পুষ্প কন্যার প্রেম পাবক পর্ব-১৩

0
218

#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব১৩
#রাউফুন

ঝুমুর খাওয়া দাওয়া করে তার নানির রুমে গেলো। তার নানি বসে দাঁত খোচাচ্ছেন। তাকে দেখে তার ছোট মামা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কি হলো? নানি আর ছোট মামা কি কথা বলছিলেন? আর তাকে দেখে এভাবে তাকিয়েই বা কেন ছিলেন ছোট মামা?

‘আসো ঝুমুর সোনা! এইদিকে আসো!’

ঝুমুর অন্যান্য দিনের তুলনায় আস্তে আস্তে হাঁটছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলো তার নানির পাশে। হঠাৎই ঝুমুর নিশ্চুপ হয়ে বসে নিজেকে সামলাতে না পেরে তার নানিকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। হালিমা খাতুন কি বুঝলেন কে জানে। ঝুমুরের মাথায় হাত রেখে স্নেহময় স্বরে বললেন,

‘তোমার মাথা খান ঢাইকা রাহো, ঝুমুর সোনা। তুমি কি ভাবছো, আমার এই চুল গুলা এমনিই পাঁকছে? এই হালিমা খাতুন সব বুঝবার পারে। আমার যহন বিয়া হইছে, তহন আমার বয়েস আছিলো বারো বচ্ছর আর তোমার নানা ভাইয়ের বয়েস আছিলো পঁচিশ বচ্ছর। আমার বিয়ার পরের দিন তোমার মতোন অবস্থা হইছিলো। তাই তোমারে দেইখাই বুইঝা গেছিলাম কি হইছে ভিতরে।’

চট করে মাথা তুলে অবাক হয়ে চাইলো সে তার নানির দিকে!

‘কি-কি বলো তুমি? ভিতরে কি হয়েছে মানে?’

‘আমি শুধু তোমারে অস্বস্তিতে ফেলবার চাই নাই। তোমার মাথায় যে চাপ টা পরবো ঐটা চাই নাই। তোমারে দেইখাই সব কিছুই বুঝবার পারছি, শুধু না বুঝার ভান করে রইছিলাম তহন। তুমি আমগো বাড়িত আইলা শরীর খারাপ লইয়া, তিনদিন আগেই তোমার শরীর ভালা হইছে। তয় আইজকা সক্কাল সক্কাল গোসল করলা ক্যা? তোমার গলার কাছে আলতো আঁ’চড়ের দাগ। এরপরে দেহি, বারান্দায় শুকাতে দেওয়া ভেজা চাঁদর। ছেড়াডার শরীরে কাপড়ও ঠিক নাই। খাবার সুময় ঠিক কইরা খাইলা না। অতঃপর তোমার চলাফেরা দেইখাই নিচ্চিত হইলাম। তাই তোমার ছোডো মামারে পাডাইলাম কাজি ডাকবার। কোনো সব্বনাশ হওনের আগেই তোমগোর বিয়াডা দিয়া দিমু আমি। যদি বাচ্চা টাচ্চা আহে!’

‘ন-ন-ননাহ! ‘ আতংকিত হলো ঝুমুর।

শুধু এই শব্দ টুকুই উচ্চারণ করে ঝুমুর হিচকি তুলে কাঁন্না করতে লাগলো তার নানিকে জড়িয়ে ধরে। ধীরে ধীরে কান্নার বেগ বেড়ে গেলো দ্বিগুণ হাড়ে। এই মুহুর্তে আর কথা বলার অবস্থায় নেই সে। যে-কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বয়স ও তার না। তার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তার নানি যা বলছে তাই সঠিক। তবে তীর্থকে সে কখনোই ক্ষমা করবে না। স্বামী হিসেবে মানতে পারবে না। আজ যদি বিয়ে না হয় তবে যদি নানির কথা সত্যি হয়? বাবা মায়ের সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে সে? সেদিন ছোট চাচার কথা শোনার পর সে আরও ইচ্ছে করেই তীর্থকে এড়িয়ে যেতো। আর তীর্থ ভাবতো ঐ ভিডিও দেখার পর থেকে সে কথা বলতো না। কিন্তু সে তো জানে, তার তীর্থ ভাই অমন নোং’রা নয়। তবে সেদিন নিচে নামার সময় চাচাকে যখন বলতে শুনলো, ভাবি ”নৌকার সামনের দিক যেদিকে যায় পেছনের দিকও কিন্তু সেদিকেই যায়।” এই কথাটা যে তাকেই ইঙ্গিত করে বলেছিলো তার চাচা সে ছোট হলেও বুঝেছিলো। তাই তো তীর্থর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ছিলো। সে কোনো ভাবেই চাইছিলো না তার চাচার কথা সত্যি হোক। কিন্তু আজ যে সেটাই হতে চলেছে। হুহু করে কাঁন্নার শব্দ বাড়লো তার। ভগ্ন হৃদয়ে এখানে চলে এসেছিলো তীর্থকে ভুলতে এখন যে আরও জোড়ালো হলো সবটা।

‘কাঁইন্দো না আমার সোনা। এই আমি, তোমার নানু বেঁচে থাকতে তোমার কোনো সব্বনাশ হইতে দিমু না।’

ঝুমুর কান্না থামিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘কিন্তু আব্বা, আম্মারে কি বলবা নানি?’

‘ওসব তোমার ভাবা লাগবো না। আমি আমার নাতনীরে বিয়া দিমু তা কার কি? আমার সিদ্ধান্ত এর উপরে তোমার বাপ কোনুদিন কতা কই নাই আইজকাও কইবো না। বিয়া পরানোর পর ডাকমু ওগোরে! আগেই কইলে বিয়াতে ঝামেলা হইতো পারে। তার আগে আমার এইডা জানতে হইবো তোমার ঘরের দরজা খানা কে আটকাইলো।’

ঝুমুর চোখ মুছে শুকিয়ে আসা গলাটা ঢুক গিলে একটু ভেজানোর চেষ্টা করলো। স্বতস্ফূর্ত ভাবে বললো, ‘তীর্থ ভাই কিন্তু খারাপ মানুষ ন, নানি! আসলে প্রচন্ড জ্বর এলে ওঁ এমন করে,ঘোরের মধ্যে আবোল তাবোল বকছিলো, আমাকে বউ ডাকছিলো, তারপর বলছিলো, তোমাকে লাল শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে বউ!’

‘আমি মানুষ চিনি, তোমার কওন লাগবো না। আমি মনে করি, যেই দরজা আটকাই দিসে সেই জাইনা বুইঝাই এই কাম করছে। যাতে তোমার সব্বনাশ হয়। কিন্তু এই বাড়িতে তোমার শত্তুর কেডা?’


তীর্থর ঘুম ভাঙলে সে দেখলো তার জামা কাপড় কিছুই ঠিক নেই। কেমন যেনো গন্ডগোলের গন্ধ পাচ্ছে। সে নিজেকে চেইক করলো ভালো ভাবে। এরপর নিজেই নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর কমেছে। তবে কেমন যেনো সবটা অদ্ভুত লাগছে। তার জ্বর এলেই যে গন্ডগোল হয়। সে কি কাল ঝুমুরকে স্বপ্ন দেখছিলো? লাল শাড়ি,লজ্জা পেয়ে হাসা,তাকে দূরে ঠেলছিলো বার বার লজ্জায়! এসব কি সে স্বপ্ন দেখলো? আস্তে আস্তে সবটা মনে পরলো তার। যেনো সবটা বাস্তব ছিলো! না না বাস্তব কি করে হবে? ছিঃ ছিঃ ঝুমুরকে নিয়ে সে এরকম ধরনের স্বপ্ন দেখলো? ভাগ্যিস এটা স্বপ্ন ছিলো। বাস্তব হলে কি হতো? সে গোসল করে কি পরবে ভাবতে ভাবতে দরজায় টোকা পরলো। নিজেকে কাঁথায় ঢেঁকে নিলো। তারপর আলতো স্বরে বলল,

‘আসুন!’

‘আমি ঝুমুরের বড় মামা আজহারউদ্দীন! এই পাঞ্জাবি,পাজামা পরে নাও। এরপরে সোজা নিচে আসবে। এটা আমার আম্মার হুকুম।’

‘আচ্ছা!’ ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বললো তীর্থ। তার কাছে কেমন যেনো লাগছিলো। ওমন গম্ভীর ভাবে কেন কথা বলছিলেন ঝুমুরের মামা? সে উঠে পরলো, ওয়াশরুমে গিয়ে একেবারে গোসল করে বের হলো৷ প্রচন্ড খিদেই পেটে ছুঁচো দৌঁড়াচ্ছে। তার আঠারো বছরের জীবনে এমন খিদে কখনোই লাগে নি। সে এই বাড়িতে আছে অথচ ঝুমুর তার সামনে একবারও এলো না? নিচে নেমে এসে দেখলো সবাই ড্রয়িং রুমে এক সাথে বসে আছে। ঝুমুরের বড় মামা, ছোট মামা, বাকি দুইজন হইতো মামি হবে। পাশের জন তো ঝুমুরের নানি। দুটো বাচ্চা ছেলে। নিশ্চয়ই ঝুমুরের মামাতো ভাই দুইজন। সোফায় কালো ব্যাগ হাতে বসে আছেন আরেকজন বৃদ্ধ। তিনি কে, তীর্থ আন্দাজ করতে পারলো না। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কোথাও ঝুমুরকে দেখতে পেলো না। নতুন জায়গায় এসে সে কিভাবে বলবে তার খিদে পেয়েছে? ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে যখন সে মুখ খুলবে কিছু বলার জন্য তখনই শুনলো গম্ভীর এক তীর্যক বানী! ঝুমুরের ছোট মামা কর্কশ গলায় বললেন,

‘এদিকে আসো! আমাদের সামনে বসো!’

তীর্থ মাথা নেড়ে বসলো। এমন ভাবে কথা বলছে তারা এবং তাদের চাহনী এমন ধারালো যে তীর্থ ঘাবড়ে গেলো। জেলের আসামীর সঙ্গে যেভাবে ব্যবহার করা হয় তার মনে হচ্ছে তাকেও সেভাবে ট্রিট করা হচ্ছে। তারা কি তবে তার অনিচ্ছাকৃত সেই ঘটনার খবর পেয়ে গেছে?

‘তোমার বয়স কত? কোন ক্লাসে পড়ো! দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানো না। কিন্তু কাজ কারবার তো সব বড় বড়! আজ আম্মা না থাকলে বুঝতে এই আজহারউদ্দীন কি জিনিস!’

‘আহ থাম আজহার!’ হালিমা খাতুন ধমক দিলেন বড় ছেলেকে। এরপর তীর্থর উদ্দেশ্যে বললেন,

‘তোমার বয়েস খান কও দেহি নানু ভাই! তোমার আব্বা, আম্মার নাম বলো!’

তীর্থ এমন প্রশ্নের মানে বুঝলো না। কিন্তু যেহেতু বয়জ্যষ্ঠ মানুষ প্রশ্নটা করেছেন সেহেতু তীর্থ সুন্দর ভাবে উত্তর দিলো,

‘জ্বী আঠারো বছর নানি! আব্বার নাম আসলাম শেইখ, আম্মার নাম রুমি বেগম। আর বড় মামা, আমি এইবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবো!’

‘কাজী সাহেব লিখেছেন তো পাত্রের নাম আর বাপ মায়ের নাম? এবারে বিয়া পরানো শুরু করেন!’

হালিমা খাতুনের কথায় পিলে চমকে উঠে তীর্থর। কার বিয়ে, কিসের বিয়ে? ঝুমুরের নানি কি বলছেন এসব?

‘কিসের বিয়ে নানি? পাত্রের নাম মানে? কি হচ্ছে এসব বলবেন দয়া করে?’ যারপরনাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তীর্থ!

‘এখন নাটক করছিস, শু’*-বা**! আমার ভাগনির সর্বনাশ করে এখন নাটক করছিস? তোকে তো..!’

তীর্থর মাথার উপর দিয়ে গেলো সবটা। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে তার। সে আতংকে দাঁড়িয়ে পরেছে।

‘ছোটো, আমি থাকতেই তোরা মাতব্বরি করস ক্যা?’

‘আম্মা, আপনে দেখতাছেন না, এই ছোকড়া কেমন নাটক করতাছে?’

‘তোরা কেউ-ই কথা কইবি না। আমি আছি, আমি বুঝুম কি হইবো। শুনো তীর্থ নানু ভাই, আমরা ক্যান ঝুমুরের লগে তোমারে বিয়া দিতাছি, এতক্ষনে বুঝবার পারছো নিশ্চয়ই ? আশা করি ভাইঙ্গা কওন লাগবো না। এবারে শান্ত হয়ে বসো। কাজি সাহেব বিয়া পরান,পাত্রের বয়েস দেন একুশ,আর পাত্রীর বয়েস দিবেন আঠারো। আমগোর সুময় আবার বয়স বাড়ান লাগতো না।এহন কি যে ঝামেলা!

তীর্থ ধপ করে বসে পরলো মাথায় হাত দিয়ে। দু চোখ বেয়ে পরলো অশ্রুকণারা। তবে কি ভোরের ঘটনাটা স্বপ্ন নয়? ওটা সত্যি ছিলো?

ঘোরের মধ্যেই কবুল বললো তীর্থ। ঝুমুরও এক রকম ধান্দার উপরে কবুল বলেছে। একদম আকস্মিক ভাবে তার ঝুমুরের বিয়ে হবে সেটা ছিলো অভাবনীয়। সে এবং ঝুমুরের কারোরই বিয়ের বয়স হয়নি, তাদের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে বিয়ে পরানো হলো। কিন্তু এছাড়া কি সত্যিই কোনো উপায় ছিলো?সে আজকের ঘটনার পর কোন মুখে ঝুমুরের সামনে দাঁড়াবে? কিভাবে ঝুমুরের চোখে চোখ রাখবে? সে এমন অন্যায় করলো কি করে? দাঁতে দাঁত চিপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলো তীর্থ! আস্তে আস্তে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে আসছিলো তার সামনে।

#চলবে