদিয়া। দেরী হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। সে মায়ের উত্তরের অপেক্ষায় রইল না। শুধু বলল,
-‘তোমার প্রতি যতটুকু বিশ্বাস এত বছরে তৈরী হয়েছিল, সেই বিশ্বাস তুমি নিজ হাতে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছ মা। তাই বাধ্য হচ্ছি এসব কথা বলতে।’
-‘এখন ওই ছেলেটাই তোর সব! মা কে? মা তো কেউ না। মায়ের কী মূল্য? সামান্য কিছু কথার জন্য…।’
-‘এটা তোমার কাছে সামান্য?’
-‘এসব মিথ্যে। আমি বার বার বলছি। কবে ফোন করেছে টোটোন? কার কাছে ছবি চেয়েছে? কোনো প্রমাণ আছে?’
মাহদিয়া নীরব হয়ে গেল! আসলেই কী প্রমাণ আছে এসবের? কোনো প্রমাণ নেই। শাদাব নিজেও এসব নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি। বলার মতো কোনো প্রয়োজনীয় শব্দ সে খুঁজে পেল না। চুপ করে রইল। শায়লা সুলতানা বললেন,
-‘তুই কি এখনও আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?’
-‘বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে, এমন কিছু কোরো। বলেছিলাম, সম্পত্তি যেন ওদের দুই ভাইয়ের নামে হয়, এটা নিয়ে আলোচনা করতে, কোরোনি। বলেছিলাম, শাদাবের হাতে আমাকে তুলে দাও। তা-ও করছ না। তবে কী করে বিশ্বাস করব, তুমি ঠিক আর শাদাব ভুল?’
শায়লা সুলতানা ওড়নায় মুখ লুকিয়ে কাঁদলেন। অন্যদিন হলে মায়ের এই কান্নায় দিশেহারা হয়ে যেত মাহদিয়া। জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিত। কত-শত বকবক করত। অথচ আজ পারল না। নিজের মনকে সামলাতে দ্রুত বের হলো ‘সুখনীড়’ থেকে। পিছনে ফিরে তাকাল না একবারও। কেন জানি না তার মনে হলো, এটা মায়াকান্না, মায়াজাল। ওখানে শুধু ছলনা আছে।
***
ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসে রিসেপশনিস্টের কাছে গেল মাহদিয়া। সেখানে একটা মেয়ে বসে আছে। তাকে গিয়ে শাদাবের কথা জিজ্ঞেস করতেই, চেম্বার দেখিয়ে দিল মেয়েটা। এখনও রোগীরা কেউ আসেনি। সিরিয়াল শুরু হয়নি। তবে অবিরত রোগীদের ফোন আসছে। মেয়েটা ব্যস্তহাতে কল রিসিভ করছে, সিরিয়াল টুকছে। ফোন রাখার পরই মাহদিয়া তাকে বলল,
-‘আপনাদের স্যার কি এসেছেন? দ্যাখা করা যাবে?’
চেম্বারে প্রবেশ করার আগেই মেয়েটাকে মাহদিয়ার আসার ব্যাপারে নিশ্চিত করে রেখেছিল শাদাব। অন্যদিন সে সময়ের পাঁচ থেকে দশ মিনিট আগে আসলেও, আজ এসেছে ত্রিশ মিনিট আগে। এত আগে আসার কারণ হিসেবেই আবিষ্কার করল, স্যারের স্পেশাল গেস্ট আসার কথা। সে ভাবনারত অবস্থাতেই বলল,
-‘আপনার নাম?’
-‘মাহদিয়া আজাদ।’
নাম শোনে নিশ্চিত হলো মেয়েটা। ঝটপট শাদাবের কাছে ফোন করল। কয়েক সেকেন্ড কথা বলে মাহদিয়াকে বলল,
-‘আপনি ভেতরে যান। স্যার অপেক্ষা করছেন।’
এতক্ষণ খুশিতে বাক-বাকুম পায়রা হয়ে গেলেও, ভেতরে যাওয়ার হুকুম পেয়েই ভয়ে বুক ধুকপুক শুরু হলো তার। একরকম টলতে টলতেই দরজার কাছে এলো। নব ঘুরিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। তার মাথায় বাজছে, ‘কঠিন শাস্তি’র কথা। কী হবে শাস্তি? সে ভেতরে প্রবেশের পরই মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে থাকা ঝুলন্ত কার্ডে ‘ওপেন’ লেখা অংশটাকে ‘ক্লোজড’ করে নিজের জায়গায় ফিরে এসে পূণরায় রোগীদের সিরিয়াল নেয়া শুরু করল।
ভয়ভীতি সঙ্গে নিয়ে পুরোদমে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকাল মাহদিয়া। চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকের কাছে দুটো হাত ভাঁজ করে মাহদিয়ার ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ দেখছিল শাদাব। গুটি কয়েক পা ফেলে কাছাকাছি এগোতেই শাদাব তাকে অভ্যর্থনা দিয়ে বলল,
-‘বহুবছর ধরে, আমার হৃদয়বাগিচা বৃষ্টির অভাবে শুকনো মরুভূমি হয়ে আছে। সব ফুল জ্বলসে গিয়েছে অসময়ে আসা এক ভয়ানক বজ্রপাতে। সমস্ত ফুলগাছেরা অকালেই মৃত্যুকে আপন করে নিয়েছিল, শুধু ‘ভ্রমর’ ছিল না বলে। মৃত সব পুষ্পকলিকে জীবন্ত করতে সেখানে একটা চঞ্চল ‘ভ্রমর’-এর আজ ভীষণ প্রয়োজনবোধ করছি। আমি কি আমার ‘ভ্রমর’-কে তৃষ্ণার্ত মরুভূমির বুকে একপশলা বৃষ্টি হিসেবে পাব? যদি নিশ্চয়তা দাও, তবেই আমি আজ সবটুকু দূরত্ব সরিয়ে ভরসার হাত বাড়ালাম। এসো…। আমার হৃদয়বাগিচাকে আবারও জীবন্ত করে তুলো, ভ্রমর। হও সেখানকার একমাত্র উত্তরাধিকারী।’
দুঃখ-সুখের সংমিশ্রণে পড়ে, বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মাহদিয়া। অবাক চোখে সামনে তাকাল। পিপাসার্ত দুটো চোখ আজ তাকে বৈধ সম্পর্কের সবটুকু নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা দিচ্ছে। দু’হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় আছে, কখন সে নিরাপদ আশ্রয়ে সুখ খুঁজে নিবে! আনন্দে সর্বাঙ্গে যে অদ্ভুত সুখের কাঁপুনি শুরু হলো তা থেকে রেহাই পেল না মাহদিয়া। জল টলমল চোখ নিয়ে দু’পা এগোলো। শরীরের সবটুকু শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে তার। এগোতে গিয়েও দুলতে লাগল। কম্পনরত কণ্ঠে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পারল না। শুধু কাঁপা কাঁপা স্বরে ‘আমি ওখানে, মানে, তোমার’ এইটুকু উচ্চারণ করল। তার আগেই শাদাব বলল,
-‘এসো, লুকোও। নিজেকে নিরাপদ রাখতে যদি এই জায়গা তোমার বিশ্বস্ত মনে হয়, তবে তুমি এখানেই নিজের নিরাপত্তাকে অনুভব কোরো। পৃথিবীর বুকে এরচেয়ে বিশ্বস্ত ও নিরাপদ আশ্রয় তুমি আর কোত্থাও খুঁজে পাবে না।’
টালমাটাল দেহখানি দিকবিদিক হারানোর আগেই দু’হাতে তাকে বুকের ভেতর আগলে নিল শাদাব। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মাহদিয়া এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, যে ছেলের কাছে গেলে, সর্বক্ষণ ‘দূরে থাকো, দূরে থাকো’ বলে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, আজ সে-ই ছেলেটাই তাকে নিজে থেকে কাছে টেনেছে। তা-ও এতটা কাছে! যতটা কাছে আসলে একে-অন্যের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানিটাও স্পষ্ট শুনতে পায় মানুষ। অনুভূতির গভীরতা উপলব্ধি করতে গিয়ে কখন যে কাঁপুনি থামল টেরই পেল না মাহদিয়া। হুঁশে ফিরল, কপালে গভীর আবেশের একটুখানি স্পর্শ পেয়ে। বিস্মিত চোখ নিয়েই তাকিয়ে রইল বেচারী। শাদাব তাকে দেখল। দু’চোখ ভরে। কতদিন দেখে না ওই মায়াবী মুখ। ছুঁয়ে দিতে পারে না। কত আফসোস, অনুভূতি মনের গোপন ঘরে লুকিয়ে রেখে, দীর্ঘদিনের অপেক্ষাকে বুকে আগলে দিন কাটিয়েছিল। আজ যখন ছুঁয়ে দেয়ার সুযোগ হলো – খুব করে, যত্ন করে পুরো মুখখানি ছুঁয়ে দিল। মাহদিয়ার বিস্ময়ভরা চাহনি দেখে বলল,
-‘কী দ্যাখছ?’
-‘তোমাকে। বুঝতে চাইছি, এটা কি সত্যিই শাদাব!’
-‘বিশ্বাস হচ্ছে না?’
শাদাবের দুটো হাত গালের সাথে চেপে রাখল মাহদিয়া। বলল,
-‘ভয় পাচ্ছি শাদাব। ভীষণ ভয় পাচ্ছি।’
-‘কেন?’
-‘সব ঠিকঠাক হবে তো? যদি না হয় আমি…।’
বাক্যটা অসম্পূর্ণ রইল। ততক্ষণে অধরোষ্ঠ সাক্ষী হলো, সুখকর মুহূর্তের। এতদিন যা করেনি, আজ সেটাই করে বসল শাদাব। শাস্তির বদলে তার ‘ভ্রমর’-কে সম্পর্কের পুরো নিশ্চয়তা দিয়ে অধর নামিয়ে, বহু বছরের জমানো সবটুকু ভালোবাসাকে উজাড় করে দিতে লাগল। মাহদিয়া বাঁধা দিল না। দু’হাতে বিশ্বস্ত মানুষটাকে আঁকড়ে দীর্ঘক্ষণের দামী উপহারটাকে আগলে নিয়ে গাল ভাসাল অত্যাধিক সুখের আবেশে।
অনেকক্ষণ, খুবক্ষণ, বহুক্ষণ পর দু’হাতের আঁজলায় প্রিয়তমার কান্নামাখা মুখখানি কিঞ্চিৎ উপরে তুলল শাদাব। আঙুলের আলতো স্পর্শে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছে দিল। কপালে আঁকল নির্ভরতার চুমু। পরক্ষণেই বুকের খাঁচায় আবদ্ধ করে নিয়ে বলল,
-‘এখনও ভয় পাচ্ছ?’
মাহদিয়া সাড়া দিল না। নিশ্চুপে নিজের জন্য পাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত এই সুখটুকু গ্রহণ করতে লাগল। শাদাব বলল,
-‘চিন্তা কোরো না। এবার আর আমরা দূরে যাচ্ছি না। সব বাঁধা ডিঙিয়ে, তুমি-আমি মিলে একটা বিশ্বস্ত নীড় গড়ে তুলব।’
ভরসা পেয়েও শান্ত হওয়ার বদলে গা কাঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল মাহদিয়া। বলল,
-‘মা’কে ছাড়ব কী করে?’
মাহদিয়ার কষ্টটা বুঝতে পারল শাদাব। মুখফুটে কিছু না বললেও মনে মনে বিড়বিড়াল, ‘তুমি ছাড়বে না। এমন কিছু করব, যেন ওই মহিলা নিজে থেকেই তোমায় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।’
***
-‘এতক্ষণ যা হলো, এসব কিন্তু তোমার শাস্তি ছিল না।’
রোদ ঝলমল আলোর মতো ঝলমলে এক হাসিতে মায়াবী মুখখানি ভরিয়ে তুলল মাহদিয়া। কেমন করে লজ্জা দিচ্ছে দেখো! আদর-ভালোবাসা ও শাস্তির মধ্যে থাকা পার্থক্য সে বুঝে। অবুঝ বাচ্চা তো আর নয়! তার হাসিমাখা মুখ দেখে শাস্তি দিবে না ভাবল শাদাব, অসব তো মজার ছলেই বলেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ এই মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখার, তৃপ্তিভরে দেখার লোভ সামলাতে পারল না দেখেই, একটা ইলেকট্রনিক ক্যাটলি ও দুটো ইনস্ট্যান্ট কফি, একটা সুগার প্যাকেট মাহদিয়ার সামনে রেখে অযথাই কাজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘দু’কাপ কফি বানাও। সময় দশ মিনিট।’
মাহদিয়া অবাক হলেও কাঁধ নাচাল। বলল,
-‘এটা শাস্তি?’
-‘দূর। ওসব তো তোমাকে ভয় দ্যাখাতে বলেছি।’
-‘টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।’
-‘পাগল নও, পাগলিনী হবে। হও, অসুবিধা নেই। তোমার সব পাগলামি আমাকে দ্যাখা মাত্রই ফুঁস করে উড়ে যাবে।’
-‘হ্যাঁ, বলেছে তোমাকে। সবকিছু জেনে বসে আছো।’
-‘বলেছে তো, কিছুক্ষণ আগেই তার প্রমাণ পেয়েছি।’
জবাব না দিয়ে, কফি তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাহদিয়া। কাছেই এর পরিপূর্ণ ব্যবস্থা আছে। রোগী দেখার ফাঁকে দশ-পনেরো মিনিটের যে বিরতি নেয়, ওই সময়ে চা-কফি অথবা স্বল্প পরিসরের নাশতাপর্বটা শেষ করে নেয় শাদাব। মুহূর্তের মধ্যেই শায়লা সুলতানার নম্বর থেকে ফোন এলো। রিসিভ করে সেটা কানে ঠেকিয়ে টেবিলের ওপর আরাম করে বসল সে। বলল,
-‘আসসালামু আলাইকুম শাশুড়ি আম্মা। কেমন আছেন? দিনকাল ভালো যাচ্ছে? শরীর-মন ঠিক আছে? অসুস্থ হলে বলবেন, ফ্রিতে ট্রিটমেন্ট করে দিব। শত হলেও আপনি আমার একটামাত্র শাশুড়ি আম্মা।’
শাদাবের কথা শোনে মিটিমিটি হেসে নীরবে নিজের কাজ সামলাতে লাগল মাহদিয়া। শায়লা সুলতানা কী বলছেন সেটা সে শুনছে না, তবে শাদাবের দুষ্টামিটা ভালো লাগছে। ওপাশ থেকে শায়লা সুলতানা বজ্রাহতের মতো জ্বলে উঠে বললেন,
-‘একদম শাশুড়ি আম্মা ডাকবে না। আমার মেয়েকে তোমার কাছে বিয়ে দিইনি আমি।’
-‘তা বললে তো হয় না শাশুড়ি আম্মা। ম্যারেজ সার্টিফিকেট আছে যে। প্রমাণ লাগলে আরও প্রমাণ দেব। বিয়ের ছবিও আছে। দ্যাখাব?’
-‘বেয়াদব ছেলে। আমার মেয়ের পিছন-পিছন ঘোরা ছেড়ে দাও তুমি। নয়তো খুব খারাপ হবে।’
-‘দুঃখিত শাশুড়ি আম্মা। ওটা আমার বউ। বউয়ের পিছনে ঘুরাঘুরি করা স্বামীদের বৈধগত অধিকার। আমার এই অধিকার আমি এত সহজে ছাড়ছি না।’
শায়লা সুলতানা হাল ছেড়ে দিলেন। শাদাবকে ক্ষ্যাপিয়ে তুলতে বললেন,
-‘নিজেকে তুমি খুব চালাক ভাবো না, টোটোন? তুমি অনেক বোকা। এখনও দিয়াকে সবকিছু যখন বোলোনি, আগামীতেও বলবে না। তাই আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, শত চাইলেও তুমি মা ও মেয়েকে আলাদা করতে পারবে না।’
এবার মায়ের গলায় এমন স্বর শোনে চোখ তুলে তাকাল মাহদিয়া। কিছু বলতে চাইল, কিন্তু পারল না। শাদাব তাকে চুপ থাকতে ইশারা করল। এরপর শায়লা সুলতানাকে বলল,
-‘শাশুড়ি আম্মা, আমি তো এসব ঝামেলা চাই না। আমি চাই, আপনি নিজে ‘ভ্রমর’কে আমার হাতে তুলে দিন।’
-‘অসম্ভব। কখনওই না। তুমি কি জানো, তোমার বাবা ওই সম্পত্তি আর তোমার নামে লিখে দিবে না? তুমি হচ্ছ রাস্তার ফকির। মানুষের দানখয়রাত নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছ। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে শুয়ে লাখটাকার স্বপ্ন দ্যাখছ এখন। বিলেতফেরত মেয়েকে বিয়ে করে কোটিপতি হতে চাইছ। এত সহজ বুঝি সব? আমাকে পথে বসাতে চাও, তুমি? পারবে না। ওই সম্পত্তি আমি আজই দখল করব, না পারলে অন্য রাস্তা দ্যাখব। তা-ও তোমাকে এক কানাকড়িও ভোগ করতে দিব না।’
-‘আপনি তো মহা স্বার্থপর মানুষ। আমার সম্পত্তি থেকে আমাকেই বঞ্চিত করতে চাইছেন! সম্পত্তি দখল করা এত সহজ? চাইলাম আর পেয়ে গেলাম? এরূপ হলে তো আমিও আপনার সম্পত্তি থেকে আপনাকে বঞ্চিত করতে পারি।’
-‘তুমি আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আজই আমার মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যাব আমি। এরপর আগামীকাল বিকেলের ফ্লাইটে ইতালি। ইতিমধ্যে তোমাদের সহায়-সম্পত্তি আমার হাতের মুঠোয় আসতে চলেছে। আমার এত বছরের প্ল্যান আমি নষ্ট হতে দিব, কক্ষনও না। বুদ্ধি দিয়েই তো সবাইকে বাড়িছাড়া করেছি আমি, প্রয়োজনে এবার পৃথিবী ছাড়া করব। শিহাব, সায়রা আপা, এমনকি তুমি। কাউকেই এই সম্পত্তির ভাগ পেতে দেব না। আমার মেয়েকেও না। তোমার সব খেলা শেষ…। হা হা হা।’
শাদাব ও মাহদিয়া দু’জনেই চমকাল। কফির কাপ নিয়ে এগিয়ে এলো মাহদিয়া। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মায়ের মুখ থেকে সব কথা শুনতে চাইল। কথার উত্তরে শাদাব বলল,
-‘ওহ তাই না-কি! আচ্ছা ভালো। যান। সাবধানে যাবেন, ও’কে?’
ফোন রেখে দিতে চাইল শাদাব। মাহদিয়া সেটা কেড়ে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা অন করল। সামনের ক্যামেরা অফ করে স্ক্রিনে শায়লা সুলতানার বিদ্রুপ হাসি দেখতে পেল। তিনি আবারও বললেন,
-‘হ্যাঁ যাব তো। যাওয়ার আগে তোমাদের সবাইকে নিঃস্ব করে দিয়ে যাব।’
ক্যামেরার সামনে এবার দু’জনে একসাথে দাঁড়াল। মাহদিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে শাদাবের কাঁধে মাথা রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তুমি আমার মা তো? সন্দেহ হচ্ছে। এমন একজন খারাপ, লোভী মানুষের গর্ভে আমার জন্ম!’
শায়লা সুলতানা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন। শাদাব প্রশান্তির হাসি হাসল। বলল,
-‘দ্যাখুন, গলায় যত জোর ছিল, সব শেষ। এবার মেয়েকে নিয়ে যান। বার বার বলেছি, একবার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন, আমি আপনাকে মাফ করে দেব। কিন্তু আপনি তো শুনবেন না। বেহুদা লাফঝাঁপ দিবেন। দেন এবার লাফ, দ্যাখি কেমন পারেন। আমরা শীঘ্রই বিয়েশাদী করে, হানিমুনে মালদ্বীপ যাব। আগামী বছর নাতি অথবা নাতনিকে ভিডিওকলে দ্যাখবেন। কেমন? টা টা।’
বিদায় নিয়েও ফোন রাখল না শাদাব। কিছুক্ষণ শায়লা সুলতানার ধরাপড়া শুকনো মুখ দেখল। তিনি তখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, মাহদিয়া ওখানে! যখন বুঝলেন, তখনই ফোনের ওপাশ থেকে চিৎকার করে বললেন,
-‘দিয়া, তুই ওসব বিশ্বাস করিস না। এসব মিথ্যে। ভুল দিয়া, সব ভুল।’
আর কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিল শাদাব। মাহদিয়ার দিকে দৃষ্টি দিল। মেয়েটা পাথর হয়ে গেছে। নিজের মায়ের মুখ থেকে এই কথা শোনে যে স্তব্ধ হয়ে যায়, সে শিহাবকে মায়ের গর্ভে মেরে ফেলার পূর্বপরিকল্পনার কথা শোনে কতটা আঘাত পাবে? মাহদিয়ার মানসিক দুরাবস্থার কথা ভেবে কিছুটা হলেও ভয় শাদাব। তাকে স্বান্তনা দিয়ে বলল,
-‘প্লিজ কেঁদো না। তুমি এত দ্রুত দুর্বল হয়ে গেলে কী করে চলবে? শক্ত হও ভ্রমর। সাহসী হও। সবসময় ভয়কে আঁকড়ে ধরে নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রেখো না। তুমি যদি এক্ষুণি এইভাবে হার মেনে নাও, বাকিপথ এগোবে কী করে, বোলো? এখনও অনেকপথ এগোনো বাকি ভ্রমর, সুন্দর একটা জীবন কাটানো বাকি। অল্পতেই কেন হাল ছেড়ে দিবে? তুমি অনেক সাহসী একটা মেয়ে। এইভাবে ভেঙে পড়ো না। কেউ না থাকুক, আমি তো আছি। ভরসা কোরো একবার।’
মাহদিয়া কথা বলতে ভুলে গেল। শুধু নিষ্পলক চোখে শাদাবের দিকে তাকাল। চোখে চোখে অসংখ্য কথার লেনদেন হলো। আর কোনো সত্য জানার প্রয়োজন নেই তার। সে তার গন্তব্য চিনতে পেরেছে। এই গন্তব্যই হোক তার সুখের ঠিকানা। এবার মা’কে তার করা ভুলের জন্য উচিত শিক্ষা যে পেতেই হবে!
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — তেত্রিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
একজন মা, যত্ন করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে। নিজে সব কষ্ট সয়ে নিয়ে সন্তানকে সুস্থ জীবন দেয়ার আশায়, দীর্ঘদিন অসহ্যরকম শারিরীক ত্রুটিবিচ্যুতি সঙ্গে নিয়ে দিন অতিবাহিত করে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সেই সন্তানকে বুকে আগলে রাখে। সমস্ত ঝড়-ঝাপটা, বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখে মায়ের চেয়ে অস্থির কেউ হয় না। শুধু গর্ভেই নয়, সন্তান বড়ো হওয়ার প্রতিটা পদক্ষেপে মা’কে ছায়া হিসেবে পাশে পায়। মায়ের আদর-মমতা, ভালোবাসা, শাসন-বারণ সবকিছুকে ডিঙিয়ে সে-ই সন্তান বড়ো হতে শিখে। বড়ো হওয়ার পর তার বিবেক-বুদ্ধি, জ্ঞান জাগ্রত হয়। সে মা’কে বুঝতে শুরু করে। মায়ের কষ্ট-সুখ, উপলব্ধি করে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান বাড়িয়ে তুলে। সন্তান জানে, জীবনে যা-ই হোক, মা’কে সে সবসময়ই পাশে পাবে। মা যে তিনি। সন্তানকে বিপদের দিকে ফেলে দিবেন কী করে? কোলেপিঠে করে মানুষ করে, সেই সন্তানকে কেউ জেনে-বুঝে কষ্ট দিবে? সম্ভব না। মায়ের মমতায় এত খামতি থাকতেই পারে না। এ যাবৎ মা সম্পর্কে এরূপ ধারণাই ছিল মাহদিয়ার। ভালোবাসা ছিল, সম্মান ছিল, ছিল ভরপুর শ্রদ্ধাও। কিন্তু আচমকা এই ঝড় তার সব সম্মানকে নিমিষেই দুমড়েমুচড়ে শেষ করে দিল। বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণায় সে একাকী ছটফট করতে লাগল। ডুকরে কাঁদল না, হাউমাউ করল না, শুধু পাথরের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শাদাব তাকে চেয়ারে বসিয়ে হাঁটুভেঙে ফ্লোরে বসে তার দুটোহাত মুঠোবন্দী রেখে বলল,
-‘আজ যা শুনেছ, এইসব কথা আংকেলকে একদমই জানাবে না। ওনি কষ্ট পাবেন।’
নির্বাক চোখে চেয়ে রইল মাহদিয়া। শাদাব ধীরস্থিরভাবে তাকে বুঝিয়ে বলল,
-‘একটা সম্পর্ক নড়বড়ে হয় দুটো মানুষের মধ্যে আসা সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্ম নেয়ার ফলে। তোমার বাবা-মায়ের মাঝখানে এখনও বিশ্বাসটা আছে। আজকের এই কথা যদি আংকেলের কানে যায়, স্ত্রীর থেকে ওনার বিশ্বাসটা চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে। ভালোবাসার বন্ধন ও আত্মিক টানটা নড়বড়ে হয়ে যাবে। ফলস্বরূপ, দূরত্ব ওই সম্পর্কে আসবেই।’
শাদাবের কথার সূত্র এবার বুঝতে পারল মাহদিয়া। বলল,
-‘এসব কথা তুমি লুকিয়ে যেতে বলছ?’
-‘হ্যাঁ, বলছি। কারণ একটাই, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভয়। দ্যাখো, একটা সম্পর্ক ভাঙা যত সহজ, গড়া ততই কঠিন। আমরা দু’জন চেষ্টা করেও আমাদের সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে পারছি না। অথচ আমরা মনের দিক কত কাছাকাছি। যখন একটা সম্পর্কে বিশ্বাস ভাঙনের সূত্রটা দৃশ্যমান হয়, তখন ওই সম্পর্ক আর কোনোদিন জোড়া লাগে না। হয়তো লোকদ্যাখানো সুখ হিসেবে মানুষ সংসার করে, জীবন এগিয়ে নেয়, কিন্তু খুব ভালো করে উপলব্ধি করলে দ্যাখবে, ওই সম্পর্কটা কেবল দায়বদ্ধতার জন্য টিকে আছে।’
-‘তুমি কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না।’
-‘আমি চাইছি না, এই সম্পর্কটা ভাঙুক। দীর্ঘদিনের পবিত্র সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা ও কাজের জন্য ঘৃণার গন্ধ ও স্পর্শ না লাগুক। আমি মা’কে দ্যাখেছি, ভাঙনের তীব্র যন্ত্রণা বুকে নিয়ে কীভাবে দিন কাটিয়েছেন। বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা অনেক কঠিন ভ্রমর। সহ্য করার মতো নয়। ঠিক একই পরিস্থিতিতে তোমার বাবাকে পড়তে দিও না। তুমি কিছু জানো না, কিছু দ্যাখোনি, শোনোনি, ঠিক এইভাবে ওনার সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট করবে।’
-‘আশ্চর্য! মা এতবড়ো একটা অন্যায় করছেন জেনেও তুমি তার প্রতি এত দয়া দ্যাখাবে?’
-‘হ্যাঁ। দ্যাখাব এইজন্য যে, আজাদ আংকেল নির্দোষ। তিনি কিছু জানেন না, তার কোনো অপরাধও নেই। একটা মানুষ দোষ না করেও, কেন বিশ্বাস হারানোর যন্ত্রণায় ভুগবেন? দোষ করেছেন তোমার মা। শাস্তিটা ওনি পাবেন।’
-‘সেটা কীভাবে?’
-‘সেসব আমি দ্যাখব। সব আমার ওপর ছেড়ে দাও। তুমি শুধু নিজেকে ও তোমার বাবাকে নিয়ে ভাবো। অকারণ দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিও না। কারও সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি কোরো না।’
-‘আর ওই সম্পত্তি! এসবের কী হবে?’
-‘ওসব জলে যাক। ওই সম্পত্তির প্রতি কোনো দাবী রাখিনি আমি। যেদিন ‘সুখনীড়’ ত্যাগ করেছি, সেদিন ওই মানুষসহ তার প্রতি সমস্ত অধিকারও ত্যাগ করে এসেছি। ওনি যদি তোমার মা’কে সব সম্পত্তি স্বেচ্ছায় দিয়ে দেন, তুমি আর তাকে বাঁধা দিবে না। এসব নিয়ে কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য করবে না। কথা দাও আমায়?’
-‘কেউ অন্যায় করছে জেনেও তুমি তাকে ছাড় দিবে? ওই সম্পতি তোমাদের হক্ব। কেন সেটা ত্যাগ করবে তুমি?’
-‘যাদের জীবনে বাবার কোনো ভূমিকা নেই, তাদের জীবনে বাবার সম্পত্তিরও প্রয়োজন নেই। চলতে পথে মাথার ওপর ছায়া পাইনি ভ্রমর, আজ কেন শুধু হক্ব আদায়ে ওই সম্পত্তির পিছনে ছুটব আমি? যখন যাকে প্রয়োজন ছিল, তখন সে পাশে ছিল না। মাঝরাস্তায় একা ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, চলে যাও। এখন আর এসবের প্রয়োজন নেই। আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য মা-ই যথেষ্ট।’
মাহদিয়া বুঝল, এই অন্যায় কাজে তার বিবেকহীন মায়েরই জয় হবে। ভালো মানুষ সবসময়ই প্রতারিত হয়। ওই সম্পদ শাদাবের নিজের হওয়া সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে, শুধু বহু বছরের পুরনো ক্ষতের কারণে। সম্পর্কে একবার ভাঙন চলে আসলে, আসলেই তা জোড়া লাগানো কঠিন হয়ে যায়। দুটো মানুষকে আবারও কি এক করা যায়? সমস্ত অবিশ্বাসের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে আবারও কি বিশ্বাসকে সম্পর্কে জাগিয়ে দেয়া যায়? কায়ছার সাহেবের চোখের সামনে যে ভুলেগড়া পর্দা আছে সেটা কি সরিয়ে দেয়া যায়? বাবা-মাকে একসাথে পেলে শিহাবের মুখেও হয়তো এতে হাসি ফুটবে। আনমনেই কতকিছু ভেবে গেল মাহদিয়া। ভাবনা থামিয়ে বলল,
-‘ঠিক আছে, আমি এসব নিয়ে আর একটা কথাও বলব না। তবে হ্যাঁ, মায়ের সাথে ঝামেলা একটা হবেই। এত সহজে তার এই ভুল আমি ক্ষমা করতে পারব না। তুমি হয়তো দয়ার সাগর হতে পারো, কিন্তু আমি তা নই। হবও না।’
-‘মোটেও সেটা নয়। তোমার মা যে অবিচার করেছেন, সেসবের পর আমি কোনোদিন ওনাকে ক্ষমা করব না। উনি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।’
প্রতিটা সন্তানের কাছে মা হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সেই নিরাপদ আশ্রয় যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সাগরে হাবুডুবু খেতে শুরু করে, সন্তান তখন ভেসে যায় কূল-কিনারহীর অথৈজলে। ডুবে ডুবে ভেসে থাকা ছাড়া ওই সন্তানের কাছে আর কোনো পথ খোলা থাকে না। মাহদিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিও তেমন। মায়ের ওই চেহারা না ভুলতে পারছে, আর না তাকে ক্ষমা করার কথা ভাবতে পারছে। ওনি মা হলে কী হবে, সে তাকে কঠিন শাস্তি দিবেই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল মাহদিয়া। শীঘ্রই মায়ের মুখোমুখি হচ্ছে সে। তার আগে এক্ষুণি ‘সুখনীড়’-এর পথে রওনা দিতে হবে তাকে। ওখানে কী হচ্ছে কে জানে! ভয়ভীতি মনে নিয়েই বলল,
-‘রোগীরা বোধহয় বাইরে অপেক্ষা করছে। আমি এখন যাই?’
মাহদিয়ার কথা শোনে টেবিলে রাখা দুটো গরম কফির দিকে তাকাল শাদাব। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চেক করে দেখল, এখনও তা ঠাণ্ডা হয়নি। হাতে তুলে একটা কাপ মাহদিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,
-‘মেহমানকে ডেকে এনে ঠিকমতো আপ্যায়ন করাতে পারলাম না। মনে কোনো অভিযোগ জন্মেছে?’
-‘ছিঃ। কী বোলো। অভিযোগ জন্মাবে কেন? আপ্যায়নের জন্য কফিটাই কি যথেষ্ট নয়?’
-‘ইচ্ছে তো হয়, দু’হাত ভরা সুখরং এনে রাঙিয়ে দিই তোমার আঁচল। অথচ সেটা পারছি না। কোনোদিন পারব কি-না তা-ও জানি না। স্রষ্টা হয়তো চান না, আমাদের এই দূরত্ব শেষ হোক।’
পুরো চেহারায় তার আঁধার নেমে এলো। অভিমানী চোখে তাকিয়ে রইল। শাদাব ভ্রু নাড়িয়ে তার গালে আলতো করে ঠোকা দিয়ে বলল,
-‘অমন করে তাকাবে না মেয়ে। তোমার এমন চোখমুখ দ্যাখলে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় আমার।’
মাহদিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
-‘ইচ্ছে করেই ভয় দ্যাখাচ্ছ আমায়!’
এই গাল ফুলানো, মুখ লুকানো অভিমানটা বড্ড পছন্দ হলো শাদাবের। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জড়ানো গলায় ডাকল,
-‘ভ্রমর…।’
ডাক শোনেও অভিমান সরাল না মাহদিয়া। মুখ ফিরিয়েই রইল। শাদাব তার কাছে এগিয়ে ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
-‘যদি কোনোদিন আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে, কী করবে তখন? ভুল বুঝে সম্পর্কে দূরত্ব টেনে আনবে, না-কি বিশ্বাস পাকাপোক্ত করার সুযোগ দিবে?’
প্রচণ্ড ভয়ে শাদাবের একটা হাত খামচে ধরল মাহদিয়া। বেখেয়ালিতে ধারাল নখ বসিয়ে দিল হাতে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভয় দূর করতে লাগল। জবাবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল শাদাব। ব্যথা পেলেও মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ করল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে শান্ত ও সহজ করল মাহদিয়া। চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল,
-‘কেন জিজ্ঞেস করছ এসব?’
-‘আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস আছে তো?’
-‘অন্যের সংসার ভেঙে যাবে জেনেও যে মানুষ অপরাধী ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে জানে, তাকে এত সহজে অবিশ্বাস করে নিজের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করব?’
-‘আমরা অনেক দূরে ছিলাম তো। সম্পর্কে অবিশ্বাস আসাটা খুবই সহজ ও সাধারণ ব্যাপার।’
-‘দূরে থাকলেই যে অবিশ্বাস আসে, এটা কে বলেছে তোমায়?
-‘কাছাকাছি থেকেও, এত ভালোবেসেও দুটো মানুষ তাদের সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।’
-‘ওইযে, কিছুক্ষণ আগে বললে সম্পর্কে সন্দেহ ও অবিশ্বাস আসলে বিশ্বাসটা নড়বড়ে হয়ে যায়। তাদের সম্পর্ক ভাঙনের কারণ ঠিক এটাই। সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয়। ছোট্ট একটা প্রাণকে বড়ো মামা ঝামেলা মনে করেছিলেন, ভেবেছিলেন, ওই সন্তান তার চলার পথের বাঁধা হবে। সম্মান নষ্টের কারণ হবে। তিনি স্ত্রীর ওপর থেকে ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং নিজেকেও দুর্বল প্রমাণ করেছিলেন। অথচ, ওই সময়টায় একটা নারীর পাশে তার স্বামীকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সম্পর্কে রাগ-অভিমান যখন চলে, একটু দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়ন যখন আসে, তখন মাঝখানে কেউ প্রবেশ করলেই ওই সম্পর্কে ভাঙন নিশ্চিত। ওনাদের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছে। তবে তুমি নির্ভয়ে থাকো, এমন কোনো সিচুয়েশন যদি আমাদের সামনে আসে, তখন ওই মুহূর্তে সমস্ত রাগ-অভিমান, ঝগড়াঝাটি পিছনে ফেলে আমরা শুধু দু’জন-দু’জনের সাপোর্টার হওয়ার চেষ্টা করব। এতে ভাঙন আসা তো দূর, আমাদের মধ্যকার বিশ্বাসটা আরও জোড়ালো হবে। সম্পর্কের খুঁটি মজবুত হবে। কারণ কী জানো? আমাদের সম্পর্কে আমরা কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দিব না। তৃতীয় ব্যক্তি সবসময় পজেটিভ মনোভাব নিয়ে এগোয় না, বরং নেগেটিভ মনোভাব প্রকাশ করে অযথা সন্দেহ বাড়িয়ে বিশ্বস্ত সম্পর্কটার মধ্যে অদৃশ্য এক প্রাচীর তুলে দেয়। আমি চাই না, এমন কোনো কঠিন মুহূর্ত আমার জীবনে আসুক, যে মুহূর্তে তোমার প্রতি আমার সমস্ত বিশ্বাস হারিয়ে যাবে। ওই কঠিন মুহূর্ত আসার আগে আমার মৃত্যু যেন হয়!’
অস্ফুটস্বরে শুধু ‘ভ্রমর’ উচ্চারণ করল শাদাব। পরমুহূর্তেই তাকে দু’হাতের বেষ্টনীতে আগলে নিল। মাথার তালুতে অধর ছুঁইয়ে আবেগঘন কণ্ঠে বলল,
-‘আ’ম রিয়্যালি ভের্যি প্রাউড অব য়্যু, ইন মাই লাইফ। ডোন্ট ওয়ারি, আই উইল কিপ য়্যু’ওর ফেই’থ্ ফোরেভার।’
***
হায়দার সাহেব বাড়িতে নেই দেখে শায়লা সুলতানার সাহস বেড়ে গিয়েছে। ‘সুখনীড়’-এ এসে প্রথমে তিনি দলিল লুকিয়ে রেখেছিলেন। মেয়েকে সামনে পেয়ে নাটকীয় কান্নায় গাল ভাসিয়েছিলেন। কিন্তু মাহদিয়া যাওয়ার পর থেকে কায়ছার সাহেবের সাথে তার তর্কাতর্কি চলছে। ননস্টপ এই তর্কাতর্কি থামাতে আসেন নূরুন্ নাহার। তাকেও কথা শুনতে হলো। তিনি জানেন, মাহদিয়া ওই মুহূর্তে শাদাবের কাছে আছে তাই আর ফোন করেননি। ভেবেছেন, এই তর্কাতর্কি একটা সময় থেমে যাবে। তার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, তবুও দু’জনার তর্কাতর্কি থামল না। শায়লা সুলতানার এক কথা, একটাই দাবী,
-‘আপনি বলেছেন, এই সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিবেন। এখন সেটা দিতেই হবে। আমি দেরী সহ্য করব না। দিয়া ফিরুক, ও’কে নিয়ে চলে যাব।’
জবাবে কায়ছার সাহেবেরও কথা,
-‘এই মুহূর্তে আমি সম্পত্তি দান-খয়রাত করতে আগ্রহী নই। তুমি যেতে পারো।’
-‘তা বললে তো হয় না ভাইজান। আপনাকে আজ এই দলিলে সই করতেই হবে। নয়তো খুব খারাপ হবে।’
-‘খারাপ যা হওয়ার, তা তো অনেক আগেই হয়েছে শায়লা। এখন আর কী খারাপ হবে? ওই সম্পত্তি আমার দুই সন্তানের। ওদের হক্ব আমি কাউকে দিব না।’
শায়লা সুলতানা দু’হাতে তালি বাজালেন। বললেন,
-‘বাহ্, খুবই ভালো। এতদিন আমাকে লোভ দ্যাখিয়ে, আজ আপনি বলছেন, সম্পত্তি আপনার দুই সন্তানের! ওরা যে আপনারই সন্তান, তার কী প্রমাণ আছে?’
-‘প্রমাণ দিয়ে কী করব আমি? আমি কি এতটাই অন্ধ যে আমার সন্তানকে চিনতে পারব না?’
শায়লা সুলতানা রাগে দিশেহারা হয়ে গেলেন। কী করবেন, কিছুই ভেবে পেলেন না। এত সহজে শাদাব এই সম্পত্তি নিয়ে নিবে, তিনি তো মানতেই পারছেন না। লোভ তার সমস্ত দেহ-মনের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। লোভের মোহে পড়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন তিনি। এত স্বাদের সম্পদ, এত বছরের অপেক্ষার ফলস, সহজেই কাউকে নিয়ে যেতে দিবেন কী করে! হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন। ভয়াবহ রাগ থেকে চিৎকার দিয়ে বললেন,
-‘এক্ষুণি আপনি এই দলিলে সই করবেন!’
ব্যাগ থেকে কলম ও দলিল বের করে কায়ছার সাহেবের সামনে নিয়ে গেলেন তিনি। কায়ছার সাহেব পাত্তা দিলেন না। ড্রয়িংরুম ছেড়ে নিজের রুমের কাছে আসলেন। শায়লা সুলতানাও দমে গেলেন না। পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে এলেন। ভেতরে প্রবেশের আগেই তাঁকে বারান্দায় আটকে বললেন,
-‘আপনি কিন্তু অন্যায় করছেন ভাইজান। এই সম্পত্তিতে দিয়ারও অধিকার আছে। আপনি তাকে বঞ্চিত করতে পারেন না।’
-‘দিয়ার ভাগ তখনই সে পাবে, যখন টোটোন ও’কে তার ভাগ বুঝিয়ে দিবে। আমি এসব পারব না।’
হঠাৎ করে হাওয়া যেন উল্টোদিকে বইতে শুরু করল। শায়লা সুলতানার মেজাজে আগুন ধরে গেল। কণ্ঠে ক্ষোভ জড়িয়ে বললেন,
-‘যে সন্তানদের মৃত মানেন, তাদের আবার হক্ব কীসের ভাইজান? ওরা তো মৃত।’
-‘এতদিন ওরা আমার চোখের আড়ালে ছিল, তা-ই মৃত ছিল। কিন্তু ক’দিন আগে স্ব-চক্ষে আমি আমার সন্তানদের দ্যাখেছি। চোখের সামনে দ্যাখেও নিজের সন্তানদের এত সহজে মৃত হিসেবে মেনে নিই কী করে?’
-‘খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভাইজান। যে সন্তানকে মেরে ফেলার জন্য উল্টাপাল্টা ঔষধ খাইয়েছিলেন, আজ সেই সন্তানের জন্য দরদ উথলে ওটা, খুব বেশি মায়া দ্যাখানো হয়ে যাচ্ছে না?’
-‘হলে হবে, তাতে তোমার সমস্যা কী? ওরা আমার সন্তান। সন্তানদের প্রতি মায়া থাকা উচিত তো।’
-‘এত বছর পর ওদের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে চাইছেন, এখন আপনার সম্মানে আঘাত লাগছে না? লোকে জানলে কী হবে ভেবে দ্যাখেছেন?’
-‘আমি লোকের পরোয়া করি না শায়লা। ভুল করেছিলাম, তোমার মতো খারাপ মহিলার কথা শোনে। আমি জানি, যে ভুল আমি করেছি, তার জন্য স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে আমি অপরাধী। ক্ষমাও পাব না কোনোদিন। কিন্তু তাদের হক্ব কোনো কালনা গিনীর হাতে তুলে দিব না।’
গালি শোনে নূরুন্ নাহার আর সামনে আসেননি। এখন কায়ছার সাহেবের এমন কথা শোনে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থেকেই হাসলেন। বিড়বিড় করলেন,
-‘এই বোধবুদ্ধি আগে কোথায় ছিল ভাইজান? কেন একটা রাক্ষ সীর কথা শোনে নিজের সন্তানদের সাথে অন্যায়-অবিচার করলেন? কেন সবাইকে বাড়িছাড়া করলেন? নিজেদের মধ্যকার সমস্যা যদি নিজেরা মিটিয়ে নিতেন, আজ এই সংসারে এত অশান্তি হোতো না। দু’দুটো বাচ্চা সবসময় বাবার সাথে হাসি-আনন্দে থাকত। ‘সুখনীড়’-এ হেসেখেলে বেড়াত দুই ভাই। ঘরটাও প্রাণবন্ত থাকত। ঘরের মানুষগুলোও সুখের দ্যাখা পেত।’
এই দীর্ঘশ্বাসের কথা শুধু শব্দহীনতার মধ্যে আগলে রাখলেন নূরুন্ নাহার। দু’জনার মাঝখানে যাবেন কি-না ভাবলেন। তখন শায়লা সুলতানা গলা ফাটিয়ে বললেন,
-‘আমার হাতে সময় খুব কম ভাইজান। এসব আদিখ্যেতা দ্যাখার সময় আমার নেই। ঝটপট সাইন করুন এখানে।’
জোরপূর্বক কায়ছার সাহেবের হাতে দলিল ও কলম ধরিয়ে দিলেন শায়লা সুলতানা। কায়ছার সাহেব সেটা হাতে তুলে নিলেন। পড়তে শুরু করলেন। শায়লা সুলতানা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-‘পড়ার দরকার নেই। আগে সাইন করুন।’
-‘না পড়ে তো সাইন করব না। আগে পড়ি…।’
শায়লা সুলতানা পড়লেন মসিবতে। পড়া শুরু করলেই তো সব জেনে যাবেন তিনি। এখানে যে শুধু কায়ছার সাহেবের অংশ লেখা নেই, দুই ভাইয়ের জমানো স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা দাবী লেখা। এখন অবধি সম্পত্তি ভাগ হয়নি। তাই হায়দার সাহেবের নামে আলাদা করে কোনো জমিজমাও হয়নি। সব সম্পত্তি-ই একসাথে আছে দেখে লোভে পড়ে একত্রে সব ছিনিয়ে নিতে চান তিনি। এজন্যই এত তাড়াহুড়ো তার। কায়ছার সাহেব যখন দলিল পড়া শুরু করলেন, শায়লা সুলতানা তখন বাঁধা দিয়ে বললেন,
-‘কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছেন ভাইজান? সাইন করে দিলেই তো হয়।’
কায়ছার সাহেব প্রচণ্ড ক্ষ্যাপে গেলেন। ঝটপট চোখ বুলিয়ে একটানে দলিল ছিঁড়ে ফেলে শায়লা সুলতানার মুখের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বললেন,
-‘লোভী, স্বার্থপর মহিলা। শুধু তোমার জন্য আমার সংসারে আগুন লেগেছে। তোমার ফাঁদে পা দিয়ে আমি আমার সাজানো সুখের বাগানটা নষ্ট করে দিয়েছি। তোমাকে আমি পুলিশে দিব।’
কায়ছার সাহেব ফোন বের করে পুলিশের কাছে ফোন দিতে গেলেই শায়লা সুলতানা তার গলা টিপে ধরলেন। তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়ে বললেন,
-‘তোর এত বড়ো সাহস, তুই আমার এতদিনের পরিশ্রমকে নষ্ট করে দিবি। আজ তোকে আমি খু ন করব।’
ক্রমশ হাতের জোর বাড়িয়ে চলছিলেন তিনি। কায়ছার সাহেবও দুই হাত দিয়ে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করছেন। পা দিয়ে লা তি মারছেন। তবুও শায়লা সুলতানাকে থামাতে পারছেন না। রান্নাঘর থেকে এই দৃশ্য দেখে দ্রুত ছুটে আসলেন নূরুন্ নাহার। দু’জনকে সরাতে গেলেই শায়লা সুলতানা ক্ষোভ থেকে নূরুন্ নাহারকে আক্রমণ করে বসলেন। দু’হাতে তার চুল টেনে ধরে বললেন,
-‘সব নাটেরগুরু হচ্ছিস তুই। তোর জন্য সব প্ল্যান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমার। কে বলেছে আমার মেয়েকে নিয়ে মাথা ঘামাতে? কে বলেছে ও’কে ‘গ্রান্ড সুলতান’-এ পাঠাতে? আলগা পিরিতি দ্যাখাতে এসেছিস না? তোর পিরিতি আমি বের করছি, দ্যাখ।’
ছাড়া পেয়ে কায়ছার সাহেব খুকখুক করে কাশলেন। ঠা টি য়ে চ ড় মারলেন শায়লা সুলতানাকে। টাল সামলাতে না পেরে তিনি ছিঁটকে পড়লেন দূরে। কায়ছার সাহেব বললেন,
-‘এই চ ড় টা আরও আগে মারতে পারলে আমার সোনার সংসারে আগুন লাগত না। নাহার, হায়দারকে ফোন কোরো। পুলিশ ডাকো। আজ এই ডাই নীকে আমি হাজতে পাঠিয়েই ছাড়ব।’
নূরুন্ নাহার দ্রুত সরে পড়লেন। পুলিশের কথা শোনে শায়লা সুলতানা যেন আরও জ্বলে উঠলেন। বিপদ বুঝতে পেরেও লোভ-লালসা থামানোর নাম নিলেন না। কোনোমতে দাঁড়িয়ে পূণরায় কায়ছার সাহেবকে আক্রমণ করতে তেড়ে আসলেন। বললেন,
-‘ওইদিন আমি দেশে থাকলে সায়রা আপাসহ তোকে মে রে সবকিছু দখল করে নিতাম। শুধু দূরে থেকে সংসারে ভাঙন ডেকে আনতাম না। এত বছর ধরে, সুখের আশায়, ‘সুখনীড়’-এর আশায় যে প্ল্যান আমি সাজিয়েছি, তা এইভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দেব? কক্ষনও না। আজ আমার মালিকানা চাই-ই চাই। ডাক তুই পুলিশ। কী করবে ওরা? যে লে নিবে? কিচ্ছু করতে পারবে না। তার আগে তোকে আমি জ্যান্ত পুঁ তে ফেলব।’
চোখে জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা নিয়ে কায়ছার সাহেবের গলা টি পে ধরতে গেলেই দুটো হাত আটকে গেল তার। বাড়তি দুটো হাত স্পর্শ করা মাত্রই পাশে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। মাহদিয়ার চোখে অবিশ্বাস, কষ্ট, কান্না। মেয়েকে দেখেই তিনি অভিনয় শুরু করলেন। মুহূর্তেই ন্যাকাকান্নায় গাল ভাসিয়ে বললেন,
-‘দ্যাখ্ দিয়া দ্যাখ্, তোর বড়ো মামা আমাকে মে রে ফেলতে চাইছেন। আমাকে চ ড়ও মে রেছেন। কত খারাপ খারাপ কথা শোনাচ্ছেন।’
কায়ছার সাহেব বড্ড অসহায়বোধ করলেন। মেঝে থেকে ছ্যাঁড়া দলিল তুলে নিয়ে মাহদিয়াকে দেখিয়ে বললেন,
-‘শুধু আমার ভাগের সম্পদ নয়, পুরো ‘সুখনীড়’-এর মালিকানা চাই তোমার মায়ের। যা আমি স্বেচ্ছায় দিতে চেয়েছি, তাতেও হচ্ছিল না তার। প্ল্যান করে, সব সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিতে চাইছিল। আমার সন্তানদের হক্ব আমি একটা কা লসা পকে কী করে দিয়ে দিই, দিয়া?’
মায়ের রূপ এতক্ষণে স্পষ্ট। কিন্তু কায়ছার সাহেবের এই রূপ অচেনা। খুশি হওয়ার বদলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মাহদিয়া। বলল,
-‘এসব তোমার সন্তানদের হক্ব, সেটা তুমি আজ বুঝেছ বড়ো মামা? এত দেরী কেন করলে তুমি? কেন আগে বুঝলে না? কেন পনেরোটা বছর অহেতুক সম্মান ও অহমিকার লোভে নিজের স্ত্রী-সন্তানদেরকে তাদের পরিপূর্ণ অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে?’
-‘আমি বুঝতে পারিনিরে মা। সত্যিই বুঝতে পারিনি। তোমার মায়ের কথায়, সায়রাকে ভুল ঔষধ খাইয়ে সেদিন নিষ্পাপ ভ্রুণ হ ত্যা করতে চেয়েছিলাম। শুধু তোমার মায়ের কথা শোনে…। আজ আমার এত বড়ো ক্ষতি হোতো না, যদি না ওই পাপিষ্ঠা নারীর ফাঁদে পা দিতাম। সন্তানদেরও হারাতাম না, ‘সুখনীড়’-এর সুখকেও হারাতাম না। যা হয়েছে, সবকিছুর জন্য তোমার মা দায়ী।’
কাকে বিশ্বাস করবে, কার কথা শুনবে, কোনো কথারই হিসাব ঠিকঠাক মিলাতে পারছে না মাহদিয়া। তার মায়ের এত রূপ? এত জঘন্য, জঘন্য রূপ? ভাবতেই তো কষ্ট হচ্ছে। গ্রহণ করতে তো আরও বেশি কষ্ট হবে। সে একইভাবে মায়ের হাত ধরে রেখে বলল,
-‘মামা যা বলছেন, সব কি সত্যি মা?’
শায়লা সুলতানা মুখ বাঁকালেন কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে আসছে মাহদিয়ার। মায়ের দিকে তাকাতেও বাঁধছে আজ। তবুও সে কণ্ঠে জোর এনে বলল,
-‘তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি মা, উত্তর দাও।’
-‘আমি কী জানি! তোর বড়ো মামা মিথ্যে বলছেন! আমাকে খারাপ প্রমাণ করতে চাইছেন।’
মায়ের এই কথা শোনে বিস্ময়ের চরম সীমানায় পৌঁছে গেল মাহদিয়া। মা তাকে এত বোকা ভাবছেন দেখে, এতদিনের সব ভালোবাসা ও মায়া-মমতার ওপর একনিমিষেই ভয়াবহ ঘৃণার জন্ম নিল। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল,
-‘সব দোষ বড়ো মামার। তাহলে একটু আগে তুমি যা করতে যাচ্ছিলে সেটা কী ছিল? তোমার হাত এত লম্বা যে তুমি বয়সের পার্থক্য ভুলে গিয়ে একটা মানুষের গ লা টি পে ধরতে যাচ্ছিলে! কী ভাবো তুমি আমাকে? চোখে কালো কাপড় পড়ে ঘুরি? কিছু দ্যাখি না? যত বোকা তুমি আমাকে ভাবো, ততটা বোকা আমি নই মা। আজকের পর তো তোমাকে মা বলে ডাকতেও রুচিতে বাঁধবে আমার! এত ঘৃণা হচ্ছে…। উফ আল্লাহ্…।’
***
চলবে…