#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৭
ভার্সিটির প্রবেশ করতেই আহিদের চোখে পরে সিনিয়র কিছু ছেলে মিলে একটা মেয়েকে র্যাগিং করছে।র্যাগিং বললে ভুল হবে। একে বলে একপ্রকার হ্যারেসমেন্ট।কারন ছেলেটা মেয়েটার গায়ের ওড়না হাতে পেচিয়ে নিয়ে তা ক্রমাগত টানছে।আর মেয়েটা কেঁদে কেঁদে ওর ওড়না ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছে ।এইসব র্যাগিং ট্যাগিং আহিদের একদম পছন্দ না।অকারনে কেন একটা মানুষকে এইভাবে হেনস্তা করবে? কি মজা পায় এরা।আহিদ এগিয়ে যায় সেখানে।মেয়েটা মাথা নিচু করে কাঁদছে।ফলে মেয়েটার চেহারা এখনও ভালোভাবে দেখেনি আহিদ।সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে আহিদ এইবার ওই ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলল,
‘ কি সমস্যা ভাইয়া’রা?মেয়েটাকে কেন শুধু শুধু আটকে রেখেছেন? আর ওর ওড়না এইভাবে টানছেন কেন?’
আহিদের মাঝখানে এসে ব্যাঘাত দেওয়ায় তারা বেশ খানিক বিরক্তবোধ করল।রাগি স্বরে বলে,
‘ এটা আমাদের ব্যাপার।তুমি তোমার কাজে যাও।’
আহিদ যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।আহিদ বেশ শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ নিজেদের ব্যাপার হলে নিজেরা বাড়ি গিয়ে স্যাটেল করবেন।এখানে ভার্সিটির মাঠে এসব করলে তো আর চুপ থাকা যায় না।’
‘ বেশি কথা বলছ তুমি ছেলে।’
রেগে গেল আহিদ।বলল,
‘ হ্যা বলছি।তো? কি করবেন?’
‘ নিজের ভালো চাইলে এখান থেকে কেটে পরো।’
‘ মেয়েটাকে যেতে দিন।’ আহিদ শক্ত গলায় বলল।
‘ তা তো সম্ভব না।এই মেয়েটাকে যা করতে বলেছি তা না করা পর্যন্ত একে ছাড়ব না।’
আহিদ এইবার ভয়া’নকভাবে রেগে গেল।রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ধুম করে একটা ঘুষি মেরে দেয় সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার মুখে।ছেলেটা ছিটকে গিয়ে পরল মাঠে।ওর সাথে দাঁড়ানো আরও তিনটে ছেলে দ্রুত ওই ছেলেটাকে টেনে তুলল।তারপর আহিদকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুব্ধ স্বরে বলে,
‘ তোর এতো বড়ো সাহস।তুই আমাদের বন্ধুর গায়ে হাত তুলিস।আজ তোকে ছাড়ছি না।’
ছেলেটা এসে আহিদকে মারতে নিলেই আহিদ সজোড়ে চ’ড় মারে ছেলেটার গালে।অন্য ছেলেরা তেড়ে আসতে গেলেই সেখানে হাজির হয় অথৈ,রিধি,পিহু আর প্রিয়ান।প্রিয়ান আর অথৈ এসে অন্য ছেলেদের মারতে এগিয়ে যায়।কিন্তু তার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় রুদ্রিক,ইহান,সাফাত,নীল,অনিক,মারিয়া,জেনি আর সিয়া।রুদ্রিককে দেখেই ওই বদমা’শ ছেলেগুলো ঘাবড়ে যায়।রুদ্রিক রক্তিম চোখে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ কি হয়েছে এখানে?’
ছেলেগুলোর মধ্যে যে লিডার সে এগিয়ে এসে বলে,
‘ কিছু না ভাই।আমরা জাস্ট এই মেয়েটাকে একটু র্যাগিং দিচ্ছিলাম।আর এই ছেলেটা এসে আমাদের কাজে বাধা প্রদান করে।এখন আপনিই বলুন ভাই।ভার্সিটিতে তো একটু আধটু এমন হয়েই থাকে তাই নাহ?’
আহিদ রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
‘ কুত্তার দল মিথ্যে বলছিস কেন?ভাই এরা এই মেয়েটার ওড়না টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো।আমি বাধা দিলেই আমাকে আগে মারতে আসে।আর তাই আমি ওদের মেরে’ছি।’
রুদ্রিক কড়া গলায় আহিদকে ধমকে উঠল,
‘ এটা কিভাবে করেছ তুমি?’
অথৈ ভ্রু-কোচকালো।আশ্চর্য লোক।সাহস কতো বড়ো ওর বন্ধুদের ধমকাচ্ছে।দেখে নিবে একে।মনে মনে কথাগুলো বলে রুদ্রিককে মুখ ভেংচি মারল।এদিকে আহিদ রুদ্রিকের এমন কথায় অবাক হয়ে বলল,
‘ মানে?কি বলছেন এসব?’
‘ দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’
রুদ্রিক দু ধাপ এগিয়ে গিয়ে ওই ছেলেটার সামনাসামনি দাঁড়ায়।তারপর খপ করে ছেলেটার হাত ধরে সজোডে মুচড়ে দেয়।ছেলেটা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে।রুদ্রিক ঘাড় ঘুরিয়ে আহিদের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে,
‘ মেয়েদের ইজ্জতের দিকে যে বাজেভাবে হাত বাড়ায়।তার হাত এইভাবে ভে’ঙে দিতে হয়।বুঝেছ?’
আহিদ চওড়া হেসে বলে,
‘ জি ভাই বুঝেছি।’
অথৈর মন ছোটো হয়ে গেল।ইস,লোকটাকে শুধু গালমন্দ করল।মনে মনে রুদ্রিককে সরি বলে দিল।রুদ্রিক ছেলেটার হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল।ছেলেটা হাতের ব্যথায় কাতরাচ্ছে।তারপর রক্তচক্ষু নিয়ে বাকি ছেলেদের দিকে তাকালো।ওই ছেলেগুলো রুদ্রিকের রাগি দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল।দ্রুত তাদের লিডারকে সাথে নিয়ে তৎক্ষনাত জায়গা ত্যাগ করল।
রুদ্রিকের কাজে বেশ খুশি হলো।তবে তা প্রকাশ করল না।রুদ্রিক অতি সন্তর্পণে অথৈয়ের পাশে দাঁড়ালো।এই সুযোগে অথৈ কণ্ঠ খাদে নামিয়ে দুষ্টুমির স্বরে বলে,
‘ আমাকে ইমপ্রেস করার জন্যে বুঝি এসব করলেন?’
রুদ্রিক প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে টান হয়ে দাঁড়ালো।দৃষ্টি সামনের দিকে রেখেই ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে হাসল।বলল,
‘ তোমাকে ইমপ্রেস করতে আমার এসব করা লাগবে না।রুদ্রিক তার বউকে স্পেশালভাবে ইমপ্রেস করতে জানে।ডিড ইউ আ্যন্ডর্স্টান্ড মাই ক্যাডেল বাগ।’
রুদ্রিকের মুখে বউ মুখে এমন কথা শুনে বেশ লজ্জা পেল অথৈ।’ক্যাডেল বাগ ‘ কথাটার মানে বুঝতে পেরেই অথৈ লজ্জায় নুইয়ে গেল।অথৈ নিজেও বুঝতে পারছে না।ইদানিং ওর এতো লজ্জা আসে কোথা থেকে?তাও শুধু রুদ্রিকের সামনেই ওর লজ্জা লাগে।এমন কেন হয়?
এদিকে রুদ্রিক অথৈয়ের লজ্জায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে যাওয়া মুখশ্রী দেখে তৃপ্তির হাসি দিল।প্রিয় মানুষটার লজ্জা পাওয়ার কারন হতে পেরে ভালোলাগায় হৃদয় জুড়িয়ে গেল।এদিকে অথৈ আর রুদ্রিককে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখেছে রিধি।ও অথৈয়ের লজ্জামাখা মুখটা দেখে নিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল।ওর এই ঘাড়ত্যাড়া,রাগি বান্ধবীটাও যে এইভাবে লজ্জা পেতে পারে জানা ছিলো না ওদের।রুদ্রিকের সংস্পর্শে এসে মেয়েটা কেমন নরম হয়ে যাচ্ছে।রিধি অথৈয়ের কানে কানে দুষ্টুমির স্বরে বলে,
‘ রুদ্রিক ভাইয়া কি এমন বলল যে তুই এইভাবে লজ্জায় লাল, নীল হচ্ছিস।আমাদেরকেও বল।’
রিধির এমন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অথৈ।নিজেকে সামলে নিয়ে মিথ্যে রাগ দেখানোর ভাণ ধরে বলে,
‘ চুপ থাক এমন কিছুই না।আমি লজ্জা পাচ্ছি না।’
‘ সেটা তো তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি জানেমন।’
হেসে দিলো অথ। বলল,
‘ চুপ কর না ইয়ার।উনি এখানে আছেন।শুনে ফেলবেন।’
‘ বাহ বাহ উনিইইইইই।’ লাস্ট ওয়ার্ডটা টেনে টেনে বলল রিধি।হেসে ফেলল অথৈ।অথৈকে এইভাবে হাসতে দেখে রুদ্রিক বলে উঠে,
‘ হাসছ যে?’
অথৈ আশেপাশে তাকিয়ে নরম স্বরে বলে,
‘ এমনি।’
রুদ্রিক আর কিছু বলবে তার আগেই নীল বলল ওদের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।এখন যেতে হবে ওদের।রুদ্রিক ছোট্টো স্বরে ‘ ওকে’ বলল।তারপর অথৈকে সরল গলায় বলল,
‘ কালকের ওখানেই আমি থাকব।যদি এসে আমায় না পাও তাহলে একটু অপেক্ষা করো।আমি আসব।’
‘ জি আচ্ছা।’
রুদ্রিক উলটো ঘুরে গেল।অথৈয়ের একদম গা ঘেষে যাওয়ার সময় অথৈয়ের কানে কানে বলে গেল,
‘ ইউ ন্যো ইয়্যু আর সো কিউট। সো ইয়্যু ডিজার্ব অ্যা বিলিয়নস্ ওফ কিসেস্ ফ্রোম মি।’
কথাটা শেষ করে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল রুদ্রিক আর ওর বাকি বন্ধুরাও।এদিকে রুদ্রিকের শেষের বলা বাক্যে শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলো অথৈ।রুদ্রিকের বলা প্রতিটা শব্দ যেন এখনও ওর কানে বাজছে।দ্রিম দ্রিম করে সজোড়ে বিট করছে হৃৎপিণ্ডটা।শরীরটাও কাঁপছে।সেই সাথে যেন শরীরের প্রতিটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছে রুদ্রিকের ওই ফিসফিসানো আওয়াজে।কারো ফিসফিস করে বলা কথাটাতেও এতোটা মাদকতা থাকে জানা ছিলো না অথৈয়ের।রুদ্রিকের বলা বাক্যটা অথৈকে ভয়ানক লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে দিল।রুদ্রিক আঁড়চোখে পিছনে ফিরে তাকালো।রুদ্রিকও একই সময়ে তাকিয়েছে।অথৈকে ওর দিকে তাকাতে দেখে বাঁকা হেসে চোখ মেরে দিল।এরপর চলে গেল।অথৈ দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে নিল বিরবির করল,
‘ এ কোন চরম অস’ভ্য এক লোকের খপ্পরে পরে গিয়েছি আমি।’
কান্নারত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে আহিদ।কেন যে ওই ক্রোদনরত লাল হয়ে যাওয়া ছোটো খাটো বাচ্চা চেহারাটা দেখতে ওর ভালো লাগছে।মেয়েটার চেহারায় যেন এক আকাশসম মায়া উপচে পরছে।আহিদের কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে।আহিফ ধীর পায়ে মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেল।নরম গলায় বলল,
‘ তুমি ঠিক আছ?’
আহিদের প্রশ্নে মেয়েটা নড়ে উঠল যেন।দু হাতে চোখ মুছে নিল।তারপর ভেজা কণ্ঠে বলে,
‘ হুঁ!’
‘ নাম কি তোমার?’ আহিদের সোজাসাপ্টা প্রশ্নে মেয়েটা ঘাবড়ে গেল একটু বোধহয়।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘ মাইশা জেরিন।’
‘ নামটা সুন্দর।এখন বলো কোন ডিপার্টমেন্ট? ‘
‘ ডিপার্টমেন্ট ওফ ম্যানেজমেন্ট ফার্স্ট ইয়ার।’
মাইশার মুখে এই কথা শুনে আহিদ বলে,
‘ ওহ তারমানে আমরা একই ক্লাসের।শুধু ডিপার্টমেন্ট আলাদা।’
অবাক হলো মাইশা।বলল,
‘ আপনিও ফার্স্ট ইয়ার?’
ভ্রু-কুচকালো আহিদ।
‘ হ্যা কোনো সমস্যা?’
ভয় পেলো মাইশা।বলে,
‘ ন..না সমস্যা হবে কেন।’
আসলে মাইশার বিশ্বাস হচ্ছে না।এমন লম্বা-চওড়া সুদর্শন দেখতে ছেলেটা ওর সাথেই পড়ে।মানে একই ক্লাস।ও তো ভেবে নিয়েছিল ছেলেটা বোধহয় থার্ড ইয়ার বা ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।নিজের ভাবনায় নিজেই বোকা বনে গেল মাইশা।মাইশার ধ্যান ভঙ হয় আহিদের গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠে,
‘ মেয়ে মানুষ হয়েছ বলে যে নিজেকে সবার কাছে দূর্বল প্রমান করবে এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা।মেয়েরা চাইলেই সব করতে পারে।এইযে একটু আগে তোমার সাথে যা হলো তুমি চাইলেই প্রতিবাদ করতে পারতে।থা’পড়িয়ে গাল লাল করে দিতে পারতে।কিন্তু তুমি তা করোনি।শুধু তোমার মনে এই কথাটা বাদা বেধেছে যে তুমি মেয়ে তুমি দূর্বল।এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।পরিস্থিতি দেখে নিজেকে প্রেজেন্ট করার চেষ্টা করো।নিজেকে ভীতু নয় সাহসী করে তোলো।দেখবে লাইফটা কতো সুন্দর হয়ে গিয়েছে তোমার।’
মাইশার মনে আহিদের বলা প্রতিটা কথা গভীরভাবে দাগ কাটল।মুগ্ধ হয়ে শুনল আহিদের কথা।আহিদ ফের বল,
‘ বুঝতে পেরেছ আমি কি বলেছি?’
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে মাইশা বলে,
‘ জি বুঝেছি।ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে আমাকে বোঝানোর জন্যে।’
‘ হুম ভালো।এখন যাও নিজের ক্লাসে।’
মাইশা আহিদের কথায় ক্লাসে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো।কি মনে করে যেন আবার পিছনে ফিরে তাকালো।আহিদকে উদ্দেশ্য বলল,
‘ ধন্যবাদ আপনাকে। আমাকে প্রোটেক্ট করার জন্যে।’
তারপর পিছনে দাঁড়ানো অথৈ,রিধি,পিহু,প্রিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ আপনাদেরকেও ধন্যবাদ আমার বিপদে এগিয়ে আসার জন্যে।আর হ্যা ওইযে ভাইয়াগুলো আসল না? তাদেরকেও আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয় দিবেন। আসি তাহলে।আল্লাহ্ হাফেজ।’
মাইশা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল।আর মাইশার সেই হাসিটা যেন আহিদের ঠিক বুকে গিয়ে লাগল।মন আটকে গেল সেই হাসিতে।এখন আদৌ কি এই মেয়ের মিষ্টি হাসির মায়াজাল থেকে বের হতে পারবে ও?
#চলবে___________
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৮
নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে।হলদেটে সূর্যটা তার প্রখর তেজে যেন ঝল’সে দিচ্ছে সব।গরমের মাঝে একটু সস্তি দেওয়ার জন্যে বোধহয় এই নির্মল বাতাস বয়ে চলেছে।মন প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো।ঘাসের উপর বসে দু হাটু ভাজ করে তাতে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে অথৈ।অনুভব করছে সে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা।রুদ্রিকের জন্যে এই জায়গাটা চিনতে পেরেছে ও।রুদ্রিক ওকে এখানের ঠিকানা না দিলে ও এই সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করতে পারত নাহ।মনে মনে রুদ্রিককে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো।ভাবনায় রুদ্রিক আসতেই চোখ মেলে তাকালো অথৈ।বাম হাতটা চোখের সামনে এনে হাত ঘড়িটায় সময় দেখে নিলো।ক্লাস শেষ করে এখানে এসে রুদ্রিকের জন্যে অথৈ বসে বসে অপেক্ষা করছে।প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে আসল।লোকটার কোনো খবর নেই।কোথায় গিয়েছে সে? এইভাবে অথৈকে অপেক্ষা করার মতো তিক্ত অনুভূতির মাঝে ফেলে দিয়ে কি মজা পাচ্ছে লোকটা?অপেক্ষা জিনিসটা অথৈ একদম পছন্দ করে না।কারন বরাবরের মতোই অথৈয়ের ধৈর্য খুব কম।কিন্তু আজ যে ও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে পেরেছে সেটা দেখে ও নিজেই অবাক।একমাত্র রুদ্রিকের কারনেই এই অসাধ্য সাধণ করতে সক্ষম হয়েছে ও।কিন্তু এখন যে আর ভালো লাগছে না অপেক্ষা করতে।অন্য সময় হলে অথৈ রেগেমেগে চলে যেত।কিন্তু আজ যাচ্ছে না।কারন রুদ্রিক তো ওকে প্রমিস করেছে লোকটা আসবে।অথৈ আবারও অপেক্ষা শেষ হওয়ার প্রহর গুনতে লাগল।মনমরা হয়ে ছোটো ছোটো ইট আর মাটির কণা উঠিয়ে নদীর স্বচ্ছ পানিতে ঢিল ছুড়তে লাগল।একটা সময় আনমনা হয়ে গেল অথৈ।কিয়ৎক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হতেই হঠাৎ নিজের অতি নিকটে কারো উপস্থিতি অনুভব করল অথৈ।নাকে সেই চেনা পুরুষালি পারফিউমের ঘ্রাণ এসে লাগছে।যেটা সেই মানুষটার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।তবে মনে ক্ষুদ্র অভিমান জন্মেছে অথৈয়ের। এইভাবে আধাঘন্টা অপেক্ষা করানোর কোনো মানে আছে?একটা টেক্সট ও তো করতে পারত ওকে।অভিমানি অথৈ রুদ্রিকের উপস্থিতি বুঝেও ফিরেও তাকালো না ওর দিকে।তার দৃষ্টি সোজা অটল নদীর ঢেউয়ের দিকে।এদিকে অর্ধাঙ্গিনীর অভিমান বুঝতে পেরে মুচঁকি হাসল রুদ্রিক।বড্ড দেরি করে ফেলেছে আজ ও।মেয়েটা হয়তো অনেকক্ষণ যাবত ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল।তাই তো অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।রুদ্রিক নরম কণ্ঠে সুধাল,
‘ মাই বাটারফ্লাই আর ইউ এ্যাংরি উইথ মি?’
রুদ্রিকের মুখে নিজের জন্যে আখ্যায়িত করা এক একটা নতুন নতুন আদুরে ডাকগুলো অথৈয়ের বুকে তীব্রভাবে ঝড় তুলে দেয়।এতো ভালো কেন লাগে?এইযে ‘ মাই বাটারফ্লাই ‘ বলে ডাকল।এই ডাকে কি অথৈ অভিমান ধরে পারে? লোকটার কণ্ঠে এতো মাদকতা যে অথৈ সেই কণ্ঠের নেশায় পরে যায়।কিন্তু অথৈ সহজে গলে যেতে চায় নাহ।একটু,অল্প একটু নাহয় অভিমান করে থাকল।সে দেখতে চায় লোকটা কিভাবে তার অভিমান ভাঙায়।অভিমানের পাহাড় ধ্ব’সে পরেছে তো সেই কখনই।তবুও অথৈ মিথ্যে রাগ দেখিয়ে রুদ্রিকের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুরে গেল।অথৈয়ের এমন বাচ্চামো দেখে হেসে ফেলল রুদ্রিক।হাটু গেড়ে ঘাসের উপর বসে অথৈয়ের কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেল।এদিকে নিজের অধিক সন্নিকটে রুদ্রিকের উপস্থিতি বুঝতে পেরে গলা শুকিয়ে আসল অথৈয়ের।রুদ্রিক আরেকটু কাছে আসল।মুখ নামিয়ে আনল অথৈয়ের কানের কাছে।রুদ্রিকের তপ্ত নিশ্বাসের ছোঁয়া অথৈয়ের ঘাড়ে এসে লাগতেই তীব্র শিহরণ বয়ে যায় ওর সারা শরীরে,প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে।অথৈয়ের ছোট্টো দেহখানি মৃদ্যুভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে।রুদ্রিক অথৈয়ের কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
‘ অভিমানির অভিমান ভাঙাতে এখন এই অপরাধি কি করতে পারে বলুন?মহারানি যা হুকুম করবেন।তা আমার শীরোধার্য।’
রুদ্রিকের এহেন কণ্ঠে বলা প্রতিটি বাক্যে অথৈয়ের দেহ,মন চনমনিয়ে উঠল।দ্রুত সরে গেল সে।আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে যে তার মৃ’ত্যু নিশ্চিত।নিশ্বাস আটকে মা’রা যাবে সে।অথৈ উঠে দাঁড়াল।বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিল।উফ,বুকের বা-পাশটায় যে কি জোড়ে জোড়ে ধুকপুক করছে।রুদ্রিক অথৈকে সরে যেতে দেখে নিজেও উঠে দাঁড়াল।বড় বড় পা ফেলে একেবারে সম্মুখে এসে দাঁড়াল অথৈয়ের।আকস্মিক রুদ্রিক অথৈয়ের এতো সামনে আসায় ভড়কালো অথৈ।মনে মনে পালানোর পায়তারা খুজতে লাগল। রুদ্রিক বোধহয় বুঝল অথৈয়ের মনোভাব।ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে হাসল ও।বলল,
‘ পালাতে চাচ্ছ বুঝি আমার থেকে?’
চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল অথৈ।এই লোক বুঝল কিভাবে? ও কি মনে মনে কথা বললেও কি অনেক জোড়ে বলে?যে লোকটা শুনে ফেলল? অথৈ আমতা আমতা করে বলে,
‘ পালাবো কেন আমি আশ্চর্য?’
‘ সেটা তো তুমি ভালো জানো।’
‘ আমি কিছু জানি না!’
‘ তাই বুঝি?’
‘ হ্যাঁ!’
‘ তা আমাকে জানো তো?’
‘ হ্যাঁ! না.. মানে?’ অথৈ থতমত খেয়ে গেল রুদ্রিকের এমন প্রশ্নে।তাই জবাব দেওয়ার সময় এইভাবে আটকে গেল।রুদ্রিক ভরাট স্বরে বলল,
‘তুমি তো বললে তুমি কিছু জানো না।তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম।আমাকে জানো তো?’
চোখ পিট পিট করে তাকালো অথৈ।এই লোকটা কি তার মজা নিচ্ছে? ভ্রু-কুচকে অথৈ বলে,
‘ আপনি কি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন?আপনাকে জানবো না কেন? আজব লোক আর তার আজব প্রশ্ন।’
‘ তো বলো আমি কে?’ রুদ্রিকের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।
অথৈ ঘাবড়ালো না।বিচলিতও হলো না একটুও।রুদ্রিকের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ আমার স্বামী আপনি।’
এই একটা বাক্যে রুদ্রিকের দুনিয়া রঙিন হয়ে উঠল।মেয়েটা কি অকপটে বলে ফেলল কথাটা।কোনো প্রকার জড়তা নেই কণ্ঠে।এদিকে তার বলা এই একটা বাক্যে যে রুদ্রিকের হৃদয়ে তোলপাড় হচ্ছে।ইচ্ছে করছে মেয়েটা বুকের মধ্যে ঝাপ্টে ধরতে।ওর শক্তপোক্ত,প্রসস্ত বুকটার মাঝে মেয়েটার ওই ছোট্টো, নরম দেহটা নিয়ে একদম বুকের সাথে পি’ষে ফেলতে।অথৈকে যদি রুদ্রিক গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাহলে কি মেয়েটা রাগ করবে?কথা বলা বন্ধ করে দিবে?মনের এই তীব্র বাসনা কোনোমতেই দমাতে পারছে না রুদ্রিক।আচমকা দু ধাপ এগিয়ে গেল অথৈয়ের দিকে।অথৈ এইবার পিছালো না।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল রুদ্রিকের দিকে।রুদ্রিক অস্থির গলায় বলল,
‘ অথৈ তুমি কি রাগ করবে?আমি যদি তোমায় জড়িয়ে ধরি?বিশ্বাস করো।নিজের এই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে পারছি না।আ’ম ফিলিং সো হ্যেল্পল্যাস অথৈ।তোমাকে বুকে নেওয়ার জন্যে আমি অস্থির হয়ে আছি।তুমি কি বুঝতে পারছ?’
অথৈ জমে গেল যেন রুদ্রিকের এহেন কথায়।কি সুন্দর করে তার কাছে আবদার করে বসল লোকটা।লোকটা এমন কেন?এইভাবে অনুমতি চাইলেই কি সে অনুমতি দিতে পারে?লজ্জা করে না ওর?কণ্ঠে কথাগুলো যে দলা পাকিয়ে জড়িয়ে আসে।বলতে পারে না ও কিছু।অথৈয়ের কোনো ভাবভঙী না দেখে।রুদ্রিক মুখটা কালো হয়ে গেল।হৃদয়ে মাঝে এসে উপস্থিত হলো মন খারাপের দল।রুদ্রিক উলটো দিকে ঘুরে গিয়ে বলে,
‘ ইট্স ওকে অথৈ। নিজেকে জোড় করতে হবে না।আমি বুঝে নিয়েছি।আমিই একটু বেশি এক্সপেক্ট করছিলাম।’
রুদ্রিক পা বাড়াতে নিলে পিছন থেকে শার্টে টান অনুভব করল রুদ্রিক।থেমে যায় কদম।সোজা হয়ে অথৈয়ের মুখোমুখি হলো ও।অথৈ করুন চাহনী ছুড়ে দিলো ওর দিকে।যার মানে এটাই দাঁড়ায় যে, ‘ আপনি এতো বেশি বুঝেন কেন?আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন।আমার মন কি বলছে।’
রুদ্রিক ওই চোখের দিকে ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে রইল।যা বোঝার বুঝে ফেলল।হাসি ফুঁটে উঠল ওর ঠোঁটে। সেই হাসিতে অথৈ নিজেকে হারিয়ে ফেলল।কি সুন্দর লোকটার হাসি।কেউ কিভাবে এতো সুন্দর করে হাসে?এইযে লোকটার হাসিতে যে অথৈয়ের বুকে ব্য’থা করছে।সুখময় মিষ্টি ব্য’থা।সেই ব্য’থা অথৈ আজীবন বয়ে বেড়াতে সর্বদা প্রস্তুত।
রুদ্রিক দু কদম পিছনে নিয়ে নিল।হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত করে নিলো।অথৈয়ের হৃদয়ের এলোমেলো অনুভূতিদের নাড়িয়ে দিয়ে অত্যন্ত আকুলতা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ বুকে আসো অথৈ।’
অথৈ কাঁধের ব্যাগটা ফেলে দিয়ে প্রায় একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে রুদ্রিকের প্রসস্ত বুকে নিজের ছোট্টো শরীরটা নিয়ে আছঁড়ে পরল।বুকের মাঝে অথৈয়ের নরম দেহটাকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।পারলে এক্ষুণি এই মেয়েটাকে নিজের বুকের ভীতর ঢুকিয়ে ফেলে।রুদ্রিক ভেবে পায় না।কি এমন আছে এই মেয়েটার মাঝে? যার কাছে আসলেই রুদ্রিক তার গম্ভীর্যতা ধরে রাখতে পারে নাহ?তার চারপাশ রঙিন হয়ে যায়।নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়।ঠোঁট থেকে যেন হাসিরা সরতেই চায়না।নিজের শক্ত সত্তাটাকে এই মেয়েটার সামনে ধরে রাখতেই পারে না।আর সবার সামনে যে গম্ভীর,রাগি,একরোখা,জেদি হলেও।এই মেয়েটার কাছে সে দূর্বল।রাগ যেন আসেই না মেয়েটা কাছে থাকলে।ওর আকুলতা,ব্যাকুলতা এই মেয়েটার সামনেই সে অনায়াসে ব্যক্ত করে ফেলে।ভালোবাসায় বুঝি মানুষকে এতোটাই পরিবর্তন করে দিতে পারে?অথৈকে নিজের সাথে আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো রুদ্রিক।ছাড়তে চায়না সে অথৈকে।ঠিক এইভাবে সারাজীবন নিজের বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।
এদিকে রুদ্রিকের বক্ষে লেপ্টে থাকা অথৈ থরথর করে কাঁপছে।দুহাতে খামছে ধরে আছে রুদ্রিকের পিঠ।এই প্রথম সে আর রুদ্রিক এতোটা কাছাকাছি।একে-অপরের মাঝে দুজন হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের।রুদ্রিকে দেহের সংস্পর্শে যেন অথৈ বিড়াল ছানার ন্যায় আদূরে ভঙিতে গুটিয়ে গিয়েছে।রুদ্রিকের বক্ষে আরও ভালোভাবে মুখ গুজে দিল অথৈ। পৃথিবীর চির শান্তি স্থান যেন এটাই তার কাছে। সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে ওর মাঝে।অথৈ নিজের এক একটা ব্যবহারে নিজেই ক্ষণেক্ষণে অবাক হয়।ও তো এতো নরম স্বভাবের মেয়ে নাহ।তাহলে কেন এই মানুষটার সামনে আসলেই এভাবে নরম হয়ে যায়।আদুরে,আহ্লাদী হয়ে যেতে মন চায়।মনে হয় এই মানুষটার কাছে সে বিনাদ্বিধায় নিজের আহ্লাদগুলো ব্যক্ত করতে পারবে।আদূরে বাচ্চাদের মতো এটা সেটা বায়না করতে পারবে।তবে কি সেই মাত্র এই দুইদিনের একান্ত সাক্ষাতের মুহূর্তগুলোতেই প্রেমে পরে গেল লোকটার?আচ্ছা প্রেমে পরা কি এতোই সহজ?কাউকে মাত্র দুদিনের মধ্যে নিজের মনের বিশাল জায়গাটায় বসানো এতোই সহজ?কি জানি।কিছু আপাততো জানে না অথৈ। সে এই মুহূর্তে জানতেও চায়না।শুধু উপভোগ করতে চায় এই সময়টুক।আর প্রেমে পরলে পরেছে সে।তাতে কি হয়েছে?নিজের স্বামীর প্রেমেই পরেছে।আর ভাবল না অথৈ।লেপ্টে রইল রুদ্রিকের মাঝে।সময়টুকু এখানেই থেমে যাক না।ভালোই তো লাগছে।ক্ষতি কি এতে?উহু, কোনো ক্ষতি নেই।
#চলবে____________
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৯
ভ্যাবসা গরমে প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে আছে।একটু বাতাসের ছিটেফোটাও নেই যেন কোথাও।আকাশে সূর্য্যিমামাটা যেন ক্ষণে ক্ষণে তার প্রখরতা বাড়িয়েই চলেছে।কপালে হাত দিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো রিধি।কিন্তু রোদের তেজে পারল না।দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।গরমে তার অবস্থা কাহিল।বাসা থেকে বের হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সে কিন্তু একটা রিকশা বা সিএনজি কিছুই পায়নি।তাই উপায় না পেয়ে রাস্তায় হাটতে শুরু করে দিয়েছে সে।নাহলে যে দেরি হয়ে যাবে।বন্ধুরা বোধহয় এতোক্ষণে গন্তব্যে পৌছে গিয়েছে।শুধু ওই লেইট করছে বোধহয়।রিধি ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পরল।এই রোধের মাঝে আর হাটতে ইচ্ছে করছে নাহ।বিরক্ত হয়ে রিধি বলে,
‘ উফ,অসহ্য।এতো গরম আর ভালো লাগে না।’
পানির তৃষ্ণাও পেয়েছে।পাশেই একটা দোকান দেখতে পেল।রিধি সেদিকে এগিয়ে গেল।পানি না খেলে চলছেই না।রিধি দোকানে গিয়ে এক বোতল পানি কিনে নিল।তারপর দোকানের বাহিরে ছাউনিতে দাঁড়িয়ে ঢকঢক করে অনেকটা পানি পান করে নিল।হ্যা,এখন একটু শান্তি লাগছে।পার্স থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘামটুকু মুছে নিল রিধি।আর বার বার রাস্তার এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।আজ মনে হয় সব রিকশা আর সিএনজি ওয়ালারা পণ করেছে।রিধি যেখানে আছে সেখানে ওরা কিছুতেই আসবে না।কি করবে এখন রিধি?এতোদূর অব্দি তো হেটে যাওয়ায় সম্ভব নাহ।এমন সময় মোবাইল ফোনটা সজোড়ে বেজে উঠল।দেখে প্রিয়ান কল করেছে।রিধি দ্রুত রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রিয়ানের কণ্ঠ ভেসে আসল,
‘ওই ছেরি! কই তুই?এতোক্ষণ লাগে তোর আসতে?কতোক্ষণ ধরে বসে আছি।সামনে এতো এতো খাবারের আইটেম চাইলেও খাইতে পারতাছি না তোর জন্যে।জলদি আয়।’
রিধি কাঁদো মুখ করে বলে উঠল,
‘ আমার কি দোষ?আমি তো আসতে চাইছি।কিন্তু একটা রিকশা বা সিএনজি কিছুই পাচ্ছি না।হেটে হেটে এতোদূর অব্দি যাওয়া পসিবল নাকি?’
প্রিয়ান যেন তেতে উঠল রিধির কথায়।বলল,
‘ পাকনামি করছস ক্যান?আগেই কইছিলাম না আমি তোরে নিতে আসুম নেহ।তুই তোর ওই হিটলার বাপের ভয়ে আমারে মানা কইরা দিলি।ওই ছেরি আমি তোর ওই পুলিশ বাপরে ভয় পাই? এহন আয় একলা একলা হাইট্টা হাইট্টাই আসবি।হিটলার বাপের বলদা মাইয়া।’
রিধি প্রিয়ানের কথায় রেগে উঠল।চেঁচিয়ে বলে,
‘ ওই তুই কথায় কথায় আমার বাবাকে টানিস কেন?আর একদম আমার বাবাকে হিটলার বলবি না।’
‘ আমি তো একশবার বলমু।’
‘ প্রিয়ানের বাচ্চা শুধু একবার আমি আসি।তোর হাড্ডি একটাও আস্ত রাখমু নাহ।’
‘ আমি অপেক্ষায়।আগে তো আইসা নেহ।তুই আসতে আসতে দেখবি।আমাগো পিকনিক শেষ।আর তোর ভাগের খাবার সব আমার পেটের মধ্যে।’
প্রিয়ান কথাগুলো বলে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল।রেগে মেগে রিধি কল কেটে দিল।পরক্ষণে রাস্তার দিকে তাকাতে আবারও ওর মুখশ্রী কাঁদো কাঁদো হয়ে আসল। কি করব সে? হঠাৎ রিধি পাশে কারো উপস্থিতি টের পেল।মানুষটার শরীরের ঘ্রাণ ওর খুব চেনা।কিন্তু এই লোক এখানে কিভাবে আসবে? রিধি পাশ ফিরে তাকাল।তাকাতেই ইহানের ফর্সা সুন্দর মুখশ্রীটা চক্ষুগোচর হলো।তাকিয়েই রইল রিধি।কি সুন্দর লাগছে মানুষটাকে।ব্লু শার্ট, ব্লাক ডেনিম প্যান্টটা যেন ইহানের ফর্সা শরীরে একদম ফুটে উঠেছে।লোকটার দিকে একবার তাকালে রিধির ঘোর লেগে যায়।চোখ ফিরাতেই ইচ্ছে করে না।মন চায় লোকটাকে আজীবন ওর সামনে বসিয়ে রাখতে।আর ও প্রাণভরে দেখবে।রিধির ভাবনা ভঙ হয় ইহানের ডাকে,
‘ কোথায় যাচ্ছিলে?’
‘ হ..হুঁ!’
‘ কোথায়?’
রিধি দৃষ্টি সরিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়াল।ইস,কিভাবে ড্যাবড্যাব করে লোকটার দিকে তাকিয়েছিল ও।মানুষটা মনে মনে ওকে কি ভাবছে কে জানে।ইহান রিধির জবাব না পেয়ে ফের বলে,
‘ বলছি তোমাদের পিকনিক স্পটটা কোথায়?ঠিকানা দেও।’
ইহানের কথা ঠাওর করতে পারল না রিধি।ভাবুক গলায় বলে,
‘ মানে?সেটা জেনে আপনি কি করবেন?’
ইহান রাশভারি স্বরে বলে,
‘ কতোক্ষণ যাবত তো দেখছি এখানে দাঁড়িয়ে আছ রিকশা অথবা সিএনজির জন্যে।কিন্তু এখন এই টাইমে এগুলা পাওয়া খুব দুষ্কর।তাই বেহেরবানি করে আমাকে ঠিকানা দিন আমি আপনাকে পৌছে দিচ্ছি।অথৈ আমাকে শুধু বলেছে তোমরা নাকি পিকনিক করবে।তবে ঠিকানা বলে নি।এখন তাড়াতাড়ি বলো।’
ইহান ওকে পৌছে দিবে?ও কি সত্যি শুনছে।ওর কতোকালের স্বপ্ন ছিল ও ইহানের বাইকে বসবে।ইহান বাইক চালাবে। আর রিধি মুগ্ধ হয়ে ইহানকে দেখবে।খুশিতে রিধির চোখজোড়া জ্বলজ্বল করতে লাগল।উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
‘ সত্যি বলছেন আমায় পৌছে দিবেন আপনি?’
‘ নাহ মিথ্যে বলছি আমি।’
এই বলে ইহান হেটে গিয়ে বাইকে উঠে বসল।তারপর গম্ভীর স্বরে বলে,’ দ্রুত আস।আমার আরও কাজ আছে।’
রিধি দ্রুত পায়ে এসে ইহানের বাইকে উঠে বসল।ইস,মনটা খুশিতে তাথৈ তাথৈ করে নাচছে।কিন্তু এখন কি করবে?ইহানের কাধে কি হাত রাখবে?লোকটা যদি পছন্দ না করে?যদি ধমকে উঠে ওকে?ইহান বাইক স্টার্ট দিলে রিধি বাইকের পিছনের অংশটা চেপে ধরল।ইহান ভরাট কণ্ঠস্বরে বলে,
‘ আমায় ধরছ না কেন?বাইক থেকে উলটে পরে হাত পা ভাঙার নিয়ত আছে নাকি তোমার?আমার কাধ শক্ত করে ধরো।’
ইহানের পেয়ে রিধি খুশিতে আত্মহারা।দ্রুত ইহানের কাধের অংশ শক্ত করে ধরল।সাথে সাথেই যেন শরীরটা ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল।লোকটাকে একটুখানি স্পর্শ করতেই যেন মনে হলো ওর শরীরের কারেন্টের শক লেগেছে।অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে মনে।সহ্য করতে না পের রিধি পরনের জামা খামছে ধরল।এদিকে ইহান বাইক চালানোর ফাঁকে ফাঁকে ফ্রন্ট মিরোরে বারবার রিধির দিকে তাকাচ্ছে।তাকাতে চাইছে না ইহান।তাও কেন যেন চোখ চলে যাচ্ছে।কাঁচা হলুদ রঙের গাউন পরেছে রিধি।ওর ফর্সা শরীরে বেশ মানিয়েছে সেটা।ইহানের চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে একদম।চুলগুলো বেনি করে একসাইডে এনে রেখেছে।কিছু ছোটো ছোটো চুল কপালে, গালে এসে পরেছে।যা বাতাসের দাপাটো উড়াউড়ি করছে।গরমে ঘার্মাক্ত মুখশ্রীটা যেন আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে।ইহানের বুকের ভীতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল।দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।নিজের বেহায়াপনায় হতভম্ভ সে।কি করছিল সে?এইভাবে রিধি দিকে তাকিয়ে কেন ছিল সে?বুকের বাপাশের তীব্র স্পন্দন যেন ক্ষণে ক্ষণে বাড়তেই আছে।নাম না জানা অনুভূতিরা যেন আঁকড়ে ধরছে ওকে ক্রমাগত।ইহান আর একবারও তাকালো না রিধির দিকে।এই মেয়ের দিকে একবার তাকিয়েই এই অবস্থা।তাহলে আবার তাকালে নিশ্চয়ই সে হার্ট এট্যা’ক করবে।ইহান হিসাব মেলাতে পারছে না।রিধিকে তো সেই ছোটোবেলা থেকেই সে দেখে আসছে।কই আগে তো কখনও এরকম অনুভূতি হয়নি।তবে আজ কেন এমন লাগছে?তবে কি ওর দৃষ্টিভঙি বদলেছে?আজ কি মেয়েটার দিকে একটু অন্য নজরে তাকিয়েছে বলেই এমন হচ্ছে?নাহ,ইহান আর এমন কিছু করবে না।এভাবে হয় না।বোনের বান্ধবীর দিকে এইভাবে তাকানো ঠিক না।শেষে রিধি তাকে নির্ল’জ্জ না ভেবে বসে।
দুজন মানুষ দুই বিপরীত ধরনের ভাবনা মাথায় নিয়ে সম্পূর্ণ পথ শেষ করল।ইহান বাইক থামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
‘ নামো এসে পরেছি।’
রিধি নেমে দাঁড়ালো।অবশ্য তার নামতে ইচ্ছে করছিল না।মন চাচ্ছিল এইভাবে ইহানের সাথে বসে গন্তব্যহীন ঘুরে বেড়াতে।এই পথ এতো তাড়াতাড়ি শেষ কেন হলো?আরেকটু দীর্ঘ হলে তো রিধি আরেকটু সময় ইহানের সাথে থাকতে পারত।দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিধি। মনের ভাবনা মনে রেখেই ধীর আওয়াজে বলল,
‘ ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ ইট্স ওকে।এটা আমার দায়িত্ব।বোনের বান্ধবীকে চোখের সামনে বিপদে পড়তে দেখে এগিয়ে আসব এটা স্বাভাবিক।’
ইহানের কথায় বুক ভার হয়ে আসল রিধির।কেন যেন কষ্ট লাগল ইহানের কথায়।ওকে কি ইহান সবসময় বোনের বান্ধবী নজরেই দেখবে?কি হয় একটু অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকালে?একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুক না লোকটা।তার চোখে লোকটার জন্যে আকাশসম ভালোবাসা আছে।সেটা কি একবারও চোখে পরে নাহ লোকটার?এতো নিষ্ঠুর কেন সে? আর কেনই বা রিধি এই নিষ্ঠুর মানুষটাকে মন দিয়ে বসল?যে ওকে একটুও বুঝে না।ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন?কেন এতো যন্ত্রনা? রিধির কষ্টে চোখে জল চলে আসল।কিন্তু তা চোখের কোটর হতে গড়িয়ে পরতে দিল না রিধি।দ্রুত নিজেকে সামলে নিল।ধরা গলায় বলল,
‘ জি তারপরেও আপনি ধন্যবাদের প্রাপ্য।তাই আপনাকে ধন্যবাদ জানালাম।’
একটু থামে রিধি ভদ্রতার খাতিরে বলল,
‘ আপনি চাইলে আমাদের সাথে জয়েন করতে পারেন।’
সরাসরি নাকচ করল ইহান,
‘ নাহ।তোমাদের বন্ধুদের মাঝে আমি যেয়ে কি করব?উলটো তোমরা আরও অসস্থিতে পরে যাবে।আর তাছাড়া আমার ইম্পোর্ট্যান্ট একটা কাজ আছে।এখন আসি।দেরি হয়ে যাচ্ছে।বাই।’
রিধিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না ইহান।বাইক স্টার্ট দিয়ে দ্রুততার সাথে চলে গেল।ইহানের যাওয়ার পথের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইল রিধি।এতোক্ষণ সামলে রাখা চোখের জলগুলো গড়িয়ে পরল গাল বেয়ে।ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ এতো নিষ্ঠুর কেন তুমি?কেন বুঝোনা আমার মনের কথা।একবার #মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না। তাহলেই না বুঝবে ঠিক কতোটা ভালোবাসি তোমায়।’
আফসোস! ঠিক এই কথাগুলো ইহানের সামনে বলার সাহস রিধি করে উঠতে পারে না।যদি পারত তাহলে এক তরফা ভালোবেসে এইভাবে তিলে তিলে কষ্ট পেতো নাহ।
দূর থেকে পিহুর কণ্ঠস্বর কানে আসতে দ্রুত চোখ মুছে নিল রিধি।বার কয়েক জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলল।বুকের যন্ত্রনা গুলোকে ধামাচাপা দিয়ে দিল।তারপর হাসিমুখে এগিয়ে গেল বন্ধুদের দিকে।
_______________
গোল হয়ে বসে আছে পাঁচ বন্ধু।অথৈ,রিধি,পিহু,প্রিয়ান আর আহিদ।অথৈয়ের হাতে একটা আপেল।যেটাতে সে বড়ো বড়ো কামড় বসিয়ে কচকচ করে খাচ্ছে।আর একবার প্রিয়ানের দিকে তো একবার পিহুর দিকে তাকাচ্ছে ভ্রু-কুচকে। আর ওকে ভ্রু-কুচকে দেখছে রিধি আর আহিদ।অথৈয়ের ভাবভঙি বুঝতে পারছে না তারা।এদিকে পিহু আর প্রিয়ান যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসেছে।পন করে নিয়েছে তারা যেন আর কোনোদিন কথাই বলবে না।কথা বললেই যেন তাদের স্যু’ট করে দেওয়া হবে।আহিদ অথৈয়ের কান্ড বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ সেই কখন থেকে এমন করে আছিস।সমস্যা কি তোর?এমন করছিস কেন?’
রিধিও তাল মেলালো আহিদের কথায়।বলল,
‘ হ্যা অথৈ।কি হয়েছে বলবি তো?আর হঠাৎ এই পিকনিকের প্ল্যান কেন করলি তুই?’
অথৈ এইবার নড়েচড়ে বসল।সে এখন বেশ আগ্রহ পাচ্ছে কথাটা বলার জন্যে।আপেলটায় লাস্ট একটা কামড় বসিয়ে তা চিবিয়ে চিবিয়ে তাড়াতাড়ি গিলে ফেলল।মুখটার ভাবভঙি দ্রুত পরিবর্তন করে নিল ও।অত্যন্ত সিরিয়াস মুড নিয়ে বলল,
‘ তোরা খেয়াল করেছিস কি না জানি না।বাট আমি দেখেছি।এই প্রিয়ান আর পিহু স্বাভাবিক নেই।’
অথৈয়ের এহেন কথা বুঝল না কেউ।আহিদ প্রশ্ন করল,
‘ মানে?কি বলছিস?’
অথৈ বিজ্ঞদের মতো মাথা দুলিয়ে বলে,
‘ হ্যা।ওরা আগের মতো স্বাভাবিক নেই।কাল থেকে কেমন যেন অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে।যেই প্রিয়ান আর পিহু একমুহূর্তের জন্যে ঝগড়া ছাড়া থাকতে পারে না।একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে টু শব্দ করলেই লঙ্কাকান্ড বেঁধে যায়।সেখানে ওর কাল থেকে এতোটা শান্ত কিভাবে?মানে হাউ ইজ দিস পসিবল?আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে বেষ্টফ্রেন্ড।আহিদ তুই-ই বল।এমন কোনো দিন কি গিয়েছে যে সেদিন প্রিয়ান আর পিহু ঝগড়া করেনি?বল?তাহলে কাল থেকে ওরা এমন ঠান্ডা হয়ে কিভাবে আছে?কিছু একটা ঘাপলা অবশ্যই আছে।আর তা একমাত্র ওরাই বলতে পারবে আমাদের।’
অথৈ থেমে এইবার প্রিয়ান আর পিহুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ এখন ফটাফট সব সত্যি কথা বলে ফেল।কোনোরকম মিথ্যে বলা চলবে না।কোনো বানোয়াট কাহিনিও যেন না শোনানো হয়।ঠাস ঠাস করে দুজন সত্যিটা আমাদের বলে দে।নাহলে ভালো হবে না একদম।বুঝেছিস?’
অথৈয়ের কথায় পিহু আর প্রিয়ান একে-অপরের দিকে তাকাতে লাগল।দুজনের অবস্থা একই।তারা এখন কি বলবে ওদের?
#চলবে_____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।