#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩৪
#নিশাত_জাহান_নিশি
“কাল রাতে তোর কী হয়েছিল মা? স্কুটিটা দেখে তুই এত ভয়ে পেয়ে গিয়েছিল কেন? কত শখের এই স্কুটিটা তোর বল? বিগত চার পাঁচ মাস ধরেই দেখছি স্কুটিটাকে তুই ধরেও দেখছিস না! কী হয়েছে তোর বল তো?”
স্কুটির কথা শোনা মাত্রই নীহারিকা তার নিজের মধ্যে ফিরে এলো। ঘুমের ঘোর কেটে গেল তার। অগোছালো দৃষ্টি ফেলল তার মায়ের দিকে। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। জায়গা থেকে খানিক নড়েচড়ে উঠল সে। কম্পিত গলায় তার মাকে বলল,
“স্কুটিটি কোথায় মা?”
নীহারিকার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বিস্ময়ের মাত্রা আরও ছাড়িয়ে গেল মারজিনা বেগমের! বিচলিত হয়ে তিনি নীহারিকার মাথায় হাত বুলালেন। শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
“এই কী হয়েছে তোর? স্কুটির কথা শুনলে তুই এভাবে রিয়েক্ট করিস কেন? ক্ষণিকের মধ্যেই তোর রিয়েকশন এভাবে পাল্টে গেল কেন? কী লুকাচ্ছিস তুই আমাদের থেকে?”
তৎক্ষণাৎ হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল নীহারিকা। তুখোড় আতঙ্কিত ভাব তার মধ্যে বিদ্যমান। তার মায়ের কথারও কোনো প্রত্যুত্তর নেই তার কাছে। অপ্রত্যাশিতভাবে সে কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল! ওয়াশরুমের দরজা আটকে সে দরজার পেছনে পিঠ ঠেকালো। একনাগাড়ে কয়েকদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলে আয়নায় তাকালো। বিস্তীর্ণ মুখমণ্ডল জুড়ে তার ঘামের ছিটেফোঁটা। কপাল থেকে গড়গড়িয়ে ঘাম ঝরছে তার৷ বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে। এক পা দু’পা করে সে বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আয়নার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে হুট করেই ট্যাব ছেড়ে দিলো। চোখেমুখে পানি ছিঁটানো শুরু করল। পানি ছিঁটানো অবস্থাতেই সে বিচলিত গলায় বিড়বিড় করে বলল,
“যে করেই হোক আমাকে স্বাভাবিক হতে হবে। নিজের দুর্বলতা কাউকে বুঝানো যাবেনা! সবাইকে বুঝাতে হবে আমি নরমাল আছি। কিছু হয়নি আমার। আমিতো ব্রেইভ গার্ল! আমি কেন ভয় পাব হ্যাঁ? বুকে সাহস রেখে আমাকে সব পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে।”
মুখে পানি ছিঁটানো শেষে নীহারিকা ভেজা মুখে পুনরায় তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেও সে স্বাভাবিক হতে পারছিলনা! দরজা ভেদ করে তার মায়ের গলার স্বর যদিও তার কর্ণকুহরে ভেসে আসছিল তবুও সে এই মুহূর্তে নীরব থাকার চেষ্টা করল। মিনিট কয়েক নিজেকে ধাতস্থ করার পর নীহারিকা ফট করে দরজা খুলে বের হয়ে এলো।চিন্তিত মারজিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে সে অবিশ্বাস্যভাবেই ফিক করে হেসে দিলো! তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বি কুল মা! আমিতো তোমাদের ভয় দেখাচ্ছিলাম। এত ভয়ে পেলে চলবে বলো? বি স্ট্রং প্লিজ।”
তাজ্জব বনে গেলেন মারজিনা বেগম! বোকার মত তিনি নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে রইলেন। নির্বোধ গলায় শুধালেন,
“ভয় দেখাচ্ছিলি মানে? কাল রাতে যা যা হলো সব নাটক ছিল?’
“নাটক নয়ত কী? তোমার মেয়েকে আগে কখনও এভাবে ভয় পেতে দেখছ বলো? এসব তো আমার অভিনয় ছিল! মিস্টার রূপলকে ভয় দেখানোর জন্য!”
অমনি দরজার ওপাড় থেকে সব শুনে নিলো পিয়াসা! আড়ি পাতার জন্য সুযোগ বুঝে দাড়িয়ে ছিল সে! নীহারিকার মনগড়া কথাগুলো শুনে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তাৎক্ষণিক দরজা থেকে সরে দাড়ালো সে। ছুটে গেল তার রুমে। বিছানার উপর থেকে ফোনটি হাতে নিয়েই রূপলের নাম্বারে ডায়াল করল। নীহারিকার পেছনে লাগার আরও একটি সুযোগ পেল সে। এই সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চায়না সে।
ঐদিকে রূপল ব্যস্ত সজলের ক্লাস নিতে! কিছুটা নির্দয়ভাবেই রূপল উত্তপ্ত ছাদের উপরে কানে ধরে উঠ বস করাচ্ছিল সজলকে! দোলনায় বসে সে দোল খাচ্ছিল আর কাউন্ট করছিল এই নিয়ে কতবার তাকে কানে ধরে উঠ বস করানো হচ্ছে। পা দুটো ধরে আসতেই সজল অসহায় দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। চেহারাতে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে রূপলকে বলল,
“ভাই আর কত? পা-দুটো তো অবশ হয়ে এলো। প্লিজ ভাই এবারের মত আমাকে মাফ করে দিন। বড়ো ভাই হয়ে ছোটো ভাইয়ের উপর এভাবে টর্চার করবেন?”
ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে রূপল সজলের দিকে তাকালো। আঙুলের ইশারায় সজলকে উঠ বস করতে বলল! ধীর গলায় বলল,
“১০৩! তারপর?”
“১০৪! কিন্তু ভাই আমি আর পারছিনা। তবে সেদিন কিন্তু আমার কোনো দোষই ছিলনা ভাই। আপনিই কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারেননি আমাকে! তাই আমিও না বুঝে ফট করে ভুলভাল কথা বলে ফেলেছি আপনাকে।”
“উঁহু। কথা বাড়াচ্ছিস কেন বল তো? ভাই বিরক্ত হচ্ছি তো! জানিসই তো পুরোনো পাগল আমি! মাথা গরম হয়ে গেলে নিজেকেও ছাড় দিইনা!”
ইতোমধ্যেই রূপল টের পেল তার পকেটে থাকা ফোনটি সাইলেন্ট মোডে কাঁপছে। পকেট থেকে ফোনটি বের করল রূপল। স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে দেখল পিয়াসার নাম্বার থেকে কল। তাড়াহুড়ো করে রূপল কলটি তুলল। মৃদু হেসে রূপল হ্যালো বলতেই পিয়াসা রাগে ফোঁসফোঁস করে বলল,
“তুমি কোথায় ভাইয়া?”
“বাসায়। কেন?”
“তুমি জানো নীহারিকা তোমার সাথে কী গেইম খেলেছে?”
নির্বোধ গলায় রূপল শুধালো,
“কী গেইম?”
“তোমাকে কাল রাতে বোকা বানিয়েছে সে!”
“কীভাবে?”
“সে আসলে কাল রাতে কোনো ভয় টয় পায়নি! তোমাকে হেনস্তা করার জন্য অভিনয় করেছে। এবার বুঝো এই মেয়ে কত শেয়ানা! আমিও তো বলি তার মত একটা দুঃসাহসী মেয়ে কীভাবে এতটা ভয় পেতে পারে! নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।”
“এক সেকেণ্ড এক সেকেণ্ড। তোকে এসব কে বলল?”
“কেউ বলেনি। আমি নিজের কানেই শুনেছি। মা আর মেয়েতে মিলে এসব বলাবলি করছিল। ভাগ্যিস আমি সব শুনে নিয়েছি। নয়ত তুমি এখনও একটা ট্রমার মধ্যে থাকতে।”
মাথায় যেন ফট করে আগুন ধরে গেল রূপলের! কলটা কেটেই সে রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। খালি গাঁয়ে ছাদে সচরাচর আসা হয়না তার। তবে আজ সজলকে শাস্তি দেওয়ার নেশায় সে এতটাই বুদ হয়েছিল যে নিজের দিকে তাকানোর সময়ই পায়নি সে! তাদের পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে একটি মেয়ে তাকে আড়চোখে দেখছিল ক্ষণে ক্ষণে। মুচকি মুচকি হাসছিলও তাকে দেখে! অনেকক্ষণ যাবত যদিও রূপল বিষয়টা খেয়াল করছিল তবুও সে একটু দেখতে চাইছিল মেয়েটি শেষ অবধি কী করতে চায়! মাথা গরম হয়ে যেতেই রূপল নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। পায়ের কাছে সে একটি ইটের কণা খুঁজে পেতেই ইটটি হাতে তুলে নিলো! জায়গা থেকে ওঠে এগিয়ে গেল ছাদের রেলিংয়ের দিকে। হঠাৎয়ের মধ্যেই সে ইটটি নিক্ষেপ করল পাশের বাড়ির ছাদে থাকা মেয়েটির দিকে! রাগে গজগজ করে বলল,
“ফা’ল’তু মেয়ে কোথাকার! খালি গাঁয়ে একটা ছেলেকে দেখে খুব মজা নিচ্ছিস তাইনা? এই তুই কোন ফ্ল্যাটে থাকিস? রুম নাম্বার বল? আমি আসছি। তখন কাছ থেকে দেখিস আমাকে। প্রয়োজনে প্যান্টও খুলে দিব!”
ইটটি যদিও মেয়েটির গাঁয়ে পড়েনি তবে রূপলের অদ্ভুত আচরণে মেয়েটি খুব অবাক হয়ে গেল। পাশাপাশি প্রচণ্ড ভয়ও পেয়ে গেল। ‘ওমাগো’ বলে চিৎকার করে সে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে গেল! রাগে রূপলের অবস্থা ধরাশায়ী। সামনের চুলগুলো টেনে ধরে সে পেছনের দিকে ঘুরতেই দেখল সজল দৌড়ে পালাচ্ছিল ছাদ থেকে। অমনি রূপল পেছন থেকে সজলকে ডাকল। মেজাজ হারিয়ে বলল,
“এই তুই কোথায় যাচ্ছিস? কাজ আছে শুনে যা।”
কপাল চাপড়ালো সজল! কাঁদো কাঁদো মুখে বিড়বিড় করে বলল,
“আজ আমারে খাইছে এই বদরাগী রূপল। নির্ঘাত ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবে আমাকে! যেখানে একটা অপরিচিত মেয়েকে ছাড় দেয়নি সে, সেখানে আমাকে ছাড় দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসছেনা! এই বান্দায় কী আবার পা’গল হয়ে গেল? যদি আমার সামনে প্যান্ট খুলে দেয়?!”
নখ কামড়াতে কামড়াতে সজল রূপলের দিকে এগিয়ে এলো। ভীরু দৃষ্টিতে সে রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। আস্ত একটি সিগারেট ধরিয়ে রূপল সজলের কাঁধে হাত রাখল। অস্থির গলায় বলল,
“আমাকে একটা হেল্প করতে পারবি?”
“কী হেল্প?”
“একটা মেয়েকে শায়েস্তা করতে হবে!”
“কোন মেয়ে?”
“পিয়াসার ননদ।”
“ঐযে নীহারিকা? বিশ্রী দেখতে মেয়েটা?”
কথাটা বলে সজল দম ফেলারও সময় পেলনা! সঙ্গে সঙ্গেই তার গালে ঠাস করে এক চড় পড়ল! পূর্বের তুলনায় আরও অধিক হিংস্র হয়ে উঠল রূপল! নীহারিকার অপমান তার সহ্য হলোনা। কেন হলোনা তার কোনো উত্তর নেই তার কাছে! চোয়াল উঁচিয়ে সে হতবাক সজলকে বলল,
“তোকে ছোটোভাই বলে স্বীকার করতেও এখন আমার লজ্জা করছে! তুই আমার ভাই হয়ে কী-না গাঁয়ের রঙ নিয়ে একটা মেয়েকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলি? আমরা তোকে এই শিক্ষা দিয়েছিলাম? ফারদার তুই আমার সামনে পরবিনা! নয়ত খবর আছে তোর।”
সজলকে হুমকি দিয়ে রূপল ছাদ থেকে প্রস্থান নিলো। হতভম্ব হয়ে সজল রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। হঠকারী গলায় বলল,
“ঐ মেয়ের প্রতি এত টান ভাইয়ার? তাকে বেড কমেন্টস করাতে তার ছোটো ভাইয়ের গাঁয়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করলনা?”
______________________________________
অতিরিক্ত ঝাল খেতে খেতে নীহারিকার চোখ থেকে টলটলিয়ে পানি ঝরছিল! তবুও ফুচকা খাওয়া বন্ধ করছেনা সে। এছাড়াও তো আর কোনো উপায় নেই তার হাতে! কারণ, তার সামনেই হিংস্র রূপ নিয়ে বসে আছে রূপল! দশ প্লেট থেকে আরও পাঁচ প্লেট ফুচকা খাওয়া বাকী আছে তার। কিন্তু তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছেনা এত ঝালযুক্ত ফুচকাগুলো খাওয়ার। রীতিমত হাঁপিয়ে উঠছিল সে। গাঁ থেকেও ঘাম ঝরছিল। এসব দেখে যেন রূপল পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিল! তার মনস্কামনা পূর্ণ হচ্ছিল। মোটামুটি ভাবে চলে এলো সে। তুড়ি মেরে সে নীহারিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। গলা খাঁকিয়ে বলল,
“কী মিস নীহারিকা? আরও কয়েক প্লেট অর্ডার করব না-কী? আপনার জন্য আজ আমার জেব খালি করতেও কোনো অসুবিধা নেই!”
চোখে জল এবং মুখে ফুচকা নিয়ে নীহারিকা মাথা দুলিয়ে না বুঝালো। দেঁতো হাসল রূপল। ভ্রু উঁচিয়ে নীহারিকার দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“কেমন লাগছে আমার শাস্তি? টেন আউট অফ টেন?”
“একদম ঝাক্কাস! ফার্স্ট ক্লাস! টেন আউট অফ টুয়েন্টি।”
“তবুও নত হবেন না আপনি?”
“নাহ্! কারণ আমি চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করতে পছন্দ করি!”
রেগে গেল রূপল। দাঁতে দাঁত চেপে সে নীহারিকার দিকে এগিয়ে এলো। উগ্র মেজাজ নিয়ে বলল,
“এটা কোনো চ্যালেঞ্জ নয় ওকে? এটা হলো আপনার মিথ্যে বলার শাস্তি! আমাকে হেনস্তা করার শাস্তি।”
“ফুচকা খাওয়া মেয়েদের জন্য কখনও শাস্তি হতে পারেনা! বরং এটা হলো আমাদের জন্য আরাম।”
পুনরায় ব্যগ্র হাসল রূপল। আগ্রাসী দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। ডানপিটে গলায় বলল,
“আরামটাই পরে বেরাম হয়ে বের হবে! দেখুন না বাড়িতে যাওয়ার পর ঠিক কী কী হাল হয় আপনার। রূপল কী চিজ তা বাড়ি যাওয়ার পর বুঝবেন।”
#চলবে…?
#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩৫
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আরামটাই পরে বেরাম হয়ে বের হবে! দেখুন না বাড়িতে যাওয়ার পর ঠিক কী কী হাল হয় আপনার। রূপল কী চিজ তা বাড়ি যাওয়ার পর বুঝবেন।”
রূপলের বিদ্বেষমূলক কথায় কান দিলোনা নীহারিকা। সে তার চ্যালেঞ্জ পুরো করতে তৎপর। এই চ্যালেঞ্জই যে তার সাজা হয়ে দাঁড়াবে এই বিষয়ে যদিও নীহারিকা পূর্ব অবগত তবে এই মুহূর্তে নিজের জেদ এবং দম্ভ বজায় রাখার জন্য সে এরচেয়েও ভয়ঙ্ক চ্যালেঞ্জ নিতে রাজি ছিল! শরীরের অবস্থা বেগতিক খারাপের দিকে অগ্রসর হলেও নীহারিকা ক্রমান্বয়ে আট প্লেট ফুচকা শেষ করল। এই পর্যায়ে এসে তার বমি বমি ভাব পেতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল যেন ভেতর থেকে সব উল্টে চলে আসবে। অতিরিক্ত ঝালের প্রভাবে চ্যালেঞ্জটা পুরো করতে তার বড্ড বেগ পেতে হচ্ছে! তার খাওয়া প্রতিদিনের নরমাল ফুচকা হলে দশ প্লেট ফুচকা খাওয়া তার জন্যে এক চুটকির ব্যাপার ছিল। জেনে বুঝেই রূপল এই ডেয়ারিং চ্যালেঞ্জটা দিয়েছে! ইচ্ছে করেই নীহারিকার দুর্বল জায়গাতে আঘাত করেছে।
অশ্রুভেজা রক্তিম দু’চোখে নীহারিকা রূপলের দিকে তাকালো। ভ্রু যুগল উঁচিয়ে রূপল মিচকে হেসে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের ইশারায় বলল,
“কী? ভেতরে যাচ্ছেনা আর? হেল্প করব?”
রূপলের মুখের দিকে তাকিয়ে এমনকি তার বিদ্রুপাত্নক ইশারায় নীহারিকা চেয়েও রূপলের কাছে হার মানতে পারলনা! বরং পূর্বের তুলনায় অপ্রত্যুল জেদ চেপে বসল তার সর্বাঙ্গে। শরীরের বেহাল দশা নিয়েই সে গপাগপ ফুচকাগুলো মুখে ঢুকাতে লাগল। চোখ থেকে অঝরে জল এবং গাঁ থেকে অনবরত ঘাম ঝরলেও নীহারিকা দশ প্লেট ফুচকা খেয়ে তার চ্যালেঞ্জ পুরো করল!
ব্যাপারটায় রীতিমত অবাক হয়ে গেল রূপল! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল। এই অসম্ভব কাজ তো নীহারিকার পক্ষে সম্ভব করার এক পার্সেন্ট চান্সও ছিলনা! কারণ, ঝাল তো নীহারিকা একদমই খেতে পারেনা। তার প্রেডিকশন অনুযায়ী দুই প্লেট ফুচকা খাওয়াও নীহারিকার জন্য কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়াবে। সেই জায়গায় দশ দশ প্লেট ফুচকা? হাউ ইট’স পসিবল? রূপলের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা অস্বস্তিকর অবস্থাতেও ফিক করে হেসে দিলো! নীহারিকার হাসি দেখে রাগে গাঁ পিত্তি জ্বলে গেল রূপলের! সঙ্গে সঙ্গেই সে চেয়ার ঠেলে জায়গা থেকে ওঠে দাড়ালো। মুহূর্তেই ফুচকা আনা ছেলেটিকে ডেকে আনল। আড়ালে নিয়ে গেল তাকে। রাগী গলায় দাঁতে দাঁত চেপে শুধালো,
“ঝাল দিসনি ফুচকাতে? মেয়েটা ফুচকাগুলো শেষ করল কীভাবে?”
ছেলেটি ভীতু গলায় বলল,
“দিয়েছিলাম তো ভাই। আপনি যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই দিয়েছিলাম। তবে আমার মনে হচ্ছে ফুচকাগুলো মেয়েটা এখন কোনো রকম শেষ করলেও পরে হজম করতে তার অসুবিধা হবে!”
ছেলেটিকে যেতে দিলো রূপল। ভেতরে ভেতরে খুশিতে ফেটে পড়ল সে! তবে বাইরে তা প্রকাশ করলনা। পুনরায় ভাবসাব নিয়ে সে নীহারিকার দিকে এগিয়ে গেল। একই জায়গায় শক্ত হয়ে বসে আছে নীহারিকা। ভেতরে ভেতরে তার অবস্থা জটিল হলেও উপরে উপরে সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। নীহারিকার ট্রিক বুঝতে পেরে রূপল ফিচেল হাসল। চেয়ার টেনে নীহারিকার সামনে বসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বোতলের ছিপি খুলে ভাবশূণ্যভাবে সে নীহারিকার দিকে বোতলটি এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক গলায় বলল,
“এই নিন। পানি খান।”
জায়গা থেকে খানিক নড়েচড়ে বসল নীহারিকা। ভেতরটা তার ফেটে গেলেও সে গলা ঝাকিয়ে বলল,
“নো থ্যাংকস।”
নীহারিকাকে উস্কে দিতে বিন্দুমাত্র ক্ষান্ত হলোনা রূপল! পকেট থেকে একটি টিস্যু বের করে সে নীহারিকার দিকে এগিয়ে দিলো। বেখেয়ালি গলায় বলল,
“টেইক ইট। ঘামটা মুছে নিন।”
রূপলকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করল নীহারিকা। গাঁয়ের ওড়না দ্বারা মুখে জমে থাকা ঘামগুলো মুছে নিলো সে! মুখটা অন্যপাশে ঘুরিয়ে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“লাগবেনা।”
চেয়ারে আরও পাকাপোক্তভাবে হেলান দিয়ে বসল রূপল! সামনের অগোছালো চুলগুলো ঠিক করল সে। নীহারিকার ধরাশায়ী অবস্থা দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। মনে ক্ষোভ এবং আনন্দ নিয়ে রূপল দ্রুত গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“তো বলুন? মাঝরাতে আমাকে ঐভাবে হেনস্তা করার কারণ কী? আমি আপনার কোন ক্ষতিটা করেছিলাম?”
বিব্রত হয়ে উঠল নীহারিকা! একই জায়গায় বসে থাকতে পারলনা আর। চট করে সে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। অস্বস্তিকর গলায় রূপলকে বলল,
“আমি বাড়ি যাব।”
“উঁহু! কোথাও যাওয়া হচ্ছেনা আপনার। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।”
রূপলের দিকে ঘুরে দাড়ালো নীহারিকা। প্রখর রাগী দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো সে। খরতর গলায় বলল,
“আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। আমি বলেছি বাড়ি যাব মানে বাড়িই যাব!”
রূপলকে রাগিয়ে দিয়ে নীহারিকা জায়গা থেকে প্রস্থান নিতেই নীহারিকার সেলফোনটি বেজে উঠল। পার্স থেকে ফোনটি হাতে নিয়ে নীহারিকা স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়েই কলটি তুলে ফেলল। দ্রুত গলায় হ্যালো বলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নীহারিকা “কে আপনি” বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল! তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পরল! শকড হয়ে রূপল একই জায়গায় বসে রইল। ইদানিং নীহারিকার আচরণ তার কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। রহস্যময়ী লাগছে নীহারিকাকে। কী চলছে নীহারিকার ভেতরে তা জানার আগ্রহ তাকে ক্রমাগত গ্রাস করে তুলছিল। ফোনের ঐ পাড়ে কে ছিল তা জানার আগ্রহ রূপলকে উৎকণ্ঠিত করে তুলল।
নীহারিকা সেন্সলেস হয়ে পড়ে যেতেই আশপাশ থেকে মানুষ এসে ভীড় জমিয়ে ফেলল। সবার মধ্যে আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। ঘোর থেকে বের হয়ে এসে রূপল দৌড়ে এলো নীহারিকার কাছে। নীহারিকাকে উঠিয়ে তার হাঁটুর উপর রাখল। পেরেশান হয়ে পানি ছিটাতে লাগল নীহারিকার চোখেমুখে। নীহারিকার গাল দুটিতে চাপড়ও মারতে লাগল। মিনিট কয়েকের মধ্যে নীহারিকার জ্ঞান ফিরে এলো। তবে চোখ খুলেই সে পেটের অস্বস্তি নিয়ে বমি করতে লাগল! মুহূর্তেই সে রূপলকে বমি করে ভাসিয়ে দিলো। ব্যাপারটায় রূপল বিন্দুমাত্র নাক সিটকালো না! বরং নীহারিকাকে স্বস্তি দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। নীহারিকার পিঠে হাত বুলাতে লাগল। আরাম পেয়ে নীহারিকা ভেতরের সব উগলে দিতে লাগল।
এই ঝামেলার মধ্যেই একজন লোক ভীড় ঠেলে ফুচকার স্টল থেকে যাওয়ার সময় হঠাৎ রূপলের গাঁয়ে ধাক্কা মেরে গেল! বিরক্ত হয়ে রূপল লোকটির যাওয়ার পথে তাকালো। চোয়াল উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল,
“এই কে?”
পিছু ফিরে তাকালো না লোকটি। দ্রুত পায়ে হেটে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই যেন লোকটি বাঁচে। সেদিকে আর মন দিলোনা রূপল। নীহারিকাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বমি থামিয়ে নীহারিকা শান্ত হতেই রূপল ঘটনার আকস্মিকতায় নীহারিকাকে কোলে তুলে নিলো! আধমরা শরীর নিয়ে নীহারিকা অর্ধখোলা দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। শরীরটা তার অসাড় হয়ে আসছে। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসছে। দুনিয়াটা অন্ধকার মনে হচ্ছে। সে তার ভেতরের অবস্থাটা বুঝাতে পারছেনা রূপলকে। মরি মরি অবস্থা তার! এই মুহূর্তে রূপলকে বেশ আপন মনে হতে লাগল নীহারিকার। শরীরের শক্তি হারিয়ে মিনমিনে গলায় সে রূপলকে লক্ষ্য করে বলল,
“আমি আর পারছিনা মিস্টার রূপল! আমি সুস্থ হতে চাই। প্লিজ হেল্প মি।”
নীহারিকার এই রোগা অবস্থা দেখে রূপল নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগল। অপরাধবোধ থেকে সে নীহারিকাকে কোলে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল! ভাবুক গলায় সে প্রত্যত্তুরে নীহারিকাকে বলল,
“ডোন্ট ওরি নীহারিকা। আপনার কিছু হবেনা। খুব জলদি সুস্থ হয়ে উঠবেন আপনি। প্লিজ ট্রাস্ট মি।”
“আমাকে বাড়ি নিয়ে চলুন প্লিজ।”
______________________________________
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল নীহারিকার। ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখে সে লাফিয়ে উঠল ঘুম থেকে। হাত দ্বারা কান দুটি চেপে ধরে সে চোখ দুটি বুজে ভয়ে ফোঁপাতে লাগল। ড্রিম লাইট জ্বলছিল রুমে। লাইটের মিটমিটে আলোটাও যেন তার কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হলো। ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার মনে হচ্ছিল। গলা থেকে কোনো শব্দই বের হচ্ছিল না তার। কোনো মানুষের ছায়া যেন তার চোখে ভাসতে লাগল। মানুষটি তার আশেপাশে হাঁটছিল। থেকে থেকে কিছু বিভৎস আওয়াজ তার কানে ভেসে আসতে লাগল। সব মিলিয়ে মোটামুটি ভয়ঙ্কর একটি পরিবেশ বিরাজ করছিল তার আশেপাশে। ভয়ে আঁতকে উঠল নীহারিকা। তাৎক্ষণিক তার সেলফোনটিও বেজে উঠল। একটি আননোন নাম্বার থেকে কল। ক্রমাগত কলটি বেজেই চলছে। বিরক্ত হয়ে নীহারিকা ফোনটি হাতে তুলল। কাঁপা কাঁপা হাতে সে কলটি তুলতেই একটি মেয়েলি গলার ভয়ঙ্কর আওয়াজ তার দু’কানে বিচ্ছিরি ভাবে বাজতে লাগল!
আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল নীহারিকা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চ্যাচিয়ে বলল,
“আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি সবিতা আপু? তুমি কেন এমন করছে আমার সাথে? কেন আমাকে এভাবে ভয় দেখাচ্ছ?”
#চলবে….?
#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩৬
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি সবিতা আপু? তুমি কেন এমন করছে আমার সাথে? কেন আমাকে এভাবে ভয় দেখাচ্ছ?”
সঙ্গে সঙ্গেই ঐ পাশ থেকে কলটি কেটে দেওয়া হলো! যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। তবুও টের পেলনা নীহারিকা। ভয়, আশঙ্কা এবং কৌতূহল থেকে সে বেখেয়ালী হয়ে রইল। বিরামহীনভাবে কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে ফোনটি বিছানার উপর ছুঁড়ে মারল। কান্নারত অবস্থায় সে তার কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো খাঁমচে ধরে সারাময় পায়চারি করতে লাগল। প্রখর অস্থিরতা নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“আমার কী উচিৎ একবার সবিতা আপুর বাড়িতে যাওয়ার? ফোনের ঐ পাশের মহিলাটি কী সত্যিই সবিতা আপু ছিলেন? না-কী পুরোটাই আমার মনের ভুল ছিল?”
মিনিট কয়েক নীহারিকা তার এলোমেলো ভাবনা চিন্তা গুলোর সাথে লড়াই করল। শেষ মুহূর্তে এসে একটি মোক্ষম সিদ্ধান্তে পৌঁছে সে রূপলের নাম্বারে কল করতে বাধ্য হলো! সবেমাত্র চোখ লেগে এসেছিল রূপলের। কিছুক্ষণ আগেও রূপল বিছানায় পড়ে ছটফট ছটফট করেছিল! শাওয়ার নেওয়ার পর শরীরে কিছুটা শান্তি পেয়েছিল। অধিকাংশ রাত নির্ঘুম কাটিয়ে তার মাঝরাতেই ঘুমানোর অভ্যাস। এরমধ্যেই আবার নীহারিকার কল। খানিকটা বিরক্তবোধ হয়েই রূপল পিটপিটে চোখে একবার স্ক্রীনের দিকে তাকালো। এতরাতে কে কল করল সেদিকে তাকালোনা সে! বরং ঘুম জড়ানো গলায় কলটি তুলে বলল,
“হ্যালো।”
দ্রুত গলায় নীহারিকা প্রশ্ন ছুড়ল,
“সবিতা আপু কী আপনাদের বাসায়?”
নীহারিকার গলার স্বর ধরতে পারল রূপল। ঘুমের ঘোরেই সে প্রত্যত্তুরে নীহারিকাকে বলল,
“উঁহু। বাড়ি ফিরে গেছে।”
“কখন গেল?”
“দশটা কী এগারোটা নাগাদ।”
“হৃদি কোথায়?”
“সবিতার সাথেই। কেন?”
“আমার সাথে একটু সবিতা আপুর বাড়িতে যেতে পারবেন?”
“উঁহু। ঘুমুচ্ছি আমি!”
কলটি কানে রেখেই রূপল গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল! একটি বারের জন্যেও জিজ্ঞেস করল না নীহারিকা কেন এত রাতে তাকে কল করল বা সবিতাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য কেন তাকে জিজ্ঞাসা করল! নীহারিকা কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে বিরক্ত হয়ে কলটি কেটে দিলো। হতাশ হয়ে সে ধপ করে বিছানার উপর বসল। রূপলের বেখেয়ালি আচরণে সে বেজায় কষ্ট পেল। মনে জেদ এনে অনড় গলায় বলল,
“ঐ কেয়ারলেস লোকটার আশায় বসে থাকব নাকী আমি? আমি এখন একাই সবিতা আপুর বাড়ি যাব! মনে সন্দেহ নিয়ে চুপচাপ বসে থাকার পাত্রী নই আমি।”
রাত তখন সাড়ে তিনটা পেরিয়ে। বুকে বল নিয়ে নীহারিকা একাই ছুটল সবিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে! বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নীহারিকা বাড়ির ভেতর কারো একটা ছায়া দেখতে পেয়েছিল! ছায়াটি রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল৷ হয়ত তার মা পানি খাওয়ার জন্য রান্নাঘরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। সেই ভেবে নীহারিকা বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামালো না৷ তবে এই বিষয়ে নীহারিকা নিশ্চিন্ত ছিল যে তার মা তাকে দেখেনি!
ঘন অন্ধকারে ঢাকা এই মাঝরাতে গাড়ি ঘোড়ার কোনো সন্ধান পেলনা নীহারিকা। চারিদিকে নীরবতা খাঁ খাঁ করছে। রাতের এই নিকষ কালো অন্ধকারটা অনায়াসে মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! বাড়ি থেকে নীহারিকা অদম্য সাহস নিয়ে বের হলেও বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর বড্ড ভয় পাচ্ছে! ভাগ্যের ফেরে একটা গাড়ি পেয়ে গেলে হয়ত এই ভয়টা তার কাজ করত না! কিন্তু এই মুহূর্তে তো গাড়ি পাওয়া মুশকিল। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই অনেকটা অসম্ভব কাজ। পায়ে হেঁটেও সবিতাদের বাড়িতে যাওয়া তার পক্ষে দুঃসাধ্য কাজ। কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিলনা নীহারিকা।
দুমনায় জর্জরিত হয়ে নীহারিকা অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো বাড়িতে ফিরে যাওয়ার! চাইলেই সবকিছু সম্ভব নয়। কিছু সীমাবদ্ধতাও থাকে। ঝুঁকি নিয়ে এই মাঝরাতে বের না হয়ে বরং সকালে বের হলেও এতে ক্ষতি কিছু হবেনা। বিষণ্নতায় ভুগে নীহারিকা বাড়ির মেইন গেইটের দিকে মোড় নিতেই হঠাৎ একটি হর্ণের আওয়াজ ভেসে এলো নীহারিকা কানে। অন্তরআত্তা কেঁপে উঠল নীহারিকার। চট করে সে হাঁটা থামিয়ে পিছু ফিরে তাকালো।অমনি অবিশ্বাস্যভাবে সে বাইক নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা রূপলকে দেখতে পেল!
রগচটা ভাব নিয়ে রূপল নীহারিকার কাছে এসে বাইকটি থামালো। বাইকের চাবিটা হাতে নিয়ে সে শার্টের কলারটা পেছনের দিকে ঝেড়ে গরম দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী পেয়েছেনটা কী আপনি আমাকে? যখন মনে হচ্ছে তখনই আমাকে কল করে বিরক্ত করছেন! সময় অসময় বুঝছেন না। এখানে ওখানে নিয়ে যেতে বলছেন কারণটা কী?”
রূপলকে দেখে যতটা না খুশি হয়েছে নীহারিকা এরচেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছে রূপলের ইতরামিপূর্ণ কথাবার্তায়। অবিলম্বেই মাথা নুইয়ে নিলো নীহারিকা৷ নিচু গলায় বলল,
“সরি।”
“সরি বললেই কী সব সলভ হয়ে গেল? আমার ঘুমের যে এত বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল? এর ক্ষতিপূরণ কে দিবে? কীভাবে দিবেন?”
মনমরা ভাব থেকে কিছুটা তেতে উঠল নীহারিকা। রূপলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে! খরখরে গলায় বলল,
“আমিতো আপনাকে ফোর্স করিনি আসার জন্য। এলেন কেন হ্যাঁ? এসে আবার আমার সাথে মেজাজ দেখানো হচ্ছে!”
নীহারিকার রেগে ওঠা দেখে রূপলের রাগ আরও তিনগুন বেড়ে গেল! মুখমণ্ডলে তার তুখোড় রাগের ছাপ। আঙুল উঁচিয়ে সে নীহারিকার দিকে তাকালো। ঝাঁজালো গলায় বলল,
“একদম উঁচু গলায় কথা বলবেন না আমার সাথে! মাথা নষ্ট হয়ে গেলে আমি কিন্তু ছাড় দিবনা আপনাকে! কখন কী থেকে কী করে ফেলব নিজের উপরও কন্ট্রোল থাকবেনা তখন!”
রূপলের হুমকি ধমকি এবং রাগকে পাত্তা দিলোনা নীহারিকা! ঘুরে এসে সে রূপলের বাইকের পেছনে বসল। ভাবশূণ্য হয়ে বেশ অধিকার খাঁটিয়ে রূপলকে বলল,
“সবিতা আপুর বাসায় চলুন।”
নীহারিকার স্বাভাবিক আচরণে অবাক হলো রূপল! নীহারিকা যে তার রাগ এবং তাকেও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করল সে বিষয়েও শতভাগ নিশ্চিত সে! রাগে বোম হয়ে হুট করে বাইক থেকে নেমে পড়ল রূপল। নীহারিকার দিকে তেড়ে এসে চোয়াল উঁচিয়ে বলল,
“নামুন আমার বাইক থেকে! ইনডিরেক্টলি আপনি আমাকে ইনসাল্ট করেছেন!”
রূপ বদলে নিলো নীহারিকা। চোখ উঠিয়ে রূপলের দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। একরোখা গলায় বলল,
“আর আপনি যে আমাকে ডিরেক্টলি ইনসাল্ট করেছেন এবং এখনও করছেন তার বেলায়? আমিতো এতে কোনো রাগ করছিনা বা রাগ দেখাচ্ছিও না। কারণ, আমি জানি আপনি অনেক রাগী! তাই পাল্টা রাগ না দেখিয়ে বরং আপনার রাগকে শান্ত করার চেষ্টা করছি।”
রাগ কিঞ্চিৎ মিইয়ে এলো রূপলের! নীহারিকার মন ভুলানো কথায় নরম হয়ে এলো সে। শিথিল দৃষ্টিতে এক পলক তাকালো নীহারিকার দিকে। বিড়বিড় করে বলল,
“ইশ! কত বুঝে মেয়েটা!”
নীহারিকার কথায় রূপল তার আচার-আচরণে সন্তুষ্টতা বুঝালো না! বরং বেশ ভাব সাব নিয়ে বাইকে ওঠে বসল। বাইক ঘুরিয়ে সবিতাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। চলতি পথে হঠাৎ তার মাথায় এলো এত রাতে তারা কেন সবিতাদের বাড়িতে যাচ্ছে? ঝগড়ার চোটে মনেই ছিলনা মূল কারণটা জিজ্ঞেস করতে। আগ্রহী হয়েছে রূপল উত্তেজিত গলায় নীহারিকাকে শুধালো,
“ওয়েট ওয়েট। এত রাতে আমরা সবিতার বাড়িতে কেন যাচ্ছি?”
“মনের সন্দেহ থেকে।”
“মানে? কীসের সন্দেহ?”
“আমার মনে হচ্ছে ফোনের ঐ পাশের মহিলাটি সবিতা আপু ছিল!”
“ধ্যাত। বুঝিয়ে বলুন। আপনার কথার আগা মাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
“একটু আগে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছিল।”
“হ্যাঁ তো? সবিতার নাম্বার তো আপনার কাছে অপরিচিত নয়।”
রূপলের কথায় কান দিলোনা নীহারিকা। বরং সে তার নিজের খেয়ালে ব্যস্ত থেকে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“ভয়ঙ্কভাবে চ্যাচাচ্ছিল সবিতা আপু! পুরোটাই আমার কাছে নাটক মনে হয়েছিল! আমাকে ভয় দেখানোর নাটক!”
তৎক্ষনাৎ বাইকটা থামিয়ে দিলো রূপল। ঘাড় ঘুরিয়ে নীহারিকার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। রাগে রি রি করে বলল,
“মাঝরাতে মজা করার জন্য আপনি আমাকে ডেকে এনেছেন? এখন তো মনে হচ্ছে আপনি শুধু নিজের সাথে না ইভেন আমার সাথেও নাটক করছেন! এসবের মানে কী ইউ স্টুপিট গার্ল?”
রূপলের উগ্র ব্যবহারে আঘাত না পেয়ে নীহারিকা বরং ধৈর্য্য সমেত অবিচল গলায় বলল,
“বিলিভ মি আমি আপনার সাথে মজা করছিনা। আমার সাথে যা যা ঘটছে তাই বলছি। সত্যিই ঐ মহিলার ভয়েসটি সবিতা আপুর ছিল। তাই আমি কনফার্ম হওয়ার জন্য সবিতা আপুদের বাড়িতে যাচ্ছি।”
“দেখি নামুন বাইক থেকে। আপনাকে প্রথম থেকে বিশ্বাস করে আসাটাই আমার ভুল ছিল! হয় আপনার মানসিক সমস্যা আছে নয় আপনি কল্পনার জগতে বাস করছেন!”
ঘাবড়ে গেল নীহারিকা। অমনি উপায় বুদ্ধি খুঁজে না পেয়ে সে রূপলের হাত দুটি চেপে ধরতে বাধ্য হলো। অসহায় গলায় বলল,
“প্লিজ মিস্টার রূপল। মাঝপথে আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন না। অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে হেল্প চেয়েছিলাম আমি। প্লিজ আমাকে নিরাশ করবেন না।”
নীহারিকার অসহায়ত্বে ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্যভাবেই রূপল তার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হলো! নীহারিকাকে সাহায্য করার জন্য উদ্ধত হলো। তবে রাগ একরত্তিও কমল না তার! তুখোর জেদ নিয়ে সে পুনরায় বাইকে ওঠে বসল। বাইক স্টার্ট করে দাঁতে দাঁত চেপে নীহারিকাকে শুনিয়ে বলল,
“যতসব পাগলনীর পাল্লায় পরেছি আমি! রিডিকিউলাস!”
নীহারিকা ভেতরে ভেতরে বেশ ফুলছিল! তবে প্রয়োজনের স্বার্থে চুপ হয়ে রইল! জিম খিঁচে সব অপমান সহ্য করছিল। সময় সুযোগে সব অপমান উসুল করবে বলে আশায় রইল!
____________________________________
ঢুলুঢুলু চোখে সবিতা নীহারিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অতিরিক্ত ঘুমের তাড়নায় একই জায়গায় বসে থাকতে পারছেনা সে। তবে নীহারিকার নজর সবিতার দিকে নয়। বরং সবিতার রুমের আনাচে কানাচে। বাড়ির বাইরে রূপল বাইক নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এতরাতে সবিতার বেডরুমে যাওয়াটা তার কাছে শোভনীয় মনে হলোনা তাই। এছাড়াও নীহারিকার কাজে রূপল বিরক্ত! সব মিলিয়ে তার মন মেজাজ বিগড়ে আছে।
ঘুমের রেশ কিঞ্চিৎ কাটিয়ে উঠল সবিতা। নীহারিকার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বড়ো একটি হামি তুলে বলল,
“কী ব্যাপার নীহারিকা? তুমি হঠাৎ এই মাঝরাতে আমার বাড়িতে?”
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল নীহারিকা। জোরপূর্বক হেসে সবিতাকে বলল,
“না মানে আপু। তোমার গলার আওয়াজটা হঠাৎ চেঞ্জ হয়ে গেল কীভাবে? রাতারাতি ঠাণ্ডা লেগে গেল নাকী তোমার?”
নির্বোধ গলায় সবিতা বলল,
“মানে? আমার গলা তো এমনই। কিছুটা ভাঙা ভাঙা। তোমার প্রশ্নের মানে আমি বুঝলাম না।”
“আচ্ছা বাদ দাও। তুমি কী নতুন সিম নিয়েছ?”
“না তো! কেন?”
“হৃদি কোথায়?”
“পাশের রুমেই ঘুমুচ্ছে।”
“তোমরা একসাথে ঘুমাও না?”
“ঘুমাই। তবে আজ হৃদি হয়ত খেলতে খেলতে ঐ রুমে চলে গেছে। ঘুমে ছিলাম তো আমি। তাই টের পাইনি।”
জায়গা থেকে ওঠে দাড়ালো নীহারিকা। পাশের রুমে গিয়ে দেখল হৃদি ঘুমুচ্ছে! নীহারিকা সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবিতার পুরো বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করল। কথায় কথায় সবিতার ফোনটাও চেক করে দেখল। তবে ডুয়েল সিমের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পেলনা সে! সবিতার কথাবার্তায়ও কোনো সন্দেহের আঁচ পেলনা! তবে সবটাই নীহারিকার মনের ভুল ছিল? ফোনের ঐপাশে সবিতা নয় বরং অন্য কেউ ছিল?
নীহারিকা পুরোপুরি হতাশ হয়ে সবিতার বাড়ি থেকে বিদায় নিলো। এই মাঝরাতে হঠাৎ সবিতার বাড়িতে আসার কারণটা সবিতা তেমন তলিয়ে দেখলনা! এই বিষয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিলনা!
#চলবে…?