বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব-১৪+১৫

0
236

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৪
রাহুর মতো সূর্যকে যেমন গ্রাস করে নেয় তেমনি বেশ সুন্দর সময় কাটানোর মুহূর্তে একটা বেনামি পত্র এসে হাজির। শুধু বেনামি পত্র না। এটা একটা হু*মকি বার্তা। মাঝির মাধ্যমে তা আরহানের হাতে এসেছে। তাতে লিখা ছিল,

“যত উপভোগ করার করে নে! সময় তো বেশি নেই!”

এতে কোন নাম লেখা না থাকলেও আরহান লেখা পড়ে ঠিক বুঝতে পেরেছে এর প্রেরক কে! কবির, সাদমান, অভিকরা চিঠিটা দেখে চিন্তিত হয়ে গেল। রুহানী বাকিদের সাথে এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় হাত দিয়ে পানি ছিঁটয়ে উপভোগ করছিল। হঠাৎ তার নজর যায় আরহানের দিকে। হাত মুষ্টিমেয়। চোখে ক্রোধ স্পষ্ট। ক্রোধান*লে যেন কাউকে দ-গ্ধ করতে প্রস্তুত। রুহানী খুব সাবধানে নৌকার অপর প্রান্তে আরহানের নিকটে পৌঁছে। তারপর চোখের ইশারার ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা করে। আরহান কয়েক সেকেন্ড রুহানীর মুখের আদলে চেয়ে হালকা হেসে বলে,

“কিছু না। তুমি যাও আনন্দ করো।”

এতেও রুহানীর চিন্তা কমলো না। সে কিছু বোঝাতে নেবে তখনি আরহান বলে ওঠে,
“আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব। ইন্ডিয়ার পাহাড় গুলো দেখছ? কি সুন্দর না? নৌকার এই পাড়ে যেহেতু এসেই পড়েছ তাহলে আমার সাথেই বসো। আমি ওদেরকে বলছি ওই সাইডে যেতে।”

আরহানের ঠোঁটকোলে হাসির রেখা দেখতে পেয়ে রুহানীও হাসলো। তারপর আরহানের সাথে বসেই আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে।

রাফাতের চোখে আজ ক্রোধ যেন আকাশচুম্বী! তার মধ্যে আর নমনীয়তার কিঞ্চিত পরিমানও বাকি নেই। মুখে কালি দিয়ে আঁকিবুঁকি করে নিজের উদ্দেশ্যে পূরণ করতে এসেছে। আজ রুহানীকেও তার বোনের সাথে পৃথিবী থেকে বিদায় জানাবে! গতকাল রাতে তার কাছে তার চাচা রঞ্জু খন্দকার জানিয়েছেন, সাফার অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তাররা নেগেটিভ ভাইব দিচ্ছেন। তারপর থেকে রাফাত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার আর রুহানীকে বাঁচিয়ে রাখবে না। সে রুহানীর হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী দেখতে দেখতে প্রতিনিয়ত হৃদয় দ*হনে দ*গ্ধ হচ্ছে।

_______

ঘোরাফেরা প্রায় শেষের দিকে। এখন ওরা জাফলংয়ের মেইন স্পটে ফিরে এসে ভারত-বাংলাদেশের বর্ডারের সেখানে পানিতে নেমেছে। সবাই নেমেছে কিন্তু রুহানীর নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে পাথরের উপর বসে পা ভিজিয়ে সবার আনন্দ দেখছে। আরহানও চেয়েছিল রুহানীর পাশে বসে থাকতে কিন্তু আহান, অভীকরা এক প্রকার টেনেই ওকে পানিতে নামিয়েছে। এদিকে স্পটে ভীড়ও খানিকটা বেশি। বিকেল চারটার মতো বাজে। রুহানী বেশ খোশ আমেজে সবাইকে দেখছিল। বাদে বাদে ফটোগ্রাফিও করছিল। কিন্তু কে জানতো, ভবিতব্য!

কিছু মুহূর্তের বেখেয়ালির আন্দাজ হতেই আতঙ্কে আরহান দ্রুত পেছন ফিরল। যা ভয় পেয়েছিল তাই! নেই রুহানী তার জায়গায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পানি থেকে উঠে হন্য হয়ে চারিপাশে পর্যবেক্ষণ করেও রুহানীকে নজরে এলো না। এবার সে চিৎকার করে উঠে রুহানীর নাম ধরে। আরহানের চিৎকারে ওর বন্ধু মহলের প্রত্যেকে সতর্ক হয়ে যায়। প্রত্যেকে থমকে দাঁড়ায় যত্র। আশেপাশের মানুষজনও থেমে ফিরে তাকায়। কী হচ্ছে সেটা বোঝার প্রয়াস করে। আরহান দ্রুত ফোন বের করে রুহানীর ফোনে ফোন করে। কিন্তু ফোন নট রিচেবল বলছে। এতে সে ঘাবড়ে গিয়ে বুঝতে পারে এতে রাফাতের হাত রয়েছে। রাফাতের নামটা মস্তিষ্কে হি*ট করতেই রাগে নিয়ন্ত্রণ হারালো সে। লা*থি দিয়ে একটা মাঝারি সাইজের পাথরকে স্থানচ্যুত করল। সাদমান, কবিররা এসে ওর বাহু চেপে আটকায়। সাদমান বলে,

“শান্ত হও আরহান। রুহানী আশেপাশেই আছে, কারণ এই পাথুরে এবড়োথেবড়ো রাস্তা দিয়ে এত দ্রুত দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ক্রোধের বশবতি হয়ে নিজের দৃষ্টিসীমা খুইয়ো না।”

“ভাইয়া, আপনি ওই চিরকুটটা দেখেছিলেন না! রাফাত!”

কবির বলে,
“আমরা ডিফরেন্ট ডিরেকশনে খুঁজতে শুরু করি। সাদমান ভাই ঠিকই বলেছেন। বেশি দূর যেতে পারেনি। চলো সবাই। আর জাওয়াদ, তুই মেয়েদের সাথেই থাক।”

ওরা পাঁচ জন পাঁচদিকে বিভক্ত হয়ে খুঁজতে শুরু করল। আহান পাহাড়ের অভিমুখে সন্ধানে গেলে সেখানে একটা পায়েল পায়। তৎক্ষণাৎ সেটা তুলে নিয়ে বাকিদের ডাকে।

“সবাই এদিকে এসো। এখানে একটা পায়েল পরে আছে এখানে।”

রাইদা, তন্নি এসে পায়েলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বলে,
“পায়েলটা কি রুহানীর? এখানে তো কত মানুষ। কার পায়ের থেকে খুলে পরেছে তা কি করে বলবো?”

কাজল ছুটে এসে পায়েলটা নিয়ে দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলে,
“এটা রুহানীর নুপুর। আরহান ভাইয়া রুহানীকে দিয়েছিল। ওদের এনগেজমেন্টের পর রুহানীর প্রথম বার্থডের দিন।”

“সত্যি? তাহলে আরহানকে ডাকো আহান।”

রাইদার কথা শুনে জাওয়াদ দ্রুত ফোন বের করে আরহানকে মেসেজ করে আসতে বলে। কিছুক্ষণ পর আরহান ও বাকিরা সেখানে উপস্থিত হলে জাওয়াদ বলে,

“রুহানীকে কি কোনো ভাবে বর্ডার ক্রস করিয়েছে? এখানে বর্ডার জাস্ট মাটিতে কাঁটাতার বিছানো।”

আহান জবাবে বলে,
“বর্ডার ক্রস করলে আর্মিরা দেখবে না? দে আর হেয়ার ফর বর্ডার গার্ড। সানলাইটের মধ্যেও সম্ভব?”

“একজেক্টলি। দিনের আলোয় বিনা পাসপোর্টে বর্ডার ক্রস করতে পারবে না। রাফাত আশেপাশে কোথাও লুকিয়েছে।”

আরহান কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সোজা পাহাড়ের গাত্র বেয়ে উঠে যেতে শুরু করে। জাওয়াদ ও আহান বর্ডার গার্ডদেরকে ব্যাপারটা জানিয়ে আসে। বর্ডার গার্ডরা ব্যাপারটাতে গুরুত্ব দেন। পাহাড়ের গাত্রে বিভিন্ন দোকানপাট আছে। এক দোকানীকে জিজ্ঞাসা করে,

“দাদু, এখান দিয়ে কোন ছেলে কি কোন মেয়েকে নিয়ে উঠে গেছে?”

জবাব আসে,
“কত মানুষই তো যায়।”

আরহান এবার রুহানীর ছবি দেখালে বৃদ্ধ দোকানী ‘দেখেনি’ জানায়। ওরা আবারও উঠতে শুরু করে। আরো দু-এক জনকে জিজ্ঞাসা করার পর শেষে একজন বলে,

“এইতো একটু আগেই এক লোক মুখের মধ্যে কালো কালো দাগ দেওয়া। সে একটা মেয়েকে কোলে করে নিয়ে গেল। মেয়েটা অজ্ঞান ছিল। আমার দোকানের সামনে আসতেই হুট করে ছেলেটা হোঁচট খেয়েছিল। তাই ছেলেটার মুখ দেখতে পেয়েছিলাম, আর বুঝতে পেরেছিলাম মেয়েটা অজ্ঞান।”

আরহানরা দ্রুত বাকি পথটুকু উঠতে থাকে। পাহাড়ের শীর্ষ চূড়ায় উঠে আশেপাশের পাহাড়ের দিকে নজর গেলে দেখতে পায় সামনের পাহাড়ের ধার বেয়ে একটা একজন পুরুষ কাউকে কোলে নিয়ে উঠে চলেছে। আরহান চিৎকার করে ওঠে,

“রাফাত দাঁড়া!”

বলা মাত্রই খানিকও অপেক্ষা না করে সে দ্রুত সেই পথে অগ্রসর হতে শুরু করে। বাকিরাও তাকে অনুসরণ করতে থাকে। রাফাত পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বিজয়ী হাসি হেসে আরহানদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে,

“দেখলি? আবারো তোর চোখ ফাঁকি দিয়ে রুহানীকে নিয়ে এলাম। এইবার আর কোন কাজ অর্ধেক রাখব না। এবার আগের বারের অর্ধেক রাখা কাজের সমাপ্তি টানব।”

আরহান উপরের দিকে উঠতে উঠতে ক্ষিপ্র স্বর বলে,
“ওর গায়ে যেন একটা আঁচও না লাগে রাফাত। তাহলে কিন্তু তোকে আমি শেষ করে দেব।”

রাফাত তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“আমাকে আর তুই কী শেষ করবি? আমার বোনকে শেষ করে তোর শখ মিটেনি? আমার ফুলের মত বোনটাকে এই পৃথিবীর রুক্ষতা তুই দেখিয়েছিস। যে রুক্ষতা থেকে বাঁচাতে ওকে আমি নিজের কাঁধ ছাড়া করেছিলাম। আজ কী-না আমি আমার সেই বোনের মৃত্যুর সংবাদের ভয়ে ভয়ভীত! আমার বোনের যদি কিছু হয়, আমি তোকে কিভাবে সুখে থাকতে দিতে পারি?”

আরহান এরইমধ্যে চূড়ায় পৌঁছেছে। রাফাত জলের ছিঁটা দিয়ে রুহানীকে হুঁশেও ফিরিয়েছে। জ্ঞান ফেরা মাত্র রুহানী আরহানের দিকে হাত বাড়ালে রাফাত ব*ন্দু*ক তাক করে ক্রোধান্বিত স্বরে বলে ওঠে,

“যদি আর এক পাও সামনে এগিয়েছিস তাহলে রুহানী এখনি ম*র*বে। বাকিদের আসতে মানা কর আরহান। নয়তো গু*লি ছুঁটে যাবে।”

এই কথা শুনে কাজল, রাইদারা ভয় পেয়ে যায়। আরহান নিচে তাকিয়ে ওদের আসতে নিষেধ করে। কিন্তু এদিকে আহান সেটা শোনার পাত্র নয়। সে পেছন দিয়ে উঠার জন্য যেতে থাকে। তার সাথে সাদমানও যায়।

রাফাত রুহানীর চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“খুব ভালোবাসিস তাই না? আমার বোনও তোকে ভালোবেসেছিল। ওর ভালোবাসাতে কিন্তু কোনো কমতি ছিল না। কতোগুলো বছর ও তোর ভালোবাসাকে বন্ধুত্বে রূপ দিয়ে অপেক্ষা করেছে। তাও তুই ওকে ভালোবাসিসনি। এমন একজনকে ভালোবাসলি যার সাথে তোর পরিচয়ের এখনও বছরই পেরোয়নি! তার জন্য তোর এত পুরানো বন্ধুকেও ফিরিয়ে দিয়েছিস। বুঝলি না তুই আমার বোনের হৃদয় দ*হন।”

আরহান অস্থির হয়ে বারবার রুহানীর পানে দেখছে। রুহানীর মুখশ্রীতে যন্ত্রণা পরিলক্ষিত। শুধু কণ্ঠস্বরের প্রতিবন্ধকতায় সে নীরব। আরহান বলে,

“দেখ রাফাত, আমি সাফার দোষী। আমি সাফাকে ভালোবাসিনি। আমি সাফাকে কষ্ট দিয়েছি। সবকিছু আমি করেছি। রুহানী তো কিছু করেনি। রুহানী আমার জীবনে আসতে চায়নি। আমি ও আমার পরিবার ওকে এনেছে। ওর তো দোষ নেই। ওকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস? দেখ ও কথাও বলতে পারে না। ওকে ছেড়ে দে। যা করার আমার সাথে কর।”

রাফাত হুংকার ছাড়ল!
“করেছে! ওই করেছে। আমার ও আমার বোনের জীবন নষ্ট করার পিছনে ওর পরোক্ষভাবে হলেও হাত আছে। শুরুটা ওর পরিবার করেছে। ওর মা করেছে। আমি নিজ চোখে নিজের মায়ের কষ্ট, যন্ত্রণা দেখেছি। ছটফট করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে দেখেছি। বাবাকে আ*ত্মহ*নন করতে দেখেছি। আমার শিশু বোনটাও এসবের সময় উপস্থিত ছিল। আমার ঘুমন্ত বোনটা জানতেও পারেনি, পাশের ঘরে তারই বাবা তার মাকে হ*ত্যা করে নিজে আ*ত্মহ*ত্যা করেছে। বাবার বলা প্রতিটা বাক্য আমি শুনেছি। সেই সন্ধ্যায় শুধু রুহানী এতিম হয়নি, আমি ও সাফাও এতিম হয়েছি। এসবের জন্য দায়ী কে জানিস? রুহানীর মা হাসনেয়ারা!”

রুহানী যন্ত্রণা ভুলে হতবিহ্বল হয়ে রাফাতের দিকে চেয়ে আছে। আরহানও যেন ভীষণ অবাক। যেন প্রত্যুত্তর করার ভাষাই ভুলে গেছে। রাফাত ওদের দুইজনের মুখের ভাব দেখে তাচ্ছিল্য হাসে। অতঃপর বলে,

“তোরা যেন আকাশ থেকে পরলি! অবশ্য স্বাভাবিক। এই সত্য সম্পর্কে তোরা জ্ঞাত না। তাহলে শোন, আমার বাবা ও রুহানীর মা বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন। রুহানীর বাবা ওরফে রবিউল শেখ ছিলেন তাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। আমার বাবা রুহানীর মাকে মনে মনে ভীষণ ভালোবাসতেন। ঠিক তোর ও সাফার মতো কে*স। এক্ষেত্রে তুই উদাসীন আর সেক্ষেত্রে রুহানীর মা। রুহানীর বাবা-মা ভালোবেসে বিয়ে করার পর আমার বাবা হুট করে কোথাও গায়েব হয়ে যায়। দাদী ও চাচ্চু উনাকে অনেক খোঁজে কিন্তু হদিস পায় না। বাবার শোকে দাদী দুনিয়া ত্যাগ করেন আর আমার মেডিকেলের ১ম বর্ষে পড়ুয়া চাচা একা হয়ে যান। সেই সময় আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। আমার মা সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেন। বেশ ভালোই চলছিল সব। বিপত্তি ঘটে যখন আমি আমার মায়ের গর্ভে তখন থেকে আমার বাবা আবারও মন-মর্জি শুরু করেন। এভাবেই ছয়টা বছর পেরিয়ে যায়। আমার তখন ছয় বছর আর সাফার এক বছর। আমরা সপরিবারে সিলেটে চলে আসি। চাচ্চুও আমাদের সাথে এসে সিলেট মেডিকেলে জয়েন করেন। আরও এক বছর গড়ালো। প্রতিদিন আমি মাকে লুকিয়ে কাঁদতে দেখতাম। তখনও আমি কিছুই জানতাম না। জানলাম সেই রাতে। যেই রাতে বাবা দুটো খু**ন করে এসে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বলছিল, ‘মে*রে ফেলেছি ওদের। ধ্বং*স করে দিয়েছি। আমি আজ সবচেয়ে সুখী। আমার আর কাউকে দরকার নেই।’ এসব বলতে বলতে বাবার নজর যায় আমার ও মায়ের অবাক দুই জোড়া চোখের দিকে। বাবা হুট করে ঝড়ের বেগে মায়ের সামনে এসে মাকে টেনে অন্য একটা ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। চাচ্চুও তখন সবে বাড়িতে ঢুকেছে। সদর দরজা খোলা দেখে তিনিও অবাক ছিলেন। আমাকে সেই ঘরের সামনে বসে কাঁদতে দেখে ছুটে আসেন। তারপর আমার কথা শুনে আমাকে নিয়ে বাড়ির পেছনে জানালার কাছে দৌঁড়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই সেই মর্মান্তিক দৃশ্য! বাবা মাকে বালিশ চে*পে হ**ত্যা করছে। আমরা তাকে আটকাতে চিৎকার করে চলেছি। জানালার কাঁচ ভেঙেও কিছু করতে পারিনি। সব শেষ হয়ে গেছে। চাচ্চু পু*লিশে কল করেছিল কিন্তু সব শেষ হয়ে যাওয়াতে তিনি আমাকে ও সাফাকে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলেন। তারপর আমার জায়গা হয় বোডিং স্কুলে আর সাফাকে এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে দত্তক দেন। এভাবে আমি ও সাফা এতিম হয়েছি। এসব হতোই না যদি রুহানীর মা তার বেস্টফ্রেন্ডের ফিলিংসের মর্যাদা দিত। ছোটো থেকে উনারা একসাথে ছিলেন। তাহলে সবসময় কেন বহিরাগতের আগমনে এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? কেন? আজও ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কিন্তু এই ধারা আজও উভয় পক্ষ ভুগবে। তবে এবার এর দ্বারা কোনো শিশু কষ্ট পাবে না। কোনো শিশুকে এতিম হতে হবে না। সাফার হাতে সময় নেই। ডাক্তার বলেছে কিছু ঘণ্টার মধ্যে আমার ছোটো বোনটা অন্তিম শ্বাস ত্যাগ করবে।”

রুহানী কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পরেছে। রাফাত চোখের জল মুছে রুহানীকে টেনে উঠায় তারপর ওকে একদিকে ধা*ক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দুই হাতে দুই দিকে ব*ন্দুক তাক করে। আর বলে,

“তোদের দুইজনকে একসাথে মা***রব!”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৫
আরহান ও রুহানী একে-অপরের দিকে তাকায়। তখনি রাফাত বলে ওঠে,
“একসাথে মা*র*লে অপরজনের প্রতি কষ্ট দেখতে পাব না। এক কাজ করে ব্যাবধানে করি। আগে কে? উম,, আমার ইচ্ছে মত হ্যাঁ? রুহানীকে?”

আরহান তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে ওঠে,
“না! রাফাত তোর মাথা ঠিক নেই। তুই তোর সেন্সে নেই। সবকিছু আরেকবার বিবেচনা করে দেখ। বিবেক দিয়ে বিবেচনা করে দেখ। যা হয়েছে তাতে হাসনেয়ারা আন্টির কোন দোষ ছিল না। আন্টিও তো রবিউল আঙ্কেলকে ভালোবেসেছেন। যেখানে দুই পক্ষের সত্যি ভালোবাসার কাছে নিয়তিতে না থাকলে এক পক্ষের ভালোবাসা হার মানবেই। তোরা আজ এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে তার কারণ তোর বাবা! তিনি তিনটা শিশুকে এতিম করেছেন। আর আমার ও সাফার কথা ধরলে, তুই প্রথম থেকে জানতি আমি সাফাকে কখনোই ভালোবাসার নজরে দেখিনি। আমারা বন্ধু। সবসময় তা থাকব। শত্রুতার মনোভাব ভুলে শান্ত মনে ভেবে দেখ রাফাত।”

রাফাত ক্রোধান্বিত স্বরে বলে ওঠল,
“আমার কিছু ভাবার নেই আরহান। আমি কিছু ভাবতে চাই না। তুই পারবি? আমার বোনের মন আগের মতো করে দিতে? সব কিছু রিবাইসে করে দিতে? পারবি না তো। আলটিমেটলি সবকিছু তো আমিই হারাব! তাই তুই আমাকে কিছু বোঝাতে আসিস না। আমি চাই রুহানীও ঐরকম কষ্টটা পাক। যেই কষ্টটা ভালোবাসার মানুষকে হারালে মানুষ পায়। তার জন্য আমায় আগে আমার নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে মা*রতে হবে! তৈরি হয়ে যা আরহান! আগে তুই। তোর প্রেয়সীর চোখে সেই বিষাদ, যন্ত্রণা, আকুতি দেখার লোভ হচ্ছে রে! এইটুকু আশা আমার পূরণ করে দে!”

এই বলে রাফাত আরহানের দিকে নিশানা করে ব*ন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিচ্ছে। আরহান শুধু এটুকু বলে,

“দেখি তুই কীভাবে গু*লি করতে পারিস।”
“আমি আর আগের রাফাত নেই। যতদিন রুহানী ছিল না ততোদিন সব ঠিক ছিল। এখন না।”

রাফাত তাচ্ছিল্য হেসে ট্রি*গার চেপে দিয়ে দিয়েছে। রুহানী দৌঁড়ে সেদিকে যাচ্ছে। তার চোখে হারানোর ভয় ও অশ্রুধারা। কণ্ঠস্বরের জড়তার সাথে প্রতিক্ষণে লড়াই করে চলেছে। অবশেষে সে জয়ী হয়! আরহানের কর্ণকুহরে মেয়েলী স্বরে আতঙ্কিত চিৎকারে নিজের নাম প্রবেশ করতেই সে কিছুটা পাশে সরে এসেছিল যার দরুণ গু*লিটা তার লক্ষ্যচ্যুত হয়ে বাহুতে লেগে বেরিয়ে যায়। আরহান প্রচণ্ড যন্ত্রণা ও র*ক্তাক্ত অবস্থাতেই দুই পা এগিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। রুহানী দৌঁড়ে এসে তার পাশে বসে গু*লিবিদ্ধ স্থান চেপে ধরে কাঁদতে থাকে।

গু*লি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় রাফাত আবারও ব*ন্দুক তাক করলে পেছন থেকে পাওয়া পাথুরে আ*ঘাতে ভূমিতে লুটিয়ে পরে। ব*ন্দুক ছিঁটকে খানিক দূরে চলে যায়। পেছন থেকে সাদমান এসে ব*ন্দুকটাকে লা*থি দিয়ে আরও দূরে সরিয়ে আরহান ও রুহানীর দিকে ছুটে যায়। রাফাত কোনোমতে উঠার চেষ্টা করলে আহান ওর মা*থায় আরেকটা বা*ড়ি দেয়। তৎক্ষণাৎ রাফাত উঠার শক্তি হারিয়ে মুখ থুবড়ে পরে। আহান পাথর ফেলে দ্রুত ওদের কাছে যায়। রুহানী ভাঙা স্বরে বলে,

“আরহান, আরহানকে হসপিটাল…”

আহান ও সাদমান অবাক হয়ে একত্রে বলে,
“ফাইনালি রুহানী কথা বলতে পারছে।”
সাদমান আরহানকে বলে,
“আরহান, ওর গলার স্বর ফিরে এসেছে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

হাতের যন্ত্রণার মধ্যেও আরহান ব্যাথাতুর হাসি হেসে বলে,
“আমিও অবাক ভাই। ওর গলার স্বর যে এভাবে ফিরবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। ওর চিৎকার শুনে আমি সরে আসাতেই গু*লিটা হাতে লেগেছে। নয়তো…”

আহান আরহানের হাতে ধরে দেখে বলল,
“গু*লিটা বেরিয়ে গেছে ব্রো। এখন তাও ফার্স্টএইড করতে হবে। আগে আমাদের এখান থেকে নামতে হবে।”

“হ্যাঁ। আহান, তুমি ও আমি আরহানকে ধরে ধরে নিয়ে যাই। রুহানী, তুমি একা চলতে পারবে না?”

রুহানী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝায়। তার যে গলায় ব্যাথা হচ্ছে তা প্রকাশ করে না। ওরা ধীরে ধীরে সাবধানে নামতে শুরু করে তখন সাদমানের মনে পরে।

“রাফাতকে নামাব না?”

“আমি বর্ডারগার্ডদের জানিয়েছি। উনারা ওকে নিয়ে যাবে।”

“তাহলে জাওয়াদ, কবিরদের কল করে বলো যাতে বর্ডার গার্ডদের আসতে বলে।”

আহান ফোন বের করে দেখে নেটওয়ার্ক নেই বললে চলে। সে বলে,
“নেটওয়ার্ক নেই। তাছাড়া রাফাত উঠতে পারবে না। সে সেন্সলেস। আমরা নিচে নেমেই বলতে পারব।”

সাদমান মাথা নাড়ায় তারপর রুহানীকে সামনে সামনে হাঁটতে বলে ওরা নামতে শুরু করে।

_______

নিচে নেমে ওরা বর্ডারগার্ডদের বললে উনারা পাহাড়ে গিয়ে রাফাতকে নিয়ে এসে নিজেদের কাস্টাডিতে রাখে। আরহানের ফার্স্টএইড করে সবাই ফেরার জন্য রওনা করে। আরহান সিটে গা এলিয়ে রেখেছে। হাতের ক্ষতের কারণে বেশ ক্লান্তও লাগছে। রুহানী বেশ সাবধানে বসেছে যাতে হাতে চাপ না পরে। গাড়ি তার নিজের গতিতে চলমান। সারি সারি বৃক্ষরাজিকে পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে ওরা। আরহান মৃদু স্বরে বলে,

“সাইফুল আঙ্কেলকে কল করো কেউ। সাফার কী খবর জানতে হবে।”

রাইদা সন্দিহান হয়ে শুধায়,
“হঠাৎ? এখানে তো ঠিকভাবে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না। ফিরে গিয়ে নাহয় কল করব।”

আরহান বাঁধা দেয়। সে বলে,
“এখনই কল কর। সাফার অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল। ডাক্তার বলেছে বেশি সময় নেই। ”

আরহানের মুখ নিঃসৃত শব্দ শুনে তন্নি, রাইদারা বি’স্ফোরিত নয়নে চাইলো। রাইদা আঁতকে উঠে বলে,
“হোয়াট? কী বলছিস এসব? দুইদিন আগেও তো আমি আন্টির সাথে কথা বললাম, তখন তো বলল যেমন আছে তেমনটাই।”

সাদমান হতাশ স্বরে বলে,
“পাহাড়ে উঠতে উঠতে আমরা পুরোটাই শুনেছি। আমার আন্দাজ হচ্ছিল এমনটাই কিছু। কিন্তু সাফার জন্য খুব খারাপ লাগছে। ও ওর অন্তরের চঞ্চলতা, বিশুদ্ধতা দিয়ে আমাদের কলিগ সম্পর্কটাকে ভাই-বোনের সম্পর্কে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল।”

তন্নি বিমর্ষ হয়ে বলে,
“তোমরা বলার আগে থেকেই আমি জানতাম যে ওরা ভাই-বোন। রাফাতের সাথে শেষবার যখন ফিরছিলাম তখন বলেছিল। যে সাফা ওর বোন। ছোটোবেলায় নাকি হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর সাফার হাতের চিহ্ন দেখে চিনতে পেরেছে তারপর নাকি ডিএনএ টেস্টও করিয়েছে। এখন সাফা কোথায় লাপাত্তা তা জানার চেষ্টা করছে। আসলে তখন সাফা ও রুহানী দুজনেই নিঁখোজ ছিল। আমি ওকে ওয়াদা করেছিলাম কাউকে বলব না সাফা যে ওর বোন। ও নিজেই ওয়াদা করিয়েছিল, কারণ সাফা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে।”

অভীক বলে,
“তোমাকে বলে ও হালকা হতে চাইছিল। সে মেন্টালি স্টেবল ছিল না। স্টেবল হলে নরমাল বিষয়টাকে এতো জটিল করত না। বুঝতো সবটা।”

“সেসব বাদ দাও। সাফার খবর নিতে হবে। রাইদা, আন্টিকে কল করো।”

জাওয়াদের কথা শুনে রাইদা নেটওয়ার্ক একটু ঠিক হলে কল করে। কল করে যা জানতে পারে তাতে যাত্রাপথেই সবাই বিষাদের চাদরে মুষড়ে পরে। সাফা আর নেই! খবরটা যেন সূর্যকে কালো মেঘের আড়ালে ঢেকে দেওয়ার মতোই বেদনাদায়ক। গাড়ি একপাশে থামিয়ে রাখা হয়েছে। সবার চোখে জলধারা। সাফার লা*শ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে না। সাফার বাবা-মায়ের সিঙ্গাপুরের গ্রিনকার্ড আছে। সাথে সাফারও। ওরা সাফাকে ওখানেই দা*ফন করবে।

সবাইকে শোক সামলানোর জন্য সেরিনা বলে,
“সাফা এই পেইন থেকে ফ্রি হয়েছে। কোমাতে প্যাশেন্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য চলে যায়। ইয়াহ, হোপ থাকে বাট উই ডোন্ট নো, প্যাশেন্ট উইল কাম ব্যাক অর নট। প্লিজ গাইজ প্রে ফর হার। নাও উই ক্যান প্রে ফর অ্যা বিউটিফুল সোল এন্ড হার ফ্যামিলি।”

“তুমি ঠিক বলেছ সেরিনা। আমরা এখন শুধু সাফার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করতে পারি। সেই সাথে আঙ্কেল-আন্টি যেন শোক কাটিয়ে উঠতে পারে। সাফা তার জীবনের কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছে।”

সেরিনা কবিরের সমর্থনে হাসলো। তারপর আবার সবাই গাড়িতে ওঠে বসে। গাড়ি আবারও তার গতিতে চলছে। রুহানী একদম নিরব হয়ে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরে চেয়ে আছে। আরহান পাশে বসে ঠিক বুঝল রুহানী মানতে পারছে না। ও নিজেকেই দোষী ভাবছে। ও সবকিছু বুকের মধ্যিখানে চেপে রেখেছে। এসব বুঝাতে রুহানীকে সময় দিতে হবে। হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল আরহান।

চলবে ইনশাআল্লাহ,