তোমার নামে হৃদয় পর্ব-৩৯+৪০+৪১+৪২

0
331

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩৯)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
রুমের ভেতর থেকে তামান্নার গলার আওয়াজ শুনে সামিরা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। সে প্রসঙ্গ টেনে বললেন,
” কাল অনেক চেচামেচি শোনা গেছে তোমার। কিছু হয়েছে নাকি? ”

মিথ্যে কথা বলার মতো স্বভাব নেই তার। তবুও এ মুহূর্তে এড়িয়ে চলাটাকেই সবচেয়ে বড় সমাধান মনে হল। বলল, ” না! ”

” তাহলে চেচামেচি কি খুশিতে করেছিলে? এতো যদি অসহ্য লাগে আমার ছেলেকে তাহলে তাকে ছেড়ে কেন দিচ্ছ না! ”

সামিরার কথায় তামান্না অবাক হল না। উল্টো তেজী গলা ছেড়ে বলল, ” ছেড়ে দেওয়া কি এতই সহজ মা? ”

সামিরা অবাক হলেন। দমে যাওয়ার পরিবর্তে সরাসরি মুখের ওপর বলে দিলেন, ” আগে সহজ না হলে এখন সহজ হয়ে গেছে। তোমার মধ্যে কি বিন্দু মাত্র অনুশোচনা নেই? ”

” কেন? অনুশোচনা আমার কেন হবে? আমি তো কোনো দোষ করিনি। ”

” তোমার জন্য দু’জন মানুষ কষ্ট পাচ্ছে সেটাও কি ঠাওর করতে পারছো না? ঠিকই তো মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছো। এরপরেও নিজের দোষ দেখতে পাচ্ছো না? ”

” কোন দুজনের কথা বলছেন আপনি? ”

” শোন তোমাকে কিছু কথা বলি। ” সামিরা থামলেন।

” সেদিন সম্মান বাঁচানোর স্বার্থে সাদিবের বাবা তোমার সাথে সাদিবের বিয়ে দেন। তোমার বাবার সাথে চুক্তি হয় যদি প্রিয়ন্তি ফিরে আসে তাহলে তোমাকে সাদিবকে ছেড়ে দিতে হবে। বিশ্বাস না হয় তো তোমার বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। ”

” চুক্তি?” তিন অক্ষরের শব্দটি কানের এসে বাড়ি খেতে তামান্না থমকে গেল। যেন তার পুরো পৃথিবী তোলপাড় হয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল নিশ্চয়ই সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। শ্বাশুড়ির আঁড়চোখে দেখার জন্যই এমন ভাবনা। তামান্না চমকিত হওয়া ভুলে গেছে। রাগে কষ্টে চোখের পানির বাঁধ ভেঙে গেছে। চোখের সামনের সবকিছু ঝাপসা লাগছে।

” চুক্তি অনুযায়ী প্রিয়ন্তি ফিরে এসেছে। সাদিবও মন থেকে চায় না তোমার সাথে থাকতে। এতোদিন এই একটা কারণেই আমি চুপ করে তোমার তামাশা দেখছিলাম, এখন আর তোমাকে বরদাস্ত করবো না। তোমাকে আমাদের কারোর দরকার নেই। যদি এতোটুকু আত্মসম্মানবোধ থেকে থাকে তাহলে সসম্মানে আমার ছেলের জীবন থেকে চলে যাও। আমি চাই না তোমার মতো মেয়ের জন্য আমার ছেলে অসুখী হোক। ”

তামান্না দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, ” আমি এই চুক্তি মানি না। আপনি মিথ্যে কথা বলছেন! ”

সামিরা চুপ রইলেন না। তারা জানামতে তামান্না সহজ সরল মেয়ে। দস্যিপনা থাকলেও খুব একটা চালাকি করে উঠতে পারবে না। সামান্য কয়েকটা কথা বললে মেয়েটা সহজে বিশ্বাস করে নেবে। কিন্তু না! তানান্নার দৃঢ় কণ্ঠ বলছে মেয়েটা এতেটাও বোকা নয়। তাৎক্ষণিক অন্য পথ অবলম্বন করার কথা ভাবলেন।

” বেশ! তাহলে তুমি খেয়াল করে দেখ সাদিব তোমার সাথে কতটা সহজ। ভেবে বলতো তোমাদের বিয়ে হওয়ার পর সাদিব কি কখনো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে? ”

” না! ”
” একটানা সারাদিন বাসার বসে কাটিয়েছে? ”
” না। ”

” অথচ এর আগে সাদিব বেশিরভাগই বাসার কাটাতো। কেবল দরকার না হলে সে খুব একটা বাহিরে বের হতো না। তাহলে বুঝেছো তো সাদিবের ঘন্টার পর ঘন্টা বাহিরে কাটানোর কারণ? ”
.

.
তামান্না ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে লম্বা সফরের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। হতে পারে তাড়াতাড়ি ফিরবে নয়তো ফিরবেও না। চুক্তি যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আর কখনো ফেরা হবে না। পুরোটা নির্ভর করছে ডাক্তার সাহেবের ওপর। বাসা থেকে বেরিয়ে আসার আগমুহূর্তে ডাক্তার সাহেবের জন্য টেবিলের ওপর একখানা চিরকুট ফেলে আসে। ভেবেছিল নিজের মুখে জানাবে। কিন্তু অভিমান আর সুযোগের অভাবে তামান্নার সাদিবকে সেই বিশেষ সংবাদটি আর জানানো হয়ে উঠেনি।

দু’টো দিন পেরিয়ে গেছে। এই দুটো দিনে সাদিব একটিবারও খোঁজ নেয়নি তামান্নার। ভেবে নিজের প্রতি করুণা জন্মায়। নিজেকে নিজের কাছে তুচ্ছ মনে হয়। কতটা খারাপ পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছে সেটা কেবল সেই জানে। তনিমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বাসায় ভরে গেছে নিকটাত্মীয়ের আগমনে। বাবা মা ভীষণ ব্যস্ত। তনিমা বিয়ের কণে। অন্যসময় হলে তনিমা চোখে মুখের অবস্থা দেখেই বুঝে ফেলত। এখন ব্যস্ততার কারণে কারোরই অন্যদিকে তাকানোর সুযোগ নেই। তামান্না অপেক্ষা করছে বিয়েটা শেষ হলে বাবাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে।

সন্ধ্যায় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান উপলক্ষে সাজসজ্জার কাজ শুরু করা হয়েছে। হলুদের জন্য সেভাবে কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যত মেহমান আসবে সব বিয়েতে। হলুদে কেবল নিকট আত্মীয় স্বজনরা সাথে সব ভাইবোনেরা মিলে করার সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাই সেই অনুযায়ী বাসার সাইডের জায়গাটাকে বেছে নেওয়া।

বিয়ের আগে দু’বোনের অনেক প্ল্যান করেছে সব ভেস্তে না যায় তামান্নার বিষন্নতা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু আপসোস বরাবরই সে ব্যর্থ! তামান্নার চেহারার অবস্থা দেখে তনিমার মুখখানি পাংশুটে রূপ ধারণ করে। একেতো মেয়েটার রংটা পাংশুটে তারওপর মুখটাও করে রেখেছে সেরকম। দু’য়ে মিলে চেহারার যাচ্ছেতাই অবস্থা। তামান্নার নজরে পড়ে ছোটবোনের মুখের চাহনি। ঠিক করে, ‘নাহ্ পরে যা হওয়ার হবে। আগে আনন্দ যা করার প্ল্যান মাফিক করে নেই।’

তনিমার পাশে গিয়ে তামান্না তনিমার চোয়ালে হাত ছোয়াল। তনিমা মুখ তুলে বোনের দিকে ছলছল নয়নে তাকায়। ” কিরে কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে? ”

তনিমা এদিক ওদিক মাথা নাড়ায়। অর্থ্যাৎ বোঝায় না, কেউ কিছু বলেনি। ” তাহলে? ”

” কালকের পর আমার জীবনটাও তোর মতো হয়ে যাবে রে। ”

তামান্না তনিমাকে খুশি করতে হেসে দিল। ” আমার মতো হবে কেন? আমি তো দিব্যি আছি। ”

” আমি খেয়াল করেছি গত দুইদিন ধরে ভাইয়ার সাথে তোর যোগাযোগ নেই। এরপরেও বলছিস দিব্যি আছিস? ”

” প্রমাণ দিবো? ”

তামান্না আশেপাশে একবার তাকাল। তনিমাকে চুপচাপ বসতে বলে নেমে গেল স্টেজ ছেড়ে। সোজা পেছন দিকে চলে গেল। দেখতে পেল পেছনের সারিতে একজন চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। তামান্না চাদর মুড়ি দেওয়া ব্যক্তিটিকে বলল, ” আংকেল এখন তো গরমকাল। এই গরমে আপনার চাদর গায়ে দিয়ে বসে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই! ”

লোকটি নিশ্চুপ বসে থেকে মাথা দোলাল৷ তামান্না বলে উঠে, ” ওয়েট আপনার কষ্ট কমিয়ে দিচ্ছি। ” বলে লোকটার চাদর টেনে ধরে। তামান্নার কথায় সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটাও কম যায় না, চাদর খানা শক্ত করে চেপে ধরে। তবুও তামান্নার জেদ আর নিজের সম্মানের কাছে পরাস্ত হয়ে লোকটাকে হাল ছেড়ে দিতে হয়। চাদর সরতে ছোটরা সবাই একসাথে ” জিজু ” বলে চিৎকার করে লোকটার দিকে হামলে পড়ে।

বেচারা তন্ময়ের বেহাল দশা। সব শালিরা তাকে ঘিরে ধরেছে। অন্যসব ছেলেদের মতো বিয়ের আগের দিন রাতে ছেলেটা এসেছিল হবু বউকে একনজর দেখতে। কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড নামক ধুরন্ধর শালির পাল্লায় পড়ে নাজেহাল অবস্থা। কটমট করে তামান্নার দিকে তাকায় তন্ময়। তামান্নার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হাত নেড়ে নিজেকে বাতাস করে। মুখে বলে, ‘ উফফস্ গরম! ‘

সবকিছুর ফাঁকে তামান্না স্টেজের দিকে তাকালে খেয়াল করে তনিমা শুরুতে হেসে দিয়েছিল। এখন বরং লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নুইয়ে পড়েছে। তনিমাকে খুশি দেখে তামান্নার মুখের হাসি প্রশস্ত হয়। প্রশান্তিতে মনটা ছেয়ে যায়৷ তন্ময়ের ওপর তার দৃঢ় বিশ্বাস তনিমা তার কাছে ভীষণ খুশি থাকবে৷

তন্ময়কে স্টেজের সামনে নিয়ে তন্ময় নিচে দাঁড়িয়ে তনিমার দিকে হাত বাড়ায়। তনিমা আশেপাশে তাকায়। মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে যা তার মুখে তখনো স্পষ্টত! এদিকে না পারছে তন্ময়ের দিকে হাত এগিয়ে দিতে না পারছে তাকে নিষেধ করতে। তামান্নার দিকে তাকালে তামান্না বাহবা দেয়। মাথা নেড়ে সায় জানায়। বোঝায়, ‘ আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? যা হাত বাড়িয়ে দে! ‘

দু’জন স্টেজে পাশাপাশি বসেছে। তন্ময় হেসে তনিমার দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে। তা দেখে তনিমা লাজুক হাসছে। তন্ময় মৃদু স্বর তুলে তনিমাকে বলল, ” তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে শ্যামাঙ্গীনি! ”

তনিমা লাজুকতার সহিত বলল, ” থ্যাংস! ”
.

.
হলুদে পাশের বাসার কয়েকজন আন্টি এবং তাদের অবিবাহিত মেয়েরা এসেছে। এক আন্টি তামান্নাকে বলে উঠে, ” কিরে তামান্না! তোর বর কোথায়? আগে যে বলতি বাপের বাড়ি আসলে লুকাই রাখবি, সত্যি সত্যি কি লুকাই রাখছিস নাকি? ”

মনে মনে ভাবল, ‘ হইছে থামেন। চোখের সামনেই পাইনা আবার লুকাইতে যামু! ‘ খালি ময়মুরুব্বি দেখে বলতে পারল না।

তামান্না মুচকি হাসল। ” একে তো জলজ্যান্ত তারওপর বড়সড় মানুষ, তারে লুকাবো কিভাবে বলেন? অবশ্য ছোটখাটো জিনিস হলে লুকোনোর ঠিক চেষ্টা করতাম। ”

” তাহলে কই দেখছি না যে? একমাত্র শালির বিয়ে আর সে-ই উপস্থিত নেই। নাকি দু’জনের ঝামেলা হইছে? ”

” ঝামেলা হবে কেন? ব্যস্ত মানুষ তাই আসেনি। সময় পেলে ঠিক চলে আসবে। ”

” আসলেই হয়। বিয়েটা তো করলি লুকিয়ে কাউকে জানাসনি। তাই ভাবলাম পালানোর বিয়ে তো দেখিস আবার ভেঙে না যায়! ”

বেশি বোঝা মানুষদের বরাবরই বিরক্ত লাগে তামান্নার। আরে বাপরে যতটুকু দরকার ততটুকুই বোঝেন না। এতো বাড়াবাড়ি করতে বলে কে আপনাদের? আপনাদের কি মাসে মাসে আমি আর আমার বাপ বেতন দিয়ে রাখি নাকি? যে সব ফেলে পড়বেন কার জামাই কি করল না করল, কার বাসার কি হলো না হলো এসব নিয়ে! একে তো সাদিবের ওপর মেজাজ বিগড়ে আছে তারওপর মহিলার ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ মার্কামারা কথা। রাগটা দমাতে ছেয়েও তামান্না ব্যর্থ হয়েছে।

” আন্টি আপনার মেয়ের একটু খোঁজখবর রাখবেন বুঝলেন? এখান থেকে সব দেখা যায়, সুযোগ ফেলে ফোনে কার সাথে জানি মেয়েটা ফুসুরফাসুর করে। আমি তো পালিয়ে করেছি আপনার মেয়ে যেন এমনটা না করে কেমন? ”

তামান্নার কথা শেষ হতে মহিলা পাশে বসা নিজের মেয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। মেয়ের জন্য তামান্না তাকে এভাবে অপদস্ত করবে ভাবতে পারেননি। ঝাঁঝাল কন্ঠে রাগ ঝেড়ে তামান্না চলে আসে মজলিস ছেড়ে। স্পিকারের শব্দে কান দু’টো জ্বালাপালা করে দিচ্ছিল তারওপর মহিলার আজাইরা ফ্যানফ্যান অসহ্যকর! রাগী স্বভাবের জন্য আশেপাশে না তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটে তামান্না। স্পিকারে পছন্দের গান বাজতে শুনলেও বিরক্ত লাগে। সাথে সব জায়গায় উস্টা গুতা খাওয়ার অভ্যেস তো জনমভরকার! হেঁটে যাওয়ার সময় এক টুকরো ইট পায়ে বিঁধে পড়েই যাচ্ছিল, পরক্ষণে শক্তপোক্ত একটা হাত তাকে আঁকতে ধরে ফেলে…..

#চলবে…

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৪০)
#ফাহমিদদা_মুশাররাত
.
তামান্না পড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।পরক্ষণে সে নিজেকে শূন্য ভাসা অবস্থায় আবিষ্কার করে। বুঝতে পারে একটি শক্তপোক্ত হাত তাকে আগলে রেখেছে। চোখ মেলে হাতের মালিকের জায়গায় ডাক্তার সাহেবকে দেখে ভেতরটা না চাইতেও ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। অপেক্ষার অবসান ঘটেছে ভেবে খুশি হয়। তবে ওপর থেকে কিচ্ছুটি বুঝতে দেয় না। সাদিবের কণ্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছাতে তামান্নার ঘোর কাটে।

” এই যে এতো রাগ, এতো জেদ দেখাচ্ছ এসবের জন্য ক্ষতিটা কার হতে যাচ্ছিল শুনি? একটু কি দেখে চলাফেরা করা যায় না? ”

সাদিবের ঝাঁঝাল কন্ঠ। ভেবেছিল মেয়েটাকে একটু উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। একে তো বলে আসেনি তারওপর এতো বড় সুসংবাদ তাকে সময় মতো জানায়নি। তাই ইচ্ছে করে গত দুইদিন যোগাযোগ করেনি। আশা করেছিল তামান্নাকে নিজের অভাব বোঝাবে। কিন্তু হলো ঠিক উল্টোটা! অভাব তো দূরের রাগটা বরং তারচে বেশি বেড়ে গেছে।

” এখানে কি চাই? ” তামান্নার গম্ভীর গলা।

সাদিব তাকিয়ে দেখল। অভিমান নাকি জেদ থেকে তামান্নার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে, এ মুহুর্তে ঠিক বুঝতে পারছে না। জবাবে শান্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, ” কিছু না! ”

সাদিব নিজে থেকে গিয়ে তনিমা এবং তন্ময়কে হলুদ ছোঁয়াল। হেসে হেসে কি যেন বলল দু’জনকে, তামান্না স্পষ্ট খেয়াল করল। তামান্না ভেবেছিল সাদিব আসবে না। কিংবা এসবে তার কোনো আগ্রহ নেই কিন্তু সাদিব এমনটি করেনি। মনে মনে তামান্না সাদিবের ওপর বেশ সন্তুষ্ট হয়।

সাদিব স্টেজ ছেড়ে নেমে আসতে তামান্না সাদিবের হাত ধরল। সাদিব প্রশ্নবোধক চাহনি জানতে চাইলে তামান্না,” ওদিকে চল!” বলে হাত ধরে টেনে পাশের বাসার আন্টিদের সামনে আলাপ করাতে নিয়ে গেল। যাদের মনে সন্দেহ ছিল তাদের সন্দেহ দূর করতে পেরে তামান্নার অশান্ত মন শান্ত হল। কিন্তু সে এলো কখন? সাদিব পাশে এসে দাঁড়াতে জিজ্ঞেস করল, ” কখন এসেছিলে? ”

” কেন মিস করছিলে নাকি? ”

‘সে তো করেছিই! ‘মনে মনে বললেনও মুখে প্রকাশ করল না। সত্য কথা চেপে রেখে বলল,
” বয়েই গেছে। ”

” তাহলে কি এসে ভুল করেছি? মানে তোমায় বিরক্ত করছি না তো? ”

তামান্না প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়। সাদিব বলে,
” বাসা থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে এলে, একটা কল করার প্রয়োজন পড়ল না। তাই ভাবলাম বিরক্ত হচ্ছো না তো? আমার উপস্থিতি ভালো না লাগলে সরাসরি বলে দিতে পারো। ইট’স সিম্পল! ”

” তোমার মা তো জানতো। তাছাড়া তুমিও তো খোঁজ নিলে না। ”

সাদিব অবাক হলো। বলল, ” আমার মা? ”

” হ্যাঁ তোমার মা। উনার সামনে দিয়েই তো বেরিয়ে এলাম। ”

” কিন্তু মা যে বলল…” সাদিব থেমে গেল। ” ওকে বাদ দেও। যাই হোক তুমি একা কেন বের হবে? যদি একটা অঘটন ঘটে যেত? ”

তামান্না তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল। বিড়বিড় করে আওড়ালো, ” ঘটার বাকি আছে কি? ”

” স্যরি! কি বললে শুনতে পাইনি! ”

” কিছু বলিনি৷ ” বলে তামান্না পাশ কাটিয়ে চলে গেছে৷
.

.
তনিমার বিয়ের কয়েকদিন কেটে গেছে। তামান্নার অন্তঃসত্তার খবর ইতিমধ্যে সবার কানে পৌছে গেছে। সবাই বেজায় খুশি। বংশে প্রথম বংশধর আসছে বলে কথা! সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে সাদিব। প্রথম সেই জানতে পেরেছিল। তামান্নার ফেলে আসা চিরকুটের মাধ্যমে। সাথে তামান্নার ওপর ভীষণ রাগও হয়েছিল। জানিয়েছে তো জানিয়েছে। জানিয়ে একেবারে উঠেছে বাপের বাড়ি। এর আগে জানালে কি যেতে নিষেধ করতো নাকি! সাদিব অর্ধাঙ্গীনির সাথে অভিমান করে কয়দিন কথা বলবে না ভেবে রেখেছিল। তা সত্ত্বেও দু’দিন পরে ঠিক ছুটে আসতে হয়েছে শ্বশুর বাড়ি। এসে দেখল উল্টো তামান্না তারওপর রেগে আছে। বিষয়টি দারুণ অবাক করেছে সাদিবকে। তবে সেভাবে ঘাটেনি। মুড সুইং ভেবে রেখে দেয়। এসময়টা মুডের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে কিনা!

সাদিব তামান্নাকে নিয়ে ফিরে যেতে চাইছিল। নীলিমা আর তালিব আবসার জোর করে রেখে দিলেন মেয়েকে। আবার কবে না কবে দেখতে পান ভেবে। তামান্নাও থাকতে চাইছে দেখে সাদিব জোর করেনি। সাদিবের থাকা না হলেও প্রতিদিনই স্বশরীরে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায়।
.

.
গ্রীষ্মের দুপুরের রোদের উত্তাপ ছড়ানোর সাথে হুটহাটই আকাশে কালো মেঘে ঢেকে যায়। বলা বাহুল্য কালবৈশাখী হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা! সূর্য্যি মামা লুকিয়ে পড়ে মেঘের আড়ালে। মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে বলে, এমন পরিস্থিতি। ঝড়ো হাওয়া বইছে। রাস্তার পথচারীগণ দৌড়াদৌড়ি করে বাড়িঘর দোকানপাট চোখের সামনে যা পাচ্ছে আশ্রয়ের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছে।

নীলিমা তামান্নাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল চেকআপের উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে পথিমধ্যে আবহওয়ার পরিবর্তন। বৃষ্টির আগে সহিসালামতে বাসার ফিরত পেরে সন্তুষ্টির ঢেকুর তোলেন তিনি। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে মুষলধারে না হলেও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়৷ তামান্নার চঞ্চল মন হালকা বৃষ্টিতে ভেজার প্রণোদনা জানায়। নিজেকে আটকানোর ব্যর্থ প্রয়াস না চালিয়ে সব ভুলে বৃষ্টির মাঝেই দৌড় লাগায়। নীলিমা পেছন ফিরে তামান্নার কান্ড দেখে মাথায় হাত দেন। মেয়ে তার করছেটা কি! যার জন্য এতো কিছু করল শেষে লাভের লাভ কিছুই হলো না।

অবস্থা বেগতিক দেখে নীলিমা আওয়াজ তুলল, ” তামান্না ভেতরে আয়। কি করছিস? ”

“মামনি তুমি যাও। আসছি। ”

” তামান্না ভিজিস না মা। ঠান্ডা লেগে যাবে বলছি। চলে আয়। ”

” এইটুকু বৃষ্টিতে কিছু হবে না। দেখ হাতই তো ভিজছে না। ”

নীলিমা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ” তামান্না কথা শোন। নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলছি। ”

তামান্না নিজের বাড়াবাড়ি বুঝতে পেরে কথা বাড়াল না। চলে গেল ঘরের ভেতরে। তা হলেও বা কি! এতোক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে। অল্পতে ঠান্ডা লাগার অভ্যেস তার। ইতিমধ্যে ঠান্ডা লেগে হাঁচি দিতে শুরু করেছে। পোষাক বদলে গরম রং চা নিয়ে বসে পড়েছে। নীলিমা পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। মেয়েটাকে কোনো কথা বললে শুনে না। এ মুহুর্তে পারছে না ঠাটিয়ে চড় মারতে। রাগ ঝাড়তে মেয়েকে ইচ্ছে মতো বকতে লাগলেন।

তামান্না মুখ ফুলিয়ে বলে, ” মা এমন করছো কেন? একটু তো ভিজতে গেছি। বৃষ্টি কি সেরকম হয়েছে নাকি? ”

” একটু ভিজবি কেন তুই? যেখানে নিষেধ করেছি সেখানে পুরোপুরি কেন একটুও ভেজা উচিত ছিল না। ”

নীলিমা ভেনিটি ব্যাগ হাতিয়ে তামান্নাকে ফোন এগিয়ে দিল। বলল, ” সাদিবের নাম্বার তুলে দে! ”

শুনে তামান্না অবাক হয়। হাঁচি-কাশি থামিয়ে জানতে চায়, ” কেন? তাকে কি দরকার? ”

নীলিমা ধমকের সাথে বলে উঠে,
” দিতে বলেছি দে! এতে কথা বলছিস কেন? ”

নীলিমা চোটে আছে দেখে তামান্না কথা বাড়ানোর সাহস পায়নি। ঝটপট হাতে সাদিবের মুখস্থ নাম্বার ডায়াল করে দেয়। ধমকে কাজ হয়েছে দেখে নীলিমা মনে মনে তামান্নাকে বাহবা দেন। মুখে বললেন, ” জানতাম ধমক ছাড়া কোন কাজ তোকে দিয়ে হবে না। ”

তামান্না বুঝল মামনি ফোন করে সাদিবকে আসতে বলবেন। সাথে একগাদা নালিশ তো আছেই। মায়ের দিকে তাকিয়ে তামান্না আনমনে ভাবে,
” বুঝি না বাবা, এদের কাছে আমার থেকে ডাক্তার সাহেব বেশি আপন হয়ে গেছে নাকি? যে সারাদিন এতো নালিশ দেয়া লাগবে তাও কিনা আবার নিজের মেয়ের বিরুদ্ধে। ”

প্রথমবার সাদিব ফোন তোলেনি দেখে তামান্না স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। যাক বাবা! বাঁচা গেল। নাহলে মায়ের বকা শেষ হতে হতে ডাক্তার সাহেব এসে শুরু করে দিত। অনবরত দু-তিনবার দেয়ার পর ফোনাটা হাত থেকে রেখে দেন নীলিমা। তামান্না মায়ের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি হেসে দেয়। মিনিট সাতেক না যেতে সাদিবের ফোন আসে। এবার নীলিমা তামান্নার দিকে তাকিয়ে একই রকমভাবে বিশ্বজয়ী হাসি হাসে।

নীলিমা সাদিবের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিকার জানতে চাইলে সাদিব স্ট্রিম নেওয়ার কথা জানায় সাথে এও জানায় সে তাড়াতাড়ি আসতে চলেছে। বাকিটা সে এসে দেখবে। কথা বলে ফোন রাখার পর তামান্না মায়ের দিকে করুণ চাহনিতে তাকায়। তার চাহনি বলে এমনটা না করলেও পারতে মা।

নীলিমা জানায়, ” যেমন কুকুর তেমন মুগুর! তোমার জন্য এটাই দরকার ছিল। ”

সাদিবের কথা অনুযায়ী তামান্না ভাপ নিচ্ছিল।কিয়ৎক্ষণ সময় বাদে দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। নীলিমা ভেতরের রুমে ছিল। বাধ্য হয়ে তামান্না দরজার খুলতে এগিয়ে যায়। বাহিরে সাদিব ভেবে তামান্না ভিতু মনে দরজা খুলে দিতে সাদিবের পরিবর্তে অপরিচিত একজনকে দেখে চমকায়…

#চলবে..

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৪১)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
দরজা খুলতে একজন প্রৌঢ় মহিলাকে চোখে পড়ল তামান্নার। সালাম বিনিময় করে স্বাভাবিক গলায় দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ় মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করল, ” আন্টি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না! ”

মহিলা তার চোখে পরা খয়েরী ফ্রেমের চশমাটা আলতো হাতের সাহায্যে ঠিক করে নিলেন। বেশভূষার ধরনে বেঝা যাচ্ছে মহিলা চাকরিজীবি। অপরিচিত হওয়ার কারণে শুধু তামান্না বুঝতে পারছে না এনার এখানে ঠিক কি বা কাকে দরকার! মহিলা বললেন, ” এটা কি তালিব আবসারের বাসা? ”

” জ্বি, এটা উনারই বাসা। আমি উনার মেয়ে। কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না! ”

মহিলা অবাক হলেন। তামান্নার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন। বললেন, ” আমাকে তোমার চেনার কথাও নয়। তোমার বাবা মা আমাকে চিনবেন, উনাদের কাছেই আসা। ”

” আপনি ভেতরে এসে বসুন আন্টি। বাবা তো বাসায় নেই আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি। ” বলে নীলিমাকে ডাকতে ভেতরের দিকে চলে যায় তামান্না।
.

.
সাদিব হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরেছে কিয়ৎক্ষণ! ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে ব্যক্তিগত ব্যবহার্য মুঠোফোনটা বেজে উঠে তার। ফোনের ওপাড় থেকে শ্বাশুড়ির অভিযোগ তামান্না কথা শুনছে না। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগিয়ে নিয়েছে। সে যেন তাকে গিয়ে বকে ঝকে হলেও বোঝায়। ইদানীং তামান্নার দুরন্তপনা বরাবরের তুলনায় অনেকাংশে বেড়ে গেছে। সাদিব তাতে চেয়েও বিরক্ত হয় না। শুধু মাঝে মাঝে কিছু জিনিস তাকে বড্ড চিন্তিত করে তোলে। নতুন বাবা হওয়ার আনন্দের পাশাপাশি চিন্তাটাও যে তার মাথায় ভর করে বসেছে। সামনের সময়গুলো তামান্নার জন্য অনেকটা কঠিন হতে চলেছে। সেখানে সাবধানতা অবলম্বন করার বদলে সে দুরন্তপনার মেতে উঠেছে।

একবার ও বাসায় যাওয়া দরকার থেকেই সাদিব পুনরায় তৈরি হয়ে নিল বেরুবার উদ্দেশ্যে। এবার গেলে নিয়ে আসা যথেষ্ট সম্ভবপর ভেবে রেখেছে। এভাবে প্রতিদিন যেতে ভালো লাগে না তার। এবার আর কারোর কথা শুনবে না। প্রয়োজনে অজুহাত দেকিয়ে হলেও নিজের কাছে নিয়ে আসবে।

বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে দেখা হলো সামিরার সাথে। ছেলেকে অসময়ে বেরুতে দেখে সামিরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
” এইতো সবে ফিরেছিস। এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস? ”

” তোমার বউমাকে আনতে! ” মৃদু হেসে সাদিব বলল। আজকাল বড়ই খুশি খুশি হাবভাব তার।

সামিরা ছেলের কথার মমার্থ বুঝতে পেরে মুখখানি চুপসে গেল। তামান্নাকে চেয়েও তিনি সাদিবের থেকে সরাতে পারবেন না বুঝতে পারলেন। ঐদিক থেকে তো কম চেষ্টা করছেন না। এদিক থেকেও নাহয় একটু করে দেখা যাক।

” এখন যাওয়ার কি দরকার? পরে গেলে হয় না.? ”

সাদিব চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের কণ্ঠস্বর তার কানে আহত ঠেকল। মৃদু হেসে মাকে জানাল, ” না মা। এখনই জরুরি! ”

সাদিব বেরিয়ে আসলে পেছন থেকে তিনি ডাকলেন, ” শোন বাবা এভাবে যাস না..”

সাদিব এগিয়ে এসে মাকে জানাল, ” তুমি না বল যাত্রা পথে না পেছন থেকে ডাকতে নেই? ডাকলেও পেছন ফিরে আসতে নেই নাহলে যাত্রা অশুভ হয়? ”

জবাবে সামিরা কিছু বললেন না। সাদিব মাকে আহ্লাদে জড়িয়ে ধরল। ” আসি কেমন? খুব শীগ্রই ফিরবো। ”
.
পথিমধ্যে সাদিবের সিঁড়ির রুমে এসে দেখা হয়ে যায় প্রিয়ন্তির সাথে। মেয়েটার স্বাস্থ্য অনেকটা বেড়ে গেছে গত কদিনে। প্রিয়ন্তি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। যার তার স্বাস্থ্যের সাথে অনেকটা ফুটে উঠেছে। তাকে দেখতে খুব সুখী সুখী লাগছে। সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হওয়ার পর থেকে প্রিয়ন্তির সাথে আর দেখা হয়নি। ফিরে এসে তামান্নার চিরকুটটি চোখে পড়ে। তামান্না আর তাদের সন্তানের কথা ভেবে সাথে সাথে প্রিয়ন্তির ফোন নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলেছে। মনে মনে নিজের সাথে পণ করে নিজেদের মাঝে আর কোনো ভুলবোঝাবুঝি আসতে দেবে না। যত যাই ঘটে যাক না কেন!

পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে প্রিয়ন্তির কণ্ঠস্বর কানে বাজল, ” কেমন আছো সাদিব? ”

সাদিব সেভাবেই জানায়, ” ভালো আছি। তুমি? ”

” ভালো, তামান্না কেমন আছে? আজকাল তাকে আগের মতো দেখছি না যে? সব ঠিক আছে তোমাদের মধ্যে? ”

তামান্নার কথা জিজ্ঞেস করতে সাদিব অবাক হলো। ভ্রু জোড়া কুঁচকে পেছন ফিরে তাকাল,
” কেন ওকে তোমার কি দরকার? ”

প্রিয়ন্তি বুঝতে পেরে হাসল,” অবাক হচ্ছো? ”

” হওয়া উচিত নয় কি? তুমি যে এ অবস্থায় একা একা বেরিয়েছ তোমার হাসবেন্ড জানে? ”

” হ্যাঁ, ওর সাথেই তো বেরিয়েছি! ”

সাদিব অবাক হল। সেটা লক্ষ্য করে প্রিয়ন্তি আগের ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ” তুমি সেদিন আমার পুরো কথা না শুনে আমাকে ভুল বুঝে চলে গিয়েছিলে সাদিব। আসলে তোমাকে সত্যিই আমি ঠকাতে চাইনি, পরিস্থিতি তখন অনেকাংশে বাধ্য করেছিল আমাকে। প্রণয় আত্মহত্যা করেছে শুনে ঠিক থাকতে পারিনি। তাই সেভাবে বিয়ের মণ্ডপ থেকে পালাতে হয়েছে। ভেতরে ভেতরে তোমাকে ঠকানোর জন্য অনুতপ্ত হয়েছি তো বটেই। সেজন্য সেদিন তুমি দেখা করতে বললে তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার একটা সুযোগ পেয়েচিলাম। অথচ তুমি ভুল বুঝলে। ভেবেছিলে ফিরে এসে নিশ্চয়ই তোমার সংসার ভাঙতে এসেছি। ”

সাদিব লম্বা করে শ্বাস ফেলে। মনে হলো বুক থেকে অনেক বড় পাথর সরেছে। তারপরেও নিশ্চিন্ত হয় না। প্রিয়ন্তির ব্যাপারে পুনরায় ভাবার প্রয়োজন বোধ মনে করল না। মিথ্যাবাদী, ধোঁকাবাজ মানুষকে সাদিবকে ভীষণ অপছন্দ তার। ডাক্তারদের যে সব সময় হাসিখুশি হতে হয় এমনটাও না। সেক্ষেত্রে হসপিটালে পেসেন্টদের কাছে সে প্রিয়পাত্র হলেও ব্যক্তিগত জীবনে একজন বড্ড অপ্রিয়পাত্র। বিশেষ করে নিজের অর্ধাঙ্গীনির কাছে। যেখানে তার কিনা হওয়া উচিত ছিল সবচেয়ে সুন্দর মনের মানুষ।

সাদিবকে চুপচাপ দেখে প্রিয়ন্তি বলল, ” কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ”

” বিশ্বাস হওয়ার কথা ছিল কি? ”

প্রিয়ন্তি ব্যথিত নয়নে তাকাল বলল, ” আমাকে এভাবে দেখেও বিশ্বাস হবে না? ”

” কেউ তোমাকে প্রথমবার ছলনার আশ্রয় নিয়ে ঠকালো, পরেরবার সে এসে একইভাবে নিজের সম্পর্কে তোমাকে গল্প শোনায়, তাকে কি তুমি বিশ্বাস করতে পারবে? ”

” জানি আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। কিন্তু সে মুহূর্তে তোমাকে ছোট্ট একটা টেক্সট করা ছাড়া আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না যে! ”

সাদিব প্রিয়ন্তির কথোপকথনের মাঝে একজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। দু’জন সেদিকে তাকাতে সামনে একজন সুদর্শন যুবককে দেখতে পেল। সাদিব আন্দাজ করল লোকটি হয়তো প্রিয়ন্তির প্রণয়।

” ছলনার সময় যদি বিশ্বাস করতে পারেন তাহলে সত্যিটা বিশ্বাস করতে পারবেন না? ”

” কে আপনি? ”

সাদিব লোকটিকে প্রশ্ন করলে প্রিয়ন্তি জবাব দিল, ” সাদিব ও প্রণয়, আমার হাসবেন্ড। ”

প্রণয় পরিচিত হওয়ার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিল। সাদিব সেটা তোয়াক্কা করার ইচ্ছে প্রকাশ করল না। প্রণয়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
” বিশ্বাস আপনাদের দু’জনের মধ্যে থাকাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। আপনারা একে অপরকে বিশ্বাস করুন সেটাই আশা করি আপনাদের জন্য যথেষ্ট! চলি মিস্টার প্রণয় সাহেব, পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। ”

সাদিব তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এমনিতে অনেকটা সময় অপচয় হলো এদের সাথে কথা বলে। তবে একদিকে ভালো লাগছে দু’জনকে একসাথে সুখী দেখতে পেয়ে। এবার অন্তত তার আর তামান্নার মধ্যে সবটা ঠিক থাকুক এটাই একান্ত চাওয়া সাদিবের।
.

.
নীলিমা ড্রয়িং রুমে বসে থাকা মহিলাকে দেখে চমকে গেল। এতদিন যে ভয়টা তাকে ধেয়ে বেড়াচ্ছিল, সে ভয়টা তার চোখের সামনে এসে হাজির হয়েছে। এটা তো একদিন হওয়ারই কতা ছিল ভেবে অজানা ভয় জেঁকে ধরল তার চেহারা জুড়ে। নিজেকে সামলে তামান্নাকে কৌশলে সামনে থেকে ভেতরের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। ভয়ের কারণ মেয়েকে জানতে দিতে চাইলেন না।

তামান্না চলে যেতে নীলিমা মহিলাকে জিজ্ঞেস করে, ” এতো বছর পর তুমি এখানে? কি মনে করে? ”

মহিলাটি জবাব দিলেন, ” কেন আসতে পারি না? ”

নীলিমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” পারো ঠিকই, কিন্তু আসার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে তাইনা? আমি সেটা জানতে চেয়েছি। ”

” তোর কি মনে হয় নীলিমা? আমি এখানে ঠিক কি কারণে আসতে পারি? ”

” আলাদা করে কিছু মনে হওয়ার মতো দেখছি না। আসার অনেক কারণই থাকতে পারে। ”

নীলিমার কথায় মহিলা মুখ টিপে হাসলেন। কয়েক সেকেন্ড মৌনতা বজায় রাখলেন। তারপর বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বাসার পুরোটা চোখ বুলনোর পাশাপাশি ভেবে চিন্তে বলল, ” তালিবকে ডাকো দু’জনকে নাহয় একসাথে বলি। ”
.
.
নীলিমা তালিব আবসারকে ফোন দিতে তিনি সহসা ছুটে চলে এসেছেন। নীলিমা আসল কারণটা এড়িয়ে জানাল জরুরি তলব, বাসায় আসলেই দেখতে পাবে। শুনে তালিব আবসার মেয়ের কথা ভেবে দেরি করার প্রয়োজন মনে করলেন না। ছুটে চলে এলেন। বাসায় এসে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে স্ত্রী-য়ের মতো একই ভাবে তিনিও চমকে গেলেন। সামনে এতো বছর পর সেই পরিচিত মুখটা দেখতে পেয়ে তালিব আবসার থমকে গেলেন। পা দু’টো যেন অসাড় হয়ে গেল। বড়সড় চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পেরেও সে সময় পুরোটা ভুলতে বসেছেন। একবার নীলিমার মুখের দিকে তাকালে নীলিমার চোখের কোণে অশ্রুর অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন। নিজেকে সামলে তিনি ইশারায় নীলিমাকে আশ্বাস দিলেন।

তালিব আবসার গম্ভীর গলায় বললেন,
” তুমি এখানে তাও এত বছর পর? ”

” কেন আসা কি অসম্ভব কিছু নাকি? ”

” এখানে কি চাই? ”

মহিলা সরাসরি বললেন, ” আমার মেয়েকে! ”

#চলবে..!

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৪২)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
মেয়ে জাতি বরাবরই শৌখিন। ঘরবাড়ির ক্ষেত্রে বলুন কিংবা নিজেকে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় করে তোলার কথা বলুন না কেন! সব ক্ষেত্রে তারা বিবেচনা করবে কোনটায় তাকে দেখতে ভালো লাগবে! নতুবা কোন জিনিসটা পরিবেশের সাথে মানাবে এবং খাপখাওয়াতে সক্ষম হবে! পুরুষ মানুষ বাহিরের জন্য মানানসই, বহিরাগত সমস্ত ব্যাপারে যেমন তাদের চিন্তাচেতনা মহিলাদের তুলনায় বেশি থাকে, সেরকমই সৃষ্টিকর্তা নারীদের তৈরি করেছেন ঘরের দিকটা সামলাবার জন্য। এজন্য ইসলাম ধর্মে নারীদের বলা হয়, ” রব্বাতুল বাইত ” অর্থ্যাৎ বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ঘরের রাণী।

তামান্না একা একা রুমে পায়চারি করছে। কোনো কিছুতে মন বসছে না তার। তনিনাটা চলে যাওয়ার পর থেকে বাসাটা পুরো খালি খালি লাগে। একদম মন টিকতে চায় না। আগে যখন তখন ফোনালাপ করা যেত এখন সে উপায়টাও নেই। বাসায় একমাত্র মামনি আছে, তকি স্কুলে। সে থাকা আর না থাকা দু’টো ব্যাপারই সমান। কথাগুলো বলার সময় আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় তামান্না। হঠাৎ চমকে ওঠে। সেকি, আমাকে দেখতে অনেকটা ড্রয়িং রুমের সেই আন্টির মতো লাগছে না? একটা চশমা থাকলে মন্দ হতো না। চোখে পরে আয়নায় নিজের চেহারার সাথে আন্টির চেহারায় আরেকবার মেলানো যেত!

অনেকক্ষণ যাবত ধরে খিদে পেয়েছে তামান্নার। রান্নাঘরে একবার যাওয়া উচিত। কিন্তু যাওয়াটা কি ঠিক হবে? মামনি যে তাকে রুমে পাঠিয়ে দিল! দূর কিছু হবে না আমি বরং যাই, রান্নাঘরে খাবার গিলতে যাচ্ছি ড্রয়িং রুমে তাদের কথা গিলতে তো নয়! ভেবে তামান্না পা বাড়াতে উদ্যত হল।
.

.
” তোমাদের খুঁজতে তোমাদের গ্রামের সেই পুরাতন বাড়িতেও গিয়েছিলাম। গিয়ে তোমাদের পাইনি। পাশের বাসায় জিজ্ঞেস করতে তোমাদের বাসার ঠিকানাটা দিল। তালিব তোমার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমার মেয়েটার সাথে শুধু একবার দেখা করতে চাই। ”

” সেটা যে আর সম্ভব না নিরুপমা! ” নিরুপমার ধরা গলার স্বরেও মন গলল না তালিব আবসারের। নীলিমা সেই তখন থেকে নিরবে চেয়ে আছে। মনে মনে ভয় পাচ্ছেন তামান্না না তাদের সব কথা শুনে ফেলে।

” ওর সাথে দেখা করার অধিকার তুমি সেদিনই হারিয়েছ, যেদিন তাকে তুমি নবজাতক শিশু অবস্থায় ফেলে গিয়েছিলে! আচ্ছা তোমার কি একটুও কষ্ট হয়নি? আমার কথা নাহয় না ভাবলে অন্তত ওর কথা তো ভাবতে পারতে। কিভাবে এতো পাষাণ হলে? ”

কথাগুলো বলে তালিব আবসার মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দুই যুগ ধরে সঞ্চিত মনের ব্যথা সব ক্ষোভ আকারে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভাবতে অবাক লাগছে একটা সময় ছিল, যখন এই মহিলাকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবেসেছিলেন তিনি। সৃষ্টিকর্তার কাছে এতো বছর দোয়া করে এসেছেন কখনো যেন তাকে তার অতীতের সামনে দাঁড়াতে না হয়, কখনো যেন মেয়েটা বুঝতে না পারে তার মা কতটা পাষণ্ড মহিলা।

নিরুপমা হাতের উল্টো পিঠের সাহায্যে চোখের পানি মুছলেন৷ বলতে চাইলেন অনেক কথা। কিন্তু কন্ঠ জুড়ে জড়তা। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছুটে এসেছেন মেয়ের কাছে। শুধুমাত্র একটিবার তাকে চোখের দেখা দেখবেন, ছুয়ে দেবেন, জড়িয়ে ধরে আদর করবেন, কপালে ঠোঁটের পরশ বুলবেন বলে! মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইবেন। জানে মেয়ে জানতে পারলে বরং তাকে ঘৃণাই করবে। তবুও মৃত্যুর আগে যেন মেয়েকে শেষ বারের জন্য হলেও দেখতে পারেন।

নিরুপমা নীলিমার কাছে কাকুতি জানিয়ে বললেন, ” আমি তোর থেকে তোর স্বামী কিংবা সংসার কোনোটাই ছিনিয়ে নিতে আসিনি। তুই তো জানতিস সবটা, তোর হাতেই তো আমার মেয়েটাকে তুলে দিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিনের কথা মনে করে নাহয় আজ একটু ওকে ডেকে দে, যাওয়ার আগে তাকে অন্তত আরেকটিবার চোখের দেখা দেখে যাই। ”

নীলিমাও বোনের কষ্টে সমান তালে চোখের পানি ফেলেছে। ” আফা তোর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ওকে দেখতে হলে তার স্বামীর থেকে তোর অনুমতি নিতে হবে। ”

নিরুপমা অবাক হলেন। সাথে খুশিও। ” বাহ্, তাহলে তো ও বেশ বড় হয়েছে। ধূর কি যাতা বলছি চব্বিশ বছর বয়স হয়েছে, বড় তো হবেই। কিন্তু ও তো ঘরেই আছে। একবার ডেকে দে না বোন আমার শুধু একবার! ”

নিরুপমার কথায় তালিব আবসার আর নীলিমা থমকে গেল। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। নিরুপমা বুঝতে পেরে বললেন,
” কি! দু’জন অবাক হচ্ছো এটা ভেবে, যে আমি কিভাবে বুঝলাম? কারণ আমি ওর মা। ওর চেহারার আদতে আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তাই প্রথম দেখাতেই ওকে চিনতে পেরেছি। মায়েরা সন্তানকে চিনতে কখনো ভুল করে না! ”

” না তামান্না তোমার মেয়ে না। ” তালিব আবসারের ঝটপট উত্তর।

নিরুপমা শুনে হাসল। ” নামটা তো আমার পছন্দের নাম ছিল তাই না তালিব? ”

তালিব আবসার তাড়াহুড়োর মাঝে মুখ ফুটে সত্য কথাটা বলে ফেললেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাথে সাথে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

” তামান্না! আমার তামান্না, সেই ছোট্ট তামান্না। যাকে আমি দশমাস নিজের মাঝে ধারণ করেছি। তামান্নার অর্থ হলো কাঙ্ক্ষিত! আমার কাঙ্ক্ষিত সে-ই অমূল্য সম্পদ। যাকে ভালো রাখার জন্য তার বাবা এবং খালার কাছে রেখে গিয়েছিলাম। ”

” দশমাস নিজের মাঝে ধারণ করলেই মা হওয়া যায় না আন্টি! মা হতে হলে দায়িত্ববোধ থাকা লাগে। আর হ্যাঁ অবশ্যই যেটা মূখ্য সেটা হলো আত্মত্যাগ করার ক্ষমতা থাকা। ” তামান্নার কণ্ঠস্বর শুনে সবাই চমকে উঠে। নীলিমা এতোক্ষণ যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হয়েছে। তামান্না এখন থেকে জানবে যাকে সে এতোদিন মামনি ডেকে এসেছে, নিজের মা ভেবে এসেছে, সে আসলে তার জন্মদায়িনী মা নয়! অথচ এতোদিন নীলিমা মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন তামান্না যেন তার জীবনে সবচেয়ে বড় সত্যিটা কখনো জানতে না পারে।

” কি ঠিক বলেছি তো বাবা? ”

তালিব আবসার মাথা নিচু করে ফেললেন। তামান্নার চোখে পানি। জীবনে এতোবড় একটা সত্যি সারাজীবন ধরে লুকায়িত ছিল সেটা পরবর্তী সময়েও তার অজানা থেকে যেতে পারতো, যদি না সে এ মুহুর্তে এদিকে আসতো! কিন্তু সত্যি তো কখনো চাপা পড়ে থাকে না৷ একদিন না একদিন ঠিক সবার সামনে এসে দাঁড়ায়।

রান্নাঘরে যাওয়ার পথে তামান্নার কানে তাদের কথোপকথন কিছুটা হলেও আসে। সেভাবে গ্রাহ্য করল না। হঠাৎ করে কানের সাথে এসে ধাক্কা খায় তামান্না নামটি! ” তামান্না তোমার মেয়ে না! ” কথাটা শোনার পর পর মনে হল বাবা তো এসময় বাসায় আসে না! আর আসলেও কখনো কারোর সাথে তাদের ব্যাপারে এভাবে কথা বলবে না! অতঃপর দাঁড়িয়ে পড়তে সবটা তামান্নার সামনে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।

নিরুপমা তামান্নার দিকে এগিয়ে আসে। কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়া তিনি জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে। তামান্না তাকে বাঁধা দেয় না। তিনি যদি সত্যিকারে তার মা হয়ে থাকে তাহলে তাকেও জানতে হবে সত্যিকার মায়ের ছোঁয়া ঠিক কেমন হয়! অন্যদের সাথে তাদের তফাৎ ঠিক কি! নিরুপমা তামান্নাকে জড়িয়ে ধরতে আবেগে তার গাল বেয়ে চোখের পানি ঝরে পড়ল।
.
.
ইতিমধ্যে সেখানে সাদিবও চলে এসেছে। সাদিব দেখল একজন অপরিচিত মহিলা তামান্নাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। উনার পরিচয় জানার আগ্রহ জন্মায় তার। কারণ মহিলা শুধুমাত্র জড়িয়ে ধরাতে সীমাবদ্ধ নেই, সাথে কান্নাও করছেন। মাঝখানে কিছু বলতে চেয়েও বলল না সে।

নিরুপমা জড়িয়ে ধরলেও তামান্না তাকে ধরেনি। নিরুপমা তামান্নার কপালে চুমু খেলেন।
” আমাকে ক্ষমা করে দিস মা! আমি সত্যি তোর মা হওয়ার যোগ্যতা রাখি না। ”

তামান্না তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, ” জানেন আমার এতোদিন মনে হতো পৃথিবীর সব মায়ের বোধহয় আমার ওপর এলার্জী আছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি এটা তাদের দোষ না, দোষটা আসলে আমার নিজের। জন্ম থেকেই এই অসুখটা নিয়ে আমি পৃথিবীতে এসেছি। নাহলে আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কেন! আপনি যখন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বাঁধা কেন দেইনি জানেন? ”

” কেন? ” নিরুপমা ছলছল নয়নে তাকিয়ে জানতে চাইলেন।

” কারণ আমি জানতে চেয়েছি এখানে ঠিক কতটা শান্তি খুঁজে পাবো! ”

তামান্নার কথায় নিরুপমা খুশি হয়। মেয়েকে তিনি ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন। এবার আর কেউ তাকে মেয়ের থেকে আলাদা করতে পারবে না। এবার তিনি তামান্নাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবেন। যেখানে থাকবে শুধু তারা মা মেয়ে দু’জন…

চলবে….

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]