অবাধ্য বাঁধনে পর্ব-২১+২২

0
347

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২১ক]
_____________________
কান্নার দরুনে মৃদু শরীর কাঁপছে ঈশার।প্রচন্ড জেদ মাথায় চড়া হতেই কান্না বাড়লো তার।নাকটা কেমন জমাট বেঁধে গেছে অনেকবার টেনে টেনে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত সে।একটু কাঁদলেই নাকটা এত জ্বালায় কেন?
ঈশানের উপস্থিতি ঈশার খারাপ লাগা বাড়ালো।মেয়েগুলো বেশিভাগ সময় তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে আর সেটা তার সয়ে গেছে কিছু বলতে চাইলেও পারবে না।সিনিয়র বলে মাথা কিনে রেখেছে।কিন্তু ঈশান তো দেখে নিয়েছে ঈশাও কারো কাছে অপদস্ত হয়।পান থেকে চুন খসলে ঈশানকে অপদস্ত করতে ছাড়ে না সেই ঈশানকে আগামীতে চোখ তুলে কিছু বলা যাবে না। নিশ্চয়ই ছেলেটা এসব কথা তুলে খোটা দেবে।ভাবতেই কান্না পেলো ঈশার।শরীরটা কেঁপে উঠলো পুণরায়।নাকের পানি এসে গেছে হাতের টিস্যুর সাহায্যে ঘষে ঘষে নাকটা পরিষ্কার করতে গিয়ে কেমন লাল করে ফেলেছে।
ঈশান পাশে দাঁড়িয়ে তার কার্যকলাপ দেখছে।মেয়েটা কেমন ফোঁপাচ্ছে।

” নাকটা এবার ছিড়ে রাস্তায় পড়বে।তখন আমার গায়ের ঘ্রাণ শুকবে কে শুনি?এত দামি দামি পারফিউম লাগানোটা তো বৃথা যাবে।”

ঈশা চটজলদি তাকিয়ে চোখ সরালো।ঈশানের গায়ের গন্ধ সে শুকবে কেন?অদ্ভুত কথাবার্তা।একটা বাস এসে থামলো ঈশা দ্রুত পায়ে উঠে পড়লো বাসে।তার পিছু পিছু বাসে উঠে ঈশান।দেশে আসার পর লোকাল বাসেই তার যাতায়াত ছিল।
ধীরে ধীরে যখন তার জীবন পালটে গেলো তখন পালটে গেলো যাতায়াত ব্যবস্থা।আজ অনেকদিন পর আবার লোকাল বাসে উঠা হলো।ঈশা চটজলদি একজন বৃদ্ধার পাশে খালি সিটে বসতে চাইলো।ঈশান তার কান্ডকারখানা বুঝতে পেরে বাহু টেনে অপর পাশে থাকা খালি সিটে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আনে।ঈশান গায়ের সাথে গা ঘেষে ঈশাকে জানলার পাশে বসতে বাধ্য করে।ঈশার প্রচন্ড রাগ হলো সিনক্রিয়েট না করে নাক ফুলিয়ে বসলো বেশ চেপে।ঈশান চুলে হাত বুলিয়ে আরামে গা এলিয়ে দিলো সিটে।পকেট থেকে মাক্স বের করে দ্রুত মুখ ঢাকার প্রয়াশ চালালো।যেহেতু লোকাল বাস সেই হিসেবে হুড়োহুড়ি করে বেশ মানুষজন উঠলো অনেকেই বসার স্থান পেলো অনেকেই দাঁড়িয়ে রইলো বাস ছুটলো তার গতিতে।ঈশার এবার নিজের প্রতি প্রচন্ড রাগ লাগলো অনুকে একা ফেলে রেখে এসেছে সে।ব্যাগ থেকে ফোন বের করে অনুর নাম্বার তুলতে ঈশান বলে,

” রাসেলের দায়িত্বে ছেড়ে এসেছি অনুকে।ফোন করে ওদের ডিস্ট্রাব করো না।ঠিক সময় মতো বাসায় পৌঁছে দেবে।”

ডিস্ট্রাব! এখানে ডিস্ট্রাবের কি পেলো ঈশান?সে তার বান্ধবীর খোঁজ নেবে এখানে…
ঈশার ভাবনারা বেশি দূর গেলো না তার আগে ঈশান বলে,

” মেয়েগুলো কতদিন ধরে তোমায় বিরক্ত করছে?”

সচল মস্তিষ্ক অচল হয়ে এলো ঈশার।ঈশানের সামনে এই ব্যপারে কথা বলতে তার ইচ্ছে করছে না নিজের ইগোতে লাগছে প্রচন্ড।ঈশান বুঝতে পেরে দমে যায়।বাস জায়গায় জায়গায় থামছে এবং যাত্রী তুলছে মানুষের জায়গা না হলে ঠেসে ঠেসে যাত্রী দিয়ে ভরতি করছে কন্টাক্টর।কিছুটা সময়পর কন্টাক্টর এলো ভাড়া নিতে ঈশা টাকা হাতে নিতে ঈশান ভাড়া মিটিয়ে দিলো ঈশা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

” টাকার গরম দেখাচ্ছেন?আমার ভাড়া আমি মিটিয়ে দিতাম আপনাকে তো বলিনি।”

” তোমার ভাড়া তুমি দিতে আমার সিটের ভাড়াটা তো দিতে না?”

“অবশ্যই না।আপনাকে আমি সেধে সেধে আমার সাথে বাসে উঠাইনি।”

” এত কৃপনতা করে না জান।কাছের মানুষের জন্য কৃপনতা করা বেমানান।”

জান!কাছের মানুষ!থমকে গেলো ঈশা।ঈশান তাকে জান ডেকেছে।এই মানুষটা তো তার সহ্যর বাঁধ ভাঙছে।

” আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন ঈশান।আমার পাশ থেকে উঠুন।”

“কেন ওই বুড়ো দাদুটাকে বসাবে পাশে?আমাকে বিয়ে না করলে এমন বুড়ো দেখে বিয়ে করিয়ে দিবো তোমায়।তখন শারীরিক মানসিক দিক না কুলিয়ে ঠিকি এই জোয়ান ছেলের কাছেই আসবে।”

ঈশা দাঁতে দাঁত চাপলো।কোলে থাকা ওড়নাটা খামছে ধরলো সহসা।ঈশান তার কান্ড দেখছিলো এই মুহূর্তে মেয়েটাকে রাগিয়ে দিতে বড্ড বেশি ভালো লাগছে।

” ভয় পায় না জান বুড়োর সাথে বিয়ে দিবো না।”

জান জান শুনতে শুনতে ঈশা মাথা চেপে ধরলো।এই মানুষটা কি তার পিছু ছাড়বে না কখনো?ঈশান হাসে ঈশাকে জান বলে ক্ষেপাতে তার বড্ড ভালো লাগছে।ওত তেল মশলা মাখিয়ে বাদ বাকি প্রেমিকের মতো প্রেম তার ধারা হয়তো কখনো হবে না কিন্তু কে জানে মাঝে মাঝে কিছু অসাধ্য সাধন হয়ে যায় তার জীবনে।যেমন ঈশা। এই মেয়েটাকে তো জানে মা রা র পরিকল্পনা সাজিয়েছিলো ঈশান কিন্তু একটা পর্যায়ে সে নিজেই জানে ম র লো।বেফাঁস ফেসে গেলো ঈশার প্রেমে।

বাসের ভীড় ফাঁক ফোকরে ঈশানের চোখ পড়লো একটা জোড়া কপোতকপতির দিকে।ছেলে আর মেয়েটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তারাও ভার্সিটির স্টুডেন্ট।ছেলেটার কোলে মেয়েটার হাত সেই হাতটা আবদ্ধ ছেলেটার বাম হাতে।ঈশানের মনের কোনে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো।ঈশার কোলে থাকা হাতটার কাছে নিজের হাত এগিয়ে নিলো।করে বসলো এক ভয়ানক কান্ড
ঈশার চিকন চিকন আঙুলের ফাঁকে তার আঙুল গুলো মিলিয়ে দিলো।টেনে নিলো ঈশার হাত।ডান হাটুর উপর স্থির রইলো সে হাত জোড়া।ঈশা চমকে গেলো লহমায় হাত ছাড়াতে চেষ্টা চালালো।

” প্লিজ ঈশান এমন করবেন না।এখানে আমার পরিচিত মুখ থাকতে পারে।”

” তাতে কী ঈশা আমরা তাদের ক্ষতি করছি না।”

” আপনি অবুঝের মতো কেন কথা বলছেন হাত ছাড়ুন।”

” আমার ভালো লাগছে।সো হাত ছাড়া হবে না।”

ঈশা তবুও মোচড়ামুচড়ি করলো কিন্তু ঈশান হাত ছাড়লো না।এভাবে ঘনিষ্ঠ ভাবে কেউ কখনো তার হাত ধরেনি।হাত ধরেনি ভুল কথা ভালোবাসার সম্ভাষণ নিয়ে কেউতো ধরেনি।ঈশা কাঁপছে কপালে দেখে মিললো চিকন ঘামের।মেয়েটার কাঁপা-কাঁপি অনুভব করলো ঈশান।কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো ঈশানের মুখে।

” তোমার নাকি এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে যার সাথে হয়েছে সেকি কখনো তোমার হাত ধরেনি?”

ঈশা থমকে গেলো।এটা তো মিথ্যা ছিলো কে ধরবে তার হাত।

” আমায় মিথ্যা বলেছিলে তাই না ঈশা?”

“…… ”

” এই হাত ভালোবাসার আবেশে প্রথম আমি ছুঁয়েছি,আর আমাতেই শেষ হবে কথা দিলাম।”

এই সিরিয়াস প্রেম প্রেম মুহূর্তে ঈশার ভীষণ হাসি পেলো।ঈশান তাকে ভালোবাসে তবে সে কি বাসে?বাসেনা।সে যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে হাত ধরে তবে কি হবে ঈশানের এই ওয়াদার?ঈশান তো নিজের কাছেই হেরে যাবে।

” আপনি এত কনফিডেন্স নিয়ে কথাটা কি করে বললেন ঈশান?ধরুন আমি ভালোবাসলাম অন্য কাউকে তখন তার হাতে হাত রাখাতে দ্বিধবোধ কখনো জন্মাবেনা।”

” তুমি আমায় চেনো না মেয়ে।”

ঈশান ঠোঁট বাঁকিয়ে পাশে তাকাতে দাঁড়ানো অবস্থায় একটি ছেলে নজরে এলো।লহমায় পৈশাচিক হাসি হাসলো ঈশান।ঈশা খেয়াল করলো ঈশানের মুখভাব পালটে গেছে সে কেমন অন্য মনষ্ক হয়েছে উঠেছে।ঈশা আলগোছে হাত সরাতে নিলে ঈশান চেপে ধরলো ঈশার হাত চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে,

” মুখ কুলুপ এঁটে বসে থাকো এরপর যা হবে তাতে তোমার কোন মতামত গ্রহণ করবো না।”

আগামাথা ঈশা কিছুই বুঝলো না। একজন লোক নামবে তাই বাস থামাতে বলে কন্ট্রাক্টর।সেই লোকের পিছু পিছু নামলো ঈশান এবং ঈশা।ঈশা ভেবে পায় না এখনো তাদের গন্তব্য স্থান আসেনি তাহলে ঈশান কেন নামলো?

ঈশা কিছু বলতে চাইলেও ঈশান তাকে ইশারায় থামিয়ে দেয়।বড় বড় পা ফেলে ঈশান হাঁটছে সামনের দিকে ঈশা তার হাঁটার সাথে কিছুতেই পেরে উঠলো না তবুও পায়ে পা মিলিয়ে চলার চেষ্টা চালিয়ে গেলো।বড় রাস্তা ছাড়িয়ে ঈশান একটি গলিতে প্রবেশ করে এখানে শুধু ঈশান নয় তার সামনে একটি যুবক রয়েছে।এদিকটায় মানুষের শোরগোল বেশ কম ঈশার ভয় লাগলো ঈশান কি কু মতলব এঁটে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে?সে কি খারাপ কিছু করবে? ঈশার দুচরণ থেমে গেলো ঝাকিয়ে সরিয়ে দিলো ঈশানের হাত।চলার মাঝে থামলো ঈশান।

” কি সমস্যা?”

” আপনার মনে যদি আমায় নিয়ে খারাপ কিছু থাকে তবে এক্ষুনি তা মুছে ফেলুন।আমার সাথে বাজে কিছু হওয়ার আগে আপনাকে শেষ করতে দুবার ভাববো না।”

ছুটে চলার মাঝেও কিঞ্চিৎ হেসে ফেললো ছেলেটা।তার ঈশা তাকে এই চিনেছে?অবশ্য এটা নিয়ে ঈশানের খারাপ লাগলো না কে হয় সে তার?ঈশার দিক থেকে কেউ না।কি করে ঈশানকে সে নিরাপদ ভাববে?এত যুক্তি দিয়ে কথা বোঝানোর সময় ঈশানের নেই তার সামনে অনেক কাজ।সামনের যুবকটি ঈশার কন্ঠে পেছনে ফিরে তাকায়। ঈশান সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চারিপাশে,নাহ মানুষজন দেখা যাচ্ছে না।

ঈশান যুবকটিকে ইশারায় ডাকে।যুবকটি দ্বিমত পোষণ না করে এগিয়ে যায়।ঈশান তার মুখের মাক্স সরাতে যুবকটি পালাতে উন্মত্ত হয় তবে তার আগেই ঈশান তাকে ধরে ফেলে।চোখের পলকে পরিস্থিতি পালটে যায় ঈশান আগন্তুক যুবকটিকে বেদম প্রহার করছে।মানুষটার নাক ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ঠোঁটে।গালের কিছু অংশ ছিলে গেছে বাজে ভাবে। ঈশা ঈশানকে থামানোর চেষ্টা চালায় তাতে লাভ না হয়ে বরং বিপরীত কিছু হয়।যুবকটিকে মা রা র সময় একটা ঘুষি তার বাহুতে লাগে মুহূর্তে মনে হয়েছে হাত ছিড়ে এখনি পড়ে যাবে।ঈশা আবিষ্কার করলো ঈশান রক্তে মাংসে গড়া মানুষ হলেও মনে প্রাণে দেহের শক্তিতে সবটা লোহার মতো।

” ইসমাইল কোথায়?”

যুবকটি এবার কাতর চাহনি নিক্ষেপ করলো।ঈশার নামটা বড্ড পরিচিত মনে হয়েছে।কিয়ৎক্ষণ চিন্তা ভাবনা পর মনেও পড়লো ইসমাইল সে যে ঈশানের টাকার জন্য তার বাবাকে বিশ্রি ভাবে গা লা গা ল করেছে।এরপর ঈশান তাকে এনে মুজাহিদ হাসানের পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করে।

” কি রে মা র কম হয়েছে কথা বল।”

” ইসমাইল ভাইয়ের কথা আমি জানি না বিশ্বাস করুন জানি না।তার সাথে আমার শেষ কাজ হয়েছে আপনাকে মা রার সময় আর কোন কাজ করা হয়নি আমাদের।”

” জানিস না মানে?ইসমাইলের ঠিকানা আমায় দে।”

ঈশান আবার তাকে মা র তে থাকে লোকটা লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়।

” আমি এসব কাজ ছেড়ে দিসি।আমার বউ বাঁচার কসম আমি এসবে আর নাই।ইসমাইল ভাইয়ের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নাই।”

” ইসমাইলের খোঁজ পাবো কী করে?”

“বড় সাহেবের নাম্বার ঠিকানা আপনাকে দিচ্ছি যোগাযোগ করুন।ইসমাইল ভাই তার আন্ডারে কাজ করেন।”

যুবক ব্যক্তিটির সাথে কাজ সেরে ঈশান পুণরায় উলটা দিকে হাটা ধরে ঈশা কপট রাগ দেখিয়ে দূরে দূরে হাটতে থাকলো।ঈশান তার রাগের কারণ বুঝলো না ঈশার হাত টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে ব্যথায় অস্পষ্টে ‘আহ” শব্দ বেরিয়ে আসে।
ঈশান অবাক হয় হন্তদন্ত হয়ে ছুঁয়ে দেয় ঈশার গাল।

” কি হয়েছে ঈশা?কোথায় লাগলো?কি করে লাগলো?”

” হাত ভেঙে আবার বলছেন কি হয়েছে?”

” মানে?”

” ওই মানুষটাকে ধরতে গিয়ে আপনার ঘুষি লেগে আমার হাত ভেঙ্গে গেছে।”

” আমার কাযে বাঁধা দাও কেন তুমি?যা হয়েছে একদম বেশ হয়েছে।”

” আপনি মানুষ নন ঈশান একটা আঘাতে আমি নেতিয়ে যাচ্ছি আর বাকিদের যে আঘাত করেন তারা…”

” এই আঘাত গুলো তোমার জন্য নয় মিস ঈশা এগুলো অন্য কারো জন্য জমা।”
৪২.
ঈশা যথা সময় বাড়ি ফিরলো গোসল সেরে খাওয়াদাওয়া সম্পূর্ণ করে একটু বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে লুটিয়ে পড়লো বিছানায়।দেয়াল ঘড়িতে জানান দিলো চারটা বেজে এসেছে হাতের ব্যথাটা এখনো তাজা।আজ আর টিউশনি যেতে ইচ্ছে করছে না ভেবে ঘুমানোর জন্য উদ্যত হয় ঈশা।সুলতানা তখন হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করেন ঈশার কক্ষে।

” তুই আর অনু একসাথে বাড়ি ফিরিস নি?”

” হ্যা…না কি জন্য হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

” অনুর মা ফোন করলেন অনু নাকি এখনো বাসায় ফিরেনি সে ভাবীকে বললো তুই তার সাথে আছিস কিন্তু তুই তো বাসায় ফিরলি তিন ঘন্টা আগেই।”

ঈশা থমকে গেলো অনু রাসেলের সাথে আছে ভেবে ভয়টা বাড়লো বহুগুনে।মায়ের চোখে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয় তিনি সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছেন।

” কিরে অনু কই তুই জানিস না?”

” হয়তো দিহানের সাথে আছে আমি খোঁজ নিচ্ছি তুমি যাও এখন।”

ঈশা ফোন করলো অনুকে।অনু একটা বারের জন্যেও ঈশার ফোন তুলেনি, কেন তুলেনি?নিশ্চয়ই ভয়ে ঈশার ভালোবাসা যতটা গভীর রাগ তার থেকেও গভীর।ঈশা নির্দ্বিধায় ফোন করলো ঈশানকে।ঈশার ফোন পেয়ে দিনের আকাশে চাঁদ দেখা অবস্থা ঈশানের।

” বলো ঈশা হঠাৎ?”

” আপনি বলেছেন অনুকে রাসেল ভাই বাড়ি পৌঁছে দেবে তাহলে অনু কেন এখনো বাড়ি ফিরেনি?”

” আমিও রাসেলের কাছে জানতে চেয়েছি সে কেন আসেনি উত্তর হলো অনুর সাথে আছে। কতদিন পর তারা একা সময় কাটানোর সুযোগ পেলো।”

” একা সময় কাটানোর মানে কি ঈশান?”

” তুমি জানো না রাসেল আর অনু রিলেশন শীপে আছে?”

সিলিংটা যেন মুহূর্তে ঈশার মাথায় ভেঙ্গে পড়লো।এত বড় কথা অথচ সে জানে না।

” কবে থেকে?”

ঈশান ঈশার কাছে আসল তথ্য আড়াল করে বলে,

” আমি সঠিক বলতে পারছি না।”

ঈশা ফোন রাখলো।অনুর কাছে কখনো সে কিছু আড়াল করেনি অথচ অনু এতবড় কথা আড়াল করলো। বন্ধুত্বের এই দাম দিলো!
#চলবে___

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২১খ]
___________________
বইয়ের পাতা উলটে পালটে বিছানায় বই ছুড়ে ফেললো ঈশা।টেবিলে থাকা চায়ের কাপটা তুলে চুমুক বসালো তৃপ্তি নিয়ে।সন্ধ্যার পর থেকে অনু প্রায় সাতবার কল এবং বেশ কয়েকটা মেসেজ করেছে মেয়েটার কল ধরার প্রয়োজন বোধ করেনি সে।করবেই বা কেন?যাকে নিজের বোনের চোখে দেখেছে সে অনু তাদের সম্পর্কে বিশাল ফাঁক রেখেছে।এই কথা মানতে নারাজ ঈশা শোকে দুঃখে কখনো ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না আসে আবার কখনো তীব্র রাগে সয়ে যায় সবটা।মৃদ্যু বাতাসে জানলার পর্দা উড়ছে ঈশা গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়ালো।রাগের মাথায় ঈশান জানলা ভেঙেছিল এরপর পুরো জানলাটায় নতুন করে গ্লাস লাগানো হয়েছে।জানলার কাছে আসতে ঈশানের কথা মাথায় আসে তার।ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে কিঞ্চিৎ হাসি রেখা।অনু তখন কক্ষের দরজা ঠেলে ভেতরে এসে চেচিয়ে বলে,

” তোর কি হয়েছে?আমার ফোন ধরলি না কেন?”

আকস্মিক ডাকে ঈশা চকিতে তাকালো অনু অভিমানি মুখ নিয়ে বসলো ঈশার বিছানায়।

” কি রে ফোন ধরলি না মেসেজের উত্তর দিলি না এর কারন কী?”

” প্রয়োজন বোধ করিনি।”

” মানে কি বলিস তুই?”

” বাংলায় বলেছি।”

গম্ভীরতা এঁটে জবাব দিলো ঈশা।
অনু সন্দিহান চোখে এগিয়ে এলো ঈশার কাছে জড়িয়ে ধরলো তাকে পেছন থেকে।

” আমার ঈশু কি রাগ করেছে?”

” ছাড় আমায় এসব নাটক বন্ধ কর এবার।”

” তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?”

” কিভাবে বলবো?আমি তোকে আমার জীবনের বিশেষ স্থানে রেখেছি তুই আমার বন্ধু,বোন আর সেই তুই এভাবে আমাকে পর করে দিলি।”

” আমি কি করেছি কি বলছিস।এই ঈশা তোর কি হয়েছে।”

” রাসেল আর তোর সম্পর্ক ভালোবাসার তাই না?”

অনু ছেড়ে দিলো ঈশার হাত।চোরা চোখে চাইলো তার দিকে বেশ কয়েকবার।

” ঈশা আমি তোকে বলতে চেয়েছি…”

” অথচ তুই আমার পেটের পিঠের সব কথাই জানতি।আর তুই এত বড় কথা আমাকে বলিসনি।আমাকে শুনতে হয়েছে বাইরের মানুষের কাছ থেকে।এটা তো প্রমান হয়েই গেলো আমি আপন ভাবলেও আমায় আপন কেউ ভাবে না।”

অপরাধবোধে মাথা নোয়ালো অনু।তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে।

” ঈশান আর তোর ঝামেলা তাই আমি রাসেলের কথা বলিনি।”

” আমার নাম করে রাসেলের সাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলি আবার আমি এতবার ফোন করা স্বত্তেও ফোন তুলিসনি।রাসেল এখন তোর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি নই সেই ছোট বেলার বন্ধুত্বে এভাবে ফাটল ধরালি।”

” ঈশা প্লিজ তুই রেগে…”

” তোর সাথে আমার এখন কথা বলতে রুচিতে লাগছে।এখান থেকে যা আর তোর রাসেল প্রেমিককে বলে দিস ঈশা তোর জীবন থেকে সরে গেছে এবার জমিয়ে প্রেম করা যাবে।”

অনু শব্দ করে কেঁদে ফেললো জড়িয়ে ধরলো ঈশাকে।

” আমার ভুল হয়ে গেছে ঈশা।প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিস না।এবার থেকে আর এমন ভুল হবে না।”

” আমি মাথায় তুলতেও পারি আবার আছাড় মে রে ফেলতেও পারি।তুই আমার বিশ্বাসে দাগ লাগালি এ আঘাত আমি কোন দিন ভুলবো না।এখান থেকে যা তুই।”

অনু ঈশাকে মানানোর চেষ্টা চালালো তবে ঈশা তার জেদেই অটল রইলো।চোখের পলকে বিশ্বস্ত এক জোড়া বন্ধুত্বের ফাটল ধরলো।

৪৩.
প্রতিদিনের ন্যায় যথা সময়ে ভার্সিটি গেলো ঈশা তবে পাশে ছিল না অনু।ক্লাসেও একাই বসেছে সে।অনু বসতে চেয়েছিলো তবে তাকে দেখে উঠে চলে যায় ঈশা।মাত্র একটা ক্লাস করেই বেরিয়ে যায় ঈশা সবকিছুতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
দিহান দুজনের দুরত্ব দেখে বেশ অবাক হয় ঈশার পিছু পিছু সে নিজেও মাঠের দিকে চলে যায়।

” কি রে ঈশা তোদের কি হয়েছে?এমন সিন তো আর জীবনে দেখিনি।”

” কিছু হয়নি কি হবে?”

” অনুর সাথে রেগে আছিস কেন?”

” সত্যি করে বল দিহান অনু যে রাসেলের সাথে রিলেশনে আছে এটা কি তুই জানতি?”

” কি!”

চমকে গেলো দিহান।অনুর রিলেশনশীপে অথচ সে জানে না।

” আমি এসব কিছু জানি না।”

” আমিও জানতাম না।আমাদের ঠকিয়েছে সে।বন্ধুত্বের বিশ্বাস ভেঙেছে।”

” এর পেছনেও নিশ্চিয়ই কারণ আছে তুই….”

” ঈশানের সাথে আমার ঝগড়া ব্যস এইটুকুই।ঈশানের সাথে আমার আলাপ সাক্ষাৎ সবটাই তোরা জানিস। আর সে এতটা দিন কি করে লুকিয়ে রাখলো রাসেলের সাথে সম্পর্কের কথা।অনুকে এত আপন ভেবেছি আর অনু…”

গলা ধরে এলো ঈশার।অনুর সাথে এর আগে কখনো এত সিরিয়াস ভাবে ঝগড়া হয়নি।কান্না আড়াল করার বাহানায় ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যায় ঈশা এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।

৪৩.

” ঈশামনি কেমন আছো তুমি?আমাকে তুমি ভুলে গেছো।আমার কথা কি একটুও মনে পড়ে না।জানো আমি তোমায় ভীষণ মিস করি তুমি আসবে না আমাদের বাড়ি?”

এক নাগাড়ে কথা বলে থামলো রুদবা।ঈশা নিশ্চুপ শুনছিলো বাচ্চাটার আগ্রহের সাথে বলা পুরোটা বাক্য।কত মিষ্টি এই কণ্ঠ যে কণ্ঠ শুনে নিমিষে মনটা ভালো হয়ে গেলো ঈশার।আকস্মিক ঈশার ঠোঁটে হাসি দেখে সন্দিহান চোখে তাকালো ঈশার স্টুডেন্ট।ঈশা এখন টিউশনিতে আছে তাই মন খুলে কথা বলতে পারছেনা কেননা পড়ানোর সময় টিচারের হাতে ফোন দেখলে গার্জিয়ানদের বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগে।ঈশা গলার স্বর‍টা চেপে বলে,

” রুদবা মনি আমি তোমার সাথে পরে কথা বলি এখন তোমার মতো একটা মিষ্টি মেয়েকে পড়াচ্ছি।”

” না না ফোন কাটবে না তুমি।আম্মুর সাথে কথা বলো জরুরি কথা।”

রুদবা ফোন নিয়ে দিলো রুমাকে।দুজনের কুশল বিনিময় শেষে মূল কথায় ফিরলো রুমা।

” আজকে আমি আর রুদবা ঘুর‍তে বের হবো একটু টুকটাক শপিং করবো।আমাদের সাথে যাবে?তোমার সাথে দেখা হয়নি অনেকদিন হতে চললো।”

” পরে দেখা করলে হয় না আপু?তোমরা যেহেতু শপিং করবে নিশ্চয়ই বিজি থাকবে।”

” না থাকবো না তোমাকে আসতে হবে এটা তোমার বোনের আদেশ বুঝলে?”

ঈশা বাধ্য হয়ে সম্মতি জানালো রুমার কথা সে ফেলতে পারে না।টিউশনি শেষে যাওয়াই যায় মন্দ নয়।
বের হওয়ার উদ্দেশ্যে স্টুডেন্টকে আজ তাড়াতাড়ি ছুটি দিলো ঈশা।দুপুরের কড়া রোদটা পড়ে গেছে বিকেলের শান্ত পরিবেশটা বেশ উপভোগ করার মতো।সরু রাস্তা মাড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে হাটছে ঈশা।হঠাৎ মনে পড়ে গেলো ঈশানে কথা সেদিন কুকুরের দৌড়ের কথা ভাবতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।আনমতে হেসে আশেপাশে সর্তক দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিজেকে নিজে পা গ ল উপাধি দিতে ভুললো না।অনেকটা রাস্তা হাটার পর তার সামনে এসে থামলো সাদা চকচকে একটি গাড়ি।এই গাড়ি সে চিনে না তাই সরে দাঁড়াতে জানলার কাঁচ নামিয়ে রুমা বলে,

” ঈশা পেছনে উঠে পড়ো।”

ড্রাইভিং সিট থেকে রুমার হাজবেন্ড রেদোয়ান হাত ইশারায় ঈশাকে হাই জানালো ঈশাও হাত নাড়লো।দরজা খুলে পেছনের সিটে বসে পাশে তাকাতে আকস্মিক চিৎকার করে উঠে ঈশা।ঈশার চিৎকারে গাড়িতে থাকা সকলে চমকে যায়।হুড়মুড়িয়ে সবাই তাকালো ঈশার দিকে।ঈশার পাশে বসে ছিল ঈশান ছেলেটার কানে হেডফোন হাতে মোবাইল দেখা যাচ্ছে গেমস খেলছে সে।ঈশার চিৎকারে ঈশান কান থেকে হেডফোন খুলে রুক্ষ স্বরে বলে,

” আসতে আসতে ষাড়ের মতো চেচাও কেন?গান শুনছিলাম তোমার চিৎকারে গানটাও অফ হয়ে গেছে।”

” আপনি এখানে কী করছেন?”

” তুমি এখানে কি করছো?”

দুজনের তর্কের মাঝে রুমা মুচকি হাসে।রেদোয়ান তাদের পাত্তা না দিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করে। রুমা ঈশা ঈশানের সম্পর্কটা নিয়ে টুকটাক জানে আর তাই তো ঈশার আর ঈশানকে এক করার জন্য তাদের সাথে নিয়ে যায়।ঈশানের মা মাহমুদার ইচ্ছে ঈশাকে ঘরের বউ করার।কথা ছিলো রাসেলের সাথে ঈশার বিয়ের কিন্তু রাসেল যখন চাইছে না তখন ঈশানের সাথে ঈশার বিয়ে হলে মন্দ কী?সেই তো বাড়ির বউ।যদিও রুমা মাহমুদাকে এখনো কিছু প্রকাশ করেনি তবে খুব শীঘ্রই জানিয়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সারাটা রাস্তায় ঈশান একটুও কথা বলেনি ঈশার সাথে।ছেলেটা গেমস খেলায় মগ্ন ছিলো তার হাবভাব এমন যেন ঈশা নামের মেয়েটার প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই অথচ কে বলবে এই ছেলে কাল দুপুরেও ঈশার হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরেছে।
গাড়ি থেমেছে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে।গাড়ির বাইরে থেকে রেস্টুরেন্টের দিকে এক পলক তাকালো ঈশা।বাইরে থেকে বেশ লতা গাছ সহ ফুল গাছ দিয়ে ডেকোরেশন করা।বাইরে অনেকে ছবি তুলছে কেউ কেউ রেস্টুরেন্টের বিল্ডিংটায় প্রবেশ করছে কেউ বের হচ্ছে।রুমা রুদবাকে নিয়ে বেরিয়ে যায় এবং ঈশাকে নামতে বলে।রেদোয়ান নেমে রুদবাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরের দিকে যায়।ঈশা নামতে নিলে খপ করে ঈশান তার হাত ধরে নেয়।ঈশানের কান্ডে গরম চোখ করে তাকালো ঈশা ঈশানকে এখানে পাওয়াটাই ছিল তার জন্য অপ্রত্যাশিত।যদি জানতো ঈশান আসবে তবে কোনদিন আসতো না।

” শরীর গরম কেন?”

ঈশান বিচলিত কণ্ঠে কথাটা বললো।ঈশা ছাড়িয়ে নিলো তার হাত।তবে ঈশান নাছোড়বান্দা সে ছাড়লো না বরং ছুঁইয়ে দিলো মেয়েটার গাল কপাল।

” জ্বর আসছে তোমার।”

” আদিখ্যেতা করবেন না আমি ঠিক আছি।”

” তুমি ঠিক নেই।অনুর সাথে কথা না বলে তুমিও ভালো নেই।এত জটিলতার কি দরকার অনু কি বলতে চায় তাকে বলার সু্যোগ দাও।মানুষ মাত্র ভুল সে ভুল করেছে।সবটা ভুলে যাও ঈশা।”

” আপনি একদম আমাদের মাঝে আসবেন না।আমাদের মাঝে কথা বলার অধিকার আপনাকে দেইনি।”

” অধিকারের প্রশ্ন তুলছো?তোমার পরিবারের বাইরে যদি তোমার উপর কারো অধিকার থাকে তবে সেটা একমাত্র আমার।”

” হাসালেন অন্য কাউকে আমার জীবনে আসার সুযোগ দেবো,আমায় নিয়ে ভাবার অধিকার দেবো তবে কোনদিন আপনাকে সেই অধিকার দেবো না।”

” তোমার জীবনে কেউ অধিকার নিয়ে আসার সু্যোগ পাবে?কি ভাবো আমায়?মাঠে যখন নেমেছি গোল দিয়ে মাঠ ছাড়বো এর আগে নয়।”
#চলবে___

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২২ক]
_____________________
এত করে বোঝানোর পরেও অনুর প্রতি ঈশার তিক্ততা ছাড়াতে পারলো না ঈশান।কত ভাবে কত কি বলে যে বুঝিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।যত যাই হোক এই মেয়ে নিজের জেদে অনড়।ঈশান মনে মনে হাসলো এই জীবনে কাউকে এভাবে বুঝিয়েছে বলে তার মনে হয় না।একবার কি দুইবার এর পরেও যদি কেউ কোন ব্যপারে না মানে তবে ঈশানের তান্ডব শুরু হয়।আশেপাশে যা আছে ভাঙ্গতে থাকে।অথচ ঈশার ক্ষেত্রে সে নিশ্চুপ,তার মাঝে রেগে যাওয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।রুদবা,রেদোয়ান ফটো বুথে ছবি তুলছে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে রুমা।ঈশা ঈশান একই টেবিলে বসে আছে দুজন দুজনার মুখোমুখি।ঈশা নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে ফোনের স্কিনে।অনু একের পর এক মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে আর ঈশা সবটা সিন করে ফেলে রাখছে।মেসেজ সিন করে রেখে দেওয়া অপর পক্ষকে শায়েস্তা করার মাঝে এই ব্যপারটা আলাদা মজার একটা পৈশাচিক আনন্দ দেয়।অনুর অনুনয় বিনয় কোনটাই ঈশার মান ভাঙালো না।ঈশার দৃষ্টি যখন ফোনের স্কিনে ঈশানের দৃষ্টি তখন ঈশার দিকে।সে মনে মনে ভাবছে এই মেয়ে এত ত্যাড়া এত জেদি কি করে বনিবনা হবে তার সাথে।ঈশান যখন রেগে যায় জেদ ধরে তখন সে চায় অপর পাশের ব্যক্তিটি তার কাছে ভেজা বিড়াল হয়ে থাকুক অপরদিকে ঈশা তার উলটো।ফোনটা পাশে রেখে চোখ তুললো ঈশা দোতলার কাচ গলিয়ে বাইরের সবটা দেখা যাচ্ছে।রেস্টুরেন্টের বাইরে চারজন বডিগার্ড দেখে ভ্রু কুচকে এলো তার।এরা তো তখন ছিলো না তবে?

” যেখানে যান সেখানে এই গার্ড গুলো নিয়ে যান।ওয়াশরুমে যাওয়ার আগেও কি নিয়ে যান?”

ঈশার ব্যাঙ্গাত্মক কথায় কান দিলো না ঈশান।মাথা ঘুরিয়ে একবার তাকালো গার্ডেদের দিকে।

” আশেপাশে সামনে পিছনে শক্রুরা দল বেঁধে আছে এসবের কারনে সেফটি দরকার।তোমার গোবর মাথায় এসব ঢুকবে না।”

” আপনি কি মন্ত্রী মিনিস্টার এত শক্রু এত নিরাপত্তা কিসের?যাই হোক আমার নাক না গলালেও চলবে।”

” নাক গলিয়ে এখন বলছো না গলালেও চলবে হাসালে।যাই হোক অনুকে কষ্ট দিও না।”

” খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?অনুর কষ্ট কমাতে আপনার ভাই আছে তাকে বলুন।”

” তুমি এত জেদি কেন বলবে?”

” আমি মোটেও জেদ করছি না বরং আমি উচিত কাজটাই করছি।রাসেল আপনার ভাই বন্ধু সে আপনার সব কথা যানে অথচ সে যদি আড়ালে বিয়ে করে নেয় তবে আপনার কাছে কেমন লাগবে?সহ্য করতে পারবেন আপনি?”

” বিয়ে আর প্রেম এক বিষয় নয়।”

” অনু যদি বাইরের কোন ছেলের সাথে প্রেম করতো আমি কখনো এতটা রিয়েক্ট করতাম না।রাসেল ভাই আর আপনার সাথে আমাদের বেশিরভাগ সময় দেখা সাক্ষাৎ হয় সবচেয়ে বড় কথা আপনার সাথে আমার যখন যা হয়েছে শুরু থেকে শেষ সবটা আমি অনুকে বলি আমার তো কোন দ্বিধা থাকে না তবে সে কী করে পারলো আমার সাথে এমনটা করতে।হয়তো আমি তাকে যতটা মূল্যায়ন করেছি সে আমাকে ততটাও করেনি।”

ঈশা থামলো এসব কথা ভাবতেই তার কান্না আসে ঈশান পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। মেয়েটা ঢকঢক শব্দে পুরো পানিটা শেষ করলো।রুদবা ততক্ষনে এগিয়ে এলো ঈশার কাছে টেনে নিয়ে গেলো তাকে ফটো বুথের সামনে।

” ঈশা মনি তোমার সাথে ছবি তুলা হয়নি।”

” আমি ছবি তুলবো না তুমি তুলো রুদবা।”

” এ কথা শুনছি না দাঁড়াও চুপটি করে দাঁড়াও।”

ঈশা দাঁড়ালো তাদের ছবি তোলার মাঝে তিয়াশ এসে উপস্থিত।তিয়াশকে ইনভাইট করেছে রুমা।তিয়াশকে দেখে সবাই খুশি হলেও ঈশানের মুখে কালো মেঘের দেখা মিললো।ফটো বুথ ছেড়ে সবাই টেবিলে বসলো তিয়াশ ঝটপট ঈশার পাশে বসে একগাল হাসে।
রেদোয়ান সবার জন্য খাবার অর্ডার দিয়ে পুণরায় আড্ডায় মত্ত হয়।তিয়াশ ঈশাকে বলে,

” ঈশা তোমার সাথে দেখা হয়েছে অনেকদিন পর।কেমন আছো তুমি?”

” বেশ ভালো আপনাকে তো অনলাইনে পাওয়া মুশকিল।”

” কাজের চাপটা বাড়ছে বুঝতেই পারছো।”

ঈশা মাথা নাড়ায়।ঈশান স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে ভেবেছিলো দুজন একসাথে কিছুটা সময় কাটাবে কিন্তু এই তিয়াশ এসে সবটা ঘেটে ঘ করে দিলো।ঈশান রুমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো রুমাও চোখ ঈশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে কিন্তু ঈশান প্রত্যুত্তর করলো না।বরং ফোন বের করে পুণরায় গেমস খেলতে থাকে।আধা ঘন্টার মাঝে সব খাবার চলে এসেছে সবাই খাওয়ার পাশাপাশি টুকটাক কথা বলছে।শুধু মাত্র মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে ঈশা।হঠাৎ শরীরটা কেমন খারাপ লাগছে।হাতে পায়ে ব্যথা অনুভব হচ্ছে, মাথাটা ভারী লাগছে গলা দিয়ে যতটুকু খাবার গিলছে তা বেরিয়ে আসতে চাইছে বারংবার।তবুও সবার সামনে ভদ্রতার খাতিরে একটু একটু খাবার মুখে তুলছে ঈশা।রেদোয়ান খুশি মনে এটা ওটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।ঈশার এই নিশ্চুপ হওয়ার কারণ জানতে চোখ ইশারায় কথা বলে দুজনে।ঈশা হাত ইশারায় কপালে হাত রাখে ঈশান সহজে বুঝে নেয় ঈশার জ্বর এসেছে।
প্লেটের খাবার খানিকটা শেষ করে গা ছেড়ে বসলো ঈশান।তখন মাগরিবের আযান পড়েছে সবাই সবার কথা বলা থামিয়ে দিয়েছে।

” আমাকে উঠতে হবে রেদোয়ান ভাইয়া।”

” সে কি কথা খাবার শেষ করেছো? করনি এক্ষুনি শেষ করো।এত খাবারের অর্ডার কি একা আমার জন্য দিয়েছি তোমার জন্যে দিয়েছি।”

” আমি যদি পারতাম খাবারটা শেষ করে যেতাম অনেক সুস্বাদু ছিল খাবারটা আমি বরং আরেকদিন আসবো।”

ঈশান দাঁড়িয়ে যায় ঈশাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,

“তোমাদের বাসার রাস্তা দিয়ে যাবো এখন কি আমার সাথে যাবে?”

ঈশা এই সময়টা অপেক্ষা করছিলো জুসের গ্লাস থেকে এক চুমুক জুস মুখে তুলে দ্রুত পায়ে দাঁড়িয়ে যায়।

” হ্যা হ্যা যাবো সন্ধ্যা হয়ে গেছে আব্বু জানলে বকবে আমাকে এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে।”

রুমা ভীষণ রেগে গেলো।ঈশার হাত ধরে অভিমান সুরে বলে,

” আমরা নামিয়ে দিবো তোমায় প্লিজ ঈশা যেও না।”

” আপু আজ যাই এই ছোট্ট পেটে আর কতটুকু খাবার যাবে বলো।আমি পেট ভরে খেয়েছি।”

তিয়াশ ঈশানের দিকে একপলক তাকালো ঈশার যাওয়ার এত তাড়া কিসের তার বুঝে এলো না।রুমার সাথে আছে জানলে নিশ্চয়ই ঈশার বাবা বকবেন না।

” ঈশা আমি তোমার পৌঁছে দেবো আর আধা ঘন্টা থাকো।”

তিয়াশের এই বাড়াবাড়িটা মোটেও পছন্দ না ঈশানের।ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।মেয়ে মানুষ দেখলেই আদর আদর কথা বের হয় অসহ্যকর লোক।

” মিস ঈশা আপনি না গেলে আমি গেলাম।”

ঈশান পা বাড়ালো ঈশা রুমাকে বুঝিয়ে ছুটলো ঈশানের পেছন পেছন।সবার আড়াল হয়ে ঈশান ধরলো ঈশার হাত।

” এত ছুটছো কেন?জ্বরটা বেড়েছে না।”

” দয়া করে জলদি হাটুন আমার ভীষণ খারাপ লাগছে গাঁ’টা কেমন করছে।”

” জ্বর হলে আসার কি দরকার ছিলো?”

” ভেবেছিলাম ওষুধ খেয়ে বের হবো কিন্তু ভুলে গেছিলাম।”

ঈশান প্রত্যুত্তর করলো না ঈশার হাত ধরে চলে গেলো পার্কিং জোনে গাড়ি নিয়ে চললো দ্রুত।তার মাঝে কল করে রাসেলকে গাড়ি থামিয়ে কল রেখে দুইজনের মাঝে কয়েক মিনিট মেসেজে কথা হয়।
ঈশা সিটে গা এলিয়ে বাইরে চোখ রাখলো তীব্র গরমে সবার যখন ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা তার এই মুহূর্তে ভীষণ শীত লাগছে।জ্বর এলে এই এক সমস্যা শীতকাল গরমকাল সব কাল মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

” তিয়াশের সাথে এত কথা কিসের হ্যা?আমি এসব বরদাস্ত করবো না।”

” কেন করবেন না তিয়াশ ভাই কি আপনাকে কামড়েছে?”

” কামড়ালেও এতটা অসহ্য লাগতো না তোমার সাথে কথা বলতে দেখলে যতটা লাগে।”

ঈশা চুপ হয়ে যায় ঈশান যে ঈর্ষান্বিত হচ্ছে ঈশা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে।ধীরে ধীরে অন্ধকার নামছে আলোময় শহরটায়।ঈশার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে জ্বরের প্রকপ ধীরে ধীরে বাড়ছে।ঈশান গাড়ি থামায় বহুতল ভবনের সামনে।ঈশা চটপট মাথা তুলে তাকায় এটা তো হসপিটাল!

” আমরা এখানে এসেছি কেন?”

” সিনেমা দেখতে।”

” দেখুন আপনি আপনার সিনেমা আমায় বাসায় দিয়ে আসুন প্লিজ ঈশান।”

ঈশান প্রত্যুত্তর করলো না পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায়।আশেপাশে মানুষের অভাব নেই হসপিটাল মানেই ব্যস্তময় স্থান।ঈশাকে দ্রুত নামতে ইশারা করলো ঈশান।তবে ঈশার মনে জেদ চেপেছে সে কিছুতেই নামবে না গাড়ি থেকে।

” কি হলো নামছো না কেন?”

” আমায় বাসায় দিয়ে আসুন এরপর আপনার যা ইচ্ছে করুন আমি বাঁধা দেবো না।”

ঈশান দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে ঈশাকে নামায়।হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় হসপিটালের ভেতর।লিফটে উঠে উপরে যাওয়ার জন্য বাটন প্রেস করে।আশেপাশে অনন্য মানুষজন আছে বিধায় এখানে কথা বাড়ালো না ঈশা।চতুর্থ তলায় উঠতে রাসেলের সাথে দেখা হয় দুজনের।

” আমরা এখানে এসেছি কেন ঈশান, কার কি হয়েছে?”

” তোমার।”

” আমার মানে?”

” এখন ডাক্তারের কাছে যাবো সিনক্রিয়েট একদম করবে না।”

” এসব আদিখ্যেতা একদম ভালো লাগছে না ঈশান।”

” আমার ভালো লাগছে এরপর আরো বেশি বেশি আদিখ্যেতা করবো।”

ঈশা চুপ হয়ে যায় রাসেল হাসছে দুজনের কান্ডে।ঈশাকে পেয়ে মনে চলতে থাকা হাজার খানেক কথা উগড়ে ফেলে সে।

“অনুর সাথে কথা না বলে রাগ ঝারছো তুমি।আর অনু রাগ ঝারছে আমার উপর।”

” আমি কারো উপর রাগ ঝারছি না।”

” মানুষ মাত্র ভুল আমি অনুকে বারণ করেছি আমাদের সম্পর্কের কথা না জানাতে তাই সে জানায়নি।”

” ওহ আচ্ছা এত বছরের বন্ধুত্বের ভরসা আপনার এক আদেশেই পালটে গেলো।আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম।”

” তোমার আর ঈশানের সম্পর্ক ভালো ছিল না তাই আমি….”

” সরি রাসেল ভাই আমার এখন এসব কথা শুনতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না।”

ঈশার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট ইচ্ছে তাই সরে গিয়ে বসলো।ঈশান চোখ ইশারায় রাসেলকে চুপ থাকতে বললো।রাসেলের পাংশুটে মুখ দেখে ঈশান বলে,

” তুই এত ভেঙ্গে যাচ্ছিস কেন?কয়েকদিন ঈশাকে সময় দে কিছুটা সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ঈশাকে নিয়ে ডাক্তার চেম্বারে গেলো ঈশান।বেশ কিছুটা সময় পর ঈশাকে নিয়ে ফিরলো সে।সব ওষুধপত্র কিনে সঙ্গে কিছু ফল কিনে নিলো।তাদের কাজ শেষ হতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেলো।এদিকে ঈশার মা একের পর এক ফোন করে যাচ্ছেন মুজাহিদ হাসান আজ মেয়ের উপর ভীষণ ক্ষেপেছেন সেই সন্ধ্যায় বলেছে বাসায় ফিরছে অথচ এখন আটটা বাজতে চললো।

৪৪.
বাসায় ফিরতে ফির‍তে ঈশার শরীরে জ্বর তীব্র ভাবে বেড়েছে।দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হাতে ওষুধ ও ফলের প্যাকেটটা নিয়ে গেটের ভেতর চলে যায় সে।ঈশান গাড়ির চাবিটা নিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে ঈশার কাছে, ঈশা ঈশানের দিকে তাকালে সেদিকে মন না দিয়ে দ্রুত ঈশার হাত থেকে প্যাকেট গুলো নিয়ে নেয় ঈশান।

” এখানে কি করছেন আপনি?”

” চলো বাসায় দিয়ে আসি তোমায়।”

” প্রয়োজন নেই আপনি এখান থেকে চলে যান বাবা মা দেখলে আমায় হাজারটা প্রশ্ন করবে।”

” আমি আছি তো সব ক্লিয়ার করে দেবো চলো চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

বেল বাজাতে দরজা খুলেন সুলতানা।ঈশাকে দেখতে পেয়ে গলা তুলে চিৎকার করে বকতে থাকেন তিনি কিন্তু যখনি ঈশানকে দেখতে পান তখনি চুপসে যান।

” আসসালামু আলাইকুম আন্টি ভালো আছেন?”

সুলতানা ঠোঁট ইশারায় সালাম নিলেন।ঈশা ছোট ছোট পা ফেলে সোফায় গিয়ে বসে মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে।মুজাহিদ হাসান ততক্ষণে উপস্থিত দরজার সামনে ঈশানকে দেখে চমকে গেলেও হাসি মুখে গ্রহণ করে তাকে।

” হঠাৎ এলে?ভেতরে আসো।”

” আসতে তো চাইনি আপনার মেয়ে বাধ্য করেছে আসতে।”

ঈশা চমকে তাকালো।ঈশান কি বলছে এসব সুলতানা তার দিকে কেমন দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে।

” আমার মেয়ে?”

” রুমা আপু ওঁকে সাথে করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় বের হওয়ার সময় বাঁধে বিপত্তি আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে যায় তারপর আর কি ছুটোছুটি করে হসপিটাল নিয়ে যাই আমরা।রুমা আপু আসতে চেয়েছিলো কিন্তু রুদবা ছোটো তো ঈশার অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেছে ভীষণ কান্নাকাটি করছে তাই আমি নিয়ে এলাম ওঁকে।”

সুলতানা বিচলিত হলেন দ্রুত গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে।

” মা কি হয়েছে তোর ঘুরে পড়লি কেন?”

ঈশা জবাব দিলো না সবটা যখন ঈশান মিথ্যা বানোয়াট বক্তব্য দিয়েছে তখন বাকিটাও সে দিক।

” ওঁর শরীরে জ্বর ডাক্তার বলেছে ঠিকঠাক ভাবে খাওয়া দাওয়া করতে খুব শীঘ্রই সেরে যাবে।”

ঈশানের কথা শেষ হতে ঈশা কপট রাগ দেখিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে বলে,

” ডাক্তার আরেকটা কথা বলেছে মিথ্যুকদের সাথে কম মেলামেশা করতে।”

এই কথার মাধ্যমে ঈশা যে ঈশানকে টিপ্পনী কেটেছে তা বেশ ভালো ভাবে বুঝতে পারলো ঈশান।ঈশা উঠে চলে গেলো নিজের রুমে।মনে মনে হাসলো ঈশান।

” আমি মিথ্যুক হলে তুমি মিথ্যুকের বউ মিথ্যুকনী হুহ।”
#চলবে___

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২২খ]
_____________________
৪৫.
” কেমন লাগে বলতো ফোন ধরে না
কেন?”

” জ্বর তো হয়তো ফোন কোথায় রেখেছে হুশ নেই।”

” হুশ নেই মানে কি কেউ কি ফোন করে না তাকে?একটা মানুষ এত কেয়ারলেস ভাবতেই রাগ লাগছে আমার।”

ঈশান শেষ বার কল করলো ঈশাকে তবে এবারো কোন সাড়া পাওয়া গেলো না।রাগের দরুনে কান থেকে ফোনটা নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেললো ঈশান।রাসেল বিছানায় বসে অফিসের ফাইলগুলো চেক করছিলো ঈশানের কান্ড দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুণরায় কাজে মনোযোগ দেয়।ঈশান বেরিয়ে গেলো রাসেলের কক্ষ ছেড়ে কয়েক মিনিট পর আবার হাজির হয় সে তার ঠোঁটে চেপে থাকা সিগারেটের দিকে তাকিয়ে রাসেল বলে,

” ঈশান স্মোক করতে বারণ করেছিলাম তোকে।”

” টেনশন হচ্ছে।”

” তাই বলে স্মোক করবি ঠোঁট থেকে ফেল ওটা।”

” এমন ভাব করছিস তুই যেন স্মোক করিস না সাধুগিরি করবি না একদম।”

” মোটেও সাধুগিরি করছিনা আমি মাঝে সাঝে একবার করি আর তুই একবার যখন সিগারেট হাতে তুলেছিস পুরো প্যাকেট শেষ হওয়া ছাড়া উঠস না আমি জানি।অনুকে ফোন করে খোঁজ নে যা করার সে করতে পারবে।”

” তুই কর না।তুই বুঝিয়ে বল অনুকে।”

” অনু আমাকে ব্লক করে রেখেছে তাই ফোনটা তোকেই করতে হবে।”

ঠোঁট থেকে সিগারেট সরালো ঈশান।দ্রুত ফোন নিয়ে ডায়াল করলো অনুর নাম্বারে দুই তিনবার রিং হয়েছে কিন্তু অনু ফোন তুলেনি।অনু অবশ্য ইচ্ছে করেই ঈশানের ফোন ধরেনি ঈশানের প্রতি তার মনে চেপে রয়েছে গাঢ় রাগ।একে একে তেরোটা কল করলো ঈশান না পেরে ফোন তুললো অনু।

” কল ধরতে এত সময় লাগে কেন? ”

“ব্যস্ত থাকতে কি পারিনা? এত চিৎকার করে কথা কেন বলছেন?”

ঈশান রেগে কথা বললে পালটা রেগে যায় অনু।ঈশানের অবাক লাগে অনুর দুঃসাহস দেখে তবুও নিজেকে স্থির করলো অনুর রাগ হওয়ার কারণটা তার অজানা নয়।

” কারণ আছে বলেই ফোন করেছি।ঈশার খোঁজ নিয়ে দাও।তুমি কি জানো ঈশা অসুস্থ?”

“কই না তো।ওর কি বেশি অসুখ।”

” বেশি নাকি কম তা তো জানি না।তবে সে ফোন ধরছে না জ্বর বোধহয় বেড়েছে।”

মুহূর্তে অনুর অস্থিরতা বেড়ে গেলো যতই হোক ঈশা সেই ছোট্ট বেলার বন্ধু।এই তো গতবছর অনুর টাইফয়েড ধরা পড়লো সেই সময়টা তার উপর দিয়ে যে কি গেছে তা কাউকে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।সেই মুহূর্তে মা বাবার পাশাপাশি ঈশা থেকেছে বড় বোনের তুল্য যত্ন করেছে।এটা ওটা পছন্দের খাবার বানিয়ে খাইয়েছে এসব কথা ভুলে না অনু তবুও কেন যেন একটা ভুল সংঘটিত হয়েছে তার দ্বারা।এখন নিজের ভুলে সে নিজেই অনুতপ্ত।

” ঈশার জ্বর?আমি জানতাম না এক্ষুনি ওর বাসায় যাচ্ছি।”

” ঠিক আছে আপডেট দিও আমায়।”

রাত তখন সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি অনু তার মাকে বলে চলে গেলো ঈশাদের ফ্লাটে।কাছাকাছি হওয়ায় রাতে একাই গেলো সে।অনুকে দেখতে পেয়ে সুলতানা বেশ অবাক হন।

” এত রাতে! কোন সমস্যা অনু?”

” ঈশা কোথায় আন্টি ওর নাকি জ্বর?”

” হ্যা রে মা জ্বরটা বেড়েছে এখনো ঘুমিয়ে আছে।”

” আমি তাহলে ওর কাছে আজ থাকি।”

” তুমি থাকবে।রাতে খেয়াল রাখতে হবে তুমি পারবে নাকি।তোমার সমস্যা হবে তুমি বরং বাসায় যাও।”

” আমি পারবো ওর খেয়াল রাখতে।”

অনু এগিয়ে গেলো ঈশার রুমে।গরমের মাঝেও মেয়েটা কম্বোল গায়ে শুয়ে আছে।হাতের ফোনটা নিয়ে ঈশার একটা ছবি তুলে নিলো অনু তারপর পাঠিয়ে দিলো ঈশানের কাছে।বিছানার পাশে টেবিলটায় একটা বাটিতে পানি রাখা নিশ্চয়ই এতক্ষণ জলপট্টি দিচ্ছিলো আন্টি তাই দেরি না করে ঈশার পাশে বসে জলপট্টি দিতে থাকে অনু।
.

ঈশার ঘুম ভাঙলো কাক ডাকা ভোরে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা মানুষটাকে অনুভব করতে মুহূর্তে চমকে যায় সে।ভেবেছিলো হয়তো সুলতানা জড়িয়ে আছে তাই চুপচাপ চোখ বুঝে রইলো কিছুটা সময়।মাথাটা তুলতে অনুকে পাশে দেখে চমকে যায় ঈশা মেয়েটা কেমন লেপ্টে আছে তার সাথে।নিশ্চয়ই জ্বরের কথা শুনে ছুটে এসেছে শুষ্ক ঠোঁট টেনে হাসলো ঈশা।বুলিয়ে দিলো অনুর চুল।কিছুটা সময় ব্যয় হতে উঠে দাঁড়ালো ঈশা মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে। দেয়াল ধরে ধরে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ফিরলো সে।জানলা খুলে দেখলো বাইরের সতেজ প্রকৃতি।ভোরের এই সময়টা একটু বেশি ভালো লাগে।পড়ার টেবিলের উপর পড়ে থাকা ফোনটা তুলে চেক করলো গতকাল তিয়াশের একের পর এক কলে বিরক্ত হয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল তখন কিন্তু কখন যে জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে পড়বে বুঝে উঠতে পারেনি।ফোনের লক খুলতে ঈশানের নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার ফোন এলো কিঞ্চিৎ হাসলো ঈশা ছেলেটা অনেক মেসেজ পাঠিয়েছে।

“তুই কখন উঠলি?”

অনুর প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে ঈশার।চমকে মাথা ঘুরিয়ে অনুর চোখে চোখ রাখলো সে মেয়েটার ঘুম ঘুম ফোলা ফোলা চোখে বেশ নাদুসনুদুস লাগছে।

” তুই এখানে কেন এসেছিলি?”

” তোর নাকি জ্বর তাই এলাম।মরার মতো পড়ে ছিলি।”

” মরে গেলে ভালোই হতো তুই বাঁচতি।”

” এখনো রেগে থাকবি।একটু দয়া কর আমি ভুল করেছি তার শাস্তি এতটা হবে?”

ঈশা প্রত্যুত্তর করলো না।সকালে ঘুম থেকে উঠে অনুর মুখটা দেখেই রাগ পড়ে গেছে কিন্তু এত সহযে যে কথা বলা যাবে না।অনু ঢুলতে ঢুলতে বিছানা ছেড়ে নামলো হাই তুলে ঈশার উদ্দেশ্যে বলে,

” আমি যাই তোর জন্য স্যুপ আর ফলের জুস করে আনি তুই বস।”

” এসবের কোন দরকার নেই।কারো বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন নেই।”

” এই কথা বলবেন না মহারানী আপনার মহারাজ আমার গ র্দা ন নেবেন যদি আপনার যত্নে ক্রুটি রাখি।”

” মানে?”

অনু এক চিলতে হাসলো জবাব না দিয়ে ছুটলো রান্না ঘরে।

৪৬.
ঈশার জ্ঞান হারানো এবং জ্বরের কথা শুনে হাসিন অস্থির হয়ে পড়লো কিছুক্ষণ পরপর ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে এটা খা ওটা খা বলে আদেশ ছুড়ছে ঈশা এসব বেশ উপভোগ করছে অবশ্য মাঝে মাঝে প্রচন্ড বিরক্ত লাগলেও মুখ বুঝে সয়ে যায়।এই মানুষগুলো তাকে একটু বেশি ভালোবাসে।হাসিনের সাথে কথা বলার মাঝে ঈশান একেরপর এক ফোন করে যাচ্ছে ঈশাকে ব্যস্ত দেখে যেন ইচ্ছে করেই বেশি ফোন করছে।ঈশা বিরক্ত হলো ফোন রিসিভ করেই ঈশানকে ধমকে বলে,

” সমস্যা কি আপনার বুঝতে পারছেন ফোনে কথা বলছি তাও কেন কল করছেন এত বার?”

” একদম ধমকাবে না কার সাথে কথা বলছিলে?কি ভেবেছো আমি বুঝিনা ঈশা তুমি তিয়াশকে এক্ষুনি ব্লক করবে।”

” তিয়াশের সাথে আমি মোটেও কথা বলিনি আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলাম।”

” আমি জানি তুমি মা বাবার একমাত্র সন্তান তাহলে এই ভাইটা আবার কোথা থেকে উদয় হলো?”

” কাজিন ভাই বুঝতে পেরেছেন এবার?”

“কাজিন ভাই মানে হাসিন নামের ছেলেটা?উনি একটু বেশি পসেসিভ তোমার ব্যপারে তাই না?”

” হ্যা কিন্তু কেন?”

” বুঝতে পারছি এবার আমি।তিয়াশের থেকেও আমার প্রেমে বড় বাঁধা হবে এই হাসিন।এই কাজিন গুলো একটু বেশি কেয়ার দেখাবে তারপর তারপর উফফ ভাবতে পারছি না আমার রাগ লাগছে।”

ঈশান রেগে গেলো পাইচারি করতে থাকলো অস্থির পায়ে।ঈশা বুঝতে পারলো হাসিনকে নিয়ে ঈশানের মনে নেগেটিভ চিন্তা আসছে।ভাই বোনের সম্পর্কে এসব সন্দেহ কখনো বরদাস্ত করবে না ঈশা তাই লহমায় রেগে গেলো সে।

” ঈশান হাসিন আমার ভাই হয়।আমি তাকে ভাইয়ের চোখে দেখি আর উনি আমাকে বোনের চোখে দেখেন।আপনার চিন্তা ধারা এতটা নোংরা ছিহ।ফোন রাখুন আপনি ফা ল তু বাজে লোক।”

ঈশা ফোন কাটলো অপর পাশ থেকে থতমত চোখে তাকিয়ে রইলো ঈশান।সত্যিত সে একটু বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছে এমন ব্যবহার করা তার মোটেও উচিত হয়নি।

তারপর কেটে গেলো দুটি দিন।অনুর সাথে এর মাঝে কথা হয়নি ঈশার।কথা হয়নি ভুল কথা অনু মেসেজ করেছে তবে প্রত্যুত্তর পাঠায়নি সে।শেষ বার্তা পাঠিয়েছিলো দুপর বেলায় সেখানে উল্লেখ ছিলো আজ অনুকে দেখতে আসবে।বিষয়টা ততটাও সিরিয়াস ভাবে নিলো না ঈশা ভেবেছিলো হয়তো অনু মজা করছে।কিন্তু দুপুরের পর অনুর মা দোলনের উপস্থিতি পালটে দিলো সবটা।ঈশা তখন নিজের কক্ষে ছিলো।অনুর মা মিষ্টির প্যাকেট এনে একটা মিষ্টি ঠেসে দিলো ঈশার মুখে ঈশার অবাক মুখখানি দেখে হেসে উঠলেন সুলতানা এবং দোলন।

” এটা কিসের মিষ্টি আন্টি?”

” আলহামদুলিল্লাহ অনুর এবার বিয়েটা হয়ে যাবে রে।তোর নতুন দুলাভাই আসছে।দুপুরের পর দেখতে এসেছিলো এগুলো সেই মিষ্টি।”

” অ…অনুর বিয়ে!”

” কেন অনু তোকে বলেনি?ছেলে মাশাল্লাহ লম্বা চওড়া ভালো চাকরি করে অনুকে তাদের পছন্দ হয়েছে বাকি সিদ্ধান্ত আমাদের।”
#চলবে___