#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব ছাব্বিশ
২৬.
বাহিরে মেঘ করেছে আজ। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কখন যেন বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় ধরনীকে তার স্নিগ্ধতায়।বৃষ্টি আসার পূর্বের বাতাসটা একেবারে দেহ ও মন শীতল করা বাতাস!বর্ষণের আভাস পেলেই অনেকের মনে প্রেম জাগে৷ কারো জাগে ভালোবাসার মানুষের প্রতি আবার কারো জাগে স্বয়ং বর্ষণের প্রতি।
কিন্তু ফারাজের আপাতত তাতে মন নেই।অফিসে গিয়ে ফারাজ মাথা ধরে বসে আছে তার কেবিনে। এখন আর ফারদিন আহমেদ তেমন একটা আসেন না অফিসে। দরকার পড়লে আসেন। ফারাজের উপর সবটা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
রাতে ঘুম না হওয়ার কারনে এখন মাথার যন্ত্রণায় ভুগছে সে।চোখ লাল হয়ে আছে তার৷ সকাল বেলা মা কে কোনো রকম বুঝ দিয়ে অফিসে এসেছে৷আখি বেগম বলেছিলেন অফিসে যেতে না। কিন্তু ফারাজের যে সেই রুমে থাকতেও ভালো লাগে না। একাকিত্ব ঘিরে ধরে। সকাল থেকে মাথা ব্যথা নিয়ে বসে ছিল। এখন আর সহ্য হচ্ছে না তাই নীতিকে পাঠিয়েছে একটা ব্লাক কফি আনতে।
কারো শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকালো ফারাজ। নীতি কফি এগিয়ে দিল।ফারাজ কফি হাতে নিল। কফি চুমুক দিতে গিয়েও দিল না৷ নীতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
‘চিনি দেন নাই তো?’
নীতি বোকার মতো বলল,
‘চিনি কে দেয় ব্লাক কফিতে?’
ফারাজ নীতির দিকে ইশারা করে তাকালো।পরক্ষনে নীতি বুঝলো কে দেয়! নীতি নিজের প্রশ্নে নিজেই বোকা হয়ে গেল। লজ্জিত হয়ে বলল,
‘ওহ হ্যা আমিই দিতাম!’
নীতির বলার ভঙ্গিতে হেসে দিল ফারাজ৷ সাথেসাথেই আবার চোখ মুখ কুচকে ফেলল মাথার যন্ত্রণায়।
নীতি ফারাজকে ভুগতে দেখে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘বাসায় চলে যান স্যার।’
ফারাজ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল,
‘না বাসায় রুমে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না।’
নীতি আবার প্রতিবাদী সুরে বলল,
‘এখানেও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। এসে শুধুই বসে আছেন। মাথা ব্যথায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না আপনার।তার থেকে অফিসে না থাকা ভালো না?’
ফারাজ নীতির কথা শুনে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নীতির দিকে বেশ কিছুক্ষন। নীতি ফারাজের এমন দৃষ্টি দেখে ভাবনায় পড়ে গেল। সে কি ভুল কিছু বলেছে?
ভাবা শেষ করে ফারাজ এবার মুখ খুলল। নীতিও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কি বলবে তা শুনার জন্য। ফারাজ চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
‘ you know what niti? আপনি একেবারে ঠিক বলছেন।অফিসে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না।আমাদের ঘুরতে যাওয়া উচিত।চলেন!’
বলে সে নীতিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেল কেবিন থেকে৷ নীতি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কি বুঝালো আর তিনি কি বুঝলেন!ফারাজ কেবিন থেকে বের হয়ে নীতিকে গলা বাড়িয়ে আবার বলল,
‘আসুন নীতি!’
নীতি ফারাজের ডাক শুনে নিজেকে সামলে ফারাজের সাথে সাথে গেল। এটাও ভালো। অফিসে থাকার থেকে বাহিরে মাইন্ড ফ্রেশ করাটা ভালো আইডিয়া।তাই নীতি আর বাধা দান করে নি ফারাজকে।
বাবার গাড়িটা এখন ফারাজ চালায়। ফায়াদের তো নিজের আছেই৷ ফারাজ ভাবছে একটা বাইক কিনবে। যেটাতে হুটহাট করে বেরিয়ে যাওয়া যাবে নিজের মতো করে ঘুরার জন্য। গাড়িতে বসে এই কথাটাই শেয়ার করলো নীতির সাথে ফারাজ। নীতি এক্সাইটেড হয়ে বলল,
‘হুম কিনতে পারেন স্যার। আমার বাইক অনেক পছন্দ।’
ফারাজ নীতির এক্সাইটমেন্ট দেখে বলল,
‘আরে বাহ তাহলে আপনিও কিনেন একটা।’
নীতি মন খারাপ করে বলল,
‘চালাতে পারি না।বাবা বলেছিল শিখাবে কিন্তু..’
ফারাজ নীতির মন খারাপ দূর করার জন্য বলল,
‘আমি শিখাবো। টেনশন কিসের?’
‘হুম’
নীতির মন অন্যদিকে নেওয়ার জন্য ফারাজ এবার নীতিকে ডেকে বলল,
‘আপনি কি জানেন নীতি? আপনাকে কুর্তি তে অনেক সুন্দর লাগে। ‘
হঠাৎ প্রশংসা শুনে নীতি একটু লজ্জা পেল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো হালকা। তা দেখে ফারাজ দুষ্টুমি করে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল,
‘ওমাহ! আপনি লজ্জা পাচ্ছেন?’
একথায় যেন নীতির লজ্জা আরো বেড়ে গেল। সে বাহিরে তাকিয়ে বলল,
‘ একদম না’
ফারাজ শব্দ করে হেসে দিল। নীতি আর ফারাজের দিকে ঘুরলো না। বাহিরেই তাকিয়ে রইলো।ফারাজ হাসি থামিয়ে এবার স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘ একদম সত্যি করে বলছি আপনাকে সুন্দর লাগছে। আপনাকে শাড়িতেও বোধহয় খুব সুইট লাগবে। ট্রাই করতে পারেন।’
ফারাজের মনোযোগ রাস্তায়। নীতি তাকালো ফারাজের দিকে। বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর সামনে মনোযোগ দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
ফারাজ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে জবাব দিল,
‘এমন একটা জায়গায় যেটা আপনি অনুভব করেন নি কখনো। গেলে বুঝতে পারবেন।’
বাকিটা রাস্তা কেউ আর কোনো কথা বলল না।
গাড়ি থামলো বেশ দূরে নদীর পাড়ে। নীতি গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। চারদিকে দারুন বাতাস। বাতাসের দরুন নদীতে ছোট বড় ঢেউ খেলা করছে। অনেকেই এসেছে ঘুরতে। নীতি চারদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,
‘নদীর পাড় এ ঘুরতে এসেছি?’
ফারাজ গাড়ি লক করে নদীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘নদীর পাড়ে নয়। আমরা আসলে নদীতে ঘুরতে এসেছি।’
বলে হাত দিয়ে নৌকার দিকে ইশারা করলো ফারাজ। নৌকা দেখে নীতি ঢোক গিলল।ভীত স্বরে বলল,
‘আমি যাবো না। আকাশের অবস্থা দেখেছেন? তারউপর এই ছোট ছোট নৌকা? না না। আমি যাবো না।’
ফারাজ বলল,
‘ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনিও সাতার জানেন আর আমিও।আর যদি বৃষ্টি আসে তাহলে তো দারুন ব্যাপার হবে।নদীর মাঝে বৃষ্টি বিলাস! এ যেন আলাদা এক অনুভূতির সৃষ্টি করবে।’
নীতি তবুও উঠতে চাচ্ছিল না। নদীর ঢেউ এ এরকম ছোট নৌকাতে উঠতে তার ভয় করছে। ফারাজ অনেকটা জোড় করে নীতিকে উঠালো।
নৌকা দুলছে ঢেউ এর তালে তালে।নীতির পরাণটাও যেন দুলছে সাথে।সে সাতার জানে তবে সেটা শুধুই পুল পর্যন্ত কিন্তুএতো বড় নদীতে!ফারাজ খুব উৎসাহ নিয়ে আশে পাশে তাকাচ্ছে।অনেক বছর পর নৌকা তে উঠলো আবার। আগে বন্ধুদের সাথে কতো উঠেছে!
নৌকা মাঝ নদীতে পৌঁছাতে নীতি খিচে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।বাতাসের আর ঢেউএর কারনে তার মনে হচ্ছে এটা যেকোনো সময় উলটে যাবে।
নীতির দিকে চোখ যেতেই ফারাজ কপাল চাপড়ালো। নীতির কাছে গিয়ে বলল,
‘চোখ খুলুন নীতি’
নীতি সেভাবেই বলল,
‘না না আমি পড়ে যাবো।’
ফারাজ এবার হালকা ধমক দিয়ে বলল,
‘যা বলেছি করুন।’
নীতি ধীরে ধীরে চোখ খুলল।মূলত ফারাজের ধমকে তার একটু খারাপ লেগেছে।ফারাজ এবার নীতি কে বলল,
‘আশে পাশে তাকান। ‘
নীতি মনে মনে ফারাজকে ভেঙচি কেটে আশে পাশে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর! আকাশ নদী যেন একসাথে মিলে গিয়েছে। বাতাসের কারনে নীতির চুল উড়ছে এলোমেলো ভাবে।নীতি সেগুলো হাত খোপা করে ফেলল। ফারাজ প্রথমে একবার ভাবলো বলবে খোলা থাকুক কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো কি দরকার!
নীতি বসে থেকেই আশে পাশে তাকাচ্ছে হাসি নিয়ে। মন প্রাণ শীতল করা পরিবেশ৷ এখন আর নৌকার দোলনে ভয় পাচ্ছে না সে।সে এখন আনন্দে দুলছে।
‘স্যার এতো সুন্দর কেন!’
ফারাজ হাসলো নীতির কথা শুনে। ফারাজ মুচকি হেসে বলল,
‘আমার বাংলাদেশ অনেক সুন্দর যদি সেটা মন দিয়ে অনুভব করা যায়।’
নীতিও অনুভব করলো। হুম সুন্দর।বাংলাদেশ সুন্দর।এর মানুষগুলোও।
নীতি এবার চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনার মাথা ব্যথা কমেছে?’
ফারাজ নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়লো মাথার নিচে হাত দিয়ে।আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
‘এই ঠান্ডা পরিবেশ পেয়ে মাথা ব্যথার কি সাধ্য আছে আমাকে কাবু করার?’
নীতি আর কিছু বলল না। বেশ কিছুক্ষণ পর ফারাজ জিজ্ঞেস করলো,
‘কাউকে ভালোবাসেন নীতি?’
প্রশ্নে চমকে উঠলো সে। ছোট্ট একটা প্রশ্ন অথচ এটা শুনে নীতির হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। মাথা নিচু করে ধীর স্বরে শুধালো,
‘বাসি স্যার!’
ফারাজ তা শুনে উৎসুক হয়ে হাসি মুখে বলল,
‘ কে সে?আমাকে তো বললেন না কখনো!সে কে?আপনাকে ভালোবাসে? ‘
নীতি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
‘সে আমাকে ভালোবাসে না স্যার। সে জানে ও না আমি তাকে ভালোবাসি’
ফারাজ নীতির কথা শুনে আবার আকাশে পানে তাকিয়ে রইলো। বলল,
‘তাহলে জানানো উচিৎ। হারিয়ে যাওয়ার আগে জানানো৷ উচিৎ। ‘
নীতি মুখে কিছু বলল না। তবে মনে মনে বলল,
‘জানালে হারিয়ে যাবে। থাকুক কিছু মানুষ অজানাতে।’
ফারাজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সে প্রকৃতিতে ডুবে আছে। অনুভব করছে পরিবেশ টাকে। হয়তো বা কারো স্মৃতিতেও ডুব দিচ্ছে।আশে পাশে খেয়াল করলে সে বুঝতো কেউ তাকে দেখায় ডুবে আছে।ভীষন মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে।
———————
‘হ্যালো’
‘বাহিরে বৃষ্টি হবে বোধহয়’
‘তো?’
‘আসুন পেম আলাপ করি।’
ফায়াদ প্রেসক্রিপশন লিখছিল।সামনে একবার রোগীকে দেখে বলল,
‘ হোল্ড এ থাকো।’
অপরাজিতা ১০ মিনিট অপেক্ষা করলো।
‘এতো প্রেম আলাপ আসে কোথা থেকে? আজ কোচিং এ গিয়েছো?’
অপরাজিতা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
‘কি আজব! আমি বলছি ভালোবাসার কথা আপনি বলছেন পড়ার কথা’
ফারাজ হাসলো।অপরাজিতা বলল,
‘গিয়েছি গিয়েছি!’
‘বাসায় তুমি?’
‘হুম।আপনাকে দেখবো।’
ফারাজ ফোন কানে ঠেকিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে বলল,
‘কাল তো অনেকটা সময় দেখলে। মন ভরে নি?’
অপরাজিতা মিষ্টি হেসে বলল,
‘আপনাকে দেখে আমার কখনো মন ভরে না।’
ফারাজ চোখ বন্ধ করে বলল,
‘তোমার মন কখনো না ভরুক।’
তারপর দুজনে বেশ খানিকটা সময় চুপ রইলো৷ তারপর ফায়াদ বলল,
‘বিকালের পর রেডি থেকো। আমি এসে নিয়ে যাবো। মা হয়তো তোমার মাকে ফোন করে জানিয়ে দিবে।এখন রাখছি। আর দুজনকে দেখে বাসায় যাবো।’
ফোন রাখতে গিয়েও ফোনটা আবার কানে ঠেকালো সে। ডাক দিল,
‘অপরাজিতা?’
অপরাজিতা তখনও ফোন কানে ঠেকিয়ে ছিল।বলল,
‘হুম’
ফায়াদ কবিতার মতো করে বলল,
‘তুমি আমার এমনি একজন যাকে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন।ভালোবাসি ভালোবাসার ফুল।’
ফোনটা কেটে গেল। কিন্তু তা অপরাজিতাকে ঘোরে রেখে গেল। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক করে দিল সে। পেশায় সে ডাক্তার অথচ অপরাজিতাকে সে প্রেমের অসুখে ভোগায়।
(চলবে)
#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব সাতাশ
২৭.
নৌকাটা অনেক সময়ের জন্য ভাড়া করেছিল নীতি। সেখানে শুয়ে ছিল ফারাজ আর নীতি পা ঝুলিয়ে বসেছিল। অনেকটা সময় থাকার পরে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো তাদের ভিজিয়ে দিতে৷ দুজনেই মনের আনন্দে ভিজছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো কিছুক্ষণ পর। নীতি হাচি দিতেই আছে একটার পর একটা।ইতিমধ্যে দারুন ঠান্ডা লেগে গেছে তার। তাই উপায় না পেয়ে ফারাজ নীতিকে নিয়ে গাড়িতে চলে আসলো।
গাড়িতে একটা তোয়ালে রাখা ছিল আগে থেকেই।ফারাজ তোয়ালে টা নীতিকে এগিয়ে দিল।নীতি তা নিয়ে মাথা মুছে নিল৷ নীতি হাচি দিতে দিতে বলল,
‘কি একটা অবস্থা বলেন তো স্যার।এতো তাড়াতাড়ি ঠান্ডা লেগে গেল।’
ফারাজ নীতি দিকে তাকিয়ে হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘আপনি এমন ব্রয়লার মুরগী তা তো জানতাম না নীতি।’
নীতি প্রতিবাদ করে বলল,
‘আমি ব্রয়লার না। আপনার আগেই মাথা ব্যথা ছিল।এখন ভেজার কারনে দেখবেন জ্বর ও চলে আসবে।’
ফারাজ হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
‘আমার বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে না।’
নীতি ভ্রু কুচকে নিজের সাথে নিজে বির বির করে বলল,
‘তাহলে কি আমি আসলেই ব্রয়লার মুরগি?’
ফারাজ নীতির বিরবির শুনে শব্দ করে হেসে দিল। নীতি লজ্জা পেয়ে গাল ফুলাল। ফারাজ হাসতে হাসতে অনেকটা সময় নিয়ে হাসি থামালো। হাসি থামিয়ে নীতির দিকে তাকাতেই এক মুহূর্তের জন্য ফারাজের কি যেন হয়ে গেল। ঠান্ডা লাগার কারণে নীতির নাক গাল পুরো লাল হয়ে গিয়েছে।তার উপর সে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। ভেজা চুল,চোখেমুখে বৃষ্টির স্নিগ্ধতা।
দৃশ্যটি দেখে ফারাজের মনে এক মুহূর্তের জন্য অন্যরকম অনুভূতি বয়ে গেল। এই মুহূর্তে কেউ যদি ফারাজকে জিজ্ঞাসা করত আপনার কাছে সুন্দরী রমণী কে? ফারাজ হয়তো নীতির নামটাই নিত।
নিজের ভাবনা নিজের অবাক হচ্ছে ফারাজ। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। হঠাৎ এই অনুভূতি কেন?ফারাজ নিজেকে বুঝ দিচ্ছে যে নীতি সুন্দর। সুন্দরকে সুন্দর বলা কোনো অপরাধ নয়। হুম এটাই।
তারপর সে গলাখাকারি দিয়ে বলল,
‘এবার বাসায় যাওয়া যাক।’
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাড়ির পথে চালানো শুরু করলো।
বাড়ি পৌঁছে দুজনকে খুব বকা খেতে হয়েছে আখি বেগমের কাছ থেকে।কাউকে ছাড় দিচ্ছিলেন না আখি বেগম। নীতি চালাকি করে সব দোষ ফারাজের উপর চাপিয়ে দিয়ে সে রুমে চলে গেল।
ফারাজ অবাক হয়ে নীতি কে দেখলো। নীতি তাকে কিভাবে ফাসিয়ে দিয়ে গেল মায়ের কাছে! মেয়ে জাতি!!
আসরের পর ফায়াদ,ফারাজ এবং নীতি বের হয়েছে অপরাজিতাকে পিক করতে। তারা যাবে শপিং মলে। অপরাজিতার জন্য একটা শাড়ি কিনবে আকদ উপলক্ষে। আখি বেগম চান শাড়ি অপরাজিতার নিজের পছন্দের হোক।ফায়াদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে তারা। ফারাজ চালাচ্ছে গাড়ি। ফায়াদ বসেছে প্যাসেঞ্জার সিটে।নীতি পিছনে৷ নীতির ঠান্ডা এখনো কমে নি৷ টিস্যু দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর নাক মুচছে সে।
ফায়াদ তাকে ওষুধ দিয়েছিল। কিন্তু সে খেতে ভুলে গিয়েছে।
‘হাচ্চি!!’
শুনে ফায়াদ টিস্যু এগিয়ে দিক পিছে নীতিকে৷ ফারাজ নীতির অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। নীতি টিস্যু নিয়ে ফায়াদ কে বলল,
‘জানেন ভাইয়া কিছু মানুষ অন্যের বিপদে হাসে।’
ফারাজ তা শুনে এবার জোরে হেসে দিল। নীতি ভেঙচি কেটে নাক মুছলো।ফারাজ দুষ্টুমি করে বলল,
‘আস্তে আস্তে! এভাবে তো নাক ছুটে হাতে চলে আসবে।’
এবার ফায়াদও হেসে দিল নিশব্দে।নীতি অসহায় চোখে তাকালো ফারাজের দিকে৷ চোখ দিয়ে হয়তো বলতে চাচ্ছে আর কতো চেতাবেন!
অপরাজিতার বাসার সামনে গাড়ি থামাতেই অপরাজিতা বাহিরে আসলো। নীল রঙের থ্রিপিস এ তাকে আসলেই অপরাজিতা ফুল লাগছে।
অপরাজিতা গাড়ি খুলে পিছনে বসতে গেলে ফারাজ থামিয়ে দিয়ে নীতিকে বলল সামনে এসে বসতে। ফায়াদকে বলল,
‘ভাই পিছে গিয়ে তোর বউ এর সাথে বস।’
নীতি বের হয়ে সামনে বসলো।ফায়াদ এবং অপরাজিতা পিছে বসলো।অপরাজিতা পিছে বসেই ফারাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘বাহ আপনি তো খুব ভালো ভাই!’
ফারাজ পিছে ঘুরে বলল,
‘কিন্তু আপনি মোটেও ভালো ভাবি না। আমার চুল টেনেছেন আমি ভুলি নি।’
অপরাজিতা ভাব নিয়ে বলল,
‘ভালো করেছি। আবার আসিয়েন ডাক্তার সাঝতে।’
ফারাজ কথা টা তুলেছিল অপরাজিতাকে একটু লজ্জা দিতে। কিন্তু এর মধ্যে তো কোনো ভাবাবেগই নেই৷
ফারাজ কপাল চাপড়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।গাড়ি চালাতে চালাতে সে বলল,
‘ভাই তোর ওয়াইফাই তো আমার থেকে অনেক ছোট তাকে নাম ধরে ডাকলে কি মাইন্ড করবে নাকি?’
ফায়াদ একবার অপরাজিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘না। ডাকতে পারিস।’
ফারাজ এবার অপরাজিতাকে লজ্জা দেওয়ার আরেকটু চেষ্টা করে বলল,
‘তো পুচকি ফুল! আপনি তো খুব ছোট।আমার ভাইকে সামলাতে পারবেন তো?’
সম্বোধন শুনে অপরাজিতা চোখ বড় বড় করে ফায়াদের দিকে তাকালো। ফায়াদ কি তাকে এই নামে সম্বোধন করে তার বাসায়? ফারাজের কথা শুনে ফায়াদ এর ইচ্ছা করলো ফারাজের কানের নিচে দুটো থাপ্প’ড় দিতে। সে জানে ফারাজ ইচ্ছে করে এই নাম বলেছে এখন। অপরাজিতা ফায়াদের দিকে তাকাতেই ফায়াদ অন্যদিকে তাকালো।
অপরাজিতা সম্বোধন শুনে মেকি হেসে বলল,
‘পারবো না কেন ভাইয়া? সামলাতে না পারলে তো আর উনি আমার প্রেমে পড়তেন না। এই যে উনি হুটহাট বেসামাল হয় তখন তো আমিই সামলাই।এগুলো কি বলার মতো বলেন।তাই আর কিছু বললাম না।’
ফারাজ চেয়েছিল অপরাজিতাকে লজ্জা দিতে কিন্তু এখন সে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে।সে বুঝতে পারলো এই মেয়ের সাথে কথায় পারবেনা।
তাই আর বৃথা চেষ্টা না করে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিল সে। নীতি ফারাজের অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসলো।
অপরাজিতা একটু একটু করে ফায়াদের কাছ ঘেঁষে বসলো। ফিসফিস করে বলল,
‘আপনি আমার এসব আজেবাজে নাম ছড়াচ্ছেন কেন?’
ফায়াদও ফিসফিস করে বলল,
‘আমি কিছু করি নি।’
অপরাজিতা কিছু বলতে যাবে তখনি ফারাজ কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করে অপরাজিতাকে বলল,
‘আমি কিন্তু দেখেছি আপনি একটু একটু করে আমার ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাকে শাসাচ্ছেন’
অপরাজিতা ফিক করে হেসে বলল,
‘আমি মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না ভাইয়া। কারন লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু হয় নি এখনো। ডাক্তার সাহেব হয়তো আপনাকে বলে নি আমার স্বভাবের কথা। লজ্জা থাকলে আপনার ভাইকে পেতাম না।’
ফারাজ অবাক হয়ে বলল,
‘ভাই আসলেই কোথা থেকে পেলি এটাকে৷ নীতিকে দেখি কিছু বলার আগেই লজ্জা পায়৷ আর উনাকে কতো কিছু বললাম!’
ফায়াদ এবার নিজেই অপরাজিতা কাছ ঘেঁষে বলল,
‘she is all rounder. সব পারে।’
অপরাজিতা এবার সত্যিকারে একটু লজ্জা পেল ফারাজের সামনে ফায়াদ এভাবে বলায়।
ব্যাপার টা খুবই সুইট লাগলো ফারাজ এবং নীতির কাছে।
শপিং মলে প্রবেশ করতেই ফায়াদ অপরাজিতার হাত হাতের মুঠোয় ভরে নিল। যেন অপরাজিতা ছোট একটা বাচ্চা। অপরাজিতা প্রতিবাদ করলো না। সে উপভোগ করছে এই ছোট ছোট কেয়ার গুলো।
শাড়ির দোকানে বসে এতো শাড়ি দেখতে দেখতে অপরাজিতা হয়রান। ফায়াদকে বলেছিল হেল্প করতে কিন্তু ফায়াদ বলে সে জানেনা।এবার অপরাজিতা জিদ দেখিয়ে বলল,
‘শাড়ি কি পছন্দ করে দিবেন নাকি বাসায় চলে যাবো?’
নীতি অপরাজিতার জিদ দেখে ফারাজকে ফিস ফিস করে বলল,
‘স্যার চলেন আমরা অন্য জায়গায় যাই।এরা আবার মারামারি লাগবে না তো?’
ফারাজ ও ফিসফিস করে বলল,
‘আরে দাড়ান দেখি। ভাইয়ের ইম্যাচুর মেয়ে আগে পছন্দ ছিল না কারন তাদের আলাদা করে হ্যান্ডেল করতে হয়। দেখি ভাই কি করে?’
ফারাজ অপরাজিতার কাছে এসে বলল,
‘ওকে ওকে দিচ্ছি।’
নীতি ফারাজকে বলল,
‘কিছুই তো হলো না।’
ফারাজ চ জাতীয় শব্দ করে বলল,
‘আহারে আমার ভাই টা গেসে’
নীতি উৎসুক হয়ে বলল,
‘কোথায় গেছে?’
ফারাজ নীতির মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
‘আরে প্রেমে ডুবে গেছে।’
বলে ফারাজ এগিয়ে গেল ফায়াদ আর অপরাজিতার দিকে। নীতি মাথা ঘষে বলল,
‘তা তো আমিও গেছি।’
তারপর সেও এগিয়ে গেল তাদের দিকে। গিয়ে দেখলো দুজনে মিলে সুন্দর একটা শাড়ি পছন্দ করেছে।তারপর টুকটাক আরো কেনাকাটা করে তারা যাচ্ছিল রেস্টুরেন্টে। খাওয়াদাওয়া করবে তাই।
যাওয়ার পথেই নীতি হাচি দিতে গিয়ে একটা লোকের সাথে বারি খেলো মাথায়।
মাথা ঘষে সামনে তাকাতেই লোকটা তাকে স্যরি বলল।
তারপর পাশে তাকাতেই বলল,
‘আরে অপরাজিতা না?’
‘রাফিদ ভাইয়া?’
রাফিদ নামের লোকটি বলল,
‘আরে কি অবস্থা। কতদিন পর দেখা হয়েছে।’
অপরাজিতা খুবই হাসি মুখে কথা বলছে। অপরাজিতাকে এভাবে কথা বলতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ফায়াদ। ফায়াদদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল অপরাজিতা। রাফিদ অপরাজিতাকে ক্যারাটের বেসিক শিখিয়েছিল একাডেমি তে।অনেক আগের কথা এটা। অপরাজিতা একটা টাইমে ক্যারাটে শিখেছিল শখ করে।
রেস্টুরেন্টে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে ফায়াদ।রাফিদ নামের লোকটিকে অপরাজিতা এখানেও ইনভাইট করে নিয়ে এসেছে। দুজনের সে কি আলাপ!ফায়াদের ইচ্ছে করছে অপরাজিতাকে এখান থেকে টেনে নিয়ে বের হয়ে যেতে। সে চুপচাপ বসে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরাজিতার আপাতত তাতে খেয়াল নেই। সে ব্যস্ত আগের দিনের গল্প করতে।
ফায়াদ এবং অপরাজিতার কান্ড বসে বসে খেয়াল করছে নীতি এবং ফারাজ।ফারাজ নীতিকে বলল,
‘ধাক্কা খাওয়ার আর মানুষ পেলেন না?’
নীতি অপরাজিতা এবং রাফিদ নামের লোকটির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,
‘পাইনি বোধহয়’
ফারাজ আরেকটু নিচু করে বলল,
‘আমার ভাই জ্বলতেছে ‘
নীতি বলল,
‘শান্ত ভাবে বসে আছে তো!’
ফারাজ বলল,
‘আরে দেখেন দেখেন।’
তার কিছু মুহুর্তের মধ্যেই ফায়াদ দাড়িয়ে গেল। ফায়াদকে দাড়িয়ে যেতে দেখে অপরাজিতা তাকালো। ফায়াদ অপরাজিতার হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো। ফারাজ কে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর শান্তকণ্ঠে বলল,
‘আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি নীতিকে নিয়ে এগুলো নিয়ে বাসায় চলে আসিস।’
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অপরাজতার হাত ধরে হাটা ধরলো।হঠাৎ এরকম করায় অপরাজিতা হকচকিয়ে গেল।এটা কি হলো! কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!
রাফিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে ফারাজকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে?’
ফারাজ দুষ্টুমি করে বলল,
‘হয় নি। হবে অনেক কিছু।তাই না নীতি?’
নীতি কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না।কি হবে?কি হতে পারে?ভাবনায় পড়ে গেল নীতি।
(চলবে)